৬. ট্রেন ছাড়ল

তখনও ঠিক ভোর হয়নি হঠাৎ কানে ভেসে এল গুম গুম আওয়াজ। এক সঙ্গে প্রায় শখানেক সুরকির কল চালিয়ে দিলে এক মাইল দূর থেকে যেমন শোনায়, ঠিক তেমনি। প্রথমটা বুঝতে পারিনি। একটু পরেই বুঝলাম সমুদ্রের ডাক। রাত্রে উল্লেখযোগ্য কিছুই ঘটেনি। পশ্চিম দিক থেকে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া সারারাত শরীরে শীতল প্রলেপ লাগিয়ে বইছিল। পথের কষ্ট জানতেই পারিনি। অপেক্ষাকৃত একটু ফাঁকা জায়গায় এসে সবাই দাঁড়ালাম। রাত তখন চারটে বাজে। দেখলাম বাচ্চা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। সঙ্গী কনস্টেবলদের কাছে গিয়ে হাত-মুখ নেড়ে কি সব বলছে। আমাদের দোভাষী পঞ্চু দাস বললে–হুজুর, বাচ্চা বলছে, এইবার নামতে শুরু করলেই মরিলা গ্রামে গিয়ে পড়বে। ও বলছে, ওখানকার জমিদার বাড়িতে আপনাদের বসতে দিয়ে আমাদের সবাইকে নিয়ে গ্রামের আর সব বাড়িগুলো ঘিরে ফেলবে, যাতে সকালে ঘুম থেকে উঠে ওরা লবণ সরিয়ে ফেলতে না পারে।

যুক্তিপূর্ণ কথা, আমি ও মজিদ সাহেব ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিলাম। বাচ্চা ছুটে এসে পঞ্চুর কানে কানে কি যেন বললে। একটু ইতস্তত করে পঞ্চু বললে–বাচ্চা বলছে, এখন থেকে কেউ যেন কথাবার্তা না বলেন। খুব আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে চলতে হবে যাতে ওরা কিছু বুঝতে পেরে আগেই সাবধান হতে না পারে।

তাই হলো। মশাল নিভিয়ে চোরের মতো সন্তর্পণে পা ফেলে নিচে নামতে শুরু করলাম। প্রায় পনেরো মিনিট বাদে সমতলে পৌঁছলাম, বুঝলাম মরিআলায় এসে গিয়েছি। দক্ষিণ দিকে কিছুটা পথ গিয়ে বাচ্চার নির্দেশে মাথা নিচু করে এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ছোট্ট উঠোন, তিন দিকে তিনখানা ঘর গোলপাতায় ছাওয়া। চালাগুলো উঠোনে হুমড়ি খেয়ে পড়তে চাইছে। এ ঘরের বৈশিষ্ট্য দেখলাম টেকনাফের মতো ক্যাংঘর নয়, অনেকটা আমাদের বাঙলা দেশের চাষীদের ঘরের মতো। বাঁশ চিরে চঁচের বেড়া, মাটি আর গোবর দিয়ে লেপা। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় অবাক হয়ে চার দিক চাইছি। চোখে পড়লো উঠোনের পুব দিকের দাওয়ার উপর থেকে ডজনখানেক ছোটবড় মুরগী–কোঁকর-কোঁ, কোঁকর-কোঁ করে ছুটে ঘরের পিছনে বা কোনো আস্তাকুঁড়ে আশ্রয় নিলে। কাছেই কোথা থেকে একটা ছাগল ডেকে উঠলো। উঠোনে আমরা কয়েকটি প্রাণী প্রেতের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। পা টিপে টিপে বাচ্চা পশ্চিমদিকের ঘরের দাওয়ায় উঠে ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দিলো। প্রায় মিনিটখানেক টোকা দেওয়ার পর আস্তে আস্তে দরজা খুলে গেল, তারপর বাইরে বেরিয়ে এল লুঙ্গি পরা মিশমিশে কালো বিশালকায় এক মুসলমান। উঠোনে নেমে আমাদের দেখে প্রথমটা বেশ ভড়কে গিয়েছে বুঝলাম। বাচ্চা কানে কানে কি বলতেই নিমেষে সব জড়তা দূর হয়ে গেল। সসম্মানে সেলাম করে ঘরের ভিতর থেকে একটা নতুন মাদুর তাড়াতাড়ি এনে উঠোনে পেতে দিয়ে আমাদের বসতে বললে। কি করবো না করবো ভাবছি, মজিদ সাহেব বললেন–বন ধীরাজবাবু। কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে খুব আস্তে আস্তে বললাম–কিন্তু আমাদের যে কোন এক জমিদারবাড়ি বসতে দেবে ঠিক হয়েছিল। আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে পঞ্চু দাস তাড়াতাড়ি কাছে এসে চুপি চুপি বললে–হুজুর ইনিই হলেন মরিআলার জমিদার রমজান মিঞা। রমজান মিঞা সাদা দুধের মতো দু’পাটি ধবধবে দাতে এক গাল হেসে বললেন–বত। সুত চিলে দেওয়া পুতুলনাচের পুতুলের মতো ঝুপঝাঁপ করে বসে পড়লাম আমি আর মজিদ সাহেব। বেশ বুঝতে পারলাম, মাদুর পাতা না থাকলেও পথে-বিপথে বনেবাদাড়ে যেখানেই থাকতাম না কেন, এ খবর শুনবার পর ঐভাবে বসে পড়া ছাড়া আর আমাদের গত্যন্তর ছিল না। . .

বাচ্চা আমাদের কনস্টেবলদের নিয়ে লবণ-চোর আসামীদের বাড়ি ঘেরাও করতে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।

দেখি জমিদার রমজান মিঞা তেমনি দু’পাটি দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছেন। কি বলি? বললাম–বসুন। প্রবলভাবে মাথা নাড়লেন রমজান মিঞা। তারপর বললেন–ছা, ছা খাইবেন

মজিদ সাহেবের দিকে তাকালাম, প্রথমটা ঠিক বুঝতে পারেননি। একটু পরেই সোল্লাসে বলে উঠলেন–চা? একটু পেলে মন্দ হয় না। আর কোনো কথা না বলে ঐভাবে দন্ত বিকশিত করেই পুবদিকের ঘরে ঢুকে গেলেন জমিদার সাহেব।

জুতোমোজা খুলে ফোস্কা-ওঠা পায়ের তলায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম–সারা পথ আসতে আসতে অনেক গবেষণার পর কি সিদ্ধান্ত করেছি জানেন? এ গাঁয়ের নাম মরিআল নয়।

জুতো খুলছিলেন মজিদ সাহেব। এক পাটি খুলে হাতে নিয়ে আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলেন।

বললাম–মরি আল্লা! কোন সে সুদূর অতীতে দু’জন ধর্মপ্রাণ মুসলমান এই চিটাগং হিলস্-এর গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন। অনাহারে, অনিদ্রায় পরমায়ুর জোরে বাঘ, হাতি, সাপ এদের অব্যর্থ হাত থেকে রক্ষা পেয়ে শুধু প্রাণটুকু নিয়ে এই জনমানবহীন সমুদ্রতীরে সমতল বালুরাশির উপর এসে পড়েন এবং কিছুক্ষণ বাদেই একজন মারা যান। মরবার আগে ক্ষোভে, অভিমানে আকাশে হাত তুলে শুধু দুটি কথা বলেন–মরি আল্লা। অর্থাৎ এতোগুলো বিপদ-আপদ থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদস্থানে পৌঁছে দিয়ে তুমি আমার প্রাণটুকু নিলে নিষ্ঠুর খোদা। অপর সঙ্গীটির অবস্থাও শোচনীয়। সে শুধু বুঝলে মরবার আগে তার দোন্ত আল্লার নাম নিয়ে বেহেস্তে চলে গেল। তারপর একটি দুটি করে পরমায়ুওলা মুসলমান পথ ভুলে এখানে এসে বাস করতে শুরু করে দিলো। মৃত দোতের স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখবার জন্য আগের লোকটি সকলকে বলে দিলে–এ গাঁয়ের নাম মরি আল্লা রাখতে। অনেকের পছন্দ হলো না, শেষ পর্যন্ত দু’দিক বজায় রেখে নাম রাখা হলো–মরিআলা। এই হলো মরিআলার সংক্ষিপ্ত ও সঠিক ইতিহাস। দেখি, জুতো হাতে মজিদ সাহেব তখনও হাঁ করে বসে আছেন। হেসে ফেললাম, বললাম–পথে যদি সুধীর আর মুখার্জির বাঙলোয় আশ্রয় না পেতাম, আমরাও হয় তো এতোক্ষণ এই বালুচরে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতাম। তবে আকাশের দিকে চেয়ে ইষ্টদেবের নাম নিতাম কিনা বলতে পারি না।

হো হো করে হেসে উঠলেন মজিদ সাহেব। বললেন–আপনি তো অদ্ভুত লোক মশাই, এত কষ্টের মধ্যেও… থেমে গেলেন মজিদ সাহেব। দেখলাম কলাইওঠা দুটো স্টীলের বাটিতে কালো ঝোলের মতো কি এক তরল পদার্থ নিয়ে রমজান মিঞা হাসিমুখে সামনে এসে দঁাড়ালেন। বাটি দুটো হাত থেকে নিয়ে ভদ্রতার খাতিরে বললাম,–আপনার কই? যেন গালে চড় মারলেন মিঞা সাহেব–আঁই তো ন খাই!

আমরা চা খেলাম। পুবদিকের ঘরের ভিতর থেকে একটা বাচ্চা ছেলে না মেয়ে কেঁদে উঠলো–হয় তো জমিদারবাবুকে ডাকবার ঘণ্টা। মিঞা সাহেব তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেলেন।

সূর্য তখন ভালো করে না উঠলেও বেশ ফর্সা হয়ে গিয়েছে। চারদিক দেখে নিয়ে গলা খাটো করে বললেন মজিদ সাহেব–ও ধীরাজবাবু! জমিদার সাহেবের যা নমুনা দেখলাম, তাতে মনে হয় প্রজাদের ঘর-বাড়িই নেই। তারা বোধ হয় দিনে গাছতলায়, আর রাতে গাছের ডালে বাস করে।

উত্তরে কি একটা বলতে যাচ্ছিলাম, দেখি আমার অনুমানই ঠিক। দুটো চায়ের ডিশে গরম অমলেট নিয়ে হাসিমুখে আসছেন জমিদার সাহেব, হাত থেকে নিয়ে খেতে শুরু করে দিলাম, এবার আর ভদ্রতা করে ওঁকেও খেতে বললাম না। খাওয়া শেষ করে ভালো করে চারদিক তাকালাম। দেখলাম উঠোনটা ছোট হলেও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, গোবর দিয়ে নিকোনো। তিনদিকে মাঝারি তিনখানা ঘর, উঁচু মাটির দাওয়া। পাওয়ায় বসলে বাইরের কিছু আর নজরে পড়ে না–উপর থেকে চালাটা প্রায় উঠোন পর্যন্ত নামানো। মজিদ সাহেবকে বললাম–চালাগুলো অতো নিচু করে নামিয়ে দেওয়ার মানে কি বলতে পারেন?

মজিদ সাহেব বললেন–হয় তো ওর দ্বারা জমিদারবাড়ির আবু খানিকটা রক্ষা হয়। কথাটায় যুক্তি আছে বলে মনে হলো।

বেলা বেড়ে ওঠে–সঙ্গে সঙ্গে সূর্যের তাপও বাড়ে। আমাদের সঙ্গীদের বা বিভীষণ-বাচ্চার তবুও দেখা নেই। ওরা যেন এই বালুচরের চোরাবালির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে, আর ফিরবে না।

আরও আধ ঘণ্টা বাদে পঞ্চু দাস ও আর সব কনস্টেবলরা ফিরে এল। পঞ্চু জানালে লবণ কোথাও পাওয়া গেল না। ঘুম থেকে উঠবার আগেই বাচ্চার নির্দেশ মতো বাড়িগুলো ঘেরাও করা হয়েছিল; কিন্তু ওরা বোধ হয় আগেই খবর পেয়ে মাল সরিয়ে ফেলেছে।

সব শুনে গুম হয়ে রইলেন মজিদ সাহেব। তারপর বললেন–বাচ্চা কোথায়, সেই ঘর-শত্রু বিভীষণ-বাচ্চা?

পঞ্চু বললে–বাচ্চা খুব ঘাবড়ে গিয়েছে। আরও দু’তিনটে বাড়িতে খবর নিয়ে একটু বাদেই আসছে। দক্ষিণ দিক থেকে ছোট ছেলেমেয়ের হাসি-হল্লার আওয়াজ ভেসে এল। পঞ্চু এগিয়ে গিয়ে দেখে এসে বললে–বাচ্চা আসছে হুজুর। মজিদ সাহেব ও আমি অবাক হয়ে গেলাম। ভাবলাম, বাচ্চা আসছে তা ওরকম প্রোসেশন করে আসছে কেন? একটু পরেই বুঝলাম। দেখি একটি বুড়ীকে প্রায় চ্যাংদোলা করে সোল্লাসে আমাদের কাছে এনে নামিয়ে দিলে বাচ্চা। বুকের উপর দু’হাত দিয়ে একটা মাঝারি মাটির হাঁড়ি জড়িয়ে ধরে আছে বুড়ী, তাতে রয়েছে খুব বেশি হলেও সের চারেক লবণ। বাচ্চা ও বুড়ীর পিছনে এসে দাঁড়ালো প্রায় বারো-চোদ্দটি ছোট ছেলেমেয়ে। মনে হলে মজা দেখতে ‘এসেছে। চেহারা দেখে বুড়ীর বয়স ধরবার উপায় নেই। সারা মুখখানা কুঁচকে গিয়েছে, সেই কুঞ্চিত অসংখ্য রেখায় ধরা পড়ে তার বেদনা-বিধ্বস্ত জীবনের ইতিহাস। ঐ রেখা আর কোঁচকানো চামড়ার মধ্যে ছোট্ট চোখ দুটি হারিয়ে গিয়েছে। মাথার চুল শাদা দুধের মতে, ছোট করে ছাঁটা। পরনে শতছিন্ন ময়লা আধখানা কাপড় বুড়ীর লজ্জা নিবারণের বৃথা চেষ্টা করে করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। ফোকলা দাতে হাউ হাউ করে বুড়ী কি যে বলে গেল, এক বর্ণও বুঝলাম না। পিছনে হুজুগপ্রিয় ছেলের দল হাততালি দিয়ে হেসে উঠলো। ক্রুদ্ধ চোখে মজিদ সাহেব তাকাতেই পঞ্চ ও তিন চারটে কনস্টেবল তাদের ছত্রভঙ্গ করে দূরে সরিয়ে দিলে। দেখলাম, রাগে মজিদ সাহেবের চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। পঞ্চুকে বললেন–বুড়ী কি বলতে চাইছে পঞ্চ, আর বাচ্চা ব্যাটাচ্ছলে একেই বা ধরে আনলে কেন?

পঞ্চু বললে–বুড়ী বলছে হুজুর, আজ ক’দিন হলো ওকে ওর নাতি বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, আর বলে দিয়েছে সে আর বুড়ীকে খেতে দিতে পারবে না। দু’দিন অনাহারে পথে পথে কাটায় বুড়ী, তারপর এক প্রতিবেশীর কথায় সমুদ্র থেকে জল নিয়ে মাটির হাঁড়িতে করে জ্বাল দিয়ে লবণ তৈরি করে। পাড়ায় পাড়ায় এক পয়সা আধ পয়সা বিক্রি করে করে তা দিয়ে কোনো মতে একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। আজও নিয়মমতো লবণের হাঁড়ি নিয়ে বুড়ী পাড়ায় বিক্রি করতে যাবে, এমন সময় হঠাৎ বাচ্চা গিয়ে ওকে ধরে নিয়ে এসেছে।

রুদ্ধ আক্রোশে ফুলতে লাগলেন মজিদ সাহেব।

বললাম–বুড়ীকে জিজ্ঞাসা করো তত পথু, ওর বয়েস কতো? পঞ্চুর প্রশ্নের উত্তরে হাউ হাউ করে কী যে বললে বুড়ী বুঝতে পারলাম না।

পঞ্চু বললে–হুজুর, বুড়ী বলছে বয়েসের হিসেব ওর নেই, তবে আন্দাজ ছ’কুড়ির কাছাকাছি হবে।

–ওর নাতির বয়স কতো?

পঞ্চু বুড়ীকে জিজ্ঞাসা করে বললে–খুব ছোটবেলা থেকে মা-হারা এই নাতিটিকে কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছে বুড়ী। এর বয়েস বুড়ীর ঠিক মনে আছে, তিন কুড়ি দুই।

বুড়ীর মুখের দিকে চাইলাম, মনে হলো যেন নাতির প্রসঙ্গে বুড়ীর কোঁচকানো মুখখানা ক্ষণিকের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। হয় তত বা আমার মনেরই ভুল।

হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন মজিদ সাহেবাচ্চা।

নিমেষে চার পাশের সব গুঞ্জন থেমে গেল। তততক্ষণে সকলের পিছনে আত্মগোপন করে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা।

–সামনে আয় শয়তানের বাচ্চা। আজ তোকে কুকুরের মতো গুলী করে মারবে। তাতে যদি আমার ফাঁসিও হয়, সেও ভি আচ্ছ। রাগে কাঁপতে কাঁপতে রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়ালেন মজিদ সাহেব।

তাড়াতাড়ি উঠে রাইফেলসুদ্ধ হাতখানা চেপে ধরে বললাম কী ছেলেমানুষী করছেন মজিদ সাহেব, বসুন।

–আপনি একে ছেলেমানুষী বলছেন ধীরাজবাবু? এই চার সের লবণ ধরবার জন্য ব্যাটা আজ চারদিন ধরে কী কষ্টটাই দিয়েছে বলুন তো? আর আসামী হলে দেড় শ’ বছরের এক অথর্ব বুড়ী। আমায় ছেড়ে দিন ধীরাজবাবু। বনের বাঘ-ভালুক-সাপ মারলে গভর্নমেন্ট পুরস্কার দেয়, আর এ ব্যাটাকে মারলে হবে আমার শাস্তি? অদ্ভুত আইন। তাই হোক–তবু গাঁয়ের গরীব লোকগুলো এই শয়তান বিভীষণের হাত থেকে বাঁচবে।

এরকম রাগতে কোনোদিন দেখিনি মজিদ সাহেবকে। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে ঠাণ্ডা করে বসালাম মাদুরের উপর।

রোদ্দুরে ছোট্ট উঠোনটা ভরে গিয়েছিল। রমজান মিঞা আর পঞ্চু এসে মাদুরটা তুলে উত্তরের ঘরের দাওয়ায় পেতে দিলে। দাওয়ায় উঠবার আগে মজিদ সাহেব বুড়ীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন, তারপর মনিব্যাগ থেকে একটা রূপোর টাকা বার করে বুড়ীর হাতে দিয়ে বললেন–বুড়ী-মা, আমিই দারোগা সাহেব। আমি তোমায় বলে যাচ্ছি, যতদিন তুমি বাঁচবে, সমুদ্দরের জল ফুটিয়ে লবণ তৈরি করে বিক্রি করবে। টাকাটা হাতে নিয়ে দেখি বুড়ী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মজিদ সাহেব বললেন–পঞ্চু, আমার কথাগুলো বুড়ীকে বুঝিয়ে দাও, আর লবণের হাঁড়ি নিয়ে ওকে বাড়ি যেতে বলে। পণুর কথা শুনে বুড়ীর রেখাবহুল কুঞ্চিত মুখে মুহূর্তের জন্য দুটো চোখের আভাস পেলাম। এক ফোঁটা জলও যেন কুৎসিত মুখের উপর দিয়ে গড়িয়ে উঠোনের ধুলোর সঙ্গে মিশে গেল। বোধ হয় মনে মনে মজিদ সাহেবের দীর্ঘজীবন কামনা করলে বুড়ী, তারপর মাটি থেকে লবণের হাঁড়িটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল। মজিদ সাহেবের ভিতরকার মানুষটার পরিচয় পেয়ে শ্রদ্ধায় রুদ্ধবাক হয়ে শুধু চেয়েই রইলাম। বেলা বাড়তে লাগলো।

***

দুপুরে জমিদার রমজান মিঞা আমাদের খাওয়ালেন মোটা চালের ভাত আর খাশির মাংস। চমৎকার লাগলো। খাওয়া দাওয়া সেরে দাওয়ায় মাদুরের উপর হাত-বালিস করে দু’জনে একটু বিশ্রামের আয়োজন করলাম। একটু পরেই শুনি মজিদ সাহেবের নাক ডাকছে। কি জানি কেন আমার ঘুম এল না, রাজ্যের চিন্তা দল বেঁধে আমার চারপাশে এসে ভিড় করে দাঁড়ালো। সব ছাপিয়ে মজিদ সাহেবের কথাটাই বার বার মনের দুয়ারে ঘা দিতে লাগলো। ছাত্র হিসেবে ব্রিলিয়েন্ট মেধাবী ছেলে, পড়াশুনা করলে অনায়াসে একদিন বিলেত থেকে আই.সি.এস. বা ঐ ধরনের হোমরা-চোমরা হয়ে এদেশে মোটা চাকরি নিয়ে পায়ের উপর পা দিয়ে বাকি জীবনটা তোফা কাটিয়ে দিতে পারতেন, তা না করে দাদার বিলেতের খরচ যোগাবার জন্যে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে এই সুদূর জঙ্গলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাকরি নিয়ে এসেছেন। কে জানে হয় তো ঐ দাদাই বিলেত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে সবার আগে মজিদ সাহেবের সঙ্গেই সম্পর্ক ছিন্ন করে দেবেন। অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। হাত ভেরে গিয়েছিল। হাত বদলে পাশ ফিরে শোবার উদ্যোগ করছি। সমুদ্রের ডাক ছাপিয়ে কানে ভেসে এল একটা হৈ-হল্লার সঙ্গে ছেলেপিলের কান্নার আওয়াজ। দাওয়া থেকে উঠে উঠোনে নেমে দাঁড়ালাম। দেখলাম শতছিন্ন ময়লা তেল কুটকুটে একখানা লুঙ্গি পরে বছর পঁয়ত্রিশের একটি রোগ। ফর্সা মুসলমান বাঁক কাঁধে এইদিকে আসছে–আর তাকে ঘিরে বিজয় গর্বে হল্লা করতে করতে আসছে আমাদের কনস্টেবলের দল ও বাচ্চা। সবার পিছনে বুকফাটা কান্না কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে আসছে দু’বছর থেকে তেরো-চৌদ্দ বছরের উলঙ্গ ও অর্ধ-উলঙ্গ এক পাল ছেলে মেয়ে। মজিদ সাহেবও ইতিমধ্যে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বক উঠোনে নামাতেই দেখলাম দু ঝুড়ি লবণ শালপাতা দিয়ে ঢাকা। রমজান মিঞা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন দেখে মজিদ সাহেব তাঁকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। ছেলেমেয়েগুলো ততোক্ষণে লোকটাকে ঘিরে এক সঙ্গে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। বাচ্চা কষে এক ধমক দিতেই দেখি চুপ হয়ে গিয়ে নিঃশব্দে ফুলে ফুলে কাঁদছে।

রমজান মিঞাকে মজিদ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন–ব্যাপার কি বলুন তো? এ লোকটা কে আর এ ছেলেমেয়েগুলোই বা ওকে ঘিরে কাঁদছে কেন?

রমজান মিঞার ভাষা সব বুঝতে না পারলেও আসল ব্যাপারটা বুঝতে কষ্ট হলো না। লোকটার নাম সিমুরালী, আলী বলে সবাই ডাকে। একপাল ছেলেমেয়ে, বড়ো গরীব, তার উপর গেল বছর স্ত্রী মারা গিয়েছে। সমুদ্রের জল দিয়ে লবণ তৈরি করে সপ্তাহে একদিন বাঁকে করে নীলার হাটে বিক্রি করে যা পায় তা দিয়ে সবার এক বেলাও ভালো করে খাওয়া জোটে না। ভয়ে বিবর্ণ মুখে আমাদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে আলী। রোগা ডিগডিগে হাড়-বের-করা বুকের উপর পাতলা ফিনফিনে চামড়ার আবরণ, তার নিচে প্রাণটা কোনো মতে ধুক ধুক করে শুধু জানিয়ে দিচ্ছে যে, ও বেঁচে আছে। মেয়েটি বড়, কিন্তু অনাহারে ও অযত্নে আর বাড়তে পায়নি। বয়েস পনেরো হলেও ও যেন দশের গণ্ডিতে আটকে আছে। মাথার ঈষৎ সোনালি চুল তেলের অভাবে রুক্ষ-বিবর্ণ; হাত দিয়ে চাপড়ালে ধুলো ওড়ে। পরনে অসংখ্য তালি দেওয়া ময়লা আবরণ। বোধ হয় ওর মায়ের পুরানো শাড়ি। ওর মধ্যে দুটি ছেলেকে দেখলাম ছেঁড়া ময়লা হাতখানেক লম্বা পরিত্যক্ত লুঙ্গির একটা অংশ লেংটির মতো করে পরা। দেখলেই মনে হয় কিছু না পরলেই যেন ছিল ভালো। পরের গুলোর আর কোনোই বালাই নেই, সব উলঙ্গ। কোনো কথা না বলে মজিদ সাহেব এক পা দু পা করে পশ্চিমে সমুদ্রের ধারে চললেন। একটু অবাক হয়েই জোরে পা চালিয়ে সঙ্গ নিলাম।

আমার দিকে না চেয়েই. মজিদ সাহেব বললেন–এখন কি করি বলুন তত ধীরাজবাবু! বুড়ীকে ছেড়ে দিয়েছিলাম কেন না চার সের লবণ আবগারি আইনে পড়ে না। কিন্তু এই লোকটার দু’ ঝুড়ি লবণ আধ মণের বেশি হবে। যদি ছেড়ে দিই ওরা সবাই ফিরে গিয়ে ওপরওলাকে পাঁচখানা করে লাগাৰে আমার নামে। যদি কেস টেক-আপ করি লবণ সমেত আলীকে নিয়ে যেতে হবে নীলায়। তার পর কোর্টে কেস উঠলে অন্ততঃ দশ টাকা ফাইন ওর হবেই, না দিতে পারলে মাসখানেক জেল।

সত্যিই জটিল সমস্যা। কি জবাব দেবো, চুপ করে রইলাম।

মজিদ সাহেব বললেন–দশটা আধলা দেবার ক্ষমতা যার নেই সে দেবে দশ টাকা ফাইন আর জেল হলে তো কাচ্চা বাচ্চাগুলো খেয়েই মরবে? না, কেন যে মরতে এ চাকরি নিয়েছিলাম।

সমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়ালাম। শাদা ফেনায় ভর্তি উন্মত্ত ঢেউগুলোর মাতামাতি দেখছি, কানে ভেসে আসছে শুধু সাগরের একঘেয়ে নিষ্ফল গর্জন। আর কিছুই শোনা যায় না। কতোক্ষণ একভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ মজিদ সাহেবের দিকে নজর পড়লো–তার চোখে জল। নোনা ঢেউ-এর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে এমনিতেই চোখে জল আসে, তাই? না –মজিদ সাহেবের কাছে গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। একইভাবে সমুদ্রের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বললেন–খোদার দেওয়া সমুদ্র, তার জল জ্বাল দিয়ে নুন তৈরি করা মানুষের আইনে অপরাধ। আর সেই অপরাধের শাস্তি দেবার জন্য চাকরি নিয়েছি আমরা! ধুত্তোরি; এ চাকরি আমি ছেড়ে দেবো ধীরাজবাবু।

বললাম–দাদার বিলেতের খরচ?

–তাও ভেবে দেখেছি আমি, কলকাতায় গিয়ে দু’-একটা টিউশনি আর অন্য যে কোনো চাকরির চেষ্টা করবে। পাই ভালোই, না পাই রাবেয়ার পড়া বন্ধ করে দেবো। কী হবে মেয়েছেলের অতো লেখাপড়া শিখে!

এর আর কোনো উত্তর নেই। চুপ করে রইলাম।

মজিদ সাহেব বললেন–তা ছাড়া অনেক ভেবে এই বুঝলাম যে, আমি এ চাকরির মোটেই যোগ্য নই, একেবারে মিস ফিট।

[১৯২-১৯৫ পাতা মিসিং]

ভাই–ধিকি নাকে নাকা ধিন। তোমার ঠেকার উপরেই নির্ভর করছে আমায় গানের সব মজাটা। গাইলাম–

ঘরকাম সুন্দরী লো–
চরখার বাজনা শুইন্যা যাইলে যাই।
[ অ্যাঁ হুঁ অ্যাঁ, অ্যাঁ হুঁ অ্যাঁ, অ্যাঁ হুঁ অ্যাঁ (তেহাই)।]

গান থামিয়ে বললাম–মাপ করে ভাই একটু রসভঙ্গ করছি। গানটার মজা হলো এই, যদি ঠিক তালে লয়ে গাওয়া যায় তাহলে চোখ বুঝে শুনলে মনে হবে একটা লোক ঘ্যাং ঘ্যাং ঘ্যাং একটানা চরকা ঘুরিয়ে সুতো কাটছে। অন্ততঃ আমার তাই মনে হয়েছিল। লেকচার থামিয়ে আবার গান শুরু করলাম

ও ভাই আলোচাল আর কাঁচকলা
চরখার গোড়ে থুইয়া
মাগী একলা একলা বানায় কাপড়
আমার দিকে চাইয়া।

নাগরালি কুম কুম
বক কুমকুম কুম
না দই পুড়া দই
ভিজা দই তামুক খাই।
ঘরকাম সুন্দরী লো–
চরখার বাজনা শুইন্যা যাইলে যাই।
[ অ্যাঁ হুঁ অ্যাঁ ইত্যাদি ]

ও ভাই নারাণগঞ্জের সুতা আমার
মাণিকগঞ্জের পাটি
চরখার দৌলতে আমার
দুয়ারে বান্‌ধা হাতি।

নাগরালি কুমকুম
বক কুম কুম কুম
সুনা দই পুড়া দই
ভিজা দই তামুক খাই!
ঘর কাম সুন্দরী লো-ও-ও

গান শেষ করে আমি থামতে চাই ওরা থামতে দেয় না, বলে আবার গাও। দু’তিনবার গেয়ে থেমে হাঁপাতে লাগলাম। আমি যেন আজ ‘বন গাঁয়ে শেয়াল রাজা। সবার প্রশংসার জয়মাল্য আমি ছাড়া নেবার আর কেউ নেই। এরপর আর দু’ তিনখানা পুরোনো দেহতত্ত্ব গাইবার পর সবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও সভা ভঙ্গ করতে হলো। তা না হলে ভোর চারটেয় উঠে নীলায় রওনা হওয়া সম্ভব হবে না।

স্মরণীয় কয়েকটি জিনিসের মধ্যে মুখার্জির বাংলোর এ সন্ধ্যাটির কথা কোনো দিনই ভুলতে পারবো না।

.

ভোর পাঁচটা থেকে অবিশ্রাম হেঁটে মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য সুধীরের বাংলোয় থেমে একটু চা খেয়ে নিয়ে নীলার আবগারি আপিসে যখন পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গিয়েছে। শুনলাম, টেকনাফ যাবার শেষ স্টীমার নীল থেকে ছাড়ে ঠিক আটটায়। মজিদ সাহেব রাত্তিরটা থেকে বিশ্রাম করে ভোরের স্টীমারে যাবার জন্যে অনেক পীড়াপীড়ি করলেন, রাজী হলাম না। সামান্য কিছু খেয়ে নিয়ে যাত্রার জন্য তৈরি হতে লাগলাম। পাশের বারান্দায় মজিদ সাহেবের গলা পেলাম।

–এই দশটা টাকা রেখে দাও, কোর্টে ফাইন হলে এটা দিয়ে দিও।

কৌতূহলী হয়ে উঠে পাশের জানলায় গিয়ে দেখি বারান্দার একটা অন্ধকার কোণে দাঁড়িয়ে আছেন মজিদ সাহেব ও লবণচোর আলী। আলী আস্তে আস্তে কি বললে শুনতে পেলাম না। দেখলাম, পকেট থেকে খুচরো পাঁচটা টাকা বের করে আলীর হাতে দিয়ে মজিদ সাহেব বললেন–বাড়ি যাবার সময় এ থেকে তোমার বড়মেয়ের একখানা শাড়ি কিনবে আর ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু খেলনা। বাকি যা থাকবে তা দিয়ে কিছু খাবার কিনে নিয়ে যেও।

অন্ধকারে কোনো কথা না বলে আলী হঠাৎ মজিদ সাহেবের পা দুটো জড়িয়ে ধরে মাটিতে মুখ গুজড়ে পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো; আস্তে আস্তে তাকে তুলে দাঁড় করালেন মজিদ সাহেব তারপর কাছে টেনে এনে বললেন–আমি হুকুম দিয়ে যাচ্ছি আলী, বাড়ি গিয়ে যতো খুশি লবণ তৈরি করবি আর নীলার হাটে এনে বেচবি।

এবার সত্যিই বুঝতে পারলাম মজিদ সাহেব ফিরে গিয়েই চাকরি ছেড়ে দেবেন। আলীকে মরিআলায় ছেড়ে দিয়ে এলে সরকারের কাছে নেমকহারামি হতো, তাই আইনের মর্যাদা রাখতে বামাল সমেত আসামী সঙ্গে নিয়ে এসে তার জরিমানার টাকা মায় উপরি কিছু ছেলেমেয়ের জন্য দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলেন। অভিভূত হয়ে গেলাম। ভাবলাম, এরকম লোক এখনো দু’-একটি সংসারে আছে বলেই বোধ হয় চন্দ্র সূর্য ওঠে।

স্টীমারের বাঁশি বেজে উঠলো। আবগারি আপিসের পাশেই স্টীমারঘাট। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি অন্ধকার বারান্দায় একা চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছেন মজিদ সাহেব। পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে শুধু বললাম–চলি।

একটু যেন চমকে উঠলেন মজিদ সাহেব। তারপর বললেন উঁহু, এখান থেকে বিদায় নেওয়া চলবে না। চলুন স্টীমারে তুলে দিয়ে আসি।

অনেক আপত্তি করলাম, বললাম–”এই তো পাশেই, কেন আর কষ্ট করবেন। পোশাক ছেড়ে একটু বিশ্রাম করুন। কোনো ফল হলো না। স্টীমারঘাটে এসে দেখি সময় হয়ে গিয়েছে। আড়ম্বরহীন বিদায়ের পালা শেষ হতে দেরি হলো না। শুধু হাত দুটো ধরে একটুখানি সময় মজিদ সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে তাড়াতাড়ি কাঠের চওড়া তক্তার উপর দিয়ে স্টীমারে উঠলাম। আমিই শেষ প্যাসেঞ্জার, স্টীমার ছেড়ে দিলে। লোহার রেলিংটা ধরে তীরের দিকে চেয়ে দেখি, তখনও মজিদ সাহেব বাড়িয়ে আছেন। আস্তে আস্তে ডান হাতখানা উপরে তুলে নাড়াতে লাগলাম, মনে মনে বললাম–বিদায় বন্ধু! জীবনের অনেক কিছুই হয় তত একদিন ভুলে যাবে, তোমায় কিন্তু কোনো দিনই ভুলবেন না।

দেখি পকেট থেকে সাদা ধবধবে একখানা রুমাল বার করলেন মজিদ সাহেব, ভাবলাম, ঐটে দিয়েই বোধ হয় শেষ অভিনন্দন জানাবেন–দেখলাম, হাত উপরে উঠলো না, মাঝপথে থেমে গিয়েছে। রুমাল দিয়ে মজিদ সাহেব চোখ মুছলেন।

নাফ নদীর মাঝখান দিয়ে স্টীমার তখন বেশ স্পীডে চলেছে।

***

আবার টেকনাফ। স্টীমার থেকে নেমে থানার পথে আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে চলেছি, একটু এগিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। আলো, আলোর সমারোহ। কে যেন ছোট্ট টেকনাফকে আলোর জোয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। কানে ভেসে এল পঁচিশ-ত্রিশটি বিভিন্ন যন্ত্রের সম্মিলিত মধুর ঐকতানের আওয়াজ। সবগুলোই আসছে বাজারের দিক থেকে। বুকের স্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠলো। তবে কি আমার আসতে দেরি হয়েছে বলে অন্য কারও সঙ্গে মাথিনের–আর ভাবতে পারলাম না। একটু একটু করে এগোতে লাগলাম। আমার অনুমানই ঠিক। মাথিনদের বাড়ির পিছনে নিবারণবাবুর দোকানের সামনের খালি জায়গাটায় যেখানে হাট বসে সেখানে বিচিত্র পোশাক পরে টেকনাফের সমস্ত বাসিন্দারা জড়ো হয়েছে। সবার পিছনে দাঁড়িয়ে মাথার টুপিটা খুলে হাতে নিয়ে চারদিক চাইতে লাগলাম। শুধু মাথা আর মাথা, এতোগুলি মানুষ এক সঙ্গে, এ দৃশ্য টেকনাফে এর আগে কোনোদিন দেখিনি। মনে হলো শুধু টেকনাফ নয়, কাছে দূরের অনেক গ্রাম থেকেও লোক এসেছে। হাটের চারদিকে বাঁশ পুতে পাঞ্চ লাইটের আলো ঝুলিয়ে দিয়েছে। নিচে মাটিতে অসংখ্য গ্যাসের আলো। অতি কষ্টে একটু একটু করে ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে অপরিচিত মুখের উপর চোখ বোলাতে বোলাতে মাঝখানে এসে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। দেখলাম ঠিক মাঝখানে হাতলওলা দুখানা চেয়ারে পা তুলে বসে দিব্যি আরামে পান চিবুচ্ছেন থানার মহেন্দ্রবাবু আর যতীনবাবু, পিছনে হাতখানেক দূরে মাটিতে একখানা পানের রেকাবি হাতে বকের মতো গলা বাড়িয়ে উবু হয়ে বসে আছেন দোকানি নিবারণবাবু। হিজ মাস্টারস ভয়েস-এর বহু প্রসিদ্ধ ট্রেডমার্ক ছবিটার কথা মনে পড়ে গেল। কিছু দূরে পশ্চিমদিকে একখানা সরু কাঠের বেঞ্চির উপর বসে রয়েছে থানার কনস্টেবলের দল। শুধু অনেক খুঁজেও হরকি আর রমেশকে দেখতে পেলাম না কোথাও। কিন্তু কিসের এ সমারোহ? কার জন্য এ উৎসব আয়োজন? কাকেই বা জিজ্ঞাসা করি! হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে বাজারের একটি মুখচেনা বাঙালী দোকানদারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার কাছে ব্যাপারটা শুনে খানিকটা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। প্রতি বছর চৈত্র-সংক্রান্তির পর হাটে এই উৎসবটি হয়। এর সমস্ত ব্যয়ভার দোকানদাররাই বহন করে। এ উৎসবের প্রধান আকর্ষণ হলো বর্মীদের বিখ্যাত পোয়ে নাচ। এ নৃত্যের নাম খ্যাতি শোনা ছিল, দেখার সৌভাগ্য এতোদিন হয়ে ওঠেনি। অকারণ মনটা খানিক খুশি হয়ে উঠলো। মাথিনদের দোতলার দেড় হাত জানলাটার দিকে উৎসুক হয়ে তাকালাম, বন্ধ জানলায় সে দৃষ্টি ঘ খেয়ে ফিরে এল। হতাশ দৃষ্টিতে চারদিকে চাইতে চাইতে দেখি, উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা বাঁশ হেলান দিয়ে উৎসব মঞ্চের দিকে পিছন ফিরে নির্লিপ্ত সমাহিতের মধ্যে হাত দুটো বুকের উপর রেখে এক বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে কনস্টেবল সতীশ। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখি, কাছেই অপেক্ষাকৃত অন্ধকারে বিচিত্র সাজে বসে রয়েছে অগুনতি মগী মেয়ের দল। সতীশের ওখানে আঁড়ানোর অর্থ খানিকটা বুঝতে পারলাম। পাগলের মতো বিস্ফারিত ব্যাকুল চোখে ঐ অন্ধকার ভেদ করে মাথিনকে খুজতে লাগলাম। ওরই মধ্যে কোথাও বসে আছে হয় তো, এখনই দেখতে পাবো। সতীশকে ওভাবে এখানে দাঁড়াতে দেখে মাথিনের উপস্থিতি সম্বন্ধে সন্দেহের আর অবকাশ রইলো না। ঐ না কিছুদূরে অন্ধকারে কয়েকটি মেয়ে বসে রয়েছে? ওর মধ্যে ঠিক মাথিনের মতো-অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছি না, দু’হাত দিয়ে ভিড় ঠেলে এগোতে যাবে, হঠাৎ ড্রামের বিকট আওয়াজের সঙ্গে অনেকগুলো যন্ত্র একসঙ্গে বেজে উঠলো। আর এক পা-ও এগোতে পারলাম না। চেয়ে দেখি, বাঁশ চিরে বেড়া দিয়ে খানিকটা জায়গা গোল করে ঘেরা, বেড়ার সঙ্গে বাঁধা রয়েছে খত্তাল থেকে শুরু করে অসংখ্য অজানা বাদ্যযন্ত্র। বেড়ার মাঝখানে ছোট নিচু একটা বেতের মোড়ায় বসে রয়েছে ঝকঝকে পোশাক পরা একটি মগ বা বার্মিজ যুবক। মাটিতে ওর চারপাশে রাখা আছে একটা বড় ড্রামের সঙ্গে ঐ জাতীয় আরও পাঁচ ছ’টি তবলা বা খোলের মতো চামড়ার বাদ্যযন্ত্র। দু’খানা কাঠি হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ও একাই বাজাচ্ছে ঐ বিভিন্ন যন্ত্রগুলো। প্রথমে আস্তে আস্তে, পরে যখন তাল লয় বেড়ে যায় তখন হাত দুটো আর দেখা যায় না। শুধু মনে হয়, ঐ বেড়ার মধ্যে একটা লোক চরকির মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। চোখ বুজে কাছে দাঁড়িয়ে বা দূর থেকে শুনলে মনে হবে–অনেকগুলো লোক মিলে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে একটি মনোরম ঐকতান বাজাচ্ছে। চোখে দেখেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না কিন্তু বিস্ময়কর সত্যি।

কিছুক্ষণ বাদে ঐকতান বাজনা থামলো। ভিড়ের মধ্যে থেকে একটি মগ উঠে দাঁড়িয়ে ওদেরই ভাষায় খানিকক্ষণ কি বলে গেল, এক বর্ণও বুঝলাম না। বক্তৃতা শেষে সবাই সোরগোল করে হাততালি দিয়ে উঠলো। পাশের দোকানদার ছেলেটির শরণাপন্ন হলাম। শুনলাম, এবার ওদের বিখ্যাত পোয়ে নাচ হবে, খুব শক্ত নাচ। একটি লোক কলার্টের বেড়ার পাশে একটি শতরঞ্চি পেতে তার উপর ধপধপে শাদা একটা চাদর বিছিয়ে দিলো। আর একটি লোক হাত দুই উঁচু একটা গোল কাঠের টুল এনে ঐ চাদরের উপর ঠিক মাঝখানে রেখে দিলো। আবার ঐকতান শুরু হলো। সবিস্ময়ে দেখলাম, বেড়ার পাশ থেকে অপরূপ সাজে সজ্জিত একটি যুবতী ধীরে ধীরে এসে চাদরের উপর দাঁড়ালো। মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী, বোধ হয় বার্মিজই হবে। মাথায় ধামার মতো প্রকাণ্ড খোঁপা, তাতে রঙ-বেরঙের ফুল গোঁজা। গলায়, বাহুতে হাতে ফুলের অলঙ্কার। মেয়েটির পরনে সাদা দামী সিল্কের লুঙ্গি। গায়ে ঐ রঙেরই ফতুয়া ও ওড়না, তাতে বিচিত্র সোনালি কাজ। ওড়নার দুই প্রান্ত হাতের চুড়ির সঙ্গে বাঁধা। হাসিমুখে হাত তুলে সবাইকে নমস্কার করে নাচতে শুরু করলো মেয়েটি। আস্তে আস্তে হেলে দুলে এক বিচিত্র ঢং-এর নাচ। চারিদিক ঘুরে ঘুরে ঐ প্রকাণ্ড খোঁপাশুদ্ধ মাথাটা ডানে বাঁয়ে হেলিয়ে এক অপরূপ ছন্দে নাচছে মেয়েটি। পিছনে ওড়নায় রয়েছে কারুকার্যমণ্ডিত নামা। বিচিত্র অলঙ্করণ, হঠাৎ দূর থেকে দেখলে মনে হবে, একটি প্রজাপতি ফুলের বাগানে এ-গাছ থেকে ও-গাছে উড়ে বেড়াচ্ছে, কোনো ফুলই যেন ওর পছন্দ হচ্ছে না। এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ বিকট আর্তনাদ করে বাজনা থেমে গেল। মেয়েটি ভয়ে কুঁকছে এক পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। আবার শুরু হলো বাজনা। এবার খুব দ্রুতলয়ে। নাচও চললো তার সঙ্গে তাল রেখে। মনে হলো একটি দুষ্ট ছেলে ফুল তুলতে বাগানে ঢুকে প্রজাপতিকে তাড়া করছে; ওর সুন্দর বিচিত্র পাখনা দুটির উপরই তার লোভ। কাছে পেলে নিষ্ঠুর হাতে ছিঁড়ে নেবে। প্রাণ ভয়ে তাই ছুটে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি। চক্ষের নিমিষে পায়ের দুটো বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে অনায়াসে লাফিয়ে উঠলো মেয়েটি কাঠের ঐ টুলের উপর। তারপর এক বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত দুটো প্রসারিত করে চুপ করে দাঁড়ালো। যেন নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে পাখনা মেলে দাঁড়ালো প্রজাপতি। বাজনা থেমে গেল। মুগ্ধ দর্শকের আনন্দোচ্ছ্বাস আর করতালিতে কানে তালা লাগবার উপক্রম।

মনে হলো বুঝি নাচ এইখানেই শেষ। একটু বিরতির পর দেখা গেল, একটা প্রকাণ্ড বেতের ঝুড়িতে অনেকগুলো ছুরি ছোরা এনে একটা লোক টুলের নিচে রাখলে। তা থেকে কতকগুলো। হাতে করে তুলে নিয়ে মহেন্দ্রবাবু ও যতীনবাবুকে দেখাতে লাগলো। হাত দিয়ে ছোরাগুলোর ধার পরীক্ষা করে মহেন্দ্রবাবু ঘাড় নাড়ছেন, বুঝলুম সত্যিই ধার আছে। কৌতূহলী জনতা নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলো। চকচকে ঐ ধারালো ছুরি ছোরাগুলো নিয়ে লোকটা টুলের চার পাশে সাজাতে লাগলো। টুলের নিচে থেকে শুরু করে সমস্ত চাদরটা ভরে গেল ছুরি ছেরায়। সাজানোর একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলাম। ধারালো দিকটা উপরে দিয়ে দাবার ছকের মতো ছোট চৌকো ঘরে চাদরটা ভরতি হয়ে গেল। এবার টুলের উপরে নজর পড়তেই দেখি, মুখে মন-ভোলানো হাসি মাখিয়ে মাত্র দুটি বুড়ো আঙুলের উপর ভর দিয়ে পাখনা মেলে বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে প্রজাপতি। আবার ধীরে ধীরে বাজনা শুরু হলো, প্রজাপতি নড়ে উঠে তালে তালে হেলে দুলে ঐ ছোট্ট টুলটার উপর নাচতে লাগলো শুধু দুটি আঙুলের উপর ভর করে। সে এক অদ্ভুত বিচিত্র নাচ। লিখে বোঝানো যায় না, দেখে উপভোগ করতে হয়।

হঠাৎ বাজনার সুর তাল লয় গেল বদলে। আবার শুরু হলো প্রজাপতির প্রাণ নিয়ে ছুটোছুটি খেলা। চক্ষের নিমিষে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লো মেয়েটি ছুরি ভরতি চাদরটার উপর। সমবেত জনতা এক সঙ্গে হায় হায় করে উঠলো। ও হরি! চেয়ে দেখি বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে চৌকো ঘরে অক্ষত পায়ে দাঁড়িয়ে হাসছে মেয়েটি। শুধু এক মুহূর্ত। তার পরই দ্রুত লয়ে নাচ শুরু হলো– নিচে না তাকিয়ে অবলীলাক্রমে চৌকো ঘর থেকে চৌকো ঘর শুধু আঙুলের টো-এর উপর ভর দিয়ে নাচ। একটু অসাবধান হলে অথবা আঙুল ঐ ছোট্ট চৌকো ঘরে না পড়লে শিউরে উঠে চোখ বুজলাম। পরবর্তী জীবনে নাচ অনেক রকম দেখেছি কিন্তু মৃত্যুর হাতছানিকে চ্যালেঞ্জ করে এরকম নাচ দেখিনি।

কিছুক্ষণ বাদে নাচ থেমে গেল। প্রশংসা উল্লাস করতালিতে ফেটে পড়লো জনতা, থামতেই চায় না। সবার অলক্ষ্যে আস্তে আস্তে থানার পথ ধরলাম।

আমার কোয়ার্টার্সের সামনে উঠোনে দাঁড়িয়ে ডাকলাম– হরকি! রমেশ! কোনো সাড়া নেই। একটু এগিয়ে দেখি বারান্দায় মশারি খাঁটিয়ে নাক ডাকিয়ে অকাতরে ঘুমোচ্ছ রমেশ। গা ধরে ঝাঁকানি দিতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বাইরে এসে দাঁড়ালো। বললাম–ব্যাপার কি? হরকি কোথায়?

রমেশ বললে–হকির আজ তিনদিন খুব জ্বর, ঘরে শুয়ে আছে। আর সবাই গান শুনতে গিয়েছে, আমার ডিউটি পড়েছে থানা পাহারা দেবার।

হেসে ফেললাম, বললাম–চমৎকার ডিউটি দিচ্ছিলে। চোর এসে যদি ঘরশুদ্ধ তোমায় তুলে নিয়ে বে অব বেঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসতো-নাক ডাকা বন্ধ হতো না। দরজা খোলল।

রমেশ তাড়াতাড়ি চাবি নিয়ে দরজা খুলে হ্যারিকেন পালিয়ে দিলো। জুতো মোজা খুলে জামাটা খুলতে যাবো বালিশের তলা আমাকে দেবতার মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন। আজ ক্ষণিক উত্তেজনার বশে তুমি যদি ব্রাহ্মণের অন্য এক মগের মেয়েকে বিবাহ কর, তাহা হইলে সমাজে ও অগণিত শিষের নিকটে আমার মুখ দেখানই দুষ্কর হইয়া উঠিবে। উপেক্ষা মৃত্যু শতগুণে শ্রেয় ও কাম্য। কিছুদিন পূর্বে তোমার বড়দার বিয়োগ ব্যথাও বুক বাঁধিয়া সহ করিয়াছি, শুধু তোমার মুখের দিকে চাহিয়া। জানি না পূর্ব জন্মে এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি, যাহার জন্য ভগবান এতবড় শাস্তি দিতে উদ্যত হইয়াছেন।

আর একটি কথা এই সঙ্গে তোমাকে জানাইয়া রাখা বিশেষ প্রয়োজন। আমার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী–চট্টোপাধ্যায়কে তুমি ভালো রকমই জান। বহুদিন পূর্বে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই–পুত্র-কন্যার বিবাহ দিয়া পরস্পরে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হইব। সম্প্রতি তাঁহার জ্যেষ্ঠা কন্যা বিবাহের উপযুক্ত হওয়ায় তিনি আমাকে পূর্বের প্রতিশ্রুতি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন। কন্যাটিকে আমরা দেখিয়া আসিয়াছি–অতি সুলক্ষণা সুন্দরী ও গৃহ-কর্ম-নিপুণা। তোমার অপছন্দ হইবে না। আমি পাকা কথা পর্যন্ত দিয়া আসিয়াছি ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি দিন স্থির করিয়াছি। তুমি পত্র পাঠমাত্র এক মাসের ছুটি লইয়া কলিকাতায় চলিয়া আসিবে–ছুটি না পাওয়া গেলে চাকুরিতে ইস্তফা দিয়া চলিয়া আসিতেও দ্বিধা করিবে না।

ধীউবাবা! আমার মান সম্মান মর্যাদা সব রক্ষার ভার তোমার উপর দিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। বাসাস্থ সর্বাঙ্গীণ কুশল জানিবে। ইতি–

নিত্য আশীর্বাদক
‘বাবা’

পুনঃ–

এই পত্র পাওয়ার পূর্বেই যদি তুমি বিবাহ করিয়া থাক, তাহা হইলে আর আসিবার প্রয়োজন নাই। আমি মনে করিব আর একটি পুত্র হারাইলাম। খুব কষ্ট হইলেও সহ্য করিবার ক্ষমতা আমার আছে। ইতি–
‘বাবা’

এবার দু’বার তিনবার পড়লাম চিঠিটা। শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুটি যে সতীশ ছাড়া আর কেউ নয়, বুঝতে এতটুকু দেরি হলো না। কিন্তু এখন আমি কী করি। মাথার মধ্যে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে; শুধু রক্তের অক্ষরে বাবার চিঠির শেষ কথাগুলো চোখের সামনে জ্বল জ্বল করতে লাগলো–ধীউবাবা! আমার মন সম্মান মর্যাদা সব রক্ষার ভার তোমার উপর দিয়া নিশ্চিন্ত হইলাম। ইচ্ছে হচ্ছিলো চিৎকার করে বলি–কেন আপনি আমার মতো দুর্বল মেরুদণ্ডহীন সন্তানের উপর এতো বড় ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলেন বাবা? দম বন্ধ হয়ে আসছে, ঘরে একটু হাওয়া নেই। ঘামে সর্বাঙ্গ ভিজে সপসপ করছে–তাড়াতাড়ি উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। কানে এল আনন্দ উৎসবে মত্ত অগণিত জনতার উল্লাস ধ্বনি–আজ টেকনাফের আকাশে বাতাসে খুশির প্লাবন–শুধু আমার অন্তরে মরুভূমির শুকনো ঝড়। আচ্ছা, সত্যি প্রচণ্ড ঝড় সেই সঙ্গে বৃষ্টি এসে ওদের ঐ উৎসব ভাসিয়ে দিতে পারে না? ওদের ঐ আনন্দ উল্লাস আমি যে আর সহ্য করতে পারছি নে। তাড়াতাড়ি উঠোনে নেমে উপরের দিকে চাইলাম। দেখি, বৈশাখের খামখেয়ালী আকাশ জলো মেঘে টলমল করছে, তবু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়লো না। সে অভাব পূর্ণ করলেন ভগবান আমার চোখ দিয়ে। শ্রাবণের ধারা নামলো।

.

অপলক চোখে চেয়ে একভাবে বসে রাত কাটিয়েছেন কেউ কোনো দিন? আমি কাটিয়েছিলাম সে রাত খাটের উপর ঠায় বসে। কত রাত, ক’টা বাজে, কোনো খেয়াল ছিল না। দরজা খোলাই ছিল, ইচ্ছে করেই খিল দিইনি।

এক মুখ হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকলে সতীশ। আমাকে ঐভাবে বসে থাকতে দেখে বললে–এই যে, মরিজালা থেকে ফিরেছেন দেখছি। না সত্যি পুণ্যাঙ্গালোক বলতেই হবে। তা না হয় অভোগুলো বিপদের ভিতর থেকে সুস্থ শরীরে ফিরে আসা–

উঠে দাঁড়িয়ে বললাম–আমার সঙ্গে তোমার কোনো বিশেষ দরকার আছে কি?

একটু আমতা আমতা করে সতীশ বললে–আজ্ঞে, আমার মানে-মহেন্দ্রবাবু ডাকছেন আপনাকে। একটু পরেই সামলে নিয়ে গলায় মধু ঢেলে বললে–আর একটা কথা হুজুর, মাথিনের সঙ্গে বিয়ের দিন কবে ঠিক করলেন?

চলে যাচ্ছিলাম, ফিরে দাঁড়ালাম। সতীশের বীভৎস মুখের দিকে মিনিটখানেক চেয়ে থেকে ঈষৎ হেসে বললাম যে দিন মেয়েঘটিত ব্যাপারে মগদের ঐ ধারালো সাড়ে তিন হাত দা’ তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করবে, সেই দিন।

অপ্রত্যাশিত উত্তরে ভ্যাবাচাকা খেয়ে একেবারে থ হয়ে গেল সতীশ। আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

উঠোনে পাতকুয়োর ধারে জরে ধুঁকতে ধুঁকতে বালতি করে জল তুলছে হরকি। কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হরকি বললে– কাল রাতে যখন ডাকাডাকি করছিলেন, আমি তখন জেগে। বড়ো জ্বর বলে উঠে আসতে পারিনি।

বললাম–-থাক, সেজন্যে তোমার লজ্জা পেতে হবে না। এখন কেমন আছো?

হকি বললে–এখন জ্বর একটু কম, আবার বিকেলের দিকে না এলেই বাঁচি।

দেরি হয়ে যাচ্ছিলো। বললাম–হরকি অনেক কথা আছে। বিকেলের দিকে আমার সঙ্গে দেখা করো।

থানা-ঘরে ঢুকে দেখলাম, মহেন্দ্রবাবুর পাশে একটি সৌম্যদর্শন প্রৌঢ় মগ বসে সিগার খাচ্ছেন। পরনে দামী সিল্কের লুঙ্গি, গায়ে ফতুয়া, মাথায় সিঙ্কের রুমাল। বয়স পঞ্চাশের উপর, মাথার চুল শাদা, তুরু শাদা। প্রকাণ্ড চওড়া মুখখানাতে দুটি বিরাট গোপ, তাও শাদা। লোকটার চোখে-মুখে সব সময় প্রচ্ছন্ন হাসি লেগে আছে–দেখলে শ্রদ্ধা হয়।

চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। মহেন্দ্রবাবু বললেন–বসো। ইনিই এখানকার জমিদার ওয়াং থিন সাহেব, আর এই ধীরাজ।

হাত তুলে নমস্কার করলাম।

খুশি হয়ে প্রতি-নমস্কার করে ওয়াং থিন মগি-বাংলায় বললেন বালো, বালো। নাম শুনেছিলাম, দেখলাম। বেটীর আমার পছন্দ খুব বালো–কি বলেন থানাগিরি?

অনিচ্ছায় শুকনো হাসি হেসে জমিদারকে খুশি করেন মহেন্দ্রবাবু–আজ্ঞে, তাতো বটেই, তাতো বটেই।

চুপ করে বসে আছি।

মহেন্দ্রবাবু বললেন–ধীরাজ, তুমি হরকিকে দিয়ে এর মেয়ে মাথিনকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলে?

বললাম–হ্যাঁ।

মহেন্দ্রবাবু–কথাটা ভালো করে ভেবে দেখেছিলে কি? তুমি বামুনের ছেলে হয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মের একটি মেয়েকে বিয়ে করলে তোমার সমাজ, তোমার বাবা-মা মত দেবেন কি?

আমি কিছু বলবার আগেই ওয়াং থিন বললেন–থাক, থাক, এতো বেস্তো হোবার কিছু নাই, তিন-চার দিন ভাবিয়ে পরে উত্তর দেবেন। আমার ঐ একটি মেয়ে। যদি বুঝেন সমাজ আপনাকে লিবে না, এইখানে থাকিয়ে যান। আমার জমি-জমা যা আছে আপনারই হোবে। আর যদি বুঝেন, ওকে লিয়ে গেলে গোলমাল হোবে না,–লিয়ে যাবেন। আমার কোষ্টো হবে—হোক ও তো সুক পাবে।

ওয়াং থিন সাহেব যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ালেন, আমরাও উঠে নমস্কার জানালুম। হেসে প্রতি-নমস্কার করে নিবে-যাওয়া চুরুটটা ধরিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেলেন তিনি।

কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো।

মহেন্দ্রবাবুই প্রথম কথা বললেন–চট করে একটা কিছু করে বসো না। বেশ করে ভেবে-চিন্তে ঠিক করো, কি করবে। বিয়ের পর মাথিনকে নিয়ে কলকাতায় যাবে না এইখানেই থাকবে।

বললাম–ভাববার দরকার হবে না। আমি কি করবো ঠিক করে ফেলেছি।

মহেন্দ্রবাবু বললেন–কি ঠিক করেছে?

গলা একটুও কাঁপলো না। বললাম–বিয়ে করবো না।

বিস্ময়ে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে রইলেন মহেন্দ্ৰবাবু, তারপর বললেন–কি বললে? বিয়ে করবে না?

বললাম–হ্যাঁ। বিয়ে আমি করবো না।

রাগে ফেটে পড়লেন মহেন্দ্রবাবু। টেবিলটায় প্রকাণ্ড একটা কিল মেরে বললেন–কী ভেবেছো তুমি, ছেলেখেলা? এই মগ জাতটাকে এখনও তুমি চেনোনি। হয় মাথিনকে বিয়ে করে এইখানে থাকতে হবে তোমায়, নয় তো সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। এ দুটো ছাড়া অন্য পথ তোমার নেই তা জানে কি?

অম্লানবদনে বললাম–জানি।

–তুমি মাথিনকে বিয়ে করবে না, এ কথাটা ওয়াং থিনের কানে গেলে তোমায় কেটে টুকরো টুকরো করবে। টেকনাফের সমস্ত পুলিশ ফোর্সও তোমায় বাঁচতে পারবে না, সেটা জানো কি?

বললাম–জানি।

হাল ছেড়ে দিয়ে চেয়ারটায় এলিয়ে পড়ে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইলেন মহেন্দ্রবাবু। উদ্দেশ্যহীনভাবে তালাবদ্ধ ঠাণ্ডা ঘরের দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম। বিশ্বেশ্বর এসে কতকগুলো ডাকের চিঠি ও একখানা খবরের কাগজ এনে টেবিলের উপর রেখে দিয়ে গেল। সেগুলোর উপর চোখ বুলোতে বুলোতে মহেন্দ্রবাবু বললেন–প্রথমে ভেবেছিলাম, সরল সাদাসিধে ভালোমানুষ। ও-বাবা, এখন দেখছি তুমি একটি বিচ্ছু, শয়তান। এখন জলের মতো বুঝতে পারছি, এতে জায়গা থাকতে বড় সাহেব কেন তোমায় টেকনাফে বদলি করেছিল। সতীশের কথাই ঠিক, তোমার মতলব ছিল বিয়ের নাম করে মাথিনের সর্বনাশ করে চুপি চুপি এখান থেকে পালিয়ে যাওয়া। আর পালাবার পথও দেখছি ভেবে-চিন্তে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছো?

বিস্মিত চোখে চেয়ে দেখি, বহুদিন আগেকার অন্যমনস্ক হয়ে লেখা আমার সেই চৌদ্দ দিনের ক্যাজুয়াল লিভের দরখাস্তখানা হাতে করে ঘৃণার দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন মহেন্দ্ৰবাবু। দরখাস্তখানা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন–তলে তলে সাহেবের কাছে ছুটির দরখা করেছে, একটা পেশায় জানাওনি।

কী উত্তর দেব, চুপ করে রইলাম। দেখলাম মুলাণ্ড সাহেব আমার দরখাস্তের পাশে ছুটি মঞ্জুর করে সই করে দিয়েছেন। মনে মনে এ বদান্যতার কারণও বুঝলাম। মুলাও বেশ ভালো রকমই জানে যে, ছুটি মঞ্জুর হলেও পাঁচ ছ মাসের মধ্যে এখান থেকে আমি যেতে পারবে না। সমুদ্র অসম্ভব রাফ–স্টীমার চলাচল বন্ধ। অদৃষ্টের এ নির্মম পরিহাসে মুলাণ্ডের মতো আমিও মনে মনে হাসলাম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ চাপ কাটলো। মহেন্দ্রবাবু সরকারি চিঠিপত্রগুলো পড়তে লাগলেন, আমি দরখাস্তখানা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম।

শান্ত সংষতকণ্ঠে মহেন্দ্রবাবু বললেন–যাক, যা হবার হয়ে গিয়েছে। শোনো ধীরাজ, যদি বাঁচতে চাও তাহলে আজ রাত্রেই তোমাকে পালাতে হবে, দেরি করলে একথা পাঁচকান হয়ে জমিদার ওয়াং থিনের কানে পৌঁছবেই। তখন শত চেষ্টা করেও তোমায় বাঁচানো যাবে না।

জিজ্ঞাসু চোখে মহেন্দ্রবাবুর দিকে চাইলাম।

বললেন–একটা বিষয়ে তোমাকে ভাগ্যবান বলতেই হবে। ছুটির দরখাস্ত এসে গেল, এদিকে এই অসময়ে স্টীমারও রেডি।

আপনা হতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল–স্টীমার? এখন?

মহেন্দ্রবাবু বললেন–হ্যাঁ, অনেক লেখালেখি করে বাজারের দোকানদারেরা চৈত্র-সংক্রান্তির উৎসবের জন্য মালপত্র বোঝাই একখানা স্টীমার আনিয়েছিল। শুঁটকি মাছের চালান নিয়ে আজ রাত্রে সেটা চিটাগং রওনা হবে। আজই সরে পড়ো তুমি। কাল সকালে আমি সবাইকে বলবোহঠাৎ বাবার অসুখের সংবাদ পেয়ে তুমি দু সপ্তাহের জন্য কলকাতায় চলে গিয়েছে।

কোয়ার্টার্সে চলে এলাম। আগের দিন রাত্রে কিছুই খাইনি, সকালেও কিছু না। তবু ক্ষিদে বলে কিছুই নেই আমার। দুপুরে অনেক বলে কয়ে রমেশ ভাত খাওয়ালে, একমুঠো খেলাম। কি দিয়ে খেলাম, মনে নেই।

রমেশ বললে– আপনি একটু ঘুমিয়ে নিন বাবু জিনিসপত্তোর আমিই গুছিয়ে দেবো।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙলো মেদ্ধে ডাকে। উঠে দেখি সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে, কালবৈশাখীর মাতনের সঙ্গে শুরু হয়েছে পিটপিটে বৃষ্টি যা সহজে থামতে চায় না, অনেকক্ষণ চলে। কিছুক্ষণ বাদে কালবৈশাখী থেমে গেলেও ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি আরো জোরে এল। চোরের মতো সবার অলক্ষ্যে পালিয়ে যাবার পক্ষে উৎকৃষ্ট রাত!

রমেশ ঘরে ঢুকে স্যুটকেস-বেডিং গোছাতে লাগলো। খাকি হাফ-প্যান্ট, শার্ট আর কেডস-এর জুতো পরে টুপিটা হাতে নিয়ে চেয়ারটায় বসলাম। একটু পরে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম হরকি, হরকি কেমন আছে রমেশ?

–ওর জ্বর আজ বিকেল থেকে বড়ো বেড়েছে হুজুর, দু’খানা কম্বল আগাগোড়া মুড়ি দিয়েও কাঁপুনি থামছে না। এই অবস্থায় আপনার কাছে আসতে চাইছিল। বলছিল আপনার সঙ্গে নাকি ওর অনেক দরকারি কথা আছে। অনেক বুঝিয়ে তবে ঠাণ্ডা করেছি। বলেছি কাল সকালে দেখা করো।

চট করে চার দিক চেয়ে নিয়ে গলাটা খাটো করে রমেশ বললে–আপনি যে আজ চলে যাচ্ছেন একথা হরকিকে জানাইনি। ও শুনলে নির্ঘাৎ একটা কাণ্ড বাধিয়ে বসতো।

মজিদ সাহেবের মতো আর একটি খাঁটি মানুষ ও দরদী বন্ধু জন্মের মতো হারালাম। আর চিন্তার সময় নেই, উঠোনে দেখলাম খালি পা, পরনে খাকি হাফ-প্যান্ট ও শার্ট, মাথায় ছাতার মতো বেত বা ঐ জাতীয় পাতা দিয়ে বোনা টোকা বা প্রকাণ্ড টুপি, হাতে রাইফেল নিয়ে আট ন’ জন কনস্টেবল আমায় নিরাপদে স্টীমার পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে এসেছে। কোনো কথা না বলে উঠে ওদের মাঝখানে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাঝখানে আমি, দু পাশে রাইফেল হাতে ওরা। নিঃশব্দে পথ চলতে শুরু করলাম। মনে হলো আমি যেন মৃত্যুদণ্ডের আসামী! নির্জন কারাকক্ষে বসে এতোদিন চরম মুহূর্তের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিলাম। আজ সময় হতেই মৃত্যুদূত এসে বধ্যভূমিতে নিয়ে এতে করেছে আজ অসময়ে এক রাশ মিথ্যের বোৰা মাথায় করে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সাহস হলো না। তার চেয়ে ওদের কাছে আমার ভীরু কাপুরুষ পরিচয়টাই বড় হয়ে থাক। সোজা। স্টেশনে চলে এলাম। কলকাতার গাড়ি তখনো তিন ঘণ্টা দেরি। কি করি? কখনও বসে কখনও পায়চারি করে কাটিয়ে দিলাম সময়টা।

অবশেষে সত্যিই ট্রেন ছাড়লো–হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *