৭. কাওয়ার্ড

নিরাপদে সুস্থ শরীরে কলকাতায় ফিরে এসেছি। বাবা মা ছোট ভাই বোন সবাই খুব খুশি। ওরা যেন জানতো আমি আসবো, তাই বিস্মিত হলো না, কোনো প্রশ্নও জিজ্ঞাসা করলো না। এক দিক দিয়ে বেঁচে গেলাম। দু’ বেলা খাই আর নিজের ঘরটিতে চুপ করে বসে বই পড়ি বা ঘুমোই। সন্ধ্যের পর হরিশ পার্কের নির্জন বেঞ্চির উপর চিৎ হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকি। ক্রমে রাত গম্ভীর হতে গভীরতর হয়, আমিও উঠে বাড়ি গিয়ে খেয়ে আমার নিচের ছোট ঘরটিতে শুয়ে পড়ি। এইভাবে দু তিন দিন কাটলো। সেদিনও সময়মতো পার্ক থেকে ফিরে ঘরে ঢুকে দেখি বাবা বসে আছেন। পাশে এসে বসতে বললেন। বুঝলাম কিছু বলবেন আমায়। চুপ করে পাশে বসে আছি, কিছুক্ষণ বাবার মুখে কোনো কথা নেই। তারপর স্বভাবগম্ভীর স্বরে আস্তে আস্তে বললেন–আমি ভেবে দেখলাম এ চাকরি তোমার ছেড়ে দেওয়াই ভালো।

আমি নিঃসঙ্কোচে বলে ফেললাম–ছাড়বো বললেই তো আর ছাড়া যায় না। তা ছাড়া বড় সাহেব গোড়া থেকেই আমার উপর চটা। শুধু জব্দ করবার জন্যেই ও আমার রেজিগনেশন চিঠিটা চাপা দিয়ে রাখবে।

একটু ভেবে বাবা বললেন–তাহলে এক কাজ করো তুমি। মা দুই দুটি নেবার ব্যবস্থা করো, আমি এর মধ্যে মতিলালকে ধরে দেখি কলকাতার কাছাকাছি কোথাও বদলি করা যায় কি না।

ভেবে দেখলাম দীর্ঘ ছুটি নিয়ে অন্য কোনো জেলায় বদলি হওয়া অথবা চাকরি ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমার আর অন্য পথ নেই। চিটাগং জেলায় আবার ফিরে যাওয়া মানে জেনে শুনে সাপের গর্তে হাত দেওয়া। তা ছাড়া ওদের কাছে মুখ দেখানোর সাহস বা মনের বল আমার ছিল না। অগত্যা প্রতিবেশী ডাক্তার সুল রায়ের শরণাপন্ন হলাম।

সব শুনে ডাক্তার বললে–আরে, এতে ঘাবড়াবার কি আছে। টাইফয়েড হয়েছে বলে আমি একটা সার্টিফিকেট দিচ্ছি, দু’ মাসের ছুটির দরখাস্তের সঙ্গে কালই পাঠিয়ে দাও মুলাণ্ডের কাছে। বাপ বাপ বলে ছুটি দিতে পথ পাবে না।

এতো সহজেই মীমাংসা হয়ে যাওয়ায় মনটা একটু হাল্কা হলো।

সে দিন সকাল থেকেই লক্ষ্য করলাম, বাবা কেমন মনমর গম্ভীর। বিকেলের দিকে জিজ্ঞাসা করলাম–আপনার শরীরটা কি ভালো নেই বাবা?

উত্তর না দিয়ে কিছু সময় আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন, তারপর আমায় ডেকে নিয়ে নিচে বাইরের ঘরে বসলেন। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বাবা বললেন–ধীউবাবা, একটা ব্যাপারে তোমার কাছে আমি অপরাধী।

চমকে বাবার মুখের দিকে তাকালাম।

বাবা বললেন–আমার সেই আশৈশবের বন্ধু সহপাঠী–চ্যাটার্জি, যার কথা চিঠিতে তোমায় লিখেছিলাম, আজ সকালে তার চিঠি পেলাম।

রুদ্ধ নিঃশ্বাসে চুপ করে বসে রইলাম।

বাবা মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে গেলেন–লিখেছে– ভাই ললিত, ধীরাজের সঙ্গে নমিতার বিয়ে দেবার জন্য আমি প্রস্তুতই ছিলাম। এমন কি অনেকদূর এগিয়েও ছিলাম। কিন্তু কি জানো ভাই, আমার আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই আপত্তি করছে। বলছে–আজ স্বদেশী আন্দোলনের যুগে সামান্য একটা কনস্টেবলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে সমাজে আমি নাকি মুখ দেখাতে পারবে না। তা ছাড়া লোকের কাছে বললে–ও ধীরাজ, এ যে দেখহি কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়লো। এখন উপায়?

বললাম–তুমি ভাই চলো আমার সঙ্গে শুক্রবার। সাহেবকে একটু বুঝিয়ে বললে হয় তো পরীক্ষা না করেই ছুটি দিয়ে দেবে।

চোখ দুটো কপালে তুলে ডাক্তার বললে–ক্ষেপেছো? মেজর গ্রীনফীল্ড ভারী কড়া আর একবোখা মানুষ। কেউ কোনো অনুরোধ করলে ঠিক তার উল্টোটি করে বসে থাকে। তবে কিনা খামখেয়ালী ডাক্তার, হয় তো তোমার দরখাস্ত দেখে এমনিই দুটি দিয়ে দিতে পারে।

বুঝলাম খানিকটা সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া সুশীল ডাক্তারের আর করবার কিছু নেই।

বাড়ি এসে বাবাকে সব খুলে বললাম। শুনে বাবা মা দুজনেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তা ছাড়া এ ব্যাপারে ওঁদের করবারই বা কি আছে। মনে মনে ঠিক করলাম, মুখটা অন্ততঃ মেক-আপ করে খানিকটা রোগা করবার চেষ্টা করি। যদি দৈবাৎ মুখ দেখে আর পরীক্ষা না করে ছুটিটা মঞ্জুর করে দেয়। মনে মনে বেশ জানতাম ডুবে মরবার আগে তৃণ-খণ্ড আঁকড়ে বাঁচবার চেষ্টার মতো এ-ও আমার একটা মস্ত দুরাশা।

মাথার এক বোঝ চুল তেল না মেখে সাবান দিয়ে রুক্ষ করে নিলাম–চিরুণীর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখলাম না। সঙ্গে সঙ্গে দাড়ি কামানো বন্ধ করে দিলাম। পরদিন সকালে আয়নায় দেখলাম, একটু রুক্ষতার আভাস দেখা দিয়েছে মাত্র, হাল ছাড়লাম না। আজ সোমবার, হাতে এখনও সময় রয়েছে চার দিন–দেখা যাক। দু’দিন বাদে কি একটা দরকারি কাজে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি এমন সময় বাল্যবন্ধু তারানাথ মুখার্জির সঙ্গে দেখা। ওর ডাক নাম নীলা।

আমায় দেখেই উৎকণ্ঠার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে–তোর কি হয়েছে রে ধীরাজ?

আশায় আনন্দে মনটা দুলে উঠলো। মুখখানা যথাসম্ভব কঁচুমাচু করে চেষ্টাকৃত ক্ষীণ কণ্ঠে বললামনীলা, আমার টাইফয়েড।

বিস্ময়ে চোখ দুটো কপালে তুলে আপাদমস্তক সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে নীলা বললে–তাই নাকি? একটা কথা কখনোই ভুলিস না যে, টেকনাফে সমুদ্রের হাওয়া আর মুরগীর মাংস খেয়ে দেহটাকে করে এনেছিস একটা নিটোল খাসির মতো। ছিলিম আষ্টেক কড়া গাঁজা খেয়েও কেউ বলতে পারবে না তোর দেহে কোনো অসুখ আছে।

রেগে গেলাম, বললাম–তোর সবতাতেই বাড়াবাড়ি। ধর যদি একখানা মোটা পুরু কম্বলে গলা পর্যন্ত ঢেকে, অন্ধকারে বসে মিহি সুরে কাতরাই, তাহলে?

এবার হেসে ফেললে নীলা। বললে–ব্যাপার কি বল তো?

সব খুলে বললাম।

শুনে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে নীলা বললে–সত্যি ভাবনার কথা। তবে এখনও দু’দিন সময় আছে, চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি?

বললাম–তোকে কিন্তু আমার সঙ্গে শুক্রবার মেডিকেল কলেজে যেতে হবে, কারণ একা গেলে আমি হার্টফেল করে মারা যাবে।

নীলা রাজী হয়ে গেল।

পরদিন দুপুরে খেয়ে দেয়ে শুয়ে আছি, ম্যাডান কোম্পানী (অধুনা ইন্দ্রপুরী স্টুডিও) থেকে নির্বাকযুগের বিখ্যাত পরিচালক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলীর সহকারী জ্যোতিষ মুখার্জি গাড়ি নিয়ে হাজির। কী ব্যাপার? মুখার্জির কাছে ব্যাপারটা যা শুনলাম তা হলো এই-নির্বাক ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র অসামান্য সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে গাঙ্গুলীমশাই দুর্গাদাস ও সীতা দেবীকে নায়ক নায়িকা নির্বাচন করে ‘কাল পরিণয়’ ছবিটি তুলবার সব ব্যবস্থা শেষ করে ফেলেন। হঠাৎ দুর্গাদাসবাবুর সঙ্গে ম্যাডান কোম্পানীর মতান্তর হওয়ায় দুর্গাদাসবাবু কোম্পানীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে এসেছেন। অগত্যা তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নায়কের ভূমিকায় মনোনীত করে সুটিং-এর দিন ঠিক করেন। আজ চারদিন ধরে সীতা দেবীকে নিয়ে সুটিং-এর জন্য সবাই স্টুডিওতে অপেক্ষা করে বসে থাকে, নায়ক তুলসীবাবুর পাত্তাই নেই। মুখার্জি কলকাতার অলিতে গলিতে কোথাও খুজতে বাদ রাখেনি কিন্তু তুলসীবাবু যেন হাওয়ার সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। আজ স্টুডিওতে এসে গাঙ্গুলীমশাই ভীষণ রেগে গিয়েছেন। মুখার্জিকে বলেছেন যাকে হোক নায়ক সাজিয়ে আজ তিনি শুটিং করবেনই। আমার কলকাতায় আসার খবরটা কি করে মুখার্জি জানতে পেরেছেন, নাম করতেই প্রিয়নাথবাবু রাজী হয়ে গিয়েছেন। মুখার্জি আমাকে নিয়ে যাবার জন্য গাড়ি নিয়ে এসেছেন, আজই দুপুরে সুটিং।

সব শুনে বললাম–সবই বুঝলাম ভাই। এত বড় একটা চান্স পাওয়া ভাগ্যের কথা কিন্তু আমার যে এদিকে শিয়রে সংক্রান্তি। আমার মরণ বাঁচন কালকেই স্থির হয়ে যাবে মেডিকেল কলেজে। এক এক করে সব কথাই মুখার্জিকে বললাম।

শুনে একটু যেন নিরুৎসাহ হয়ে পড়লো মুখার্জি। তারপর বললে–তুমি বাড়িতেই আছে তো? আমি ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঘুরে আসছি গাঙ্গুলীমশাই-এর কাছ থেকে। যদি এক ঘণ্টার মধ্যে না আসি, জানবে হলো না, অন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মুখার্জি চলে গেলে ভাবলাম এতো বড় একটা চান্স পেয়ে হারালাম। নির্বাকযুগে ‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার পর থেকেই সীতা দেবী অসম্ভব জনপ্রিয়। তার বিপরীতে নায়ক সাজা একটা ভাগ্যের কথা। ক্ষোভে দুঃখে নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে হচ্ছিলো।

কিছুই করতে হলো না। আধ ঘণ্টার মধ্যেই মুখার্জি এসে হাজির। বললে–চলো।

সত্যি অবাক হয়ে বললাম–চলো মানে?

মুখার্জি বললে–স্টডিওতে গিয়ে গাঙ্গুলীমশাই-এর কাছেই সব শুনবে, চলো। মোন্দা আজ তোমাকে দিয়ে তিনি শুটিং করাবেনই। তোমার কালকের অগ্নিপরীক্ষার কথাও বলেছি। শুনে বললেন বেশ কাল যদি বিচারে তুমি দোষী সাব্যস্ত হও এবং শনিবার দিন চট্টগ্রাম রওনা হতে হয় তাহলে তিনি আজকের সুটিংটা বাতিল করে দিয়ে অন্য নায়ক ঠিক করে আবার শুরু করবেন গগাড়া থেকে। মোট কথা আজ সুটিং করা চাই-ই চাই।

এরপর আর কথা চলে না। উপরে বাবার ঘরে গিয়ে দরজায় আস্তে আস্তে ঘা দিলাম। বাবা মা ঘুমুচ্ছিলেন। একটু পরে বাবাই উঠে দরজা খুলে দিলেন। সব কথা খুলে বললাম।

একটু চিন্তা করে বাবা বললেন–যাও তুমি। যেচে এতো বড় একটা সুযোগ এসেছে তাকে ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

মা ক্ষীণ একটু আপত্তি তুলেছিলেন, বাবা এক ধমকে মাকে থামিয়ে বললেন–একবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে পুলিসে ঢুকিয়ে ছেলেটার সারা জীবনটাই নষ্ট হতে বসেছে, এখনও তার জের মেটেনি। এবার নিজের ইচ্ছায় যে পথ ও বেছে নিয়েছে সে পথ ধরে স্বাধীনভাবে ওকে চলতে দাও। পরিণামে দুঃখ কষ্ট যাই পাক ও একাই তা ভোগ করবে। আমরা তো আর ভুগতে আসবে না।

নিচে থেকে মুখার্জি চেঁচামেচি শুরু করে দিলে–দেরি হয়ে যাচ্ছে, কাপড় জামা কিছু পাল্টাতে হবে না। একটা ময়লা শার্ট আর কোট থাকে তো নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি নেমে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম।

স্টুডিওতে ঢুকেই দেখি বন আলো করে খোলা চুলে বনদেবী বসে আছেন। এখানে বলে রাখি ম্যাডান স্টুডিও বলতে তখন গেট-এর সামনে রাস্তায় আম গাছের নিচে ছোট দু’খানা টিনের শেড আর টালিগঞ্জ ডিপোর গা ঘেঁষে দুখানা ছোট কোঠা ঘর এই বোঝাত। বাকি সবটাই ছিল জঙ্গল। পথের পাশে সেই টিনের শেডের নিচে নড়বড়ে একখানা চেয়ারে বসে আছেন নায়িকা সীতা দেবী। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়ে, নাম ‘মিস রেনি স্মিথ। তার পাশে আর একটা টিনের চেয়ারে বসে রয়েছেন বিরাটকায় পরিচালক প্রিয়নাথ গাঙ্গুলী। ময়লা কাপড় জামা পরে একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর এক মাথা রুক্ষ চুল নিয়ে নায়িকা সীতা দেবীর সামনে দাঁড়াতে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিলো। কোনো রকমে মুখ নিচু করে নমস্কার জানিয়ে গাঙ্গুলীমশাই-এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

কিছু বলবার আগেই তিনি বললেন–আমি সব শুনেছি ধীরাজ, কোনো চিন্তা নেই। দুটি না পাও আমার একদিনের কাজ নষ্ট হবে।

একটু ইতস্তত করে গালে হাত দিয়ে বললাম–কিন্তু এই এক মুখ দাড়ি–

কথা শেষ করতে পারলাম না, হো হো করে হেসে উঠলেন গাঙ্গুলীমশাই আর মুখার্জি। শুধু কিছু বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে রইলাম আমি আর সীতা দেবী।

হাসি থামিয়ে ইংরেজিতে সীতা দেবীকে বললেন গাঙ্গুলীমশাই –কি আশ্চর্য যোগাযোগ, ডাক্তারের চোখে ধূলো দেওয়ার জন্য মেক-আপ করলে ধীরাজ আর সেই মেক-আপ কাজে লাগালাম আমি। আবার হেসে উঠলেন গাঙ্গুলীমশাই।

ব্যাপারটা তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি। সীতা দেবীর অবস্থাও তথৈবচ।

গাঙ্গুলীমশাই-এর পরের কথাগুলোতে ব্যাপারটা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। বললেন–গল্পের নায়ক মনীন্দ্র খুব গরীব। শুধু চেহারা আর বিদ্যার জোরে ধনী শ্বশুরের একমাত্র কন্যা কিশোরীর সঙ্গে দৈবাৎ বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের কিছুদিন পরে মনীন্দ্রের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ে। সকাল থেকে পায়ে হেঁটে চাকরির চেষ্টায় চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, চাকরি হয় না। সারাদিন হেঁটে নিরাশ হয়ে শ্রান্ত মনীন্দ্র সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরে, সাধ্বী স্ত্রী কিশোরী স্বামীকে সান্ত্বনা দেয়। এইভাবে কিছুদিন চলে। পয়সার অভাবে মনীন্দ্রের চেহারাও হয়ে উঠেছে তদনুরূপ। মাথায় এক রাশ রুক্ষ চুল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, পরনে ময়লা কাপড় ও জামা।

সেদিনও নিয়মিত চাকরির চেষ্টায় ঘুরে ঘুরে সন্ধ্যার সময় ঘরে ফিরে দেখে–তার স্ত্রী ও এক বছরের শিশুপুত্র নেই। পাড়ার লোকের কাছে খবর নিয়ে জানতে পারে যে, তার শ্বশুর লোকমুখে খবর পেয়ে মেয়ের অনিচ্ছাসত্ত্বেও একরকম জোর করেই ওদের নিয়ে গিয়েছে। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মনীন্দ্র তখনই ছোটে ধনী শশুরের বাড়ি।

–সিনটা হলো এই। কাজেই বুঝতে পারছে, তোমার মেকআপ আইডিয়াল ফর দি সিন। কিছু করতে হবে না, যেমন আছছ ঐভাবেই সুটিং হবে। আজ শুধু আপিস পাড়ায় চাকরির চেষ্টায় ঘোরাঘুরি আর বাড়ি থেকে রেগে বেরিয়ে পথ দিয়ে হেঁটে শশুর বাড়ি যাওয়া, এই পাসিংগুলো নেওয়া হবে। যতীনকে ক্যামেরা নিয়ে রেডি হতে বলে মুখুজ্জে।

অধুনা বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান যতীন দাস ছবিখানি তুলছিলেন। সারাদিন কলকাতার পথে পথে রোদ্দু রে ঘুরে ছবি তোলা হলো। বাড়ি যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। খাওয়া দাওয়া সেরে সে রাত্রে ঘুমুতে পারলাম না। একদিকে আমার শৈশবের স্বপ্ন বহু আকাঙিক্ষত সিনেমার নায়ক হাতছানি দিয়ে ডাকছে, অন্যদিকে কুটিকুটিল প্রতিহিংসাপরায়ণ মুণ্ড রিভলবার হাতে শাসাচ্ছে। হাসিকান্নার টানাপোড়েনে সারা রাত ছটফট করে কাটালাম। অবশেষে কাল রাত্রি প্রভাত হলো।

শুক্রবার। কোনো বিশেষ বার যে মনে কতোখানি ভীতির সঞ্চার করতে পারে আজকের আগে তা কোনদিন উপলব্ধি করতে পারিনি। করবার বিশেষ কিছুই ছিল না, শুধু মোটা ময়লা কম্বল একখানা যোগাড় করে ঘড়ির কাটার দিকে চেয়ে বসে রইলাম। স্নান করলাম না, চুলের রুক্ষতা নষ্ট হবে বলে। আর খাওয়া? out of question। ক্ষিদে তেষ্টা ছিলই না। বেলা ঠিক নটায় নীলা এসে হাজির। এই চেহারায় কম্বল মুড়ি দিয়ে ট্রামে বাসে গেলে লোকে পাগল বলে ঢিল মারবে। সুতরাং ট্যাক্সি চড়েই যাওয়া স্থির হলো। মেডিকেল কলেজে নেমে প্রিন্সিপ্যাল মেজর গ্রীনফীল্ডের রুগী দেখবার চেম্বার খুঁজে নিতে দেরি হলো না। শুনলাম, সাহেব এখনও নামেননি, ঠিক দশটা থেকে রুগী দেখবেন। আরও শুনলাম, মাত্র গতকাল সাহেব বিলেত থেকে ফিরেছেন। দু তিনজন হাউস সার্জেন ছোকরা ডাক্তার, ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, ওঁদেরই একজনের কাছে গিয়ে নিজের নাম বললাম।

শুনে ডাক্তারটি বললেন–জানি, আপনার কেসটাই আগে দেখা হবে। আসুন সাহেব নিচে আসবার আগেই আপনাকে একজামিন করে ফর্মটা ফিল-আপ করে রাখি। জামা কাপড় খুলুন।

হতভম্ব হয়ে গেলাম। জামা কাপড় খুলবে কি?

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে ছোকরা ডাক্তারটি বললেন–কম্বল, জামা খুলে ফেলুন, আপনার বুক পেট পরীক্ষা করবো।

অগত্যা ভয়ে ভয়ে গায়ে জড়ানো কম্বল শার্ট ও গেঞ্জিটা খুলে চেয়ারের হাতলের উপর রেখে দিলাম। ঘরের বাইরে ওয়েটিং রুমে নীলা বসে আছে। এ বিপদে সে কাছে থাকলেও খানিকটা সাহস পেতাম।

যথারীতি পরীক্ষা শুরু হলো। স্টেথিস্কোপ দিয়ে প্রথমে অনেকক্ষণ ধরে বুক ও পরে পিঠ পরীক্ষা হলো। জোরে জোরে পেট টিপে কি পরীক্ষা করলে ডাক্তারই জানে। তারপর ডান হাতখানা ধরে ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নাড়ীর গতি দেখলে–সবশেষে চোখের নিচের চামড়াটা টেনে ধরে দেখে পরীক্ষা শেষ হলো। একখানা ছাপানো ফর্ম টেবিল থেকে টেনে বার করে ডাক্তার পরীক্ষার ফল লিখতে লাগলেন। দেখলাম, হার্ট থেকে শুরু করে সবগুলোই লেখা হলো-নরমাল, শুধু আমার ফেবারে লিখলো একটি কথা–Looks ill!

হতাশভাবে বললাম–এ রিপোর্ট দেখলে সাহেব কিছুতেই ছুটি দেবে না।

খিঁচিয়ে উঠলেন ছোকরা ডাক্তার-আপনি বলতে চান আপনার ছুটির জন্য আমি চাকরি ডিপ্লোমা সব খোয়াবো? আট বছর ধরে দু তিনবার ফেল করে কতো কষ্টে পাশ করে ছ’ মাসের জন্য হাউস সার্জেন হয়েছি। মিথ্যে রিপোর্ট লিখে দিই আর সাহেব এসে পরীক্ষা করে দেখুক আট বছরে যা কিছু শিখেছি সব ভুল। তখন আমার অবস্থাটা কি হবে বলতে পারেন?

ইতিমধ্যে আরো দুটি ছোকরা ডাক্তার কৌতূহল নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের মধ্যে একজন বললে–এটা সেই চিটাগং-এর কেস, তাই না ঘোষ?

ঘোষ মাথা নেড়ে জানালে, তাই-ই। তারপর একটু নরম সুরে বললে–কিছু মনে করবেন না ধীরাজবাবু, আপনার কেস হোপলেস! আপনাদের এন্স, পি, আমাদের সাহেবের অন্তর বন্ধু। দেখবেন চিটাগং থেকে পারসন্যাল চিঠি কি লিখেছেন তিনি? যদিও এটা দেখানো আমার পক্ষে খুবই অন্যায় হচ্ছে, তবু ফর ইওর স্যাটিসফ্যাকশন দেখাচ্ছি।

দেখলাম টেবিলে রয়েছে একটা ফাইল, উপরেই আছে মুলাণ্ডের কাছে পাঠানো আমার ছুটির দরখাস্তখানা ডাঃ সুশীল রায়ের সার্টিফিকেটের সঙ্গে পিন দিয়ে আঁটা। তার নিচে রয়েছে ডাঃ ঘোষের পরীক্ষার ফল, সবার নিচে একখানা হলদে খাম। সেই খামখানা টেনে নিয়ে তার ভিতর থেকে একখানা টাইপ করা চিঠি বার করে ডাঃ ঘোষ আমায় পড়তে দিলেন। বহুদিনের কথা, চিঠিটা একবার মাত্র পড়েছিলাম। চিঠির ভাষা হয় তো ঠিক মনে নেই কিন্তু মুলারে বক্তব্যটুকু আজও স্পষ্ট মনে আছে। যতোদূর মনে হয়, চিঠিটা এই–

Dear Greenfield,

A. S. I. Dhiraj Bhattacherjee of my District went on fourteen day’s casual leave. At the expiry of the leave he wants to prolong it for another two months on the pretext that he is suffering from typhoid, which I doubt very much. Will you please examine him minutely and let me know the result at your earliest convenience! Your usual fees are sent herewith.

With best wishes
yours
H. B. Mulland.

যেটুকু ক্ষীণ আশা ছিল তাও নিবে গেল। শুধু মাইকেল মধুসূদনের বিখ্যাত কবিতার গোড়ার লাইনটি আমার হতাশ মনের দুয়ারে বার বার ঘা দিতে লাগলো–

‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়’—

ডাঃ ঘোষের কথা কানে এল–এইবার ব্যাপারটা সব বুঝলেন তো? যান, বাইরে ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসুন, সাহেব আসক্স, সময় হয়ে গিয়েছে।

কাঠের পুতুলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে ওয়েটিং রুমে নীলার পাশে গিয়ে চুপ করে বসে পড়লাম।

নীলা জিজ্ঞাসা করলে–কি রে, কি হলো?

জবাব দেবার ক্ষমতা ছিল না, চুপ করে বসেই রইলাম।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আর্দালি এসে ডাকলো–ধীরাজ ভটচাজ।

হাঁড়িকাঠে মুণ্ড গলিয়ে দেবার আগে বলির পাঁঠার মতো কঁপতে কাঁপতে কম্বল জড়িয়ে সাহেবের টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বিরাট চেহারা, বিলেতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় লাল মুখ আরো লাল হয়ে গিয়েছে।

সাহেবের হাতে রয়েছে আমার সেই ফাইলটা। সবার উপরে রাখা আমার ছুটির দরখাস্তখানায় একবার দ্রুত চোখ বুলিয়ে সেইদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে সাহেব বললে–You are Dhiraj Bhattacherjee?

গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল, একরকম জোর করেই বললাম–Yes Sir.

–You want two months leave?

–Yes.

–If I give you three months?

সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম, ভাবলাম সাহেব আমাকে নিয়ে বোধ হয় একটু মশকরা করছেন। কি বলি? বুকের ভিতরে হাতুড়ি পিটছিল, ভয়ে ভয়ে বললাম–If you please, Sir.

হঠাৎ সিংহের মতো গর্জে উঠলেন সাহেব। ফাইলটা টেবিলের উপর আছড়ে ফেলে এই প্রথম আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন I don’t please! Don’t you require three months leave after typhoid?

নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সাহেব কি এখনো আমাকে ঠাট্টা করছেন? ইডিয়টের মতো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।

দেখি সাহেবের চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে হাত মুখ নেড়ে ভা ঘোষ আমাকে ইশারা করে বলছেন–বলুন ইয়েস।

আপনা হতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–Yes Sir.

টেবিল থেকে ফাইলটা টেনে নিয়ে আমার দরখাস্তটার উপরে খস খস করে সাহেব লিখলেন–Countersigned. Three months leave recommended. তারপর নিচে নাম সই করে দিয়ে ফাইলটা বন্ধ করে বললেন–Next!

তবু দাঁড়িয়ে আছি। মনেই হয়নি যে, আমার দাঁড়াবার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে।

তাড়াতাড়ি ডাঃ ঘোষ আমাকে ইশারা করে বাইরে ডেকে নিয়ে গেলেন। বাইরে গিয়ে ডাঃ ঘোষকে বললাম–কি হলো ডাক্তার?

অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে ডাক্তার ঘোষ বললেন–এখনও বুঝতে পারেননি ব্যাপারটা কি হলো? খামখেয়ালী সাহেব, এসেই আপনার ফাইলটা নিয়ে শুধু দেখেছে আপনার দরখাস্তখানা। ব্যস, নিচে যে আরও চিঠিপত্তোর রয়েছে, তা দেখবার দরকারই মনে করলেন না সাহেব। আপনি সত্যিই ভাগ্যবান মশায়! এরকম কেস বড় একটা হয় না।

সংশয় তখনও রয়েছে, বললাম–কিন্তু আমি দু’মাসের ছুটি চেয়েছিলাম–সাহেব তিন মাসের দিলো কেন?

হেসে ডাঃ ঘোষ বললেন–এইখানেই আমাদের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব যে কত বড় বিচক্ষণ ডাক্তার তার পরিচয় পাওয়া যায়। উনি জানেন, আপনি সত্যি টাইফয়েড থেকে ভুগে উঠেছেন। বিশ্রামের পক্ষে দু মাস ছুটি তাই মোটেই পর্যাপ্ত নয়। অন্ততঃ তিন মাস হলে তবু খানিকটা শুধরে নিতে পারবেন।

কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। মনে মনে সাহেবের দীর্ঘজীবন কামনা করলাম।

তারপর ঢুকে পড়লাম ওয়েটিং রুমে।

অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল নীল। আমায় দেখে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো–কি হলো?

কোনো জবাব না দিয়ে ওর জামার কলারটা মুঠো করে ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বাইরে চলে এলাম। চওড়া সিঁড়ি। দু তিনটে ধাপ বাদ দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে গেট-এর বাইরে এসে চিৎকার করে ডাকলাম–ট্যাক্সি!

ভাগ্য সেদিন আমার সত্যিই ভালো। তখনই ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। নীলাকে ঐভাবে টানতে টানতে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম, গাড়ি ছেড়ে দিলো।

হতভম্ব নীলা খালি জিজ্ঞাসা করেই চলেছে–ব্যাপারটা কি হলে বল?

এতোক্ষণে হুশ হলো। কম্বলটা গা থেকে খুলে নীলার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললাম–আমি যা বলব, সঙ্গে সঙ্গে বলে যাবি নইলে মেরে ফেলবে। ফুসফুসের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম–লঙ লিভ মেজর গ্রীনফীল্ড। নীলা তবুও চুপ করে আছে দেখে পিঠে কষিয়ে দিলাম এক কিল।

দম ফুরিয়ে যাওয়া গ্রামোফোনের মতো নীলা ভয়ে ভয়ে বলে উঠলো–হিপ হিপ হুররে!

মেডিকেল কলেজ থেকে কতোক্ষণে কিভাবে বাড়ি পৌঁছলাম কিচ্ছু মনে নেই। বাড়ি এসেই মা বাবাকে প্রণাম করে ভাগ্যের এই ডিগবাজির কথা সবিস্তারে বললাম।

শুনে বাবা বললেন–ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। ভালোই হয়েছে, তবে তুমি একটা কাজ করতে ভুলে না। খুচিয়ে বাঘকে ছেড়ে দেওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। হয় তাকে যেভাবে হোক শেষ করে দিতে হয়, নয় তো ওর সান্নিধ্য থেকে বহু দূরে চলে যেতে হয়। শেষেরটাই করো তুমি। কেননা, এ ব্যাপারে মুলাও আরও চটবে। তবে চোরের মার কান্না, তিন মাসের মধ্যে কিছু করতে পারবে না। সুতরাং ছুটি ফুরিয়ে যাবার আগেই রেজিগনেশন দিয়ে একটা চিঠি আর সেই সঙ্গে ডাক্তারের একটা সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দিও। কারণ দেখাবে যে, টাইফয়েডের পর অ্যাকটিভ সার্ভিস করা তোমার পক্ষে সম্ভবপর নয়। মনে হয়, এবার আর পুলিস বিভাগ তোমায় ধরে রাখতে পারবে না।

খানিক বাদে মুখার্জি খবর নিতে এল।

সব শুনে আমায় জড়িয়ে ধরে নাচতে শুরু করে দিলে। বললে–বাঁচালে ভাই। গাঙ্গুলীমশাইও এ খবর শুনে খুব খুশি হবেন। তোমার পথে পথে হেঁটে বেড়ানোর মেক-আপটা স্টিল ফটোয় এতো ভালো এসেছে যে, সেগুলো বাদ দিতে হলে সত্যিই দুঃখের কথা হতো। আচ্ছা, চলি ভাই, গাঙ্গুলীমশাইকে সুখবরটা দিয়ে আসি। আর একটা কথা। কাল কোনো সুটিং রাখিনি, তোমার কি হয় না হয় ভেবেই। রবিবার সুটিং। তোমার আর সীতার একটা রোমান্টিক সিন নেওয়া হবে। কালকের মধ্যে চুল ছেটে দাড়ি কামিয়ে ভদ্রলোক হয়ে যেয়ো।

অনেকদিন বাদে রাত্রে পেট ভরে খেয়ে আর প্রাণ ভরে ঘুমিয়ে বাঁচলাম। আঃ!

***

কাহিনী এখনও শেষ হয়নি, আর একটুখানি বাকি আছে।

রবিবার। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাড়ি কামিয়ে স্নান করে খেয়ে নিতেই নটা বাজলো। আরশির সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম, নিজের চেহারা দেখে নিজেই মোহিত হয়ে গেলাম। ভাবলাম, আজ আর হিরোইন সীতা দেবীর পাশে মুখ নিচু করে নয়, উঁচু করেই দাঁড়াতে পারবে। স্টুডিওর গাড়ি এসে গেল, বাবা মাকে প্রণাম করে নতুন কাপড় জামা পরে ফিটফাট হয়ে গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, চেনা পিওনের সঙ্গে দেখা। অভ্যাস মতো আমার কিছু আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই চিঠির বাণ্ডিল থেকে একখানা খাম আমার হাতে দিলে, দেখি টেকনাফের ছাপ। একটা অজানা আশঙ্কায় সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। খামখানা পকেটে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।

স্টুডিওয় পৌঁছে দেখি গেট-এর সামনে রাস্তায় গাঙ্গুলীমশাই পায়চারি করছেন। গাড়ি থেকে নামতেই আমার আপাদমস্তক দেখে নিলেন, তারপর খুশি হয়ে বললেন–very good। যাও ধীরাজ, তাড়াতাড়ি ভালো করে মেক-আপ করে নাও। আজ। তোমার আর সীতার বিয়ের পর প্রথম লাভসিনটা নেবো। ঐটের উপরই ছবির বক্স অফিস।

মেক-আপ রুমে এসে আরশির সামনে চুপ করে বসে আছি। দু’তিনবার মনে করলাম চিঠিটা পকেট থেকে বার করে খুলে পড়ি –সাহস হলো না। নিজের মনকেই প্রশ্ন করি কে লিখেছে? কেন লিখেছে আমায়? আমি তো টেকনাফের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এসেছি। কোনো জবাব পাই না। আস্তে আস্তে ভেসলিনের শিশি থেকে একটুখানি নিয়ে হাতে ঘষে মুখে মাখিয়ে নিলাম। তারপর একটুখানি সবেদার সঙ্গে অল্প একটু পিউড়ি মিশিয়ে জল দিয়ে দু’হাতে ঘষে নিয়ে মুখে বেশ করে মাখিয়ে নিলাম। আলতার শিশি থেকে আঙুলে করে একটু নিয়ে ঠোঁটে লাগালাম, খানিকটা ভুসো কালি একটা দেশলাই-এর কাঠিতে নিয়ে ভুরু আর চোখ আঁকলাম। মেক-আপ হয়ে গেল। আরশির ভিতরে ‘কাল পরিণয়’ ছবির নায়ক মনীন্দ্রের দিকে চেয়ে বসে আছি। আমার ভেতরের মন তিরস্কার করে উঠলো–সামান্য চিঠিটা পড়বার সাহসও তোমার হচ্ছে না? চরম কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে কেমন পালিয়ে আসতে পারলে! আর এতো দূরে। এসেও সামান্য কয়েকটা কালির আঁচড়কে এতো ভয়? যা হয় হোক, মরীয়া হয়ে পকেট থেকে খামখানা বার করে একটা ধার ছিঁড়ে চিঠিটা বার করলাম। ছোট্ট চিঠি, বারোদিন আগের তারিখ দেওয়া। এ. এস. আই. যতীন লিখেছে টেকনাফ থানা থেকে–

“ভাই ধীরাজ–

তুমি এখান হইতে যাওয়ার দু’দিন পরেই কি ভাবে রাষ্ট্র হইয়া যায় যে, তুমি বাবার অসুখের জন্য ছুটি লইয়া যাও নাই, মাথিনকে বিবাহ করিবার ভয়ে পালাইয়া গিয়াছ। আমার দৃঢ় ধারণা সতীশই এই সর্বনাশ করিয়াছে। খবর শুনিবার পর হইতে মাথিন অন্নজল ত্যাগ করিয়া শষ্যা লয়। ওর বাবা ওয়াংথিন, আমরা সবাই, এমনকি সমগ্র টেকনাফবাসীর শত চেষ্টাও ওকে জল গ্রহণ করাইতে পারে নাই। গতকল্য সকালে মাথিন মারা গিয়াছে। ওয়াংথিন পাগলের মতো হইয়া গিয়াছে। তোমার ঠিকানা জানিবার জন্য ওয়াংথিন বহু চেষ্টা করিয়াছে ও এখনও করিতেছে, আমরা দিই নাই। এখন বুঝিতেছি তুমি পালাইয়া গিয়া ভালোই করিয়াছ। হরকিই যতো অনিষ্টের মূল জানিতে পারিয়া ওয়াংথিন তাহাকে মারিয়া আধমরা করিয়াছে। প্রাণে বাঁচিয়া থাকিলেও অনেক দিনের জন্য বিশ্রাম লইতে হইবে। মহেন্দ্রবাবু বদলি হইয়া গিয়াছেন, তাঁহার স্থলে মিঃ  ভৌমিক আসিয়াছেন। আমরা ভালো আছি, তুমি–”

আমি ভালো আছি, খুব ভালো আছি।

আর দরকার নেই, পড়বার প্রয়োজন আমার ঐ একটি লাইনেই ফুরিয়ে গিয়েছে–গতকল্য সকালে মাথিন মারা গিয়াছে। আমার অভিশপ্ত ভাগ্যের সামান্য ছোঁয়াচ লেগেই দুটো অমূল্য জীবন নষ্ট হয়ে গেল। মাথিন আর হরকি। কিন্তু আমার তো ভালো হলো। কলকান্তি তরুণ সিনেমার নায়ক! আরশির ভিতরের মানুষটার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বসে রইলাম।

বোধ হয় অনেকক্ষণ বসে ছিলাম, সময়ের হিসাব ছিল না? হন্তদন্ত হয়ে গাঙ্গুলীমশাই এসে হাজির।–এতো দেরি হচ্ছে কেন? এই যে মেক-আপ হয়ে গিয়েছে দেখছি। শীগগির এসে ধীরাজ, বোর চলে যাচ্ছে।

আস্তে আস্তে উঠে গাঙ্গুলীমশাই-এর পা দুটো জড়িয়ে ধরে বললাম–আপনি আমার বাবার বয়সী, আজ আমায় ক্ষমা করুন। আমি আজ কিছুতেই লাভসিন করতে পারবো না, শুধু আজকের দিনটা আমায় ছেড়ে দিন। কাল পরশু যেদিন বলবেন।

একবার আমার মুখের দিকে একবার হাতের মুঠোয় দলা পাকানো চিঠিটার দিকে চেয়ে কি ভাবলেন যেন গাঙ্গুলীমশাই, তারপর বললেন–তার জন্যে তুমি এতো কুণ্ঠিত হচ্ছে। কেন ধীরাজ। আজ আমি সীতার ক্লোজ-আপগুলো নিয়ে শুটিং প্যাক-আপ করে দিচ্ছি–পরে সুবিধামতো সিনটা নিলেই চলবে। তুমি মেক-আপ তুলে বাড়ি চলে যাও, আমি মুখুজ্জেকে দিয়ে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

মেক-আপ? মনেই ছিল না, হঠাৎ মনে হলো আমার সারা জীবনটাই শুধু মেক-আপ-এমন কি মাথিনকে ভালোবাসাটাও মেক-আপ ছাড়া আর কিছুই নয়। আরশির সামনে বসে নারকেল তেলের শিশি থেকে খানিকটা তেল হাতে ঢেলে নিয়ে জবজবে করে মুখে মাখিয়ে নিলাম। পুরু একখানা তোয়ালে দিয়ে ঘষে রঙ তুলতে যাচ্ছি, আরশির ভিতর দেখলাম ঘরে ঢুকলে সীতা দেবী। কোনো রকম ভূমিকা না করে আমার দিকে চেয়ে ভাঙা বাংলায় বললেন–ধীরাজ, গাঙ্গুলীমশাই বললেন তুমি নাকি খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছে ব্যাপার কী?

জবাব না দিয়ে রঙ তুলতে লাগলাম। খিল খিল করে হেসে উঠলো সীতা, তারপর বললে–মুখার্জি বলছিল চিটাগং-এ তুমি অনেক অ্যাডভেঞ্চার করে এসেছে, একটি মেয়ের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করতে এত ভয়?

গাড়ি রেডি হয়েছে খবরটা দিতে মুখার্জি ঘরে ঢুকলো। সীতা বললে–মুখার্জি, এমন একটা কাওয়ার্ড স্বামী জুটিয়ে দিয়েছে, প্রেম করা দূরের কথা, কথাই কইছে না আমার সঙ্গে। আবার সেই দুষ্টুমি ভরা হাসি। গাড়ির খবরটা দিয়ে মুখার্জি তাড়াতাড়ি সীতাকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

তা তো গেল, কিন্তু ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে গেল ঐ বিষাক্ত কথাটা–কাওয়ার্ড। ঘরের দেয়াল থেকে দেয়ালে রিবাউণ্ড করে আমার চার পাশে ঘুরে বেড়াতে লাগলো একটি মাত্র কথা–কাওয়ার্ড! কাওয়ার্ড!! কাওয়ার্ড!!!

হঠাৎ মনে হলো আরশিতে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। রাগ হলো মেক-আপ ম্যানের উপর। ধুলো জমেছে, একটু পরিষ্কার করে রাখতেও পারে না? আন্দাজে মুখে তোয়ালে ঘষেই চলেছি।

কাওয়ার্ড! মাথিন মরবার আগে জেনে গিয়েছে আমি কাওয়ার্ড! মৃত্যুশয্যায় শুয়ে হরকি শুধু বলছে ঐ একটি কথা–কাওয়ার্ড! কোতোয়ালির হেমদা, রাখালদা এমন কি মুলাণ্ড দম্পতি পর্যন্ত আমার প্রসঙ্গে ঐ একটি কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারছে না–কাওয়ার্ড।

পুলিস লাইন ছেড়ে নতুন জীবনের পথে পা বাড়ালাম–এখানেও ঐ অভিশপ্ত কথা আমার পিছু ছাড়লো না। আজ গাঙ্গুলীমশাই, সীতা দেবী, মুখুজ্জে, এদের সবার কাছে আমার একমাত্র পরিচয় হলো–কাওয়ার্ড!

সবেদা আর পিউড়ি মেশানো রঙ, সামান্য একটু নারকেল তেল দিয়ে দু’বার ঘষলেই উঠে যায়। আমি কিন্তু মুখে তোয়ালে ঘষেই চলেছি। মানুষের চামড়া হলে এতোক্ষণ ছাল চামড়া উঠে যেতো কিন্তু এক ফোঁটা রক্তও পড়লো না। গণ্ডারের চামড়া কিনা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *