৪. মাথিন

দু’ তিনদিন পরের কথা। এখন আমার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ হলো দু’বেলা বারান্দায় চেয়ারে বসে কাগজ পড়ার ভান করে মগী যুবতীদের জল তোলা দেখা। ওদের ঐ দুর্বোধ্য, ভাষার কিচির মিচির কানে মধুবৰ্ষণ না করলেও বেশ লাগে। সেদিন একটু সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। যথারীতি চেয়ারে বসে ডিউটি দিচ্ছি। পাতকুয়োর ধারে সবেমাত্র তিন চারিটি যুবতীর জটলা শুরু হয়েছে, অন্যান্যরা এখনও এসে জড়ো হয়নি। হঠাৎ পুলিস কিছু দূরে নজরে পড়লো, চৌদ্দ পনেরো বছরের একটি মেয়ে। কঁখে ঝকঝকে একটা পেতলের কলসী; পরনে সিঙ্কের দামী লুঙ্গি, গায়েও দামী রেশমী ফতুয়া। মেয়েটি ধীরে ধীরে এসে পাতকুয়োর ধারে কলসী রেখে দাঁড়ালো। অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় এরকম রূপযৌবনে লাবণ্যময়ী মেয়ে আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। নাক চোখ মুখ সুন্দরী বাঙালী মেয়েদের মতোই নিখুঁত, তার উপর ঐ নয়নমনোহর খোঁপা। মনে হলো, সমুদ্র থেকে কোনো জলপরী উঠে এসেছে টেকনাফের পাতকুয়ো থেকে জল নিতে। স্থান কাল পাত্র ভুলে বিমুগ্ধ চোখে হা করে চেয়ে আছি। মেয়েটি দু’-একবার আমার দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই কাটলো।

পা টিপে টিপে দুষ্ট, হরকিটা যে কখন এসে পড়েছে খেয়াল হয়নি। একটু হেসে হরকি বললে–আর কতোক্ষণ চেয়ে থাকবেন বাবু, মাথিনের জল নেওয়া আজ আর তাহলে হবে না।

বেশ একটু বিরক্ত হয়েই বললাম–মাথিন! মাথিন আবার কে?

–ঐ যে মেয়েটি আপনার চাউনির ধাক্কা সামলাতে না পেরে লজ্জায় লাল হয়ে পায়ের আঙুল দিয়ে মাটি খুড়ছে ঐ তো মাথিন। এখানকার জমিদার ওয়াং থিনের একমাত্র আদুরে মেয়ে।

লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম–আচ্ছা, ও কি রোজ কুয়ো থেকে জল নিতে আসে?

হরকি বলে–প্রায়ই তো আসে, তবে খুব সকালে। অন্য মেয়েরা জল নিতে আসবার আগেই ও জল নিয়ে চলে যায়। জল নিতে আসা ওর একটা শখ। বাড়িতে পাঁচ ছ’টি চাকরানী রয়েছে, তবু ওর জল নিতে আসা চাই। ওর বাপ মেয়েঅন্ত প্রাণ, তাই কোনো কিছুতেই আপত্তি করে না।

কথায় কথায় বেলা হয়ে উঠলো। চেয়ে দেখি পাতকুয়োর ধারে ভিড় বেশ জমে উঠেছে কিন্তু তাদের মধ্যে মাথিন নেই। কোন্ ফাঁকে জল নিয়ে সে সরে পড়েছে জানতেও পারিনি।

কৌতূহল হলো। চেয়ে দেখি সর্বাঙ্গে চন্দনের ফোঁটা কেটে পূজার আসনে বসে লোলুপ দৃষ্টিতে পাতকুয়োর দিকে চেয়ে ডিউটি দিচ্ছে বিশ্বেশ্বর পাড়ে। অন্যদিন হলে হেসে ফেলতাম, আজ পারলাম না। থানার দিকে পা বাড়ালাম। ঘরে ঢুকে কাগজপত্রগুলো নাড়াচাড়া করছি, একখানা সাদা কাগজ হাতে রমেশ এসে স্যালুট করে দাঁড়ালো।

–ব্যাপার কি রমেশ? জিজ্ঞাসা করলাম।

রমেশ বললে–আজ্ঞে, একটা ক্যাজুয়াল লিভের দরখাস্ত লিখে দিন।

বললাম–ছুটি পেলেও এখন যাবে কি করে? স্টীমার তো বন্ধ।

রমেশ–তিন চার দিনে হেঁটেই মেরে দেবে।

রমেশের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলারই কোনো গ্রামে। দরখাস্ত নিয়ে খুশি মনে রমেশ মহেন্দ্রবাবুর কোয়ার্টার্সে সই করাতে নিয়ে গেল।

ভাবলাম, আমারও তো চৌদ্দ দিন ক্যাজুয়াল লিভ পাওনা হয়েছে, করবো নাকি একটা দরখাস্ত? হাসি পেলে। রমেশ না হয় হেঁটেই মেরে দেবে, কিন্তু আমি? অন্ততঃ ছ’ মাসের মধ্যে স্টীমার আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই। মাথিন আর স্টীমারের কথা ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে লিখে ফেললাম একখানা দরখাস্ত। তারপর পড়ে নিয়ে সেটা মহেন্দ্রবাবুর টেবিলে ডেলি রিপোর্টের ফাইলের ওপর রেখে দিলাম।

থানার সামনে সরু রাস্তার উপর চোখ পড়তেই দেখি, আগে সতীশ, তার পিছনে রক্তমাখা প্রকাণ্ড একটা পোঁটলা হাতে চার পাঁচজন মগ উত্তেজিতভাবে কি বলতে বলতে এগিয়ে আসছে। গোলমাল শুনে মহেন্দ্রবাবুও এসে পড়লেন, তখন খোলা হলো পোঁটলা। দেখলাম, আধবয়সী একটি মগ মেয়ের ছিন্ন ভিন্ন দেহের রক্তাক্ত টুকরোগুলো এক সঙ্গে জড়ো করে বাঁধা। বীভৎস দৃশ্য। আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। দেখলাম, দিব্যি সহজভাবে ঝুঁকে পড়ে মহেন্দ্রবাবু সেগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখে নিলেন। সতীশের কাছে ব্যাপারটা যা শুনলাম, তা হলে এই-থানার পশ্চিমদিকে চিটাগং হিলস্-এর পাদদেশে খানিকটা সমতল জমি আছে, সেখানে ধানের চাষ করা হয়। কিছুদিন হলো ধানকাটা হয়ে গিয়েছে। আজ ভোরে এই মেয়েটি আরও অনেকগুলো মেয়ের সঙ্গে কাঠ কুড়োতে চিটাগং হিলস্-এর দিকে যায়। এদের উপজীবিকাই হলো কাঠ কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করা। হঠাৎ সেই সময় একপাল বুনন হাতী হিলস থেকে নেমে আসে সমতল ভূমিতে ধানের গোড়া খাবার জন্যে। এই মেয়েটি সেই হাতীর পালের সামনে পড়ে যায়। একটা হাতী মেয়েটাকে শুড়ে জড়িয়ে ধরে আছাড় মারে, ফলে এর হাত পা ধড় মুতু সব টুকরো টুকরো হয়ে দূরে ছিটকে পড়ে।

সব শুনে মহেন্দ্রবাবু বললেন–হুঁ, আর একটা আনস্যাচরল ডেথ কেস। আমি রিপোর্টটা লিখে নিচ্ছি। ওর আপনার লোক কেউ যদি থাকে তো লাস তাদের দিয়ে দাও, নইলে পোঁটলাটা শক্ত করে বেঁধে নদীতে ফেলে দাও।

.

সেদিন দুপুরে ভাত খেতে বসে খেতে পারলাম না। পেট গুলিয়ে উঠলো আর চোখের সামনে ভেসে উঠলো রক্তমাখা পোঁটলাটা। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বমি করে ফেললাম।

বিকেলের দিকে একটু সকাল সকাল নিজেই বেড়াতে বেরুলাম। বাজারে ঢুকে দেখি, রঙ-বেরঙের লুঙ্গি ফতুয়া পরে একদল মেয়ে পুরুষ জিনিসপত্তোর নিয়ে বসে গিয়েছে, আরও অনেকে আসছে। বুঝলাম, আজ হাটবার। ওখানকার সবচেয়ে বড় দোকানদার হলেন নিবারণ সাহা। তিনি আমায় দেখতে পেয়ে মহা সমাদরে ভেতরে নিয়ে বসালেন। প্রকাণ্ড ঘর, উপরে টিনের চাল। ভালো করে চেয়ে দেখলাম, এখানে না পাওয়া যায় এমন জিনিসই নেই। কাপড় চোপড় থেকে শুরু করে চাল ডাল তেল মুন চাই কি পান বিড়ি সিগারেট মায় তেলেভাজা পর্যন্ত। চওড়া তত্ত্বাপোশের উপর পরিষ্কার মাদুর পাতা। সেইদিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে নিবারণবাবু বললেন–বসতুক–মানে বসুন। বসে পড়লাম। এদের চট্টগ্রামের ভাষায় সবতাতেই একটা ‘তুক’ জুড়ে দেওয়াই হচ্ছে ভদ্রতা বা নিয়ম। যেমন ধরুন–আসুন, বসুন, খান, যান। ওঁরা বলবেন আসতুক, বসতুক, খাতুক, যাতুক ইত্যাদি। নিবারণবাবুর কাছে টেকনাফ সম্বন্ধে অনেক নতুন কথা জানতে পারলাম। মগের মুলুক বললেও আসলে কিন্তু এরা হচ্ছে বামিজ। রেঙ্গুনের দিকটা হচ্ছে আপার বার্মা আর এদিকটা হচ্ছে লোয়ার বার্মা। ভাষা ধর্ম আচার ব্যবহার সব এক। তফাত হলো, বার্মিজরা শিক্ষিত, তাদের ভাষাও মার্জিত। আর এরা অধিকাংশ অশিক্ষিত কাজেই ভাষাটাও অনেকটা গেঁয়ো। যেমন আমাদের দেশের শিক্ষিত ভদ্রলোকের ভাষা আর অশিক্ষিত চাষার ভাষা।

দেখলাম, বাজারের অধিকাংশ মগের হাতে রয়েছে দু’তিন হাত লম্বা দা’। খুব ধারালো, তার উপর পড়ন্ত রোদের আলো পড়ে চক চক করছে।

নিবারণবাবু বললেন–কি জানেন, ওদের অনেককেই বহুদূর থেকে ঐ চিটাগং হিলস্-এর মধ্যে দিয়ে আসতে হয়। পথে অনেক সময় বাঘ, ভালুক সাপ পড়ে। ঐ দা দিয়ে সেগুলো টুকরো টুকরো করে কেটে তবে ওরা নিরাপদে পথ চলতে পারে।

চকচকে দা’গুলোর দিকে চেয়ে আকাশ পাতাল ভাবছি, হঠাৎ নজরে পড়লো, প্রকাণ্ড মূলোর মতো গাঢ় হলুদ রঙের এক কাঁদি মর্তমান কলা। এত বড় কলা আগে দেখিনি। নিবারণবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম–আচ্ছা, ওর এক ছড়া কলার দাম কতে হবে।

নিবারণবাবু হেসে জবাব দিলেন–আপনার পরিচয় জানতে পারলে ও দামই নেবে না। আমরা কিনলে দু’পয়সা নেবে।

বিশ্বাস হলো না। বললাম–আমায় এক ছড়া আনিয়ে দিন।

দুটো পয়সা দিয়ে নিবারণবাবু একজন কর্মচারীকে পাঠিয়ে কিছু পরে এক ছড়া কলা এনে আমার হাতে দিলেন। দাম দিতে গেলাম, জিভ কেটে নিবারণবাবু বললেন–আপনাদের কিছু দিতে পারলে আমরা ধন্য হয়ে যাই। খুশি হয়ে মনে মনে বললাম, না দেখিয়ে এটা যে সত্যিই দিলেন এর জন্য ধন্যবাদ। এর পরে সব জিনিসের দাম যা শুনলাম, তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। ধরুন, মাঝারি লাউ-এর মতো একটা পাকা পেঁপে, দাম এক পয়সা। হাঁসের বা মুরগীর ডিম পয়সায় চারটে, একটু দর-কষাকষি করলে পাঁচটাও পাওয়া যায়। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চাল বারো আনা মণ, নইলে আট দশ আনায় মাঝারি ভালো চাল পাওয়া যায়। মুরগী, পাঁঠা, মাছ, দুধের কথা আগেই বলেছি। এইসব কথা কলকাতার আমার এক সহপাঠী বন্ধুকে টেকনাফ থেকে লিখেছিলাম। উত্তরে সে লিখলে–অতিরঞ্জন করা চিরদিনই তোর অভ্যাস জানতাম। আজগুবি গল্প বানিয়ে বলতেও হোর জুড়ি নেই জানি। কিন্তু সুদূর মগের মুলুকে গিয়ে তুই তারও উপরে চলে গিয়েছিস। মনে হয়, সঙ্গদোষে আবগারির সন্তা শুকনো নেশার কবলে পড়ে আজকাল তুই যা তা লিখছিস। সত্যি ব্যাপারটা জানাবি কি? রাগে দুঃখে সেই থেকে তাকে আর কোনো চিঠিপত্তোর দিইনি।

নিবারণবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম–জিনিসপত্তোর এখানে এতো সস্তা হওয়ায় কারণ কি?

নিবারণবাবু বললেন–এখন স্টীমার বন্ধু। এ দ্বীপের বা এর আশেপাশের দ্বীপের তরি-তরকারি, মুরগী, ছাগল, মাছ কিছুই বাইরে চালান দেবার উপায় নেই। কাজেই সস্তায় না দিলে কেনবার পয়সা এদের নেই। তবে হ্যাঁ, জিনিসপত্তোর একটু আক্রা হয় শীতকালে, তখন ভালো ভালো জিনিস সব বাইরে চালান করে দেয়।

কথা বলা নিবারণবাবুর একটা নেশা। মনে হলো, অনেকদিন ভালো শ্রোতা পাননি, তাই আজ আমায় পেয়ে উৎসাহ বেড়ে গেল। বললেন–এই মগ জাতটার একটা অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছেন দাবোগাবাবু? অসম্ভব সরল এরা। ঠাট্টা-তামাশা, ঘোরপ্যাঁচ কিছুই এর বোঝে না। আর এদের যৌন ব্যাপারটা আরো অদ্ভুত। ব্যভিচার বলে কিছু এদের মধ্যে নেই। যদি কদাচিৎ কেউ অবিবাহিত কুমারী বা পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হয় আর তা হাতে নাতে ধরা পড়ে, তাহলে আর রক্ষে নেই। ঐ ধারালো চকচকে দা দিয়ে মেয়েটির অভিভাবক বা স্বামী দু’জনকেই কেটে টুকরো টুকরো করবে, পুলিসের বিচারের তোয়াক্কা না করেই। তারপরে নিজেই এসে থানায় হাজির হবে শাস্তির জন্যে। জেল, ফাঁসি, দ্বীপান্তর যা হয় হাসিমুখে মাথা পেতে নেবে, পালাবে না।

সভয়ে হাটের দিকে চাইলাম। অস্তগামী সূর্য তখন চিটাগং হিলস-এর আড়ালে আত্মগোপন করেছে। সন্ধ্যার পাৎলা আঁধার আস্তে আস্তে নেমে আসছে। দেখলাম, অস্পষ্ট আলোতেও দূরের যাত্রী মগদের হাতের প্রকাণ্ড দাগুলো চকচক করছে। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম–সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, এবার উঠি। আর একদিন এসে সব শুনবে। দু-এক পা এগিয়ে একটু ইতস্তুত করে জিজ্ঞাসা করলাম–আচ্ছা, এখানে জমিদার ওয়াং থিনের বাড়িটা কোথায় বলুন তো? শুনেছিলাম বাজারের মধ্যে।

বাইরে বেরিয়ে এসে দক্ষিণদিকে হাত দিয়ে দেখিয়ে নিবারণবাবু বললেন–ঐ যে দোতলা বাড়িটা।

বাড়িটা কাঠের হলেও দোতলা। মোটা শালগাছের গুঁড়ির উপর পুরু তক্তার মেজে, দেওয়ালও তক্তার। উপরে টিনের ছাউনি। ছবির মতো সুন্দর বাড়িটা। দোতলায় হাটের দিকে এক হাত লম্বা ও আধ হাত চওড়া একটা ফোকর বা জানলা। বাড়ির চার পাশে অনেকখানি জায়গা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যে নানা রং-এর ফুলের গাছ। মোটকথা গৃহস্বামী যে সঙ্গতিসম্পন্ন এবং রুচিবান বাড়িটার দিকে এক নজর চাইলেই বেশ বোঝা যায়। দোতলার সেই ফোকরটার দিকে উৎসুক ব্যাকুল চোখ মেলে চেয়ে আছি, যদি একবার মাথিন উঁকি দেয়। দিলো না। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে এগোতে যাবে, নিবারণবাবু বললেন–একটু দাঁড়ান। ছুটে গিয়ে দোকান থেকে একটা টর্চ এনে দিয়ে বললেন–অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। এ সময় পথে সাপ টাপ থাকতে পারে। এটা নিয়ে যান, পরে সুবিধে মতে পাঠিয়ে দেবেন।

ধন্যবাদ দিয়ে এগোলাম। এক হাতে প্রকাণ্ড একছড়া মর্তমান কলা, অন্য হাতে টর্চ। বাজার ছেড়ে খানিকটা পথ বেশ খোলা, কোনও গাছপালা নেই। টর্চ না জ্বেলেই বেশ এগিয়ে চললাম। কিছু দূর গিয়ে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ পড়ে, তার তলাটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। গা’টা ছমছম করে উঠলো। হাওয়ায় শুকনো গাছের পাতার ঝুরঝুর শব্দে মনে হয় বুঝি সাপ। একটু পরে একটা অস্পষ্ট ধস্তাধস্তির শব্দ পেলাম, মনে হলো, কারা যেন ফিসফিস করে কথা কইছে। কান খাড়া করে রইলাম। কই, কিছুই তো শোনা যায় না। শুধু হাওয়ায় ভেসে আসছে বে অব বেঙ্গলের চাপা আক্রোশ। ভাবলাম, নিবারণবাবুর দোকান থেকে একজন লোক সঙ্গে নিয়ে আসি। আবার মনে, হলো কি ভাববে ওরা। না, থাক, কাজ নেই। যা থাকে কপালে এগিয়ে যাই। টর্চটা জ্বালোম, সঙ্গে সঙ্গে কলাগুলো হাত থেকে রাস্তার পাশের একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। সমস্ত ঘটনাটা বোধ হয় একমিনিটের মধ্যেই ঘটে গেল। টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, রাস্তার পাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সাপের ভয়কেও তুচ্ছ করে যোগীন দাসের কুমারী স্ত্রীকে জাপটে ধরে আদর করছে কনস্টেবল বিশ্বেশ্বর পাঁড়ে। জল ভরা মাটির কলসীটা হাত দুই দূরে পড়ে রয়েছে। তাড়াতাড়ি আলো নিবিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে বটগাছের সীমানা পেরিয়ে এলাম।

কি জানি কেন, হঠাৎ হাসি পেল আমার। ভাবলাম, এতদিনে বিশ্বেশ্বর পাঁড়ের আকুল প্রার্থনা বোধ হয় বিশ্বেশ্বরের দরবারে পৌঁচেছে। পরক্ষণেই আঁৎকে উঠলাম। ভাবলাম, আজ আমি না হয়ে যদি লম্বা দা’ হাতে কোনও মগের সামনে ঐ দৃশ্যটি পড়তো, তাহলে? বিশ্বেশ্বরের ভয়াবহ পরিণামের কথা চিন্তা করে আবার শিউরে উঠলাম।

এরপর দু তিনদিন কেটে গিয়েছে। ছোটোখাটো উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলেও সেদিকে নজর দেবার ইচ্ছা বা অবকাশ আমার ছিল না। ভোর হবার আগেই বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসি, মাথিন আসে। পরস্পরের দিকে চেয়ে দু’জনে সম্ভব অসম্ভব নানা কল্পনার রঙিন জাল বুনে চলি। অন্য মেয়েরা আসে, হাসাহাসি করে, গা টেপাটেপি করে, ভ্রূক্ষেপ নেই। পরে ভিড় বেশি বেড়ে গেলে অনিচ্ছায় জল নিয়ে মাথিন চলে যায়, আমিও উঠে পড়ি। মুখের ভাষা না বুঝলেও দু’জনের মধ্যে চোখের ভাষার পরিচয় ততোদিনে বেশ ঘনীভূত হয়ে এসেছে। আমি সন্ধ্যেবেলায় আবার আসবার মিনতি জানাই, সেও সানন্দে সম্মতি দিয়ে চলে যায়। আবার সন্ধ্যেবেলায় চলে ঐ একই খেলার পুনরাভিনয়। সবাই জল নিয়ে চলে গেলে মাথিন আসে, দু’জনে দু’জনার দিকে চেয়ে থাকি যতোক্ষণ দেখা যায়। পরে সন্ধ্যার আঁধার গাঢ় হয়ে আসে, কাছের মানুষও ভালো দেখা যায় না। জল নিয়ে ধীরে ধীরে মাখিন চলে যায় আর ওর চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখেও সমস্ত বিশ্ব-সংসার অন্ধকার হয়ে আসে। রাত্রে ঘুমুতে পারি না। মাথিনের কথা ভাবি, কল্পনায় মাথিনকে দেখি। বুঝলাম, আমার জীবনে প্রথম বসন্ত এল এই সুদূর টেকনাফে। মাথিনকে আমি ভালোবেসেছি। অনেক কষ্টে ঘুম এলেও স্বপ্ন দেখি মাথিনদের কাঠের দোতলায় আধ হাত চওড়া জানলায় মুখ বাড়িয়ে আমি আর মাথিন হাটে মগদের বিচিত্র বেচাকেনা দেখছি। মুখ ফেরাতে গিয়ে মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে যায়, দু’জনে এক সঙ্গে হেসে উঠি। ঘুম ভেঙে যায়, ততোক্ষণে ভোর হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি লাফিয়ে উঠে বাইরে চেয়ারে গিয়ে বসি।

এমনি করে চোখে চোখে চেয়ে থাকার দিনগুলি আমার কেটে যাচ্ছে; মনে হয়, এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না। সেদিনও যথারীতি বারান্দায় বসে আছি, হরকি এসে কাছে বসলো। কোনোরকম ভূমিকা না করেই বললাম–আমায় মগী ভাষা শিখিয়ে দিবি হরকি?

কিছুক্ষণ হাঁ করে মুখের দিকে চেয়ে থেকে হরকি বললে ভাষা না শিখেই যা করেছেন বাবু এর পরে ভাষা শিখলে টেকনাফের সুন্দরী মেয়ে আর একটাও বেঁচে থাকবে না, সব মরে যাবে। মগী রসিকতায় হো হো করে হেসে উঠলো হরকি।

রাগ হলো না, বললাম–ঠাট্টা রাখ, সত্যিই আমি শিখব।

–তার চেয়ে এক কাজ করুন না বাবু, মাথিনকে বিয়ে করে ফেলুন, ওই আপনাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবে।

জিজ্ঞাসা করলাম–আচ্ছা, ওদের বিয়ের নিয়ম-কানুনগুলো কি রকম?

হরকি বললে–খুব সোজা। বিয়ের ব্যাপারে অভিভাবকদের কোনও হাত নেই, যা করবে মেয়ে। মেয়ের যদি ছেলে পছন্দ হয় তাহলে সে যৌতুক চাইবে। ধরুন, দু’ভরি শোনা। ছেলের যদি ক্ষমতা থাকে এনে দেবে। মেয়ের আত্মীয়স্বজন সবাই এক সঙ্গে ক্যাং ঘরের কাঠের মেজেতে বসে শুকটি মাছের ডো দিয়ে ভাত খাওয়া হলেই বিয়ে হয়ে গেল। আপনার ভরণপোষণের সব ভার নিয়ে নিলো মেয়ে। আপনি নিশ্চিন্তমনে খেয়ে দেয়ে আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়ে দিন।

পাতকুয়োর দিকে চোখ পড়লো। দেখি, কৌতূহলী দৃষ্টি আমাদের দিকে মেলে দাঁড়িয়ে আছে মাথিন। হরকি বললে ঐ যে! না এসে আর উপায় আছে? আমি বলছি বাবু, ওর আপনাকে খুব পছন্দ হয়েছে।

লজ্জা পেলাম, বললাম–যাঃ।

–আমি বলছি বাবু। একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, আমাদের থানার নতুন বাবুকে ওর কেমন লাগে।

ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলাম–কি বললে?

–বললে—

বলতে গিয়ে থেমে গেল হরকি। থানার দিকে চেয়ে দেখি, দরজায় দাঁড়িয়ে সতীশ শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে আমাদের নিরীক্ষণ করছে। একটু পরে চট করে ও সরে গেল।

হরকি বললে–বাবু, ব্যাটা সতীশ সব দেখে গেল। বড়বাবুর কাছে গিয়ে এখুনি পাঁচখানা করে লাগাবে। আমি যাই, পরে আপনাকে সব বলবো।

হরকি থানার দিকে চলে গেল। কুয়োর দিকে চেয়ে দেখি, দুটি মেয়ে হাসি ঠাট্টা করতে করতে মাথিনের কলসীতে জল তুলে দিচ্ছে আর গম্ভীর মুখে মাথিন তাই দেখছে। আমার দিকে একবারও তাকালো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে বিছানার ওপর শুয়ে পড়লাম। কিছুই ভালো লাগছিল না, খানিক বাদে উঠে বসলাম। চোখ পড়লো ঘরের কোণে একটা ভাঙা কাঠের বাক্সের উপর। মনে পড়লো, বাজারের সেই হারমোনিয়মটার কথা। কবে দিয়ে গিয়েছে মনেও নেই আর প্রয়োজনও হয়নি। হঠাৎ গান গাইতে ইচ্ছা হলো। ভাঙা বাক্সটা খুলে ততোধিক ভাঙা নড়বড়ে হারমোনিয়মটা বার করলাম। অযত্নে ও অব্যবহারে ধুলো জমে গিয়েছে। যতদূর পারলাম পরিষ্কার করে ‘সা’-এর পর্দা টিপতেই সমবেদনায় ‘মা’ আর ‘পা’ও বেজে উঠলো। চড় চাপড় দিয়ে আলগা স্টপার গুলো দুমড়ে শক্ত করে বাজাতে শুরু করলাম। ও হরি, এবার আরও পাঁচ সাতটা পর্দা চিৎকার করে উঠলো। হতাশ হয়ে ভাবলাম, আমার গান শোনা টেকনাফবাসীর ভাগ্যে নেই। হারমোনিয়মটা বন্ধ করতে যাচ্ছি, দেখি, দরজায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হাসছে সতীশ। সত্যি কথা বলতে কি, ওকে ঐরকম হাসতে দেখলে কি এক অজানা ভয়ে আমার সর্বাঙ্গ কাঁটা দিয়ে উঠত।

সতীশ বললে–গানের চর্চা করছিলেন বুঝি?

রাগ চেপে জবাব দিলাম–চৰ্চা আর করতে পেলাম কই। হারমোনিয়মটা ভাঙা।

হাসিতে মুখখানা কুঁচকে গেল সতীশের। একটু পরে বললে–তা গানের চেয়েও ভালো জিনিসের চর্চা যখন করছেন–

বাধা দিয়ে বললাম–কি যা তা বলছে সতীশ।

গলায় মধু ঢেলে সতীশ বললে–বাবু, আপনি ছেলেমানুষ, তার উপর অজানা দেশ। হঠাৎ যদি কোনও বিপদে পড়েন, বেঘোরে মারা যাবেন।

বললাম তুমি কি বলতে চাইছে। সতীশ?

সতীশ বললে–বলছিলাম, কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক। বিশেষত এ বয়সে। তা হরকিকে না বলে আমাকে দয়া করে হুকুম করবেন। একটু ইশারা করে আমাকে দেখিয়ে দেবেন পাতকুয়োর ধারে কোনটাকে আপনার চাই। রাত্রে আপনার ঘরে এনে হাজির করে দেবদা, কাক-পক্ষীও জানতে পারবে না। হরকি হলো ওদেরই লোক, ওকে অতোটা বিশ্বাস না করাই ভালো। শুধু মাঝে মাঝে টাকাটা-সিকিটা আমার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। আবার সেই শয়তানি হাসি।

রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে গেলেও মুখে কিছুই বলতে পারলাম না। মুখ নিচু করে হারমোনিয়মের পর্দাগুলোর উপর হাত বুলোতে লাগলাম।

একটু পরে মুখ তুলে চেয়ে দেখি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাতকুয়োর দিকে চেয়ে একটা বয়স্ক মেয়েকে কুৎসিত ইশারা করছে সতীশ, আর আশপাশের মেয়েগুলো হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে।

সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে খিল লাগিয়ে দিলাম।

***

আজ ক’দিন হলে স্ত্রীর অসুখ বলে ছুটি নিয়ে দেশে চলে গিয়েছে যতীনবাবু। ডেলি রিপোর্ট লিখবার ভার পড়েছে আমার উপর। সন্ধ্যের পর থানায় বসে তাই লিখছিলাম, চোরের মতো চারদিক তাকাতে তাকাতে ঘরে ঢুকলো হরকি। লেখা শেষ করে ওর দিকে চাইলাম। চাপা গলায় হরকি বললে সতীশ আপনাকে কি বলেছে আমি জানি বাবু, আপনি মন খারাপ করবেন না। ব্যাটা জ্যান্ত শয়তান। এখানে এসে অবধি খালি আমায় বলে–তোরই তো স্বজাত, দে না একটা মেয়ে ঠিক করে।

বললাম,–কেন? আজই তো পাতকুয়োর ধারে একটা মেয়ের সঙ্গে জঘন্য ইয়ার্কি দিচ্ছিলো–আর মেয়েগুলোকেও আমার মোটই ভালো মনে হলো না।

গম্ভীরভাবে হরকি বললে–ঐ কথাটা বলবেন না বাবু। মগেরা গরীব, লেখাপড়া জানে না, সবই সত্যি। কিন্তু একটা জিনিষ ওরা এখনও আঁকড়ে ধরে আছে, সেটা হলো ধর্ম। জান দেবে তবু ধর্ম দেবে না।

সংশয়ভরে বললাম–কিন্তু সতীশ যে বললে–আপনি শুধু দেখিয়ে দিন কাকে চাই, রাত্রে আপনার ঘরে এনে হাজির করে দেবব?

তাচ্ছিল্যভাবে হরকি বললে–সব ফড়ি! সে মুরোদ থাকলে ও ব্যাটা আমার হাতে পায়ে ধরে? আপনি বিশ্বাস করুন বাবু, বিয়ে না করলে মগী মেয়েরা কাউকে জাত দেবে না। মুহূর্তের ভুলে কেউ যদি সেকথা ভুলে যায়, আর ধরা পড়ে, তাহলে ভগবান বুদ্ধও তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন না। মুখে ঠাট্টা ইয়ার্কি সব করবে। কিন্তু আসলে খুব হুঁশিয়ার।

মন অনেকটা হাল্কা হয়ে গেল, বললাম–আজ সন্ধ্যেবেলায় মাথিন জল নিতে এল না কেন?

দুষ্টমি হাসি হেসে হরকি বললে–আসবে কি করে? আমি এতোক্ষণ ওদের ওখানেই ছিলাম যে। অনেক কথা হলো। বখশিস দেন তত বলি।

বললাম–দু’টাকা বকশিস-বল কি কথা হলো।

খুশি হয়ে মহা উৎসাহে হরকি বললে–আপনার কথা বলতেই মাথিন বলে উঠলো, থানাগিরি কুং ফুং রে এ এ এ এ…।

রীতিমতো রেগে গিয়ে বললাম–ঠাট্টা রাখ, সত্যি বল কি বললে?

–ভগবান বুদ্ধের দিব্যি বাবু, মাথিন ঐ কথাই বললে। ওর মানে হলো–থানার বাবুকে চমৎকার দেখতে।

সমস্ত শরীরে একটা আনন্দের শিহরণ খেলে গেল। বললাম –আচ্ছা হরকি, মাথিনের সঙ্গে যদি কোনোদিন কথা কইবার সুযোগ পাই, যদি ওকে বলতে চাই–তোমায় চমৎকার দেখতে। তাহলে মগী ভাষায় কি বলতে হবে?

দ্বিরুক্তি না করে হরকি বললে–মাগো কুং কুং রে এ এ এ এ…।

জিজ্ঞাসা করলাম–যদি বলতে চাই-মাথিন, তুমি যে কোনো যৌতুক চাও তাই দিয়ে তোমায় আমি বিয়ে করবে–তা হলে?

হরকি বললে–মাগো জাই ফলেয়ু মাগোঙা নিজ্জামে এ ‘এ এ এ এ। শেষের কথাটা একটু টেনে বলতে ভুলবেন না বাবু।

হেসে বললাম–না, ভুলবো না। মগী কথার উচ্চারণে হয় তো ভুল হবে–কিন্তু শেষের অক্ষরটা মাইল খানেক টেনে নিয়ে যেতে কোনো দিনই ভুল হবে না।

পাছে ভুলে যাই, একটা কাগজে কথাগুলো লিখে নিলাম। আরও অনেকগুলো চলতি কথাও ঐ সঙ্গে টুকে রাখলাম।

হরকি বললে–মেয়েটা আপনার জন্যে একেবারে পাগল। বলে কি জানেন? বাবু যদি কোনও দিন আমাকে বিয়ে করতে চায়, আমি যৌতুকই চাইব না।

অবাক হয়ে বললাম–সে কি!

–সত্যি বাবু। কোনো সুন্দরী মগ মেয়ে যদি কাউকে বলে তুমি যদি আমায় বিয়ে করো আমি কোনো যৌতুকই চাইবো না। এটা যে পুরুষের পক্ষে কতো বড় সম্মান ওগৌরব তা আপনি হয়তো বুঝবেন না বাবু। কোনও মগের ছেলে হলে আহ্লাদে দম ফেটেই মরে যেতো।

দম ফেটে মরিনি সত্যি, কিন্তু খুশি হইনি একথা বললে মিথ্যা বলা হবে। একটু চুপ করে থেকে বললাম–কাল তুই এক ফাঁকে ওকে বলে দিস হরকি, ও যেন দু’বেলাই জল নিতে আসে। ওকে না দেখলে সে দিনটাই আমার বিশ্রী লাগে।

হরকি বললে–তার চেয়ে এক কাজ করুন বাবু। আর সাত আটদিন বাদেই চৈত্র-সংক্রান্তি। জাদিমুরায় ভগবান বুদ্ধের উৎসব। ঐ দিন সকাল থেকেই অবিবাহিত ছেলেমেয়ের দল সেজেগুজে মন্দিরে গিয়ে জড়ো হবে। তারপর ভগবান বুদ্ধের মূর্তির সামনে পরস্পরে প্রেম নিবেদন করে বিয়ের প্রস্তাব করবে। আপনি আর মাথিনও চলুন না বাবু।

বললাম–কিন্তু ওদের ঐ পবিত্র ধর্মমন্দিরে আমাকে ঢুকতে দেবে কেন?

হরকি হেসে ফেললে–আপনি কিছুই জানেন না বাবু। একমাত্র মুসলমান ছাড়া সব জাতই ওখানে ঢুকতে পারে আর বিয়ের প্রস্তাবও করতে পারে।

মনে পড়লো প্রথম দিন হরকিকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়ে একটা ছোট্ট পাহাড় দেখেছিলাম, তার উপরই হলো বুদ্ধের মন্দির–জাদিমুর। এখনও মনে আছে কেমন একটা শান্ত মৌন স্তব্ধতা পাহাড়টার চারদিকে বেড়ার মতো ঘিরে রয়েছে।

মহা উৎসাহে হরকি বলে চললো–সারা বছর ধরে মগী ছেলেমেয়েরা ঐ দিনটির পানে অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে। সকাল থেকে মেয়েরা দামী রেশমী সুঙ্গি ফতুয়া ওড়না পরে যত্ন করে বাঁধা খোঁপায় রঙ-বেরঙের ফুল গুঁজে ঐ আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে পাহাড়ে উঠতে থাকে। সঙ্গে থাকে নতুন পোশাকপর। স্বাস্থ্যবান মগী যুবার দল, চাইলে চোখ ফেরানো যায় না বাবু।

অবশেষে তাই ঠিক হলো। হরকিকে শুধু বলে দিলাম কথাটা এখন গোপন রাখতে। এমন কি মাথিনকেও বলতে মানা করে দিলাম। ঠিক হলো চৈত্র-সংক্রান্তির দিন দুই আগে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে হকি একটা নতুন রেশমী লুঙ্গি আর ফতুয়া এনে দেবে আর মাথিনকেও জানিয়ে দেবে। আমার একান্ত ইচ্ছা চৈত্র-সংক্রান্তির আগে ব্যাপারটা কেউ না জানতে পারে, বিশেষ করে সতীশ। কি জানি হয়তো সব ভণ্ডুল করে দেবে, ওর অসাধ্য কাজ নেই।

হকির উৎসাহ দেখে কে! বললে–কচি কলাপাতা রঙের রেশমী লুঙ্গি, ফিকে গোলাপী রেশমী ফতুয়া, আর মাথায় পাতলা সিল্কের রুমাল। আপনাকে যা দেখতে হবে বাবু, ওঃ! মগী ছেলের দল নির্ঘাৎ হিংসায় ফেটে মরে যাবে। এই বলে উত্তেজিতভাবে হকি টেবিলের উপর মারলো এক বিরাট কিল। ফলে চওড়া মুখ দোয়াত থেকে এক ধাবড়া ব্লু-ব্ল্যাক কালি ছিটকে গিয়ে পড়লো হরকির মুখে। নিমেষে সব উৎসাহ নিবে গেল। বিচিত্র মুখে বেকুবের মতো আমার দিকে চেয়ে রইলো হরকি। আর আমি হাসিতে দম ফেটে চেয়ার শুদ্ধ উল্টে পড়তে গিয়ে কোনো রকমে টাল সামলে টলতে টলতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

রাত্রে খেতে বসে অন্যমনস্কভাবে অনেকগুলো ভাত খেয়ে ফেললাম।

.

বিছানায় ছটফট করছি, ঘুম আর আসে না। কখনও ভাবি বিয়ের পর মাথিনকে আমি শেখাবো বাঙলা আর মাথিন আমায় শেখাবে মগী ভাষা। সে যা মজা হবে! আবার ভাবি, এখানেই সারা জীবন কাটিয়ে দেবো কিসের জন্য? মাথিনকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাবো। চোখের সামনে ফুটে উঠলে আমাদের ছোট্ট মধ্যবিত্ত সংসার। উৎসাহে একটু ভাটা পড়লো। বাবা মা মাথিনকে ভালো মনে গ্রহণ করবেন কি? মা পারবেন না এটা ঠিক। চোখের সামনে ভেসে উঠলো বাবার শান্ত সৌম্য মুখখানা-বুকে খানিকটা বল পেলাম। বুঝলাম বাবার আশীর্বাদ থেকে আমরা বঞ্চিত হবে না। গরম লাগছিল, উঠে পশ্চিম নির্জন স্থানে গিয়ে বললে, বসুন বাবু। কোনো দিকে না। তাফিয়ে পথের পাশে ধুলোর উপরেই বসে পড়লাম, সামনে উবু হয়ে বসলে হরকি।

সোজা জিজ্ঞাসা করলাম–আজ সন্ধ্যাবেলা মাথিন এল না

–আসবে কি করে! ঘরে বন্ধ করে রাখলে কেউ আসতে পারে? কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো ফুলে গিয়েছে মেয়েটার!

প্রথমটা বিস্ময়ে কথা কইতে পারলাম না। একটু পরে বললাম–ঘরে বন্ধ করে রেখেছে! কে? কেন?

একটু চুপ করে থেকে হরকি বললে–এখনও বুঝতে পারেননি বাবু? সব কিছুর মূলে আছে ঐ শয়তান বেটা সতীশ।

–সতীশ মাথিনকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছে?

এতো দুঃখের মধ্যেও হেসে উঠলো হরকি। বললে–নাঃ, আপনি দেখছি পাগল হয়ে যাবেন। সতীশ বন্ধ করবে কেন? সতীশ ব্যাটা আজ কদিন থেকেই আপনাদের লক্ষ্য করছিল। আজ সকালে সে মাথিনের বাবা ওয়াং থিনের সঙ্গে দেখা করে সব বলে এসেছে। আরও বলেছে আপনার স্বভাব চরিত্র নাকি খুব খারাপ। চট্টগ্রামে কি একটা বিশ্রী কেলেঙ্কারি করেছিলেন, যার জন্যে বড় সাহেব রেগে আপনাকে এখানে বদলি করেছেন। শালা ভালো কারুর করবে না, মন্দ করতে পেলে নাওয়া খাওয়া ভুলে যায়।

খুন চেপে গেল মাথায়। বললাম–আমায় একটা মগী লম্বা দা’ যোগাড় করে দিবি হরকি? ওকে আমি কেটেই ফেলবে।

উত্তেজনায় কাঁপতে কঁপতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি ধরে বসিয়ে দিয়ে হরকি বললে–কি সব ছেলেমানুষী করছেন বাবু। আগে সবটা শুনুন। মাথিনের বাবাকে আমি সব খুলে বলে এসেছি যে, বাবুর আমাদের কোনো খারাপ মতলব নেই। চৈত্র-সংক্রান্তির দিন জাদিমুরায় মাথিনকে উনি বিয়ের প্রস্তাব করবেন। তারপর একটা ভালো দিন দেখে বিয়ে করবেন। এসব বলার পর তবে ঠাণ্ডা হলো। কিন্তু মাথিনকে আর জল নিতে আসতে দেবে না।

অসহায়ভাবে বললাম–তাহলে উপায়?

–ভালোই হলো বাবু। কটা দিন কোনোরকমে চোখ কান বুজে কাটিয়ে দিন, তারপর চৈত্র-সংক্রান্তির পর যখন-তখন ওদের বাড়ি যেতে পারবেন, সতীশ ব্যাটা তখন জ্বলে পুড়ে মরবে।

থানায় চলে এলাম। রাত্রে শুয়ে ঘুম এল না। সতীশ তাহলে মিসেস মুলাণ্ডের ব্যাপারটা বিকৃত করে মাথিনের বাবাকে লাগিয়েছে। মাথিনের কানেও ব্যাপারটা নিশ্চয় পৌচেছে। সে কী ভাবছে কে জানে। ঠিক করলাম বিয়ের পর সবার আগে মাথিনের ঐ ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতেই হবে।

আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙলো অনেক বেলায়। উঠবার তাড়া আজ আর নেই। চোখ বুজে শুয়ে গত রাত্রের বিচ্ছিন্ন ঘটনার জটগুলো খুলতে শুরু করে দিলাম। আচ্ছা, হরকি যে বললে–বিয়ের প্রস্তাব করলে এবং মাথিন মত দিলে যখন-তখন ওদের বাড়ি যেতে পারবো। গিয়ে কি করবো আমি? ওদের বাড়ি গিয়ে মাথিনের মুখের দিকে নীরবে চেয়ে বসে থাকাটা ঠিক হবে কি? ভাষা জানি না, কিছু জিজ্ঞাসা করলে জবাবও দিতে পারবো না। উপায়? প্রথম প্রথম কয়েক দিন হরকিটাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে ইন্টারপ্রেটারের কাজ করবে। সহজ মীমাংসায় মন খানিকটা হাল্কা হলো।

সতীশ মিসেস মুলাণ্ডের ব্যাপারটা শুনলে কি করে? তখনই মনে পড়লো সারা চিটাগং শহর যে খবর জানে, সতীশের মতো ধড়িবাজ লোকের পক্ষে সেটা শোনা মোটেই আশ্চর্য নয়। চিন্তায় বাধা পড়লো। বাইরে থেকে কে যেন দরজার কড়া নাড়ছে। উঠে দরজা খুলে দেখি সর্বাঙ্গে চন্দনের ফোঁটা কেটে কনস্টেবল বিশ্বেশ্বর পাড়ে। কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই বিশ্বেশ্বর বললে–শিগগির একবার থানায় আসুন। বড়বাবু ডাকছেন।

কি এক অজানা আশঙ্কায় মনটা চঞ্চল হয়ে উঠলো। ভয়ে ভয়ে থানায় ঢুকে দেখি লোকে লোকারণ্য। মহেন্দ্রবাবু চেয়ারে বসে আছেন, পাশে দাঁড়িয়ে সতীশ। কিছু দূরে দাঁড়িয়ে রমেশ, হরকি, বিশ্বেশ্বর, মহবুব এবং আরও তিন চারজন কনস্টেবল। তাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বিরাটকায় এক মগ, সর্বাঙ্গে রক্তমাখা। হাতে একখানা বিরাট দা’ রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে। সামনে একটা প্রকাণ্ড জালার মতো মাটির হাঁড়ি বড় বড় করে কাটা মাংসের টুকরোয় ভর্তি। তার উপর রয়েছে একটি মগ মেয়ের রক্তমাখা এলিয়ে পড়া খোঁপা। মাথা ঘুরে গেল। তাড়াতাড়ি একটা চেয়ারে ঝুপ করে বসে পড়লাম। কি একটা লিখতে লিখতে মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে মহেন্দ্রবাবু বললেন–দ্যাখো ফ্যাসাদ!. যতীন নেই এখন কি যে করি! আবার রিপোর্ট লিখতে শুরু করলেন মহেন্দ্রবাবু। ইচ্ছে হচ্ছিলো জিজ্ঞাসা করি। কিন্তু গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে, আওয়াজ বেরোলল না। কাঠের চেয়ারটার হাতল জোর করে চেপে ধরে চুপ করে বসে রইলাম।

কিছুক্ষণ পরে মহেন্দ্রবাবুর কাছে ব্যাপারটা শুনলাম। আওলিং বলে ঐ বিরাটাকার মগটি দিন মজুরি করে খায়। কাজের জন্য মাঝে মাঝে ওকে নাফ নদী পেরিয়ে আকিয়াবেও যেতে হয়। সেখানে ইয়ানুল বলে একটি মুসলমান ছেলের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হয়। তারই সুযোগ নিয়ে ইয়ানুল মাঝে মাঝে টেকনাফে এসে আওলিং-এর সুন্দরী যুবতী স্ত্রী মাও তুং-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা শুরু করে এবং কিছুদিন বাদে দু’জনেই পরস্পরের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। আওলিং-এর সন্দেহ হয় অনেকদিন আগে থেকেই, কিন্তু হাতে-নাতে ধরতে না পেরে সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। গতকাল সুযোগ এসে গেল। মজুরি খাটতে নদী পেরিয়ে আকিয়াবে আসতেই ইয়ানুলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আওলিং-এর। ইচ্ছে করেই আওলিং তাকে বললে যে, সে কাজ নিয়ে বাইরে যাচ্ছে, বাড়ি ফিরতে দু’দিন লাগবে। কিছু পরে একটা বাজে অছিলায় সরে পড়লে ইয়ানুল। আওলিংও গাছ কাটবার করাত ও দা’ নিয়ে ঢুকে পড়লো আরাকান হিলস-এ। তারপর সকলের অলক্ষ্যে একটা লম্বা গাছের মাথায় উঠে পাতার আড়ালে লুকিয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। আওলিং দেখলে চোরের মতো চারদিক চাইতে চাইতে ইয়াকুল ছোট্ট একখানা নৌকো নিয়ে ওপারে রওনা হলো। গাছের উপর থেকে আওলিং স্পষ্ট দেখতে পেলো সব। তারপর ইচ্ছে করেই ঘণ্টা খানেক দেরি করে অপর একখানা নৌকোয় ওপারে গিয়ে উঠলো। সোজা পথে না গিয়ে অনেক ঘুরে বাড়ি গিয়ে দেখলে ঘরের দরজা বন্ধ। স্ত্রীর নাম ধরে জোরে ডাকতে লাগলো, আওলিং, কিন্তু দরজা আর খোলে না। অধৈর্য হয়ে হাতের ল দা’ দিয়ে দরজা কেটে ঘরে ঢুকে দেখে উত্তর দিকের বেড়া কঁক করে ইয়ানুল পালিয়েছে, আর পাংশু মুখে অর্ধ উলঙ্গ মাও তুং ঘরের একটা বাঁশের খুটি ধরে বলির পাঁঠার মতো কাঁপছে। সঙ্গে সঙ্গে আওলিং দা দিয়ে স্ত্রীকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেললো। তারপর রক্তমাখা দা’ হাতে করে ছুটলো নদীর ধারে। দেখলে ইয়ানুল নৌকোর অপেক্ষা না করেই সাঁতার দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে উঠেছে। তারপর এদিকে নজর পড়তেই দা হাতে আওলিংকে দেখে লোকালয় ছেড়ে ছুটে গিয়ে ঢুকলে আরাকান হিলস্-এর গভীর জঙ্গলে। বাড়ি ফিরে একটা প্রকাণ্ড মাটির জালায় কাটা মাংসগুলো তুলে ঘাড়ে করে থানায় এসে সব স্বীকার করে রাজার আইনের শাস্তির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গিয়েছিল। পকেট থেকে রুমাল বার করে ঘাম মুছে ভয়-বিস্ফারিত চোখে আওলিং-এর দিকে চেয়ে বসে রইলাম।

আমার দিকে ফিরে চুপি চুপি মহেন্দ্রবাবু বললেন–ব্যাটা যদি পালিয়ে কিছু দিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকতো, তাহলে নিজেও বাঁচতে আমরাও বাঁচতাম। কিন্তু এখন তো কেস টেক-আপ না করে উপায় নেই। তুমি তো একেবারে নতুন, আনাড়ি। মার্ডার কেস কণ্ডাক্ট করতে পারবে না। যতীন থাকলে তাকেই পাঠাতাম। আমি গেলে চলবে না। একটু ভেবে বললেন, –সতীশ! তুমিই আওলিংকে সঙ্গে নিয়ে কক্সবাজার রওনা হয়ে পড়ো। সঙ্গে বিশ্বেশ্বর আর মহবুবকে নিয়ে যাও।

ভাবলেশহীন মুখে সতীশ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ঘণ্টা খানেক বাদে নরমাংসের জালাটা আওলিং-এর মাথায় চাপিয়ে তার কোমরে একটা শক্ত মোটা দড়ি বেঁধে কনস্টেবলের ইউনিফর্ম পরে বিশ্বের আর মহবুব দু’পাশের সেই দড়ি ধরে হাঁটতে শুরু করলো। সবার পিছনে কাপড়টা হাঁটুর ওপর তুলে নম্বর দেওয়া খাকি কোটটা গায়ে দিয়ে এক হাতে ছাতি আর লাঠি অপর হাতে বন্দুক নিয়ে এক অপরূপ ভঙ্গিতে চললল সতীশ। মনে হলো, পচে ফুলে ওঠা একটা মৃতদেহ নদীর তীর ঘেঁষে আস্তে আস্তে ভেসে চলেছে, আর তারই উপর লোলুপ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে লাফাতে লাফাতে চলেছে একটি বয়স্ক শকুন।

***

খেতে বসে এক গ্লাস ভাতও মুখে তুলতে পারলাম না দুপুর বেলা। সকান্ধের বীভৎস দৃশ্যটা খালি চোখের উপর ভেসে ওঠে। কিছু না খেয়েই উঠে পড়লাম। রমেশ এক বাটি দুধ এনে দিলে, কোনোরকমে চোখকান বুজে খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসে না, ছটফট করে কাটাই। মাথিনের কথা ভাবতে চেষ্টা করি, সঙ্গে সঙ্গে রক্তমাখা দা হাতে বিরাটকায় আওলিং এসে সামনে দাঁড়ায়–মাথিন ভয়ে পালিয়ে যায়। চারটে বাজবার আগেই উঠে পড়লাম। কাপড় জামা পরে কোঁকড়ানো বাবরি চুলগুলো ভালো করে আঁচড়ে বেড়িয়ে পড়লাম। থানার পুবদিকের বারান্দায় বেঞ্চির উপর হরকি বসেছিল লক্ষ্যই করিনি। হঠাৎ ডাক শুনলামবাবু।

দাঁড়াতেই কাছে এসে বললে–এতো রোরে কোথায় চললেন বাবু?

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললাম–কিছু ভালো লাগছে না হকি, তাই একটু বেড়াতে বার হলাম। আয় না সঙ্গে!

দ্বিরুক্তি না করে সঙ্গ নিলো হরকি। সবেমাত্র একটু এগিয়েছি, হরকি বললে–আপনার ভাগ্য খুব ভালো বলতে হবে বাবু।

সঙ্গে সঙ্গে চলা থেমে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম-কেন বল তো?

–ব্যাটা সতীশের হাত থেকে তো পাঁচ-সাত দিনের মতো রেহাই পেলেন। আমি বলছি বাবু ও থাকলে চৈত্র-সংক্রান্তির মধ্যেই একটা অনর্থ বাঁধিয়ে সব পণ্ড করে দিতে।

ভেবে দেখলাম হরকি সত্যি কথাই বলেছে। আজকের ঘটনায় অন্তত সে দিক দিয়ে আমার মত লাভ হয়েছে বলতে হবে। অকারণে মনটা খুশি হয়ে উঠলো। বললাম–চল হকি, আজ জাদিমুরার ওদিকটা বেড়িয়ে আসি।

লোকালয় ছেড়ে চিটাগং হিলস্-এর প্রায় গা ঘেঁষে ছোট্ট পাহাড়টা যেন শান্তির কোলে ঘুমিয়ে আছে। ঐখানটায় এলেই চঞ্চল মন আপনা হতেই শান্ত হয়ে আসে। কোনো কথা না বলে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম।

হরকি বললে–উপরে উঠবেন না বাবু?

বললাম–আজ না। চৈত-সংক্রান্তির দিন উঠবে।

কতোক্ষণ চোখ বুজে শুয়েছিলাম মনে নেই। হরকি বললে বাড়ি চলুন বাবু, রাত হয়ে গিয়েছে। অগত্যা থানার দিকে রওনা হলাম।

বাজারে এসে হরকি বললে–আপনি এগিয়ে যান, আমি মাথিনের ওখানটা ঘুরে আসি।

বাড়ি ফিরে এসে অন্ধকার বারান্দার কাঠের চেয়ারটায় চুপ করে বসে আছি। আধঘণ্টা বাদে হরকি ফিরে এল। মাথিনের খবর জানবার জন্য মন আকুলিবিকুলি করলেও মুখে কিছুই বললাম না। কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটলো।

হরকিই প্রথমে কথা বললে–কি ভাবছেন বাবু?

কোনো জবাব না দিয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। আমার দিকে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে হরকি বললে–আমাকে একটা দিন বাবু। যদিও যা খবর এনেছি তাতে এক সের সন্দেশ খাওয়ানো উচিত।

সিগারেট দিয়ে হেসে বললাম–হরকি, হয় তুই সব চেয়ে বোকা নয় তো সতীশের চেয়েও শয়তান।

অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে হরকি বললে–কেন বাবু?

বললাম–মাথিনের খবরটা বলবার জন্য তুই যে ছটফট করছিলি তা আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম। আর একটু অপেক্ষা করলে সিগারেট বা সন্দেশ না খাওয়ালেও তুই সবগড় গড় করে বলে ফেলতিস তাও জানি। সেইজন্য তোকে বোকা বললাম। আর শয়তান বলছি এই জন্য যে, মাথিনের ব্যাপারটা হয় তো কিছুটা সত্যি, বাকিটা তোর রঙ ফলানো। আমায় নিয়ে খানিকটা নাচাচ্ছি।

হাতের সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো হরকি। অন্ধকারেও দেখতে পেলাম ওর চোখ দুটো যেন জ্বলছে। মনে মনে ভয় পেয়ে গেলাম। উত্তেজিতভাবে হরকি বললে–বাবু। পুলিসের চাকরি করি। মিথ্যা কথা ছল চাতুরি অনেক সময় বাধ্য হয়ে করতে হয়, কিন্তু ভগবান তথাগতের নাম নিয়ে কবুল করছি, আজ পর্যন্ত আপনাকে কোনো মিথ্যা বলিনি, বলতে সাহসও করিনি। এ কথাটা সব সময় মনে রাখবেন।

সত্যিই লজ্জা পেলাম। বললাম–আজ কদিন ধরে কি জানি কেন মনটা খুব চঞ্চল হয়ে আছে হরকি, কাউকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। এই টেকনাফে তুই আমার শেষ অবলম্বন। তাই শেষবারের মতো তোকে যাচাই করে নিলাম। অজান্তে যদি তোর মনে ব্যথা দিয়ে থাকি তো তুই আমায় ক্ষমা করিস হরকি। উঠে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে হরকির হাত দুটো চেপে ধরলাম। গলাটাও ধরে এসেছিল, আর কিছু বলতে পারলাম না। খানিকক্ষণ ঐভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম।

ঠাণ্ডা হয়ে হরকি বললে–বসুন বাবু।

চেয়ারে বসে পড়লাম, হরকি দাঁড়িয়ে রইলো। একটু পরে বললে–আমার মাথায় খুন চেপে গেল কেন জানেন? ঐ শয়তান সতীশের সঙ্গে আমার তুলনা করলেন বলে। আপনি হয়তো জানেন না বাবু টেকনাফে কেউ ওকে দেখতে পারে না। বড়বাবুর পেয়ারের লোক বলে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। নইলে–

বাধা দিয়ে বললাম,-এখন সতীশের কথা থাক, তুই মাথিনের কথাই বল।

একটু চুপ করে থেকে হরকি বললে–ওর সব ছেলেমানুষী দেখলে হাসি পায়। আজ আমি যেতেই হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল উপরে। তারপর চুপি চুপি বললে–হকিদা, তোমাদের থানার নতুন বাবু তো বাঙালী হিন্দু। ওদের মেয়েরা তো শাড়ি পরে।

অবাক হয়ে বললাম–হ্যাঁ, তাতে কি হলো?

মাথিন বললে–ভাবছি, আমাদের লুঙ্গি বাবুর যদি পছন্দ না হয়, তাহলে?

আমি গম্ভীর হবার ভান করে বললাম–তাই তো, সত্যিই ভাবনার কথা।

মাথিন বললে–তুমি আমার একটা উপকার করবে হরকিদা’? আমায় লুকিয়ে একখান শাড়ি কিনে এনে দেবে? এখানে দিনের বেলায় শাড়ি আমি কিছুতেই পরতে পারব না, সবাই ঠাট্টা করবে। রাতে সবাই ঘুমুলে ঐ শাড়ি পরে আমি ওঁর কাছে যাবো। দেখো কিন্তু কথাটা কাউকে বলো না। তোমাদের নতুন বাবুকেও না। বিয়ের দিন রাত্রে শাড়ি পরে ওঁর কাছে গিয়ে ওঁকে চমকে দেবো।

এই বলে একখানা সিল্কের রুমালে বাঁধা পাঁচটা টাকা আমায় দিয়ে বললে–এই দেখুন বাবু।

রুমালের খুট খুলতে দেখা গেল পাঁচটা চকচকে রূপোর টাকা। চোখে জল এসে গিয়েছিল। অন্ধকারে হরকি দেখতে পেলে না। ধরা গলায় বললাম,–বলতে মানা করেছিল যদি, বললি কেন?

হাল্কা হাসিতে ফেটে পড়ে হরকি বললে–এসব কথা ও আপনাকে বলতে বারণ করে দিয়েছিল। তার মানে দেখা হলেই যেন বলি। বুঝলেন না বাবু? আবার হাসে হরকি।

চুপ করে থাকি, কথা খুঁজে পাই না। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করি– তুই বিয়ে করেছিস হরকি?

–হুঁ।

–ছেলে পিলে আছে?

–হুঁ, এক ছেলে এক মেয়ে।

–কোথায় তারা?

–কেন বাড়িতে, বাবা-মার কাছে।

আবার চুপ করে থাকি। কিছু পরে হঠাৎ আবার জিজ্ঞাসা করি–তোর বিয়ের সময় বউ কি যৌতুক চেয়েছিল রে?

চিৎকার করে হেসে উঠলো হরকি। একটু পরে হাসির বেগ কমলে একটু রেগেই জিজ্ঞাসা করি-হাসির কথাটা কি বললাম।

গম্ভীর হয়ে হকি বললে–আপনি আমাকে কি ভেবেছেন বলুন তো? মগ?

অবাক হয়ে বলি–হ্যাঁ! নয় তো কি?

হরকি বললে,–আমি বাঙালী। বাড়ি আমার চট্টগ্রাম জেলায়। তবে হ্যাঁ, ধর্মটা আমাদের এক। মগদের সঙ্গে শুধু ঐটুকু আমাদের মিল। নইলে আচার-ব্যবহারে, ভাষায়, সামাজিকতায় কোনো দিক দিয়েই মেলে না। আর একটি কথা জেনে রাখুন বাবু। মগদের মধ্যে ‘বড়য়া’ পদবী নেই।

একেবারে বোকা বনে গেলাম। এতদিন হরকিকে আমি মগ বলেই জেনে এসেছি। তাছাড়া এই সেদিন সতীশও ওকে মগ বলেই আমার কাছে বলেছে। বললাম–কিন্তু হরকি, মাথিনের ব্যাপারে সেদিন সতীশ পরিষ্কার বললে

মুখের কথা একরকম কেড়ে নিয়ে হরকি বললে–জানি বাবু, ব্যাটা আমাকে রাগাবার জন্য মগ বলে সবার কাছে পরিচয় দেয়। প্রথমত আমি মগী ভাষা ভালোরকম জানি, তারপর এখানকার মগ ছেলেমেয়ের সঙ্গে আমি অবাধে মেলামেশা করি। সবাই পছন্দও করে। সতীশ ব্যাটা হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরে।

যাক, এতদিন পরে একটা বিশ্রী ভুলের সংশোধন হলো।

রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। খাওয়া দাওয়া করতে হকি উঠে গেল। আমি ঠায় অন্ধকারে চেয়ারটার উপর বসে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদে রমেশ খাবার জন্য ডাকতে এল। উঠতে যাবে–দেখি কোলের উপর পড়ে আছে মাথিনের সেই ছোট্ট সিল্কের রুমালখানা, টাকা পাঁচটা হরকি নিয়ে গিয়েছে। একবার ভাবলাম হরকি সত্যি এটা নিতে ভুলে গিয়েছে না ইচ্ছে করেই! যাই হোক রুমালটা যত্ন করে পকেটে রাখলাম।

রাত্রে খাওয়া দাওয়া সেরে সেই ছোট্ট রুমালটা বুকে নিয়ে ওয়ে কল্পনায় শাড়ি পরা মাথিনের দিকে অপলক চোখে যতোক্ষণ পানি চেয়ে থাকি। গাঢ় ঘুমে ক্লান্ত চোখের পাতা দুটো আতে আস্তে বুকে আসে।

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *