প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

১.৩ অষ্টাদশ লুই-এর রাজত্বকাল

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তখন অষ্টাদশ লুই-এর রাজত্বকাল। ১৮১৭ সাল। নেপোলিয়ঁন তখন সেন্ট হেলেনা দ্বীপে ইংরেজদের হাতে বন্দি অবস্থায় দিন যাপন করছিলেন। প্রুশীয় সৈন্যরা ফান্সের উপর বুক চেপে বসেছিল তখনও। এই বছর রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও তুলিয়ের শহর ধ্বংস করার অভিযোগে অভিযুক্ত প্লেগনিয়ের, ক্যাবেয়ো আর তলেরকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে তাদের প্রথমে হাত ও পরে মাথা কেটে বিপ্লব দমন করে অবস্থা আয়ত্তে আনা হয়। এ বছর দুটো ঘটনা লোকের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। একটি ঘটনা হল ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের নির্বাচিত রচনাসগ্রহের প্রকাশ এবং দ্বিতীয় ঘটনা হল দতানের ভ্রাতৃহত্যা। দতান নাকি তার ভাইয়ের মাথা কেটে মাথাটা একটা জলাশয়ে ফেলে দেয়। মেদুসে নামে একটি যুদ্ধজাহাজ হারিয়ে যায় এবং সেটি খুঁজে বার করার এক সরকারি তদন্ত শুরু হয়। এ বছর কর্নেল মেলভেস মিশরে পালিয়ে গিয়ে মুসলমান হয়ে সুলেমান পাশা উপাধি ধারণ করে। এ বছর মঁসিয়ে কেঁতে লিঞ্চ একটা বড় কাজ করেন। ১৮১৪ সালের ১২ মার্চ তারিখে তিনি বোর্দো শহরের মেয়র হওয়ার পর শহরটাকে ডিউক দ্য অ্যাঙ্গুলিমের হাতে তুলে দেন। এই বছর অ্যাকাডেমি ফ্রাঁসোয়া এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তার বিষয়বস্তু ছিল পাণ্ডিত্য থেকে প্রাপ্ত সুখ। ক্লেয়ার দ্য আলবে আর মালেক আদেল এই দুটি বিখ্যাত গ্রন্থের জন্য মাদাম কত্তিনকে সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখিকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ইনস্টিটিউট দ্য ফ্রান্স থেকে নেপোলিয়ঁন বোনাপার্টের নামটি বাদ দেওয়া হয়। অ্যাঙ্গুলিমেতে এক নৌবাহিনীর কলেজ স্থাপিত হয়। অ্যালিমের ডিউক নৌবাহিনীর প্রধান হিসেবে শহরটিকে এক প্রসিদ্ধ সমুদ্রবন্দরে পরিণত করা চেষ্টা করেন, কারণ তার ধারণা ছিল তা না হলে রাজতন্ত্রের মর্যাদা অপমানিত হবে। নেতা ও জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ তখনও ছিল। রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন কাফে লেমক্লিনের লোকেরা রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিল এবং কাফে ভেলয়ের লোকেরা বুর্বনদের সমর্থক ছিল। তবে সব বুদ্ধিজীবী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিরা এ বিষয়ে একমত ছিলেন যে রাজা অষ্টাদশ লুই এক সনদের মাধমে চিরতরে বিপ্লবের অবসান ঘটিয়েছেন। রাজতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার জন্য দক্ষিণপন্থীরা নানারকম পরিকল্পনা রচনা করার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। দক্ষিণপন্থীরা প্রায়ই বলতেন উগ্র রাজতন্ত্রী মতবাদের জন্য আমাদের বেকলের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। তবে আবার সেন নদীর ধারে তুলিয়েরের প্রাসাদশীর্ষে মিলিত হয়ে কাউন্ট দার্নয়ের একদল সার্থক ষড়যন্ত্রের জল্পনা-কল্পনা করতেন। বিবাহবিচ্ছেদ প্রথার উচ্ছেদ করা হয়। সমস্ত উচ্চ বিদ্যালয়গুলোকে কলেজের মর্যাদা দেওয়া হয়। অভিনেতা পিকার্দ একাডেমির সদস্য নির্বাচিত হয়, নাট্যকার মলিয়ের যা কোনওদিন পারেননি। থিয়েটার দ্য লোসেওনে কিদার্দ লে দিউ ফিলবার্ত নাটকে নিয়মিত অভিনয় করতেন। এ বছর সবাই একবাক্যে বলতে থাকে মঁসিয়ে শার্লক লয়জেঁ এ শতাব্দীর সবচেয়ে সেরা প্রতিভাধর ব্যক্তি হয়ে উঠবেন। তবে ঈর্ষাকাতর ব্যক্তিরা প্রায় বলতেন, লয়জে যখন আকাশে উড়ছেন, তাঁর পা দুখানি মাটিতেই আছে। যে দার্শনিক সেন্ট সাইমনের কথা লোকে জানতই না, তিনি হঠাৎ বিখ্যাত হয়ে ওঠেন, তিনি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্য হন। ইংরেজ কবি লর্ড বায়রন ফ্রান্সে পরিচিত উঠে খ্যাতি লাভ করতে থাকেন। মঁসিয়ে জেনাভে পুলিশের বড়কর্তার পদ লাভ করলে ফবুর্গের অভিজাত সমাজ তাঁর ধর্মাচরণের জন্য তাঁকে সমর্থন করে। দু জন নামকরা সার্জেন এ কোন দ্য মেডিসিনের সভাকক্ষে খ্রিস্টের ঐশ্বরিকত্ব নিয়ে বিতর্কে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। বিতর্ককালে আবেগের উত্তাপে তারা পরস্পরের প্রতি ঘুষি পাকাতে থাকেন। তাঁদের একজন কুভিয়ের একই সঙ্গে প্রকৃতি জগৎ ও বাইবেলের জেনেসিসের প্রতি তার আনুগত্য ও শ্রদ্ধা দেখান। একই সঙ্গে তিনি ধর্মশাস্ত্র আর ফসিল বা জীবাশ্মের গুরুত্ব স্বীকার করেন এবং সেই সঙ্গে যে কোনও লুপ্ত বৃহদাকার প্রাণীর থেকে মোজেসের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেন। কাউন্ট সার্তয়কে নোতার দ্যমে প্রবেশ করতে দেখে একজন লোক বলে ওঠে, যেদিন আমি বোনাপার্ট আর তালমাকে হাত ধরাধরি করে বল সভেজে ঢুকতে দেখি সেদিনটা কী অভিশপ্ত!’ এই কথা বলার জন্য লোকটার দুমাস কারাদণ্ড হয় রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে। নেপোলিয়ঁনের সামনে যারা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গা-ঢাকা দেয় তারা আবার প্রকাশ্যে বেরিয়ে আসতে থাকে। যারা একদিন যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষে যোগদান করে, তারা সম্মান ও পুরস্কার লাভ করতে থাকে। যারা একদিন ছিল রাজতন্ত্রের বিরোধী তারা আবার দৃঢ়ভাবে প্রকাশ্যে রাজতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য দেখাতে থাকে।

এই হল ১৮১৭ সালের মোটামুটি এক চিত্র। লোকে এখন এসব কথা প্রায় সব ভুলে গেছে। এইসব ছোটখাটো ঘটনা বাতিল করে দিয়ে ইতিহাস বড় বড় ঘটনা নিয়ে মত্ত হয়ে থাকে। কিন্তু মানুষের জীবনকাহিনীতে এই আপাততুচ্ছ ছোটখাটো ঘটনারও মূল্য আছে। ইতিহাসস্বরূপ বিশাল বনস্পতির শাখা-প্রশাখায় যেসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা পাতার মতো বিরাজ করতে থাকে তারা কেউ মৃত্যুহীন নয় একেবারে। এক একটি বছরের উপাদানেই শতাব্দীর বিশাল মুখমণ্ডলটি রচিত হয়।

১৮১৭ সালে প্যারিসের চারজন যুবক হাস্যকৌতুকে বিশেষ নাম করে।

.

তুলুজ, লিমোজে, ক্যাহর আর মঁতাবাঁ থেকে চারজন ছাত্র প্যারিসে পড়তে আসে। তারা ছিল বছর কুড়ি বয়সের সাধারণ যুবক। মোটামুটি ধরনের দেখতে। তাদের সম্বন্ধে ভালো বা মন্দ, পণ্ডিত বা মূর্খ, বুদ্ধিমান বা বোকা কোনওটাই ঠিকমতো বলা যায় না। তাদের স্বভাবের সঙ্গে স্ক্যান্ডিনেভিয়া আর ক্যালিডোনিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের স্বভাবের একটা মিল ছিল। তাদের চালচলন ছিল অস্কারসুলভ, ইংরেজ ভাবাপন্ন তখনও হয়ে ওঠেনি।

তুলুজ থেকে আসা যুবকের নাম ছিল ফেলিক্স থোলোমায়েস, ক্যাহরের যুবকের নাম ছিল লিস্তোলিয়ের, লিমোজে থেকে যে যুবক এসেছিল তার নাম ছিল ফেমিউল আর মঁতাবাঁর যুবকের নাম ছিল ব্ল্যাকিভেল। যুবকদের প্রত্যেকেরই একজন করে প্রেমিকা ছিল। ব্ল্যাকিভেল ভালোবাসত ফেবারিতেকে। ফেবারিতে আগে ইংল্যান্ডে বাস করত। লিস্তোলিয়ের ভালোবাসত ডালিয়াকে। তার প্রিয় ফুলের এই নামটা সে নিজে পছন্দ করে ধারণ করে। ফেমিউল ভালোবাসত জেফিনেকে। অনেকে আবার তাকে জোশেফাইন বলে ডাকত। থোলোমায়েস ভালোবাসত ফাঁতিনেকে। তার সোনালি চুলের জন্য লোকে তাকে লা ব্লক বা সুন্দরী বসে ডাকত।

ফেবারিতে, ডালিয়া, জেফিনে আর ফাঁতিনে–এই চারজন মেয়েরই মোহিনী শক্তি ছিল। তারা সব সময় চকচকে পোশাক পরত, গাঁয়ে গন্ধদ্রব্য ব্যবহার করত। তাদের। মুখগুলো হাসিখুশিতে ভরা থাকত। তবে তাদের দেখলেই বোঝা যেত তারা আগে দর্জির কাজ করত এবং সূচিশিল্পের কাজ তখনও ছাড়েনি তারা। তারা এখন প্রেমে পড়লেও তাদের আগেকার কর্মজীবনের শান্ত স্র একটা ভাব তাদের চোখে-মুখে ফুটে ছিল তখনও। নারীদের অধঃপতন শুরু হলেও তাদের চরিত্রের ধাতুর মধ্যে একটা পবিত্রতার বীজ রয়ে যায় এবং এই মেয়েগুলোরও তাই ছিল। এই মেয়েগুলোর মধ্যে যে সবচেয়ে ছোট ছিল তাদের সবাই ‘বেরি’ বলে ডাকত। আর যে সবচেয়ে বড় ছিল বয়সে তাকে সবাই ‘বিগ সিস্টার বা বড় বোন’ বলত। বড় বোনের বয়স ছিল তেইশ। এদের মধ্যে যে তিনজন বড় ছিল তারা ছিল অনেক অভিজ্ঞ, বেপরোয়া এবং প্রেমের ব্যাপারে অভ্যস্ত আর সুন্দরী ফাঁতিনে প্রথম প্রেমের অভিজ্ঞতা জীবনে প্রথম অর্জন করছিল এবং তার আস্বাদ অনুভব করছিল।

ডালিয়া, জেফিনে আর ফেবারিতের জীবনে একাধিক প্রেমের অভিজ্ঞতা ছিল। আগে তাদের জীবনে তাদের প্রেমকাহিনীর নায়ক হিসেবে যে তিন জন যুবক আসে তারা হল অ্যাডলেফ, আলফোনসে আর গুস্তভ। দারিদ্র্য আর চটুল প্রেমাভিনয় সুন্দরী খেটে খাওয়া শ্রমিক মেয়েদের এক অপ্রতিরোধ্য প্রলোভন হিসেবে এসে তাদের জীবনটাকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়। দারিদ্র্য তাদের খোঁচা দেয়, আর তার পীড়ন তাদের কুপথে ঠেলে দেয়। প্রেম তাদের তোষামোদের পথে নিয়ে যায়। এই দুই-এর আবেদনের কাছে তারা অসহায় এবং তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারে না তারা। যে প্রেমের ফুল তাদের উপর ছুঁড়ে দেওয়া হয় তা পরে পাথর হয়ে তাদের আঘাত করে। এইভাবে তারা নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনে। যে আশা আপাতগৌরবময় অথচ এক দুর্বোধ্য ছলনায় জটিল, সে আশার মোহ তাদের জীবনের পথ থেকে সরিয়ে দূরে নিয়ে যায়।

এদের মধ্যে ফেবারিতে কিছুকাল ইংল্যান্ডে থাকায় জেফিনে আর ডালিয়া তাকে খাতির করত। ছোটবেলা থেকেই তার একটা বাড়ি ছিল। তার বাবা ছিলেন গণিতের শিক্ষক। অহঙ্কারী আত্মম্ভরী এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। যৌবনে একটি মেয়ের প্রেমে পড়েন। কিন্তু বিয়ে করেননি তাকে। ফেবারিতের জন্ম হয় তারই গর্ভে। ফেবারিতের বাবার বয়স বাড়লেও নারীলোলুপতা কমেনি। তার বাবার কাছে থাকত না ফেবারিতে। মাঝে মাঝে দেখা করতে যেত। ফেবারিতে একবার তার বাড়িতে থাকাকালে কোনও এক সকালে রক্তচক্ষু এক বয়স্ক মহিলা তার ঘরে ঢুকে তাকে বলে, তুমি জান আমি কে? আমি তোমার মা। মহিলাটি ঘরে ঢুকে নিজের হাতে খাবার বার করে খেয়ে একটা তোক নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মহিলাটি খুব বদমেজাজি ছিল এবং ফেবারিতের সঙ্গে একটা কথাও বলত না কখনও। সে তার বাবার কাছে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আনত।

ডালিয়া ভালোবাসত লিস্তোলিয়েরকে। এই ভালোবাসা কিভাবে গড়ে ওঠে তা কেউ জানে না। তবে ডালিয়ার গোলাপি আঙুলের নখগুলো খুব সুন্দর ছিল। এই সুন্দর নখ নিয়ে কোনও মেয়ে কঠোর শ্রমের কাজ করতে পারে না। কাউকে ধার্মিক হতে হলে আগে তাকে হাত দুটিকে উৎসর্গ করতে হবে। সে হাতে কঠোর শ্রম করতে হবে। জেফিনে ফেমিউলকে প্রেমিক হিসেবে লাভ করে তার গায়ে পড়া ঢলে পড়া ভাব আর তোষামোদসূচক আদরের কথাবার্তার দ্বারা।

যুবকরা ছিল পরস্পরের কমরেড’ আর মেয়েরা ছিল পরস্পরের বান্ধবী। এইসব ক্ষেত্রে সাধারণ প্রেম আর বন্ধুত্ব পাশাপাশি সমান্তরালভাবে চলতে থাকে।

সদ্‌গুণ আর দর্শন দুটি ভিন্ন বস্তু। তার প্রমাণস্বরূপ বলা যেতে পারে ফেবারিতে, জেফিনে আর ডালিয়া ছিল দার্শনিক মনোভাবাপন্ন আর ফাঁতিনে ধর্মভাবাপন্ন আর গুণশীলসম্পন্না।

কিন্তু এই তো গেল ফাঁতিনের কথা, কিন্তু থোলোমায়েস? সলোমন হয়তো বলতেন প্রেম ধর্মেরই এক অঙ্গ। ফাঁতিনের কাছে সেটা তাই ছিল। তার জীবনে এটাই হল প্রথম প্রেম এবং একমাত্র প্রেম। সে ছিল প্রেমের দিক থেকে সম্পূর্ণ বিশ্বস্ত। সব মেয়েদের মধ্যে একমাত্র তাকেই তার প্রেমিক আপনজন মনে করত এবং তাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করত।

ফাঁতিনে ছিল সমাজের নিচুতলার মানুষদের একজন। অবজ্ঞা আর অপরিচয়ের অপরিসীম কলঙ্ক সারা গাঁয়ে মেখে সে উঠে আসে এক নারকীয় সমাজের গভীরতম প্রদেশ থেকে। তার জন্মপরিচয়, বাবা-মা কিছুই জানত না সে। মন্ত্রিউল সুর-মের নামক এক জায়গায় তার জন্ম হয়, কিন্তু কে তার বাবা-মা তা সে জানত না। তার কোনও ঘরবাড়ি ছিল না বলে বাড়ির দেওয়া কোনও নাম ছিল না। সে যুগে চার্চ ছিল না বলে জন্মের পর চার্চে তার কোনও ধর্মীয় নামকরণ হয়নি। সুদূর শৈশবে একদিন সে যখন রাস্তা দিয়ে খালি পায়ে ছুটতে ছুটতে কোথায় যাচ্ছিল তখন এক পথচারী তাকে দেখে তার নাম দেয় লা পেতিত ফাঁতিনে। সেই নামটাকেই সে মেনে নেয়, মাথার উপর ঝরে পড়া বৃষ্টিকে যেমন মেনে নেয় মানুষ। তার নাম লা পেতিত ফাঁতিনে নিজের সম্বন্ধে সে শুধু এইটুকুই জানে। এর বেশি কিছু না। তার বয়স যখন দশ তখন সে শহর ছেড়ে কাছাকাছি এক গাঁয়ের খামারে কাজ করতে যায়। পনেরো বছর বয়সে সে ভাগ্যান্বেষণে যায় প্যারিসে। সে ছিল দেখতে সুন্দরী। যতদিন পেরেছিল সে তার কুমারী জীবনের শুচিতাকে রক্ষা করে এসেছিল। তার মাথার চুলগুলো ছিল সোনালি আর দাঁতগুলো ছিল মুক্তোর মতো সাদা ঝকঝকে। সোনা আর মুক্তো দিয়ে ভূষিত ছিল সে। কিন্তু সোনা ছিল তার মাথায় আর মুক্তো ছিল তার দাতে।

বাঁচার জন্য কাজ করত সে এবং বাঁচার জন্যই সে যেন প্রেমে পড়ে। কারণ পেটের মতো অন্তরেরও একটা ক্ষিদে আছে। সে ক্ষিদে মেটাবার জন্যই সে যেন থোলোমায়েসের প্রেমে পড়ে।

থোলোমায়েসের কাছে ভালোবাসার ব্যাপারটা ছিল জীবনের এক চলমান ঘটনা। কিন্তু ফাঁতিনের কাছে ভালোবাসাই ছিল জীবন।

লাতিন কোয়ার্টারে যেখানে ছাত্রাবাস ছিল সেখানেই ফাঁতিনের প্রথম প্রেমের জন্ম হয়। তার স্বপ্নের ফুল সেখানেই প্রথম ফোটে। প্যানথিয়নের যে পাহাড়ে অনেক ছেলেমেয়ে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ ও মুক্ত হয় সে পাহাড়ে কিছুদিনের জন্য থোলোমায়েসের কাছ থেকে পালিয়ে গিয়েছিল ফাঁতিনে। কিন্তু তবু সে পাহাড় থেকে থেলোমায়েসকে দেখার চেষ্টা করত। অনেক সময় মানুষ ছুটে পালিয়ে যায় কাউকে অনুসরণ করার জন্য। ফাঁতিনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল।

চারজন যুবকের মধ্যে থোলোমায়েস ছিল সবচেয়ে প্রাণবন্ত আর হাসিখুশিতে ভরা।

ছাত্র হিসেবে থোলোমায়েসের চালনচলন ছিল পুরনো ধাঁচের। সে ছিল ধনী পরিবারের ছেলে। তার বার্ষিক আয় চার হাজার ফ্রাঁ। তার বয়স ছিল তেইশ। কিন্তু এই বয়সেই তার গায়ের চামড়ায় কোঁচকানো দাগ পড়েছিল। মাথার একটা জায়গায় টাক পড়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কিছুই মনে করত না সে। সে বলত, তিরিশ বছরে টাক পড়েছে, চল্লিশ বছরে হাঁটু গেড়ে গেড়ে চলতে হবে। তার হজমশক্তি ভালো ছিল না। একটা চোখে কম দেখত। কিন্তু তার এই বিগতপ্রায় যৌবনের জন্য কোনও দুঃখ না করে বরং তা নিয়ে আনন্দোচ্ছল হয়ে উঠত। তার ভাঙা দাঁত, পড়া চুল আর ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে সে নিজেই হাসি-তামাশা করত। মোট কথা, তার যৌবনহানির ব্যাপারটাকে হাসিমুখে সানন্দে মেনে নিয়েছিল সে। সে একটা নাটক লিখেছিল। কিন্তু বদেভিলের থিয়েটার সে নাটক মঞ্চস্থ করতে চায়নি। মাঝে মাঝে কবিতা লিখত সে। তাছাড়া তার চারপাশের সবাইকে ছোট ভাবত। কারও কোনও গুণকে স্বীকার করত না। তার মাথায় টাক ছিল আর সবার সব কিছু সমালোচনা করত বলে সে সহজেই নেতা হয়ে গিয়েছিল যুবকদলের। সবার ওপর প্রভুত্ব করত।

একদিন থোলোমায়েস তার বন্ধুদের আড়ালে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাদের বলল, প্রায় এক বছর ধরে তিনে, জেফিনে আর ফেবারিতে তাদের একবার চমক লাগিয়ে দেবার জন্য বলছে আমাদের। আমরাও তাদের তা দেব বলে কথা দিয়েছি। তারা কথাটা আমাদের বরাবর বলে আসছে। বিশেষ করে আমাকে। নেপলস-এর মেয়েরা সেন্ট জেভিয়েরকে একবার বলেছিল, কই হলুদমুখো, তোমার মাছ দেখাও। তেমনি ওরাও আমাকে বলে, কই খোলোমায়েস, তোমার চমক কোথাও। তা দেখাও। এখন আমরা বাড়ি থেকে বাবা-মা’র চিঠি পেয়েছি। দু’দিক থেকেই আমরা বিব্রত। আমার মনে হয় এবার আমাদের সময় এসেছে। এখন ব্যাপারটা আমাদের ভেবে দেখতে হবে।

থোলোমায়েস এবার তার গলার স্বরটা নিচু করে তাদের কী বলতেই তারা সবাই জোর হাসিতে ফেটে পড়ল। ব্ল্যাকিভেল চিৎকার করে বলে উঠল, চমৎকার পরিকল্পনা!

পরদিন ছিল রবিবার। চারজন যুবক আর চারজন যুবতী এক প্রমোদভ্রমণে বেরিয়ে গেল।

.

আজ হতে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে কয়েকজন ছেলেমেয়ে মিলে কোনও গ্রামাঞ্চল দিয়ে বেড়াতে গেলে কী ধরনের ব্যাপার হত তা আজকের দিনে কল্পনা করা কঠিন। আজকাল প্যারিস শহরের প্রান্তে বেড়াতে যাবার মতো কোনও গ্রামাঞ্চল নেই। আজকাল ঘোড়ার সেই ডাকগাড়ির পরিবর্তে লোকে রেলগাড়িতে চড়ে অথবা জলপথে স্টিমবোটে করে বাইরে যায়। ১৮৬২ সালে সারা ফ্রান্সের মধ্যে প্যারিসই ছিল একমাত্র শহর, আর সব শহরতলি।

আটজন ছেলেমেয়ে শহর থেকে দূর গ্রামাঞ্চলে গিয়ে তখনকার দিনে যত রকমের গ্রাম্য আমোদ-প্রমোদ প্রচলিত ছিল তাতে স্বেচ্ছায় গা ঢেলে দিয়ে মত্ত হয়ে উঠল। আর গ্রীষ্মের ছুটি সবে মাত্র শুরু। উষ্ণ উচ্ছৃঙ্খল গ্রীষ্মের দিন। আগের দিন চারজন মেয়ের পক্ষ থেকে থোলোমায়েসকে একখানি চিঠি লিখে পাঠায় ফাঁতিনে। কারণ সে-ই একমাত্র লিখতে পারত। তাতে লেখে ‘সেই বড় চমকের জন্য খুব সকালে উঠতে হবে।’

সেদিন তারা সকাল পাঁচটায় উঠেছিল। তারা ঘোড়ার গাড়িতে করে প্রথমে সেন্ট ক্লাউতে গিয়ে পৌঁছয়। সেখানে জল দেখে তারা আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। তেতিনয়েরে তারা প্রাতরাশ খেয়ে ইচ্ছামতো দৌড়ঝাঁপ করে বেড়াতে থাকে। তারা পুকুরে সাঁতার কাটে, গাছে চড়ে, জুয়ো খেলে, ফুল তোলে, ক্রিমপাফ কেনে এবং গাছ থেকে আপেল পেড়ে খায়।

পিঞ্জরমুক্ত পাখির মতো মেয়েরা হাসিখুশিতে উজ্জ্বল হয়ে বেড়াতে থাকে। তারা পুরুষদের টীকা-টিপ্পনী কেটে ঠাট্টা-তামাশা করতে থাকে। এ হল প্রথম যৌবন-জীবনের উন্মত্ততা, কতকগুলি অবিস্মরণীয় মুহূর্তের সমষ্টি, এ যেন কতকগুলি বড় বড় মাছির রঙিন ডানার উচ্ছ্বসিত কম্পন। প্রথম যৌবনের এইসব কথা কি তোমাদের কারও মনে নেই? তোমরা কি কেউ কখনও কোনও সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে ঝোপে-ঝাড়ের বা কোনও জলাশয়ের ধারে বেড়াওনি? পথের ছোটখাটো বাধা-বিপত্তি কখনও এইসব প্রমোদাভিলাষী দলের কারও মনে কোনও বিরক্তি উৎপাদন করতে পারেনি। ফেবারিতে একবার অবশ্য তাদের সাবধান করে দিয়েছিল, পথে ওই যে খোলাহীন শামুক দেখা যাচ্ছে, এটা হচ্ছে বৃষ্টি আসার লক্ষণ।

মেয়ে চারজনের দেহসৌন্দর্য আর বেশভূষা ছিল সত্যিই মনোমুগ্ধকর। তারা সেন্ট ক্লাউডে বাদামগাছের তলায় সকাল ছ’টার সময় যখন বেড়াচ্ছিল তখন একজন বয়স্ক কবি তাদের দেখে অবাক হয়ে যান। মেয়েদের মধ্যে সবার বড় এবং ব্ল্যাকিভেলের বান্ধবী তেইশ বছরের ফেবারিতে সাবার আগে আগে গাছগুলোর তলা দিয়ে যাচ্ছিল। যত সব খাল-নালা ডিঙিয়ে ঝোঁপঝাড়ের পাশ কাটিয়ে একরকম নাচতে নাচতে পথ হাঁটছিল আর সবাইকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। জেফিনে আর ডালিয়া দু জনে ঘন হয়ে পাশাপাশি পথ হাঁটছিল। একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে ইংরেজি আদব-কায়দা দেখাচ্ছিল। তখন মেয়েদের মাথার চুল কুঞ্চিত করার রীতি প্রথম প্রচলিত হয়। বায়রন। সুলভ এক ভাবময় বিষাদে স্বেচ্ছায় গা ঢেলে দেওয়ার এক রীতিও শিক্ষিত মেয়েদের সমাজে প্রচলিত ছিল। পরে এ বিষাদ ইউরোপের শিক্ষিত পুরুষদের পেয়ে বসে। জেফিনে আর ডালিয়া তাদের পোশাক আঁট করে পরেছিল। লিস্তোলিয়ের আর ফেমিউল তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সম্বন্ধে কী সব আলোচনা করছিল। তারা ফাঁতিনেকে আইনের অধ্যাপক মঁসিয়ে ডেলভিনকোট ও মঁসিয়ে ব্লোদের মধ্যে কী নিয়ে ঝগড়া হয় তা বোঝাচ্ছিল। ব্ল্যাকিভেল সমানে ফেবারিতের গায়ের শালটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। যেন এই কাজের জ্যই তার জন্ম হয়েছে পৃথিবীতে।

দলের নেতা হিসেবে তখনও সবার পেছনে ছিল থেলোমায়েস। সে রসিক ছিল, কিন্তু তার রসিকতার মাঝে নেতৃত্বসুলভ এক গাম্ভীর্য ছিল। তার কথা সবাই মানতে বাধ্য হত। তার পোশাক বলতে ছিল একটা ঢিলা পায়জামা, আর একটা শার্ট। হাতে ছিল একটা ছড়ি আর মুখে একটা চুরুট। তার সঙ্গীরা বলাবলি করত, ওই পায়জামা পরলে থোলোমোয়েসকে সত্যিই অসাধারণ দেখায়।

ফাঁতিনে ছিল আনন্দের প্রতিমূর্তি। তার সাদা সুন্দর দাঁতগুলো যেন হাসির জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। তার হাতে সব সময় থাকত সাদা ফিতেওয়ালা একটা খড়ের তৈরি বনেট। তার মাথায় সোনালি চুলের রাশগুলো প্রায়ই ছড়িয়ে পড়ত মাথার চারদিকে। তার ঠোঁট দুটো সব সময় ভোলা থাকত আনন্দের আবেগে। তার মুখের কোণ দুটো যেমন একদিকে কোনও উদ্ধত যুবকের অগ্রপ্রসারী প্রেমোচ্ছ্বাসকে আহ্বান করছিল অন্যদিকে তেমনি তার চোখের বড় বড় অবনত পাতাগুলো এক অব্যক্ত বিষাদ ছড়িয়ে সেই ঔদ্ধত্যকে খর্ব করার প্রয়াস পাচ্ছিল। তার পোশাক ও বেশভূষার মধ্যে একই সঙ্গে এক মিষ্টি গানের ছন্দ আর শীতল আগুনের শিখা অদৃশ্য অবস্থায় বিরাজ করছিল অপর তিনজনের পোশাক মাঝামাঝি ধরনের ছিল। তাতে কোনও পারিপাট্যের আতিশয্য ছিল না। সব মিলিয়ে ফাঁতিনের চেহারাটার মধ্যে একই সঙ্গে এক সংযমের শাসন আর উদ্ধত প্রেমের ছলনা লুকিয়ে ছিল। অনেক সময় মানুষের নির্দোষিতার মূলে থাকে কৃত্রিমতার একটা প্রয়াস, জোর করে ভালো হবার একটা সচেতন চেষ্টা।

হাসিখুশিতে উজ্জ্বল মুখ, সুন্দর চেহারা, ভারী ভারী পাতাওয়ালা নীল চোখের গভীর চাউনি, ঈষৎ ধনুকের মতো বাঁকা পা, সুঠাম গঠন, সাদা ধবধবে গায়ের মাঝে দু’একটা নীল শিরার উঁকিঝুঁকি, যৌবনলাবণ্যপুষ্ট গাল, ঈজিয়ার জুনোর মতো ঋজু ঘাড়, জামার ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাওয়া কোনও এক নামকরা ভাস্করদের গঠিত মূর্তির মতো সুন্দর দুটো কাঁধ–এই হল ফাঁতিনের দেহের মোটামুটি বিবরণ। আত্মসচেতনতার দ্বারা সংযত, আনন্দোশ্রুল্লতায় সঞ্জীবিত এক সুন্দর প্রতিমা।

আত্মসচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হলেও নিজের সৌন্দর্য সম্বন্ধে কোনও অহঙ্কার ছিল না ফাঁতিনের। কোনও সৌন্দর্যের উপাসক যিনি সকল দেহসৌন্দর্যের মধ্যে এক নিখুঁত পরিপূর্ণতার সন্ধান করেন তিনি হয়তো ফাঁতিনেকে দেখে তার চেহারার মধ্যে কোনও কোনও খুঁত ধরার চেষ্টা করবেন। আবার তিনি হয়তো তার মধ্যে এক প্রাচীন সৌন্দর্যরীতি ও সামঞ্জস্যের সুষমা খুঁজে পাবেন। সৌন্দর্যের দুটি দিক আছে–রূপাবয়ব আর ছন্দ। রূপাবয়ব হচ্ছে আদর্শ আঙ্গিক বা আধার, আর ছন্দ হচ্ছে গতি।

আমরা আগেই বলেছি ফাঁতিনে ছিল আনন্দের প্রতিমূর্তি। কিন্তু সেই সঙ্গে শালীনতাবোধ, নারীসুলভ গুণশীলতারও কোনও অভাব ছিল না তার মধ্যে। কেউ যদি খুঁটিয়ে তাকে দেখত তা হলে বুঝতে পারত তার যৌবনের উন্মাদনার অন্তরালে নববসন্ত আর ফুল্লকুসুমিত এক প্রেমের ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আত্মস্বাতন্ত্রের এক অজেয় দুর্গও ছিল। জীবনে প্রথম প্রেমের ঘটনায় সে ক্ষণে ক্ষণে অনুভব করত এক অপার বিস্ময়ের চমক আর নির্দোষিতাজনিত এক অবুঝ আশঙ্কা, যে আশঙ্কার দ্বারা সাইককে ভেনাস থেকে সহজে পৃথক করা যায়। তার সরু সরু লম্বা আঙুলগুলো যেন কোনও কুমারী সন্ন্যাসিনীর মালার জপ করার ভঙ্গিতে মৃদু সঞ্চালিত হত, মনে হত সেগুলো যেন এক পবিত্র অগ্নিশিখার অন্তরালে ভস্মাচ্ছাদিত এক একটি স্বর্ণদণ্ড। যদিও থোলোমায়েসকে তার অদেয় কিছুই ছিল না, তবু সে মাঝে মাঝে যখন গম্ভীর হয়ে উঠত, যখন সংযমশাসিত কুমারীত্বের কঠোর একটা ভাব ফুটে উঠত তার চোখে-মুখে, গভীর অনমনীয় এক আত্মমর্যাদাবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলত তাকে, যখন তার যৌবনজীবনের সকল আনন্দোচ্ছলতা ত্যাগ আর আত্মনিগ্রহের অগ্রপ্রসারী আক্রমণে অভিগ্রস্ত হয়ে পড়ত সহসা তখন দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উঠত যে কেউ। সেই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হত সে যেন রোষকষায়িতলোচনা নিষ্করুণ কোনও দেবী। তখন তার কপাল, নাক ও চিবুকে এমন সব রেখা ফুটে উঠত যাতে তার সমগ্র মুখমণ্ডলের ভারসাম্য নষ্ট হত, আর সঙ্গে সঙ্গে তার নাক আর উপরকার ঠোঁটের মাঝখানে অপরিদৃশ্যপ্ৰায় এমন এক সুন্দর কুঞ্চন দেখা দিত যা সতীত্বের এক দুর্বোধ্য নিদর্শন, যা দেখে একদিন, আইকোনিয়ামের ধ্বংসাবশেষের মাঝে বার্বাডোসা ডায়েনার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছিল।

অনেক সময় ভালোবাসা ভুল হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু ফাঁতিনের নিষ্পাপ মনের সততা সে ভুলকে অতিক্রম করে চলছিল স্বচ্ছন্দে।

.

সেদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত উজ্জ্বল সূর্যালোকের প্লাবন বয়ে যেতে লগাল। মনে হচ্ছিল সমস্ত প্রকৃতি যেমন ছুটির আনন্দে ঢলে পড়েছে। সেন্ট ক্লাউডের প্রান্তর থেকে ফুলের গন্ধ ভেসে আসছিল। নদীতীরের বাতাসে গাছপালার শাখাগুলো দুলছিল। মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছিল ফুলে ফুলে। যুঁই, ওট, মিলকয়েল প্রভৃতি ফুলের উপর প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছিল দল বেঁধে। এদিকে ফ্রান্সের রাজার পার্কটাকে কোথা থেকে একদল যাযাবার পাখি এসে দখল করে বসেছিল।

প্রকৃতির এই সুন্দর পরিবেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল যেন আটজন যুবক-যুবতী। তারা নাচছিল, গান করছিল, প্রজাপতিদের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছিল, বনফুল তুলে আনছিল, যখন-তখন এ ওকে চুম্বন করছিল। একমাত্র ফাঁতিনে ছিল এর ব্যতিক্রম। এক সলজ্জ স্বপ্নবরণের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে সে হয়তো তার প্রেমের কথা ভাবছিল। ফেবারিতে তাকে একবার বলল, তুমি কারও পানে না তাকালেও তোমাকে সবাই সব সময় দেখে।

এই হল জীবনের আনন্দ। ক্ষণপ্রণয়িত এক আনন্দের তাৎক্ষণিক আবেশে মত্তবিভোর চারজোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা পর্যাপ্ত আলো আর উষ্ণতায় মণ্ডিত এক উদার প্রকৃতির প্রাণবন্ত আহ্বানে সাড়া দিতে ছুটে এসেছে এখানে। হয়তো কোনও বিস্মৃত অতীতে কোনও এক পরী এইসব মাঠ-বনকে শুধু যুবক-যুবতীর অন্তরের সামনে নিজেদের উন্মুক্ত করে দেবার জন্য আদেশ দিয়ে গেছে। সেই পরীকে অশেষ ধন্যবাদ, তার জন্যই আজও মুক্ত আকাশের তলে বৃক্ষছায়া দ্বারা আলিঙ্গিত প্রান্তরে প্রেমিক-প্রেমিকারা দল বেঁধে ছুটে আসে। যতদিন আকাশ, প্রান্তর আর গাছ থাকবে, যতদিন নীল আকাশ থেকে অবারিত আলোর চুম্বন ঝরে পড়বে এই প্রান্তরে, যতদিন এইসব বৃক্ষরাজি তাদের স্পর্শশীতল ছায়ার দ্বারা আলিঙ্গন করবে এইসব প্রান্তরকে ততদিন এখানে ছুটে আসবে এই ধরনের প্রেমিক-প্রেমিকার অসংখ্য দল।

এইজন্যই হয়তো বসন্তকালের এত জনপ্রিয়তা। সামন্ত থেকে বালকভৃত্য, জমিদার থেকে চাষি-ক্ষেতমজুর, সভাসদ থেকে সাধারণ শহরবাসী সকলেই এই বসন্তরূপ মায়াবিনী পরীর দ্বারা বিছিয়ে দেওয়া মোহের আবেশে আচ্ছন্ন হয়। কোর্টের সামান্য মুহুরিও যেন স্বর্গের দেবতা হয়ে ওঠে। তারা হাসির স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়, বাতাসের মধ্যে কিসের যেন খোঁজ করে বেড়ায় পাগলের মতো, যেন এক রহস্যময় রূপান্তর ঘটে তাদের প্রেমবিগলিত অন্তরে। ঘাসের উপর হৈ-হুল্লোড় করতে করতে ছুটে বেড়ানো, পরস্পরের কোমর ধরাধরি করা, গানের ছন্দভরা অর্ধস্ফুট কথার গুঞ্জন, পরস্পরের মুখে মুখে চেরি ফলের আনাগোনা আরও কত কী যে সব করে তারা, তার ইয়ত্তা নেই। এই সময় মেয়েরা হাসিমুখে বিলিয়ে দেয় নিজেদের এবং ভাবে এই সুখ চিরস্থায়ী হবে। দার্শনিক, কবি ও শিল্পীরা প্রেমিক-প্রেমিকাদের এই উন্মাদসুলভ আবেগ আর আচরণের একটা মানে খোঁজার চেষ্টা করেন, কিন্তু বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে যান। লানস্ৰেত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষদেরও আকাশে উড়তে দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। দিদেররা সব হালকা প্রেমকেই দু হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানান।

আটজন যুবক-যুবতী প্রাতরাশের পর রাজার বাগান দেখতে গেল। সে বাগানে ভারত থেকে একটি বিরল গাছের চারা এসেছে। তার নামটা ভুলে গিয়েছি। তা দেখার জন্য সমস্ত প্যারিসের লোক ভিড় করেছে সেন্ট ক্লাউডে। গাছটা লম্বা একটা সুন্দর ঝোঁপের মতো দেখতে যার কোনও ডালপালা বা পাতা নেই, যার সুতোর মতো শাখাগুলোতে ছোট ছোট সাদা ফুল ফোটে। মনে হয় সাদা ফুলে ভরা একমাথা চুল। একরাশ মুগ্ধ জনতার ভিড় গাছটাকে ঘিরে ছিল সব সময়।

থোলোমায়েস প্রস্তাব করল, গাধার পিঠে চড়ে খানিকটা বেড়াব আমরা।

তখন কয়েকটা গাধা জোগাড় করে বানব্রে থেকে আইসি গেল ওরা।

আইসিতে একটা ঘটনা ঘটল। পার্কের মতো যে ঘেরা বাগানটা ওরা দেখতে গেল সেটা তখন সৈন্যবিভাগের খাবার পরিবেশনকারী কুঁগুই-এর অধীনে ছিল। বাগানের লোহার গেটটা তখন ভোলা ছিল। ওরা গেট দিয়ে পার্কের মধ্যে প্রথমে অ্যাঙ্কোরিতের প্রতিমূর্তিটা দেখল। তার পর সেই বিখ্যাত আয়নার ঘরটা দেখল যে ঘরে ঢুকলে সবারই মুখগুলো বিকৃত দেখায়। এরপর ওরা বাদামগাছে ঘেরা বড় দোলনাটায় পালাক্রমে দুলল। দোলনায় দুলবার সময় হাসিতে ফেটে পড়ছিল ওরা। তুলু থেকে আসা থোলোমায়েসের স্বভাবটায় স্প্যানিশ ভাবটা তখনও পুরোমাত্রায় ছিল। সে মনের সুখে একটা গান ধরল। গানটার অর্থ হল, আমি বাজাজ থেকে এসেছি। প্রেমই আমায় ডেকে এনেছে এখানে। আমার আত্মা এখন আমার চোখের তারায় এসে ফুটে উঠেছে, কারণ তুমি তোমার পা দেখাচ্ছ আমায়।

একমাত্র ফাঁতিনেই দোলনায় দুলল না।

ফেবারিতে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, আমি কোনও লোকের অহঙ্কার দেখতে পারি না।

গাধায় চড়ার শখ মিটলে ওরা একটা নৌকো ভাড়া করে পাসি থেকে ব্যারিয়ের দ্য লেতয়েনে গেল। ওরা সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে সারাদিন এখানে-ওখানে ছোটাছুটি করছে। তবু ওরা ক্লান্ত হয়ে ওঠেনি। ফেবারিতে বলল, রবিবারে ক্লান্তি বলে কোনও কথা নেই। রবিবারে কেউ ক্লান্ত হয় না কখনও। ওরা রু বুর্জোর উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দূরে গাছপালার মাথায় শ্যাম্প এলিনার চূড়াটা দেখতে পেল।

ফেবারিতে মাঝে মাঝে বলছিল, কিন্তু সেই বিস্ময়ের চমকটা কোথায়?

থোলোমায়েস বলল, তোমাদের ধৈর্য ধরতে হবে।

.

পাহাড়ের চূড়োয় উঠতে গিয়ে এবার ওরা কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তখনও ওদের দুপুরের খাওয়া হয়নি। এবার ওরা সবাই খাবার কথা বলতে লাগল। তখন ওরা শ্যাম্প এলিসি’র বিখ্যাত রেস্তোরাঁ বম্বার্দার একটি শাখা হোটেল ক্যাবারে বম্বার্দায় খেতে গেল। হোটেলটা ছিল র‍্যু দ্য রিভেলিতে।

সেদিন রবিবার বলে হোটেলটায় ছিল দারুণ ভিড়। সব ঘর লোকে ভর্তি। ওরা একটা বড় অপরিচ্ছন্ন ঘর পেল। ঘরটার একপ্রান্তে পার্টিশান করা একটা ছোট ঘর ছিল। তার মধ্যে একটা বিছানা ছিল। ঘরের মধ্যে দুটো টেবিলের ধারে কয়েকটা চেয়ার ছিল। ওরা চারজন সেই চেয়ারগুলোতে বসল। দুটো ভোলা জানালা দিয়ে এলম গাছের ফাঁক দিয়ে নদী দেখতে পেল ওরা। তখন আগস্ট মাস। বিকাল সাড়ে চারটে বাজে। সূর্য সবেমাত্র অস্ত যেতে শুরু করেছে। টেবিলের উপর খাবার ও মদ দেওয়া হল। প্রচুর হৈ-হুল্লোড় করতে লাগল ওরা।

শ্যাম্প এলিসিতে তখনও সূর্যের আলো ছিল। জনাকীর্ণ পথে ধুলোর ঝড় উঠছিল। পথে অনেক ঘোড়ার গাড়ি যাওয়া-আসা করছিল। অ্যাভেনিউ দ্য নিউলি দিয়ে একদল সৈন্য চলে গেল। তাদের সামনে একদল বাদক জয়ঢাক বাজিয়ে যাচ্ছিল। তুলিয়েরের প্রাসাদের চূড়ার উপর উড়তে থাকা সাদা পতাকাটা অস্তম্লান সূর্যের ছটায় গোলাপি দেখাচ্ছিল। প্লেস দে লা কঙ্কর্দে তখন লোকের দারুণ ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে অনেকে কোটের বোতামে সাদা ফিতেয় জড়ানো রুপোর ফুল খুঁজে বেড়াচ্ছিল। এখানে-সেখানে একদল করে ছোট ছোট মেয়ে দর্শকদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে বুর্বন গাইছিল।

রবিবারের পোশাক পরা অনেক শ্রমিক বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে ভিড় করেছে শহরের পথে। তাদের অনেকে মদ পান করছিল, কেউ কেউ ঘোড়ায় চেপে বেড়াচ্ছিল। সকলেই হাসিখুশিতে মেতে উঠেছিল। তখন দেশে শান্তি বিরাজ করছিল। রাজতন্ত্রীদের পক্ষে সময়টা ছিল বেশ নিরাপদ। পুলিশের বড়কর্তা কাউন্ট অ্যাঙ্গলে রাজার কাছে প্যারিসের শ্রমিক ও সাধারণ জনগণ সম্বন্ধে এক গোপন রিপোর্ট পেশ করেন। সে রিপোর্টে বলা হয়, মহাশয় সব দিক বিবেচনা করে দেখলে বোঝা যায়, এইসব জনগণ থেকে ভয়ের কিছু নেই। তারা যেমন উদাসীন তেমনি বিড়ালের মতো অলস। গ্রামাঞ্চলের নিচের তলায় মানুষরা কিছুটা বিক্ষুব্ধ আছে, কিন্ত প্যারিসের জনগণের মধ্যে কোনও বিক্ষোভ নেই। তাদের চেহারাগুলোও বেঁটেখাটো এবং তারা দু জনে একজন পুলিশের সমকক্ষ হতে পারে। রাজধানী প্যারিসের শ্রমিকশ্রেণির কাছ থেকে আমাদের ভয়ের কিছু নেই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই যে, গত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে প্যারিস ও শহরতলির জনগণের চেহারা বিপ্লবের আগে যা ছিল তার থেকে অনেক খারাপ হয়ে গেছে। তারা মোটেই বিপজ্জনক নয়। এক কথায় তারা বড় উদাসীন, কোনও কিছুরই খেয়াল রাখে না।

কিন্তু কোনও পুলিশের বড়কর্তাই বিশ্বাস করে না যে বিড়ালও সিংহ হতে পারে। পুলিশের বড় কর্তারা যাই বলুক প্যারিসে অনেক কিছুই ঘটে। এটাই হচ্ছে প্যারিসের জনমতের রহস্য। তাছাড়া কিছুকাল আগে প্রজাতন্ত্রীরা এই বিড়ালদেরই স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক হিসেবে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। এই ধরনের এক বিড়ালেরই এক বিরাট ব্রোঞ্জমূর্তি কোরিনথের মেন স্কোয়ারে পিরেউসের মিনার্ভার মূর্তির অনুকরণে দাঁড়িয়ে আছে। রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর পুলিশ প্যারিসের জনগণ সম্বন্ধে অতিমাত্রায় আশাবাদী হয়ে ওঠে। কিন্তু প্যারিসের সাধারণ জনগণ মোটেই ঢিলেঢালা বা উদাসীন প্রকৃতির নয়। ফরাসিদের কাছে প্যারিসের অধিবাসীরা গ্রিকদের কাছে এথেন্সের জনগণের মতো। উপর থেকে তাদের দেখে মনে হবে তাদের মতো এত ঘুমোতে কেউ পারে না, কেউ এত তাদের মতো উচ্ছৃঙ্খল এবং অলস প্রকৃতির নয়। কিন্তু এ ধারণা স্পষ্ট ভ্রান্ত। তারা উদাসীনও উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে। কিন্তু যখন কোনও বৃহত্তর গৌরব অর্জনের জন্য তাদের ডাক পড়বে তখন এক প্রচণ্ড সংগ্রামশীলতায় আশ্চর্য ও অভাবনীয়ভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠবে তারা। প্যারিসের কোনও একটা লোক হাতে একটা বর্শা পেলে সে ১০ আগস্টের যুদ্ধের অবতারণা করতে পারে আর যদি সে একটা বন্দুক পায় তা হলে অস্টারলিৎসের যুদ্ধ বাধিয়ে তুলতে পারে। এই প্যারিসের লোকই ছিল নেপোলিয়ঁনের সাম্রাজ্য বিস্তারের মূল শক্তি, তারাই ছিল বিপ্লবী দাঁতনের মূল ভিত্তি। লা পার্টির ডাকে তারা সেনাবিভাগে যোগ দেয় দলে দলে। স্বাধীনতার ডাকে তারা পদভরে রাজপথ ও ফুটপাতগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। সুতরাং সাবধান। রাগে তাদের মাথার চুল একবার খাড়া হয়ে উঠলে তারা এক মহাকাব্যসুলভ বীরত্ব লাভ করে, তাদের সামান্য জামাগুলো গ্রিক বীরের সামরিক পোশাক বা বর্মে পরিণত হয়। তাদের গণ-অভ্যুত্থান গদিন কোর্কের যুদ্ধের রূপ নেয়। যুদ্ধজয়ের ঢাকের শব্দে শহরের অলি-গলিতে বাস করা অধিবাসীরা এক মহাশক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। বেঁটেখাটো লোকগুলোর চোখের দৃষ্টি ভয়ঙ্কর ভাব ধারণ করে। তাদের সংকীর্ণ বুকগুলো থেকে বেরিয়ে আসা নিঃশব্দ নিশ্বাসগুলো এক মত্ত প্রভঞ্জনের রূপ পরিগ্রহ করে দিগন্তপ্রসারী আল্পস পর্বতের চূড়াটাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চায়। প্যারিসের এইসব ছোটখাটো লোকগুলোকে ধন্যবাদ, এদের দ্বারা সংঘটিত বিপ্লবই সেনাবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করে সারা ইউরোপ জয় করে একদিন। তারা যুদ্ধের গানে আনন্দ পায়। সে গানের সুর আর ছন্দ তাদের প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খায়। কারমাগনোল’ গান গেয়ে তারা যোড়শ লুই-এর সিংহাসন উল্টে দেয় আর মার্সেলাই’ গান গেয়ে সারা পৃথিবীকে মুক্ত করতে পারে।

কোঁতে অ্যাঙ্গলের এই রিপোর্টের কথা বলে আমরা সেই আটজন যুবক-যুবতীর কাছে ফিরে যাব, যাদের আহারপর্ব বম্বার্দা হোটেলে সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছিল।

.

টেবিলের কোনও আলোচনা আর প্রেমিকদের আলোচনা হাওয়ার মতোই অলীক আর বিলীয়মান। প্রেমিকদের আলোচনা বা কথাবার্তা হল কুয়াশা, টেবিলের আলোচনা ক্ষণবিলীন এক সুবাস।

ফেমিউল আর ডালিয়া গুনগুন করে গান গাইছিল। থোলোমায়েস মদ খাচ্ছিল। জেফিনে হো হো করে হাসছিল, আর ফাঁতিনের মুখে ছিল মৃদু হাসি। লিস্তোলিয়েরের হাতে সেন্ট ক্লাউডে কেনা কাঠের যে জয়ঢ়াকটা ছিল সেটা সে বাজাচ্ছিল।

ফেবারিতে তার প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে বলল, ব্ল্যাকিভেল, আমি তোমাকে দারুণ ভালোবাসি।

এ কথায় ব্ল্যাকিভেল এক প্রশ্ন করে বসল, আমি যদি তোমাকে আর ভালো না বাসি তা হলে তুমি কী করবে ফেবারিতে?

ফেবারিতে বলল, আমি? ঠাট্টা করেও এসব কথা বলবে না তুমি। যদি তুমি আমাকে ভালো না বাস তা হলে আমি তোমাকে ছাড়ব না, তোমার পিছু পিছু ঘুরব, আমি তোমাকে মারব। তোমার চোখ দুটো উপড়ে ফেলব; তোমাকে গ্রেপ্তার করাব।

ব্ল্যাকিভেল যখন কথাটা শুনে পুরুষোচিত অহঙ্কার আর আত্মতৃপ্তির হাসি হাসছিল, ফেবারিতে তখন আবার বলল, তুমি কী ভেবেছ, অসভ্য কোথাকার! আমি চেঁচামিচি করব, পাড়ার সব লোককে জাগাব।

ব্ল্যাকিভেল এবার চেয়ারে হেলান দিয়ে আনন্দে চোখে দুটো বন্ধ করে কী ভাবছিল। ডালিয়া তখন খেতে খেতে ফেবারিতেকে চুপি চুপি কী একটা কথা জিজ্ঞাসা করল।

ডালিয়া বলল, সত্যি সত্যিই কি তুমি ওকে ভালোবাস?

ফেবারিতে হাতে কাঁটাটা তুলে নিয়ে তেমনি চাপা গলায় বলল, আমি ওকে মোটেই সহ্য করতে পারি না। ও বড় নীচ। আমি রাস্তার ওপারের একটা ছেলেকে ভালোবাসি। আমি কার কথা বলছি তুমি জান?

তাকে দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে অভিনেতা হওয়ার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে। তার। আমি অভিনেতাদের পছন্দ করি। রোজ রাত্রিতে সে বাড়ি ফিরে বাড়ির ছাদে গিয়ে এত জোরে গান গায় আর আবৃত্তি করে যে নিচের তলার সব লোক তা শুনতে পায়। সে একটা উকিলের কেরানি হিসেবে এখনই রোজ কুড়ি করে রোজগার করে। তার বাসা সেন্ট জ্যাকে একটা দলে সমবেত গান গাইত। ছেলেটা সত্যিই সুন্দর। সে আমাকে এত ভালোবাসে যে একদিন আমি যখন কেক তৈরি করার জন্য ময়দা মাখছিলাম তখন সে আমাকে বলল, তুমি যদি তোমার হাতের দস্তানা ছিঁড়ে দাও তা হলেও আমি তা খাব। একজন শিল্পীই এ কথা বলতে পারে। তার ব্যবহারটা সত্যিই বড় মিষ্টি। আমি তার জন্য পাগল। কিন্তু আমি ব্ল্যাকিভেলকে বলি আমি তাকে ভালোবাসি। আমি ভয়ঙ্কর মিথ্যাবাদী, তাই নয় কি?

ফেবারিতে কিছুক্ষণের জন্য থেমে আবার বলতে লাগল, আমার মনমেজাজ খুব খারাপ ডালিয়া। আমার জীবনে কোনও বসন্ত নেই, আছে শুধু বর্ষার অবিরল ধারা। যেন তার শেষ নেই। ব্ল্যাকিভেলের মনটা বড় ছোট, এদিকে বাজারে সব জিনিসেরই প্রচুর দাম। যেমন ধর মটরদানা, মাখন সব কিছু। যাই হোক, আমরা এখানে এসেছি, খাচ্ছি একটা ঘরে। ঘরের মধ্যে একটা বিছানা আছে। কিন্তু জীবনটা আমার কাছে বিতৃষ্ণ হয়ে গেছে।

.

দলের কেউ কেউ গান গাইছিল, কেউ কেউ আবার জোরে কথা বলছিল। ঘরের ভেতর চলছিল তুমুল হট্টগোল। থোলোমায়েস এবার সকলকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

খোলোমায়েস বলল, এখন শান্ত হয়ে যুক্তির সঙ্গে কথা বল। এখন ভেবে দেখতে হবে জীবনে আমরা বড় হতে চাই কি না। হঠকারীর মতো যা-তা বলাতে আত্মশক্তিরই ক্ষয় হয়। ঘন ঘন মদ খেলে চিন্তাশক্তি বাড়ে না। তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই দ্রমহোদয়গণ, এখন আমাদের এই আমোদ-প্রমোদের সঙ্গে মর্যাদাবোধের সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে, ক্ষুধার সঙ্গে সুবিবেচনার। বসন্তকাল থেকে আমরা একটা শিক্ষা পেতে পারি। বসন্ত যদি খুব তাড়াতাড়ি আসে এবং তাড়াতাড়ি খুব জোর গরম পড়ে যায় তা হলে অনেক ফলের ক্ষতি হয়। নিজের গরমে নিজেই পুড়ে ছারখানা হয়ে যায় বসন্ত। উদ্যমের আতিশয্য সুরুচিকে নষ্ট করে। অতিরিক্ত তাড়াহুড়ো করে খাওয়াও ভালো হয় না। এ বিষয়ে রেনিয়ের আর তালিবাদ একমত।

বাকি সবাই একযোগে প্রতিবাদ করে উঠল।

ব্ল্যাকিভেল বলল, আমাদের বিরক্ত কর না থোলোমায়েস।

ফেমিউল বলে উঠল, অত্যাচারীরা নিপাত যাক, আজ রবিবার।

লিস্তোলিয়ের বলল, আমাদের সকলেরই জ্ঞানবুদ্ধি আছে।

ব্ল্যাকিভেল বলল, হে আমার প্রিয় খোলোমায়েস, আমার শান্ত ভাবটা একবার দেখ।

থোলোমায়েস বলল, তুমি স্বয়ং মার্কুই দ্য মঁতকাম হয়ে উঠেছ।

মঁতকামের মার্কুই ছিলেন সে যুগের এক প্রখ্যাত রাজতন্ত্রবাদী। কথাটা ঠাট্টার ছলে বললেও তাতে কাজ হল। ব্যাঙডাকা কোনও জলাশয়ে ঢিল ছুঁড়লে যেমন ব্যাঙগুলো একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়, তেমনি সবাই চুপ করে গেল।

থোলোমায়েস শান্ত কণ্ঠে নেতা হিসেবে তার প্রভুত্বকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য বলতে লাগল, শান্ত হয়ে আরাম করে বস বন্ধুগণ। ঠাট্টার ছলে যে কথাটা মুখ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে গেছে সেটাকে আর ধরো না। আকাশ থেকে ঝরে পড়া এইসব তুচ্ছ কথাগুলোকে কোনও গুরুত্ব দিতে নেই। ঠাট্টা-তামাশা হচ্ছে পলায়মান আত্মা থেকে ঝরে পড়া এক বস্তু। সেটা যে কোনও জায়গায় পড়তে পারে। তা যেখানেই পড়ুক এইসব চটুল রসিকতার বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মা তখন আকাশে উঠতে থাকে। পাহাড়ের মাথার উপর একটা সাদা দাগ দেখলে ঈগল কখনও তার উড়ে চলার কাজ। বন্ধ করে না। আমি যে ঠাট্টা বা রসিকতা ঘৃণা করি তা নয়। তাদের যেটুকু মূল্য আছে। আমি শুধু সেইটুকুই তাকে দিতে চাই; তার বেশি নয়। মানবজাতির মধ্যে অনেক মহাপুরুষ ও মহাজ্ঞানী ব্যক্তিরাও রসিকতা করতেন মাঝে মাঝে। যিশু একবার পিটারকে নিয়ে তামাশা করেছিলেন। মোজেস একবার আইজাককে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন। এসকাইলাস পলিনিয়েস আর ক্লিওপেট্রা অক্টেভিয়াসকে নিয়েও তামাশা করেছিলেন। তবে আমরা দেখতে পাই অ্যাক্টিয়ামের যুদ্ধের আগে ক্লিওপেট্রা এই ঠাট্টার কথাটা না বললে আমরা তোরিনা নগরের কথাটা কেউ মনে রাখতাম না। তোরিনা শব্দটা এসেছে একটা গ্রিক শব্দ থেকে যার অর্থ হল কাঠের চামচ। যাই হোক, আমরা আবার আমাদের মূল কথায় ফিরে যাই। হে আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আমি আবার বলছি, কোনও হৈ-হুল্লোড় বা হট্টগোল নয়, কোনও আতিশয্য বা উচ্ছৃঙ্খলতা, চপলতা নয়। আনন্দোৎসবের মত্ততায় আমাদের জ্ঞানবুদ্ধিকে বিসর্জন দিলে চলবে না। আমার কথা শোন, আমার কাছে অ্যাফিয়ারাসের বিজ্ঞতা আর বুদ্ধি আর সিজারের টাক। ঠাট্টা-তামাশা আর খাওয়া-দাওয়ারও একটা সীমা থাকা উচিত। মেয়েরা, তোমরা। আপেল ভালোবাস, কিন্তু এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। এখানেও সুমতি আর কলাকৌশলের ভূমিকা আছে। গোগ্রাসে সব কিছু গিলে অতি ভোজন করলে শাস্তি পেতে হয়। পাকস্থলীর ওপর নীতিবোধ চাপিয়ে দেবার জন্যই ঈশ্বর অজীর্ণ রোগের সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং মনে রেখো, আমাদের সব আবেগানুভূতির, এমনকি প্রেমাবেগেরও একটা পাকস্থলী বলে জিনিস আছে যার গ্রহণক্ষমতার একটা সীমা আছে। যথাসময়ে সবকিছুর শেষে আমাদের ইতি’ লিখে দেওয়া উচিত। সংযমের রশ্মি দিয়ে কামনার বেগ। প্রবল হয়ে উঠলে তাকে টেনে ধরা উচিত। ক্ষুধার দরজা সময়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। অবস্থাবিশেষে আমরা অসংযত হয়ে উঠলে আমাদের নিজেদেরই বন্দি বা গ্রেপ্তার করা উচিত। যিনি কোন সময়ে কী করা উচিত সেটা জানতে পারেন তিনিই যথার্থ জ্ঞানী। আমার ওপর আস্থা স্থাপন করতে পার, কারণ আমি কিছুটা আইন পড়েছি, অন্তত পরীক্ষার ফল তাই বলে। কখন কী করতে হবে বা বলতে হবে তা আমি জানি। প্রাচীন রোমে পীড়নের পদ্ধতি সম্পর্কে আমি লাতিন ভাষায় এক গবেষণামূলক তত্ত্ব রচনা করেছি। আমি অল্পদিনের মধ্যে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করব। সুতরাং এর থেকে বোঝা যাবে আমি একেবারে অপদার্থ নই। আমি চাই তোমরা কামনা-বাসনার দিক থেকে নরমপন্থী হও এবং আমার মতে এটাই বিজ্ঞজনোচিত পরামর্শ। সেই মানুষই সুখী যে যথাসময়ে বীরের মতো কোনও জায়গায় প্রবেশ করে, আবার সময় হলে চলে যায়।

গভীর মনোযোগের সঙ্গে কথাগুলো শুনছিল ফেবারিতে।

ফেবারিতে বলল, ফেলিক্স নামটা কী সুন্দর! ফেলিক্স শব্দটা লাতিন। এর মানে হচ্ছে সুখী।

থোলোমায়েস আবার বলতে লাগল, বন্ধুগণ, তোমরা কি কামনার দংশন থেকে মুক্তি পেতে চাও? তোমরা বাসরশয্যা বাতিল করতে চাও অথবা কুটিল প্রেমের ছলনাকে পরিহার করতে চাও? তা হলে তা সহজেই করতে পারবে। এটাই হল ব্যবস্থাপত্র। বিরামহীন বিদ্রি শ্রমের মধ্য দিয়ে তোমাদের নিজেদের ক্ষয় হয়ে যেতে হবে, আহার। নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় উপবাসে জীবন কাটাতে হবে, সামান্যতম পোশাক পরতে হবে আর ঠাণ্ডা জলে স্নান করতে হবে।

লিস্তোলিয়ের বলল, আমি কিছুদিনের মধ্যেই এক নারীকে লাভ করব।

থোলোমায়েস আবেগে চিৎকার করে উঠল, নারী! নারী থেকে সাবধান! নারীদের চটুল চঞ্চল অন্তরকে যারা বিশ্বাস করে তারা জাহান্নামে যাক। নারীরা হচ্ছে অবিশ্বস্ত এবং চঞ্চল প্রকৃতির। সে সাপকে তার প্রতিদ্বন্দিনী ভেবে ঘৃণা করে, অথচ সেই সাপ তার সামনের বাড়িতেই থাকে।

ব্ল্যাকিভেল বলল, থোলোমায়েস, তুমি মাতাল হয়ে পড়েছ।

হয়তো তাই।

তা হলে অন্তত আনন্দ কর।

গ্লাসে মদ ঢেলে উঠে দাঁড়িয়ে থোলোমায়েস বলল, ঠিক আছে। মদের জয় হোক। মেয়েরা, আমাকে ক্ষমা করবে। স্পেনদেশীয় রীতি। মদই মানুষকে নাচায়। শোন। ভদ্রমহিলারা, বন্ধুর একটা উপদেশ শোন। ইচ্ছে হলেই তোমার প্রেমের অংশীদার পরিবর্তন করতে পার। ইংরেজ নারীদের মতো কোনও নারীর অন্তরে আবব্ধ হয়ে থাকার জন্য প্রেমের জন্ম হয়নি, এক বাধাহীন গণ্ডিহীন আনন্দ চঞ্চলতায় অন্তর থেকে অন্তরে ঘুরে বেড়াবার জন্যই প্রেমের সৃষ্টি হয়েছে। ভুল করাই মানুষের কাজ, এটা প্রবাদের কথা। আমি বলি ভালোবাসা মানেই ভুল করা। ভদ্রমহিলাগণ, আমি তোমাদের প্রত্যেককেই শ্রদ্ধা করি। জেফিনে, জোশেফাইন, তোমরা একটু কম কটুভাষিনী হলে এবং ক্রোধের অভিব্যক্তিটা একটু কম হলে তোমরা আরও বেশি মনোহারিণী হয়ে উঠতে পারতে। আর ফেবারিতে, একদিন ব্ল্যাকিভেল যখন রু্য গেরিন বয়সের একটা রাস্তা পার হচ্ছিল তখন সাদা মোজাপরা একটি মেয়ে তাকে পা দেখাল এবং তাতে এত আনন্দ পায় যে মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলে সে। ফেবারিতে, তোমার ঠোঁট দুটো গ্রিক ভাস্কর্যের মতো। একমাত্র ইউফোরিয়ন যে চিত্রকর শুধু ঠোঁটের ছবি আঁকায় নাম করে সে-ই তোমার মুখের ছবি ঠিকমতো আঁকতে পারত। তোমার আগে আর কোনও মেয়ে ওই নামের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারেনি। ভেনাসের মতো তোমাদের আপেল দাবি করা উচিত আর ইভের মতো তোমাদের সে আপেল খেয়ে ফেলা উচিত। এইমাত্র তুমি আমার নামের কথা বলেছিলে এবং আমি তাতে কিছুটা অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু নামের শব্দার্থগুলো বড় ছলনাময়। আমার নাম ফেলিক্স, কিন্তু আমি সুখী নই। শব্দগুলো মিথ্যাবাদী, তাদের কথা বিশ্বাস করা উচিত নয়। মিস ডালিয়া, আমি যদি তুমি হতাম তা হলে আমি নিজেকে গোলাপ বলে চালাতাম। ফুলের যেমন গন্ধ থাকা উচিত, মেয়েদের তেমনি গুণ থাকা উচিত। ফাঁতিনে সম্বন্ধে আমি কিছু বলতে চাই না। সে বড় স্বপ্নালু আর সূক্ষ্ম চেতনাসম্পন্ন। তার চেহারাটা পরীর মতো হলেও তার অবনত বিষাদগ্রস্ত চোখ দুটো সন্ন্যাসিনীর মতো। শ্রমজীবিনী হলেও স্বপ্নের আয়নার মধ্যে ডুবে থাকে মনে মনে। সে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে গান করে, প্রার্থনা করে, কিন্তু কী দেখে কী করে তা সে নিজেই জানে না। সে এমন এক বাগানে প্রায়ই চলে যায় যেখানে এত পাখি আছে যে বাস্তব কোনও জীবন বা জগতে তা নেই। আমি কী বলছি শোন ফাঁতিনে, আমি থেলোমায়েস, একটা মায়া মাত্র… কিন্তু সে শুনছে না, তার সোনালি স্বপ্নের মধ্যে ডুবে আছে। তার মধ্যে সব কিছুই সবুজ, সজীব, মেদুর, যৌবন আর প্রভাতী আলো। ফাঁতিনে, তোমার নাম রাখা উচিত ছিল মার্গারেট অথবা পার্ল। তুমি যেমন দূরপ্রাচ্যের ঐশ্বর্যশালিনী কোনও দেশের মেয়ে। আর একটা উপদেশের কথা শোন মেয়েরা, বিয়ে করো না তোমরা। কিন্তু একথা আমি কেন বলছি? কেন আমি আমার নিশ্বাস ক্ষয় করছি? বিয়ে ব্যাপারটাকে মেয়েরা কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারে না। জ্ঞানী ব্যক্তিরা যতই উপদেশ দিন না কেন, মেয়েরা যে কাজই করুক, বা যত গরিবই হোক, তারা শুধু এমন স্বামীর স্বপ্ন দেখে যে হীরে বোঝাই করে এনে তাদের কাছে ঢেলে দেবে। সে যাই হোক, তোমরা বড় বেশি চিনি খাও। তোমাদের যদি কোনও দোষ থাকে তো সে দোষ একটাই। তোমরা শুধু চঞ্চল মিষ্টি বস্তুমাত্র। তোমাদের ঝকঝকে দাঁতগুলো শুধু চিনি খেতে চায়। কিন্তু মনে রেখ, চিনি নুনের মতোই। নুন-চিনি দুটোই বেশি খেলে শরীরটাকে শুকিয়ে দেয়। শিরায় রক্তের চাপ বাড়িয়ে দেয়, রক্তের গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়, রক্তকে জমাট বাঁধিয়ে দেয়। ফুসফুসেতে ঘায়ের সৃষ্টি করে। এইভাবে তা মানুষকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। বহুমূত্র থেকে যক্ষ্মরোগের সৃষ্টি হয়। সুতরাং হে ভদ্রমহিলারা, তোমরা চিনি খেয়ো না, দীর্ঘদিন জীবিত থাক।… এবার আমি পুরুষদের কথা বলব। হে ভদ্রমহোদয়গণ, তোমরা বিজয় অভিযান শুরু কর। তোমরা তোমাদের বন্ধুদের প্রেমিকাকে নির্মমভাবে ছিনিয়ে নাও। ঘুষি বা তরবারি চালিয়ে এগিয়ে যাও–প্রেমের ব্যাপারে বন্ধুত্ব বলে কিছু নেই। যেখানেই সুন্দরী নারী সেখানেই প্রকাশ্য যুদ্ধ, কোনও ক্ষমা নেই। সুন্দরী নারীরাই যত অনর্থের মূল, তারা কীটদষ্ট কুসুমের মতো। নারীর সৌন্দর্যই অনেক ঐতিহাসিক যুদ্ধের কারণ। নারীরা পুরুষদের বৈধ শিকার। যুদ্ধজয়ের পর রোমুলাস মেথাইন নারীদের বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ন্যান্ডির উইলিয়ম বহু স্যাক্সন নারীকে এবং সিজার রোমের বহু নারীকে ধর্ষণ করেন। যারা নিজেরা ভালোবাসা পায় না তারা শকুনির মতো অপরের প্রেমাস্পদের ওপর ভাগ বসাতে চায়। যেসব হতভাগ্য পুরুষের কোনও প্রেমিকা নেই, ইতালির সেনাদলের কাছে বলা বোনাপার্টের একটি কথার পুনরাবৃত্তি করে তাদের বলতে চাই আমি, সৈনিকগণ, তোমাদের কিছুই নেই, অথচ সৈনিকদের সব আছে।

হাঁফ ছাড়ার জন্য থোলোমায়েস একবার থামল। ব্ল্যাকিভেল, লিস্তোলিয়ের আর ফেমিউল একটা বাজে গান ধরল। যে গানের কোনও যুক্তি বা মাথামুণ্ডু নেই, যা মনের মধ্যে কোনও রেখাপাত করতে পারে না, শুধু তামাকের ধোয়ার মতো উড়ে যায়, উবে যায় মুহূর্তে। এ গানের উদ্দেশ্য হল থোলোমায়েসের আবেগটাকে আরও বাড়িয়ে দেওয়া। গ্লাসের মদটা এক চুমুকে শেষ করে আবার তাতে মদ ঢেলে তার কথাটা শেষ করার জন্য আবার বলতে লাগল, জাহান্নামে যাক যত সব জ্ঞান! আমি যা কিছু বলেছি সব ভুলে যাও। আমরা সতী নারী বা পরিণামদর্শী পুরুষ কোনওটাই হব না। আমি চাই শুধু আনন্দের মত্ততা। খাওয়া-দাওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের আলোচনায় জলাঞ্জলি দিয়ে আনন্দ করো। হজম, বদহজম সব চুলোয় যাক। পুরুষরা বিচার চায় আর মেয়েরা ফুর্তি আর আমোদ উৎসব চায়। এই বিশ্বসৃষ্টি কত সুন্দর, কত ঐশ্বর্যমণ্ডিত! কত আনন্দে ভরা এই পৃথিবী। বসন্তের পৃথিবী উজ্জ্বল সূর্যালোকে মুক্তোর মতো চকচক করছে। পথে-ঘাটে পাখির গান ঝরে পড়ছে অবিরল ধারায়। অ্যাভেনিউ দ্য অবজারভেরিতে কত সুন্দরী ধাত্রীরা শিশুদের দিকে অজানা দৃষ্টি রেখে স্বপ্নবিষ্ট হয়ে বসে আছে। আমার অন্তরাত্মা পাখির মতো

অনাবিষ্কৃত কোনও অরণ্যে অথবা নির্জন সাভানা অঞ্চলে উড়ে যেতে চায় যেখানে সব। কিছুই সুন্দর, সব কিছুই মনোরম। মাছিরা ঝাঁক বেঁধে সেখানে সূর্যের আলোয় উড়ে বেড়ায়, যে সূর্যের আলো থেকে অনেক সঙ্গীতমুখর পাখির জন্ম হয়। আমাকে চুম্বন করো ফাঁতিনে।

কিন্তু অন্যমনস্কভাবে সে ফেবারিতেকে চুম্বন করল।

.

জেফিনে বলল, এ হোটেলে থেকে ইডনের খাবার ভালো।

ব্ল্যাকিভেল বলল, আমি বম্বার্দাকে বেশি পছন্দ করি। পরিবেশটা বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। নিচের তলায় দেয়ালগুলোতে আয়না আছে।

ফেবারিতে বলল, আমি শুধু দেখতে চাই আমার প্লেটে কী খাবার দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু এখানকার কাঁটাচামচগুলো দেখ। হাতলগুলো সব রুপোর। ইডনে এগুলো হাড়ের।

থোলোমায়েস জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী দেখছিল।

ফেমিউল তাকে বলল, থোলোমায়েস, লিস্তোলিয়েরের সঙ্গে আবার ঝগড়া হচ্ছে।

থোলোমায়েস বলল, বিবাদ ভালো, তবে ঝগড়া আরও ভালো।

ফেমিউল বলল, আমরা দর্শনের একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেকার্তে ও স্পিনোতার মধ্যে তুমি কাকে পছন্দ করো?

থোলোমায়েস বলল, আমি পছন্দ করি বিখ্যাত ক্যাবারে গায়ক দেসজিয়েতকে।

এরপর বিচারের পর রায়দানের ভঙ্গিতে সে বলতে লাগল, আমি বাঁচতে চাই। এখনও পৃথিবীর পরমায়ু শেষ হয়নি, সুতরাং এখনও আমরা বাজে কথা বলে ফুর্তি করতে পারি। আর এই ফুর্তির জন্য অমর দেবতাদের ধন্যবাদ দিই আমি। আমরা মিথ্যা কথা বলি, তবু হাসি। আমরা কোনও কিছু মেনে নিয়েও তাতে সংশয় পোষণ করি। চমৎকার। ন্যায়মূর্তির আশ্রয়বাক্য থেকে অপ্রত্যাশিত অনেক কিছু অনেক সময় বেরিয়ে আসে। পৃথিবীতে এখনও এমন অনেক লোক আছে যারা বিস্ময়ের চমকে ভরা বৈপরীত্যের বাক্স খুলে বা বন্ধ করে অনেকখানি আনন্দ পায়। হে মহিলাগণ, তোমরা এখন যে মদ পান করছ শান্তিতে তা এখানকার সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তিনশো সত্তর মাইল দূরে কোরাল দ্য ফ্রেইরার আঙুরক্ষেতে তৈরি হয় এবং সেখান থেকে চালান আসে। একবার ভেবে দেখ, তিনশো সত্তর মাইল দূর থেকে এই বম্বার্দা হোটেলে যে মদ আসে তা লিটারপ্রতি সাড়ে চার ফ্রাঁতে এখানে বিক্রি হয়।

ফেমিউল প্রতিবাদ করে কী বলতে গেল। সে বলল, থোলোমায়েস, তুমি নেতা, তোমার মতই আইন। কিন্তু তুমি কি ভেবে দেখেছ–

ঘোলোমায়েস সে কথা গ্রাহ্য না করে বলতে লাগল, বম্বার্দা হোটেলের জয় হোক। বম্বার্দা এলিফ্যান্টার মিউনোফিসের সমান মর্যাদা পাবে যদি সে আমাকে একটা নাচের মেয়ে জোগাড় করে দেয়। আবার সে যদি আমাকে সঙ্গদানের জন্য একটা মেয়ে এনে দিতে পারে তা হলে সে শেরোনেউসের থাইজেলিয়নের মর্যাদা পাবে। বিশ্বাস করো মহিলাগণ, আপুলিউসের কথা থেকে জানতে পারা যায় গ্রিস ও মিশরেও বম্বার্দা নামে হোটল ছিল। সলোমন তাই হয়তো বলতেন, জগতে নতুন কোনও কিছুই নেই। আবার ভার্জিল বলেছিলেন, আসলে এই প্রেম যুগে যুগে বিভিন্ন নরনারীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করে। আজ যেমন কয়েকটি যুবতী তাদের যুবক প্রেমিক এক একজন লুইকে নিয়ে সেন্ট ক্লাউডে নৌকোবিহার করে বেড়াচ্ছে তেমনি অতীতে একদিন অ্যাসপেপসিয়াও পেরিক্লিসের সঙ্গে জাহাজে করে সামস দ্বীপে বেড়াতে যায়। অ্যাসপেসিয়া কে ছিল, তোমরা তা জান কি? সে এমন একটা যুগের মেয়ে ছিল যখন মেয়েদের আত্মা বলে কোনও জিনিস ছিল না। তথাপি তার মধ্যে এমন একটা আত্মা ছিল যা একই সঙ্গে গোলাপি এবং লাল, যে আত্মা একই সঙ্গে ছিল অগ্নিশিখার থেকে তপ্ত আর স্নিগ্ধ, সকলের থেকে শীতল। নারীচরিত্রের দুটি প্রান্তসীমাকে সে অতিক্রম করেছিল। সে ছিল বারবণিতা দেবী, সে ছিল অংশত সক্রেটিস আর অংশত মেলন লেসকৎ। আসলে সে যেন প্রমিথিউসের সেবার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল। অবশ্য প্রমিথিউস যদি তা চাইত।

কথা বলার আবেগ তখন পেয়ে বসেছিল থোলোমায়েসকে এবং তাকে তখন থামানো কঠিন হত যদি-না তখন তাদের ঘরের বাইরে জানালাটার তলায় গাড়ি টানতে টানতে একটা ঘোড়া হঠাৎ পড়ে না যেত। ঘোড়াটা ছিল মাদী এবং বয়সে বুড়ি। গাড়ি টানার সামর্থ্য তার ছিল না। গাড়িটা টানতে টানতে ঘোড়াটা তাই ক্লান্তির নিবিড়তায় দাঁড়িয়ে পড়েছিল। আর যেতে পারছিল না। গাড়ির চালক গালাগালি করছিল। নির্মমভাবে চাবুক মারতে লাগল। কিন্তু ঘোড়াটা আর চলল না, পড়ে গেল। তখন গাড়িটার চারদিকে ভিড় জমে গেল। গোলমাল শুনে থোলোমায়েস ও তার দলের সবাই জানালা দিয়ে উঁকি মারতে লাগল।

সবাই অন্যমনা হয়ে ঘটনাটা দেখতে ব্যস্ত থাকায় থোলোমায়েস ফেবারিতেকে কাছে পেয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। ফেবারিতে বলল, কিন্তু চমক কোথায়? তোমরা যে বলছিলে আমাদের চমকে দেবে?

খোলোমায়েস বলল, ঠিক বলেছ। এখন তার সময় হয়েছে। ভদ্রমহোদয়গণ, এবার মেয়েদের চমক দেখাতে হবে। মহিলাগণ, কয়েক মিনিট ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা করতে হবে।

ব্ল্যাকিভেল বলল, তা হলে প্রথমে চুম্বন দিয়ে শুরু করা যাক।

থোলোমায়েস বলল, আর সে চুম্বন হবে কপালে।

এরপর প্রত্যেকটি প্রেমিক তার প্রেমিকাকে চুম্বন করল। তার পর পুরুষরা একযোগে সারবন্দিভাবে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখে হাততালি দিয়ে উঠল ফেবারিতে। বলল, কী মজার ব্যাপার!

ফাঁতিনে বলল, বেশি দেরি করো না কিন্তু, আমরা অপেক্ষা করে থাকব।

.

মেয়েরা সবাই জানালার ধারে বসে রইল রাস্তার দিকে তাকিয়ে। তারা দেখল পুরুষরা হাতধরাধরি করে যেতে যেতে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। তার পর শ্যাম্প এলিসির পথে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ফাঁতিনে চিৎকার করে একবার বলল, বেশি দেরি করো না।

জেফিনে বলল, ওরা কী আনবে বলে মনে হয়?

ডালিয়া বলল, আমার মনে হয় নিশ্চয় সুন্দর কিছু আনবে।

ফেবারিতে বলল, আমার তো মনে হয় সোনার একটা কিছু আনবে।

অদূরে জলের ধারে আবার কী একটা গোলমাল শুনে সেদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হল ওদের। গাছের ফাঁক দিয়ে ওরা দেখতে পেল জলের ধারে কিসের একটা গোলমাল হচ্ছে। তখন ডাকগাড়ি যাবার সময়। শ্যাম্প এলিসি শহরটার পাশ দিয়ে নদীর বাঁধটার ধার ঘেঁষে ডাক নিয়ে অনেক ঘোড়ার গাড়ি দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে জোর গতিতে এগিয়ে চলেছিল। গাড়িগুলোর উপর যাত্রী মানুষগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছিল। পথের উপর পড়ে থাকা পাথরখণ্ডগুলোকে চাকার আঘাতে গুঁড়ো করে দিয়ে দুপাশের জনতাকে পাশ কাটিয়ে গাড়িগুলো এমন জোরে যাচ্ছিল যাতে মনে হচ্ছিল এক প্রচণ্ড ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যেন গাড়িগুলো। গাড়িগুলোর গতিবেগের এই উন্মত্ততা দেখে মেয়েরা বেশ মজা পাচ্ছিল।

ফেবারিতে বলল, হা ভগবান! কী গোলমাল! মনে হচ্ছে কতকগুলি পুরনো লোহার তাল আকাশে উড়তে চাইছে।

ওরা এক ঝাঁক এলম গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল অনেকগুলো গাড়ির মধ্যে একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটে যেতে যেতে হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার পর আবার ছুটতে ছুটতে চলে গেল। তা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল ফাঁতিনে।

ফাঁতিনে বলল, ডাকগাড়ি কিন্তু থামে না কোথাও। এটা অস্বাভাবিক।

ফেবারিতে বলল, ফাঁতিনের ব্যাপারটাই আলাদা। যে কোনও সাধারণ ঘটনা দেখেও ও আশ্চর্য হয়ে যায়, শোন, মনে করো আমি একজন যাত্রী, আমি ড্রাইভারকে একসময় বললাম, আমি এখন সামনের দিকে বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি ফেরার সময় আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। আমি ওই বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে থাকব। সুতরাং ড্রাইভার আমাকে ফেরার পথে তুলে নিয়ে যাবেই। এটা প্রতিদিনই হয়। জীবন সম্বন্ধে তোমার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই।

কিছুক্ষণ এই ধরনের কথাবার্তা বলতে লাগল। তার পর ফাঁতিনের মনে সেই কথাটা ঘুরে এল। সে বলল, কই, সেই বিস্ময়ের চমক কোথায়?

ডালিয়া বলল, হ্যাঁ, সেই বিরাট বিস্ময়ের চমক কোথায় গেল?

ফাঁতিনের একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওরা বড় দেরি করছে।

ফাঁতিনের কথাটা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হোটেলে যে তাদের খাবার পরিবেশন করছিল সে একটা খামের চিঠি নিয়ে এসে তাদের দিল।

ফেবারিতে বলল, এ কিসের চিঠি?

হোটেল-চাকরটি বলল, আপনাদের লোকেরা যাবার সময় এই চিঠি আপনাদের হাতে দেবার জন্য দিয়ে গেছেন।

ফেবারিতে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল, আরও আগে দাওনি কেন?

ফেবারিতে বলল, কোনও ঠিকানা নেই চিঠিখানার উপর। তবে ভেতরে কী লেখা আছে দেখি। এই হচ্ছে বিস্ময়ের চমক। এই কথাগুলো খামটার উপরেই লেখা আছে।

তাড়াতাড়ি চিঠিটা খাম থেকে বার করে ভাঁজ খুলে জোর গলায় পড়তে লাগল ফেবারিতে, হে প্রিয়তমাবৃন্দ! তোমরা প্রথমেই জেনে রাখ, আমাদের পিতামাতা আছে। তোমাদের কাছে হয়তো বাবা-মা’র বিশেষ কোনও দাম নেই। কিন্তু আইনের দিক থেকে আমরা বাবা-মার কথা শুনতে বাধ্য। তাঁদের এখন বয়স হয়েছে। তাঁরা স্বভাতই উদ্বিগ্ন আমাদের জন্য। তারা চান আমরা এখন তাদের কাছে ফিরে যাই। আমরা তাঁদের বাইবেলবর্ণিত অমিতব্যয়ী পুত্রের মতো যারা ঘরে ফিরে গেলেই তারা মোটা বাছুর কেটে ভোজ দেবার কথা বলেছেন। যেহেতু আমরা কর্তব্যপরায়ণ সন্তান, তাঁদের কথা আমাদের শুনতেই হবে। তোমরা যখন আমাদের এই চিঠিটা পড়বে তখন পাঁচটা দ্রুতগতিসম্পন্ন ঘোড়া আমাদের বাড়ির পথে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা যেন দূরে, বহু দূরে পালিয়ে যাচ্ছি। তুলোর পথে ধাবমান গাড়িগুলো যেন তোমাদের প্রেম আর যৌবনের ফুলে ভরা পথ থেকে আমাদের উদ্ধার করে সমাজজীবনের নানারকম কর্তব্যের পথে নিয়ে চলেছে আমাদের। আমরা এখন আমাদের সেই সামাজিক কর্তব্যের পথে ঘন্টায় প্রায় ছয় মাইল বেগে এগিয়ে চলেছি। আপন পরিবার ও সমাজের প্রতি কর্তব্য আছে আমাদের। আমরা সদাচরণের মাধ্যমে যথাযথভাবে সে কর্তব্য পালন করি, দেশ এটাই আশা করে আমাদের কাছ থেকে। আমরা হব পুলিশের বড় কর্তা, সন্তানের পিতা, স্থানীয় রক্ষীবাহিনী ও আইনসভার সদস্য। আমাদের এই আত্মত্যাগের জন্য তোমরা। আমাদের সম্মান করো, শ্রদ্ধা করো, আমাদের জন্য কিছুটা চোখের জল ফেলো, তার পর আমাদের জায়গায় একে একে বিকল্প প্রেমিক গ্রহণ করে। এ চিঠি পড়ে তোমাদের অন্তর যদি দুঃখে বিদীর্ণ হয় তা হলেও আমাদের করার কিছুই থাকবে না। তোমরা যা খুশি করতে পার। বিদায়।

প্রায় দুই বছর ধরে আমরা তোমাদের যথাসম্ভব সুখ দিয়েছি। আমাদের প্রতি কোনও বিদ্বেষভাব পোষণ করো না।

স্বাক্ষর : ব্ল্যাকিভেল
ফেমিউল
লিস্তোলিয়ের
ফিলিক্স থোলোমায়েস

পুনঃ–ডিনারের টাকা আমরা দিয়ে দিয়েছি।

মেয়েরা পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল।

ফেবারিতেই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে কথা বলল, যাই হোক, এটা কিন্তু বেশ মজার ঠাট্টা।

জেফিনে বলল, সত্যিই ব্যাপারটা বড় মজার।

ফেবারিতে বলল, আমি বেশ বলতে পারি এটা ব্ল্যাকিভেলের পরিকল্পনা। এজন্য তাকে আরও ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে। ভালোবাসতে না বাসতেই ওরা হারিয়ে যায়। এটাই হল জগতের রীতি।

ডালিয়া বলল, না, এটা থোলোমায়েসের পরিকল্পনা। এটা কখনও তার মাথা ছাড়া আর কারও মাথা থেকে বার হতে পারে না।

ফেবারিতে বলল, তা যদি হয় তা হলে ব্ল্যাকিভেল নিপাত যাক, আর থোলোমায়েস দীর্ঘজীবী হোক।

ডালিয়া-জেফিনে একসঙ্গে বলে উঠল, থোলোমায়েস দীর্ঘজীবী হোক।

কথাটা বলেই হাসতে লাগল ওরা।

প্রথমটায় ফাঁতিনেও হাসতে লাগল ওদের সঙ্গে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরে সে তার ঘরে গিয়ে একা একা কাঁদতে লাগল। এটা তার জীবনে প্রথম প্রেম। থোলোমায়েসের কাছে সে অনুগত স্ত্রীর মতো বিলিয়ে দিয়েছিল নিজেকে। তার একটি সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *