প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

১.৪ প্যারিসের অনতিদূরে

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এই শতাব্দীর প্রথম ভাগে প্যারিসের অনতিদূরে মঁতফারমেল গাঁয়ে একটা ছোট হোটেল ছিল। হোটেলটা এখন আর নেই। হোটেলটা রুয়েন দু বুলেঙ্গার অঞ্চলে অবস্থিত ছিল আর সেটা ব্রেনাদিয়ের দম্পতি চালাত। হোটেলটার সামনে দরজার উপর একটা কাঠের বোর্ডের উপর ছবি আঁকা ছিল। তাতে একটা সৈনিক তার পিঠের উপর তারকাচিহ্নিত সেনাপতির পোশাক পরা অবস্থায় আর একজনকে বয়ে নিয়ে চলেছে। ছবিটিতে রঙের সাহায্যে চাপ চাপ রক্ত আর ধোঁয়ার রাশি দেখানো হয়েছে। ছবিটার মাথার উপর লেখা আছে, দি সার্জেন্ট অব ওয়াটারলু।

কোনও হোটেলের সামনে কোনও যাত্রীবাহী গাড়ি বা মালবাহী ওয়াগন বা বড় ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকাটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। কিন্তু ১৮১৮ সালের বসন্তের এক সন্ধ্যায় হোটেলের সামনে এক বিরাট মালবাহী ওয়াগন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন চিত্রকর রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে আশ্চর্য হয়ে যায়। ওয়াগনটার শেষের দিকে লোহার পাটাতনওয়ালা একটা অংশ বড় বড় দুটো চাকার উপর দাঁড়িয়েছিল। তার থেকে একটা লোহার শিকল ঝুলছিল। সে শিকল দিয়ে গোলিয়াথ, হোমারের পলিফেমাস বা শেকসপিয়ারের ক্যালিবনের মতো দৈত্যদের বাধা যেত।

ওয়াগনটা তখন রাস্তাটা জুড়ে দাঁড়িয়েছিল। তখন তার অন্য কোনও কাজ ছিল না। তার থেকে ঝুলতে থাকা শিকলটার একটা অংশ মাটির উপর পড়েছিল আর দুটো বাচ্চা মেয়ে সেটা ধরে দোলনার মতো দুলছিল। বাচ্চা দুটির মা কাছেই বসেছিল। একটি মেয়ের বয়স আড়াই বছর আর একটি মেয়ের বয়স মাত্র দেড় বছর। একটা শাল দিয়ে তাদের মা বাচ্চা দুটিকে শিকলটার সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিল যাতে মেয়ে দুটি খেলা করতে করতে পড়ে না যায়। মা ভাবছিল শিকলটা বাচ্চাদের খেলার পক্ষে সত্যিই একটা মজার বস্তু। মেয়ে দুটিও তাতে খুবই আনন্দ পাচ্ছিল। তাদের তখন দেখে লোহার স্তূপের উপর দুটো ফুটন্ত গোলাপের মতো মনে হচ্ছিল। তাদের চোখগুলো বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল আর তাদের গোলাপি গানগুলো হাসিতে ফুলে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একজনের মাথার চুল বাদামি আর একজনের চুল কালো। তাদের নির্দোষ নিষ্পাপ মুখগুলো আনন্দের উত্তেজনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ছোট মেয়েটির অনাবৃত পেটটা দেখা যাচ্ছিল। ক্রীড়ারত আত্মভোলা এই শিশুদের সরল সুন্দর এক দৃশ্যের পটভূমিকায় ওয়াগনের উপর দিকটা একটা বিরাটকায় দানবের বিকৃত মুখের মতো দেখাচ্ছিল। শিশুকন্যাদের মার চেহারাটা তেমন সুন্দর না হলেও এই দৃশ্যের সঙ্গে তাকে বেশ মানিয়ে গিয়েছিল। সে তখন হোটেলটার সামনে বসে তার মেয়েদের দোলাচ্ছিল তন্ময় হয়ে। সূর্যাস্তের এক রঙিন আভা তাদের মুখের উপর তখন ছড়িয়ে পড়েছিল। শিশুরা যখন শিকলটা ধরে ঝুলছিল পালাক্রমে তখন শিকলটা থেকে একটা কাঁচক্যাচ শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল নিষ্প্রাণ লোহার শিকলটা যেন এক অস্পষ্ট অস্ফুট প্রতিবাদে ফেটে পড়ছিল। মা যখন তার শিশুসন্তানদের নিরাপত্তার দিকে সতত সজাগ দৃষ্টি ছড়িয়ে তাদের দেখাশোনা করছিল তখন তার মুখের উপর একই সঙ্গে পশু ও দেবদূতের মিশ্রিত ভাব ফুটে উঠছিল।

শিশুদের দোলাবার সময় মা অনুক্ত সুরে একটা গান গাইছিল। সে তখন এমন তন্ময় হয়ে আত্মভোলো এক ভাবের আবেশে বিভোর হয়ে ছিল যে হোটেলের সামনের রাস্তায় কী হচ্ছিল না-হচ্ছিল সে বিষয়ে তার কোনও খেয়াল ছিল না।

হঠাৎ কার কণ্ঠস্বরে তার চমক ভাঙল। কে তাকে বলল, আপনার মেয়ে দুটি খুবই সুন্দর মাদাম।

শিশুকন্যাদের মা তাকিয়ে দেখল তার সামনে এক যুবতী মেয়ে কোলে একটি সুন্দর মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার সঙ্গে আছে ভ্রমণকারী একটা ভারী বড় ব্যাগ।

আগন্তুক যুবতী মহিলার কোলে যে শিশুটি ছিল তার বয়স দুই থেকে তিনের মধ্যে। সে তখন নিশ্চিন্তভাবে তার মা’র কোলে ঘুমোচ্ছিল। সে একটা লিনেনের সুন্দর ফ্রক পরে ছিল। তার আপেলের মতো গোলাপি গাল দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার স্বাস্থ্য ভালো। চোখ দুটো বেশ বড় বড়।

আগন্তুক যুবতী মাতাটিকে দেখে গরিব মনে হচ্ছিল। সে হয়তো কোনও শহরে শ্রমিকের কাজ অথবা কোনও গাঁয়ে চাষির কাজ করে। বয়সে সে যুবতী এবং সুন্দর ছিল, কিন্তু তার পোশাক-আশাক দেহগত লাবণ্য প্রকাশের উপযুক্ত ছিল না। তার মাথায় চুল ছিল প্রচুর এবং সে চুলের একটি গোছা মাথায় শক্ত করে পরা টুপির পাশ দিয়ে বেরিয়ে এসে তার চিবুকের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। সে যদি একবার হাসত তা হলে হয়তো তার সুন্দর ঝকঝকে দাঁতগুলো দেখা যেত। কিন্তু সে হাসেনি। জমাটবাঁধা এক অব্যক্ত বিষাদের জন্য তার মুখটা ম্লান আর চোখদুটো শুকনো দেখাচ্ছিল। সে তখন খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। তার কোলের ঘুমন্ত শিশুটার পানে সে সকরুণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। তার গায়ে ছিল ক্যালিকো কাপড়ের জামা আর মোটা পশমের একটা কোট। গলায় জড়ানো ছিল একটা বড় নীল রুমাল। তার হাত দুটো ছিল খসখসে এবং ডান হাতের তর্জনীটাতে ছিল সূচ ফোঁটার দাগ। এই যুবতী মেয়েটিই হল ফাঁতিনে।

আসলে সে ফাঁতিনে হলেও তাকে তখন চেনা যাচ্ছিল না। তবে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তার দেহসৌন্দর্য তখনও অটুট ছিল। কিন্তু বিষাদের কতকগুলি কুটিল রেখা, এক অব্যক্ত দুঃখবাদের এক নীরব নিরুচ্চার সূচনা নেমে এসেছে তার অত্যুজ্জ্বল গাল দুটিতে। তার মসলিন পোশাক-আশাকের সেই পারিপাট্য, আনন্দের উজ্জ্বলতা, গানের অবিচ্ছিন্ন সুরধারা সব চলে গেছে তার জীবন থেকে। গাছের উপর শুভ্রোজ্জ্বল তুষারকণাগুলো নিঃশেষে ঝরে গেলে যেমন গাছের শূন্য শাখাগুলোকে কালো কালো দেখায় তেমনি ফাঁতিনের জীবনে থেকে সব আনন্দের উজ্জ্বলতা আর সুরের ধারা নিঃশেষে চলে গিয়ে কেমন যেন বিবর্ণ ও ম্লান হয়ে উঠেছিল তার সমগ্র মুখমণ্ডল।

ফাঁতিনেদের সেই প্রমোদভ্রমণের পর দশটি মাস কেটে গেছে। তার মধ্যে কী ঘটে গেছে তার জীবনে তা অনুমান করা খুব একটা কঠিন হবে না।

তার যে জীবন একদিন এক নিবিড় নিচ্ছিদ্র ঔদাসীন্যে ভরে ছিল, সে জীবনে নেমে এল এক কঠোর বাস্তব সচেতনতা, এল লাভ-ক্ষতি আর দেনাপাওনার এক অবাঞ্ছিত হিসাবপ্রবণতা। তাদের প্রেমিকরা চলে যেতেই ফাঁতিনে ফেবারিতে, ডালিয়া আর জেফিনের সঙ্গে সব যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের থেকে। সে শুধু একা নয়, যে বন্ধন ছিঁড়ে নির্মমভাবে সকলে চলে যায় সে বাঁধন মেয়েরাও সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে মুক্ত করে ফেলে নিজেদের। সকলেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পরস্পর থেকে। এই বিচ্ছেদের ঘটনার এক পক্ষকাল পরে কেউ যদি তাদের পারস্পরিক বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিত তা হলে তারা নিজেরাই হয়তো আশ্চর্য হয়ে যেত। ফাঁতিনে একেবারে নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে পড়ে। এইসব প্রেমের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদটাই স্বাভাবিক এবং এক অবশ্যম্ভাবী ব্যাপার। সন্তানের পিতা সন্তানকে ছেড়ে চলে গেলে তার সব ভার স্বাভাবিকভাবেই মার ওপরে এসে পড়ে। এবার নিজের রুজি-রোজগারের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করতে হয় ফাঁতিনেকে। থোলোমায়েসের সংস্পর্শ এবং সাহচর্যে আসার পর থেকে তার আগেকার চাকরিটাকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকে সে। কাজ বা রুজি-রোজগারের ওপর সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গে আমোদ-উৎসবের প্রতি দেখা দেয় এক অত্যধিক প্রবণতা। যেসব কাজ বা চাকরি আগে সে সহজেই পেত, সেসব কাজকে সে অবহেলা করতে থাকায় সব যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে সে। সব চাকরির পথ একে একে বন্ধ হয়ে যায় তার সামনে। ফলে যখন তার সত্যি সত্যিই চাকরির দরকার দেখা দিল তখন চেষ্টা করেও চাকরি পেল না কোনও। সে লিখতে-পড়তে জানত না, ছোটবেলায় সে শুধু কোনওরকমে নাম-সই করতে শেখে। সে একজনকে টাকা দিয়ে থোলোমায়েসকে পাঠাবার জন্য তিনখানা চিঠি লেখায়, কিন্তু থোলোমায়েস একটা চিঠির উত্তর দেয়নি। আজ সে যখন মেয়ে কোলে করে রাস্তায় বার হয় তখন রাস্তার লোকেরা তাকে বিদ্রূপ করে। উপহাসের সুরে কী সব বলাবলি করতে থাকে। ফলে থোলোমায়েসের ওপর কঠোর হয়ে ওঠে তার মনটা। এখন সে কী করবে এবং কোথায় যাবে? সে অন্যায় করেছে ঠিক, কিন্তু আসলে সে সৎ এবং গুণবতী। সে যখন দেখল অধঃপতনের এক অতলান্তিক খাদ তার সামনে পথরোধ করে। দাঁড়িয়ে আছে তখন সে ভয়ে পিছিয়ে না গিয়ে সাহস ও ধৈর্যসহকারে তার সম্মুখীন হল। সে তার জন্মস্থান তার দেশের শহর মন্ত্রিউল-সুর-মেরে ফিরে যেতে চাইল। সেখানে তাকে অনেকে চেনে এবং তাদের মধ্যে কেউ না কেউ আশ্রয় বা কাজ দিতে পারে তাকে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তার এই অবৈধ সন্তানের জননী হিসেবে কুমারী মাতার অনপনেয় কলঙ্কের কথাটাকে সম্পূর্ণ গোপন রাখতে হবে। কলঙ্কের বোঝাটাকে কোথাও নামিয়ে যেতে হবে। আবার কেউ সেকথা না জেনে তাকে গ্রহণ করে তাকে আশ্রয় দিলেও পরে যদি সব কথা জেনে ফেলে তা হলে আবার বিচ্ছেদ অনিবার্য এবং সেটা হবে প্রথম বিচ্ছেদের থেকে আরও বেদনাদায়ক, আরও মর্মবিদারক। কিন্তু ফাঁতিনে মনে মনে সংকল্প করে ফেলেছিল। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য উপযুক্ত সাহসের অভাব ছিল না ফাঁতিনের। সেই সাহসের সঙ্গে সৈনিকসুলভ ভঙ্গিতে সংকল্পসাধনে এগিয়ে চলল সে।

ভালো পোশাক পরা ছেড়ে দিয়েছিল ফাঁতিনে। সিল্কের যা কিছু পোশাক ছিল তা সে তার মেয়ের জন্য রেখে দিয়েছিল। তার ঘরে দামি জিনিসপত্র যা কিছু ছিল তা সব বিক্রি করে দিয়ে দুশো ফ্রাঁ পায়। কিন্তু তার থেকে সব দেনা শোধ করে মাত্র আশি ঐ অবশিষ্ট থাকে। তার পর বসন্তের কোনও এক সকালে বাইশ বছরের এক যুবতী ফাঁতিনে কোলে এক বাচ্চা নিয়ে প্যারিস শহর ত্যাগ করল। যারা তাকে তখন শহর ছেড়ে চলে যেতে দেখে তারা সত্যিই দুঃখ প্রকাশ না করে পারেনি তার জন্য। একমাত্র তার এই শিশুসন্তান ছাড়া জগতে আর কেউ নেই তিনের। সন্তানটিরও তার মা ছাড়া আর কেউ ছিল না। ফাঁতিনেকে তার মেয়েকে প্রায়ই স্তনদুধ খাওয়াতে হত। তার ফলে তার শরীর ক্ষয় হয়। তার বুকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। সে প্রায়ই কাশতে থাকে।

মঁসিয়ে ফেলিক্স থোলোমায়েসের কথা বলে আর লাভ নেই। তার সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে বাইশ বছর পরে রাজা লুই ফিলিপের অধীনে একজন ধনী প্রভাবশালী অ্যাটর্নি হিসেবে সে নাম করে। কড়া ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও কাজ করে সে। কিন্তু যে কোনও অবস্থাতেই হাসিখুশিতে মেতে থাকত।

কয়েক স্যু খরচ করে ফাঁতিনে একটা গাড়িতে করে প্যারিস থেকে মঁতফারমেলে এসে হাজির হয়। তার পর হাঁটতে হাঁটতে রুয়েন দু বুলেঙ্গারে এই হোটেলটায় চলে আসে। হোটেলটার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ দুটি শিশুকন্যাকে তাদের মা’র কাছে খেলা করতে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যটা ভালো লেগে যায় তার। একটি সুখী পরিবারের পুরো ছবিটা ভেসে উঠল তার সামনে। সেই ছবি আর এই সুন্দর দৃশ্য থেকে উদ্ভূত একটি অনির্বচনীয় সুখের আবেশ আচ্ছন্ন করে ফেলল ফাঁতিনের মনটাকে। তাই শিশু দুটির মা যখন গান গাইতে গাইতে একবার থামল তখনি সে এগিয়ে এসে মাকে বলল, আপনার শিশু দুটি খুবই সুন্দরী মাদাম!

কোনও হিংস্র জন্তুও কেউ তার বাচ্চাকে ভালো বললে তার প্রতি অনেকখানি নমনীয় ও সহনীয় হয়ে ওঠে।

কথাটা শুনে শিশু দুটির মা ফাঁতিনেকে ধন্যবাদ দিয়ে তাকে পাশের একটা বেঞ্চিতে বসতে বলল। সে নিজেও তার সামনে এক জায়গায় বসে বলল, আমার নাম থেনার্দিয়ের। আমি আর আমার স্বামী এই হোটেলটা চালাই।

মাদাম থেনার্দিয়েরের চেহারা বেশ বলিষ্ঠ, হাড়গুলো দারুণ শক্ত আর মোটা। মাথার চুলগুলো লালচে। যেন কোনও সৈনিকের স্ত্রী; মোটাসোটা এবড়ো-খেবড়ো চেহারা। অঙ্গসৌষ্ঠবের মধ্যে কোনও সূক্ষ্মতা নেই। তবু দেহটা তার যতই রুক্ষ হোক, যত সব জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাস পড়ে তার মনটা বেশ কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে। তার বয়স তিরিশের বেশি হবে না। দেহে তখনও তার ছিল পূর্ণ যৌবন। দরজার সামনে না বসে থেকে সে যদি খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত তা হলে তার বলিষ্ঠ পুরুষালি চেহারা দেখে ভয় পেয়ে যেত ফাঁতিনে। ফলে কোনও কথাই সে তাকে বলতে পারত না।

থেনার্দিয়েরের সামনে বসে ফাঁতিনে তার জীবনকাহিনী সব বলল। তবে কিছুটা পরিবর্তিত আকারে বলল। সে বলল, সে ছিল প্যারিসের এক শ্রমিকের স্ত্রী। তার স্বামী সম্প্রতি প্যারিসে মারা গেছে। সে সেখানে কোনও চাকরি না পেয়ে গ্রামাঞ্চলে যাচ্ছে কাজ খুঁজতে। সে আজ সকালেই প্যারিস থেকে রওনা হয়। কিছুটা পথ গাড়িতে আর কিছুটা পথ হেঁটে সে মঁতফারমেলে এসে পৌঁছেছে। তার কোলের শিশু মেয়েটিও কিছুটা হেঁটেছে। তার পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার কোলে।

কথা বলতে বলতে ফাঁতিনে একবার তার কোলের ঘুমন্ত শিশুটাকে আদর করে চুম্বন করতেই সে জেগে উঠল। তার মা’র মতো নীল বড় বড় চোখ দুটো খুলে চারদিকে তাকাতে লাগল। ছোট ছোট শিশুরা এইভাবে অনেক সময় পরিবেশকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর হয়তো ভাবে সারা পৃথিবীতে একমাত্র তারাই দেবদূত আর সবাই মানুষ। এরপর ফাঁতিনের শিশু মেয়েটি চারদিকে তাকিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ জোর হাসতে লাগল। তার মা তাকে থামাবার চেষ্টা করলেও থামাতে পারল না, আরও জোরে খিল খিল করে হাসতে লাগল এবং তার মার কোল থেকে নেমে যেতে চাইল। মা’র কোল থেকে নেমে শিশুরা যে শিকলটাতে দোলনার মতো করে দুলছিল সেটা দেখে আনন্দে কী বলল। মাদাম থেনার্দিয়ের তার মেয়েদের দোলনা থেকে নামিয়ে বলল, এবার তোমরা সকলে মিলে খেল।

শিশুদের এই বয়সে তাদের বন্ধুত্ব খুব তাড়াতাড়ি গড়ে ওঠে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনটি শিশু একযোগে খেলা করতে লাগল। তারা পরম আনন্দে মাটিতে গর্ত খুঁড়তে লাগল। ফাঁতিনের বাচ্চা মেয়েটি একটা কাঠের টুকরো পেয়ে তাই দিয়ে গর্ত খুঁড়তে লাগল। গর্ত নয় যেন ইঁদুরের কবর।

এদিকে তাদের মায়েরা কথা বলতে লাগল। থোর্দিয়ের ফাঁতিনেকে বলল, তোমার মেয়ের নাম কী?

ফাঁতিনে বলল, কসেত্তে।

আসলে তার মেয়ের নাম ছিল ইউফ্রেজি। ইউফ্রেজি নামটাই চলতি কথায় বলতে বলতে সেটাকে কসেত্তে করে তুলেছে তিনে। যেমন করে অনেক সময় জোসেফ থেকে সাধারণের মুখে মুখে চলতি কথায় বোপিতা আর ফ্রঁসোয়া সিলেক্তে হয়ে দাঁড়ায়। ভাষাগত এই রূপান্তর ভাষাবিজ্ঞানীদের বিস্ময়ে অভিভূত করে তোলে।

থেনার্দিয়ের আবার প্রশ্ন করল, ওর বয়স কত?

ফাঁতিনে বলল, তিন বছরের কাছাকাছি।

বাচ্চারা তখন একই সঙ্গে এক প্রবল আশঙ্কা আর আনন্দের উত্তেজনায় দল বেঁধে দাঁড়িয়ে কী দেখছিল। কিছু একটা ঘটেছে। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে একটা পোকা বেরিয়ে পড়ায় তারা সকলেই একই সঙ্গে ভয় পেয়ে যায় আর আনন্দের আবেগে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারা তিনজনে তখন ঘন হয়ে দাঁড়ায়।

মাদাম থেনার্দিয়ের তাদের পানে তাকিয়ে বলল, শিশু কত তাড়াতাড়ি পরস্পরকে চিনে ফেলে। যেন মনে হচ্ছে ওরা তিন বোন।

কথাটা শুনে উৎসাহিত হয়ে উঠল ফঁতিনে। এই কথাটাই সে শুনতে চাইছিল। সহসা সে মাদাম থেনার্দিয়ের একটা হাত তুলে নিয়ে বলল, তুমি আমার মেয়েকে তোমার কাছে রেখে দেবে ভাই?

মাদাম থেনার্দিয়ের চমকে উঠল। হ্যাঁ বা না কোনও কিছুই বলল না। ফাঁতিনে আবার বলতে লাগল, আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে ওকে নিয়ে যেতে পারি। আমাকে এখন কাজ খুঁজতে হবে এবং সঙ্গে বাচ্চা থাকলে কাজ পাওয়া যায় না। ও অঞ্চলের লোকরাই বড় একগুয়ে এবং যুক্তিহীন। ঈশ্বর যেন এখানে আমাকে পথ দেখিয়ে এনেছেন। আমি তোমার মেয়েদের দেখে ভাবলাম যার বাচ্চারা এমন সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন তার মা না জানি কত ভালো! ও যদি তোমাদের এখানে থাকে তা হলে ওরা ঠিক তিন বোনের মতো খেলা করবে। বল, তুমি ওর দেখাশোনা করবে এখানে রেখে?

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, কথাটা ভেবে দেখতে হবে আমাদের।

ফাঁতিনে বলল, আমি ওর জন্য মাসে ছয় ফ্রাঁ করে দিতে পারি।

এমন সময় বাড়ির ভেতর থেকে এক পুরুষকণ্ঠ শোনা গেল, মাসিক সাত ফ্রাঁ’র কম হবে না, আর দু মাসের অগ্রিম দিতে হবে।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, সাত ফ্ৰাঁ করে হলে ছয় মাসে বিয়াল্লিশ ঐ লাগবে।

ফাঁতিনে বলল, ঠিক আছে।

সেই পুরুষকণ্ঠ আবার বলল, আরও পনের ফ্রাঁ বাড়তি লাগবে।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, তা হলে সবসুদ্ধ সাতান্ন ফ্রাঁ লাগছে।

কসেত্তের মা ফাঁতিনের বলল, ঠিক আছে তাই পাবে। আমার কাছে মোট আশি ফ্রাঁ আছে। তোমাদের সাতান্ন ফ্রাঁ দিয়ে দিলে যা থাকবে তাতে আমি পায়ে হেঁটে গাঁয়ে পৌঁছতে পারব। আমি চাকরি পেলে কিছু জমিয়েই ওকে দেখতে আসব।

পুরুষের সেই কণ্ঠস্বর ভেতর থেকে আবার বলল, ওরা পোশাক-আশাক আছে তো?

মাদাম থেনার্দিয়ের ফাঁতিনেকে বলল, ও হল আমার স্বামী।

ফাঁতিনে বলল, আমি তাই অনুমান করেছিলাম। ওর পোশাক যথেষ্ট আছে। এক সম্ভ্রান্ত মহিলার মতো ওর সিল্কের পোশাকও আছে।

পুরুষ কণ্ঠস্বর বলল, ওগুলো আমাদের দিয়ে যাবে।

ফাঁতিনে বলল, অবশ্যই দিয়ে যাব। আমি কি আমার মেয়েকে নগ্ন অবস্থায় রেখে যাব ভাবছ?

যে পুরুষ এতক্ষণ ঘরের ভেতর থেকে কথা বলছিল সে এবার দরজার কাছে এসে দেখা দিয়ে বলল, ঠিক আছে।

এইভাবে সব বোঝাপড়া বা দরাদরি শেষ হয়ে গেল। ফাঁতিনে রাতটা হোটেলেই কাটাল। তার পর সকাল হতেই সব টাকা মিটিয়ে দিয়ে হোটেল থেকে চলে গেল। তার মেয়ের পোশাকগুলো বার করে দিতে ব্যাগটা হালকা হয়ে গেল। ফাঁতিনে বলল, সে তাড়াতাড়ি চলে আসবে তার মেয়েকে দেখতে। তবু যাবার সময় ফাঁতিনের বুকে ছিল এক হতাশার বোঝ। ফাঁতিনে যখন সকালে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন হোটেলের পাশের বাড়ির একজন লোক তাকে দেখে মাদাম থেনার্দিয়েরকে বলে, আমি এই মাত্র দেখলাম একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছিল তার অন্তরটা ফেটে যাচ্ছে।

থেনার্দিয়ের এরপর তার স্ত্রীকে বলল, তুমি মেয়েগুলোকে নিয়ে বেশ ফাঁদ পেতেছিলে। তবে আরও পঞ্চাশ ফ্রাঁ হলে ভালো হত।

মাদাম থেনার্দিয়ের বলল, কিন্তু তার মানেটা কী হল।

.

ব্যাগ যত ভালোই হোক, একটা ছোট্ট ইঁদুর সেটাকে কেটে ফেলতে পারে ধীরে ধীরে।

এই থেনার্দিয়েররা কে ছিল?

এখন আমরা তাদের কথা বলব সংক্ষেপে। ফলে তাদের চরিত্রের পুরো চিত্রটা পাওয়া যাবে।

থেনার্দিয়েররা সমাজের এমন একটা স্তরের মানুষ যে স্তরটি উচ্চ আর নীচ এই দুই পরস্পরবিরুদ্ধ শ্রেণির সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে। সমাজের উঁচুতলার যেসব লোক কোনও কারণে যারা নিচে নেমে গেছে অথবা যেসব নিচু তলার লোকেরা কোনওক্রমে কিছুটা উপরে উঠে এসেছে ওরা তাদের মাঝামাঝি এবং তাদের থেকে কিছু কিছু উপাদান নিয়ে গড়ে উঠেছিল ওদের শ্রেণিগত স্তরটা। ফলে তাদের ভালো গুণগুলো কিছুই পায়নি, পেয়েছিল শুধু তাদের দোষগুলো। ওরা যেমন শ্রমিক শ্রেণির উদারতা পায়নি, তেমনি বুর্জোয়া শ্রেণির সম্মানজনক সততারও কিছু পায়নি।

আসলে তারা অবস্থার দিক থেকে আপাতদৃষ্টিতে বামনের মতো মনে হলেও ঘটনার আনুকূল্য পেলে সহসা দৈত্যাকার হয়ে উঠতে পারে। মেয়েটার অন্তরে সুপ্ত ছিল নিষ্ঠুরতার এক বীজ আর লোকটার অন্তর ছিল শয়তানিতে ভরা। দু জনেই ছিল যত রকমের অন্যায় ও পাপকর্মে বিশেষভাবে পারদর্শী। সংসারে এক ধরনের মানুষ আছে যারা ক্রে মাছের মতো, যাদের গতি শুধু ছায়া আর অন্ধকারের দিকে, যারা কখনও সামনের দিকে এগিয়ে যায় না, যারা শুধু পেছনের দিকে যায়। তাদের জীবনের সব অভিজ্ঞতাই বিকৃত হয়ে ওঠে এবং তারা ক্রমশই গভীরতর অন্ধকারের দিকে চলে যায়। থেনার্দিয়েরদের জীবনেও তাই ঘটেছিল।

যারা মুখ দেখে মানুষের মনের কথা বুঝতে চায় তাদের কাছে থেনার্দিয়ের ছিল একটা সমস্যা। এমন কতকগুলি লোক আছে যাদের চারদিকে এমন একটা শূন্যতা ঘিরে থাকে যার জন্য তাদের ওপর আমরা নির্ভর করতে পারি না, আমরা তাদের বিশ্বাস করতে পারি না। এই ধরনের লোকেরা আমাদের সামনে বা পেছনে যেখানেই থাক না কেন, আমাদের পক্ষে তারা হয়ে ওঠে ক্ষতিকর আর ভয়াবহ। তাদের স্বরূপ কিছুতেই জানা যায় না, তাদের মধ্যে সব সময় অজ্ঞেয়তার একটা রহস্যময় উপাদান রয়ে যায়। তাই তারা কখন কী করে বসতে তা কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না। অনেক সময় তাদের চোখের চাউনি দেখে তাদের মনে কুমতলবের কথা জানা যায় কিছুটা। তারা যদি কোনও কথা বলে অথবা কিছু করে তা হলে আমরা সে কথা বা কাজের মধ্যে তাদের অতীত কিংম্বা ভবিষ্যতের কোনও রহস্য খুঁজে পাবার চেষ্টা করে থাকি।

থেনার্দিয়ের আগে সৈনিকের কাজ করত। সে সার্জেন্ট ছিল। সে নিজে বলত ১৮১৫ সালের সামরিক অভিযানে যোগদান করে। এর ফলে কী ঘটেছিল আমরা পরে তা জানতে পারব। সে যে যুদ্ধ করতে জানে এবং সে যে একদিন সৈনিকের কাজ করত তা তার হোটেলটা দেখলেই বোঝা যায়। নিজের হাতে আঁকা কতকগুলি যুদ্ধের ছবি সে হোটেলটার এখানে-সেখানে টাঙিয়ে রেখে দিয়েছে। সে ছবি আঁকতে ভালো না জানলেও সব বিষয়ে মাতব্বরি করতে চায় এবং সব কিছুই খারাপ করে বসে।

সে যুগে কিছু ঐতিহাসিক উপন্যাস জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ম্যাদময়জেল দ্য স্কুদেরি থেকে শুরু করে মাদাম বাৰ্থেলেমি হেদত এই ধরনের উপন্যাস লিখে বেশ নাম করেন। এইসব উপন্যাসের বিষয়বস্তুর মধ্যে অনেক অশ্লীলতার উপকরণ ছিল এবং প্যারিসের পাঠকদের মনে রোমান্টিক ভাবধারা সঞ্চার করত। মাদাম থেনার্দিয়ের বেশি লেখাপড়া না জানলেও এই ধরনের উপন্যাস পড়ার মতো ক্ষমতা ছিল তার। মাদাম থেনার্দিয়ের ওইসব উপন্যাস গোগ্রাসে গিলত যেন এবং তার থেকে খারাপ জিনিসগুলো গ্রহণ করত। যেমন এইসব উপন্যাস পাঠের ফলেই তার স্বামীর প্রতি এক রোমান্টিক আনুগত্য সব সময় প্রদর্শন করত মাদাম থেনার্দিয়ের। কিন্তু তার স্বামী লেখাপড়া জানলেও আসলে এক দুর্বৃত্ত ছিল। তার বুদ্ধি এবং রুচি খুবই স্থল প্রকৃতির ছিল। তবে সে পিগল ব্রোনের ভাবপ্রবণতার সমর্থক ছিল। মেয়েদের আচার-আচরণ ও চালচলন সম্বন্ধে সে প্রথাগত রক্ষণশীলতায় বিশ্বাসী ছিল। একথা সে মুখে বলত। মাদাম ছিল তার স্বামীর থেকে পনেরো বছরের ছোট। যখন বিয়োগান্তক উপন্যাসের পরিবর্তে আনন্দোচ্ছল হালকা ধরনের উপন্যাসের প্রচলন দেখা গেল দেশে তখন মাদাম থেনার্দিয়েরও সেই সব বাজে বইয়ের ভক্ত হয়ে উঠল। এইসব কিছু পাঠের অবশ্যই একটা অশুভ প্রভাব আছে এবং এই প্রভাবের ফলেই মাদাস থেনার্দিয়ের তার বড় মেয়ের নাম রাখে এপোনিনে। আর তার ছোট মেয়ের নামটা গুলনেয়ারের পরিবর্তে আজেলমা রাখা হয়।

আসলে ওই যুগটায় নামকরণের এক অরাজকতা চলছিল। এটাকে এক সামাজিক ব্যাধির উপসর্গ বলা যেতে পারে, আবার আবার তা রোমান্টিক উপন্যাস পাঠেরও ফল হতে পারে। যার ফলে গ্রামের চাষিদের ছেলেদের নাম রাখা হত আর্থার, আলফ্রেড, আলফনসে। অন্যদিকে কাউন্ট পরিবারের ছেলেদের নাম রাখা হত টমাস, পিয়ের অথবা জ্যাক। দুটি সামাজিক শ্রেণির মধ্যে নামকরণের এই বিপরীতমুখী ভাব দেশে সাম্যের বৈপ্লবিক ভাবধারা প্রসারের প্রত্যক্ষ ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। এক নতুন যুগের হাওয়া বইছিল যেন সর্বত্র। জীবনের যে কোনও ক্ষেত্রে যে কোনও বৈপরীত্যের পেছনে খোঁজ করলেই ফরাসি বিপ্লবের এক গভীরতর তাৎপর্য অবশ্যই খুঁজে পাব আমরা।

.

শুধু অকুণ্ঠ দুর্নীতিপরায়ণতা সমৃদ্ধি আনতে পারে না কখনও। থেনার্দিয়েরদের হোটেলের অবস্থা দিনে দিনে খারাপের দিকে যাচ্ছিল।

ফাঁতিনে তার মেয়ের জন্য যে সাতান্ন ফ্রী দিয়ে গিয়েছিল তাতে তাদের অনেকটা উপকার হয়। তাতে এক ঋণের মামলা থেকে বেঁচে যায়। কিন্তু এক মাস পর আবার অভাব দেখা দিল তাদের। সংসারে একবারে টাকা নেই, কোনও আয় নেই। মাদাম থেনার্দিয়ের কসেত্তের দামি পোশাকগুলো সব প্যারিসে নিয়ে গিয়ে বন্ধক দিয়ে ষাট ফ্রাঁ নিয়ে এল। ওই টাকাটাও ফুরিয়ে গেল থেনার্দিয়ের দম্পতি কসেত্তেকে অনাথ শিশু হিসেবে দেখতে লাগল। তাকে তাদের মেয়েদের ছেঁড়া ফেলে দেওয়া জামাগুলো পরতে দিত। তাকে কুকুর-বিড়ালের সঙ্গে টেবিলের তলায় খেতে দেওয়া হত একটা কাঠের পাত্রে।

ইতোমধ্যে মন্ত্রিউলে ফাঁতিনে একটা চাকরি পায়। সেখান থেকে প্রতি মাসেই সে তার মেয়ের খবর পাবার জন্য থেনার্দিয়েরদের চিঠি লিখত। প্রতিবারই তার চিঠির উত্তরে থেনার্দিয়েররা ফাঁতিনেকে জানাত তার মেয়ের স্বাস্থ্য খুব ভালো আছে।

ছয় মাস কেটে যাবার পর আগের প্রতিশ্রুতি অনুসারে ফাঁতিনে আর মেয়ের মাসিক খরচ হিসেবে ছয় ফ্রাঁ’র পরিবর্তে সাত ফ্ৰাঁ করে পাঠাতে থাকে। এইভাবে এক বছর কেটে গেলে থেনার্দিয়ের ফাঁতিনের কাছ থেকে মাসিক বারো ফ্রাঁ করে দাবি করে। ফাঁতিনেকে যখন জানানো হল তার মেয়ে বেশ সুখেই আছে তখন সে নির্বিবাদে তা দিয়ে যেতে লাগল।

এমন অনেক মানুষ আছে সংসারে যারা ভালোবাসার অভাব ঘৃণা দিয়ে পূরণ করে। মাদাম থেনার্দিয়ের যখন দেখল কসেত্তে তার মেয়েদের সব অধিকারে ভাগ বসাতে এসেছে তখন সে তাকে ঘৃণা করতে থাকে। মাতৃস্নেহের এটাই কুৎসিত স্বার্থপরতার দিক। কসেক্তের দাবি খুবই কম হলেও মাদাম থেনার্দিয়ের ভাবল সে দাবি পূরণ করা মানে তার মেয়েদের একটা প্রাপ্য অংশ থেকে বঞ্চিত করা। তার মনে হল কসেত্তে যেন তার মেয়েদের প্রয়োজনীয় প্রাণবায়ুর একটা অংশ কেড়ে নিতে এসেছে। সাধারণ নারীদের মতো বাদাম থেনার্দিয়েরের অন্তরটাও ছোট ছিল। সে অন্তরে বেশি দয়া বা স্নেহমমতার স্থান ছিল না।

মাদাম থেনার্দিয়ের কসেত্তেকে প্রায়ই তিরস্কার এবং মারধর করত। কসেত্তে তার প্রতিটি পদক্ষেপে শুধু ভৎর্সনা পেত আর তারই সামনে তার মেয়েদের আদর করত মাদাম থেনার্দিয়ের।

মা’র দেখাদেখি এপপানিনে আর আজেলমা নামে মেয়ে দুটিও দুর্ব্যবহার করত কসেত্তের সঙ্গে।

এইভাবে দুটি বছর কেটে গেল।

গায়ের সবাই বলাবলি করতে লাগল, থেনার্দিয়েররা খুব ভালো লোক। তারা ধনী নয়, তাদের অবস্থা ভালো নয়, কিন্তু তারা একটা অনাথা মেয়েকে মানুষ করছে। মেয়েটাকে বোঝা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয় তাদের ওপর।

গাঁয়ের লোকরা ভাবত কসেত্তের মা তাকে ত্যাগ করে চলে গেছে।

এদিকে থেনার্দিয়েররা কোনওক্রমে জানতে পারে কসেত্তে তার কুমারী মাতার এক অবৈধ সন্তান। এরপর কসেত্তে’র মাসিক খরচ বারো থেকে পনেরো ফ্রতে বাড়িয়ে দেয়।

থেনার্দিয়ের একদিন তার স্ত্রীকে বলে, মেয়েটি বড় হচ্ছে এবং তার খাওয়াও বেড়েছে। আমার আরও টাকা চাই তার জন্য। তা না হলে মেয়েটাকে তার মা’র কাছে দিয়ে আসব।

এইভাবে বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগল। কসেত্তে’র বয়স যেমন বাড়তে লাগল তেমনি তার দুরবস্থাও বেড়ে যেতে লাগল। তার বয়স পাঁচ হতেই বাড়িতে তাকে। দিয়ে ঝি-এর কাজ করানো হতে লাগল। পাঁচ বছরের শিশু কাজ করতে না পারলেও তখনকার কালে অনাথা মেয়েদের এইভাবে খাটানো হত এবং এইভাবে তাদের জীবিকার্জন করতে হত। আমরা সম্প্রতি দামোনার্দ নামে এক যুবককের বিচারকাহিনী থেকে জানতে পারি সে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে নিরাশ্রয় ও অনাথ হয়ে খেটে জীবিকার্জন করত এবং মাঝে মাঝে চুরি করত।

কসেত্তেকে অনেক ফাইফরমাশ খাটতে হত। ঘরের মেঝে মুছতে হত, উঠোন ঝট দিতে হত। থালা-ডিশ ধুতে হত। বোঝা বইতে হত। থেনার্দিয়ের দম্পতি তাকে দিয়ে বেশি করে এই কাজ করাত কারণ সম্প্রতি তার মা নিয়মিত প্রতি মাসে টাকা পাঠাত না। খরচের টাকা দু-এক মাসে বাকি পড়ে যায়।

ফাঁতিনের যদি তিন বছর পর মঁতফারমলে আসত তা হলে সে তার মেয়েকে দেখে চিনতেই পারত না। সুন্দর ও স্বাস্থ্যোজ্জ্বল অবস্থায় যে মেয়েকে সে হোটেলে রেখে যায় সে মেয়ে এখন রোগা আর ম্লানমুখ হয়ে গেছে। থেনার্দিয়েররা বলত, মেয়েটা বড় চতুর আর চঞ্চল।

ক্রমাগত দুর্ব্যবহার তাকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে এবং ক্রমাগত দুঃখভোগ তাকে কুৎসিত করে তোলে। শুধু চোখ দুটোর সৌন্দর্য রয়ে গিয়েছিল। তাতে তার দুরবস্থাটা আরও বেশি করে প্রকটিত হয়ে উঠত। কারণ চোখ দুটো বড় বড় হওয়ার জন্য তাতে তার অন্তরে বেদনাটা বেশি পরিমাণে প্রকাশ পেত। প্রতিদিন শীতের সকালে সূর্য ওঠার আগেই যখন ছয় বছরের একটা মেয়ে ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরে শীতে কাঁপতে কাঁপতে হোটেলের বাইরের দিকের বারান্দাটা একটা বড় ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁট দিত তখন তাকে দেখে যে কোনও লোকের অন্তরটা বিদীর্ণ হয়ে যেত দুঃখে। আঁটাটা এত বড় ছিল যে সে তার। ছোট হাতে ভালো করে ধরতেই পারত না।

পাড়ার লোকেরা তাকে বলত লা লুয়েত্তে অর্থাৎ লার্ক পাখি। গাঁয়ের লোকেরা এই প্রতীক নামটাই তার পক্ষে প্রযোজ্য ভেবেছিল, কারণ সে ছিল লার্ক পাখির মতোই সশঙ্কচিত্ত, কম্পমান এবং ক্ষীণকায় এবং লার্ক পাখির মতো প্রতিদিন সকাল হওয়ার আগেই উঠত। কিন্তু সে ছিল এমনই পাখি যে কখনও কোনও গান গাইত না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *