৪. সুযোগের অপেক্ষায়

চতুর্থ খণ্ড

-রূপকথার গল্পকার

“সুযোগের অপেক্ষায় আছেন আপনি, তাই না?” সোফা থেকে জিজ্ঞেস করলো হিতোমি। “নাকি এই মুহূর্তে কাউকে হত্যা করা বা এইখানে নিয়ে আসাটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে?”

মিকি সবকিছু গোছাচ্ছে। এই বাড়িটায় আসার সময় খুব বেশি জিনিস অবশ্য সাথে আনেনি। তাই গোছানোর মতনও সেরকম কিছু নেই। কিছু কাপড়চোপড় আর বই। তবে সে ব্যস্ত অন্য একটা কাজে।

“আমি বাইরে থেকে ঘুরে আসতে চাইলে গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন আপনি। তখন নিশ্চয়ই কেউ দেখেছে, হিতোমি বললো। “নতুন গাড়ি কিনলেই দায় এড়াতে পারবেন না।”

মৃদু হাসছে হিতোমি। তার সরু চোখ জোড়া আরো সরু দেখায় হাসলে। হাত-পা বিহীন মেয়েটাকে পুতুলের মত লাগছে এখন।

তাকে সেখানে রেখে তলকুঠুরিতে নেমে এলো মিকি। এই ঘরটা বাদে বাকি ঘরগুলোর ব্যবস্থা করে ফেলেছে সে। ভেতরে পা দিতেই ইউকির গানের শব্দ কান এলো। সেই ইংরেজি গানটাই গাচ্ছে সে। ঘরের অন্ধকার কোণ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বেদনার সুরটা। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ইটের দেয়ালে।

ঘরের কোনায় রাখা ইটগুলো সিঁড়ির গোড়ায় নিয়ে এলো মিকি। সবগুলো ইট সরাতে বেশ কসরত করতে হলো।

ইউকির গান বন্ধ হয়ে গেলো হঠাৎ।

“কি করবেন?” অন্ধকার থেকেই জিজ্ঞেস করলো সে। এরপরেই গুঙিয়ে উঠলো। “আমার গোড়ালিতে একটা চোখা পাথরের খোঁচা লাগছে!”

“সরি,” মাফ চাওয়ার ভঙ্গিতে বললো শিনিচি। তাদের বিশাল দেহটা নড়ে ওঠার শব্দ কানে এলো মিকির।

বাড়ি ছেড়ে দেয়ার কথা বললো সে।

“ওহ আচ্ছা, শিনিচি বললো মাথা নেড়ে। “তাহলে বিদায়ের সময় এসে গেছে?”

“মানে?” পাশ থেকে ইউকি জিজ্ঞেস করলো।

“তোমাকে পরে বুঝিয়ে বলবো।”

তলকুঠুরি থেকে বেরিয়ে দোতলার স্টাডিতে চলে এলো মিকি। হিতোমি এখানেই আছে। তাকে দেখেই মন খারাপ হয়ে গেল মেয়েটার।

“আমাকে যেহেতু সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন না, নিশ্চয়ই মেরে ফেলবেন বা এমন কোথাও রেখে যাবেন, যেখানে কেউ কোনদিন আর আমার খোঁজ পাবেন না। শেষবারের মতন সূর্যটা দেখতে চাই।”

মিকি তাকে উঠিয়ে নিল দু’হাতে। মেয়েটার ওজন কম হওয়াতে এই কাজে কোন কষ্টই হয় না তার। বাতাসে দুলছে লম্বা চুলগুলো।

“আপনি ধরা পড়লে আদালতে আমি বলবো যে কখনো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেন নি।

তাকে জানালার পাশে শুইয়ে দিল মিকি।

.

শিওজাকিকে হিতমির ছবিটা দেখানোর পর থেকে ভয়ে ভয়ে কাটতে লাগলো আমার সময়। যে কোন মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে সে, ভাবি আমি।

ক্যাফের রান্নাঘরে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় এরকম জিনিসের অভাব নেই। নানা আকৃতির পাঁচটা ছুরি ঝুলছে একপাশে। এগুলো ইচ্ছে করলেই সরিয়ে ফেলা যাবে। কিন্তু নিতে ইচ্ছে করছে না আমার। কোটের পকেটে সবসময় একটা ছুরি লুকিয়ে রাখা বাড়তি ঝামেলা। তাছাড়া সে যদি আমাকে অতর্কিতে পেছন থেকে আক্রমণ করে, তখন পকেটের ছুরি দিয়ে কিছু করতে পারবে বলে মনে হয় না।

শেষমেশ তাই কাপবোর্ড থেকে ছোট্ট ভাঁজ করা যায় এরকম একটা ছুরি নিলাম। জানিনা এটা আদৌ কোন কাজে আসবে কিনা, তবুও মনকে শান্ত রাখার জন্যে এই সতর্কতাটুকু অবলম্বন করতেই হবে।

সাওরি আর তার মামার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি লিখেছি। আমার যদি কিছু হয়, তখন নিশ্চয়ই জিনিসপত্র খুঁজে দেখবে তারা। তখন চিঠি পড়ে জানতে পারবে কেন কায়েদিতে এসেছি আমি। হঠাৎ করে উধাওই বা হলাম কেন।

আমি উধাও হয়ে গেলে পুলিশের লোকদের কাজে নামতেই হবে। শিওজাকির ব্যাপারে চিঠিতে বিস্তারিত লিখেছি। সে যদি আমাকে আক্রমণ করে, তাহলে জিত আমারই হবে।

প্রতিদিন সকালে ওঠার পর মনে হয় যে তখনও কি করে বেঁচে আছি আমি। বাড়িতে বা বাইরে একা থাকার সময় সামান্যতম শব্দেও চমকে উঠি। ভয়ে ভয়ে তাকাই সবদিকে। হৃৎস্পন্দন কখনো স্বাভাবিক হয়নি সেদিনের পর থেকে।

কিন্তু শিওজাকির দেখা নেই। বরং মেলানকলি গ্রোভে আসাই থামিয়ে দিয়েছে সে।

*

সবকিছুরই একটা ইতি আছে। কিন্তু এই ব্যাপারটার ইতি কিরকম হবে তা জানি না। খুব সুখকর কিছু হবার সম্ভাবনা নেই।

তিন দিন হতে চললো শিওজাকিকে হিতোমির ছবি দেখিয়েছি আমি।

আমার অনুসন্ধানের শেষ দিন এসে গেছে।

*

প্রচণ্ড ঠান্ডা পড়েছে আজকে সকাল সকাল। ঘুম থেকে উঠে মনে হলো হাত পা রীতিমত জমে বরফ হয়ে আছে। কম্বলের নিচেই গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। ভালো লাগছে এভাবে শুয়ে থাকতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার হৃত্যন্ত্রের ধুকপুকানি দ্রুত হয়ে গেল। এর আগে একদিন অনুসন্ধানের শেষদিন নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেদিনও সকালবেলা এরকম ঠান্ডা পড়েছিল। তাহলে আজকেই কি সেই দিন? হতে পারে।

কাজুয়া আর সাওরির কথা ভেবে বিছানা থেকে উঠে পড়লাম।

“আগে কখনো এপ্রিলে এত ঠান্ডা পড়তে দেখিনি,” সাওরির মামা বললেন মুখ গোমড়া করে। জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তাকে বিদায় জানিয়ে ক্যাফের দিকে রওনা হলাম আমি আর সাওরি।

আমার আর সাওরির একসাথে হাঁটার সময় যদি হঠাৎ শিওজাকি এসে উপস্থিত হয়, তখন কি করবো জানি না। বিনা কারণে ঝামেলায় পড়ে যাবে সাওরি। সেজন্যেই গত দুই দিনে তার থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব।

কিন্তু তিন দিনেও যেহেতু শিওজাকির দেখা নেই, খুব বেশি সতর্কতা আর অবলম্বন করছি না। যদিও সকালবেলার চিন্তাটা মাথায় ঘুরছে। তবে একসাথে হেঁটে যাওয়ার সময় কোন সমস্যা হবে না আশা করছি।

“বসন্তের ছুটি শেষ হয়ে যাবে শিঘ্রই,” সাওরি বললো আমার উদ্দেশ্যে। অনবরত নাক টানছে সে। কথা বললে বাষ্প বেরুচ্ছে মুখ থেকে।

“হ্যাঁ,” বললাম আমি। “নতুন শিক্ষাবর্ষ বোধহয় পরশু থেকে শুরু হবে।”

“তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার জন্যে পড়া শুরু করবে এখন থেকে?”

ওরিয়েন্টশন অনুষ্ঠানে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার। এখানকার কাজ শেষ না করে বাড়ি ফিরতে চাই না।

“আরো কয়েকটা দিন এখানে থাকবো।”

চোখে অস্বস্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালো সাওরি।

ক্যাফেতে বেশ বড় একটা হিটার আছে। নির্লজ্জের মত সেটার সবচেয়ে কাছের চেয়ারটায় বসে আবারো চোখের স্মৃতি বইটা পড়লাম।

ঘড়িতে বারোটা বেজে গেলেও কোন কাস্টমার আসেনি সকাল থেকে। দুপুরের একটু আগ দিয়ে সাওরি বেরিয়ে গেল। হিটারের কাছে বসে শিওজাকিকে নিয়ে ভাবছি এসময় অ্যাপ্রন খুলে আমার দিকে এগিয়ে এসে বলে, “একটু কিয়োকোর বাসায় যাচ্ছি। কিমুরাকে বলে দিও।”

মাথা নাড়লাম। কিমুরা এ মুহূর্তে রান্নাঘরে। সাওরি বেরিয়ে গেলে তার সাথে কথা বলতে গেলাম।

“কিন্তু আজকে তো কিছু ডেলিভারি দেয়ার কথা না,” গোঁফে তা দিয়ে বললো কিমুরা।

শিওজাকি সবসময় একটার দিকে মেলানকলি গ্রোভে আসে। কিন্তু আজকেও যখন এলো না সে, স্বস্তি আর দুশ্চিন্তা জেঁকে বসলো আমার চিত্তে। খুবই অস্থির লাগছে ভেতরে ভেতরে। সে কি করছে বা কোথায় আছে এ ব্যাপারে কিছু জানি না। হয়তো ইতিমধ্যেই পালিয়ে গেছে।

“শিওজাকিও দেখি এখন আর আসে না,” গোমড়া মুখে বললো কিমুরা। “হলোটা কি তার?” আসলেও চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে।

“ছুটিতে যাবার ব্যাপারেও তো কিছু বলেনি,” মুখে স্ট্র নিয়েই বললো সুমিদা পাশ থেকে। তার সামনের কমলার জুসের গ্লাসটায় বরফ বাদে কিছু নেই।

সাওরি যাবার এক ঘণ্টা পর উদয় হয়েছে সে। তার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যেই এসেছিল নিশ্চয়ই। যখন বললাম বাইরে গেছে, মুখটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গিয়েছিল বেচারার।

শিওজাকির পালিয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবতে লাগলাম।

যদি পালিয়েই যায়, তাহলে তার বাসায় এখন কি আছে? সেখানে গেলে কি কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে? হিতোমিকে আটকে রাখার কোন আলামত?

প্রথমে যে জিনিসটার কথা মাথায় এলো সেটা হচ্ছে কাপড় চোপড়। এর আগে ঐ বাসায় মেয়েদের কাপড় দেখেছি আমি। কিন্তু হিতোমিকে তো কাজুয়া হাত-পা বিহীন অবস্থায় একটা বস্তার ভেতরে দেখেছিল। সেক্ষেত্রে স্বাভাবিক কাপড় তার গায়ে হবার কথা না।

হয়তো আমি যেগুলো দেখেছিলা, সেগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় পড়তো সে?]।

আরেকটা ব্যাপার মাথায় এলো। শিওজাকি নিশ্চয়ই পালিয়ে যাওয়ার আগে তলকুঠুরিটার একটা ব্যবস্থা নেবে? জানালাটা প্ল্যান্টার দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। সেরকম তলকুঠুরিতে যাওয়ার রাস্তাটাও চাইলে ইট দিয়ে বুজে দিতে পারে।

আর কি আলামত থাকতে পারে সেখানে? সে-ই যে অপহরণকারী এটা প্রমাণ করার জন্যে কি কি তথ্য বের করতে হবে আমাকে?

উঠে দাঁড়ালাম। নিজের বোকামিতে নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে ভীষণ। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটাই তো ভুলে বসে আছি।

হিতোমি আইজাওয়াকে খুঁজে বের করতে হবে। কেউ যদি জানতে পারে যে বেঁচে আছে মেয়েটা, তখন সেটা শিওজাকির জন্যে বিপদ ডেকে আনবে। তাহলে এরকম পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ তার?

তাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পারে অথবা এমন এক জায়গায় রেখে যেতে পারে যেখানে কেউ তাকে কোনদিন খুঁজে পাবে। হিতামিকে যে সহজেই হত্যা করতে পারে শিওজাকি, এই ভাবনাটা জোর করে মাথা থেকে দূরে রাখলাম।

এখনই শিওজাকির বাড়িতে যেতে হবে আমাকে।

*

“আমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে আপনাকে!”

সুমিদা অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো। “কি? কোথায়?”

“চলুন প্লিজ!” অনুনয়ের স্বরে বললাম। “এখনই যেতে হবে আমাদের?”

কাউন্টারের পেছন থেকে কৌতুকপূর্ণ চোখে আমাদের দেখছে কিমুরা। “নিয়ে যাও তো,” সুমিদাকে নির্দেশ দিল সে। মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম তাকে।

সুমিদাকে একরকম ঠেলতে ঠেলতে বের করে নিয়ে এলাম ক্যাফে থেকে। বিল না মিটিয়েই বেরিয়ে এসেছে সে। তার হয়ে আমি পরে টাকা দিয়ে দিব।

বাইরে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড ঠান্ডা, কিন্তু উত্তেজনার কারণে কিছু অনুভব করতে পারছি না। ক্যাফের পার্কিং লটে রাখা সমিদার গাডিটার প্যাসেঞ্জার সিটে লাফিয়ে উঠে পড়লাম।

“আগে একটু শান্ত হয়ে বোসো,” সুমিদা বললো। “টেনে টেনে আমার জামার হাতাটাই বড় করে দিয়েছে।”

“সরি,” লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললাম। “কিন্তু তাড়া আছে আমার। দ্রুত শিওজাকির বাড়িতে চলুন।”

আবারো বিস্ময় ভর করলো সুমিদার চেহারায়। “কেন?”

“যেতে যেতে বলছি। দয়া করে ইঞ্জিন চালু করুন।”

চুপচাপ চাবি ঘুরিয়ে ইঞ্জিন চালু করে ফেললো সে। মেলানকলি গ্রোভ পেছনে ফেলে শিওজাকির নীল বাড়িটার দিকে ছুটে চললাম আমরা।

“এবার বলো। কেন যাচ্ছো ওখানে?”

হিতোমির ব্যাপারে তাকে কিছু বলবো কিনা সেটা নিয়ে দোটানায় ভুগছি। যুক্তি দিয়ে চিন্তা করলে, সুমিদাকে এসবে জড়ানোর কোন মানে হয় না। কিন্তু একেবারেই কিছু যদি না বলি, তাহলে খারাপ দেখাবে। শিওজাকি একটা মেয়েকে অপহরণ করেছে, এটা বলবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।

“হয়তো আপনি শুনে খুব অবাক হবেন।”

“আজকে তোমার চেহারা দেখে যেরকম অবাক হয়েছি, এর বেশি বিস্মিত হবে বলে মনে হয় না।”

“আমার কথা মন দিয়ে শুনুন।”

“ঠিক আছে, কিছুক্ষণ পর শান্তস্বরে বললো সুমিদা। রাস্তার দিকে চোখ তার। মনে মনে স্বস্তিবোধ করছি, সুমিদাকে নিয়ে এসে ভালো হয়েছে।

তাকে হিতোমর ব্যাপারে অসবকিছু খুলে বললাম। এরপর বললাম যে এই মুহূর্তে হয়তো মেয়েটাকে শিওজাকির বাড়ির তলকুঠুরিতে আটকে রাখা হয়েছে। এর বেশি কিছু জানালাম না। আমার বাঁ চোখের ব্যাপারে কথা বললে সেটা হয়তো সে বিশ্বাসও করবে না।

“তিন দিন আগে শিওজাকিকে হিতোমির একটা ছবি দেখাই আমি।”

ব্যাখ্যা করে বললাম যে গত তিন ধরে শিওজাকির অপেক্ষা করছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে পালিয়ে গেছে সে।

সুমিদা চুপচাপ আমার কথা শুনছে। কথা শেষ হলে ক্ষীণকণ্ঠে বললো, “তাই বলে…শিওজাকি?” চেহারা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গেছে বেচারার। “আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

“মিথ্যে বলছি না।”

“কিন্তু…”

পেঁচানো রাস্তাটা দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠছি এখন আমরা। দু’পাশেই কেবল সিডার গাছ। কাজুয়া যেখানে মারা গিয়েছিল সেই জায়গটা পার করে আসলাম।

“আমার কথা আপনার না বিশ্বাস করলেও চলবে। আমিই ভেতর যাবো নাহয়, আপনি বাইরে অপেক্ষা করবেন। শিওজাকি হয়তো এখনও ভেতরেই আছে। যদি আমি না ফিরি, তাহলে পুলিশে খবর দেবেন।” ভয় পেয়েছি ঠিকই, কিন্তু হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলিনি।

“বিপদ হতে পারে নাকি?”

“না হলেই অবাক হবো। কিন্তু আমার কাছে একটা ছুরি আছে।”

আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেল সুমিদার চেহারা।

“তবুও… তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না আমি।”

কথাগুলো শুনে কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠলো মন।

কিয়োকোর বাড়িতে যাবার রাস্তাটা পেছনে ফেলে এলাম। অবশেষে নীল রঙের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছি সামনে। ঘন মেঘের কারণে চারদিকে কেমন যেন ঘোলাটে অন্ধকার। বাড়িটা দেখার সাথে সাথে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল আমার।

“গাড়ি নিয়ে বেশি কাছে যাবার দরকার নেই,” বললাম। “সামনেই থেমে বাকিটা রাস্তা হেঁটে যাব আমরা।”

“কেন?”

“শিওজাকি যদি ভেতরে থেকে থাকে, তাহলে সতর্ক হয়ে যাবে।

ভেতরে প্রবেশ করার আগে আরেকবার বাড়ির চারদিকটা দেখে নিতে চাই আমি। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি বন্ধ করে দিল সুমিদা। আমার শরীর রীতিমত কাঁপছে এখন। চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করে নিলাম একবার।

কাজুয়া যখন হিতোমিকে বাঁচাতে এসেছিল, সে-ও নিশ্চয়ই ভয় পাচ্ছিল এরকম।

“তৈরি?” ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করলো সুমিদা। আগের চেয়েও ফ্যাকাসে লাগছে এখন তার চেহারা।

মাথা নেড়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

.

গেটের দু’পাশে আমার উচ্চতার দু’টা গেটপোস্ট। লোহার দরজাটা হা করে খোলা। মাথা নিচু করে ভেতরে ঢুকলাম আমি আর সুমিদা।

নুড়ি বেছানো পথে কিছুদূর এগোনো পর নীল দেয়াল চোখ পড়লো। আজকে কেন যেন আগের তুলনায় বড় লাগছে বাড়িটাকে। মনে হচ্ছে এক বিশাল দানো পেটভর্তি অন্ধকার নিয়ে ঘাপটি মেরে আছে। আমার আত্মশুদ্ধ কেঁপে উঠলো কথাটা ভেবে। যতই সাহসী কথাবার্তা বলি না কেন, বাড়িটা দেখলে সব সাহস দূরে পালায়। কেমন যেন অশুভ একটা ব্যাপার আছে বাড়িটাকে ঘিরে।

নীল হচ্ছে একাকীত্ব আর অন্ধকারের রঙ। নীল সমুদ্রের ভেতরটা একদম ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুতরাং সে অর্থে বলা যায় নীল আর ভেতরকার অন্ধকারের কোন পার্থক্য নেই। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটাও সেটারই প্রমাণ।

বাইরে যেরকম অন্ধকার, অন্য কেউ হলে ভেতরে আলো জ্বালতো নিশ্চয়ই। কিন্তু জানালাগুলো ভেতরের অন্ধকারের পক্ষেই গান গাইছে। কেউ আছে বলে মনে হয় না।

শিওজাকির গাড়িটা অবশ্য আগের জায়গাতেই আছে।

“সে ভেতরে আছে নাকি বুঝতে পারছি না,” সুমিদার উদ্দেশ্যে বললাম। আমার নিজের কানেও নিজের কণ্ঠস্বরটা বড় খেলো শোনাচ্ছে।

“গাড়ি রেখেই পালিয়েছে হয়তো।”

গাছের আড়ালে আছি আমরা এখন। বনটা এতটাই নিশ্চুপ আমার কানের রক্তপ্রবাহের শব্দও শুনতে পাচ্ছি। মাঝে মাঝে দুই একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে, শব্দ বলতে এটুকুই।

এই নিখাদ নৈঃশব্দের সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি, এসময় একটা একাকী দাঁড়কাককে বসে থাকতে দেখলাম ছাদের ওপরে। চুপচাপ বসে আশেপাশে নজর রাখছে ওটা।

দুই দিক থেকে বাড়িটা চক্কর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা।

“সুমিদা, আপনি ডানদিকে যান, আমি বামে যাচ্ছি।”

“যদি কিছু হয়, চিৎকার করবে,” চিন্তিত চেহারায় বললো সুমিদা। একটু পর উধাও হয়ে গেল ডানদিকে।

তার থেকে হঠাৎ আলাদা হবার পরই ঘাবড়ে গেলাম। সুমিদা নিজেও যে খুব বেশি শক্তিশালী, তা নয়। কিন্তু একা থাকার চেয়ে দু’জন থাকা উত্তম।

এভাবে ভয় পেলে চলবে না, নিজেকে বোঝালাম। কাজুয়া তো এখানে একাই এসেছিল। ভেতরে ঢোকার উদ্দেশ্যে ছিল তার, এজন্যেই স্কু ড্রাইভারটা নিয়ে এসেছিল পকেটে করে।

আমিও তার মত একই কাজটাই করছি। মৃত্যুর আগে যে অনুসন্ধানটা শুরু করেছিল সে, সেটা সফল করার দায়িত্ব এখন আমার।

চোখ বন্ধ করে দশ সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরের বমি বমি ভাবটা কেটে গেল। চোখ খুলে বড় করে শ্বাস নিয়ে সন্তর্পণে সামনে এগোলাম। খেয়াল রাখছি যাতে শব্দ না হয়।

আমার উপস্থিতি কি টের পেয়ে গেছে শিওজাকি? ছাদ থেকে দাঁড়কাকটা উড়ে যাবার শব্দ কানে এলো।

.

-রূপকথার গল্পকার

মিকি স্টাডিতে। গোছগাছ মোটামুটি শেষ। এখন শুধু তলকুঠুরিটা বুজে দিয়ে পালাতে হবে। রিয়েল এস্টেটের লোকটার সাথে কথা বলে নেবে পরে, নতুন ভাড়াটিয়া পেতে অসুবিধে হবে না তার।

ডেস্ক, চেয়ার, পর্দা, ঘড়ি-এসব ফেলে যাবে সে। কেবল জরুরি আর ব্যক্তিগত কিছু জিনিস আলাদা করে প্যাক করেছে।

হঠাৎই একটা কথা মনে পড়ায় ডেস্কের ড্রয়ার খুললো মিকি। ভেতরের জিনিসটা বের করে দীর্ঘ একটা সময় তাকিয়ে থাকলো। আগন্তুক ফেলে গিয়েছিল এটা।

এসময় বাইরে থেকে পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ কানে এলো তার। অন্য সময় হলে পাত্তা দিত না। কিন্তু আর কিছুক্ষণের মধ্যে কেটে পড়বে সে, এই মুহূর্তে অসতর্ক হলে চলবে না।

জিনিসটা পকেটে চালান করে দিল মিকি। স্টাডির জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লো না।

দোতলায় হলওয়েতে বেরিয়ে এলো সে। এখান থেকে নিচতলার সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। হলওয়ের বাম দিকে একটা জানালা আছে। সেই জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরে উঁকি দিল। ইচ্ছে করেই জানালাটা খুললো না। বাইরে কেউ থাকলে সতর্ক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু জানালা না খোলার কারণে ঠিক নিচটায় কি আছে তা দেখতে পাচ্ছে না।

তবুও জানালার কার্নিশ বরাবর দেয়ালটার কোণ দিয়ে একজনের কাঁধ দেখতে পেল এক মুহূর্তের জন্যে। দেয়ালের সাথে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক। নিশ্চয়ই আশপাশ ঘুরে দেখছে।

নিঃশব্দে নিচে নেমে এলো মিকি।

একগাদা ইট আর প্লাস্টার রাখা আছে সিঁড়ির গোড়ায়। তলকুঠুরি থেকে সেগুলো ধীরে ধীরে উপরে নিয়ে এসেছে সে। ভাগ্যিস হাতুড়িটাও এনেছিল। ওটার মাথায় মরিচা ধরলেও বেশ ওজন। যে কোন কিছু ভাঙতে পারবে জোরে আঘাত করলে।

.

আগন্তুকের মুখোমুখি হবার সময় হয়ে গেছে। দেয়ালে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। এভাবে থাকলে ওপর থেকে দেখা যাবে নানিশ্চয়ই। দেয়ালটা একদম ঠান্ডা। মুখ দিয়ে সাদা বাষ্প বেরিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছে।

এই বাড়িটা অন্য দশটা বাড়ির মত চারকোনা নয়। যেদিকে যেদিকে ঘর, সেখান দিয়ে সামনে বেরিয়ে এসেছে দেয়াল। ফলে বারবার ঘুরতে হচ্ছে গোলকধাঁধার মতন। প্রতিবার ঘোরার সময় মনে হয় এই বুঝি সামনে শিওজাকিকে দেখতে পাবো।

জানালাগুলো দিয়ে ভেতরে উঁকি দিচ্ছি। কিন্তু বেশিরভাগ ঘরেই পর্দা ভেজানো। শিওজাকি এখানে নেই তাহলে। ভেতরটা খালি কোন বাড়ির মতনই ফাঁকা লাগছে।

বেশ কয়েকটা প্ল্যান্টার আছে বাড়ির চারপাশে। অবশ্য কোনটাতেই ঘাস বাদে কিছু জন্মেনি। কয়েকটা মরা শেকড় দেখে বুঝলাম আগে হয়তো ছোট ছোট ঝোপ ছিল সেগুলোয়।

বাড়িটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটার সাথে আমার লাইব্রেরিতে দেখা স্মৃতিটার সবচেয়ে বেশি মিল। শেষবার এখানে এসে এ ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিলাম। এর আগেরবার যেখানে থেমেছিলাম, এবারো সেখানে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। পা দিয়ে জোরে গুঁতো দিলাম প্ল্যান্টারের ইটে। নাহ, এভাবে সরানো যাবে না। সিমেন্ট দিয়ে আটকানো।

এই প্ল্যান্টারটা নিশ্চয়ই গত দুই মাসের মধ্যে কোন এক সময়ে বানানো হয়েছে তাড়াহুড়ো করে। খুঁজলে হয়তো দুর্বল জায়গা পেতাম, কিন্তু সেই সময় নেই।

এ নিয়ে ভাবা বাদ দিলাম। একই জায়গায় খুব বেশিক্ষণ থাকাটা নিরাপদ না।

বাড়ির পেছন দিকে আবারো চোখে পড়লো ছাউনিটা। এখনও আগের মতনই আছে। ছাউনিটার বয়স নিশ্চয়ই বাড়িটার বয়সের সমান। কাঠগুলো পচতে শুরু করেছে। একসময় বোধহয় সাদা রঙ ছিল বাইরে, এখন একদমই উঠে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটার দাগ জায়গায় জায়গায়।

কিছু স্থানে বোর্ড উঠে আসছে। ভেতরের অন্ধকার দেখা যাচ্ছে সেদিক দিয়ে। ছাউনির দরজাটা ঠেলা দিলাম জোরে, কিন্তু এক চুলও নড়লো না

ওটা। আরেকবার সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে যাবার মত ফাঁকা জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হলাম। ভেতরটা খালি।

এসময় জানালাটা চোখে পড়লো আমার। ছাউনির পেছনের দেয়াল বরাবর থাকায় বাইরে থেকে দেখা যায় না। এই জানালাটায় কোন পর্দা টাঙানো নেই। আসলে নেই বললে ভুল হবে, দুই পাশে সরিয়ে রাখাহয়েছে হয়তো। বাড়ির ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

আশপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে একাই আছি আমি।

জানালাটা বেশ ওপরে। বাড়িটা ঢালের ধারে তৈরি করা হয়েছে বিধায় একেকটা জানালার উচ্চতা একেকরকম। একটা কাঠের বোর্ডে পাড়া দিয়ে কোনমতে উঁচু হয়ে ভেতরে তাকালাম।

.

-রূপকথার গল্পকার

সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে মিকি। ওপরতলা থেকে যাকে দেখেছে, সে বাড়ির পেছন দিকের দেয়াল ঘেঁষে সামনে এগোচ্ছে। সুতরাং মিকিকে চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই।

এই প্রথম যে কেউ ছোঁকছোঁক করতে এসেছে তা নয়। এর আগেও কয়েকবার এমনটা হয়েছে। আসলে কখনো নিজের অপরাধগুলো লুকোনোর সেরকম চেষ্টা করেনি সে।

এমনকি তার প্রথম খুনের পরেও কিছু করেনি। পাহাড়ের ওপর থেকে কেন মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল সেটার সদুত্তর এখনও দিতে পারবে না। এই কাজগুলোর পরিণতি কি হতে পারে, সেগুলো নিয়েও ভাবেনি কখনো। ধরা পড়লে কিছু আসে যায় না তার।

কিন্তু যদি ধরা না পড়ে থাকা যায়, তাহলে সেই চেষ্টা না করাটা বোকামি। আগন্তুকের মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ পেলে, সেটাই করবে।

হাতুড়িটা শক্ত করে চেপে ধরে পা টিপে টিপে সামনে এগোলো সে। কিছুক্ষণ পর দেয়ালের অন্য পাশ থেকে একটা বের হয়ে থাকা কাপড়ের অংশ দেখতে পেল। আগন্তুকের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

আগন্তুক অবশ্য এখনও টের পায়নি যে বাড়ির কর্তা তার পেছনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। যতটা সম্ভব আস্তে শ্বাস টানার চেষ্টা করছে মিকি।

এরকমটাই হয় প্রতিবার। এ পর্যন্ত কতজন চেষ্টা করেছে এই বাড়িটার ভেতরে উঁকি দেয়ার?

আগের বাড়িটাতেও একইরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল। তবে সেবার আগন্তুক ছিল এক প্রতিবেশী গৃহিণী। মিকিকে বাইরে দেখে কিছু একটা সন্দেহ হয় তার। হয়তো প্রতিবেশীদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ করি না দেখেই মহিলার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। সেখানে থাকার সময় দুজনকে বাড়ির পেছনে কবর দিয়েছি। আমাকে কি দেখে ফেলেছিল? চাইলে তাকেও মারতে পারতাম। কিন্তু তেমনটা করলে তার পরিবারের লোকজন হৈচৈ করতে পারে দেখে আর কিছু করিনি। তাই ভিন্ন কোথাও চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। সে শক্ত কোন প্রমাণ যোগাড় করে ফেলার আগে উধাও হয়ে যাওয়াই ভালো।

তাই মিকি কায়েদিতে চলে আসে।

দেয়ালে গা ঘেঁষে আবারো আগন্তুকের দিকে তাকালো সে। প্রবল ঠান্ডায় মুখ দিয়ে শ্বাস বের হওয়া মাত্র জমে যাচ্ছে। আগন্তুক যে জানালাটা দিয়ে ভেতর দেখছে সেখানে কি আছে একবার ভাবলো মিকি।

সাথে সাথে হাতুড়িটা উঁচু করে ধরলো।

হিতোমি বলেছিল শেষবারের মতন সূর্য দেখতে চায়।

সে যদি এই অনুরোধটা না করতো তাহলে আগন্তুকের মুখ বন্ধ করতে হতো না তাকে। তলকুঠুরিটা বুজে দিয়ে পালিয়ে গেলেই হতো।

কিন্তু জানালার অন্যদিকে হিতোমিকে রেখে এসেছে সে বেশ খানিকক্ষণ আগে। নিজের হাতে।

আগন্তুক নিশ্চয়ই দেখে ফেলেছে তাকে। সেজন্যেই অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে।

.

জানালার ওপাশে সেরকম কিছু চোখে পড়লো না। বড় বড় বই ভর্তি একটা বুকশেলফ। খুব সম্ভবত আর্ট বই। দেয়ালে কিছু পেইন্টিং ঝোলানো। আরেকপাশে না খোলা কার্টন। শিওজাকি স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করে এই ঘরটা।

খুশি হবো নাকি হতাশ, বুঝলাম না। কাঠের বোর্ডটা থেকে নিচে নামলাম। শিওজাকি কি আসলেও চলে গেছে?

হঠাৎই একটা ছায়া দেখতে পেলাম চোখের কোণ দিয়ে। চিৎকার করতে যাবো এসময় খেয়াল করলাম ওটা সুমিদা। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো যেন।

“কিছু পেয়েছো?” জিজ্ঞেস করলো সে।

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম।

এবারে ভেতরে ঢুকবো দু’জন।

সামনের দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করলাম প্রথমে। তালা দেয়া। তবে সুমিদা আরেকটা দরজা দেখে এসেছে উত্তর পাশে। সেটার হ্যাঁন্ডেল ঘোরাতেই খুলে গেল দরজা।

ভেতরটা অন্ধকার। একে তো বাইরে মেঘলা, তার ওপর বাড়িটার উত্তর দিকে আছি আমরা এখন। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। বাতি জ্বালবো কিনা ভাবছি, শিওজাকি না পালিয়ে থাকলে সতর্ক হয়ে যাবে। কিন্তু সুমিদা অতশত না ভেবে সুইচ অন করে দিল।

“সমস্যা নেই, ব্যাটা ভেগেছে মনে হয়।”

“আমাদের আরো সতর্ক হতে হবে,” বললাম। সুমিদা ফিরে আসায় আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছি আবারো।

পেছনের দরজাটা দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকতে হয়। একটা পুরনো টিমটিমে বাতির আলোয় ফ্রিজের অবয়বটা বোঝা যাচ্ছে। আরেকপাশে কয়েকটা কেবিনেট। আশপাশ নীরব হওয়াতে ফ্রিজের গুঞ্জন শুনতে পাচ্ছি। তবে রান্নাঘরটা দেখে মনে হচ্ছে না খুব একটা ব্যবহৃত হয়।

সেখান থেকে বের হয়ে অন্য ঘরগুলোয় উঁকি দেয়া শুরু করলাম আমরা। কিন্তু কোথাও কেউ নেই।

একটা ঘর দেখে মনে হলো শিওজাকির স্টুডিও। অর্ধেক কাজ হওয়া কয়েকটা ছবি দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যান্ডে। টেবিলের ওপর কাপে বিভিন্ন আকৃতির ব্রাশ।

আগেরবার এসে দেখা কাপড়গুলো এখনও একই জায়গাতেই আছে। পুরো ঘরটা জুড়েই আসলে মেয়েদের কাপড়ে ভর্তি। এগুলোর কোনটাই হিতোমির গায়ে লাগবে বলে মনে হয় না। মাঝবয়সী কোন মহিলার কাপড় এগুলো।

খালি বাথরুমটায় উঁকি দেয়ার পর সুমিদা ঘোষণা করলো, “কেউ নেই বাসায়।”

সুমিদা নার্ভাস হলেও তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না। হিতোমি এখানে নেই বলেই ধারণা তার। শিওজাকিকেও বোধহয় এখন আর অপহরণকারী মনে হচ্ছে না। আমার মুখের ওপর কথাগুলো বলেনি অবশ্য, কিন্তু হাবভাবে বুঝতে পারছি।

মৃদু আলোয় আলোকিত হলওয়েগুলো ধরে হাঁটছি আমরা। তলকুঠুরিতে ঢোকার প্রবেশপথটা নিশ্চয়ই আশপাশেই কোথাও আছে, কিন্তু সেটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছি না।

কিছুক্ষণ পর সুমিদা বললো, “চলো বের হয়ে যাই, নামি। হয়তো তোমার কোন ভুল হয়েছে।”

ভেতরে ভেতরে মুষড়ে পড়লাম। ভুল তো হবার কথা না। কিন্তু এ মুহূর্তে করার মত কিছু নেইও আসলে।

“দোতলাটা দেখা বাকি,” ক্ষীণ স্বরে বললাম।

“আমি যাবো না ওপরে,” কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সুমিদা।

একাই ওপরে উঠলাম। দোতলার হলওয়ে থেকে নিচতলাটা পুরোপুরি দেখা যায়। এখানেও কয়েকটা ঘর পাশাপাশি। একটা ঘর দেখে মনে হলো শিওজাকির বেডরুম। অন্য ঘরটায় বিশাল একটা কাঠের ডেস্ক। খুব সম্ভবত

স্টাডি রুম। আরো দমে গেলাম। কোথাও কিছু নেই।

কিছুক্ষণ আগে যখন সুমিদা বললো যে ওপরে আসবে না, ভেতরে ভেতরে রেগে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার কথায় যুক্তি আছে।

এতক্ষণে ভয়টা অবশ্য কেটে গেছে। বাইরে থেকে দেখে শয়তানের বাসস্থান মনে হলেও, বাড়িটার ভেতরে অদ্ভুত কিছু নেই। বরং শিওজাকির আঁকা ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে এরকম কারো অপহরণকারী হবার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ। একটা ছবিতে প্রজাপতিকে তাড়া করছে একটা বাচ্চা কুকুর, অন্যটায় টিভি দেখছে কয়েকটা বাচ্চা।

তলকুঠুরিতে যাওয়ার কোন দরজা নেই কেন? অপহরণের আলামত বলা যায় এরকম কিছু খুঁজে পাচ্ছি না কেন? এই প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।

হলওয়ের একদম কোনায় একটা জানালা চোখে পড়লো এ সময়। পর্দা ভেড়ানো থাকলে অবশ্য চোখে পড়তো না। এখান থেকে বাইরের বন দেখা যায়। কিছুটা দূরে পাহাড়ের ওপর আরেকটা বাড়ি। শিওজাকির বাড়িটার মতনই একই নকশার ওটা। তবে ইটগুলো লাল রঙের।

হয়তো ওটাই কিয়োকোর বাড়ি। কিমুরার কাছে শুনেছিলাম সে-ও ইটের তৈরি বাড়িতে থাকে।

এমনটা কি হতে পারে যে চোখে রঙিন সানগ্লাস পরে ছিল কাজুয়া সেদিন। তাই রংটা নীল মনে হয়েছে আমার কাছে?

পরক্ষণেই বাতিল করে দিলাম ভাবনাটা। এটা সম্ভব না। কিন্তু মন থেকে সন্দেহ পুরোপুরি দূর হলো না।

কাজুয়ার স্মৃতিতে তলকুঠুরির একটা জানালা দেখেছিলাম। কিন্তু এই বাড়িটার বাইরে একটা প্ল্যান্টার। তাছাড়া দুই মাসের মধ্যে তো প্ল্যান্টারে ঘাস জন্মে মরে যাবে না। তাহলে কি আমারই ভুল হয়েছে?

ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। কাজুয়া যদি সেদিন কিয়োকোর বাড়ীর তলকুঠুরি দেখে থাকে… তাহলে খুব বড়সড় ভুল করে ফেলেছি আমি।

রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলাম। নিচে নামার মত ধৈর্য নেই, তাই রেলিংয়ের ধারে গিয়ে সুমিদার নাম ধরে ডাক দিলাম। “সুমিদা!”

সিঁড়ির গোড়ায় হেঁটে এলো সে। “দেখা শেষ?”

“গাড়ি বের করুন! আমাদের কিয়োকোর বাড়িতে যেতে হবে!”

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো সে।

“পরে বুঝিয়ে বলছি!”

আমার কথায় খুব একটা ভরসা পেয়েছে বলে মনে হলো না। তবে আর কিছু না বলে সামনের দরজার দিকে দৌড় দিল।

সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামার সময় ভাবলাম, কাজুয়া আসলে সেদিন কিয়োকোর বাড়িতেই গিয়েছিল। আর সেটা সত্যি হলে সাওরি বিপদে আছে। ওখানেই যাওয়ার কথা বলে বের হয়েছে সে।

শেষের কয়েকটা ধাপ লাফিয়ে নামলাম।

.

-রূপকথার গল্পকার

আগন্তুককে দেখে হিতোমির চেহাআর কি দশা হয়েছে সেটা ভাবছে মিকি। তার যে হাত পা কেটে ফেলা হয়েছে, এটা কি বুঝতে পারবে আগন্তক? যে কোন সুস্থ মানুষের তো ভয় পেয়ে যাবার কথা।

বাড়ি বসানোর জন্যে হাতুড়িটা ওপরে তুলেছে এ মুহূর্তে তার পকেটের চাবিগুলো শব্দ করে উঠলো। কান না পাতলে সেই শব্দ শুনতে পাবার কথা না কারো। কিন্তু এটুকু শব্দেই সতর্ক হয়ে গেল আগন্তুক। দৌড় দিল আশপাশে না তাকিয়ে।

মিকিকেও দৌড়াতে হবে এখন। আগন্তুকের মুখটা বন্ধ করতে হবে।

.

সামনের দরজার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম আমি। সুমিদা নিশ্চয়ই গাড়ির ইঞ্জিন চালু করবে এখন। যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে হবে আমাকে।

এসময় এমন একটা শব্দ কানে এলো যেটা এখানে শুনতে পাবো সেই কল্পনাও করিনি।

কেউ গান গাচ্ছে।

সিঁড়ির নিচে ফিরে এলাম আবারো। একদম ক্ষীণ একটা আওয়াজ, তবে সেটা যে মেয়েকণ্ঠ তা বুঝতে অসুবিধে হলো না। ইংরেজিতে গান গাইছে।

হয়তো কোন একটা ঘরে রেডিও বা টেলিভিশন চলছে। দ্রুত কিয়োকোর বাড়িতে পৌঁছুতে হবে। মনে মনে এই কথা বললেও গানের উৎস না খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবো না মনে।

অনেক হয়েছে। এবারে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে আমাকে। কাজুয়া সেদিন যে রঙ্গেরই সানগ্লাস পড়ে থাকুক না কেন, লাল ইট কখনো নীল দেখাবে না…

সিঁড়ি থেকে সামনে এগোলে গানের শব্দ কমে যায়। সিঁড়ির পেছন দিকে যে কেবিনেটটা আছে সেখান থেকে সবচেয়ে জোরে শোনা যাচ্ছে গানটা।

পুরনো কাঠের কেবিনেটটা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে দেয়াল থেকে। ওটার পাল্লায় কান রাখলাম। শুনে মনে হচ্ছে কেবিনেটের পেছন থেকে গানের শব্দটা আসছে।

কেউ আছে ওপাশে। কেবিনেটটা ইচ্ছেকৃতভাবে কিছু একটা লুকোনোর জন্যে ঝোলানো হয়েছে এখানে।

কেঁপে উঠলাম একবার। কিয়োকোর বাড়িতে যাবার ইচ্ছে মরে গেছে। কেবিনেটটার ভেতরে কিছু নেই। বহনের সুবিধার জন্যে ইচ্ছেকৃতভাবে খালি রাখা হয়েছে নিশ্চয়ই।

ওটা এতই হালকা যে আমি ধাক্কা দিতেই সরে গেল। পেছনের দেয়ালে একটা গর্ত। বাড়ির অন্য দেয়ালগুলোর মতনই এখানকার দেয়ালেও সাদা ওয়ালপেপার লাগানো হয়েছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু একটা জায়গায় উঠে গেছে। ওয়ালপেপার। একজন মানুষ ভেতরে অনায়াসে ঢুকতে পারবে গর্তটা গলে। প্লাস্টার ছাড়া ইটের গাঁথুনি কোনার দিকগুলোয়।

ইটের পেছনে দরজার চৌকাঠ চোখে পড়লো। হয়তো দরজাটা ঢাকার জন্যেই সামনের ইটগুলো অদক্ষ হাতে বসানো হয়েছে। পেছনে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের দিকে। সিলিং থেকে জ্বলছে কম ওয়াটের বাতি। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিশাল দানো মুখ হা করে রেখেছে।

গানের শব্দ এখন আরো স্পষ্ট হয়েছে। টিভি বা রেডিও না, কেউ একজন গান গাইছে নিচে।

তলকুঠুরি। ভুল দেখিনি তাহলে।

খুব সাবধানে নিচে নামতে লাগলাম। এতটাই বিচলিত যে শ্বাস নিতেও ভুলে গেছি। বুকে কেউ হাতুড়ির বাড়ি বসাচ্ছে অনবরত।

সিঁড়ির দু-পাশে নগ্ন ইটের দেয়াল। ওখানে হাত রেখে নিচে নামছি। যাতে হুমড়ি খেয়ে না পড়ে যাই।

সিঁড়ির নিচে সঁতসেঁতে গন্ধ। আর্দ্রতা ওপরের থেকে অনেক বেশি। একবার মনে হলো দম বন্ধ হয়ে যাবে। টিমটিমে আলোটা ঘরের অন্ধকার দূর করতে পারছে না।

একটা ঘরে প্রবেশ করেছি, এখানেও মৃদু আলোর একটা বা ঝুলছে। সিলিং থেকে। একটু পর পর নিভছে-জ্বলছে সেটা, যে কোন সময় চিরতরে নিভে যাবে। কোনার দিকগুলোতে পৌঁছাচ্ছে না বাটার আলো। বরং অন্ধকার আরো গাঢ় করে তুলছে মনে হলো। পেছনের দিকে কয়েকটা শেলফের অবয়ব চোখে পড়লো।

আমার ঠিক সামনে বিশাল একটা কাঠের ডেস্ক। এই ডেস্কটা খুব সম্ভবত ওয়ার্কবেঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। হাতুড়ি, করাত জাতীয় কয়েকটা যন্ত্র পড়ে আছে এলোমেলো ভাবে। অন্য যন্ত্রপাতিগুলো পুরনো হলেও একটা হাতুড়ি একদম নতুন।

স্কালপেলও দেখতে পেলাম। শেষ এরকম কিছু দেখেছিলাম হাসপাতালে, আমার অপারেশনের সময়। মৃদু আলোয় চকচক করছে স্কালপেলের ফলাটা। ডেস্কের পুরো উপরিতল জুড়ে কালচে দাগ।

ওগুলো মানুষের রক্ত, এই ভাবনাটা জোর করে মাথা থেকে দূর করে দিলাম। তেলও হতে পারে, মনে মনে বললাম।

শেলফগুলোর সামনে কয়েকটা বাক্স ভর্তি পুরনো অব্যবহৃত জিনিসপত্র। হয়তো এখানে এমন কিছু জিনিস আছে যেগুলো বাড়িটা তৈরির সময় থেকে ছিল। একটা পুরনো আমলের পেন্ডুলাম ক্লক আর ধুলোভর্তি বেবি ক্যারিজ রাখা এক পাশে।

এখনও গানের আওয়াজ ভেসে আসছে ঘরটার পেছন দিক থেকে। ওদিকটায় বাল্বের আলো পৌঁছায় না। ইংরেজি কথাগুলো বুঝতে পারছি না, তবে গানটা যে কষ্টের সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। মনে হচ্ছে যেন এই বাড়ির সমগ্র অন্ধকার একীভূত হয়ে গানটা গাইছে।

একবার গায়িকার উদ্দেশ্যে কিছু বলে উঠতে চাইলাম, কিন্তু কোন আওয়াজ বেরুলো না গলা দিয়ে। আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “কেউ আছেন?”

অন্ধকার যেন গিলে নিল আমার কথাটা। নীরবতা নেমে এলো গোটা তলকুঠুরিতে।

এরপর এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো ঘরের পেছন দিক থেকে। “কে আপনি?” উৎকণ্ঠা মিশে আছে তার গলায়।

“তুমি নিশ্চয়ই হিতোমি আইজাওয়া,” কণ্ঠস্বরটা যেদিক থেকে আসছে সেদিকে এগিয়ে বললাম।

“ও হিতোমি না।”

একটা পিলারের পাশে থমকে গেলাম।

একটা তরুণের কণ্ঠ এটা। আগের জায়গা থেকেই আসছে।

“আমি শিনিচি হিসামোতো। একটু আগে ইউকি কথা বলেছে আপনার সাথে।”

এই প্রথম শুনলাম নাম দুটো মাথায় চিন্তার ঝড় বইতে শুরু করেছে। এতদিন তো ভেবে এসেছি তলকুঠুরিতে একাই আছে হিতোমি।

“হিতোমি কোথায়?”

“ও বোধহয় ঘুমাচ্ছে। একটু আস্তে কথা বলুন,” শিনিচি বললো।

দু’জনে ফিসফিস করছে তাকের অন্য পাশ থেকে। আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি না অন্ধকারে, কিন্তু তারা নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে পাচ্ছে।

প্রচণ্ড অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করছে আমার ভেতরে। চেষ্টা করেও সামনে এগোতে পারছি না। এই বাটার টিমটিমে আলোর বলয় ছেড়ে ইচ্ছে করছে না যেতে। অন্য দু’জন অন্ধকারে কেন লুকিয়ে আছে কে জানে। খারাপ কিছু ভাবনা মাথায় খেলে গেল, সেগুলো সত্যি না হলেই ভালো হবে।

“আপনি নিশ্চয়ই শিওজাকির বন্ধু নন?” ইউকি জিজ্ঞেস করলো। শিওজাকিকে নিয়ে কেন কথা বলছে সে, জানি না। আপনার কণ্ঠস্বর শুনে একবার নড়ে উঠেছে ও।”

“সে… এখানে?”

“আমাদের পাশেই আছে,” শিনিচি বললো। “কথা বলার মত দশায় নেই, কিন্তু আপনার গলা শুনে গুঙিয়ে উঠেছিল।

শিওজাকি এখানেই আছে। কথা বলার মত দশায় নেই। এটা কি কোন কৌতুকশালা নাকি ভাবতে লাগলাম।

এখনও চোখে পেছনের অন্ধকারটা পুরোপুরি সয়ে আসেনি, তাই তাদের দেখতে পাচ্ছি না। নিচু সিলিংয়ের কারণে দমবন্ধ লাগছে। আমার বোধহয় ক্লস্টোফোবিয়া আছে।

পাশে সিলিং থেকে কিছু জিনিস ঝুলছে। কয়েকটা মাছ ধরার বর্শি। ওগুলোর মাথায় শুকনো কিসব লেগে আছে।

“শিওজাকি কথা বলতে পারছে না কেন?” জিজ্ঞেস করলাম।

“দু’হাতে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে আছে সে। পুরো শরীরে কয়েকটা শিক বিধাননা। একটা শিক বোধহয় ফুসফুস ফুটো করে বেরিয়ে গেছে। এখনও বেঁচে আছে অবশ্য।”

“সেটা কি করে সম্ভব?” কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম। বিশাল কিছু একটা নড়ে ওঠার শব্দ কানে এলো।

“সম্ভব। কারণটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে,” অনিশ্চিত কণ্ঠে বললো শিনিচি। “দয়া করে আস্তে কথা বলুন।

এই সময় একটা তাক নড়ে উঠলো। যেন কিছু একটা ধাক্কা দিয়েছে সেটাকে। একটা বাক্স ওপর থেকে পড়ে গেল নিচে।

মুখে হাত দিয়ে পিছিয়ে এলাম।

তাকটা নড়ার ফলে বাল্বের আলো শিনিচি আর ইউকির ওপর গিয়ে পড়েলো এক মুহূর্তের জন্যে।

নিশ্চয়ই ভুল দেখেছি। মাথা খারাপ হয়ে গেছে আমার। নিজেকে প্রবোধ দিলাম।

“চেহারা এরকম করবেন না প্লিজ,” দুঃখী কণ্ঠে বললো ইউকি।

“আপনাকে দেখতে পাচ্ছি আমরা।

“কেন…” কথাটা শেষ করতে পারলাম না। কেউ যেন ভেতর থেকে সব শক্তি শুষে নিয়েছে আমার। এখান থেকে এখনও পালাইনি কারণ এক কদম পা ফেলার শক্তি নেই।

“আমাদের সার্জারি করা হয়েছে।”

“সার্জারি?”

“এখানকার সবাইকে ছোটখাটো সার্জারির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ভালো সার্জারি। এরপর চিরতরে বন্দী করে রাখা হয়। তবে জেনে অবাক হবেন, কোন ব্যথা অনুভব করি না আমরা,” এটুকু বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো ইউকি। “আপনিও কি তলকুঠুরির নতুন বাসিন্দা?”

তলকুঠুরির নতুন বাসিন্দা বলতে কি বোঝাচ্ছে? জানতে চাইছে যে আমাকেও অপহরণ করে আনা হয়েছে কিনা?

“আপনাদের উদ্ধার করতে এসেছি আমি,” অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বললাম। “হিতোমি কোথায়?”

আগে এখান থেকে বেড়াতে হবে আমাকে-এখনই। এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে পাগল হয়ে যাবো। এখানকার অস্ফুট আঁধারে দম বন্ধ হয়ে যাবে। ওপরে আলোর স্পর্শে হয়তো কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাবো। তখন সাহায্য নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব ফিরে আসবো। শিনিচি আর ইউকির শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

“হিতোমি বাচ্চাদের ক্যারিজটায় আছে। ওটাই ওর বিছানা,” শিনিচি বললো।

অন্ধকারের দিক থেকে মনোযোগ না সরিয়ে ক্যারিজটার দিকে এগোলাম। পুরনো, ছোট্ট একটা ক্যারিজ। কাপড়গুলো মলিন হয়ে গেছে। হাতলে ঝুল। ওপরে একটা কম্বল দিয়ে ঢাকা দেয়ায় ভেতরে কি আছে দেখতে পাচ্ছি না।

কান্নার দমকে কেঁপে উঠলো আমার শরীর। হিতোমিকে যখন অপহরণ করা হয় তখন তার বয়স ছিল চৌদ্দ। এখন তার বয়স পনেরো। কোন দক্ষ অ্যাক্রোব্যাটের পক্ষেও এটুকু জায়গায় পা ভাজ করে থাকা সম্ভব না।

কাঁপা কাঁপা হাতে কম্বলটা সরালাম।

ভেতরে একটা মেয়ে ঘুমোচ্ছে। তার শরীরটা এতই ঘোট যে একহাতে ভোলা যাবে। গাল দুটো ভয়ানক রকমের ফ্যাকাসে। শিরাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। লম্বা চুলগুলো অনেকদিন ধোয়া হয়নি।

চেহারায় আলো পড়ায় ঘুম ভেঙে গেল তার। ধীরে ধীরে চোখ খুললো। আমাকে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক একটা চাহনি ভর করলো চেহারায়। যেন স্বপ্ন দেখছে এমন ভঙ্গিতে হেসে উঠলো পরমুহূর্তে।

“হ্যালো,” বললো সে।

কেঁদে ফেললাম। একটা কাপড়ের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তার গলা থেকে শরীরের নিচের অংশটুকু।

“কে…” মিষ্টি কণ্ঠে বললো হিতোমি। “কে আপনি? আপনাকেও কি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে?”

না। মাথা ঝাঁকালাম। বলতে ইচ্ছে করছে যে ওকে উদ্ধার করতে এসেছি, কিন্তু শব্দ বেরুচ্ছে না গলা দিয়ে।

“আপনাকেও কি গাড়িতে করে এখানে আনা হয়েছে? কালো পাখিটা দেখেছেন? এখনও স্বপ্নে মাঝে মাঝে দেখি ওটাকে।”

“হ্যাঁ, দেখেছি কাকটাকে। ছাদে বসে ছিল।”

“কি? আরে নাহ। আমি চাবির রিংয়ের কথা বলছি। গাড়ি চলার সময় দোল খায় ওটা।”

দোল খায়?

“তিনি অবশ্য নতুন একটা গাড়ি কেনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু চাবির রিংটা তো খুবই পছন্দের ছিল তার। তাই ভেবেছি নতুন গাড়িতেও একই রিং ব্যবহার করবেন।”

হিতোমিকে রেখেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার জন্যে ঘুরলাম। কিন্তু কেউ একজন নেমে আসছে সেদিক দিয়ে। সুমিদা।

“তুমি এইখানে!” বললো সে। তার সামনে গিয়ে জোরে গাল বরাবর সর্বশক্তিতে থাপ্পড় কষিয়ে দিলাম।

“এসব আপনার কীর্তি!”

একবারের জন্যেও চোখের পলক পড়লো না তার। হিতোমি যে চাবির রিংটার কথা বলছে সেটা আমিও দেখেছি। সুমিদার গাড়িতে।

.

১০

রূপকথার গল্পকার

বনের ভেতর দিয়ে আগন্তুকের পেছন পেছন ছুটছে মিকি। কিছুদূর সামনে যেতেই দেবদারু গাছগুলো চোখে পড়লো।

হঠাৎই দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল আগন্তুক। পরক্ষণে তাকে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখলো সে। সামনেই একটা রাস্তা।

গাড়ির টায়ারের শব্দ কানে এলো। আগন্তুককে গুঁতো দিয়েছে গাড়িটা। একটা গাছের পেছন থেকে দৃশ্যটা দেখছে মিকি।

গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ড্রাইভার। একজন মাঝবয়সী লোক। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলে যে কেউ আছে কিনা। এরপর গাড়িতে উঠে চলে গেল।

নিথর পড়ে আছে আগন্তুকের দেহটা।

.

১১

আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে হিতোমির দিকে এগোলো সুমিদা। ধীরে আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে নড়ছে সে। যেন একটা বিড়াল।

পাশে সরে দাঁড়ালাম আমি।

ক্যারিজটা একবার হাত দিয়ে দোলালো সুমিদা। “কেমন আছো?” হিতোমিকে জিজ্ঞেস করলো সে।

“মোটামুটি,” চোখ বন্ধ করে জবাব দিল মেয়েটা।

“শিওজাকি তাহলে অপহরণকারী না,” বললাম আমি।

বারবার মনে হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সুমিদা। এখনও গোটা পরিস্থিতিটা পরিষ্কার না আমার কাছে। এসময় একটা কথা মনে হলো।

“আপনি জানতেন লাইটের সুইচটা কোথায়।”

অন্ধকারে অচেনা একটা বাড়িতে ঢুকেই সুইচ খুঁজে পেয়েছিল সুমিদা। এখন আর ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে হচ্ছে না। বাড়িটা খুব ভালোমতন চেনা তার।

“কয়েকদিন আগে এখানে এসেছিলাম আমি, গত কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবারের মতন,” ক্যারিজ থেকে হাত না সরিয়েই বললো সুমিদা। ক্যাফেতে আমার সাথে যে স্বরে কথা বলে, এখনও সেভাবেই কথা বলছে সে। “তার আগে শিওজাকির কোটটা ফেরত দিতে এসেছিলাম আমরা দু’জন। ফেরার পথে কি বলেছিলে, মনে আছে?”

বলেছিলাম যে শিওজাকি দেয়াল ঠিক করার জিনিসপত্র কিনেছে। কিন্তু বাড়িটায় কোন ভাঙা দেয়াল চোখে পড়েনি আমার।

“আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু একটা দেয়ালে আসলেই ফাটল ধরেছিল। তলকুঠুরিটা লুকোনোর জন্যে আমার তৈরি করা দেয়ালটা। সেটা শিওজাকির চোখে পড়েছিল, কিন্তু সেটার সামনে কেবিনেট থাকায় খুব একটা মাথা ঘামায়নি।”

“কেবিনেট?”

মাথা নাড়লো সুমিদা। “দেয়ালটা লুকোনোর জন্যে আমি কেবিনেটটা আনি এখানে। শিওজাকি জানতোও না যে একটা তলকুঠুরি আছে এই বাড়িতে। কিন্তু ভূমিকম্পের কারণে দেয়ালটায় ফাটল ধরে। ইউকির গানের আওয়াজ শুনতে পায় সে। শিওজাকি নিজেই কথাটা বলেছিল আমাকে। ইউকির সাথে কথা হয়েছে তোমার?”

ঘরের পেছন দিকটায় নির্দেশ করলো সে।

“শিওজাকি তাহলে দেখে ফেলেছিল তলকুঠুরিটা?”

সুমিদা বললো যে দেয়ালটা ভেঙে ফেলার ইচ্ছে ছিল শিওজাকির। সেজন্যেই নতুন হাতুড়িটা কিনেছিল।

“সে যেহেতু সবকিছু জেনে ফেলে, তাই ঐ অবস্থা করেছেন…” ঘরের পেছন দিকে তাকালাম আবারো। কিছু দেখতে পাচ্ছি না ঠিকই, কিন্তু শিওজাকি যে সেখানে আছে, এটা জানি।

“শিওজাকি কে?” নিষ্পাপ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো হিতোমি।

“আমি চলে যাবার পর এই বাসাটায় ওঠে যে,” সুমিদা বললো। “যাকে কয়েকদিন আগে এখানে নিয়ে এসেছি।”

“ওহ শিক কাবাব লোকটা,” যেন মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললো হিতোমি।

তলকুঠুরির সব নিয়ম কানুনই যেন ওপরের পৃথিবী থেকে ভিন্ন। জানি এখনও অজ্ঞান হয়ে যাইনি কেন। নিচু সিলিং আর গুমোট অন্ধকারের কারণে মাথা ঘুরাচ্ছে।

“তিন দিন আগে নিজের হাতে এক বছর আগে গড়া দেয়ালটা ভাঙ্গি আমি। ভাবিনি যে তুমি এখানে নিজ থেকেই আসবে।”

এটুকু বলে আমার দিকে এক পা এগোয় সুমিদা।

“কাছে আসবেন না!” চেঁচিয়ে উঠলাম বদ্ধ ঘরটায়।

থেমে গেল সে। “

আপনি এখানে থাকতেন?”

মাথা নেড়ে সুমিদা বললো যে এক বছর আগ অবধি এখানেই থাকতো সে। এই ঘরটাতেই হিতোমির হাত পা কেটে আলাদা করা হয়।

“চলে যাবার আগে ইট দিয়ে তলকুঠুরির জানালাটাও ঢেকে দেই।”

তলকুঠুরির জানালা।

“বাইরের প্ল্যান্টারটা আপনার তৈরি করা, তাই না?”

“অনেকগুলো আগে থেকেই ছিল। আমি কেবল একটা যোগ করেছি।”

আমি যে মরা গাছগুলো দেখেছি বাইরে ওগুলো অন্য কোথাও থেকে এনে ওখানে গেড়েছিল সুমিদা। এক বছরের ব্যবধানে মরে গেছে। সবগুলো।

কিন্তু বাঁ চোখের স্মৃতিতে তো দু’মাস আগে এই বাড়িতে উঁকি দিতে দেখি আমি কাজুয়াকে। তখন শিওজাকি এখানে থাকতো? হিসেব মিলছে না।

“আপনি বলেছিলেন যে এক বছর আগে কাজুয়ার সাথে পরিচয় হয়েছিল। সেটা সত্যি?।”

“ও একজন আগন্তুক ছিল।”

“আগন্তুক?”

“যারা আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসে তাদের এই নামেই ডাকি আমি। মিঃ হিসামোতোও আমার পুরনো বাড়িটার আশেপাশে ছোঁকছোঁক করতো।”

“কাজুয়াকে তলকুঠুরির জানালা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিতে দেখেন আপনি?”

“হ্যাঁ, এক বছর আগে,” মাথা নেড়ে বলে সুমিদা।

মুখে হাত চাপা দিয়ে গুঙিয়ে উঠলাম। আমার বাঁ চোখে দেখা স্মৃতিটা তাহলে দুমাস না, এক বছর আগের।

স্মৃতিটায় দেখেছিলাম কাজুয়াকে একটা গাড়ি ধাক্কা দিয়েছে। আসলে তখনই মারা যায়নি সে। কিন্তু ড্রাইভার হয়তো ভাবে যে মারা গেছে, তাই পালিয়ে যায় সেখান থেকে। স্বপ্নগুলোয় কোন শব্দ শুনতে পাই না আমি, তাই বুঝতে পারিনি।

এ কারণেই ঐ দেয়ালের ব্যাপারটা আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলেছিল। আসলে দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গা।

আমার দিকে আরেক পা এগিয়ে এলো সুমিদা। মাথা ঝাঁকিয়ে পিছিয়ে গেলাম আমি।

“এক বছর আগে কাজুয়াকে জানালাটা দিয়ে উঁকি দিতে দেখি আমি। এর এক সপ্তাহ আগে থেকে আমার মনে হচ্ছিল যে কেউ একজন নজর রাখছে বাড়িটার ওপর। তুমি এখানে হিতোমির খোঁজে এসেছো কারণ কাজুয়া তোমাকে ওর কথা বলেছিল, তাই না?”

দু’চোখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেললাম। তবুও তার কথাগুলো শুনতে পাচ্ছি।

“একটুর জন্যে আমার হাত ফসকে বেড়িয়ে যায় কাজুয়া। কিন্তু পালানোর সময় একটা গাড়ি গুতো দেয় তাকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কাপুরুষ ড্রাইভারটা সে মরে গেছে ভেবে পালিয়ে যায়।”

আরেক পা এগোলো সে।

“এরপরেই সমস্যার শুরু। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না। জ্ঞান ফিরে পাবার পর সব ভুলে যায় কাজুয়া। আমাকে বা এই বাড়িটাকে চিনতে পারছিল না। আসলে কয়েক সপ্তাহের স্মৃতি মুছে গিয়েছিল তার মাথা থেকে।”

অ্যামনেশিয়া। এটাই একমাত্র ব্যাখ্যা। প্রচণ্ড ভয়ের কারণে ঠিকমতো কিছু ভাবতে পারছি না, কিন্তু এটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না।

“ওকে মারিনি আমি। এখানেও আনিনি।”

“কেন?”

“জানি না কেন, কিছুক্ষণ ভাবার পর বললো সুমিদা। “ঝুঁকি নিয়েছিলাম বলতে পারো।”

“এরপর আগন্তুককে ক্যাফেতে নিয়ে যান তিনি,” হিতোমি বললো প্রফুল্ল কণ্ঠে।

সাওরির সাথে সুমিদার দেখা হয় এক বছর আগে। সে ভেবেছিল মাতাল কাজুয়াকে মেলানকলি গ্রোভে নিয়ে এসেছে সুমিদা। কাজুয়ার আসলে হুশ ছিল না তখন। গোটা ব্যাপারটাই সাজানো।

এরপর কাজুয়ার সাথে বন্ধুর মত সময় কাটাতে শুরু করে সুমিদা।

আমার একদম কাছে চলে এসেছে সে। তার রোগাটে শরীরে খুব বেশি শক্তি ধরে বলে মনে হয় না। কিন্তু আমার মুখ বন্ধ করার জন্যে সেই শক্তিটুকুই যথেষ্ট।

দমবন্ধ করা নিস্তব্ধতা নেমে এলো তলকুঠুরিতে। শ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছি। সুমিদাকে ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে এখন। তার চেহারা কিন্তু ঠিকই আছে। তবে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন বিশ্লেষণ করছে কোন কিছু।

“ঐ ঘটনার পরেই এই বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে স্টেশনের পাশের ঐ অ্যাপার্টমেন্টটায় গিয়ে উঠি। এর আগে তলকুঠুরিটার ব্যবস্থা করে ফেলি অবশ্য।”

সুমিদার কথা বলা শেষ হলেই কি আমার সময় ফুরিয়ে যাবে? হাত পা নাড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম যে আমার মধ্যে এখনও দৌড়ে পালানোর শক্তি অবশিষ্ট আছে কিনা।

“কিন্তু একটা ব্যাপার খুব বেশি অদ্ভুত,” বললাম আমি। “আপনি তো এক বছর ধরে এখানে নেই। তা সত্ত্বেও হিতোমিরা বেঁচে আছে কিভাবে?”

“ক্ষুধা বলে কিছু নেই ওদের। ক্ষতগুলো কখনো শুকাবে না। এরকমই থাকবে সারাজীবন। সময় থেমে গেছে এখানকার অধিবাসীদের। ইচ্ছেমতন গান গাইতে পারবে, কথা বলতে পারবে। তলকুঠুরির দরজার সামনে দেয়ালটা তোলার আগে একটা নতুন বাল্ব এনে এখানে লাগিয়ে দেই। আমি।

প্রায় নিভে যাওয়া বাটার দিকে একবার তাকালো সুমিদা।

“এভাবে কিছু না করে থাকা যায় নাকি,” হিতোমি বললো।

যা করার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই করতে হবে আমাকে। এরপরে আর সুযোগ পাবো না। ভেতরে ভেতরে প্রার্থনা করতে লাগলাম।

“আর সাওরি? তার ব্যাপারে কি মন্তব্য আপনার? ঘটনার পরেও নিয়মিত মেলানকলি গ্রোভে কেন যেতেন? তাকে মনে ধরেছিল?”

ও আমার দিকে তাকালো সে। প্রশ্নগুলোর জবাব দিল না। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার ব্যাপারে নতুন একটা জিনিস জানতে পারলাম।

আমার আরো কাছে চলে এলো সুমিদা। প্রচণ্ড ভয় লাগছে। আর সেই ভয় থেকেই কাজটা করলাম। কাঁধ দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলাম সুমিদাকে। ঘরের পেছন থেকে অনেকগুলো কণ্ঠ একসাথে কথা বলে উঠলো যেন।

এত জোরে ধাক্কা দিয়েছি যে আমি নিজেও তাল হারিয়ে ফেললাম।

কিন্তু সুমিদার অবস্থা সঙ্গিন। পেছনে ঝুলানো বৰ্শিগুলো তার জামায় পেঁচিয়ে গেছে।

দৌড় দিলাম। জানি যে খুব দ্রুত পিছু নিবে সে।

সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। নামার সময় খুব বেশি ধাপ মনে হয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অনন্তকাল পেরিয়ে যাবার পরেও সিঁড়ির মাথায় পৌঁছতে পারবো না। তবে এক সময় ঠিকই বেরিয়ে এলাম বাইরে। হয়তো আমার কাছে কয়েক সেকেন্ডকেই অনেক বেশি লম্বা মনে হচ্ছিল ভেতরে।

সামনের দরজার উদ্দেশ্যে দৌড় দিলাম। বেশি সময় লাগলো না কালো দরজাটার সামনে পৌঁছুতে। ওটার নব ধরে মোচড় দিলাম। কিন্তু খুব বেশিদূর খুললো না দরজাটা। বারবার চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। এসময় খেয়াল করলাম একটা এক্সটেনশন কর্ড পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে নবের সাথে। অনেক সময় লাগবে এটা খুলতে।

সুমিদার কাজ।

পেছনের দরজাটার কথা মনে হলো এসময়। আবারও হলওয়ে ধরে ছুটে চললাম। সিঁড়ি পেরিয়ে একটু সামনে গিয়েছি এসময় কিছু একটায় পা বেঝে পড়ে গেলাম। সুমিদা যে আড়াল থেকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে তা টের পাইনি। একটা ঘরের খোলা দরজার সাথে ধাক্কা খেলাম, কিন্তু কোন ব্যথা পেলাম না। যেন বালিশের সাথে ধাক্কা লেগেছে।

দৌড়াতে পারবো ভেবে উঠতে যাবো এসময় চোখে পড়লো ব্যাপারটা। আমার ডান পাটা ঘুরে গেছে বিপরীত দিকে। কিন্তু ব্যথার বদলে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা অনুভব করছি সেখানে।

আমার শরীরে কি ঘটছে বুঝে উঠতে পারলাম না। ভয়ের কারণে বোধহয় সাময়িক ব্যথার অনুভূতি লোপ পেয়েছে।

সুমিদা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। গালে কাটা দাগ। নিশ্চয়ই একটা বর্শি বিধে গেছিল সেখানে। পরনের জামাটাও কয়েক জায়গায় ছেঁড়া। হাচড়ে পাঁচড়ে নিজেকে ছাড়িয়ে এনেছে।

পকেট থেকে ছোট ছুরিটা বের করলাম। আমার হাত কাঁপছে। এত ছোট ছুরি দিয়ে কিছু হবে কিনা জানি না, কিন্তু এটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে।

ছুরিটা খোলা মাত্র আমার হাতে জোরে লাথি কষালো সুমিদা। এবারেও কোন ব্যথা অনুভব করলাম না। মনে হলো কেউ আলতো করে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়েছে হাতটা।

পড়ে যাওয়া ছুরিটা তুলে নিল সুমিদা। আমি বুঝছি যে পালানো উচিৎ কিন্তু নড়তে পারছি না।

এর পরের কয়েকটা মুহূর্তে কি ঘটলো ঠিক ধরতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম ছুরি ধরা হাতটা আমার পেটের কাছে ঠেসে রেখেছে সুমিদা। হাত দিয়ে তাকে সরাতে গিয়ে বুঝলাম হাতটা নড়ছে না। একদৃষ্টিতে আমার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে সুমিদা। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে এবার আমিও তাকালাম। শার্টটা ছিঁড়ে গেছে। ছুরির ফলাটা ঢুকে আছে আমার পেটের ভেতরে। ক্ষতস্থানের চারিদিকে লাল রক্ত, তবে পরিমাণ খুব বেশি না।

একটা অদ্ভুত জিনিস ঝুলছে ক্ষতস্থান থেকে। দেখতে অনেকটা সদ্য জন্মানো বাচ্চাদের নাড়ির মতন।

সুমিদার হাতের দিকে তাকালাম। লাল হয়ে আছে ওদুটো। আমার পেটের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিল সে। নাড়িটা টেনে বের করার জন্যে বোধহয়।

সেই মুহূর্তে চিন্তা চেতনা লোপ পায়নি এর একমাত্র কারণ আমার মনে হচ্ছিল অন্য কারো পেটের দিকে তাকিয়ে আছি। পেট থেকে যে জিনিসটা বেরিয়ে আছে, সেটা অন্য কারো। ডান হাত দিয়ে নাড়িটা ধরলাম, এখনও উষ্ণ।

হাতের স্পর্শ পাওয়া মাত্র এক অবর্ণনীয় সুখে ছেয়ে উঠলো গোটা শরীর। তলকুঠুরির বাসিন্দারা কেন সুমিদাকে ভয় পায় না এটা পরিষ্কার এখন। মনে হচ্ছে যেন আরামদায়ক উষ্ণ পানিতে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছি।

দূর থেকে সুমিদার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

পালাবার পথ নেই।

ক্ষতস্থান থেকে থকথকে কি যেন বেরিয়ে এলো। হাত সরিয়ে নিলাম দ্রুত। আমার ভেতরের একটা অংশ এই নিগূঢ় আনন্দের বিরোধীতা করছে অনেকক্ষণ যাবত।

হঠাৎই নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলাম। সুমিদা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরার চেষ্টা করেও পারলো না। পাশের ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। কিন্তু তালা দেয়ার জন্যে নব খুঁজতে গিয়ে দেখি কোন নব নেই। জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। একটা পায়ে সবকিছু করতে হচ্ছে। অন্য পাটা সম্পূর্ণ অচল।

পেছনে দরজা খুলে গেল এই সময়। সুমিদা এসে পড়েছে আবারো। সে জানে যে পালাতে পারবো না আমি। শান্ত দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো কি করি।

জানালাটা খুলতে খুব বেশি বেগ পেতে হলো না। এটাও যদি শক্ত করে আটকানো থাকতো, তাহলে ভাঙার চেষ্টা করতে হতো আমাকে। চারকোনা জায়গাটা দিয়ে বাইরে মাথা গলিয়ে দিলাম। উপুড় হয়ে পড়লাম মাটিতে। এভাবে পড়ার কারণে ভেতর থেকে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল। তবে এখনও কোন ব্যথা অনুভব করতে পারছি না।

মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় বুঝতে পারলাম একটা প্ল্যান্টারের পাশে পড়েছি। আমার চোখের সামনেই তলকুঠুরির জানালা ঢেকে দেয়া নীল ইটের ছোট দেয়াল। এখানেই এসেছিল এক বছর আগে কাজুয়া। ঈশ্বর বোধহয় আজ আমার সাথে কৌতকে মেতে ওঠার পণ করেছেন।

কিছুক্ষণ পর সুমিদা বাইরে বেরিয়ে এলো জানালা দিয়ে।

উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই আমার। “এসব কেন করেন?” মাটি থেকেই জিজ্ঞেস করলাম তার উদ্দেশ্যে।

“জানি না,” সুমিদাকে দেখে মনে হচ্ছে এই প্রশ্নটার উত্তর কখনো খোঁজার চেষ্টা করেনি সে। “এমনটা না যে মানুষ মারতে ভালো লাগে আমার। কিন্তু তাদের মুখ বন্ধ করার জন্যে মারতে হয়।”

বুকে ভর দিয়ে সামনে এগোনোর চেষ্টা করলাম। আমার বাম হাতের আঙুলগুলোয় কোন সাড়া নেই। কিন্তু কনুই অবধি নাড়াতে পারছি। বাম পা দিয়ে মাটিতে ঠেলা দিয়ে সামনে এগোলাম কিছুটা। ডান পা কাজ করছে না।

মাটিতে এভাবে পড়ে থাকলে ঠান্ডা অনুভব করার কথা, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। শুধু ধুলোবালির অস্বস্তিকর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। পেট থেকে নাড়ি বেড়িয়ে আছে সেটা না ভাবার চেষ্টা করলাম।

সুমিদা আমার পাশে পাশে হাঁটছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে, এটা বুঝতে পারছি।

“দু’মাস আগে কাজুয়া কি আসলেও দুর্ঘটনায় মারা গেছে?” মাটির দিক থেকে মাথা না তুলেই জিজ্ঞেস করলাম।

আমার মনে ক্ষীণ আশা যে যতক্ষণ এভাবে কথা বলবো, আমাকে মারবে না সুমিদা।

হাতে ভর দিয়ে আর মাথা উঁচু করে রাখা সম্ভব হলো না। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়লাম।

“এমনভাবে সব সাজিয়েছি যেন দেখে মনে হয় দুর্ঘটনা।”

আমার পেট থেকে বের হয়ে থাকা লম্বা সরু জিনিসটায় পা রাখলো সুমিদা। সামনে এগোচ্ছি এখনও। এটা বুঝতে পারছি যে পেট থেকে এখনও বের হয়ে আসছে ওটা। শব্দও শুনতে পাচ্ছি।

“চোখে কাপড় বেঁধে হাত পা ভেঙে দেই প্রথমে। এরপর একটা ঢালের ওপর থেকে গাড়ির সামনে ছেড়ে দিইয়েছিলাম।”

সুমিদা বললো যে কাজুয়াকে ধাক্কা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে চোখের কাপড়টা সরিয়ে নেয় সে। কাজয়া বুঝতে পারে না যে তার হাত পাগুলো কেন কাজ করছে না।

বাড়িটায় এক কোনায় পৌঁছে গেছি আমি। ভালো হাতটা দিয়ে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম সেখানকার দেয়াল।

আমার নাড়ি কত লম্বা? হাতে ভর দিয়েই এতদূর এসেছি। মাটিতে আমার দেহ ছেচড়ানোর দাগ। সুমিদা এখনও পা দিয়ে চেপে রেখেছে। আমার নাড়ির এক প্রান্ত।

এটুকু এসে সামনে এগোনো থামিয়ে দিলাম। খুব কসরত করে উঠে বসে দেয়ালে হেলান দিলাম। এরপর ধুলো আর চোখের পানিতে একাকার চেহারাটা সুমিদার দিকে ঘুরিয়ে বললাম, “এরকম একটা কাজ কেন করলেন?”

“কাজুয়ার স্মৃতি ফিরে আসতে শুরু করেছিল। একবারে না, ধীরে ধীরে।

সুমিদা তাহলে ভয় পেয়ে গেছিল যে কাজুয়ার সব মনে পড়ে যাবে। এজন্যেই তাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়াটা জরুরি হয়ে পড়েছিল তার জন্যে।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সুমিদা। মাটিতে বসে থাকায় তাকে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা দেখাচ্ছে। “যথেষ্ট হয়েছে, নাকি?” যেন কোন ছোট বাচ্চার সাথে কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বললো সে। “তোমার ভাগ্য খারাপ দেখে তলকুঠুরিটা খুঁজে পেয়েছে।”

নিচু হয়ে আমার গলায় হাত রাখলো সুমিদা। ওর মুখটা আমার মুখ থেকে একটু দূরে এখন।

“কোন কষ্ট হবে না। ঘাড় মটকানোয় দক্ষ হয়ে গেছি আমি।”

ধীরে ধীরে ডান হাতটা সরিয়ে আনছি। আমি যেখানে বসে আছি তার পাশেই একটা ড্রেন। ভেতরে শুকনো, মরা পাতা। জিনিসটা আগের জায়গাতেই আছে তাহলে।

“ভুল বললেন,” কান্না চেপে বললাম। “আমার ভাগ্য খারাপ না। আপনাকে খুঁজে পাবার কথা বলেই পেয়েছি।”

শরীরের শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে জিনিসটা সুমিদার ভেতরে সেঁধিয়ে দিলাম। এক বছর ধরে এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিল কাজুয়ার স্ক্রু ড্রাইভারটা।

.

১২

রূপকথার রচয়িতা

অচেতন ছেলেটার দিকে এগিয়ে গেল মিকি। খুবে বেশি ব্যথা পায়নি বলেই মনে হচ্ছে।

তাকে মেরে ফেলবে নাকি তলকুঠুরিতে নিয়ে যাবে সেই সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে মিকিকে।

এমন সময় গুঙিয়ে উঠলো ছেলেটা। এর আগেরদিন যখন মিকির বাসায় এসেছিল সে, চোখে ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। এখন ব্যান্ডেজটা নেই।

এক চোখ হালকা খুললো ছেলেটা। বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালো মিকির দিকে।

মিকি জানে যে এখান দিয়ে অন্য কেউ যাবার আগেই ছেলেটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে হবে তাকে। সেই কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সময় কথা বলে উঠলো কাজুয়া, “আমি… আমি কোথায়?”

তাকে টেনে রাস্তার একপাশে নিয়ে এলো মিকি। কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো। ছেলেটার শেষ স্মৃতি হচ্ছে একটা ক্যাফেতে বসে কফির অর্ডার দেয়া।

“আপনার নাম কি?” জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা।

“সেটা না জানলেও চলবে।”

যেন স্বপ্ন দেখছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়লো ছেলেটা।

এখনও হাতুড়িটা ধরে রেখেছে মিকি। ওটা ওপরে উঠালো সে। মাথায় জোরে একটা বাড়ি দিলেই মারা যাবে ছেলেটা।

ছেলেটা বারবার জ্ঞান হারাতে গিয়েও হারাচ্ছে না। “আমাকে… আমাকে মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছে দিতে পারবেন?” কিছুক্ষণ পর ক্ষীণকণ্ঠে বললো সে।

মিকি সিদ্ধান্ত নিল ছেলেটাকে মারবে না সে। যদি আসলেও স্মৃতি হারিয়ে ফেলে তাহলে অযথা মারার কোন দরকার নেই। তাছাড়া সব প্রমাণ মুছে ফেলা সহজ হবে না। ছেলেটার মৃতদেহ রাস্তার পাশেই ফেলে রেখে যেতে হবে, অথবা বাড়িতে টেনে নিয়ে যেতে হবে। দুটোই বিরক্তিকর।

হাতুড়িটা পাশের ঝোপে ছুঁড়ে ফেলে ছেলেটাকে উঠিয়ে ক্যাফের দিকে রওনা হয়ে যায় সে। এর আগে কখনো ভেতরে না গেলেও বাইরে থেকে জায়গাটা দেখেছে মিকি।

মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রাত হয়ে যায়। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টগুলো অনেক দূরে দূরে। তাই ক্যাফেটাকে দেখে মনে হয় যেন শূন্যে ঝুলছে।

ওখানে পৌঁছানোর আগেই হুশ হারিয়ে ফেলে ছেলেটা। মিকি কাঁধে করে তাকে দরজার সামনে নিয়ে যায়।

“কাজুয়া!” বলে দৌড়ে আসে কাউন্টারের পেছনে বসে থাকা যুবতী।

একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে দেয় মিকি।

“আমি দুঃখিত যে আমার ভাইয়ের কারণে আপনাকে এত কষ্ট করতে হলো,” বারবার ওর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে মেয়েটা।

মিকি তাকে বলে যে মাতাল হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল কাজুয়া। ভাইয়ের শরীর থেকে অ্যালকোহলের গন্ধ না পেলেও এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি সাওরি।

“মাথায় ব্যথা পেয়েছে ও,” বলে সে। “ফুলে গেছে।”

মিকি বলে যে ক্যাফেতে আসার সময় রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় কাজুয়া। তখনই ব্যথা পেয়েছে।

আশপাশে তাকিয়ে অন্য কোন খদ্দের চোখে পড়েনা মিকির। সাওরি যে ক্যাফের মালিক না সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না তার। এত কম বয়সে এরকম একটা জায়গায় ক্যাফে খোলার কথা না কারো।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে মিকি। পেছন থেকে তাকে ডাক দেয় যুবতী, কিন্তু না শোনার ভান করে সে।

অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় অচেতন ছেলেটাকে নিয়ে ভাবতে থাকে সে। কাউন্টারের পেছনে বসে থাকা যুবতাঁকে নিয়েও ভাবে। ছোটবেলায় সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা যায় মিকির এক বান্ধবী। যুবতীর চেহারাটা একদম তার মতন।

এসময় সে খেয়াল করে যে পকেটে থাকা জিনিসটা আনমনেই নাড়াচাড়া করছে এক হাতে-একটা সোনালি রঙের ঘড়ি। মিকির বাড়ির বাইরে ঘোরাফেরার সময় হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল বোধহয় ওটা।

থমকে দাঁড়ায় সে। এটা ফেরত দেয়ার কোন দরকার নেই।

 কিন্তু কিছুক্ষণ পর তাকে দেখা যায় ক্যাফের ভেতরে ঢুকছে।

সে যতটুকু ভেবেছিল, তার চেয়েও বেশি খুশি হয় যুবতী ঘড়িটা দেখে। “এটা দেয়ার জন্যে এতদূর ফিরে এসেছেন! আপনার নাম কি?” আন্তরিক ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে সে।

একদম ওর মতো চেহারা।

নিজের আসল নামটা বলে মিকি।

“আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, সুমিদা,” বলে ঘড়িটা নিচে নামিয়ে রাখে মেয়েটা।

মিকি বাইরে বেরুনোর জন্যে ঘুরে দাঁড়ানোয় তার হাত আঁকড়ে ধরে সে। “প্লিজ, এক কাপ কফি খেয়ে যান।”

না করতে পারে না সুমিদা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *