২. রূপকথার গল্পকার

দ্বিতীয় খণ্ড

রূপকথার গল্পকার

মিকি স্বপ্নে দেখলো যে আকাশ থেকে বৃষ্টির মতন মানুষ ঝরে পড়ছে।

একটা বড় বিল্ডিংয়ের ছাদে দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ঝরে পড়া মানুষগুলোকে একদম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

প্রত্যেকের পরনে কালো স্যুট। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই একই পোশাক পরে আছে। আকাশ থেকে অনবরত পড়েই চলেছে একের পর এক। মেঘমুক্ত বেগুনি আকাশে ছোট ছোট তারার মত দেখাচ্ছে মানুষগুলোকে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। তবে কারো চোখে কোন ভয় নেই।

নিচের শহরের দিকে তাকালো মিকি। অসংখ্য দেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারদিকে। লাল রঙ্গে রাঙিয়ে দিয়েছে গোটা শহর। আশপাশের সবগুলো ছাদ ভরে উঠেছে দুমড়ে যাওয়া শরীরে। কিন্তু মিকি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে একটা দেহও পড়েনি।

ঘুম ভেঙে গেল মিকির। উপন্যাসটার খসড়া সম্পাদনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কয়েকটা প্রিন্ট দেয়া কাগজ পড়ে আছে মাটিতে। ওগুলো তুলে নিল সে।

– “ঘুম ভেঙেছে তাহলে?” কাউচ থেকে মাথা বাঁকিয়ে বললো কিশোরী মেয়েটা। “প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ঘুমিয়েছেন। বোর হচ্ছিলাম।”

কাগজগুলো টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখলো মিকি। টেবিলটা একটা অ্যান্টিক। অনেক বয়স, জটিল নকশা ভোলা গায়ে। গত ভাড়াটিয়ার রেখে যাওয়া জিনিস।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো সে। সূর্যাস্তের বেশি দেরি নেই। রক্তিম আকাশের নিচে সবুজ গাছগুলোকে কালো দেখাচ্ছে এখন। পর্দা টেনে দিল মিকি। এগুলোও তার নিজের নয়, আগের কারো। পর্দাগুলো পুরু হওয়াতে আলো প্রবেশের সুযোগই পায়না ফাঁক গলে।

“একটা গল্প বলুন না, কাউচে একবার নড়ে উঠে বললো মেয়েটা।

“ঐ কাক আর মেয়েটার গল্প না কিন্তু। চোখ উপড়ে নেয়ার কাহিনি শুনতে শুনতে বিরক্তি ধরে গেছে। অন্য কিছু বলুন।”

কিছুদিন আগে প্রকাশিত ‘চোখের স্মৃতি’ গল্পটার কথা বলছে মেয়েটা। অবসর সময়ে এটা তাকে পড়ে শোনায় মিকি।

“আপনার ছেলেবেলার কাহিনি বলুন না,” মেয়েটা কথা বলে উঠলো আবারো। “চমৎকার বুদ্ধি দিয়েছি না? আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন অনেক দিন হতে চললো। কিন্তু এখনও আপনার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানি না।” একটা মৃদু হাসি ফুটলো তার চেহারায়। “শান মিকি কি আপনার আসল নাম?”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিল সে। মিকি হচ্ছে তার ছদ্মনাম।

কাউচে বসে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো সে। তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিল স্নেহের ভঙ্গিতে। এরপর অতীত রোমন্থন শুরু করলো।

*

ওর বাবা ছিল একজন ডাক্তার। বড় হাসপাতালের সার্জন। তাই ছেলেবেলার বেশির ভাগ সময় হাসপাতালেই কেটেছে। ওটাই ছিল তাদের বাড়ি।

ছেলেবেলার কথা বলতেই তাই প্রথমে তার বাড়িতে থাকা রোগীদের কথা মনে পড়ে যায় মিকির। হাসপাতালের করিডোরগুলোতে খেলনা গাড়ি আর প্লেন নিয়ে দৌড়ে বেড়াতে সে। কেবিনে শুয়ে কোকাতে থাকা নানা বয়সী লোকজন ছিল নিত্যদিনের দৃশ্য। কারো হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ করা আবার কারো পা প্লাস্টার করে স্ট্যান্ডের সাথে ঝোলানো। তাকে দেখলে সবসময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো রোগীরা।

গ্রেড স্কুলে থাকতে প্রতিবেশী কিছু ছেলের সাথে পোকামাকড় ধরতে যেত মিকি। তাদের বাড়ির পাশেই ছিল পরিত্যক্ত একটা জমি। সেটার মালিক কিছু না করেই দিনের পর দিন ফেলে রেখেছিল জায়গাটা। তাই আগাছাও জন্মেছিল মনের সুখে। সন্ধ্যাবেলা ঝিঁঝি পোকার ডাকে কান পাতা দায়। এছাড়াও গুবড়ে পোকা বা ঘাস ফড়িংয়ের কোন অভাব ছিল না। চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতে তার এক বন্ধু নতুন খেলা আবিষ্কার করে। ঘাসফড়িং ধরে সেগুলোকে সুঁই দিয়ে গুতিয়ে গুতিয়ে হত্যা করা। একটা কাঠের বোর্ডে পোকাগুলোকে গেঁথে মিকিকে দেখায় তার বন্ধু। কিছুক্ষণ আগেই গাঁথা পোকাগুলোকে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে নিথর হয়ে যায়।

মিকি নিজেও খেলাটার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। একটা ঘাসফড়িং ধরে এনে বাসা থেকে নিয়ে পুঁইগুলো সেটার পেটে গেঁথে দেয়। কিন্তু ঘাসফড়িংটা মরে না।

ব্যাপারটা স্বাভাবিক ভাবেই নেয় সে। ধরে নেয় যে ভাগ্যবশত সুঁই কোন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ভেদ না করেই ভেতরে ঢুকে গেছে। তাই পোকাটার গায়ে আরো তিনটা সুঁই ফোঁটায় সে।

একটা মাথায়, একটা গলায় আর একটা পেটে। তবুও নড়তেই থাকে ঘাসফড়িংটা। ছয়টা পা-ই এমনভাবে নাড়াচাড়া করছে যেন কিছুই হয়নি। মাথার ওপরের অ্যান্টেনা দুটোও নড়ছে ক্রমাগত-এদিকে শরীরের ভেতর থেকে থকথকে তরল বেরিয়ে এসেছে আগেই।

বারোতম পিনটা ফোঁটানোর পরে অবশেষে মারা গেল ঘাসফড়িংটা। তবে পুঁই আর পিনের ভিড়ে সেটাকে দেখা দায় এখন।

অন্য পোকাগুলোর ক্ষেত্রেও একই ফলাফল পেলো মিকি। একটা গুবড়ে পোকাকে দেয়ালে কয়েক বার ছুঁড়ে মারার পরেও মারা গেল না সেটা। পুরো শরীর ফেটে গেলেও মাথার শিং দু’টো ঠিকই নড়ছিল।

মিকি ধরে নেয় যে সব পোকামাকড় এরকমই হয়। একবার কেচি দিয়ে একটা ঘুঘুরে পোকাকে দু’ভাগ করে দিয়েছিল, আবার আরেকটা গুবড়ে পোকার মাথা ধড় থেকে আলাদা করে দেয়। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই কিছুক্ষণ হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করে পোকাগুলো। মরতেই চায় না। সব গোঁয়ারের দল, ভাবে সে।

কিন্তু এক পর্যায়ে মিকি বুঝতে পারে যে ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক নয়। অন্যান্য বাচ্চারা খুব সহজেই পোকাগুলোকে মেরে ফেলে। হয়তো আমি এমন পোকাগুলোকে ধরেছি যেগুলোর জীবনীশক্তি অন্যগুলোর চাইতে বেশি, নিজেকে প্রবোধ দেয় সে। কিন্তু তার হাতের দিকে তাকানো পরে মনে হয় কি যেন একটা ঠিক নেই।

আমার ভেতরে অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে।

একবার মিকির বয়সী একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছিল হাসপাতালে। খেলতে খেলতে তার ঘরে একদিন ভুল করে ঢুকে পড়ে সে। বন্ধুত্ব হয়ে যায় দু’জনের। প্রায়ই তার সাথে দেখা করতে আসততা মিকি।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু খুব বেশি ছিল না মিকির। এমনকি তার সাথে পোকা ধরতে যারা, তারাও নতুন বন্ধু খুঁজে নিয়েছে। তাই প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরে মেয়েটার সাথে কথা বলতে যেত সে।

মিকিকে দেখামাত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠতো মেয়েটার চোখমুখ। নিজের ব্যান্ডেজ করা হাত দুটো মিকির উদ্দেশ্যে নাড়ে সে। অবশ্য তার দু’হাতই কনুইয়ের কাছে এসে শেষ হয়ে গেছে। রেললাইনের পাশে খেলতে গিয়ে ও দু’টো খোয়াতে হয়েছে তাকে।

“আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম যে হাতের ওপর দিয়ে ট্রেন চলে গেলে কি হয়,” নিরাবেগ কণ্ঠে মিকিকে বলে মেয়েটা। “কিন্তু ওমা! ট্রেনের চাকা হাতের ওপর ওঠার পরেই অর্ধেকটুকু আলাদা হয়ে গেল!”

তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে মিকির। বাবা আর মা’র লেকচার থেকে বিভিন্ন গল্প বানিয়ে তাকে বলতো সে।

*

একদিন জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল ওরা দু’জন, এমন সময় সংকটাপন্ন এক রোগীকে ভর্তি করা হয় সেখানে। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরে উঁকি দেয়ার চেষ্টা করে দু’জনই। লোকটা কতটা ব্যথা পেয়েছে, সেটা দেখাই উদ্দেশ্যে।

মিকির বাবা আর কয়েকজন নার্স তাড়াহুড়ো করে প্রস্তুতি নিয়ে প্রবেশ করে ভেতরে। সেসময় এক ফাঁকে রোগীকে দেখার সুযোগ পায় মিকি। কম বয়সী এক তরুণ, সারা শরীরে দৃশ্যমান কোন ক্ষত নেই।

কিন্তু অপারেশন চলাকালীন সময়ে মারা যায় সে।

“খুব খারাপ একটা জায়গায় ব্যথা পেয়েছিল, মিকির বাবা বলেন পরবর্তী সময়ে। সাইকেল থেকে পড়ে গিয়েছিল ছেলেটা।

“খারাপ জায়গা আবার কোনটা?” মিকির বান্ধবী জিজ্ঞেস করে। সেই জায়গাটা ঠিক থাকলে সবাই বেঁচে থাকবে?”

“কারো কি এমন ক্ষমতা থাকতে পারে যে সে কাউকে আহত করার সময় অবচেতন ভাবেই ঐ খারাপ জায়গাগুলো এড়িয়ে যায়?”

“কি জানি ভাই,” মেয়েটা হাত ভাঁজ করার ভঙ্গি করে জবাব দেয়। তবে তার হাত দুটো কনুইয়ের কাছাকাছি এসে শেষ হয়ে যাওয়ায় সে আর পুরোপুরি হাত ভাজ করতে পারবে না কখনোই।

*

এরপর মিকি ঘাসফড়িং ধরে এমনভাবে সেগুলোকে আহত করার চেষ্টা করে যাতে ওগুলো মারা যায়। প্রথমদিকে ধরা পোকাগুলো বেশ তাড়াতাড়ি মারা যেতে লাগলো। এই যেমন তাদের শরীরে বারো-চৌদ্দটা পিন ফুটালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু পরবর্তীতে ধরা পোকাগুলো আরো বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকলো।

তার ধরা একদল গুবড়ে পোকার নিচের অর্ধেকটুকু শরীর থেকে আলাদা করে দেয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেও সেগুলো দিব্যি বেঁচে রইলো। এরপর ধুকে ধুকে মারা গেল কিছুদিনের মধ্যে। কিন্তু মাথা পিষে ফেললে বা কেটে ফেললে সাথে সাথেই মারা যায়।

একটা ব্যাঙ ব্যবচ্ছেদ করলো মিকি, একটা মাছ কেটে ভেতর থেকে সব কিছু বের করে পানিতে ছেড়ে দিল। কিছুক্ষণ এমন ভঙ্গিতে সাঁতার কাটলো ওগুলো যেন কিছুই হয়নি। ব্যাঙটার ক্ষতস্থান থেকে অবশ্য নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসে পানিতে ভাসছে লম্বা সুতোর মতন।

চারপেয়ে জন্তুদের ওপরেও পরীক্ষা করলো মিকি। একটা বিড়ালকে ফাঁদ পেতে ধরলো সে। এরপর হাসপাতালের পেছনে খালি জায়গাটায় নিয়ে মাঝামাঝি ছুরি দিয়ে কেটে অর্ধেক করে ফেললো। কিন্তু বিড়ালটা মরলো না। নিজের সম্পর্কে আরেকটা অদ্ভুত তথ্য আবিষ্কার করলো মিকি। সে যেসকল প্রাণীর অঙ্গহানি করে, তারা কোন প্রকার ব্যথা বা কষ্ট অনুভব করে না।

বিড়ালটা বুঝতেও পারেনি যে মিকি তাকে দু’ভাগ করে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর পেছনে পা চাটতে গিয়ে অসঙ্গতিটা চোখে পড়ে তার। খুব বেশি রক্তও ঝরেনি। ক্ষুধা আর তৃষ্ণার অনুভূতি বহাল তবিয়তে আছে। যে খাবারগুলো খায় সেগুলো একটু পরেই কাটা পেট দিয়ে বেরিয়ে আসে। তবে পরবর্তী এক সপ্তাহে তার শারীরিক ক্ষমতা ধীরে ধীরে কমে আসে এবং এক পর্যায়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

আরেকটা বিড়াল নিয়ে এসে পরীক্ষা করে মিকি। তবে এই বিড়ালটা বাঁচে দুই সপ্তাহ, কোন প্রকার খাবার বা পানীয় ছাড়াই।

বান্ধবীকে নিজের এই আবিষ্কারের কথা জানানোর জন্যে উদগ্রীব হয়ে ওঠে মিকি। হাসপাতাল থেকে চলে গিয়েছে সে কিছুদিন আগে। তবে বাসা খুব বেশি দূরে নয়। সাইকেলে করে যেতে আধঘণ্টার মত লাগে।

তার বাসার সামনে সাইকেলটা রেখে দরজায় কড়া নাড়লো মিকি। দরজা খুলে দেয় মেয়েটার মা। একরম নিস্পৃহ কণ্ঠেই পরবর্তী কথাগুলো বলেন তিনি। “গত পরশু দিন মারা গেছে ও। সিঁড়ির রেলিং বেয়ে নিচে নামতো সবসময়। কিন্তু আগে হাত ঠিক ছিল তাই ভারসাম্য রক্ষা করতে সমস্যা হতো না। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরে ও প্রায়ই ভুলে যেত যে কনুইয়ের নিচ থেকে হাত দুটো আর নেই। তাই এবারে রেলিং বেয়ে নামতে শুরু করার পর হয়তো ভুলটা বুঝতে পারে…কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়।

*

হাই স্কুলের তৃতীয় বর্ষে থাকার সময় প্রথম খুন করে মিকি।

বেশ ঠান্ডা পড়েছিল সেদিন। নিজের মোটর সাইকেলে চড়ে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল মিকি। কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য ছিল না মনে। প্রায়ই এরকম উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতো সে।

একটা পাহাড়ি পথ বেয়ে উপরে উঠছিল ঘুরে ঘুরে। এমন সময় রাস্তার পাশে বেশ চওড়া একটা খালি জায়গা চোখে পড়ে। দুটো গাড়ি পার্ক করা যাবে সেখানে। এমনকি দু’টা ভেন্ডিং মেশিনও ছিল।

সেখানে মোটর সাইকেল থামালো মিকি। আর কেউ ছিল না আশেপাশে। রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালে নিচের চমৎকার দৃশ্য মন ভরে উপভোগ করা যায়। তবে একটু সামনে এগোলেই মোটামুটি গভীর একটা খাদ। একটা সিঁড়ি নেমে গেছে দুই রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে।

কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্য দেখলো সে। ছাইরঙা মেঘগুলোর প্রভাবে আশপাশের সবকিছুর মধ্যেই এক ধরনের ধূসরতার ছাপ। হেমন্তের সবুজও কিছুটা মলিন হয়ে গেছে। এসময় একটা গাড়ি এসে থামলো সেখানে। ড্রাইভিং সিট থেকে এক তরুণী বের হয়ে এসে রেলিংয়ের ধারে দাঁড়ালো। একাই এসেছে সে। পরনে বিজনেস স্যুট, হাতে মাঝারি সাইজের একটা ম্যাপ।

“আমি শহরে যেতে চাইছি যত দ্রুত সম্ভব,” মিকির উদ্দেশ্যে বললো সে। “আপনি কি একটু পথ দেখিয়ে দিতে পারবেন?” এরপর মোটর সাইকেলটা দেখে মিকিকে জবাব দেয়ার সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে, “আপনার বাইকটা দারুণ। কিন্তু এরকম আবহাওয়ায় বাইক চালাতে অসুবিধে হয় না? ঠান্ডা একদমই ভালো লাগে না আমার,” একবার রেলিংয়ের ঠান্ডা হাতল ধরেই পিছিয়ে গেল সে।

কিন্তু বেশিদূর পেছাতে পারলো না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জোরে ধাক্কা দিয়ে তাকে নিচে ফেলে দিল মিকি। রেলিংটা বেশ নিচু হওয়াতে, চেষ্টা করেও সেটা আঁকড়ে ধরতে পারলো না তরুণী। ধাক্কা দেয়ার পর আশপাশে তাকিয়ে মিকি লক্ষ্য করলো যে কোন প্রত্যক্ষদর্শী আছে কিনা।

এরপর নিচে তাকিয়ে দেখলো কোথায় পড়েছে মেয়েটা। প্রথমে চোখে পড়লো না। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর খেয়াল করলো যে একটা বড় গাছের ছায়ায় পাথুরে পাহাড়টা থেকে কিছুটা দূরে নিথর পড়ে আছে তরুণীর দেহ। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলো সে।

এত ওপর থেকে নিচে পড়ার পরেও বেঁচে আছে মেয়েটা। হাত পাগুলো অবশ্য বিপজ্জনক ভঙ্গিতে বেঁকে আছে। চোখ আর মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। হতভম্ব ভঙ্গিতে মিকিকে দেখছে সে। ম্যাপটা পড়ে আছে পাশেই। মিকি তুলে নিল সেটা।

একবার পেছনে তাকিয়ে ঢালটা দেখলো মিকি। নিচে একটা বেশ লম্বা পাথর। সেটাতেই নিশ্চয়ই মাথা ঠুকে গেছে মেয়েটার। অনেক ওপরে রুপালি রেলিংটা দেখা যাচ্ছে। চকচক করছে ক্ষীণ আলোতেও।

মেয়েটাকে টেনে বনের আরো ভেতরে নিয়ে এলো মিকি, যাতে ওপর থেকে কেউ কিছু দেখতে না পায়। তার ঠোঁট নড়ছিল গোটা সময়, কিন্তু কোন শব্দ শোনা যাচ্ছে না; গাছের একটা বড় ডাল এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে তার বুক, সে কারণেই বোধহয়। ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে রক্তাক্ত ফুসফুস দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। একটা মোটামুটি সাইজের গর্ত সেখানে এখন। স্পন্দনরত হৃৎপিণ্ডটাও দেখতে পেল মিকি।

অবশ্য তরুণীকে দেখে মনে হচ্ছে না যে সে কোন প্রকার শারীরিক কষ্ট অনুভব করছে। বরং একটা শূন্য দৃষ্টি তার চোখজোড়ায়। এত ওপর থেকে পড়ায় শরীরের সবগুলো হাড়ি ভেঙে যাবার কথা। তাই শুধু মুখ আর চোখই নাড়াতে পারছে কোনরকমে।

সম্মতি প্রকাশের জন্যে দু’বার আর অসম্মতি প্রকাশের জন্যে একবার চোখের পাতার নাড়াবার নির্দেশ দিল তাকে মিকি।

“বুঝতে পারছেন কি বলছি?”

দু’বার নড়লো চোখের পাতা। অর্থাৎ তার কানও কাজ করছে।

এরপর সে জিজ্ঞেস করলো যে কোন প্রকার ব্যথা অনুভব করছে কিনা।

একবার চোখের পলক পড়লো। করছে না।

সে ভয় পেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলো মিকি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটা। এরপর ম্যাপটার দিকে ইশারা করলো চোখ দিয়ে।

তার সামনে ম্যাপটা খুলে শহরে পৌঁছবার দ্রুততম পথটা দেখিয়ে দিল মিকি। এরপর জিজ্ঞেস করলো কেবল এই উত্তরটাই জানার ছিল কিনা তার। দু’বার চোখের পলক পড়লো।

মেয়েটাকে বিদায় জানিয়ে উঠে পড়লো মিকি। ঘুরতে যাবে এসময় প্রবলভাবে কেঁপে উঠলো মেয়েটার চোখজোড়া। যেন তাকে জিজ্ঞেস করতে চাইছে, এখন কি হবে আমার?

মিকি আমলে নিল না প্রশ্নটা। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে মোটর সাইকেলে চেপে বসলো। মেয়েটার গাড়ির ইঞ্জিন এখনও চালু। প্যাসেঞ্জার সিটের জানালা দিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল সে। এরপর যা যা

স্পর্শ করেছে সবখান থেকে নিজের হাতের ছাপ মুছে ফেললো।

পরদিন আবারো জায়গাটায় এলো সে। গাড়িটা এখনও আগের মতনই আছে। নিচে মেয়েটাকে দেখতে গেল সে।

এখনও বেঁচে আছে তরুণী। মিকিকে দেখে স্বস্তির একটা হাসি ফুটলো তার মুখে।

মিকি জিজ্ঞেস করলো যে ঠিক আছে কিনা।

দুবার চোখের পলক পড়লো। ঠিক আছে।

তার বুকের গর্তের দিকে তাকালো মিকি। হৃৎপিণ্ডটা এখনও ধুকপুক করছে। ক্ষতস্থান দিয়ে রক্তপাত হয়নি বলতে গেলে।

একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করলো মিকি। এখনও সেভাবে জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েনি, কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এখন তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। কিন্তু মেয়েটা সেই ঠান্ডা অনুভবের কোন লক্ষণই দেখাচ্ছে না। তার চেহারা আর ঠোঁট ফ্যাকাসে হয়ে এসেছে কেবল, কিন্তু ফ্রস্টবাইটের অন্য কোন লক্ষণ নেই।

মিকি জিজ্ঞেস করলো যে তার ঠান্ডা লাগছে কিনা। কিছুক্ষণ ভেবে একবার চোখের পলক ফেললো মেয়েটা।

তার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে নাম ঠিকানা জেনে নিল মিকি।

পরবর্তী তিনদিন সেখানে এসে মেয়েটার সাথে কথা বলে সে। প্রতিবারই চলে যাবার সময় একাকী একটা দৃষ্টি ভর করে মেয়েটার চেহারায় চতুর্থ দিন এসে গাড়িটাকে আর পেলো না মিকি।

সেদিন মিকিকে দেখে দীর্ঘ একটা সময় তাকিয়ে থাকলো মেয়েটা, যেন কিছু বলতে চায়। এরপর চোখ দিয়ে বুকের দিকে ইশারা করলো। কাছাকাছি গিয়ে উঁকি দিয়েই পেছনে সরে এলো মিকি। একটা সাপ আশ্রয় নিয়েছে মেয়েটার বুকের গর্তে। ওকে দেখে লাল জিহ্বা বের করে হিস হিস করলো কয়েকবার। এখনও নিশ্চয়ই উষ্ণ মেয়েটার দেহ। সেজন্যেই তার হৃৎপিণ্ডের ওপরে শীতনিদ্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে সাপটা।

সরীসৃপটাকে ভেতর থেকে বের করে আনলো মিকি। এরপর একটা ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে ফুটো করে দিল হৃৎপিণ্ডটা। যেন ঘুমে ঢলে পড়ছে, এমন ভঙ্গিতে বুজে আসলো মেয়েটার চোখ। শ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে গেল।

কয়েকদিন পর মেয়েটার মৃতদেহ আবিষ্কারের খবর ছাপা হলো স্থানীয় খবরের কাগজে।

সেদিন কেন মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিয়েছিল সেটা নিয়ে খুব বেশি ভাবেনি মিকি। পোকাগুলোর শরীরে যে কারণে পিন ফোঁটাতে, সেই কারণেই ধাক্কা দিয়েছিল হয়তো। সে ক্ষমতা আছে তার।

তাছাড়া ধাক্কা দেয়ার পর কি হয় সেটা জানার কৌতূহলও একটা ভূমিকা পালন করেছে।

*

মিকির কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।

স্টাডিরুমের ডেস্কে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো এসময়। উঠে গিয়ে রিসিভারটা কানে দিতেই ওপাশ থেকে তার সম্পাদকের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।

“আপনার পরবর্তী গল্পের জন্যে অপেক্ষা করছি।”

মিকির কাছে মনে হলো আসলে গল্প চাওয়ার জন্যে নয়, বরং সে বেঁচে আছে কিনা তা জানার জন্যে ফোন দিয়েছে লোকটা। এমন না যে ও কয়েকদিন পরপর গল্প দেয়। লেখালেখি তার মূল পেশা নয়, বরং শখের ঘোরেই রূপকথা লেখে। সম্পাদকের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে তা-ও নয়। কোন গল্প লেখা শেষ হলে তখনই যোগাযোগ করে মাত্র।

দ্বাদশ শ্রেণিতে থাকার সময় তার লেখা একটা রূপকথা বেশ বড়সড় পুরষ্কার পায়। ছোটবেলায় তার বান্ধবীকে বলা গল্পগুলোর একটারই লিখিত রূপ ছিল সেটা।

তার লেখা প্রথম গল্পটা ছিল একটা কাক আর এক অন্ধ মেয়েকে নিয়ে। মেয়েটার জন্যে শহর থেকে চোখ যোগাড় করে আনতে কাকটা।

দ্বিতীয় গল্পটা এক ডাক্তারকে নিয়ে, যে রোগীদের পিঠে জিপার লাগিয়ে দেয় অপারেশনের সুবিধার্থে। এতে প্রতিবার কাটাছেঁড়া করতে হয় না। কিন্তু একবার ভুলবশত এক নার্স জিপারটা বন্ধ করতে ভুলে যায়, ফলে সেই রোগীর ভেতরের সবকিছু বাইরে বেরিয়ে আসে।

তার তৃতীয় কাজটার নাম ‘দ্য কালেক্টেড ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইলস’। পাঠকমহলে বেশ ভালো সাড়া ফেলে বইটা। লেখক হবার ইচ্ছে কখনোই ছিল না তার। ভেবেছিল কয়েকটা গল্প লেখার পরই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, কিন্তু গল্পগুলো একের পর এক আসতেই থাকে।

“আমরা কি দেখা করে কথা বলতে পারি এবারে?”

জবাবে চুপ করে থাকলো মিকি। প্রকাশকদের সাথে খুব সহজে দেখা করে না সে। কোন সাক্ষাৎকার বা সাহিত্য আলোচনাতেও যায় না। রূপকথার গল্প লেখে সেগুলো যথাস্থানে পাঠিয়ে দেয়। খুব বেশি কাঁটাছেঁড়া ছাড়াই প্রকাশিত হয়ে যায়, বদলে প্রাপ্য সম্মানী পায় সে। এটুকুই।

অনেকেই বলাবলি করে যে শান মিকি নামে আসলে কোন লেখকের অস্তি ত্বই এই। এসবে তার কিছু যায় আসে না।

রিসিভার নামিয়ে রাখলো সে। কাউচের মেয়েটাকে কোলে তুলে নিয়ে স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেল। ওজন খুব বেশি না মেয়েটার, বড়জোর দশ কেজি। প্রথমবার শহরে তার সাথে দেখা হয়েছিল মিকির। বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। নাম হিতামি আইজাওয়া।

মিকির মনে আছে, তলকুঠুরিতে প্রথমবার মেয়েটার চোখে বাঁধা কাপড়টা সরানোর পর সে বলে উঠেছিল, “ওগুলো ম্যানেকুইনের হাত পা না?”

অবশ্য তার নিজের হাত পাগুলোও যে যথাস্থানে নেই, সেটা খেয়াল করতে খুব বেশি দেরি হয়নি।

“ওগুলো…আমার?”

হাত আর পা দুটো শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্যে করাত ব্যবহার করেছে মিকি। কোন প্রকার চেতনানাশক ব্যবহার করেনি। তা সত্ত্বেও মেয়েটা টু শব্দ করেনি। এমনকি কাঁটার পর কোন ব্যান্ডেজও বাঁধতে হয়নি। খুব বেশি রক্ত ঝরেনি যে। তবে ক্ষতস্থানগুলো একদম তাজা ছিল তখন অবধি, টকটকে লাল।

হিতোমির পক্ষে আর স্বাভাবিক জামা-কাপড় পরা সম্ভব না। সেজন্যে একটা বস্তার ভেতরে তার গলা অবধি ঢুকিয়ে দিয়েছে মিকি। আরো বেশ কয়েকটা বস্তা বানিয়েছে সে। কোনটায় ফুলের নকশা আবার কোনটা ডোরাকাটা। তবে সেগুলো খুব একটা পছন্দ নয় হিতোমির।

“গলার কাছটায় খচখচ করে,” বলেছিল সে।

শেষে নীল রঙের কাপড় দিয়ে বানানো বস্তাটা বেছে নেয় হিতেমি। গলার কাছটায় বেশ প্রশস্ত ওটার, তাই অসুবিধে হয় না।

ঘুমন্ত কিশোরীকে নিচে নিয়ে এলো মিকি। বুকের কাছটায় ভেজা তার। মাঝে মাঝে মা-বাবার কথা মনে পড়লে কাঁদে মেয়েটা।

সিঁড়ির পেছনদিকে তলকুঠুরিতে যাবার প্রবেশপথ। দেয়ালের রঙ আর দরজার রঙ একই হওয়ায় আলাদা করা বেশ কষ্ট। এই পশ্চিমা নকশার বাড়িটা ভাড়া করার অন্যতম প্রধান কারণ নিচের তলকুঠুরিটা।

লাইটের সুইচ জ্বালিয়ে দিল মিকি। তলকুঠুরির দেয়ালগুলোয় প্লাস্টার

থাকায় লাল ইট দেখা যায়। প্রচণ্ড ঠান্ডা। রীতিমত বাষ্প বেরোয় নাক মুখ থেকে। আর ছাদ বেশ নিচু। তবে মাথা উঁচু করে হাঁটতে সমস্যা হয় না।

চারকোনা একটা জায়গা। টিমটিমে বাটার আলোয় অন্ধকার দূর তো হয়ই না, বরং আরো জমাট বাঁধে কোনার দিকগুলোতে। বেশ কয়েকটা শেলফ সারি সারি দাঁড় করানো। আগের ভাড়াটিয়া রেখে গেছে। সেগুলোতে এখন নানারকম যন্ত্রপাতি আর পুরনো জামা-কাপড় ঠাসা।

শেলফগুলোর একপাশে হিতোমির বিছানা। তাকে সন্তর্পণে সেখানে নামিয়ে রাখলো মিকি।

এসময় পেছনের শেলফ থেকে শিনিচি হিসামোতোর কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “শুনছো…।”

মুখ তুলে তাকালো মিকি। শেলফে দুটো বাক্সের মধ্যখানে শিনিচির চোখ দেখা যাচ্ছে। হিতামির দিকে তাকিয়ে আছে সে।

শেলফের অন্য পাশ থেকে বিশাল একটা দেহের নড়াচড়ার শব্দ কানে এলো। শিনিচির চোখ উধাও গেল ফাঁকটা থেকে। এখন ইউকি মোচিনাগার চোখ দেখা যাচ্ছে সেখানে।

“বুড়োটার কি যেন হয়েছে,” বলে সে। “একটু দেখো তো।”

তলকুঠুরির এক অধিবাসীর ডাকনাম ‘বুড়ো’। তার আসল নাম অবশ্য দাশি কানেদা। মাথা নাড়লো মিকি। ইউকির চোখও উধাও হয়ে গেল ফাঁকা জায়গাটা থেকে। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কানে এলো তার।

“ফাঁকা জায়গাটা অবধি চোখ নিয়ে যেতেও হাঁপিয়ে উঠি,” শেলফগুলোর পেছনের অন্ধকার থেকে বলে উঠলো ইউকি।

হিতোমির শরীরে একটা কম্বল টেনে দিল মিকি। যাদের সে কাটাছেঁড়া করে, তারা যে উত্তাপ বা শৈত্য অনুভব করে না, এটা জানা আছে তার। তবুও কাজটা করলো সে।

অনুভব যেমন করে না, অতিরিক্ত তাপ বা শীত তাদের দেহের ওপর কোন প্রভাব ফেলে না। ঠান্ডায় কখনো জমে যাবে না তাদের শরীর। ঠিক সেরকমই ক্ষুধা বা অসুখ-বিসুখ থেকেও সদা মুক্ত তারা। যাদের সে আহত করেছে, মৃত্যু তাদের ওপর করাল থাবা বসাতে পারে না সহজে। কোন অদৃশ্য ক্ষমতা দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়। মিকির ক্ষমতা।

অন্ধকারে গান গাইতে শুরু করলো ইউকি। ইংরেজি ভাষার একটা গান, সুরটা বেদনার। ইংরেজির টিচার ছিল সে, চমৎকার উচ্চারণ। তলকুঠুরিতে ভেসে বেড়াচ্ছে অপূর্ব সেই সুর।

ঘুমের মধ্যেই একবার গুঙিয়ে উঠলো হিতোমি। কি যেন বিড়বিড় করছে। তার মুখের কাছে কান নিয়ে গেল মিকি! দুটো শব্দ বাদে আর কিছু বুঝলো না।

“দাঁড়কাকটা উড়ছে…”

.

রিয়ারভিউ মিররের সাথে লাগানো চাবির রিংটা। তাই গাড়িটার প্রতিটা নাড়াচাড়ায় একই তালে নড়ছে।

“এখানে থাকে এমন কাউকে চেনো?” ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা তরুণ জিজ্ঞেস করলো।

বিচলিত ভঙ্গিতে মাথা কঁকালাম আমি। অচেনা একজনের গাড়িতে উঠে বসতে এমনিতেও অনেক সাহসের দরকার হয়েছে। কিন্তু আমার গন্তব্য যেখানে, সেখানে প্রতিদিন মাত্র দুটো বাস যায়। দুর্ভাগ্যবশত কায়েদি শহরের উদ্দেশ্যে দিনের দ্বিতীয় বাসটাও রওনা হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। তাই অন্য কারো গাড়িতে লিফট নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না।

চাবির রিংটা থেকে চোখ ঘুরিয়ে বাইরের ধূসর আকাশের দিকে তাকালাম। পাহাড় খুব কাছেই, পেঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে রাস্তা। মৃত ঘাসে ছাওয়া ঢালগুলো দেখে মনটা কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে উঠলো।

সিডার গাছে ভর্তি একটা জায়গায় থামলাম আমরা। সামনে হলুদ সাদা ক্রসিং গেইট। রেলগাড়ি যাবে।

আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে লোকটা অনেকক্ষণ ধরে, কিন্তু ভয় পাচ্ছি। অপরিচিত কারো সাথে কিভাবে স্বাভাবিক হতে হয়, জানি না। .

সে যেহেতু আমাকে তার গাড়িতে করে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে, তাই এভাবে চুপ করে থাকাটাও ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। কি নিয়ে কথা বলবো ভাবতে লাগলাম। আমার তো বলার মত কোন গল্প নেই। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেছে, তাই অতীতের কিছু যে বলবো তা সম্ভব নয়। আর গত কয়দিনে এমন কিছু ঘটেনি যেটা নিয়ে অপরিচিত কারো সাথে আলাপ করা যাবে। এখন সে যদি অতীত নিয়ে বেকায়দা কিছু জিজ্ঞেস করে বসে, জবাব দিতে পারবো না। তাছাড়া নেহায়েত দরকার না পড়লে কাউকে আমি দুর্ঘটনার কথাটা বলি না।

নতুন কারো সাথে দেখা হলে তারা আমার সম্পর্কে কিছু জানবে না। সেজন্যেই মাথায় যা আসবে সেটাই বানিয়ে বলবো ভেবে রেখেছি। কিন্তু বিভ্রান্তি আর দুশ্চিন্তার দরুণ মুখ খুললে এ মুহূর্তে না তোতলিয়ে কিছু বলতে পারবো না, তাই আপাতত কেবল মাথা নাড়ছি।

স্কুলে বসন্তের ছুটি এখন। অবশ্য পড়াশোনা নিয়ে ভাবনা চিন্তা আরো আগেই ছেড়ে দিয়েছি। গত শিক্ষাবর্ষ শেষ হবার পর একদিনও ক্লাসে যাইনি। তবে সেজন্যে মনে অপরাধবোধ কাজ করে ঠিকই।

তাই যে দিনগুলোতে আসলেই স্কুল বন্ধ থাকে, একটু ভারমুক্ত অনুভব করি ভেতরে ভেতরে। বাড়ি থেকে পালানোর সময় নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিয়েছি যে, নতুন কোথাও গেলে কেউ অন্তত আমার দিকে চোখে। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তাকাবে না।

বাবা মার উদ্দেশ্যে একটা চিঠি রেখে এসেছি। সেখানে লেখা যে কয়েকদিন বাড়ির বাইরে থাকবো, প্রতিদিন একবার ফোন দিয়ে নিজের খোঁজখবর জানাবো।

কিছুদিন আগে নামির সঞ্চয়ের সব টাকা তুলে নিয়েছি ব্যাঙ্ক থেকে। নিজের নাম লেখা চেকটা নিয়ে গিয়েছিলাম ব্যাঙ্কে। আমার ডেস্ক ড্রয়ারের পেছনে লুকোনো ছিল ওটা। স্মৃতি হারাবার পূর্বে নিয়মিত টাকা জমাতাম আমি।

কিন্তু পিন নম্বরটা ভুলে গিয়েছিলাম। অন্যদের পিন নম্বর ভোলার সাথে আমার পিন নম্বর ভোলার কারণের অবশ্য বেজায় ফারাক। একবার ভাবলাম ব্যাঙ্কের কোন কর্মকর্তাকে আমার পরিস্থিতি বুঝিয়ে বলবো। সাথে তো স্কুলের পরিচয়পত্র আছেই। কোন ঝামেলা হবার কথা না।

কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছিল যে আগের নামির টাকাগুলো আমার নিজের নয়। সুতরাং অন্য কারো টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কের কারো সাথে কথা বলতে গেলে অনর্থক বাজে পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে। যদিও চিন্তাটা পুরোপুরি অমূলক, তবুও মন থেকে ঝেরে ফেলতে পারলাম না।

শেষমেষ সিদ্ধান্ত নেই যে এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করবো। পিন হিসেবে প্রথমে জন্মদিনের তারিখ পাঞ্চ করি। বাবার কাছ থেকে তারিখটা শুনে নিয়েছি আগেই।

১০২১।

কাজ হলো না। সিকিউরটি গার্ড চোর সন্দেহে পাকড়াও করবে আমাকে, এই ভয় কাজ করছিল মনে মনে।

মা’র জন্ম তারিখ পাঞ্চ করে দেখলাম এরপর।

০৭২৬।

ভাগ্য নেহায়েত ভালো বলতে হবে। কাজ করলো পিন কোডটা। মনে মনে প্রবল অপরাধবোধ নিয়েই নামির অ্যাকাউন্ট থেকে সব টাকা তুলে। নিলাম। এগুলো আমার নিজেরই টাকা, তবুও মনে হচ্ছে যেন চুরি করেছি।

বেরিয়ে পড়লাম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। সাথের ম্যাপ দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম কোন রুট দিয়ে গেলে সবচেয়ে সুবিধা হবে। কাজুয়া যে শহরে থাকে সেটার নাম কায়েদি। খুব বেশি লোক থাকে বলে মনে হয় না। ম্যাপে এত ছোট করে জায়গাটার নাম লেখা যে প্রথমে চোখেই পড়েনি।

যাত্রার প্রস্তুতি নেয়ার দিনগুলোতেও একটার পর একটা স্বপ্ন দেখতেই থাকি। তবে সবগুলো স্বপ্নই কাজুয়ার ছেলেবেলা সম্পর্কিত। সেদিনের সেই ঘটনার মত আর কিছু দেখিনি। প্রতিবার তার চোখ দিয়ে সাওরি বা অন্য কাউকে দেখার পর কাঁদতে ইচ্ছে গলা ছেড়ে। স্বপ্নটা যতই আনন্দের হোক না কেন। কাজুয়া মৃত, কথাটা ভাবলে কিছু একটা দলা পাকিয়ে আসে গলার কাছটায়।

“এই ছোট্ট শহরটায় গিয়ে কি করবে?” ড্রাইভার জানতে চাইলে আগ্রহী কণ্ঠে।

“একজনের সাথে দেখা করতে হবে,” দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললাম।

“তুমি না বললে কায়েদির কাউকে চেনো না?”

“আসলে… ব্যাপারটা…” কি বলবো খুঁজে পেলাম না।

গাড়ি যতই সামনে এগোচ্ছে, আশপাশের পরিবেশের সাথে বাম চোখে দেখা জায়গাটার পরিবেশের মিল খুঁজে পাচ্ছি। কাজুয়া আর সাওরির বাসস্থানেই যাচ্ছি। এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নেই।

রাস্তার পাশের দেবদারু গাছ আর ট্রান্সমিশন টাওয়ারগুলো আগেও দেখেছি। কাজুয়ার চোখ দিয়ে। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। এখন বসন্ত চলছে। কিন্তু আশপাশের দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে শীত। গাছগুলোর বেশির ভাগেরই পাতা নেই। গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ভেতরে ঢাকায় শরীর কেঁপে উঠছে কিছুক্ষণ পরপর। এই ঠান্ডায় বরফ পড়লেও অবাক হবো না।

একটা সিগন্যালে কিছুক্ষণের জন্যে থামলো গাড়ি। আশপাশে অবশ্য অন্য কোন গাড়ি নেই। বামপাশে পরিত্যক্ত কয়েকটা সাদা ট্রেইলার পড়ে আছে। ওগুলোর পেছনে ঘন বন। পরের সিগন্যালটায় বড় একটা সাইন চোখে পড়লো।

বাম চোখটা গরম হতে শুরু করেছে। এটা তো…

“গাড়িটা একটু থামাবেন?” মনে সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম।

একটা সন্দেহ ভর করলো তরুণ ভদ্রলোকের চেহারায়। সবুজ বাতি জ্বলে উঠেছে কিছুক্ষণ আগে।

“কি হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলো ড্রাইভার। “অ্যালার্জি?”

বাম চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। অনেকেই আগে এই একই প্রশ্ন করেছে আমাকে। চোখের পানি মুছে মাথা ঝাঁকালাম। “একটু বাইরে যেতে পারি?” জিজ্ঞেস করলাম। “এক্ষুনি ফিরবো।”

তার অনুমতির অপেক্ষা না করেই দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বাইরের বাতাস খুব বেশি ঠান্ডা। সেটাই স্বাভাবিক, এখানে তো আর হিটার নেই।

বিশাল সাইন বোর্ডটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। দু’টো খুটির ওপর ঝোলানো ওটা। সাইনবোর্ডে খুব সুন্দর একটা ছবি। হয়তো কোন কোম্পানির পক্ষ থেকে এখানে লাগানো হয়েছিল, এখন অবশ্য কোম্পানির নামটা মুছে গেছে। কিছুক্ষণ ওটার নিচে হাঁটাচলা করলাম। কয়েকবার আঙুল দিয়ে টোকা দিলাম ধাতব খুটিগুলোয়। মুখে হাসি ফুটেছে কখন যেন।

ড্রাইভার লোকটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার সময় নষ্ট করা উচিৎ হচ্ছে না ভেবে আবারো ফিরে এলাম গাড়িতে।

“আমার পরিচিত একজন অনেক আগে খেলতে এখানটায়। তখন অবশ্য কেবল ঝোলানো হচ্ছে সাইনবোর্ডটা…”

বাম চোখের স্বপ্নে একজন লোককে সাইনবোর্ডের ছবিটা আঁকতে দেখেছিলাম। খেলতে খেলতে নীল রঙের কৌটাটা উল্টে দিয়েছিল কাজুয়া। চোখের উচ্চতা থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে বয়স খুব একটা কমও না তখন তার। কিন্তু কৌটা উল্টে যাবার সাথে সাথে ঝেরে পালায় সেখান থেকে।

দৃশ্যটা মনের পর্দায় ভেসে ওঠায় না হেসে পারলাম না। একই সাথে দুঃখে ভারি হয়ে উঠলো হৃদয়টা।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে আবার। ব্যাকপ্যাক থেকে বাইন্ডারটা বের করে স্বপ্নটা টুকে নিলাম। ভেতরে ভেতরে আনন্দ দানা বাধছে। সাইনবোর্ডটার সামনে দাঁড়ানোর পর থেকে কাজুয়ার জীবনকে অনেক বেশি বাস্তব মনে হচ্ছে এখন। আমি আর কাজুয়া যে সম্পূর্ণ ভিন্ন দু’টো সত্তা, এটা ভুলে যাই মাঝে মাঝে।

“কায়েদি পৌঁছে গেছি আমরা,” ড্রাইভার বললো।

গাড়ির জানালা দিয়ে যে দৃশ্যটা দেখতে পাচ্ছি, তাতে মন ভরে গেছে।

“তবে একটা জায়গায় একটু কাজ আছে আমার,” বললো সে। “সেখানে যদি আগে যাই, কোন সমস্যা হবে?”

“না,” ছোট করে বললাম। কায়েদিতে কোথায় যাবো, সেটা আসলে আমি নিজেও জানি না এখন পর্যন্ত। সাওরি আর কাজুয়ার শহরে যেতে হবে–এ কথাটাই মাথায় ঘুরছিল কেবল। এর বেশি এখনও কিছু ভাবিনি।

একটা থাকার জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। সেখান থেকে সাওরির খোঁজ করবো। এখনও নিশ্চয়ই বেঁচে আছে সে। কাজুয়া খুব সম্ভবত দুই কি তিন মাস আগে মারা গেছে। সাওরি এখনও এখানেই থাকার কথা। এরপর খুঁজতে হবে নীল ইটের বাড়িটা।

অবশেষে কাজুয়ার শহরটা চোখে পড়লো আমার। ওটার মাঝ দিয়ে ধমনীর মত একেবেকে বেরিয়ে গেছে হাইওয়েটা। খুব বেশি যানবাহন চোখে পড়লো না। চারদিক মোটামুটি নিশ্চুপ।

জানালা দিয়ে কোন উঁচু দালান দেখতে পেলাম না। ছড়ানো ছিটানো কয়েকটা দোতলা বাড়ি আর দোকানপাট। ফাঁকা জায়গাগুলোতে মৃত ঘাস। ডাস্টবিনে ময়লা গুঁকছে একটা নেড়ি কুকুর।

সদ্য কাটা দেবদারু গাছ ভর্তি একটা ট্রাক চলে গেল উল্টো পাশের রাস্তা দিয়ে। ড্রাইভার লোকটার কাছে শুনলাম একটা আপেল খামার আছে পাহাড়ের ওপরে। সেটাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে শহরটা। অ্যালার্জি আছে এরকম কারো থাকার পক্ষে জায়গাটা সুবিধাজনক কিনা ভাবলাম মনে মনে। সাওরির হয়তো এই অ্যালার্জির কারণেই সবসময় নাক থেকে পানি ঝরে।

একটা সুপারমার্কেট চোখে পড়লো। ওখানে পর্যাপ্ত ক্রেতা সমাগম হয় কিনা কে জানে। এমনকি সামনের সাইনবোর্ডটাও মলিন। গলায় ভোয়ালে পেঁচিয়ে বয়স্ক এক লোক ছোট মিট্রিাক থেকে অ্যালকোহলের কেস নামিয়ে। যাচ্ছে।

প্রাণহীন শহরটার বাতাস আমার শহরের তুলনায় কিছুটা পাতলা। উচ্চতার কারণে এমন লাগছে বোধহয়। রাস্তার মার্কিংগুলো উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। কে বলবে যে এখান থেকে মাত্র বিশ মিনিটের দূরত্বে একটা রেল স্টেশন আছে?

গাড়ির মধ্যে কয়েকবার কথা বলে উঠতে গিয়েও চুপ করে গেলাম। বাঁ চোখের স্বপ্নে দেখা দোকানপাট, রাস্তা আর দৃশ্যপাট পেছনে ফেলে যাচ্ছি। এই শহরটাতেই থাকতো কাজুয়া। পরিচিত কিছু চোখে পড়লেই ড্রাইভার লোকটাকে গাড়ি থামাতে বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তাতে সে বিরক্ত হবে ভেবে করছি না। বরং জানালায় কপাল ঠেকিয়ে প্রাণভরে দেখে নিচ্ছি সবকিছু।

“শহর থেকে একটু বাইরে জায়গাটা,” লোকটা বললো এসময়। “একটা জিনিস পৌঁছে দেব।”

কিছুক্ষণের মধ্যে হাইওয়ে থেকে একটা পার্শ্বরাস্তায় নেমে গেল গাড়িটা। আশপাশে বাড়ির সংখ্যা তুলনামূলক কম এখন। এখানকার দৃশ্য আগের মত পরিচিত ঠেকছে না দেখে কিছুটা হতাশ হলাম। বিষণ্ণতা ভালো করে জেঁকে বসার আগেই গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে দিলো লোকটা।

পেছনের সিট থেকে একটা বাক্স বের করে বললো, “কাজ শেষ করেই তোমাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেব।”

কিন্তু সেটার আর দরকার হবে না। গাড়ি থেকে বেরিয়ে সে যে বাড়িটায় প্রবেশ করেছে সেটার দিকে তাকালাম।

আসলে বাড়ি না বলে ক্যাফে বলাটাই বোধহয় ঠিক হবে। মাউন্টেইন লজের মত দেখতে। অনেকবার দেখেছি আগে।

মেলানকলি গ্রোভ।

সাওরি কাজ করে এখানে।

*

কাঠের দরজাটা খুলে ভেতরে পা রাখলাম। হিটারের আরামদায়ক উষ্ণতা সাদর আমন্ত্রণ জানালো। প্রবেশপথের বামদিকে কাউন্টার আর ডান দিকে কয়েকটা টেবিল। এসব আগেই দেখা আমার। কাঠের মেঝেতে নিজের প্রতিটা পদশব্দ কানে মধুর মত বাজছে যেন। কাউন্টারের সামনে পাতা টুলগুলোর একটায় বসলাম।

পেছন থেকে মালিক বের হয়ে এসে বললো, “স্বাগতম।

পালস দ্রুত হয়ে গেল আমার। এনাকে আগে বেশ কয়েকবার দেখেছি আমি। গাট্টাগোট্টা শরীর, নাকের নিচে পুরু গোঁফ। স্বপ্নে যেরকম বড়সড় দেখাত, বাস্তবেও সেরকমই দেখাচ্ছে। এরকম বিশাল শরীর নিয়ে কাউন্টারের পেছনে ছোট্ট জায়গাটায় কিভাবে সারাদিন বসে থাকে কে জানে।

“কোন সমস্যা?” আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো সে।

“না। মাফ করবেন,” বলে চোখ নামিয়েনিলাম।

ক্যাফের পরিচিত দশ্যে একবার নজর বুলালাম। সেই একই ফুলদানি, একই ফুল আর একই টেবিল চেয়ার। সোডিয়াম বাতির হলদেটে আলো। বাম চোখে এমনটাই দেখেছিলাম।

“এখনই অর্ডার করবেন?” জিজ্ঞেস করলো ক্যাফে মালিক।

দ্রুত মেনু খুলে প্রথম যেটা চোখে পড়লো সেটার নামই উচ্চারণ করলাম। “ক্যারামেল কফি, প্লিজ।”

ক্যাফের পেছনের দরজা দিয়ে আমাকে যে লোকটা এতদূর অবধি লিফট দিয়েছে সে প্রবেশ করলো এসময়। বড় বেশি কাকতালীয় ব্যাপারটা। মেলানকলি গ্রোভেই আসছিলো সে! মালিককে আগে থেকেই চেনে। হেসে হেসে কথা বলছে এখন। হয়তো শহরে আসার পথে তাকে কিছু মালপত্র নিয়ে আসার অনুরোধ করেছিল ক্যাফে মালিক। আশপাশে বারবার উঁকি দিচ্ছে ড্রাইভার লোকটা। বোধহয় কাউকে খুঁজছে।

দু’জন খদ্দের আছে ক্যাফেতে এ মুহূর্তে। ধূসর চুলের বয়স্ক এক মহিলা। বয়স ষাটের আশেপাশে। জানালার ধারে বসে আছে সামনে একটা বই আর কফির কাপ নিয়ে। দুর্বল হাতে একটা পৃষ্ঠা ওল্টালেন মহিলা। পরনের পোশাকগুলো বেশ দামি। কাছেপিঠেই থাকেন কিনা কে জানে। দেখে মনে হচ্ছে এখানে নিয়মিত আসেন।

আরেকজন খদ্দের বসে আছে একদম পেছনের দিকে। প্রথমে তাকে খেয়ালই করিনি ঠিকমতন। ওদিকটায় আলো কিছুটা কম। লোকটার পরনের পোশাক কালো হওয়ায় অন্ধকারে মিশে গেছেন প্রায়।

একটু পর ড্রাইভার লোকটা আমার কাছে এসে বললো যে কাজ শেষ তার।

“এখানেই থেকে যাবো আমি। লিফটের জন্যে ধন্যবাদ,” একটু ভেবে জবাব দিলাম।

বিদায় জানিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে গেল সে। আমার জন্যে তার চোখের দুশ্চিন্তাটুকু অবশ্য নজর এড়ালো না। বোধহয় ভাবছে এরকম একটা জায়গায় একা একা কি করব। দৃষ্টিটা আগেও দেখেছি বলে মনে হলো। হয়তো কোন একটা স্বপ্নে, এই ক্যাফেতেই। জার্নালটা এত মোটা যে সবগুলো ঘটনার কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক।

আমার ক্যারামেল কফি নিয়ে ফিরে এল ক্যাফে মালিক। “এই নিন মিস, কাপটা আমার সামনে নামিয়ে রেখে বললো সে।

আবারো চোখে কৌতূহল নিয়ে তাকালাম তার দিকে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে আমার সামনেই আছে।

কাজুয়া প্রায় সময়েই আসততা এই ক্যাফেতে। সাওরি এখানে কাজ করে, সেজন্যেই বোধহয়। এমনকি ক্যাফেটা প্রথম যখন খোলে, সেদিনও এখানে এসেছিল। তখন বোধহয় মিডল স্কুলে পড়তো সে। মালিক অবশ্য অন্য একজন ছিল তখন। কিছুটা বয়স্ক এক লোক।

বাসায় কফির কাপের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় একদিন বাঁ চোখটা গরম হয়ে উঠেছিল। সেদিন দেখেছিলাম দৃশ্যটা। সবকিছু একদম ঝ চকচকে ছিল তখন ক্যাফেটার। স্কুল বাদ দিয়ে এসেছিল কাজুয়া, ইউনিফর্ম পরেই। পেছনে বসে দেখছিল উদ্বোধনী দিনের ব্যস্ততা। ধূসরচুলো লোকটার চেহারা তখনই তার চোখে লম্বা সময়ের জন্যে অঙ্কিত হয়ে যায়।

সবকিছুরই অতীত আছে, ভাবলাম আমি। এই ক্যাফেটারও। হয়তো এখানে আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যার কোন অতীত নেই।

খুব অদ্ভুত লাগছে। আমার ব্যাকপ্যাকে যে বাইন্ডারটা আছে সেখানে এই শহর আর শহরের লোকদের বিশদ বর্ণণা। কিন্তু বাস্তবে তাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। “এক্সকিউজ মি…” ক্যাফে মালিকের উদ্দেশ্যে এটুকু বলে চুপ করে গেলাম। বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। তাকে আমি আগে অনেকবার দেখেছি, কিন্তু সে তো আমাকে কোনদিন দেখিনি।

“কিছু বলবেন?” বয়সে তার চেয়ে আমি অনেক ছোট। তবুও আপনি করে বলছে লোকটা।

“এভাবে হঠাৎ জিজ্ঞেস করাটা হয়তো উচিৎ হচ্ছে না…” অনেকক্ষণ ধরেই একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে আমার মাথায়। “আপনার নামটা জানতে পারি কি?”

স্বপ্নগুলোয় যেহেতু কোন শব্দ নেই, ভদ্রলোকের নামটাও কখনো জানা হয়ে ওঠেনি। সেজন্যেই প্রশ্নটা করা।

স্বাভাবিক ভাবেই অবাক হয়ে গেল লোকটা। “কিমুরা… কিন্তু কেন…”

“ধ-ধন্যবাদ,” কোনমতে বললাম। গাল লাল হয়ে উঠছে আমার। অবশ্য মনে মনে কিছুটা ভালোও লাগছে। লোকটার নাম তাহলে কিমুরা।

কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ভালো করে তাকালো কিমুরা। গতানুগতিক জাপানিজদের তুলনায় একটু বেশিই লম্বা সে। অনেকটা ভালুকের মতন। একটা হাসি ফুটেছে তার চেহারায়। সেই হাসি দেখে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার যোগাড় হলো আমার। “আমার নাম কেন জানতে চাইছেন?”

এই প্রশ্নের যথাযথ কোন জবাব নেই আমার কাছে।

“না, মানে… এখানে আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখন কেউ একজন আপনার নাম ধরে ডেকেছিল। সেটাই মনে করে চেষ্টা করছিলাম,.. তাই…” বাক্যটা শেষ করতে পারলাম না।

“এখানে আগে এসেছেন আপনি? কতদিন আগে?”

“দু’বছর,” এ মুহূর্ত দ্বিধার পর বললাম। বানোয়াট একটা কথা।

বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রেখে সন্দিহান চোখে আমার দিকে তাকালো কিমুরা। “মিথ্যে বলবেন না। সব কাস্টমারের চেহারা মনে থাকে আমার।”

“মিথ্যা বলছি না,” আতঙ্ক চেপে বললাম।

“তাই নাকি…” বলে কিছুক্ষণ ভাবলো কিমুরা। “এখানে একটা জিনিস অল্প কিছুদিন ধরে আনা হয়েছে। বলুন তো সেটা কি? অন্য সবকিছু দু’বছর আগে যেরকম ছিল, সেরকমই আছে।”

জানালার ধরে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটা উঠে দাঁড়ালো এসময়। “আহ… কিমুরা, থামো তো। আমিও তো এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবো না।”

তিনি যে আমাদের কথা শুনছেন, তা আগে খেয়াল করিনি।

“আমাদের কথা শুনছিলেন আপনি, কিয়োকো?”

হাতের বইটা বন্ধ করে কড়া চোখে কিমুরার দিকে তাকালেন কিয়োকো।

“কিয়োকো ঠিকই বলেছেন। প্রশ্নটা বেশি কঠিন হয়ে…” কিমুরা বলতে শুরু করলো।

হাত উঠিয়ে মাঝপথেই থামিয়ে দিলাম তাকে। “আপনার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবো আমি।” দেয়ালে ঝোলানো একটা পেইন্টিংয়ের দিকে ইশারা করলাম। কালো বনের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা একটা হ্রদ দেখা যাচ্ছে ছবিটায়। অবাক হয়ে গেল কিমুরা। ঠিক উত্তরটাই দিয়েছি আমি।

ক্যাফের একদম পেছনে বসে থাকা লোকটা উঠে দাঁড়ালো এসময়। চেহারা বেশ সুন্দর তার, অন্ধকারে বসে থাকায় আগে বুঝতে পারিনি। লম্বা চুলগুলো কপাল অবধি নেমে এসেছে, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। এমন ভাবে হাঁটছে যে কোন শব্দই শুনতে পাচ্ছি না। কাউন্টারের সামনে এসে বিল মেটানোর জন্যে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলো সে।

কিমুরা সাহেবের চক্ষু ছানাবড়া। বেচারা কল্পনাও করতে পারেনি যে আমি আসলেও ঠিকঠাক জবাবটা দিয়ে দিব। সুন্দরমত চেহারার লোকটার কাছ থেকে বিলের টাকা সংগ্রহ করার সময়েও বিড়বিড় করে কিসব বলতে লাগলো।

ক্যাফে ছেড়ে বেরিয়ে যাবার সময় আমার দিকে এক ঝলক তাকালো লোকটা। সে-ও হয়তো আমাদের কথোপকথন শুনছিল।

“যেই লোকটা মাত্র বের হয়ে গেল,” কিমুরা বললো। “সে-ই এঁকেছে ছবিটা। শিওজাকির নাম শুনেছেন?”

মাথা ঝাঁকালাম।

“তার সম্পর্কে কিছু মনে নেই?”

আমার যে কোন কিছু সম্পর্কেই মনে নেই, এটা বলতে গিয়েও বললাম না।

“থাকার জন্যে এরকম একটা জায়গা হঠাৎ কেন বেছে নিল সে, কে জানে। যাইহোক, আপনি এখানে কোন কাজে এসেছেন?”

কি বলবো ভাবতে লাগলাম। সত্যিটা বলে দেব? স্বপ্নে দেখেছি একটা মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। হয়তো তার সাহায্যও পাবো।

কিন্তু আমার কথা কেন বিশ্বাস করবে? আমাকে তো চেনেও না ঠিকমতোবাম চোখ প্রতিস্থাপনের পর সেই চোখের পুরনো স্মৃতিগুলো থেকে এসব জেনেছি, এই কথাটা যে কারো কানে অদ্ভুত শোনাতে বাধ্য। বলা যায় না, হেসেও উঠতে পারে।

“একজনকে খুঁজছি আমি,” শেষমেষ বললাম। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যাও না। সাওরি আর হিতোমি আইজাওয়া। এই দু’জনকে খুঁজছি। সেই সাথে খুনীকেও। “এখানে পার্টটাইম চাকরি করেন না একজন?”

“আপনিও সাওরির খোঁজে এসেছেন?” হাসি ফুটলো কিমুরার মুখে।

থমকে গেলাম তার উত্তর শুনে। এই প্রথম কেউ সাওরির নাম উচ্চারণ করলো আমার সামনে।

“আমিও খুঁজছি… মানে?”

“মেয়েটার শুভাকাক্ষীর সংখ্যা কম না। আপনাকে যে এখানে পৌঁছে দিল, সে প্রায়ই আসে তার সাথে দেখা করতে। একটু আগে যখন বললাম ঠান্ডার কারণে আজ আসতে পারেনি, সুরসুর করে বেরিয়ে গেল। ভেতরে ঢুকে প্রথমে কিছু একটা অর্ডার তো করতে পারতো।” একটা গালি দিল কিমুরা।

সাওরি আজকে আসেনি শুনে হতাশও হলাম আবার কিছুটা স্বস্তিও পেলাম। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে কি বলতাম সেটা জানিনা, এখনও সে ব্যাপারে কিছু ভাবিনি।

তবে মেলানকলি গ্রোভেই কাজ করে সে, এটা এখন একদম নিশ্চিত। কাজুয়ার মৃত্যুর পর চাকরি ছেড়ে দেয়নি।

ক্যাফের ভেতরে মৃদু একটা সুর বাজছে স্পিকারে। এতটাই আস্তে যে মনে হয় অবচেতন মনে কিছু শুনছি। সামনে রাখা কাপটা তুলে নিয়ে কফিতে চুমুক দিলাম। কাজুয়া এখানে বসে এই কাপেই চুমুক দিয়েছিল কিনা কে জানে!

কাউন্টারের মাঝামাঝি সে যে সিটটায় বসততা সেটায় হাত বুলালাম।

উঠে দাঁড়িয়ে আরেকবার ভালোমতো মাথায় গেঁথে নিলাম ক্যাফের ভেতরকার সবকিছু। কেন যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে বাস্তবেও দেখছি সবকিছু। কিমুরা আর কিয়োকো কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তবে তাদের দৃষ্টিকে পাত্তা না দিয়ে সিটে বসে আবারো চুমুক দিলাম কফিতে।

ক্যাফের পেছনের দরজা দিয়ে এসময় ভেতরে প্রবেশ করলো এক যুবতী। “ময়লা ফেলে দিয়েছি,” কিমুরার উদ্দেশ্যে বললো সে। সোয়েটারে একবার হাত মুছে আমার দিকে তাকালো। চুলগুলো পনিটেইল স্টাইলে বাঁধা। ঠান্ডার মধ্যে বাইরে থাকার কারণেই হয়তো তার গাল আর নাক কিছুটা লাল হয়ে আছে।

“ঐ লোকটাকে মিথ্যে বলেছিলাম আমি,” কিমুরা আমার দিকে তাকিয়ে বললো।

সদ্য ভেতরে প্রবেশ করা যুবতী কাউন্টারের পেছনে রাখা টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু বের করে নিয়ে সশব্দে নাক ঝরলো। আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কিছুটা লজ্জা পেলো মনে হয়। কিছু মনে করবেন না, ছোটবেলা থেকেই ঠান্ডার সমস্যা আমার।”

“সাওরি ফুইয়ুতসুকি…।”

ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকালো সে। যেন জিজ্ঞেস করতে চাইছে আমি কিভাবে তার নাম জানলাম।

“… আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগছে,” বললাম। “আমি কাজুয়ার বন্ধু, আপনা আপনি কথাটা বেরিয়ে গেল মুখ দিয়ে।

কাজুয়ার নাম শোনার পর পুরো বদলে গেছে কিমুরা আর সাওরির মুখভঙ্গি।

সত্যিটা হচ্ছে, এর আগেও বহুবার দেখা হয়েছে আমাদের। আপনাকে অনেক দিন ধরে চিনি। মনে হয় যেন একদম ছোট থেকে একসাথে আছি।

বাইরে স্বাভাবিক থাকলাম। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কাঁদছি।

.

“আমার বাসায় চলো তুমি,” সাওরি বললো আমার উদ্দেশ্যে। আমি কাজুয়ার বন্ধু এটা শোনার পর থেকেই ব্যবহার অন্যরকম হয়ে গেছে তার। তাকে খুলে বলেছি যে এখানে কোথাও থাকবো সেটা জানি না। হোটেল ভাড়া করার মত টাকা আছে আমার, কিন্তু কায়েদিতে হোটেল বলতে সেরকম কিছু নেই। তাই একরকম বাধ্য হয়েই সাওরির কথা মেনে নিতে হলো। সত্যি কথা বলতে, আমার ভেতরের একটা অংশ চাচ্ছিলো যাতে সে এরকম প্রস্তাব দেয়। কারণ বাসাটা নিজের চোখে দেখার খুব ইচ্ছে।

“ক্যাফে বন্ধ হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে সমস্যা হবে?”

মাথা ঝাঁকালাম। কোন সমস্যা নেই। তাছাড়া খুব বেশি খদ্দের নেই, তাই আমার সাথে গল্প করেই সময় কাটাচ্ছে সে।

আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে জলজ্যান্ত সাওরি আমার চোখের সামনে বসে আছে। তার চেহারার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া বোনের দেখা পেয়েছি অনেক বছর বাদে। সম্পূর্ণ অতীত বিহীন আমার জন্যে সে-ই সবচেয়ে কাছের আত্মীয়। তার সাথে যত স্মৃতি আছে, মা-বাবার সাথে তার ছিটেফোঁটাও নেই। অবশ্য স্মৃতিগুলো সব কাজুয়ার।

কিন্তু তার কাছে আমি সম্পূর্ণ অচেনা একজন ব্যক্তি। এ কথাটা ভুলে গেলে চলবে না।

কিয়োকো তার বিল মিটিয়ে চলে যাবার পর কিমুরা ঘোষণা করলো, “আজকের মত ক্যাফে বন্ধ করে দেই। আর কেউ আসবে বলে মনে হয় না। মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি চলে যাও তুমি। সে যেহেতু কাজুয়ার বন্ধু…”

তার কণ্ঠে সাওরির জন্যে উদ্বেগ টের পেলাম। কাজুয়ার মৃত্যু আসলেও অনেক কিছু ওলট পালট করে দিয়েছে তাদের জীবনে।

সাওরির সাথে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে এলাম কিছুক্ষণ পর। বাস্তবে এই প্রথম তার পাশাপাশি হাঁটছি, যদিও কাজুয়ার স্মৃতিতে এই কাজ অনেকবার করেছি। তাই খুব বেশি অপরিচিত ঠেকছে না দৃশ্যটা।

বাইরে বেশ ঠান্ডা। ক্যাফের আরামদায়ক উষ্ণতা পেছনে ফেলে আসায় এখন মনে হচ্ছে রীতিমত জমে যাবো। গাল লাল হয়ে গেছে, দেখে মনে হতে পারে কেউ সজোরে থাপ্পড় কষিয়েছে। ক্যাফের সাইনটা দেখে মনে হচ্ছে হাওয়ায় ভাসছে। একটা সিডার বনের মধ্যে দিয়ে সামনে এগিয়েছে রাস্তাটা।

“আমরা যেখানে যাচ্ছি, সেটা আসলে আমার মামার বাড়ি,” নাক টেনে বললো সাওরি।

বাবা মা মারা যাবার পর সাওরি আর কাজুয়া প্রতিবেশী এক লোকের বাসায় গিয়ে ওঠে। স্বপ্নে তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা বুঝতে পারিনি।

“এখন আমি আর মামা একসাথেই থাকি।”

“আপনার মামী?”

“কাজুয়ার দুর্ঘটনার কিছুদিন আগে নিউমোনিয়ায় মারা যান তিনি।

এই স্মৃতিটা দেখিনি বাম চোখে। আসলে এখনও কাজুয়ার ব্যাপারে অনেক কিছু জানি না। বলা যায় তার পুরো জীবনের অভিজ্ঞতার খণ্ড খণ্ড চিত্র দেখেছি মাত্র।

চারিদিক চুপচাপ। বাড়িঘরের সংখ্যাও হাতে গোনা। সাওরি বলেছিল যে ক্যাফে থেকে বাড়িতে পৌঁছুতে পনেরো মিনিটের মত সময় লাগবে। ঠান্ডায় দাঁত ঠকঠক করছে আমার। রাস্তার দু’পাশে লম্বা লম্বা গাছ। কতগুলো পরিত্যক্ত গাড়ি চোখে পড়লো, মরিচার কারণে এখন আর আসল রঙ বোঝা যাচ্ছে না। অন্ধকারে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

একটা পাখির ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ কানে এলো। অন্ধকারের জন্যে বুঝতে পারলাম না যে কি পাখি। তবে অবয়ব দেখে মনে হচ্ছে একটা কাক। দেবদারু গাছগুলোর ওপর দিয়ে উড়ছে।

মেলানকলি গ্রোভে সাওরির সাথে হওয়া আমার প্রথম কথোপকথনের কথা ভাবলাম।

“কাজুয়া নেই এখানে,” বলে সে। এক মুহূর্তের জন্যে বড় অদ্ভুত লাগে কথাটা। তার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হয় যেন কোন কাজে একটু আগে বাইরে গেছে কাজুয়া। তবে প্রচ্ছন্ন বেদনার সুরটা কান এড়ায় না।

“দুর্ঘটনার কথাটা জানি আমি।”

“ওহ…” বলে মাথা নিচু করে ফেলে সাওরি।

“ও মারা যাবার পর কি হয়েছে সেটা বলবেন, প্লিজ?”

তখন জানতে পারি যে কিভাবে ভাইয়ের মৃত্যুর সাথে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সাওরি।

দু’মাস আগে রাস্তায় কাজুয়াকে ধাক্কা দেয় একটা গাড়ি। ড্রাইভার অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে ফোন দেয়। কিন্তু কোন সাহায্য আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। সাওরি হাসপাতালে গিয়ে মৃতদেহ সনাক্ত করে। সে মুহূর্তে তার মনে কি চলছিল তা ভাবতেও খারাপ লাগে আমার। বাবা-মা’র মৃত্যুর পর কাজুয়াই ছিল তার সবকিছু।

দুর্ঘটনার তারিখটা জিজ্ঞেস করলাম সাওরিকে। আমার অপারেশনের ঠিক আগ দিয়েই। কায়েদি থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে একটা পাহাড়ি রাস্তায় মারা যায় কাজুয়া।

নীল দেয়ালের বাড়িটা কাজুয়ার দুর্ঘটনাস্থল থেকে খুব বেশি দূরে হবার কথা না। পরোক্ষভাবে হিতোমির অপহরণকারীই খুন করেছে কাজুয়াকে।

তাকে খুঁজে বের করবো আমি। দুর্ঘটনার যেহেতু দু’মাস হয়েছে মাত্র, হিতোমি হয়তো বেঁচে আছে এখনো। স্থানীয় পত্রিকার খবর অনুযায়ী এক বছর আগে অপহরণ করা হয় তাকে। কিন্তু কাজুয়া তাকে দেখতে পায় দু মাস আগে। তার মৃত্যুর তারিখ শুনে নিশ্চিত হলাম ব্যপারটা। দশ মাসে যেহেতু মেয়েটাকে হত্যা করেনি অপহরণকারী, তার এখনও বেঁচে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করা যাবে না। হিতোমিকে বাঁচাতে হলে আগে বাড়িটা খুঁজে বের করতে হবে। প্রমাণ যোগাড় করে পুলিশে খবর দিতে হবে এরপর।

সাওরির পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে পরদিনই অপহরণকারীর খোঁজে বের হবো। ভয় লাগছে ভীষণ। কাজটা কি করতে পারবো আমি?

সাওরির বাড়িটার সামনে চলে এলাম।

বাঁ চোখের স্বপ্নে সাওরি আর কাজুয়া প্রথম যেদিন এই বাড়িতে এসেছিল সেদিনকার ঘটনা দেখেছি আম। দরজার পাশে নামফলকে “ইশিনো’ লেখা মোটা হরফে। ওদের মা’র পরিবারের পদবি।

কাজুয়ার বয়স বেশ কম ছিল সেসময়। সাওরির হাত ধরে বাড়িটায় উপস্থিত হয় সে। তার অস্থিরতা স্বপ্নের মধ্যেও স্পর্শ করেছিল আমাকে। শক্ত করে বোনের হাত ধরে বাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল অনেকক্ষণ।

সাওরি আমার, মানে কাজুয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে হাসে একবার। তার নিজের বয়সও কম ছিল তখন। মনে মনে নিশ্চয়ই উৎকণ্ঠিত ছিল সে-ও। তবুও ভাইকে ঠিকই সাহস যোগাচ্ছিল।

ইশিনোদের সাথে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুরুটা অবশ্য খারাপ ছিল না। বাচ্চাদের প্রতি সবসময় উদাসীন দৃষ্টিতে তাকাতেন মিঃ ইশিনো। বেশ কয়েকবার তাকে ট্রাক চালাতে দেখে ধরে নেই যে সেটাই তার পেশা। কাজুয়ার চোখের স্মৃতিগুলোয় কখনো হেসে কথা বলতে দেখিনি তাকে। মিসেস ইশিনোই খেয়াল রাখতেন সাওরি আর কাজুয়ার।

“এটাই আমার মামার বাড়ি,” সাওরি বললো। “কাজুয়াও এখানেই থাকতো।”

আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভেতরে প্রবেশ করলো সে। হয়তো মিঃ ইশিনোর সাথে কথা বলবে।

অপেক্ষা করতে সমস্যা হচ্ছে না কোনও প্রবেশপথের কাছে গিয়ে বাড়িটার আশপাশে তাকালাম। ভেতরে ভেতরে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। সেই একই মেইল বক্স, খবরের কাগজের স্ট্যান্ড, ছোট একটা গেট। খুবই সাধারণ একটা বাড়ি।

অপারেশনের পর যখন প্রথম নিজের বাড়িতে যাই, তখন এরকম কোন অনুভূতি কাজ করেনি ভেতরে। মনে হয়েছে সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় যাচ্ছি। কিন্তু কাজুয়া আর সাওরির মামার বাসাকে সে তুলনায় আপন ঠেকছে।

এই বাড়ির অনেক স্মৃতি আছে আমার, মানে কাজুয়ার। তার চোখেই সব দেখা।

তার বাবা-মা বেঁচে থাকার সময়েও এই বাড়ির সামনে দিয়ে স্কুলে যেত। আবার হাইস্কুলে পড়ার সময় আর্কেডে ভিডিও গেইম খেলে দেরি করে যখন বাসায় ফিরতো, সাওরি বাইরে দাঁড়িয়ে রাগত ভঙ্গিতে অপেক্ষা করতো তার জন্যে।

“নামি, ভেতরে এসো,” দরজা থেকে বললো সাওরি। কোমড়ে হাত দিয়ে এই অবস্থান থেকেই কতবার ছোটভাইকে বকুনি দিতে দেখেছি

তাকে। “হাসছো কেন?” জানতে চাইলো সে।

মাথা ঝাঁকালাম কেবল জবাবে। ভেবেছিলাম অপরিচিত একটা বাসায় এসে খুব বিচলিত অনুভব করবো মনে মনে, কিন্তু সেরকম কিছু হলো না। সরু করিডোরটা পেরিয়ে একটা মোটামুটি সাইজের হলঘরে পৌঁছুলাম। হলঘরের পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। বাঁ চোখের স্মৃতিগুলো থেকে জানি যে সিঁড়িটা বেশ খাড়া।

লিভিংরুমটা জাপানি ঐতিহ্যে সাজানো। মেঝেতে তাতামি ম্যাট বিছানো। কোতসু টেবিলটা ঘরের একদম মাঝখানে। ওটার আশপাশে কতগুলো খবরের কাগজ আর পত্রিকা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা।

ট্র্যাকস্যুট পরিহিত ধূসর চুলের একজন লোক আমাকে দেখে বাউ করলো। “হ্যালো,” বললো সে। যা ভেবেছিলাম, তার চাইতে চড়া তার গলার স্বর। সামনা সামনি দেখার আগে এতদিন ভেবে এসেছি, তাকে দেখেই হয়তো ভয় পাবো। স্মৃতিগুলোতে সবময় স্ত্রীর সাথে উচ্চবাচ্য করতে দেখে এসেছি।

কিন্তু আমার সামনে এ মুহূর্তে যাকে দেখতে পাচ্ছি, তাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম ঠেকছে। খুব একটা লম্বাও নয়। মুখে দুর্বল একটা হাসি শোভা পাচ্ছে। আমার বাম চোখের স্মৃতিগুলোতে তার বয়স কত ছিল? সাওরি আর কাজুয়ার মামি মারা যাবার পর বদলে গেছেন? বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাঁচার ইচ্ছেটাও চলে গেছে মনে হচ্ছে।

তবে এখনও নিয়মিত কাজ করেন আর সাওরির দেখাশোনা করেন তিনি-এটা শুনেছি সাওরির কাছ থেকে। এমনকি রান্নাও করেন দু’জনের জন্যে।

“এরকম অগোছালো অবস্থার জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছ থেকে। তুমি করেই বললাম। খাওনি বোধহয় এখনও?”

আমাকে কোতসুর পাশে বসার অনুরোধ করলেন তিনি।

সাধারণত কোথাও গেলে নিজেকে বাড়তি ঝামেলা মনে হয় আমার; বড্ড অনুশোচনা হয় ভেতরে ভেতরে। হয়তো আগের নামির চাইতে নিজেকে ছোট করে দেখি সবসময়-একারণেই। কিন্তু এখানে সেরকম লাগছে না। আশপাশের সবকিছুই আগে দেখেছি। প্রতিবার যখন পরিচিত একটা দৃশ্য দেখি, বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।

সাওরির জোরাজুরিতে ওদের সাথেই রাতের খাবার সারতে রাজি হতে হলো। সে রান্না করতে গেলে মামার সাথে কথা বলে সময় কাটালাম।

“কাজুয়ার কবর দেখতে এসেছো?” জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

“জ্বি… জানি অনেক দেরি করে ফেলেছি…।”

এখানে আসার পথে কারণ হিসেবে এই কথাটা বলবো বলে ঠিক করেছি।

“সাওরি তোমাকে নিয়ে যাবে সেখানে।”

রান্নাঘর থেকে সাওরির বাসন নাড়াচাড়ার শব্দ ভেসে এলো। একটা স্লাইডিং দরজা লিভিংরুম থেকে পৃথক করে রেখেছে রান্নাঘরটা।

“সাওরি আর কাজুয়ার কাছে আপনার ব্যাপারে অনেক শুনেছি, বললাম।

“তাই? কাজুয়া কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমাদের কিছু বলেনি কখনো।”

“আসলে, সেটা…”

“তুমি এসেছো দেখে খুব খুশি হয়েছি,” মাথা নিচু করে বললেন তিনি। তার ব্যবহার একদম ভিন্ন ঠেকছে এখন। চোখের স্মৃতিতে যা দেখেছিলাম, সেগুলো মিলছে না। কাজুয়ার উদ্দেশ্যে কখনো হাসেননি। কিন্তু এখন যা বলছেন, সেগুলো মন থেকেই বলছেন বলে মনে হচ্ছে।

সাওরি আর তার মামার সাথে এক টেবিলে বসে খাবো, এটা কিছুদিন আগেও কল্পনাতে ছিল না। মিশ্র একটা অনুভূতি কাজ করছে ভেতরে ভেতরে।

আমাকে নিয়ে কি চলছে তাদের মনে? এভাবে হঠাৎ করে উদয় হওয়াতে বিরক্ত হয়েছে?

বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ করছে না। খুব বেশি কথা হলো না রাতের খাবারের সময় মনে হচ্ছে টেবিলের মানুষগুলো একে অন্যের অস্তিত্বের কথা ভুলেই গেছে। তাই অন্য দু’জনের উপস্থিতি সত্ত্বেও একাকী লাগছে ভীষণ।

বাঁ চোখের স্মৃতিগুলোতে কিন্তু দেখেছিলাম রাতের খাবারের সময় বেশ হাসিখুশি থাকতে সবাই। হয়তো তখন মিসেস ইশিনো বেঁচে ছিলেন বলেই গোমড়া ভাবটা জমাটবাধার সময় পেতনা কারো মনে। মাঝে মাঝে একজন মানুষের উপস্থিতিই বদলে দিতে পারে আশপাশের পরিবেশ।

ইশিনোদের বাড়িতে এখন যে দুজন মানুষ থাকে তারা দুজনই অবসাদের ভারে ন্যুজ। ক্ষিধে মরে গেল আমার। সাওরি আর মিঃ। ইশিনোকে এভাবে চুপচাপ আপনমনে খাবার খেতে দেখতে খুব খারাপ লাগছে।

এই থকথকে নীরবতার মাঝেই জিজ্ঞেস করলাম যে মানুষ হিসেবে কাজুয়া কেমন ছিল।

“কাপুরুষ, ভীতু,” সাওরি বললো সাথে সাথে। “আর ভীষণ অলস। পড়াশোনায় মন ছিল না, খেলাধুলাও পারতো না তেমন একটা ভালো কোণ গুণই ছিল না আমার ভাইটার।”

হাই স্কুলের পড়াশোনা চুকে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় কাজুয়া, কিন্তু শেষ করতে পারে না। ক্লাসগুলো নাকি খুব বেশি কঠিন লাগতো তার কাছে। দুর্ঘটনার বছরটা মোটামুটি শুয়ে বসেই কাটিয়েছে।

 “তবে মনটা খুব ভালো ছিল,” কিছুক্ষণ পর বললো সাওরি।

মাথা নাড়লাম। আসলে কাজুয়ার নিজের ব্যাপারে খুব কমই জানি আমি। কারণ বাঁ চোখের স্মৃতিগুলোতে সবসময় অন্যদের দেখতাম। কদাচিৎ আয়নার দিকে তাকালে তখন তার চেহারা দেখেছি কয়েকবার। তবে সেই খণ্ড খণ্ড স্মৃতিগুলো থেকেই এটুকু বুঝেছিলাম যে ছাত্র হিসেবে খুব একটা ভালো নয় কাজুয়া। বন্ধুবান্ধবের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। স্মৃতিশক্তি হারাবার পূর্বে আমি যেরকম ছিলাম, তার ঠিক উল্টোটা ছিল সে।

বাথরুমে গেলাম। সেখানকার আয়নার দিকে তাকাতেই অদ্ভুত একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়। এই যে কাজুয়ার বাম চোখটা ভাগ্যগুণে এখনও বেঁচে আছে, সেটা কি আগের বাসাতে ফিরে নস্টালজিয়ায় ভুগছে? কাজুয়ার টুথব্রাশটা এখনও বেসিনের একপাশে রাখা। দুর্ঘটনার পরেও সাওরি সেটা সরিয়ে ফেলেনি। তবে ব্রাশটা যে আসলেও কাজুয়ার, সেটা কিন্তু কেউ আমাকে বলে দেয়নি। স্বপ্নেও দেখিনি। তবুও মনে হচ্ছে এটাই সত্যি।

লিভিং রুমে ফিরে আসার পর খেয়াল করলাম সাওরি আর তার মামা দু’জনই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

“বাথরুমটা খুঁজে পেয়েছে তাহলে একাই!” সাওরি বললো। “বেশিরভাগ লোকই হারিয়ে যায় ওটা খুঁজতে খুঁজতে।”

*

গেস্ট রুমে থাকার বন্দোবস্ত করা হলো আমার। ক্লোজেট থেকে একটা তোষক বের করে দিয়েছে সাওরি। কিন্তু ঘুমোতে যাবার আগে একটা কাজ, করতেই হবে আমাকে। আমাকে ইতস্তত করতে দেখে সাওরি জিজ্ঞেস করলো যে কোন সমস্যা হয়েছে কিনা।

কাজুয়ার ঘরটা দেখতে চাই, সত্যটাই বললাম।

এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে সাওরি, মলিন একটা হাসি ফুটলো তার চেহারায়।

বাম চোখের স্মৃতিতে ঘরটা যেরকম দেখেছিলাম, সেরকমই আছে।

“এখনও নিয়মিত পরিষ্কার করি আমি,” গোটা ঘরটায় আমাকে নজর বুলাতে দেখে বললো সাওরি। “কোন দরকার নেই, জানি। তবুও না করে পারি না।”

একটা বড় জিগস পাজল দেখলাম একপাশে। মোটরসাইকেলে বসা একটা ছেলের ছবি ওটায়। গরম হতে শুরু করলো আমার বাঁ চোখ। স্মৃতির ঢাকনা খুলতে খুব বেশি সময় লাগলো না।

“এই পাজলটার…” নিজের অজান্তেই কথা বলে উঠলাম।

“একটা অংশ হারিয়ে গিয়েছিল। খুব ঝগড়া হয়েছিল সেটা নিয়ে আপনাদের মধ্যে…।”

মাথা নাড়লো সাওরি। “ভ্যাকুয়াম ক্লিনারে পেয়েছিল হারানো টুকরোটা। ওকে না বলেই ঘরটা পরিষ্কার করতে ঢুকেছিলাম সেদিন”

এজন্যেই তাহলে ঝগড়া করছে দুই ভাইবোন, ভাবলাম। বাম চোখের স্মৃতিতে তরুণী সাওরিকে দেখছি কোমড়ে হাত দিয়ে কাজুয়ার সাথে তর্ক করতে। কিন্তু কোন শব্দ না শুনতে পাওয়ায় ঝগড়ার বিষয়বস্তু বুঝতে পারিনি।

টিস্যু বক্স থেকে একটা টিস্যু বের করে নিয়ে নাক ঝরলো সাওরি। ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।

“আমার ভাই তোমার সাথে সবকিছু নিয়েই কথা বলতো, তাই না?”

পাজলের স্মৃতিটা শেষ হবার সাথে সাথে আরেকটা স্মৃতি ভেসে উঠলো বাম চোখের পর্দায়। এই বাড়িটায় স্মৃতির কোন শেষ নেই কাজুয়ার। বিশেষ করে এই ঘরের বইখাতা, টেবিল, ল্যাম্প থেকে শুরু করে জানালার শার্সি পর্যন্ত ট্রিগার হিসেবে কাজ করছে। কাজুয়ার স্মৃতিগুলো এখানে আরো ভালোমতো অনুভব করতে পারছি।

কাজুয়ার বিছানায় বসে আছে সাওরি।

“আমার ভাই যে মারা গেছে সেটা কার কাছে শুনেছো?”

তৎক্ষণাৎ কোন জবাব মুখে এলো না। কি বলবো? বিশ্বাসযোগ্য উত্তর হিসেবে কি বলা যায় সেটা ভাবছি, এ সময় সাওরি বললো, “পুলিশের ধারণা, কাজুয়ার মৃত্যু আত্মহত্যাও হতে পারে।

কি বলছে সাওরি এসব? আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম যে সবাই এটাকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিয়েছে, এর বেশি কিছু না।

“যে গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগেছিল কাজুয়ার, সেটার ড্রাইভার বলেছে-হঠাৎ করেই নাকি লাফ দিয়ে তার গাড়ির সামনে এসে পড়ে সে। দুর্ঘটনার আগের কয়েকদিন বাসাতেও বড্ড অদ্ভুত আচরণ করছিল কাজুয়া। কিছু একটা ভেতরে ভেতরে খোঁচাচ্ছিল ওকে। আর কেউ না বুঝলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারি। কোন কাজে মন বসাতে পারছিল না। কি যেন ভাবতে সারাদিন,” বলে আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো সারি। “ভেবেছিলাম তুমি হয়তো এ ব্যাপারে জানো…?”

তার জন্যে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। আমি জানি কাজুয়া কেন ওরকম অদ্ভুত আচরণ করছিল। হিতোমি আইজাওয়ার হদিস পেয়েছিল সে। ঘটনাস্থল থেকে পালানোর সময় গাড়ির সামনে পড়ে। এর আগের দিনগুলোতে নিশ্চয়ই ঘটনাটা নিয়ে দিনরাত ভাবছিল সে।

অপহৃত মেয়েটার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেনি। হয়তো সে-ও আমার মতন শক্ত কোন প্রমাণের অপেক্ষায় ছিল। নিশ্চিত হবার জন্যে নীল দেয়ালের বাড়িটায় উপস্থিত হয়েছিল যাতে পুলিশকে ঠিকঠাক সব তথ্য দিতে পারে।

“আত্মহত্যা করেনি কাজুয়া,” বললাম আমি।

আমার চোখের দিকে তাকালে সাওরি। এক মুহূর্তের জন্যে বিস্ময় ভর করলো তার চোখে, তবে দ্রুত কেটে গেল সেই বিস্ময় ভাব।

লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে প্রায় ফিসফিসে কণ্ঠে বললো, “জানি আমি… জানি। কিন্তু ওর মৃত্যুর পর একটুও কাঁদিনি। এমনকি এখনও…অতটা খারাপ লাগে না। অন্য সবাই তো কাঁদছিল, কিন্তু ওর নিজের বোন হয়ে… আমি ঠিক আছি কিভাবে?”

হাতে কিছু একটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে সাওরি। কাজুয়ার পছন্দের সোনালি হাতঘড়িটা। এক পাশের স্ট্র্যাপ ছেঁড়া ওটার।

আমাকে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাওরি বললো, “ওর বিশতম জন্মদিনে এটা উপহার দিয়েছিলাম।”

এই তথ্যটা জানা ছিল না আমার, কিন্তু ঘড়িটা যে কাজুয়ার খুব প্রিয় সেটা জানতাম। স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেলেও সবসময় ঘড়িটা সাথে রাখতো সে।

“দুর্ঘটনায় নষ্ট হয়ে গেছে ঘড়িটা। ঠিক ওর মৃত্যুর সময়টায় কাটাগুলো আটকে যায়,” বলে ঘড়িটা আমার দিকে বাড়িয়ে ধরলো সে। “তুমি নেবে এটা?”

মাথা ঝাঁকালাম। “আপনার কাছেই ভালো থাকবে জিনিসটা। কাজুয়াও সেটাই চাইতো নিশ্চয়ই।”

কাজুয়ার একটা স্মৃতিচিহ্ন ইতোমধ্যেই আমার কাছে, আর কিছুর দরকার নেই।

উঠে দাঁড়ালো সাওরি।

“কালকে কবরস্থানে যাবে?”

মাথা নাড়লাম। আসলেও যেতে চাই আমি।

কাজুয়ার ঘর থেকে বের হলাম দুজনে। নিচে নামার সময় সাওরি বললো, “একটু আগে তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বড় অবাক হয়েছিলাম। একদম ওর চোখের মতন।”

*

শহরের বাইরে মা-বাবার কবরের পাশেই কবর দেয়া হয়েছে কাজুয়াকে। মিঃ ইশিনোর বাসা থেকে হেঁটে যেতে এক ঘণ্টা লাগে।

“যদি গাড়িতে যেতে চাও, তাহলে আমার এক বন্ধুকে বলতে পারি, সাওরি বললো। “ওর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।”

সাওরি গাড়ি চালায় না সাধারণত। বললাম যে হেঁটেই যাব।

একটা বিশাল পাহাড়ি উপত্যকায় শত শত কবরফলক। এরকম একটা দৃশ্যও যে মন জুড়িয়ে দিতে পারে, জানা ছিল না। হয়তো আশপাশের পরিবেশটাই এমন। এতগুলো কবরফলকের মাঝে কাজুয়ার কবর খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য।

ফুইয়ুতসুকিদের পারিবারিক কবরটা গোরস্থানের একদম শেষ প্রান্তে। সাওরি গিয়ে কবরের আশপাশ পরিষ্কার করলে প্রথমে। শুকনো পাতা সরিয়ে দিল।

হাত জড়ো করে একসাথে প্রার্থনা করলাম দু’জন। কাজুয়াকে একদম মন থেকে ধন্যবাদ দিলাম তার উপহারের জন্যে। আমাকে তোমার চোখটা দেয়ার জন্যে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।

ওর স্মৃতিগুলোই যে আমার সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পাথেয়, সেটাও বললাম। নতুবা বিষণ্ণতার আস্তাকুঁড়ে এতদিনে আমাকে ছুঁড়ে ফেলতো মহাকাল। অবসাদের চক্র ভেঙে বেরুতে পারতাম না। চোখ হারাবার পর নিজের স্মৃতি বলতে কিছুই তো ছিল না।

হার্ডওয়্যার স্টোরটায় দেখা সেই কষ্টের স্মৃতিটার কথা ভাবলাম। কাজুয়া আর সাওরির বাবা-মা মারা যান সেটায়।

ফেরার পথে নাক ঝরতে ঝরতে সাওরি বললো, “মা-বাবা’র ভাগ্য প্রচণ্ড খারাপ ছিল সেদিন। যে দড়িটা দিয়ে খুঁড়িগুলো বেঁধে রাখা হয়েছিল, সেটা ছিঁড়ে যায় হঠাৎই।”

মেলানকলি গ্রোভের উদ্দেশ্যে হাঁটছি আমরা। শহরের মাঝ দিয়ে একেবেকে যাওয়া হাইওয়েটা পেছনে ফেলে এলাম। কাজুয়ার চোখ দিয়ে দেখেছি, এরকম অনেকগুলো জায়গা বাস্তবেও দেখলাম।

“শুনেছি, কাজুয়া নাকি দুর্ঘটনাটা নিজের চোখে দেখেছিল,” বললাম।

থেমে, বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো সাওরি।

“কাজুয়া বলেছে তোমাকে এটা?”

এরকম প্রতিক্রিয়া আশা করি নি। মাথা নাড়লাম কেবল।

“সেদিন ওখানে যারা ছিল, তারাও একই কথা বলে। কিন্তু কাজুয়ার নিজের মনে ছিল না। বরং সবসময় বলতে যে কিছুই দেখেনি। আমার ধারণা, স্মৃতিটা এতটাই দুঃসহ যে, ইচ্ছেকৃতভাবে সেটা ভুলে যায় কাজুয়া।”

সাওরির কথায় আসলেও যুক্তি আছে। আমার নিজের সাথেও তো একই রকম ঘটনা ঘটেছে।

ব্যাপারটা কাজুয়ার মন ভুলে গেলেও, ছবিগুলো ঠিকই জমা ছিল চোখের স্মৃতিতে।

“নতুন এক কর্মচারির ভুলে দুর্ঘটনাটা হয়েছিল সেদিন। মাত্র কয়েকদিন আগেই মিলে কাজ নিয়েছিল ছেলেটা।

“ছেলে?”

“হ্যাঁ। হাইস্কুল থেকে পাশ করেই কাজে ঢুকে গিয়েছিল। দড়ি দিয়ে সে-ই বেঁধেছিল গাছগুলো। কিন্তু অভিজ্ঞতা না থাকায় ঠিকমতো গিঁট দিতে পারেনি…।”

কোন রাগ নেই সাওরির কণ্ঠে। বরং মনে হচ্ছে যে ছেলেটার প্রতি সহানুভূতি কাজ করছে তার।

গোরস্থান থেকে মেলানকলি গ্রোভে পৌঁছুতে এক ঘণ্টার মত লেগে গেল।

আশপাশের দোকানপাট, বাড়িঘর সবই আমার পরিচিত। কে বলবে যে এই প্রথম সামনাসামনি দেখছি ওগুলো? স্টেশনারি দোকান আর নুডলস শপগুলো এখনও একইরকম আছে।

একটা ক্যান্ডি শপ চোখে পড়লো। ভেতরটা বেশ অন্ধকার। জানালা দিয়ে ভেতরে সারি সারি ক্যান্ডির প্যাকেট দেখা যাচ্ছে। তবে সেই ব্যাগগুলোর ওপর ধুলো জমেছে মনে হলো।

“ভেতরে যাবে নাকি?” সাওরি জিজ্ঞেস করলো। “আগে কাজুয়া প্রায়ই এখানে আসতে এখানে।”

ভেতরে পা রাখতেই পেছন থেকে বেরিয়ে এলো এক মহিলা। পেছনের ঘরে টিভি দেখছিল সে।

“একটুও বদলাননি,” তার উদ্দেশ্যে হেসে বললো সাওরি। মহিলার মুখেও হাসি ফুটেছে, রীতিমত একটা বেড়ালের মত লাগছে এখন তাকে।

কাজুয়ার ছেলেবেলার স্মৃতিগুলোতে তার চেহারা যেমন দেখেছি, এখনও একদম সেরকমই দেখাচ্ছে।

একটা ললিপপ কিনে বেরিয়ে এলাম আমরা।

আবারো নাক ঝারলো সাওরি। টিস্যুটা ফেলে দিল মাটিতে।

“এভাবে রাস্তায় ফেলাটা কি ঠিক হলো?” জিজ্ঞেস করলাম।

“সবকিছু তো একসময় ধুলোতেই মিশে যাবে।”

ওর যুক্তিহীন কথাটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবলাম। আসলে প্রতিদিন এত বেশি পরিমাণে টিস্যুর প্রয়োজন হয় সাওরির যে ব্যবহৃত টিস্যুগুলো বাসায় বয়ে নেয়া সম্ভব না।

আশপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে তাদের উদ্দেশ্যে বাউ করছে সাওরি। আমার দিকে প্রশ্নাতুর চোখে তাকাচ্ছে সবাই। নিশ্চয়ই ভাবছে, এটা আবার কে?

মনে হচ্ছে যে এখানে অনেক লম্বা সময় ধরে আছি আমি। যেদিকেই তাকাই, পরিচিত দৃশ্য চোখে পড়ে। কিন্তু এখানকার অধিবাসীদের চাহনি মনে করিয়ে দেয় যে শহরটায় আমি একজন আগন্তুক।

আগন্তুক। কথাটা হৃদয়ে গেঁথে গেল আমার। ভুল করে এই জগতটায় পা দিয়ে ফেলেছি। আমি নামি, আবার নামি না। তাহলে আমি কে? কোথা থেকে এসেছি? প্রায়ই এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খায় আমার মাথায়।

আকাশে মেঘ জমেছে। সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। যে কোন মুহূর্তে তুষারপাত শুরু হতে পারে বলে মনে হচ্ছে। পুরো শহরটা স্তব্ধ। ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে উত্তর দিক থেকে। খুব বেশি লোক নেই রাস্তায়। যারা আছে, তাদের মুখে হাসি নেই।

শহরটা মরে যাচ্ছে নাকি? ধীরে ধীরে মহাকালের ধূসরতায় অদৃশ্য হয়ে যাবে হয়তো।

মেলানকলি গ্রোভ থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে থেমে গেল সাওরি।

“একটু ঘুরপথে যাওয়া যাক আজকে,” বললো সে।

একটা পার্শ্বরাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম আমরা। রাস্তা না বলে পাহাড়ি ঢালু পথ বলা ভালো। ঢাল বেয়ে যত ওপরে উঠতে লাগলাম, শহরটা নিচে নামতে লাগলো। রাস্তার এক পাশে সিডার বন, অন্য পাশে গার্ডরেইল। রেলিংগুলো থেকে কিছুটা দূরে আবারো সারি সারি গাছ।

কিছুদূর হাঁটার পর থেমে গেল সাওরি। নিচের পিচঢালা পথের দিকে তাকিয়ে আছে একমনে।

বুঝতে অসুবিধে হলো না, এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে কাজুয়া।

সাওরির চেহারায় কোন অনুভূতি নেই। পথটার ঠিক কোন জায়গায় আটকে আছে তার চোখ সেটা বুঝতে পারলাম না। গতরাতেই সে আমাকে বলেছে যে কাজুয়ার মৃত্যুর পর একটুও কাঁদেনি। আশপাশের সবাই ভীষণ কষ্ট পেয়েছে, কিন্তু একমাত্র তার চোখ দিয়েই পানি ঝরেনি।

আমার ধারণা সাওরির হৃদয়ে এখন কেবলই শূন্যতা। বিশাল, অতলান্ত শূন্যতা। আসলে ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদের প্রাথমিক ধাক্কাটাই কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে।

দেখে মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কাঁধে হাত রাখলাম। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালে সাওরি।

জানিনা কেন, আমার ভেতরেও একটা অচেনা কষ্ট বাসা বেঁধেছে। সেটা কাজুয়ার জন্যে, নাকি সাওরির জন্যে-তা ঈশ্বরই জানেন। আমার নিজের কষ্টেরও তো শেষ নেই। খুব বেশি নাটুকে শোনাচ্ছে বোধহয় কথাগুলো।

ওপরের পাহাড়ি এলাকাটার দিকে তাকালাম। ওখানেই কোথাও আছে সেই নীল বাড়িটা। যেখান থেকে সব ঘটনার শুরু।

চুপচাপ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলাম দু’জন। কারো মুখেই কোন সাড়া নেই। রাস্তার দু’পাশে লম্বা সিডার গাছগুলো নীরবে পাহারা দিয়ে যাচ্ছে কাজুয়ার মৃত্যুস্থল।

*

আমরা ক্যাফের সামনের দরজাটা খোলার সাথে সাথে একটা ঘণ্টা বেজে উঠলো। ভেতরের উষ্ণ বাতাস স্বাগতম জানালো আমাদের।

“হঠাৎ করে ঠান্ডা জায়গা থেকে গরম কোথাও আসলে নাক দিয়ে পানি ঝরা বেড়ে যায় আমার,” কিমুরার উদ্দেশ্যে বাউ করে বললো সাওরি।

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ, আপনার সাইনাসের সমস্যা থাকলে বুঝতেন।”

নাক ঝারলো সাওরি। ক্যাফের ভেতরে ময়লার বাক্সেই টিস্যুগুলো ফেলে সে।

আমাকে গতদিন যে লোকটা লিফট দিয়েছিল তাকে বসে থাকতে দেখলাম কাউন্টারের উল্টোদিকের চেয়ারে। এতক্ষণ ঝিমাচ্ছিল, কিন্তু সাওরিকে দেখামাত্র সোজা হয়ে বসলো। “সাওরি!” বলে হাত নাড়লো ওর উদ্দেশ্যে। চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

“ফিরেছো তাহলে,” পাল্টা হাত নেড়ে বললো সাওরি।

কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম তরুণ ড্রাইভারের নাম সুমিদা। কাজুয়ার বন্ধু ছিল সে।

তবে তাদের বন্ধুত্ব খুব বেশিদিনের না হওয়াতে বাঁ চোখে স্মৃতিগুলোয় সুমিদাকে দেখিনি তেমন একটা। কিছুক্ষণ পর অবশ্য দু’জনের আড্ডা দেয়ার একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো চোখের পর্দায়।

এক বছর আগে দেখা হয়েছিল সুমিদা আর কাজুয়ার। মাতাল কাজুয়াকে ট্রেন স্টেশন থেকে মেলানকলি গ্রোভে নিয়ে এসেছিল সুমিদা। সেদিন বিকেলেই একটা পাবে প্রথম কথা বলেছিল তারা।

“ক্লাসের কি খবর?” সাওরি জিজ্ঞেস করলো তাকে।

“ছুটি এখন।”

চেহারা একদম লাল হয়ে উঠেছে সুমিদার। মনে কি চলছে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

“গতকাল আমাকে সাহায্য করার জন্যে ধন্যবাদ,” বললাম। সে কাজুয়ার বন্ধু ছিল শোনার পর আগের চাইতে আপন মনে হচ্ছে।

“কিমুরা আমাকে আপনার ব্যাপারে বলেছে,” আন্তরিক হেসে বলল সুমিদা।

একটা টেবিলে বসে সুমিদা আর সাওরিকে দূর থেকে আলাপ করতে দেখলাম।

কিমুরা এক গ্লাস দুধ নিয়ে এলো আমার টেবিলে। সেটা খাবার সাথে সাথে ভেতর থেকে হিমের শেষ অনুভূতিটুকুও বিদায় নিল।

কিছুক্ষণ আগের সাওরি আর এখনকার সাওরির মধ্যে অনেক পার্থক্য। হাসিমুখে সুমিদার সাথে কথা বলে চলেছে, যেন ভাইয়ের কথা ভুলেই গেছে। কিন্তু কাছের কারো মৃত্যু চাইলেই সহজে ভোলা যায় না। এখন সে যা করছে, তা হচ্ছে অভিনয়। ভালো থাকার অভিনয়।

শিওজাকিকে আজকে দেখলাম না ক্যাফেতে, কিন্তু কিয়োকো ঠিক আগের জায়গাটাতেই বসে আছে। চোখাচোখি হলে একবার হাসলো সে, আমাকে তার টেবিলটায় বসায় আমন্ত্রণ জানালো।

“তুমি কি সাওরির ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড?”

“জ্বি?”

“কিমুরা তো সেটাই বলছিল।”

ওহ! আমাকে তাহলে কাজুয়ার প্রেমিকা ধরে নিয়েছে সবাই।

তার চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। গাল লাল হয়ে উঠছে। চাই সেটা কেউ দেখুক।

“আমি কায়েদিতে এসেছি খুব বেশিদিন হয়নি,” কিয়োকো বললো। “তাই কাজুয়ার সাথে খুব বেশি মেশার সুযোগ পাইনি।

আমার বাঁ চোখে দেখা স্মৃতিগুলোর কোনটায় তাকে দেখেছি কিনা চিন্তা করলাম। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। আসলে কাজুয়ার সাথে দেখা হয়েছে এরকম অনেকের চেহারাই ভুলে গেছি। শুধু কাছের কয়েকজনের চেহারা ভালোমতন মনে আছে। যেমন মিঃ ইশিনো, কিমুরা।

আমার হাতটা মুঠো করে ধরলো কিয়োকো। আঙুলের চামড়াগুলো কুঁচকে গেছে তার বয়সের ভারে। “জানি, ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে। তোমার বয়সী আমার একটা ছেলে ছিল।”

দুধের গ্লাসটা খালি হবার পরেও কিছুক্ষণ টেবিলে বসে থাকলাম। বিল মেটাতে গেলে হাত ঝাঁকিয়ে মানা করে দিল কিমুরা। “ক্যাফের পক্ষ থেকে ট্রিট ধরে নাও।”

“নামি,” সাওরি ডাক দিল এসময়। “কোথায় যাচ্ছো?”

“একটু হাঁটাহাঁটি করবো।”

“হারিয়ে যেও না।”

আমার জন্যে আসলেও চিন্তিত সে। হেসে মাথা নাড়লাম। সকাল বেলা মামার সামনে সাওরি আমাকে বলেছে যে যতদিন খুশি তাদের বাসায় থাকতে পারি।

বাইরে বেরোনোর সাথে সাথে ঠান্ডা বাতাসের ঝাঁপটা এসে লাগলো নাকে মুখে।

কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যেখানে হয়েছিল, সেদিকে রওনা হলাম। পথে তার কথা ভাবতে লাগলাম। বাঁ চোখের একটা স্মৃতিতে দেখেছিলাম বিশাল একটা খেলার মাঠে একা একা বসে কাঁদছে কাজুয়া। তবে দিনটা খুব সুন্দর ছিল।

কাজুয়াকে ভালোবাসি আমি। ওর দেখা দৃশ্যগুলো আলোকিত করে তুলেছে আমার মনের অন্ধকার কোণগুলোকে। আচ্ছা, একটা মানুষ তার জীবদ্দশায় কতগুলো দশ্য প্রত্যক্ষ করে?

অপহরণকারীকে যে করেই হোক খুঁজে বের করতে হবে আমার। তাকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে চাই। তার কারণে নিরীহ একটা মানুষের জীবন শেষ হয়ে গেছে, এর মূল্য চুকাতেই হবে।

দুর্ঘটনার জায়গাটা আশপাশের অন্য জায়গাগুলোর তুলনায় একটু বেশিই ঠান্ডা মনে হলো। আকাশ এখনও মেঘলা, বড় বড় সিডার গাছগুলোর ছায়ার কারণে অন্ধকার আরো জমাটবেঁধেছে। বনের ভেতর থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ ভেসে আসছে একটানা।

শরীর কাঁপছে আমার। দু’মাস আগে কাজুয়া রাস্তার ওপরে যেখানে পড়ে যায়, এ মুহূর্তে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাঁ চোখের স্মৃতিতে দেখেছি যে অপহরণকারী লুকিয়ে ছিল গাছের পেছনে। কাজুয়ার মৃত্যুর দৃশ্যটা আড়াল থেকে উপভোগ করেছে সে।

রাস্তার পাশে রেলিং টপকে বনের ভেতরে পা রাখলাম। ভয় লাগছে, তবে পাত্তা দিলাম না। সিডার গাছের ঝরা পাতাগুলোর কারণে নিজের পদশব্দ শুনতে পাচ্ছি না। স্মৃতির স্বপ্নে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে দেখেছিলাম কাজুয়াকে। যেদিক দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে সে, সেই পথটা অনুসরণের চেষ্টা করলাম।

কিন্তু হাজার খুঁজেও নীল দেয়ালের বাড়িটা খুঁজে পেলাম না। সামনে কেবল সারি সারি সিডার গাছ আর জমাটবাঁধা সবুজ। ওগুলোর মাঝ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

ভেবেছিলাম হাঁটাহাঁটি করলে শরীর গরম হবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ঠান্ডা আরো জাঁকিয়ে বসছে। এই সিডার বনের নৈঃশব্দ্য আমার শরীরের উষ্ণতা শুষে নিচ্ছে যেন।

জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিলাম। বাম পকেটে ডিম্পোজেবল ক্যামেরাটার অস্তিত্ব টের পাচ্ছি। কায়েদিতে আসার পূর্বে কিনেছি ক্যামেরাটা। অপহরণকারীর বাড়িটা খুঁজে পেলে ছবি তুলে রাখবো প্রমাণ হিসেবে। তলকুঠুরির জানালাটা দিয়ে হয়তো দেখতে পাবো হিতোমি আইজাওয়াকে।

এসব ভাবতে ভাবতেই থমকে যেতে বাধ্য হলাম। অপহরণকারীকে ধরার আমার পরিকল্পনা মাঠে মারা যেতে বসেছে। সামনে দশ ফুট লম্বা একটা কংক্রিটের দেয়াল। দেয়ালের ওপরে স্টিলের রেলিং। দেখে মনে হচ্ছে একটা পথ চলে গিয়েছে দেয়ালটার ওপর দিয়ে। যতদূর চোখ যাচ্ছে দুই দিকেই বিস্তৃত দেয়ালটা।

বিভ্রান্তি ভর করলো আমার চিত্তে। কাজুয়ার স্মৃতিতে তো দেখেছিলাম যে নীল বাড়িটা থেকে সরাসরি বনের ভেতরে প্রবেশ করেছিল সে। তখন তো এরকম কোন দেয়াল ছিল না। নতুবা ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নিচে পড়ে দেয়ালটার সাথে ধাক্কা লাগতো তার, রাস্তায় গিয়ে পড়তো না।

কোথায় আছি আমি?

রাজ্যের হতাশা নিয়ে দেয়ালটার পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কোথাও কোথাও নিশ্চয়ই ওপরে ওঠার সিঁড়ির দেখা মিলবে।

এরকমটা তো হবার কথা ছিল না, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা কঁকালাম। বাড়িটা উধাও হয়ে গেছে, সেই জায়গাই এই দশফুটি দেয়াল। এর ব্যাখ্যা কি?

আরো দশ মিনিট হাঁটার পর খেয়াল করলাম দেয়ালটার উচ্চতা কমছে। এক পর্যায়ে ভূমির সাথে সমতল হয়ে গেল।

বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছে দেয়ালের ওপরের পথটা। আমি যদি বেড়া না টপকে পিচঢালা পথটা বেয়ে সামনে এগোতাম, তাহলে এই দেয়ালটা চোখে পড়তো কিছুক্ষণ পর।

অপহরণকারীর বাড়ির হদিস হারিয়ে ফেলেছি আমি। পরিস্থিতি যে কতটা ঘোলাটে তা বোঝতে অভিজ্ঞ কারো দরকার হবে না। দৈব সাহায্য না পেলে হিতোমিকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

গাড়িটার সাথে যে স্থানে ধাক্কা লেগেছিল কাজুয়ার, সে জায়গাটা খুঁজে বের করতে পারলেই অপহরণকারীর বাসাটা পেয়ে যাবো, এমনটাই ভেবে এসেছি আমি। কিন্তু বিধি বাম। অন্য কোন পরিকল্পনাও নেই মাথায়। অগত্যা বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পেয়েও যেতে পারি, বলা যায় না।

অন্ধকার নেমে আসা অবধি ঘুরে বেড়ালাম। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বাঁ চোখটা গরম হয়ে উঠেছে। একটা পুরনো ভেন্ডিং মেশিন দেখার পর কাজুয়ার ছোটবেলার স্মৃতি ভেসে উঠেছিল চোখের পর্দায়। কিন্তু অপহরণকারীর বাড়ি খুঁজে পাইনি। কাজুয়ার স্মৃতিগুলোতে যা যা দেখেছি, কায়েদিতে আসার পর সবকিছুই মিলে গেছে। তাহলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটার ক্ষেত্রে স্মৃতি কেন প্রতারণা করছে আমার সাথে?

.

হলওয়ে থেকে আগত পদশব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। ঘরে এই বিছানাটা বাদে আর কিছু নেই। একপাশে আমার ব্যাকপ্যাকটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে রাখা।

চোখ কচলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম। লিভিং রুমে মিঃ ইশিনোর সাথে দেখা হলো।

“সুপ্রভাত, মিঃ ইশিনো,” বলেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। এমনভাবে কথা বলছি যেন তিনি আমার নিজের পরিবারের সদস্য।

মিঃ ইশিনোও অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। “আমি তো ভেবেছি তুমি কাজুয়া। বিশেষ করে এটা গায়ে দেয়ার কারণে, আমার পরনের জ্যাকেটটার দিকে নির্দেশ করে বললেন তিনি। রাতে বেশি ঠান্ডা পড়ায় সাওরি এটা বের করে দিয়েছে আমাকে।

সাওরির তৈরি করা নাস্তা খেলাম আমরা। খাওয়া শেষে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন মিঃ ইশিনো।

কাঠুরেদের কাটা সিডার গাছ কাঠের মিল অবধি ট্রাকে করে পৌঁছে দেন তিনি। প্রতিদিন সকালে কাজের পোশাক পরে বাসা থেকে বের হন। রোজকার ব্যবহারে নরম হয়ে গেছে পোশাকগুলো।

তিনি গাড়ির দরজা খুলছেন এমন সময় পেছন থেকে ডাক দিলাম।

“একটা প্রশ্ন ছিল আমার,” বলে পকেট থেকে হিতোমির একটা ছবি বের করে তাকে দেখালাম। (লাইব্রেরির খবরের কাগজ থেকে অনুমতি না নিয়েই ছবিটা কেটে নিয়েছি)।

“এই মেয়েটাকে কখনো দেখেছেন আশেপাশে?”

ছবিটা এক ঝলক দেখে আমার দিকে তাকালেন তিনি। “ওকে খুঁজছে নাকি?”

“জ্বি।”

আবারো ছবিটার দিকে তাকিয়ে মাথা চুলকালেন মিঃ ইশিনো। “নাহ, দেখিনি।”

সাওরিও একই কথা বললো। টিভি চালু করেই ঘরের কাজ করছে সে। নাস্তার বাসনগুলো ধুয়ে ফেলেছে ইতোমধ্যে। হিতোমির মত কাউকে নাকি কখনো দেখেনি।

“আজকে কি করবে?” আমাকে জিজ্ঞেস করলো সে।

“কাজুয়ার কাছে শহরের যে জায়গাগুলোর গল্প শুনেছি, সবগুলো ঘুরে দেখবো।”

“ঠিক আছে। যতদিন খুশি এখানে থাকতে পারবে, এটা তো বলেছিই আগে। তোমাকে বাইরের কেউ মনে হয় না, জানো? তুমি যেভাবে বাড়ির ভেতরে ঘুরে বেড়াও, হাঁটাচলা করো-সবকিছুর মধ্যে কাজুয়ার ছাপ খুঁজে পাই। এমনকি ভাত খাবার ভঙ্গিটাও একই।”

“আজকে কি ক্যাফেতে ডিউটি আছে আপনার?”

আলতো মাথা নেড়ে সিঙ্কের কল চালু করলো সাওরি।

“কাজুয়া মারা যাবার পর থেকে এই বাসা আর ক্যাফে ছাড়া আর কোথাও যাইনি। কিছু করিও না। সপ্তাহে একবার শুধু একটা বাসায় কফি ডেলিভারি করতে যাই, ব্যস। কিন্তু কায়েদির বাইরে বেরুই না।”

কাজ বন্ধ করে শূন্য দৃষ্টিতে সিঙ্কের দিকে তাকিয়ে আছে সে। লিভিং রুম থেকে টিভির শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রাত্যাহিক রাশিফল পড়ে শোনাচ্ছে এক উপস্থাপক। কল বন্ধ করে দ্রুত টিভির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সাওরি।

নাক ঝেরে বললো, “আহহা! কন্যারাশি লোকজনের জন্যে আজকের দিনটা খারাপ যাবে দেখছি।”

আমাকে বাসার একটা চাবি দিয়ে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল সে। আমি যে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ, সেটা নিয়ে কোন মাথাব্যথাই নেই। চাইলেই কিন্তু বাসার জিনিসপত্র চুরি করে পালিয়ে যেতে পারি।

কিছুদিন আগে লাইব্রেরিতে দেখা বাঁ চোখের স্বপ্নটার কথা ভাবলাম আবারো। হিতোমি আইজাওয়ার ছবি ট্রিগার হিসেবে কাজ করেছিল। স্বপ্নে কাজুয়াকে একটা গাড়ির সাথে ধাক্কা খেতে দেখি। দশদিন পেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। ব্যাকপ্যাক থেকে বাইন্ডারটা বের করে সেই স্বপ্নের বর্ণনাগুলো পড়তে লাগলাম।

তলকুঠুরির জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল কাজুয়া। তখনই হিতোমিকে দেখে সে। এরপর আশপাশে নজর বুলিয়ে খেয়াল করে যে বাড়িটা নীল ইটে তৈরি।

তার বাঁ চোখ দিয়ে পুরো বাড়িটা দেখার সুযোগ হয়নি আমার। ছাদ কিংবা সামনের দিকটা কেমন দেখতে-সেটাও জানি না। কাজুয়া চেষ্টা করেছিল ক্রু ড্রাইভার দিয়ে জানালাটা খুলতে, কিন্তু কারো পদশব্দে সতর্ক হয়ে যায়। ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে দৌড় শুরু করে। পাশের বনটাতে ঢুকে যায় দ্রুত।

এখান থেকেই গোলমালের শুরু। আমি কালকে যে দেয়ালটা দেখেছি, সেটা কি পার হয় সে? জার্নালে এরকম কিছুর বর্ণনা নেই।

বাড়িটা থেকে সোজা বনের দিকে দৌড় দেয়। এক পর্যায়ে ঢাল বেয়ে নামার সময় হোঁচট খায়, একদম রাস্তার মাঝখানে গিয়ে পড়ে। সেখানেই সাদা গাড়িটা তো দেয় তাকে।

একটা ভিন সম্ভাবনা উঁকি দিল মাথায়। হয়তো অপহরণকারী কোন কারণে কাজুয়ার অচেতন দেহটা অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়। ফলে সবাই ভাবে যে দুর্ঘটনাটাও সেখানেই হয়েছে।

নাই, এটা অসম্ভব। নিজের গাধামোতে নিজেই বিরক্ত হলাম প্রচণ্ড। গাড়িচালক নিজে অ্যাম্বুলেন্স ডাক দেয়। সুতরাং অপহরণকারীর পক্ষে কাজুয়ার অচেতন দেই সরানোর মত সময় পাবার কথা না।

তাহলে কি কংক্রিটের দেয়ালটা পরে বানানো হয়েছে? সেটা হলেই। কেবল বলা যায় যে লাইব্রেরির স্বপ্নতে আমি যা দেখেছিলাম, তা ঠিক। এখানকার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেই অবশ্য জবাব পেয়ে যাবো।

মনে মনে প্রশ্নগুলো গুছিয়ে নিয়ে ক্যাফের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম। এই শহরে আমি যাদের চিনি, তারা সবাই ওখানেই আছে।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে, প্রায় দুপুর এখন। মেলানকলি গ্রোভেই লাঞ্চ সেরা নেয়া যাবে।

ক্যাফের ভেতরে বরাবরের মতনই আরামদায়ক উষ্ণতা। এক মুহূর্তের জন্যে অপহরণকারী কিংবা অন্য ব্যাপার সংক্রান্ত সব দুশ্চিন্তা দূর হয়ে গেল। মুখে হাসি নিয়ে কাউন্টারের উল্টোপাশে বসে পড়লাম।

কিমুরা একাই আছে আজকে। “সাওরি ডেলিভারি দিতে গেছে, বললো সে।

লাঞ্চের অর্ডার দিলাম আমি। খাবারের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ক্যাফেতে সাজানো ছোট ছোট কাপপিরিচগুলো দেখতে লাগলাম। কোনটাতেই ধুলো জমেনি। কেউ কি প্রতিদিন পরিষ্কার করে ওগুলো? কিমুরার আঙুলগুলো তো মোটা মোটা। তার পক্ষে এত ছোট কাপ পরিষ্কার

করা কষ্টসাধ্যই হবার কথা। হয়তো সাওরিই করে।

“আমি নিজেই পরিষ্কার করি সবকিছু,” যেন আমার মনে কথা ধরতে পেরেই খানিকটা রূঢ় ভঙ্গিতে বললো কিমুরা। অর্ডার দেয়া খাবারগুলো একটা ট্রেতে করে নিয়ে এসেছে সে।

“কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যে রাস্তায় হয়, সেটার একটু সামনে একটা লম্বা দেয়াল আছে। ওটা কবে বানানো হয়েছে?” জিজ্ঞেস করলাম।

“অনেক আগে। তখন বোধহয় আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম।”

হতাশ ভঙ্গিতে হিতেমির ছবিটা দেখালাম তাকে। “এই মেয়েটাকে কখনো দেখেছেন?”

“পুলিশে চাকরি নিয়েছে নাকি?” ভ্রূ কুঁচকে কথাটা বলে ছবির দিকে তাকায় সে। “নাহ, দেখিনি।”

“বেশ… এখান থেকে কেউ কি হারিয়ে গেছে গত কয়েক মাসে?”

“একজন বয়স্ক লোক হারিয়ে যাবার কথা শুনেছিলাম। তার কোন আত্মীয় স্বজন নেই শহরে।”

হারিয়ে যাওয়া লোকটার নাম কানেদা। শহরের কাছেই থাকতো সে, কিন্তু অনেকদিন যাবত তাকে কেউ দেখেনি।

“লোকে খুব একটা পছন্দ করতো না কানেদাকে,” কিমুরা বললো। “কয়েকজন তার কাছে টাকাও পেতো। আমার ধারণা পাওনাদারদের ভয়ে পালিয়ে গেছে।”

এই কানেদা লোকটার সাথে আমি এখানে যা করতে এসেছি সেটার কোন সম্পর্ক নেই মনে হচ্ছে।

“আশেপাশে ইটের তৈরি কোন বাসা আছে নাকি?” (জাপানে বেশিরভাগ বাড়ি কাঠের তৈরি)।

“কিয়োকোর সাথে কথা হয়েছে না তোমার? সে ইটের বাসায় থাকে।”

“নীল ইটের তৈরি একটা বাসা খুঁজছি।”

“নীল ইট..” বলে গম্ভীর ভঙ্গিতে একবার মাথা নাড়লো সে। “সেটার ব্যাপারে জানতে পারি।”

হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল আমার। এরকম উত্তর আশা করছিলাম না তার কাছ থেকে। “আসলেই? কোথায় ওটা? প্লিজ বলুন!” উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে গেলাম সিট ছেড়ে।

আমাকে ঠান্ডা করার ভঙ্গিতে হাত নাড়লো সে।

“কি এমন আছে ঐ বাড়িতে?”

থমকে গেলাম। এই প্রশ্নের উত্তরে কি বলবো তা আসলেও ভাবিনি। “না মানে… একজনের কাছে শুনেছি বাড়িটার কথা। নীল ইটের তৈরি যেহেতু, সুন্দর নিশ্চয়ই অনেক। সেজন্যেই নিজের চোখে দেখতে চাই।”

“শিওজাকি এসে পড়বে দ্রুত। সবসময় এখানেই লাঞ্চ সারে সে। জায়গাটা তার চেনা। তুমি বললেই নিয়ে যাবে।”

দেয়ালে ঝোলানো শিওজাকির আঁকা ছবিটা দেখলাম। একটা টলটলা পানির হ্রদের ছবি। সেখানে প্রতিফলিত হয়েছে আশপাশের বন।

নীল ইটের বাড়িটা যে এভাবেও খুঁজে বের করতে পারি সেটা মাথায় আসেনি। শিওজাকি নাহয় আমাকে ওখানে নিয়ে যাবে, কিন্তু এরপর কি করবো?

না, সামনের দিক দিয়ে যাওয়া যাবে না। ঘুরে পেছন দিয়ে যেতে হবে যাতে অপহরণকারী লোকটার চোখে না পড়ি। তখন ছবি তুলে নিব প্রমাণ হিসেবে। বাড়ি পর্যন্ত গাড়ি করে গেলে, অপহরণকারী সন্দেহ করতে পারে।

আচ্ছা, সে যদি সন্দেহ করেও, তখন কি হবে? হিতোমি বেঁচে থাকলে তার জন্যে বিপদ হবে।

এসময় ক্যাফেতে প্রবেশ করলো শিওজাকি। আবারো পেছনের সেই অন্ধকার টেবিলটায় গিয়ে বসলো সে। এমনভাবে ওটার দিকে এগিয়ে গেল যেন অন্য টেবিলগুলো চোখেই পড়েনি।

একটা ট্রেতে করে তার লাঞ্চ সাজিয়ে নিয়ে গেল কিমুরা। শিওজাকি নাকি প্রতিদিন একই সময়ে ক্যাফেতে এসে একই জিনিস অর্ডার করে। তার খাবার বিশেষ ভাবে রান্না করে কিমুরা। শিওজাকি নিরামিষভোজী, মাংস খায় না।

খেয়াল করলাম যে কিমুরা আমার ব্যাপারে কথা বলছে শিওজাকির সাথে। একবার আমার দিকে তাকালোও সে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে মাথা নামিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।

“খাওয়া শেষ হলে তোমাকে ওখানে নিয়ে যাবে ও,” কিমুরা বললো একটু পর।

এক ঘন্টার মত সময় লাগবে শিওজাকির। তাই এই সময়টুকু ক্যাফেতে পত্রিকা পড়ে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।

স্মৃতি হারিয়ে ফেলার পর থেকে বেশ কয়েকটা উপন্যাস পড়েছি। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করার পর থেকে বইই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। খুব বেশি বাছাবাছি করি না। হাতের কাছে যা পাই, সবই পড়ি। সেটা উপন্যাসও হতে পারে, আবার মাঙ্গা বা পত্রিকাও হতে পারে। যা-ই পড়ি, সব নতুন ঠেকে আমার কাছে।

স্মৃতি হারাবার আগে কি ধরনের বই পড়তাম। রোমান্টিক উপন্যাস? যেগুলো পড়ে চোখে পানি চলে আসততা। নাকি কবিতার বই?

সেই সুন্দর স্মৃতিগুলো হারিয়ে ফেলার জন্যে মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করি প্রায়ই। জানি যে আমার কোন দোষ নেই। তবুও, কিছুদিন আগে যখন নামির ঘরটা নিজের মত করে গোছালাম, অতীতের বেশ বড় একটা অংশ মুছে ফেলেছি।

এগুলো ভাবতে ভাবতে পত্রিকার পাতা উল্টে গেলাম। এরপর ঠিক করলাম একটা নতুন বই পড়বো। বইয়ের শেলফ ঘাটতে গিয়ে একটা অদ্ভুত বই চোখে পড়লো। বেশ পাতলা। রূপকথার গল্পের বই।

দ্য কালেক্টেড ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইলস : ভলিউম ১। নিচে ছোট্ট করে লেখা চোখের স্মৃতি।

উল্টেপাল্টে দেখলাম যে প্রতি পাতায় গল্পের সাথে ছবি জুড়ে দেয়া হয়েছে। কালো ছবিগুলো এমনভাবে আঁকা হয়েছে যে দেখলে অস্বস্তি লাগে।

মাঝের দিকের ছবিতে একটা দাঁড়কাককে একটা বাচ্চার চোখ তুলে নিতে দেখা যাচ্ছে। গা শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো, আরেকটু হলেই হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল বইটা। একবার ভাবলাম রেখে দেই, কিন্তু কেন যেন চোখ সরাতে পারছি না। যেন আমার ওপর মন্ত্র করেছে লেখক।

শুরু থেকে বইটা পড়বো বলে মনস্থির করলাম, এমন সময় লাঞ্চ শেষ করে উঠে দাঁড়ালো শিওজাকি। অগত্যা বইটা আবারো শেলফে রেখে দিতে হলো।

“চলুন তাহলে,” কালো রঙের কোটটা গায়ে চাপিয়ে বললো সে।

দুরুদুরু বুকে তার গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসলাম। কিমুরা ক্যাফের বাইরে এসে হাত নেড়ে বিদায় দিল আমাকে। হাসি লেগে আছে তার মুখে, যেন সে এমন কিছু একটা জানে যেটা আমি জানি না। হেসে তার উদ্দেশ্যে পাল্টা হাত নাড়লাম আমি।

নিঃশব্দে চলতে শুরু করলো গাড়িটা। গাড়ি সম্পর্কে খুব একটা ধারণা নেই আমার, তবে এই গাড়িটা নিঃসন্দেহে দামী। চকচক করছে ভেতরটা, এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধটাও দারুণ।

“শহর থেকে কিছু জিনিস কিনতে হবে আমাকে। থামলে আপনার অসুবিধে হবে?”

“না,” মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম।

“আপনি তাহলে কাজয়ার বন্ধু ছিলেন?”

“আপনি চিনতেন ওকে?”

“কয়েকবার দেখা হয়েছিল আর কি।”

“কায়েদিতে আপনি এসেছেন খুব বেশিদিন হয়নি বোধহয়?”

“গত বছর।”

ছবির ব্যাপারে কথা বলা শুরু করলো সে। গাড়ির মতনই, এই ব্যাপারেও আমি বিশেষ ‘অজ্ঞ। তাই শুধু হাঁ-হুঁ করে গেলাম। শিওজাকি কি বিখ্যাত কোন আঁকিয়ে নাকি?

ক্যাফেতে যে ছবিটা ঝুলছে সেটা বিদেশে থাকার সময় এঁকেছিল। “কেন যেন মনে হলো, মেলানকলি গ্রোভকেই দিয়ে দেই ছবিটা,” স্টিয়ারিং হুইল ধরে বললো সে।

ছবিটার দাম কত হতে পারে? এত জায়গা থাকতে কায়েদিতে কেন এলো সে? তাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু চুপ থাকলাম। খুব বেশি কথা বলার অভ্যাস নেই তার, সেটা স্পষ্ট। বিরক্ত হতে পারে।

একটা ফার্ম সাপ্লাই স্টোরের পার্কিং লটে গাড়ি থামালো সে।

খুব বেশি সময় নাকি লাগবে না, তাই গাড়িতেই রয়ে গেলাম আমি। হাতে মাথা রেখে জানালা দিয়ে সাইড মিররের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর শিওজাকি দোকান থেকে বেরিয়ে এসে সদ্য কেনা জিনিসগুলো ট্রাঙ্কে ঢুকিয়ে রাখলো।

“এবার তাহলে ঐ বাড়িটায় যাওয়া যাক,” ড্রাইভিং সিটে বসে বললো সে।

মাথা নাড়লাম। একটু নার্ভাস লাগছে।

অপহরণকারী আর হিতামি, দু’জনেই আছে সেখানে। বাড়িটা দেখা মাত্র গাড়ি থেকে নেমে যাবো। কোন রাস্তাটা দিয়ে যেতে হয় সেখানটায়, আপাতত সেটুকু জানাই যথেষ্ট আমার জন্যে।

কিছুক্ষণ পর শহরের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়েটায় উঠে পড়লাম। সেটা ধরে বেশ খানিকক্ষণ সামনে এগোনোর পর একটা পার্শ্ব রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে দিল শিওজাকি। পাহাড়ি এলাকার দিকে এগিয়েছে। রাস্তাটা।

“কি কিনলেন?”

“গত ভূমিকম্পের পর আমার বাসার একটা দেয়ালে ফাটল ধরেছে। সেটাই ঠিক করার জিনিসপত্র কিনেছি,” রাস্তার দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বললো সে।

ভূমিকম্পের ব্যাপারে কারো কাছে কিছু শুনিনি। শিওজাকি বললো, আমি আসার আগেরদিন নাকি কায়েদিতে ভূমিকম্প হয়েছে। দুর্ঘটনার পর থেকে আজ অবধি কোথাও ভূমিকম্প হতে দেখিনি আমি।

জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম আনমনে। কিছুক্ষণ পর হঠাই আগে দেখেছি এরকম একটা দৃশ্য চোখে পড়লো।

“গাড়ি থামান।”

ব্রেক চেপে প্রশ্নাতুর চোখে আমার দিকে তাকালো শিওজাকি।

“একটা পার্ক!” বলে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম আমি। রাস্তার পাশে খালি জায়গায় পরিত্যক্ত, পুরনো একটা পার্ক। বাইরে নোটিশ ঝুলছে-প্রবেশ নিষেধ। ভেতরে উঁচু আগাছা, খেলার সরঞ্জামগুলোতে মরিচা জমেছে। দোলনাটা অবশ্য এখনও বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যালেন্ডারের ছবিতে যে দোলনাটা দেখেছিলাম, এটাই সেই দোলনা! আমার দেখা কাজুয়ার প্রথম স্মৃতি।

দোলনাটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। শিওজাকি পাশে এসে দাঁড়ালো।

“অনেক বছর আগে,” কৈফিয়তের সুরে বললাম। “কাজুয়া আর সাওরি এখানে নিয়মিত খেলাধুলা করতো,” দোলনাটা ঘিরে চক্কর দিলাম একটা। “কোন সন্দেহ নেই, এটাই সেই দোলনা।”

ভেতরে ভেতরে খুব ভালো লাগছে। কায়েদিতে আসার পর থেকে পরিচিত অনেক কিছু চোখে পড়েছে। কিন্তু এই দোলনাটা সাওরির হাসিমুখের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রথম যে কোন কিছুরই বিশেষ মূল্য আছে।

মরিচা ধরা দোলনাটায় উঠে বসলাম। তখন মনে হলো যে শিওজাকি এতক্ষণ ধরে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জা পেলাম কিছুটা। একটা ভদ্র মেয়ে এরকম আচরণ করবে না।

“আজকে খুব অদ্ভুত আচরণ করছেন আপনি,” শিওজাকি বলেই ফেললো।

আমার চোখের দিকে তাকালো সে। প্রথমে স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই দেখছিল, কিন্তু হঠাৎই কিছু একটা চোখে পড়ায় জমে গেল যেন।

“কোন সমস্যা?” জিজ্ঞেস করলাম।

“তাহলে ভুল দেখিনি আগে। আপনার দুটো চোখের রঙ দু’রকম। ভালো করে না তাকালে অবশ্য বোঝা যাবে না…”

হেসে কথাটা উড়িয়ে দিলাম। সে যদি জানতে পারে যে আমার বাম চোখটা অস্ত্রোপচার করে বসানো হয়েছে, তাহলে অনর্থক ঝামেলার সৃষ্টি হবে। কিছুক্ষণ পর আবারো গাড়ি উঠে বসলাম আমরা। এখনও আমার চোখ নিয়েই ভাবছে সে, আমি নিশ্চিত। সব শিল্পীরাই এমন হয়। ভিন্নতা আকৃষ্ট করে তাদের। খুব একটা আমলে নিলাম না ব্যাপারটা।

কিছুক্ষণ পর একটা পরিচিত রাস্তা চোখে পড়লো আমার। দু’পাশে সিডার গাছ থাকাতে এই বিকেল বেলাতেও অন্ধকার লাগছে সবকিছু।

“এখানেই তো কাজুয়া…”

মাথা নেড়ে সায় দিল শিওজাকি। কাজুয়ার দুর্ঘটনাটা যেখানে হয়েছিল সেই রাস্তাটায় আছি আমরা এখন।

তাহলে নীল ইটের বাড়িটায় এখান দিয়েই যেতে হয়। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। বাম চোখে দেখা সেই স্বপ্নটা পুরোপুরি ভুল নয়, কিছু তথ্যের এদিক সেদিক হয়েছে কেবল।

জায়গাটা পেছনে ফেলে সামনে এগোতে লাগলাম আমরা। একটা গাড়িতে বসে কাজুয়ার দুর্ঘটনাস্থলের ওপর দিয়ে যাওয়ার অনুভূতিটা খুব একটা সুখকর নয়। চোখ বন্ধ করে নিলাম। কেউ যেন বরফ ছেড়ে দিয়েছে আমার শিরদাঁড়া বরাবর।

সামনে একটা তীক্ষ্ণ মোড়। বাম দিকে মোচড় খেয়েছে রাস্তাটা। পাশেই গার্ডরেইল। আর গার্ডরেইল থেকে একটু সামনে বেশ গভীর খাদ। শুধু নিচ থেকে উঠে আসা লম্বা সিডার গাছ দেখা যাচ্ছে গার্ডরেইলের ফাঁক দিয়ে।

কিমুরাকে যে প্রশ্নটা করেছিলাম, সেটাই জিজ্ঞেস করলাম শিওজাকিকে।

“রাস্তাটা কবে বানানো হয়েছিল?”

“জানি না। আমি এসে এরকমই দেখেছি।”

একটা পার্শ্বরাস্তা পার করে আসলাম আমরা। এবারে ডানে মোড় নিল রাস্তাটা। কিছুক্ষণ পর গাড়ি থামিয়ে বাইরে দেখতে বললো আমাকে শিওজাকি। এমন একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়েছে সে যে ঢালটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সেই ঢালু জমিতে সারি সারি সিডার গাছ। তবে ওগুলোর ফাঁকে রংটা ঠিকই চোখে পড়ছে।

নীল রঙ। তবে আকাশি নীল নয়। একদম গাঢ় নীল। গোধূলিতে কিছুটা কালচে দেখাচ্ছে।

সিডার বনের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে নীল বাড়িটা, যেটার খোঁজে এতদূর ছুটে এসেছি। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। এখান থেকে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না যে বাড়িটা ইটের তৈরি। কিন্তু স্বপ্নে যেরকম নিল রঙ দেখেছিলাম, সেরকমটাই দেখছি বর্তমানে।

অপহরণকারী ওখানেই আছে। হিতোমিকে লুকিয়ে রেখেছে সে। লোকটা কেমন তা ভাবলাম।

বাম চোখে হিতোমির শরীরের যে অবস্থা দেখেছিলাম তা মন থেকে দূর করার চেষ্টা করেও সফল হইনি। আমার ধারণা, হাত-পা কেটে ফেলা হয়েছে তার। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?

কাজটা যদি অপহরণকারীর হয়ে থাকে, তাহলে কতটা নিষ্ঠুর সে? “বাড়িটার ব্যাপারে কিছু জানেন?” শিওজাকিকে জিজ্ঞেস করলাম। সে যা জানে, খুলে বললো আমাকে। গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম।

“এই বাড়িটা যে আসলেও আছে, এটা জেনেই খুশি আমি,” বললাম।

“কাজুয়ার সাথে বাজি ধরেছিলাম একটা, বলেছিলাম বানিয়ে কথা বলছে।”

“চাইলে আপনাকে ক্যাফেতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারি আমি।”

মাথা ঝাঁকিয়ে না করে দিলাম। “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। রাস্তা মনে আছে আমার। একাই ফিরে যেতে পারবো।”

তার উদ্দেশ্যে একবার বাউ করলাম। চোখে সংশয় নিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে গেল শিওজাকি।

বাড়িটার ব্যাপারে সে আমাকে বলেছে-”কিমুরা বললো আপনি নাকি বাড়িটা খুঁজছেন, চা খেয়ে যান? আমিই থাকি ওখানে।”

*

শিওজাকির গাড়িটা দৃষ্টির আড়াল হয়ে যাওয়া অবধি পাশের দেবদারু বনে অপেক্ষা করলাম। এখনই বাড়িটায় যাওয়া ঠিক হবে না। সে ভেতরে গিয়ে আয়েশ করে বসার পর যাবো।

নীল বাড়িটায় শিওজাকি থাকেসে-ই অপহরণকারী। এতক্ষণ না জেনে তার গাড়িতে বসে ছিলাম আমি। কথাও বলেছি। ব্যাপারটা বিশ্বাসই হচ্ছে না আমার।

এজন্যেই ওভাবে হাসছিল কিমুরা। শিওজাকি যে নীল বাড়িটায় থাকে, এটা ভালো করেই জানতো সে। খুব রাগ লাগছে, কিন্তু কিমুরা যে নেহায়েত মজা করার জন্যেই কাজটা করেছে, সেটা জানি।

আধা ঘণ্টা পর বাড়িটার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমি। এই সময়টায় মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছি।

এই রাস্তাটায় গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। প্রতি দশ মিনিটে একটা কিংবা দুটা। একটু পেছালেই কাজুয়ার সাথে সাদা গাড়িটার যেখানে সংঘর্ষ হয়েছিল, সেখানটায় পৌঁছে যাব। তার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ ছিল সেদিন।

বাড়িটায় কি রাস্তার দিক থেকে যাবো নাকি বনের দিক থেকে, সেটা ভাবতে লাগলাম। কিন্তু রাস্তা ধরে সামনে এগোলে যদি হঠাৎ শিওজাকি ফিরে আসে, তখন বানিয়ে কিছু বলতে পারবো না। এর চেয়ে বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়াই ভালো।

বেশ ঢালু জমি হওয়াতে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে ওপর উঠছি। মরা পাতার কারণে পা পিছলে যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিছুটা ওপরে ওঠার পর সমতল হতে শুরু করলো জমি।

নীল বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর, সিডার গাছ বাদেও অন্য এক ধরনের গাছ চোখে পড়লো। কাজুয়ার স্মৃতিতে এই গাছগুলোও দেখেছি। এরকম একটা গাছের শেকড়েই হোঁচট খেয়েছিল সে।

প্রচণ্ড ঠান্ডা। মুখ দিয়ে বাষ্প বেরুচ্ছে রীতিমত। একটা একটা করে গাছ গুণতে গুণতে এগোলাম। পঞ্চাশটা অবধি গোণার পর হাত ব্যথা হয়ে গেল।

হঠাৎ করেই নীল বাড়িটার সামনে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। দোতলা একটা বাড়ি। যে রকমটা ভেবেছিলাম, নীল ইটে তৈরি সবকিছু। বাড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে গহীন বনে একটা দানো ঘাপটি মেরে আছে। শিকারের অপেক্ষা করছে। বাস্তবে বাড়িটার সামনে দাঁড়ানোর পর মনে হচ্ছে ওটাও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বাড়ির দেয়ালগুলো যেন শ্বাস নিচ্ছে। যেকোন সময় হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

চোখ বন্ধ করে মনে সাহস যোগাতে লাগলাম। কাজুয়ার কথা ভাবলাম, হিতেমির কথা ভাবলাম।

পকেট থেকে ক্যামেরাটা বের করে নিয়েছি আগেই। গাছের আড়াল থেকে দেখে নিলাম আশেপাশে কেউ আছে নাকি। শিওজাকি বাদে অন্য কারো থাকার কথাও না আসলে।

ছায়ার মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলাম। একপাশের দেয়ালে গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ পর। দেয়ালটা স্পর্শ করার পর মনের মধ্যে সন্দেহের যে শেষ দানাটুকু ছিল, সেটাও উধাও হয়ে গেল। এই বাড়িটাই দেখেছিলাম আমি বাঁ চোখের স্বপ্নে। হাতে গ্লাভস থাকা সত্ত্বেও ঠান্ডা ঠিকই টের পেলাম। আমার আত্মশুদ্ধ কেঁপে উঠলো সেই ঠান্ডায়।

আকাশে এখনও ধূসর মেঘ।

দেয়াল ঘেঁষে সামনে এগোচ্ছি। চোখ নিচের দিকে। তলকুঠুরির জানালাটা এখানেই কোথাও হবে।

বাড়িটার চারদিকে ঘন গাছপালা। তবে দেয়াল আর বনের মাঝে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ফাঁকা জায়গা আছে, সেখান দিয়ে একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ হেঁটে যেতে পারবে। পায়ের নিচে শক্ত মাটি এখন। কায়েদির অন্যান্য জায়গার মতন সেখানকার ঘাসগুলোও মরা।

শুধুমাত্র বাড়িটার সামনের দিকেই কোন গাছপালা নেই। আমার যেহেতু কারো চোখে পড়ার ইচ্ছে নেই, তাই সেদিকটা এড়িয়ে গেলাম।

যতদূর মনে আছে, তলকুঠুরিটা বাড়ির সামনের দিকে ছিল না। তাছাড়া কাজুয়া নিজেও দেয়ালের আড়ালে লুকিয়েছিল। জানালাটা দেয়ালের কোনা বরাবর কোথাও। আর কাজুয়া যেখান দিয়ে বনের উদ্দেশ্যে দৌড় দিয়েছিল, সেখানকার জমি ছিল ঢালু। সুতরাং জায়গাটা বাড়ির পেছনের দিকে হবার সম্ভাবনাই বেশি।

একটু পরেই বাম চোখে দেখা একটা জায়গা খুঁজে পেলাম। বাড়িটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। আশপাশের দৃশ্যগুলোও পরিচিত ঠেকছে এখান থেকে। তবে বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হওয়াতে কিছু কিছু ব্যাপার বদলাতেও পারে।

তবুও তলকুঠুরির জানালাটা খুঁজে পেলাম না। বরং পায়ের নিচে ইটের তৈরি প্ল্যান্টার এখানে।

হয়তো এই প্ল্যান্টারটা পরে বানানো হয়েছে, জানালাটা ঢেকে দেয়ার জন্যে। দু’মাসে এরকম দেয়াল সহজেই বানানো যাবে। প্ল্যান্টারটা ভাঙলে অপর পাশের ইট জানালা দেখা যাবে নিশ্চিত।

জানালাটা ঢেকে দেয়া হয়েছে। তাই ক্যামেরা দিয়ে কোন কিছুর ছবিও তুলতে পারছি না।

খুবই হতাশ লাগতে লাগলো। তবে একদিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে। বাড়ির চারপাশটা আরো ভালোমতন দেখতে হলে পরে আসতে হবে। এখন মানসিক আর শারীরিক, দুদিক দিয়েই ক্লান্ত আমি।

বাড়িটার পেছন দিকে উঁকি দিলাম। একটা কাঠের ছাউনি সেদিকে। দেয়ালের সাথে লাগানো। শিওজাকি বলছিল যে সাপ্লাই স্টোর থেকে দেয়াল ঠিক করার জিনিসপত্র কিনেছে। সেগুলো হয়তো ছাউনিতেই আছে।

ফেরার আগে ছাউনির ভেতরে উঁকি দিয়ে যাব বলে ঠিক করলাম।

এসময় দোতলা থেকে একটা জানালা খোলার শব্দ ভেসে এলো।

জমে গেলাম সাথে সাথে। তবে বোকার মত কিছু না করে দেয়ালের ছায়া মিশে যাওয়ার চেষ্টা করলাম সাবধানে। যে কোন মুহূর্তে মাথা বের করে বাইরে উঁকি দিতে পারে শিওজাকি।

ধীরে ধীরে ঢুকে গেলাম বনের ভেতরে। কিছুদুর আসার পর দৌড়াতে শুরু করলাম। হয়তো কাজুয়াও এই পথেই দৌড়িয়েছিল। পেছন থেকে শিওজাকির ছুটে আসার শব্দ কানে আসছে না। তবুও মনে হচ্ছে কেউ যেন ছায়ার মধ্যে পিছু নিয়েছে আমার।

অবশেষে ঢাল পার হয়ে বেরিয়ে এলাম খালি রাস্তাটায়। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো যেন। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অঝোরে।

.

রূপকথার গল্পকার

হাতের পিষে ফেলা মাছিটার দিকে তাকালো মিকি। কাউচে বসে থাকা হিতোমিকে বিরক্ত করছিল হতচ্ছাড়া।

“খুবই রাগ হচ্ছিল,” বলে হিতোমি। “কিন্তু ওটাকে যে তাড়াবো, সে উপায় নেই।”

এমনটা নয় যে তার ক্ষতস্থানগুলো পচন ধরেছে, সেখানে মাছি ওড়াউড়ি করছে। মিকির সৃষ্ট ক্ষতস্থানগুলো কখনো পচে না। মাছিটা পাশ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় হিতোমিকে দেখেছিল।

শেষবার বস্তাটার এক পাশে বসা মাত্র হাত চালিয়েছে মিকি। এখনও হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করছে মাছিটা।

“আমি হলে তো খুবই বিরক্ত হতাম,” হিতোমি বললো। “একটা মাছিও মারতে পারেন না ঠিক মতন।”

মিকির এখন দু’টো কাজ করতে পারে। পুরোপুরি পিষে ফেলতে পারে মাছিটা অথবা এই অবস্থাতেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলতে পারে। জানালার দিকে এগোলো সে।

“জীবিত অবস্থাতেই তাহলে ওটাকে খেতে শুরু করবে পিঁপড়াগুলো,” হিতোমি বললো।

জানালাটা খুলেই জমে গেল মিকি।

সাবধানে মাথা বের করে বাইরে দেখলো একবার।

“কেউ এসেছে নাকি?”

স্টাডিরুমটা বাসার পেছন দিকে। সেদিক থেকেই একটা শব্দ কানে এসেছে মিকির। কিন্তু কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। হয়তো ভুল শুনেছে।

“জানতাম, কেউ না কেউ আসবে আমাকে উদ্ধার করতে। তারা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছে আপনিই অপহরণকারী।”

হিতামিকে রেখে স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেল মিকি।

“কোথায় যাচ্ছেন?” জিজ্ঞেস করলো মেয়েটা। কিছুক্ষণ পর নিজের প্রশ্নের জবাব অবশ্য নিজেই দিল, “ওহ, বুড়োকে তো কবর দিতে হবে।”

কিছুক্ষণ আগেই তলকুঠুরিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে কানেদা।

হিতোমিকে বিছানায় নিয়ে যাচ্ছিল এসময় ইউকি বলে যে, “বুড়োর কিছু একটা হয়েছে।”

ততক্ষণে কানেদা মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।

বেলচা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো মিকি। ইটের দেয়ালটার পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ির পেছন দিকে চলে এলো।

আশেপাশে তাকালো আরেকবার। দোতলা থেকে যে শব্দটা শুনেছিল, সেটার উৎস হতে পারে এমন কিছু চোখে পড়লো না।

চারদিকে কেবল গাছ আর গাছ। নিচু ডালগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে বনের ভেতরে পা দিল মিকি। কিছুদূর হাঁটার পর কানেদাকে কবর দেয়ার মত একটা জায়গা খুঁজে পেল। বেলচা দিয়ে মাটিতে খোঁচা দিল আলতোভাবে। ঠান্ডায় একদম জমে গেছে। তবে একটু বাড়তি শক্তি প্রয়োগ করতেই সুন্দর মত উঠে আসতে শুরু করলো মাটি।

.

*

কানেদার সাথে মিকির প্রথম দেখা হয় নতুন বাড়িটায় আসার কয়েকদিন পরে। এর দুই সপ্তাহ আগে শিনিচি আর ইউকিকে তলকুঠুরিতে নিয়ে আসে সে।

সেসময় প্রতিবেশীদের সাথে খুব একটা যোগাযোগ হয় না মিকির। বাড়িটা পাহাড়ের ওপরে হওয়াতে কেউ কষ্ট করে দেখা করতে আসেনি তার সাথে। তারও কারো সাথে যোগাযোগ করার ইচ্ছে নেই। এমনভাবে থাকে যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে বাড়িটায় কেউ আছে।

তাই কানেদার বাড়ি যে পাশেই সেটা জানা হয়নি তার।

যেদিন প্রথম মিকির বাসায় আসে লোকটা, এমন ভঙ্গিতে তাকায় যেন অদ্ভুত কোন জানোয়ার দেখছে।

“এখানে কেউ থাকে সেটা জানতাম না তো,” বলে সে।

মিকি তাকে ভেতরে আসার আমন্ত্রণ জানায়। খানিকটা গাইগুই করে রাজি হয়ে যায় কানেদা।

“জুতো কি বাইরে রেখে আসবো? বাড়িটাকে দূর্গ মনে হচ্ছে।”

কানেদার শরীর বয়সের তুলনায় রোগাটে। জীর্ণ চেহারা, হাঁটে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। মিকি বাড়িটায় একা একা কিভাবে থাকে আর তার আয়ের উৎস কি, সেটা জানার বেশ আগ্রহ কানেদার মধ্যে।

বাইরে হঠাৎই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। বুড়ো লোকটাকে লিভিং রুমে বসিয়ে দ্রুত স্টাডিতে ছুটে গেল মিকি। খোলা জানালাটা বন্ধ করতে হবে।

এসময় নিচ থেকে একটা চিৎকার ভেসে এলো। মিকি দোতলায় আসার পর ফ্রিজে হাত দিয়েছিল কানেদা। সেখানে ডিম রাখার জায়গায় সাজানো সারি সারি কান আর আঙুল দেখে ভয় পেয়েছে সে। আগের বাড়িটা ছেড়ে আসার সময় এগুলো নিয়ে এসেছে মিকি।

*

কানেদা হাঁটুগেড়ে বসে আছে এমন অবস্থায় তার পেটে ছুরি বসিয়ে দিল মিকি। একটা পুরনো প্যাকিং টেপ দিয়ে বুড়োকে বেঁধে নিয়ে এলো বেইজমেন্টে।

পেট থেকে বেরিয়ে থাকা ছুরিটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে কানেদা। “অদ্ভুত লাগছে,” বললো সে, চোখে আনন্দের ছটা। কাটা জায়গাটায় কোন ব্যথার অনুভূতি নেই কেন সেটা নিয়ে ভাবছে না।

বুড়োকে তলকুঠুরির একপাশের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল মিকি। এরপর জিজ্ঞেস করলো সে বেঁচে থাকতে চায় কিনা।

যদি বাঁচতে না চাইতো তাহলে তখনই তার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা করে দিত মুক্তি। এর আগের এক্সপেরিমেন্টগুলো থেকে দেখেছে যে মস্তিষ্ক এবং হৃদযন্ত্রের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলে মৃত্যু হয় তার শিকারদের। কিংবা বুড়োটা তার ক্ষত বুজে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করতে পারে। মিকির কারণে সৃষ্ট ক্ষত বুজে গেলে জীবনিশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তখন ক্ষুধা অথবা বার্ধক্যের কারণে মৃত্যু হয় তাদের।

কানেদা বেঁচে থাকবে বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

তার পেটটা ফেড়ে ফেলে মিকি। চামড়া আর মাংশপেশি কেটে সরিয়ে নেয়ার পর ভেতরের পাজর আর অন্যান্য অঙ্গগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। এরপর থেকে আর একটা শব্দও করতে পারেনি বুড়ো লোকটা।

কানেদার পুরো শরীরের এই অবস্থা করে মিকি।

দেহের ভেতরের অংশ বাইরে এনে, বাইরের অংশটুকু ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়। কানেদার হাত-পা এখন ভেতরের দিকে ঢোকানো, চামড়াসুদ্ধ। একটা একটা করে বুড়ো লোকটার হাড্ডিগুলো কেটে নিয়েছে মিকি, এরপর আগে যেরকম ছিল তার বিপরীতভাবে সাজিয়েছে। সেক্ষেত্রে ক্রু’র সাহায্য নিতে হয়েছে তাকে।

গোটা সময়টায় কানেদা একবারের জন্যেও জ্ঞান হারায়নি। রক্ত খুব কমই ঝরেছে। ইচ্ছেকৃতভাবেই শিরা বা ধমনীগুলো যাতে না কেটে যায়, সেদিকে খেয়াল রেখেছে মিকি। কানেদার ভেতরের অঙ্গগুলো বাইরে বের করে নেয়ার পরেও ঔজ্জ্বল্য হারায়নি সেগুলো। এমনকি শুকিয়েও যায়নি।

কিছুদিন পর দেখা গেল কানেদার গলার নিচ থেকে সবকিছু উল্টে ফেলা হয়েছে। কানেদার পক্ষে এখন আর নিজের শরীরের ভার বহন করা সম্ভব নয়। এজন্যে মাছ ধরার আংটা মাংসে বিধিয়ে তাকে সোজা করে রাখার ব্যবস্থা করেছে মিকি। কানেদার হাত আর পায়ের আঙুলগুলো শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে। মাঝে মাঝে নড়ে ওঠে ওগুলো।

কানেদার চেতনা তখনও লোপ পায়নি। তার চোখ দেখেই মনে কি চলছে তা বুঝতে পারে মিকি। মাঝে মাঝে চোখের মণিগুলো নড়ে ওঠে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। কখনো আবার চোখ দিয়ে পানি ঝরে। সেগুলোও আনন্দাশ্রু।

নিজের হাতের কাজের দিকে সন্তুষ্টচিত্তে তাকিয়ে থাকার সময় মিকি খেয়াল করে যে নাক বা মুখের কোন দরকার নেই কানেদার। মুখের চামড়া আড়াআড়িভাবে কেটে নিয়ে দলা পাকিয়ে মাথার পেছনে টানা দিয়ে রাখলো সে। কঙ্কালটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে এখন। এর মধ্যে কেবল চোখটা ঠিক জায়গায় আছে। চোখের পাতা না থাকায় অক্ষিকোটরের চোখ দুটোকে বলের মত মনে হয়। তবে একটা ঝামেলা হচ্ছে কানেদার শরীরের নিচের অংশ সোজা করে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারলেও, মাথাটা কেবলই ঝুলে যাচ্ছিল। তাই তার কপাল বরাবর একটা পেরেক ঠুকে দিল মিকি। সে জানে যে মগজের ভেতর দিয়ে পেরেকটা চলে গেলেও মারা যাবে না কানেদা। হাতুড়ির প্রতিটা বাড়ির সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছিল বুড়োর শরীর।

যথেষ্ট হয়েছে, ভাবলো মিকি। এবারে সুন্দর একটা শিল্পকর্ম দেখতে পাচ্ছে চোখের সামনে।

কানেদা চোখের পাতা ফেলতে না পারলেও তার চোখের আর্দ্রতা কমলো না। কথা না বললেও চোখের নাড়াচাড়ার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে কানেদা। দরকার মনে হলে আঙুলগুলোও নাড়ায়।

তবে কানেদার নতুন রূপের মধ্যে আগের জীর্ণ-শীর্ণ ভাবটা নেই। তার। অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো টকটকে লাল। হৃদযন্ত্রটা ঠিকই ধুকপুকাচ্ছে নিয়মিত বিরতিতে। কেটে ছিঁড়ে যাওয়া শিরা আর ধমনীগুলো যতটা সম্ভব ঠিক করে দিয়েছে মিকি।

পরে সে আবিষ্কার করে যে তার বাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বেই থাকত কানেদা।

*

গর্তটা খোঁড়া শেষ হলে বাড়িতে ফিরে আসে মিকি। কানেদার দেহটা কবর অবধি টেনে নিয়ে যেতে হবে তাকে।

ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ শুনে ওপরের দিকে তাকিয়ে একটা কালো রঙের পাখি দেখতে পেলো সে। মনে হচ্ছে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দাঁড়কাকটা।

বাড়ির পেছন দিকে একটা ছাউনি। আগের ভাড়াটিয়া তৈরি করেছিল ছাউনিটা। স্লাইডিং দরজাটা ঠিক মতো কাজ করে না, বেশ জোর খাটাতে হয়। ফ্রেমের কাঠ পচে যাওয়াতে এই অবস্থা।

দরজা খোলাতে রোদ খেলে গেল ভেতরে। কানেদার শরীরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যাচ্ছে। একটা ময়লার ব্যাগে করে তলকুঠুরি থেকে তাকে বয়ে এনে এখানে রেখেছে মিকি।

তলকুঠুরিতে ইঁদুরের কারণে মারা গেছে কানেদা। তার হৃৎপিণ্ডটা চাবিয়েছে ইচ্ছেমতন। শুনিচি আর ইউকি কিছু খেয়াল করার আগেই নিঃশ্বাস থেমে গিয়েছিল বুড়োর।

ময়লার ব্যাগটা টানতে টানতে ছাউনি থেকে বের করে আনলো মিকি। এসময় অচেনা একটা জিনিস চোখে পড়লো তার। কিছুটা দূরে ধুলোর ওপর পড়ে আছে।

ওটা উঠিয়ে নিল মিকি। তার নিজের না নিশ্চিত। কেউ একজন আসলেও এসেছিল এখানে। স্টাডি থেকে ভুল কিছু শোনেনি। নিজের ধারণার ওপর বরাবরই ভরসা আছে মিকির।

কেউ তাকে সন্দেহ করেছে, এমনটা প্রথম নয়। আগেও তার কার্যকলাপ সম্পর্কে জেনেছে কয়েকজন। ঘুরঘুর করেছে বাসার আশপাশে। তাদের আগন্তুক বলে ডাকে সে। অনাহুত আগন্তুক।

এর আগে অল্পবয়সী একটা ছেলে মোক ছোঁক শুরু করেছিল। সেবারেও এরকম অনুভূতি হয়েছিল, যেন কেউ নজর রাখছে তার ওপর।

আগন্তুক কি তার অপরাধের কোন প্রমাণ পেয়েছে? সেরকমটা হলেও ব্যবস্থা নেয়া যাবে। যেমনটা নিয়েছিল শেষ আগন্তুকের।

*

চোখের স্মৃতি

উপসংহার

একদিন জানালার পাশে বসে মেয়েটা বলে উঠলো, “আমার ভয় লাগছে…”

কারাসুর আনা নতুন স্টপার দু’টো শোভা পাচ্ছে তার দুই অক্ষিকোটরে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে সে। দুটো চোখই উল্টোভাবে ঢুকিয়েছে, কিন্তু তাতে দৃশ্যগুলো দেখতে কোন সমস্যা হচ্ছে না।

“ভয় কেন পাচ্ছেন, মিস?”

নতুন উপহার দুটো সরাসরি মেয়েটার হাতে দিয়েছে কারাসু।

“তোমার আনা স্টপারগুলো চোখে দিলেই স্বপ্নের মত দৃশ্য দেখতে শুরু করি। আমার জন্যে এই অভিজ্ঞতাগুলো অমূল্য। কিন্তু সবগুলো স্টপারের ক্ষেত্রেই শেষদিকে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটে। কয়েকদিন আগে প্রথম খেয়াল করি সেটা।

“ভয়ঙ্কর ব্যাপার?”

মাথা নেড়ে সায় জানালো মেয়েটা। ঝাঁকুনিতে বাম চোখটা কোটর থেকে বেরিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। নিচু হয়ে সেটা তুলে কাঁচের বয়ামে রেখে দিল সে। আগের চোখগুলোও সেখানেই আছে। প্রায় ভরে গেছে বয়ামটা।

কারাসু আবারো জিজ্ঞেস করলো ভয়ানক জিনিসটা কি। কিন্তু জবাবে কেবল মাথা ঝাঁকানো মেয়েটা।

“জানি না আমি। কখনোই কয়েক সেকেন্ডের বেশি দেখতে পারিনি। দেখে মনে হয় একটা দানো, যেটাকে ভয় পাওয়া উচিৎ। কিন্তু…”

তার চেহারায় ভয় ছাপিয়ে একটা হাসি ফুটলো। “কিছু মনে করবে না। তোমার উপহারগুলো পেতে খুবই ভালো লাগে আমার। নতুবা এই অন্ধকারেই বাকি জীবনটা কাটাতে হতো। রঙ আর দেখতে পেতাম না। চিরকৃতজ্ঞ থাকবো তোমার কাছে।”

হাতটা সামনে বাড়িয়ে ধরলো মেয়েটা। কারাসু বুঝতে পারলো যে সে চাইছে কেউ তার হাতে হাত রাখুক। একটা সিনেমায় এরকম দৃশ্য দেখেছিল কারাসু। কিন্তু হাতটা কিছুটা উঁচুতে ধরেছে মেয়েটা। কারাসু যদি সত্যি সত্যি একজন মানুষ হতো, তাহলে তার মুখ বরাবর থাকতো ওটা।

“তুমি কি তোমার আসল নামটা আমাকে বলবে না? নাহলে বুঝবো কি করে যে তুমি সত্যি নাকি কল্পনা? কখনো তোমার হাতটাও ধরিনি…”

কারাসুর মনে হলো তার হৃদয়টা বুঝি ফেটেই যাবে। মেয়েটাকে কোনভাবেই স্পর্শ করতে দেয়া যাবে না তাকে। সে একটা পাখি। মেয়েটা যদি জানতে পারে এতদিন একটা কাক চোখ এনে দিয়েছে তাকে, তাহলে কষ্ট পাবে নিশ্চয়ই।

“দুঃখিত মিস, আপনার হাতটা ধরতে পারবো না। কয়েক বছর আগে বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর সময় একটা খুব খারাপ অসুখ হয় আমার। আপনাকে স্পর্শ করলে আপনিও অসুস্থ হয়ে যাবেন। অনবরত হেঁচকি উঠতে থাকবে।”

এটক বলে জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো কারাস। মেয়েটা পেছনে কিছু একটা বলছিল, তবুও ডানা ঝাঁপটানো বন্ধ করলো না সে। তার ছোট্ট হৃদয়টা ছেয়ে উঠেছে বেদনায়। এই অনুভূতিগুলোর অর্থ ঠিক বুঝতে পারছে না সে।

মেয়েটাকে দেয়ার মত নতুন চোখের জন্যে শহরময় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলো সে। ইদানীং খুব সাবধান থাকতে হয়। কাক দেখলেই এখন দূর দূর করে তাড়া করে সবাই। একটা কালো রঙের পাখি সুযোগ পেলেই চোখ উপড়ে নেয় এটা শহরবাসী জেনে গেছে। রাইফেল, গুলতি দিয়ে কাকদের আক্রমণ করে তারা। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলে যাবার সময় চোখে হাত দিয়ে রাখে।

কারাসুর গায়েও গুলি লেগেছিল একবার। তবে যে গুলি করেছিল তার হাতের সই খুব একটা ভালো ছিল না, তাই বেঁচে গেছে। তখন থেকে অনেক উঁচুতে উড়ে বেড়ায় সে, যাতে নিচ থেকে দেখা না যায়। আর মেয়েটার জন্যে নতুন উপহারের খোঁজে দূর দূরান্তের শহর অবধি পাড়ি

চোখ তুলে নেয়ার জন্যে বেশ কয়েকটা কৌশলও আবিষ্কার করেছে সে। একদিন একটা আবাসিক এলাকায় উড়তে উড়তে একটা বাড়ির দেয়ালে ছোট ফুটো দেখতে পায়। যে কেউ চোখ রাখতে পারবে সেই ফুটোয়। দেয়ালটার পেছন দিকে গিয়ে অপেক্ষা করে সে। এরপর সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে মানুষের কণ্ঠে বলে, “এই যে! শুনছেন? যাদু দেখতে চাইলে এই ফুটোয় চোখ রাখুন দ্রুত।”

যেই না কেউ তার ফাঁদে পা দিয়ে ফুটোয় চোখ রেখেছে, অমনি চোখা চঞ্চুর সাহায্যে সেটা উপড়ে নেয় কারাসু। এর এক ঘণ্টা পরে সেই চোখটা নিজের কোটরে রেখে হেসে ওঠে মেয়েটা। আর সেই হাসিটা অমূল্য।

লাঠির বাড়ি বা মার খেয়েও বারবার তাই মানুষের চোখের রক্তে ঠোঁট রাঙাতে কোন আপত্তি নেই কারাসুর।

উঁচ ডালে বা বাড়ির ছাদে বসে নিচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষদের খেয়াল করে সে। এরপর সুযোগ বুঝেই আঘাত হানে। যেইমাত্র তার শিকার বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলে, ঠোঁট দিয়ে উপড়ে নেয় সেটা।

একবার চোখ উপড়ে নেয়ার পরে শিকারের সাথে জাপটাজাপটির কারণে প্রায় অচেতন হয়ে পড়ে কারাসু। আরেকবার উপড়ে নেয়া চোখটা ঠোঁটেই পিষ্ট হয়ে যায়, সেটা আর মেয়েটাকে উপহার দিতে পারে না সে।

একদিন কারাসুর এনে দেয়া উপহার চোখে দিয়ে খুশিতে প্রায় লাফিয়ে ওঠে মেয়েটা। আসলে চোখটা যার ছিল, সে বিদেশ বিভুঁইয়ে ঘুরে বেরিয়েছে প্রচুর। তাই চোখের স্মৃতিতে অনেক কিছু দেখতে পায় সে।

ম্যানশনটা ছেড়ে আসার কিছুক্ষণ পর পাহাড়ের ওপরে ছোট একটা কবরস্থান চোখে পড়লো কারাসুর। আশপাশে কোন বাড়ি নেই। সূর্য মামা বিদায় নিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চাঁদ মশাই গা ঝারা দিয়ে জেগে উঠেছে সেই সুযোগে। কবরফলকগুলো ভরিয়ে দিয়েছে সাদা আলোয়।

চাঁদের আলোয় একদিকে কবর খুঁড়ে যাচ্ছে গোরখোদক। একটা গাছের ওপরে বসে তার কাজ দেখতে লাগলো কারাসু। কাপড়ে মোড়া একটা মৃতদেহ রাখা আছে সদ্য খোঁড়া কবরটার পাশে। যে লোকটা মারা গেছে তাকে চেনে কারাসু। আজকেই তার চোখ উপড়ে নিয়েছিল। এরপর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বেচারা।

কবর দেয়া শেষ হলে সেখান থেকে উড়ে গেল কারাসু। দিন দিন আরো সতর্ক হয়ে উঠছে লোকজন।

.

“একটা ভালো খবর আছে,” মেয়েটা বললো একদিন। “চোখের অপারেশন হবে আমার।”

এর আগে অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে পারেনি চিকিৎসকেরা। তবে নতুন একটা প্রযুক্তির কারণে এখন সেটা সম্ভব হলেও হতে পারে।

“দৃষ্টি ফিরে পেলে,” খুশি মনে বলে চলেছে মেয়েটা। “তোমাকে দেখতে পাবো।”

“শুনে খুবই খুশি হলাম, মিস,” কারাসু বললো।

তবে মনে মনে ভীষণ হতাশ সে। মেয়েটা দেখতে পাবার অর্থ হচ্ছে তার আসল পরিচয় ফাঁস হয়ে যাওয়া। যখন অন্ধ কিশোরী জানতে পাবে যে এতদিন ধরে কারাসু ‘উপহার’ নাম করে তাকে যা দিয়েছে, সেগুলো আসলে অন্য মানুষের চোখ, তখন তার মনে কি চলবে?

মেয়েটার মনের সুখের জন্যে যদি অন্য কেউ মারাও যায়, তাতে কারাসুর কিছু আসে যায় না। সে যা করছে, তা ঠিক নয়, এটা ভালো করেই জানে। তবুও কোন অনুশোচনা বা অনুতাপ বোধ নেই তার।

কিন্তু মেয়েটা সত্য কথা জানার পর কষ্ট পাবে, সন্দেহ নেই। অনেকে তার সাময়িক সুখের জন্যে মারাও গেছে, এটাও সুস্থ মস্তিষ্কের কেউই ভালো ভাবে নেবে না। তখন কারাসুকে ঘৃণা করবে সে। এটাই তার সবচেয়ে বড় ভয়।

আমাকে কি আসলেও মন থেকে ঘৃণা করবে সে? যদি পাখি না হয়ে মানুষ হতাম, ভাবলো কারাসু। তার সামনে আজকে আনা চোখটা জায়গামত ঢুকিয়ে দিল মেয়েটা। কিছুক্ষণ বাদেই চেঁচিয়ে উঠলো সে।

“কি সমস্যা, মিস?” অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো কারাসু।

“দানোটাকে দেখেছি আমি-প্রতিটা স্বপ্নের শেষে ভয়ঙ্কর যে জন্তুটাকে দেখতে পাই। কালো রঙের একটা দানা। যখনই ওটা উদয় হয়, স্বপ্নগুলো শেষ হয়ে যায়। তখন আমার মুখের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দানোটা। ভয়ঙ্কর একটা চেহারা,” কম্পিত কণ্ঠে বললো মেয়েটা। চেহারা ছাইবর্ণের হয়ে গেছে তার। স্ট্রবেরির মত ঠোঁটজোড়াও ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।

দাঁড়কাকটার বুঝতে অসুবিধে হলো না যে কি দেখেছে সে। যে দানোটাকে ভয় পাচ্ছে সে, ওটা তো আসলে আমি!

এখন কি হবে? আর কিছুদিন বাদেই তো চোখের দৃষ্টি ফিরে পাবে সে। তখন কার সাথে কথা বলবো? অপারেশনটা না হলেই ভালো হতো।

কিন্তু এই কথাগুলো মেয়েটার সামনে উচ্চারণ করতে পারবে না কারাসু। সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে দৃষ্টি ফিরে পাবার জন্যে।

“অপারেশনটার কথা ভাবলেই ভয় লাগে,” মেয়েটা বললো। “তবে * আমি নিশ্চিত, এবারে কাজ হবেই। তোমাকে দেখতে পাবো খুব শিঘ্রই।”

কারাসুকে দেখতে পাবে এই ভাবনাটা মেয়েটার ভয় অনেকটাই দূর করে দেয়।

“আগামীকাল রাতে, দূরের একটা শহরে পাড়ি জমাতে হবে আমাকে অপারেশনের জন্যে। তাই সময়মত এসে পড়বে। যাওয়ার আগে তোমার সাথে কথা বলতে চাই আমি।

এটুকু শুনেই জানালা দিয়ে উড়াল দিল কারাসু। বিদায়ে সময় ঘনিয়ে এসেছে। কারাসুর ছোট্ট মস্তিষ্কটা ভরে আছে মেয়েটার স্মৃতিতে। এটাই তার প্রতিদিনের বেঁচে থাকার পাথেয়। গত ক’দিনে অনেকবার ভেবেছে যে দূরে কোথাও চলে যাবে, চিরদিনের জন্যে। কিন্তু প্রতিবারই ফিরে এসেছে। সে হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে মন খারাপ হবে মেয়েটার। তার নিজেরও বড় খারাপ লাগবে।

খুব দ্রুত মেয়েটার চোখে অস্ত্রোপচার হবে শোনার পরেও আগের মতনই তার জন্যে উপহার খুঁজে বেড়ায় কারাসু। কিন্তু ইদানীং কাজটা বড় কঠিন হয়ে গেছে। সবাই খুবই সতর্ক থাকে। অনেকে তো চোখ বাঁচানোর জন্যে বিশেষ চশমাও ব্যবহার করে।

মানুষেরা তো আর একটা কাক থেকে অন্য কাককে আলাদা করতে পারে না। তাই অনেক নিরীহ কাক মারা পড়েছে তাদের হাতে। বুলেট ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদের ছোট্ট বুক। এমনকি কারাসুর নিজের ভাইবোন আর বাবা-মাও সেই ভাগ্য বরণ করে নিয়েছে।

তাই কারো চোখ উপড়ে নেয়া এখন রীতিমত অসম্ভব একটা কাজ।

দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে এলো। পূব দিকটা রক্তিম হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। মেয়েটা অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে রওনা হবে আজকেই। কিন্তু এখন অবধি তার জন্যে কোন উপহার যোগাড় করতে পারেনি কারাসু।

অস্ত্রোপচারের পরে কারাসুর উপহারের কোন মূল্য থাকবে না। দেখতে দেখতে অনেক দূরের একটা শহরে চলে এলো সে। ক্লান্তির কাছে নতি স্বীকার করেনি। একনাগাড়ে ডানা ঝাঁপটানোর কারণে ব্যথা করছে ও’দুটো।

তার মনে একটা চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে। যে করেই হোক, শেষবারের মতন হাসি ফোঁটাতে হবে মেয়েটার চেহারায়। এরপর মারা যেতেও কোন দ্বিধা নেই কারাসুর।

কয়েকজন তোক পাথর ছুঁড়ে মারলো তার দিকে। বেশিরভাগই লক্ষ্য ভ্রষ্ট হলেও একটা পাথরের আঘাতে ঠোঁট ফেটে গেল কারাসুর। আরেকবার অসাবধানতার কারণে একটা লোক তার ডান পাখনাটা আঁকড়ে ধরলো। কোনমতে তার হাত থেকে ছাড়া পেলেও পালক ছিঁড়ে গেল। তবু চোখ খোঁজা থামালো না কারাসু। কিন্তু লাভ হচ্ছে না কিছুতেই।

কোনমতে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। একটু মনোযোগ বিঘ্নিত হলেই মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে।

অবশেষে কোন চোখ খুঁজে না পেয়ে তার নিজের চোখের কোণে পানি জমলো। এরকম ব্যর্থ জীবন জিইয়ে রাখার কোন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে না সে।

সূর্য ডুবে গেছে, মেয়েটা আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়বে। এসময় আগের দিনের কবরস্থানটা চোখে পড়লো কারাসুর। আজকেও একটা মৃতদেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে একপাশে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাটি চাপা দেয়া হবে। গোরখোদকের মাথার ওপরে চক্কর দিল কারা।

একটা বুদ্ধি এসেছে তার মাথায়।

কিছুটা দূর থেকে মানুষের ভাষায় চিৎকার করে উঠলো সে, “ঐদিকে দেখুন, একটা শেয়াল।”

বিস্মিত হয়ে হাতের কোদালটা নামিয়ে রেখে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করতে লাগলো সে। কারাসু যেখানটায় লুকিয়ে আছে, সেদিকে হেঁটে এলো। এই সময়টারই তক্কে তক্কে ছিল কারাসু। নিঃশব্দে মৃতদেহটার পাশে উড়ে এসে বসলো সে।

ঠোঁটের সাহায্যে মৃতদেহের চেহারা থেকে চাদরটা সরালো। একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেলো সে। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে। চেহারায় অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন। নাক-মুখ থেতলে গেছে। একপাশের চোখও নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু অন্য চোখটাকে দেখে মনে হচ্ছে ঠিকই আছে।

এক মুহূর্ত দেরি না করে মৃত মহিলার ভালো চোখটা উপড়ে নিয়ে উড়াল দিল কারাসু।

*

“ভেবেছিলাম, তুমি আর আসবেই না আজকে,” কারাসুর উদ্দেশ্যে বললো মেয়েটা। অপারেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হবার জন্যে তৈরি সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িতে উঠে পড়বে। “ফিরতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে আমার।”

সাথে করে আনা চোখটা মাঝের গোল টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলো কারাসু। টেবিলের ওপরে ফুলদানির পাশে একটা কাঁচের বয়ামও রাখা আছে। ওটা সাথে করে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে মেয়েটার।

“আমি নিশ্চিত যে আপনার অস্ত্রোপচার সফল হবে। আমার পক্ষ থেকে নিরন্তর শুভকামনা।”

দুই গালে টোল পড়লো মেয়েটার। “ধন্যবাদ,” হাসিমুখে বললো সে।

“আপনার জন্যে শেষ একটা উপহার এনেছি। টেবিলে রাখা আছে।”

কারাসুর মনে হচ্ছে কেউ দু’হাতে চেপে ধরেছে তার হৃদযন্ত্র। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। শেষবারের মতন জানালাটা দিয়ে উড়ে যাবার সময় কথাটা বলবে। আমি আর ফিরবো না, মিস।

এরপর আর কখনো তাকে নিয়ে ভাববে না কারাসু।

জানালার চৌকাঠে গিয়ে বসলো সে। “আমি আর…” কথাটা বলতে গিয়ে থেমে গেল মাঝপথেই। চিৎকার করে উঠেছে মেয়েটা।

লম্বা একটা সময় ধরে আর্তচিৎকারের পর দু’চোখ নখ দিয়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করে ফেললো অন্ধ কিশোরী। পরমুহূর্তে বমি করতে করতে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। হাত-পা মোচড়াচ্ছে সমানে। পরিপাটি করে বাঁধা। চুলগুলো আউলে গেছে পুরোপুরি। টেনে টেনে চুল ছিঁড়তে লাগলো কিছুক্ষণ পর।

চোখভর্তি কাঁচের বয়ামটা মাটিতে পড়ে ভেঙে গেল। মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো কারাসুর এতদিনের সংগ্রহকৃত চোখগুলো। কয়েকটা ইতোমধ্যে পচে গেছে, আবার কয়েকটা তুলনামূলক নতুন এবং তাজা।

মাটিতে নিথর হয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। গাঁজলা ওঠা মুখটা হাঁ হয়ে আছে। কারাসু মেয়েটার পাশে এসে বুকে কান রাখলো। হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে তার। ভয়ে বিকৃত ফ্যাকাসে মুখটা।

কারাসু জানতো না। জানতো না যে যার চোখ উপহার হিসেবে এনেছিল, সেই মহিলার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়েছে মৃত্যুর আগ অবধি। মানুষের আচরণের নিষ্ঠুর দিকগুলো প্রত্যক্ষ করেছে তার চোখটা। ফলে মেয়েটাকেও সাক্ষী হতে হয়েছে সেই নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচারের।

মেয়েটার বুকে মাথা চেপে বসে রইলো কারাসু। এই প্রথম তার শরীর স্পর্শ করছে সে। তবে সেই স্পর্শের অনুভূতি যে শীতল হবে, তা আশা করেনি কখনো।

মেয়েটার মা তাকে ডাকতে এসে দেখলো মেঝেতে মরে পড়ে আছে সে। চারিদিকে অসংখ্যা চোখ। আর তার পাশে একটা দাঁড়কাকের মৃতদেহ।

একইসাথে মৃত্যুলোকের অভিযাত্রী হয়েছে তারা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *