০. চোখের স্মৃতি

ব্ল্যাক ফেয়ারি টেইল – অৎসুইশি / ভাষান্তর : সালমান হক
প্রথম প্রকাশ একুশে বইমেলা ২০২০

.

চোখের স্মৃতি

একটা অদ্ভুত দাঁড়কাকের গল্প বলছি শুনুন। শুরুতেই অদ্ভুত শব্দটা দেখে হয়তো বিরক্ত হতে পারেন। ভেবে নিতে পারেন গল্পের চমক বাড়াতে গল্পকার কোন ফন্দি আঁটছে। দাঁড়কাক আবার অদ্ভুত হয় কি করে? দাঁড়কাক তো দাঁড়কাকই! কিন্তু না, কোনরকম বাড়িয়ে বলছি না। এই গল্পের দাঁড়কাকটা অদ্ভুত, কারণ সে মানুষের ভাষায় কথা বলতে পারে। সেটারও উপযুক্ত ব্যাখ্যা আছে বৈকি। দাঁড়কাকটার বাবা মা বাসা বেঁধেছিল এক সিনেমা হলের দেয়ালের খুপড়িতে। সুতরাং একদম ছোটবেলা থেকেই দেয়ালের ফুটোটা দিয়ে সারাক্ষণ সিনেমা দেখেছে কাকটা। মা’র এনে দেয়া। খাবার খেতো আর সিনেমা দেখতে। তার ভাইবোনেরা অবশ্য কখনো সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহী ছিল না। আসলে সিনেমা দেখতে ভালো লাগতো কাকটার। সে সিনেমা দেখতে আর সংলাপগুলো আপনমনে বলতো, এভাবেই মানুষের ভাষায় কথা বলতে শিখে গেল সে।

মেয়েটার সাথে কাকটার দেখা সিনেমা হলটা গুঁড়িয়ে দেয়ার পর। এতদিনের থাকার জায়গা হারিয়ে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে সে। তার বাবা মা আর ভাইবোনেরা আগেই শহরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, একমাত্র সে-ই রয়ে যায়। এখন সে পরিণত বয়স্ক; ডানা ঝাঁপটিয়ে উদ্দেশ্যহীনের মত ঘুরে বেড়াতে থাকে এখান থেকে ওখানে।

উড়তে উড়তেই নীল দেয়ালের ম্যানশনটা চোখে পড়ে তার। সামনে বিশাল বাগান, চারদিকে উঁচু বেড়া। বাড়িটার পাশেই একটা বড়সড় গাছ। ডালগুলোও প্রশস্ত, বিশ্রাম নেয়ার জন্যে একদম যথার্থ। তাই দাঁড়কাকটা নেমে এলো গাছটায়। অনেক ওড়াউড়ি হয়েছে, এবারে একটু বিশ্রাম দরকার।

ডালটার একদম কাছেই বাড়ির দোতলার জানালাটা। ডানা বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। জানালার পাশে বসে থাকা মেয়েটাকে প্রথমে অবশ্য চোখে পড়েনি কাকটার। সাধারণত দেখা যায় যে মানুষের কাছাকাছি গেলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু এই মেয়েটা ব্যতিক্রম, মনে হচ্ছে যেন তার অস্তিত্ব চোখেই পড়েনি।

কিছুক্ষণ ডালটায় বসে থেকে মেয়েটাকে দেখলো কাকটা। এর আগে কখনো এত কাছ থেকে কোন মানুষকে দেখেনি সে। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটার ঠোঁট স্ট্রবেরির মতন লাল। জানালার পাশে একটা চেয়ারে বসে শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছে।

কাকটা একবার ভাবলো ডানা ঝাঁপটে মেয়েটার মনোযোগ আকর্ষণ করবে, কিন্তু বাতিল করে দিল বুদ্ধিটা। মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের এর চেয়েও ভালো পদ্ধতি জানা আছে তার।

“আছেন কেমন?”

চমকে উঠলো মেয়েটা। উৎকণ্ঠা আর বিভ্রান্তি ভর করেছে চেহারায়। “কে?” জিজ্ঞেস করলো সে।

কাকটা এতক্ষণে বুঝতে পারলো কেন চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও তাকে খেয়াল করেনি মেয়েটা। সে এখন মেয়েটা থেকে যত দূরে আছে, অন্য কেউ হলে অবশ্যই দেখতে পেতো। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, মেয়েটার চোখ আর দশজন স্বাভাবিক মানুষের চোখের চেয়ে আলাদা। চোখ নেই তার, সে জায়গায় শূন্য দু’টো কোটর। কিছু দেখতে পায় না।

এটাই আমার সুযোগ, কাকটা ভাবলো। মেয়েটা তো আমাকে দেখতে পাবে না, এই সুযোগে কথাবার্তা বলা যাবে। কথা বলতে শেখার পর থেকেই মানুষদের সাথে আলাপ করার ইচ্ছে হয়েছে তার বহুবার। কিন্তু অনেক মানুষেরই বদভ্যাস আছে তার জাতভাইদের ধরে ভেজে খেয়ে ফেলার, তাই আর সাহসে কুলোয়নি।

মেয়েটা যেহেতু দেখছে না যে কে কথা বলছে, সুতরাং এবার সুযোগ নেয়া যেতেই পারে। “কেমন আছেন মিস?” বললো সে খানিকটা গম্ভীর গলায়।

“কে কথা বলছে? কে?”

“ভাববেন না। ক্ষতি করার কোন উদ্দেশ্য নেই আমার। আমি শুধু আপনার সাথে কথা বলতে চাই।”

চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরের মাঝামাঝি গেল মেয়েটা। সামনে হাত বাড়িয়ে শব্দের উৎসের খোঁজ করার চেষ্টা করছে। “আপনি কোথায়?”

জানালাটা খোলাই ছিল। কয়েকবার ডানা ঝাঁপটাতেই ভেতরে পৌঁছে গেল কাকটা। খুবই সুন্দর, সাজানো গোছানো একটা ঘর। দেয়ালে ফ্লাওয়ার প্রিন্টের ওয়ালপেপার, একটা নরম বিছানা আর অগণিত পুতুল। মাঝখানটায় গোল একটা টেবিল। জানালার পাশের চেয়ারটায় বসলো কাকটা।

“আপনার কণ্ঠটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে,” মেয়েটা বললল। “আগে কখনো এরকমটা শুনিনি। তবে দ্ৰতাজ্ঞান একদমই কম। মেয়েদের ঘরে প্রবেশের আগে যে দরজায় নক করাটা ভদ্রতা।”

“মাফ করবেন। মাঝে মাঝে এরকম অভদ্রের মতন কাজ করে বসি। আমি তো ছুরি কাঁটাচামচ ব্যবহার করে খেতেও পারি না।”

“তাহলে খান কিভাবে?”

“আমার ঠোঁট দিয়ে ঠুকরিয়ে।”

“ভারি অদ্ভুত তো আপনি,” হেসে বললো মেয়েটা। হাসলে গালে টোল পড়ে তার, ভীষণ মিষ্টি দেখায়। “যাইহোক, আপনার আগমনে খুশিই হয়েছি আমি। কথা বলার মানুষ খুঁজে পাই না, জানেন?”

সেদিন থেকে হাতে(বা ডানায়?) সময় পেলেই মেয়েটার সাথে দেখা করতে আসততা কাকটা। প্রথমদিকে কেবল সিনেমা দেখা শেখে সংলাপগুলো কপচানোর জন্যেই আসততা, কিন্তু কদিন পর আবিষ্কার করলো যে মেয়েটার সাথে কথা বলতে আসলে ভালো লাগে তার।

মেয়েটাকে অন্য আলোয় দেখে সে। বেশিরভাগ মানুষই তাকে দেখলে ইট বা হাতের কাছে যা খুঁজে পায়, ছুঁড়ে মারে। কিন্তু এই মেয়েটা সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকে একা একা, জানালার ধারে। বাইরের শব্দগুলো অনুভবের চেষ্টা করে। তার একাকীত্ব কাকটাকেও পীড়া দেয় যেন।

“হ্যালো মিস,” মেয়েটার উদ্দেশ্যে বললো সে।

সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার চেহারা। যেন প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে একটু উষ্ণ বাতাসের আবাহন ঘটেছে। “তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না!” পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হলে যেভাবে কথা বলে সবাই, ওভাবেই কথাটা বললো। এতদিনে কাকটার সাথে তুমি করে কথা বলা শুরু করেছে। সে। “কতবার বলেছি নক করে ভেতরে ঢুকবে!”

মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গি ভীষণ আনন্দিত করলো কাকটাকে। ডিম ফেটে বেরুবার পর থেকে আজ অবধি কখনো এরকম অনুভূতি হয়নি। তার মা কখনো তাকে গান গেয়ে শোনায়নি, কেবল কেঁচো ধরে এনে খাওয়াতো। ভাইবোনগুলোও গতানুগতিক পাখিদের মতনই ছিল। জীবন বলতে খাওয়া আর ঘুম তাদের।

সারাজীবন যে সিনেমাগুলো দেখেছে সেখান থেকেই নানারকম গল্প মেয়েটাকে শোনাতে কাকটা। শুধু এই গল্পগুলোর ব্যাপারেই কথা বলতে তারা। নিজের পরিচয় ইচ্ছে করেই গোপন করেছে, সেটার ফলাফল হয়তো ভালো হবে না। বরং বানিয়ে বলেছে অনেক কিছু।

একদিন মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো সে, “আচ্ছা মিস, আপনার চোখগুলো কোথায় গেল?”

“ছোট বেলার এক দুর্ঘটনায় চোখ দুটো হারিয়েছি,” যথাসম্ভব নিস্পৃহ কণ্ঠে বলে মেয়েটা। “এক রবিবারে বাবা-মা’র সাথে চার্চে গিয়েছিলাম। চার্চটার জানালায় খুব সুন্দর নকশা করা ছিল, পুরোটা সময় সেদিকেই তাকিয়ে ছিলাম আমি, চোখ বড় বড় করে। আর সেটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। আচমকা জানালার বিশাল কাঁচটা ভেঙে যায়। কিভাবে ভাঙলো তা জানা যায়নি, হয়তো কেউ পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। এক মুহূর্ত আগেই ভাবছিলাম যে জানালাটা কত সুন্দর, আর পরমুহূর্তে ঝরঝর ভেঙে পড়ে গোটা জানালা।”

মেয়েটার কথা শুনে সিনেমা হলের প্রজেক্টরের আলোয় ভেসে বেড়ানো ধূলিকণাগুলোর কথা মনে পড়ে গেল কাকটার।

“দু’টো ধারালো কাঁচের টুকরো বিঁধে যায় আমার দুই চোখে,” মেয়েটা বলে। “বাম চোখে নীল কাঁচ আর ডান চোখে লাল। দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হয় আমাকে, কিন্তু ততক্ষণে আর কিছু করার ছিল না। রক্তপাত বন্ধ করতে আমার দুটো চোখই তুলে ফেলতে হয়। আমার দেখা শেষ দৃশ্যটা ছিল, অজস্র রঙিন কাঁচ বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে। খুবই সুন্দর একটা দৃশ্য।”

কেউ একজন কড়া নাড়লো দরজায়।

“মিস,” কাকটা বললো, “আমার সাথে কথা বলার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। এখন আমাকে আসতে হবে।”

মেয়েটার আপত্তি সত্ত্বেও দ্রুত জানালা গলে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।

খুব বেশিদূরে অবশ্য গেল না। জানালার পাশের ডালটায় বসে রইলো। কিছু দেখা না গেলেও ভেতরের শব্দ শোনা যায় এখান থেকে।

কেউ একজন দরজা খুলে প্রবেশ করেছে ভেতরে। “আমি ভাবলাম কারো সাথে কথা বলছিলে তুমি। কেউ এসেছিল?”

কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটার মা এসেছে।

না দেখলেও কাকটা বুঝতে পারল যে জবাবে কিছু একটা বানিয়ে বলতে বেগ পেতে হচ্ছে মেয়েটাকে। যেরকম অদ্ভুত আনাগোনা তার, এরকমটাই তো হবার কথা। মেয়েটা জানেও না যে সে আসলে কি।

ডানা ঝাঁপটে গাছটা থেকে নেমে পড়লো সে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেশ উঁচুতে উঠে গেল। ওপরে অন্তহীন নীল আকাশ আর নিচে ধূসর যান্ত্রিক শহর।

ওকে সব কিছু দেখাতে চাই আমি। আজকের আগে কাকটা বুঝতে পারেনি যে মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে।

চোখ দুটো কিভাবে হারিয়েছে সেটা এমন ভঙ্গিতে বলেছে মেয়েটা যেন জীবনের প্রতি আগ্রহই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু কাকটা যখন সিনেমায় দেখা চমৎকার সব দৃশ্যের বর্ণনা দেয়, একটা প্রশান্তির ভাব ফুটে ওঠে তার চেহারায়। চোখ থাকলে বলা যেত স্বপ্নাতুর দৃষ্টি ভর করছে চোখে। “আমিও দেখতে চাই”, মনে মনে নিশ্চয়ই বলে মেয়েটা।

“আমার স্বপ্নগুলো সব অন্ধকার এখন,” একবার বলেছিল মেয়েটা। এরপরই প্রসঙ্গ বদলে নিজের কষ্ট গোপনের চেষ্টা করে। নিজের প্রিয় বিষয়গুলো কথা বলতে থাকে।

“আপনার কি অন্ধকার ভয় লাগে?” জিজ্ঞেস করে কাকটা।

 কিছুক্ষণ ভাবে মেয়েটা, এরপর আলতো মাথা নাড়ে।

মেঘের নিচ দিয়ে উড়ে চলে কাকটা। কোনভাবে যদি তার দৃষ্টিতে আবার রঙ ফিরিয়ে দিতে পারতাম! দরকার হলে পুরো দুনিয়া চষে ফেলবো, রক্তে রাঙিয়ে দেব পথঘাট! তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে, শহরের অসংখ্য চোখ থেকে দু’একটা নিয়ে এলে কোন ক্ষতি হবে না।

.

একটা বেকারির ছাদে নেমে এলো কাকটা। আশপাশে নজর বুলাতে লাগলো সতর্ক চোখে। বেকারির পেছনে একটা সবুজ গাছ। ডালগুলো এমন ভাবে বেড়েছে ওটার যেন কোন বডিবিল্ডার নিজের মাসল দেখাচ্ছে। বেকারি মালিক টায়ার দিয়ে বানানো একটা দোলনা ঝুলিয়ে দিয়েছে ডাল থেকে। তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটা মনে সুখে দোল খায় সেখানে। বর্তমানে অবশ্য ছেলেটাকে উল্টো হয়ে ঝুলতে দেখা যাচ্ছে।

বেকারির ছাদে বসে ছেলেটাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলো কাকটা। ভেতর থেকে ছেলেটার মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো কিছুক্ষণ পর, “এখন ঘুমোনোর সময় তোমার! ভেতরে এসো তাড়াতাড়ি।”

সাথে সাথে দোলনা থেকে নেমে ঘরের ভেতরে চলে গেল ছেলেটা।

যে ডাল থেকে দোলনাটা ঝুলছে সেটায় নেমে এলো কাকটা। ওখান থেকে বেকারির দোতলাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেখানে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় উঠে পড়লো ছোট ছেলেটা।

বেশ, একে দিয়ে শুরু করা যাক তাহলে। সতর্কতা স্বরূপ ছেলেটার ঘুমিয়ে পড়া অবধি অপেক্ষা করলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নির্দিষ্ট ছন্দে উঠতে নামতে লাগলো ছেলেটার বুক।

নিঃশব্দে জানালা গলে ভেতরে ঢুকে পড়লো কাকটা। তাজা রুটির ঘ্রাণে ম ম করছে চারদিকে। ছেলেটা এখন গভীর ঘুমে, কাকটার অস্তিত্ব একবারের জন্যেও টের পেল না।

খুব সাবধানে, ছেলেটার ডান চোখ উপড়ে নিল কাকটা। সতর্ক থাকতে হয়েছে যেন তাড়াহুড়োয় উপহারটা নষ্ট না হয়ে যায়।

চমকে জেগে উঠলো ছেলেটা। বাম চোখে দিয়ে কাকটাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলো তারস্বরে।

“মা! একটা কাক আমার চোখ খেয়ে ফেলছে!”

হন্তদন্ত হয়ে কাকটাকে ধরার চেষ্টা করলো সে এক হাত দিয়ে; তার মায়ের পদশব্দ শোনা যাচ্ছে সিঁড়িতে।

সুযোগ থাকতে থাকতে ডানা ঝাঁপটে ঘরটা থেকে বেরিয়ে পড়লো কাকটা। ঠোঁটে চোখটা চেপে ধরে অনেক উঁচুতে উঠে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে। এবারে ম্যানশনটায় ফেরার পালা।

কিন্তু জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে কাকটা দেখলো ডেস্কের ওপর মাথা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে মেয়েটা।

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল কাকটা। ঠোঁটের রক্তাক্ত চোখটা ঘরের মাঝে টেবিলটায় রাখলো প্রথমে, এরপর বললো, “মিস, আপনি কাঁদছেন কেন?”

কাঁপতে কাঁপতে তার দিকে তাকালো মেয়েটা। কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পেরেছে সে কোথায় আছে। আমি চাইনি যে তুমি আমাকে এই অবস্থায় দেখো।”

গাল বেয়ে পানি গড়াচ্ছে তার। দৃশ্যটা অনেকটা কাপ থেকে এক ফোঁটা কফি উপচে পড়ার মতন। কাকটার কাছে খুবই সুন্দর লাগলো দৃশ্যটা।

“আজকে আমার সাথে একটা ঘটনা ঘটেছে,” বলে মেয়েটা। “ঘরের মাঝে একটা টেবিল রাখা আছে, দেখেছো নিশ্চয়ই?”

কিছুক্ষণ আগে যে টেবিলটায় চোখটা নামিয়ে রেখেছে সেটার দিকে তাকালো কাকটা। “জ্বি।”

“ওটার ওপরে,” কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে অন্ধ মেয়ে, “একটা ফুলদানিতে কিছু ফুল ছিল। আমি ভেবেছিলাম ফুলগুলো একদম তাজা, নীল রঙের।”

আসলে ফুলগুলোর রঙ লাল, বিবর্ণ হয়ে এসেছে।

“আমার মা মিথ্যা কথা বলেছে আমার সাথে।”

“আপনার কি নীল ফুল ভালো লাগে?”

মাথা নাড়ে মেয়েটা। “আমাকে সত্যিটা বললেই তো হতো। বাবা যখন একটু আগে ঘরে এসে বললল লাল ফুলগুলো তো মরে যাচ্ছে মা-তখন সত্যিটা জানতে পারি।”

মেয়েটার কাঁদার দৃশ্য শেলের মত বিধছে কাকটার বুকে।

“কাঁদবেন না, প্লিজ,” বলে সে। “আপনার জন্যে একটা উপহার এনেছি আজকে।”

“উপহার?”

চোখের পানি মুছে ফেলে মেয়েটা। এই ঘরের কোথায় কি আছে সব মুখস্থ তার। মাপা পদক্ষেপে টেবিলটার সামনে পৌঁছুলো সে। এরপর হাতড়াতে হাতড়াতে চোখটা পেয়ে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।

“এটা কি?”

“আপনার কি মনে হচ্ছে হাতে নিয়ে?”

চোখটার ওপর আঙুল বুলিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো মেয়েটা।

“নরম। নরম আর গোল।”

“আপনার চোখের কোটরে ওটা রাখুন।”

কাঁপা কাঁপা হাতে চোখটা চেহারার কাছে নিয়ে এলো মেয়েটা। “ডান পাশে না বামে?” থেমে জিজ্ঞেস করলো।

“যেটায় ইচ্ছে।”

বাম কোটরে নরম চোখটা ঢুকিয়ে দিল মেয়েটা। সে যেহেতু কিছুই দেখতে পায় না, চোখটা উল্টোভাবে স্থান পেল কোটরে। তবে আটকে রইলো সেখানে, পড়লো না।

“কেমন লাগছে? জানতে চাইলো কাকটা।

“কেমন যেন… শান্ত লাগছে সবকিছু। কিন্তু এটা কি? মনে তো হচ্ছে একটা স্টপার।”

“এটার ব্যাপারে যেন আর কেউ না জানে। কাউকে বলতে পারবেন না যে আমি জিনিসটা এনে দিয়েছি আপনাকে। বাবা-মাকেও না। ওটা চোখে দিয়ে দয়া করে কারো সামনে যাবেন না। বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখবেন। আশপাশে যখন কেউ থাকবে না বা কাঁদতে কাঁদতে হয়রান হয়ে গেলে চোখে দেবেন।”

মাথা নেড়ে একবাই হাই তুললো মেয়েটা। তার নতুন চোখটায় হাত বুলালো একবার; ফলে খানিকটা ঘুরে গেলো ওটা।

“ধন্যবাদ, কারাসু, কেন জানে না… হঠাৎই কাকটাকে এই নামে ডেকে উঠলো মেয়েটা। “আপনার উপহারের জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভরাত্রি।”

বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লো সে।

“শুভরাত্রি,” বলে জানালা দিয়ে বেরিয়ে গেল কারাসু, নামটা মনে ধরেছে তার। এবারে দ্বিতীয় চোখটা খোঁজার সময় হয়েছে।

*

পরদিন সকালে নতুন একটা উপহার নিয়ে হাজির হলো সে। বাইরের ডালটায় বসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে প্রথমে। যখন নিশ্চিত মেয়েটা একা, জানালা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।

নতুন উপহারটা আগের জায়গায় রেখে দিল কারাসু। “হ্যালো, মিস।”

“তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম!” মেয়েটা বলে উচ্ছ্বসিত স্বরে। “গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি আমি! একটা আসল স্বপ্ন! সবকিছু দেখা যাচ্ছিল সেখানে। শেষ কবে রঙিন কিছু দেখেছিলাম ভুলেই গেছি। আর স্বপ্নটাও ছিল দারুণ। স্বপ্নে, একটা বেকারিতে নিজেকে আবিষ্কার করি আমি।”

চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের বিস্তারিত বর্ণনা করে সে। কাকটার বুঝতে সমস্যা হয় না কোটর থেকে তার দেয়া চোখটা বের করে নিলেও স্মৃতিটা মগজে গেঁথে গেছে মেয়েটার।

“স্বপ্নে আমি একটা ছেলে। আমার বাবা আটা কাই করছিল আর মা কেক বানাচ্ছিল। খদ্দেররা সবাই ভেতরে এসে আমাকে একবার আদর করে দেয়। খুব খেলছিলাম। এরপরেই নিজেকে বেকারির বাইরের গাছটায় যে দোলনাটা আছে, সেটা থেকে উল্টোদিকে ঝুলন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করি।”

দীর্ঘ একটা সময় অন্ধকারে থাকার পর হঠাৎ এই রঙিন দুনিয়ার হাতছানিতে আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠেছে মেয়েটা। কারাসুও খুব খুশি হলো মেয়েটাকে হাসতে দেখে।

“এত সুন্দর ছিল স্বপ্নটা!” বলে মেয়েটা। “আপনার দেয়া স্টপারটা কোটর থেকে খুলতে ইচ্ছে করছিল না। এমনকি জেগে ওঠার পরেও অনেকক্ষণ খুলিনি। ভাববেন না, কেউ দেখেনি। পায়ের শব্দ শুনেই তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলি। আমার বিছানার নিচে একটা কাঁচের বয়ামে রেখে দিয়েছি। কিন্তু একটু একাকী লাগলেই স্টপারটা কোটরে ঢুকিয়ে স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করি। প্রথমে শুধু ঘুমোনোর পরেই বেকারিটা দেখতে পেতাম। কিন্তু এখন দিনের বেলাতেও স্বপ্ন দেখি, দিবাস্বপ্ন।”

“মিস, আপনার জন্যে আরেকটা উপহার নিয়ে এসেছি আজকে।”

“আসলেই?”

কারাসু তাকে বললো যে এবারের উপহারটাও স্বপ্নে ভরপুর। আগ্রহের সাথে রক্তাক্ত চোখটা হাতে তুলে নিল মেয়েটা, এরপর বসিয়ে দিল বাম চোখের খালি কোটরে।

“দেখতে পাচ্ছি কারাসু! দেখতে পাচ্ছি,” বুকের কাছে হাত নিয়ে বলে মেয়েটা। যেন ঈশ্বরের দরবারে ধন্যবাদ জানাচ্ছে অপূর্ব দৃশ্যটার জন্যে। “মনে হচ্ছে কেউ যেন নীল রঙ্গে রাঙিয়ে দিয়েছে পৃথিবীটা। চারিদিকে শুধু রঙ আর রঙ। এই স্টপারটার নীল রঙ প্রবেশ করছে। আমার মনেও।”

এবারে কারাসু যে চোখটা নিয়ে এসেছে সেটা একজন বয়স্ক মহিলার। পাহাড়ি অঞ্চলে ফসলি ক্ষেত আর ফুলের বাগানে ঘেরা এক বাড়িতে বাস করে সে। মেয়েটা যখন কারাসুকে বলেছিল যে নীল রঙের ফুল ভালো লাগে তার, তখনই নীলের সমারোহ থেকে পরবর্তী চোখটা নিয়ে আসবে বলে মনস্থির করে সে।

তার পছন্দের সবকিছু তাকে দেখাতে চাই আমি। এমন কাউকে দরকার যে কিনা সবসময় নীল রঙের ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শহরের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই একটা নীল ফুলের বাগান চোখে পড়ে কারাসুর। সেই বাগানের মাঝে ছোট্ট একটা বাড়ি। আর বাড়ির ভেতরে বয়স্ক মহিলাটা বসে উল বুনে সারাদিন। প্রত্যেক নাতি নাতনীর জন্যে নিজ হাতে কিছু একটা বুনে দিতে ভালো লাগে তার।

একটা গাছে বসে প্রথমে ভেতরের দৃশ্যটা মনে গেঁথে নেয় কারাসু। চোখে চশমা পড়ে রকিং চেয়ারে বসে একমনে বুনে চলছিল মহিলা। জানালার কাছেই একটা ক্যানারি খাঁচার ভেতরে কিচিরমিচির করছে। কিছুক্ষণ পর চশমাটা খুলে পাশের টেবিলে নামিয়ে রাখে সে। দু’হাত দিয়ে নাকের গোড়ায় হাত বুলায় কিছুক্ষণ। এত লম্বা সময় ধরে একমনে কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল নিশ্চয়ই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে যায়।

যতটা সম্ভব নিঃশব্দে জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে কারাসু। রকিং চেয়ারটার একপাশের হাতলে এসে বসে। তার ভারে কিছুটা নড়ে ওঠে চেয়ারটা, তবে মহিলার ঘুম ভাঙে না। কোন এক সুখস্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত সে। খাঁচার ক্যানারি পাখিটা ডেকে উঠতে যাবে এমন সময় মহিলার চোখের পাতার নিচে ঠোঁট ঢুকিয়ে দে কারাসু…

“কি সুন্দর ফুলের বাগান!” মেয়েটার গলায় খুশির আমেজ। “এবারের স্বপ্নে আমি কাপড় বুনছি। এর আগে কখনো কিছু বুনিনি।”

আরো সুখী দেখতে চাই আমি তাকে আরো চোখ খুঁজে বের করবো। পুরো পৃথিবী দেখাবো। দুনিয়ার সব জায়গা থেকে চোখ এনে দেব! ওর খুশির জন্যে যে কোন কিছু করতে রাজি।

মেয়েটার চোখের আনন্দাশ্রু দেখে মনে মনে ওয়াদা করলো কারাসু, তার বিছানার নিচে রাখা কাঁচের বয়ামটা চোখে পূর্ণ করে দেব আমি। কানায় কানায় পূর্ণ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *