প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

১.২ দিগনে শহরের পথে

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

১৮১৫ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে সূর্যাস্তের এক ঘণ্টা আগে একজন পথিক পদব্রজে দিগনে শহরের পথে প্রবেশ করল। শহরের কিছুসংখ্যক লোক যারা খোলা জানালা বা দরজা দিয়ে তাকে দেখল, এক অস্পষ্ট সংশয়ে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল তাদের মন। এমন অবাঞ্ছিত অশোভন বেশভূষায় কোনও পথিককে সাধারণত দেখা যায় না। বয়সে লোকটি ছিল মধ্যবয়সী, প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। চেহারাটা ছিল বলিষ্ঠ, কাঁধ দুটো চওড়া, দেহের উচ্চতা মাঝামাঝি। মাথায় ছিল একটা চামড়ার টুপি। তাতে তার মুখের আধখানা প্রায় ঢাকা ছিল। রোদে পোড়া মুখখানা থেকে ঘাম ঝরছিল। তার গায়ের চাদরটা দড়ির মতো পাকানো ছিল এবং তার পরনের জ্যাকেট পায়জামা সবই ছেঁড়া ছিল। তার পায়ে মোজা ছিল না, জুতোয় পেরেক আঁটা ছিল। তার মাথার চুলগুলো লম্বা করে ছাঁটা ছিল, কিন্তু মুখের দাড়িটা লম্বা হয়ে উঠেছিল। বেশ কিছুদিন কাটা হয়নি দাড়িটা। ঘাম আর পথের ধুলো আরও শোচনীয় করে তুলেছিল তার চেহারাটাকে।

এ শহরের কেউ চিনত না তাকে। হয়তো সে দক্ষিণ দিকের উপকূলভাগ থেকে এসে শহরে ঢুকছিল। ঠিক সেই পথ দিয়ে শহরে ঢুকছিল যে পথ দিয়ে সাত সাল আগে নেপোলিয়ঁন কেন থেকে প্যারিসে গিয়েছিলেন। সে নিশ্চয় সারাদিন পথ হাঁটছিল, তাই তাকে খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। বাজারের কাছে সাধারণের জল খাবার জন্য একটা ঝরনা ছিল, তাতে সে দু বার জল খায়।

র‍্যু পয়শেভার্তের কোণের কাছে সে বাদিকে ঘুরে টাউন হলে যাবার পথ ধরে। সে টাউন হলে ঢুকে আধ ঘণ্টা পরে বেরিয়ে আছে। টাউন হলের দরজার কাছে একটা পাথরের বেঞ্চের উপর একজন পুলিশ বসেছিল সেখানে থেকে ৪ মার্চ জেনারেল দ্রাউন্ড সমবেত জনতাকে নেপোলিয়ঁনের গলফ জুয়ানে অবতরণের ঘোষণাপত্রটি পড়ে শুনিয়ে চমকে দেন। পথিক পুলিশের কাছে এসে টুপি খুলে অভিবাদন জানাল তাকে। পুলিশ তাকে প্রতি-অভিবাদন না জানিয়ে তার চেহারাটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। পথিকটি সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতেই সে তার নিজের কাজে অফিসের ভেতর ঢুকে গেল। সেকালে দিগনেতে একটি সুদৃশ্য পান্থশালা ছিল, তার নাম ছিল ক্ৰয় দ্য কোলবা আর তার মালিকের নাম ছিল জ্যাকিন লাবারে। গ্রেনোবেলের এয় ডফিন নামে পান্থশালার মালিক আর এক লাবারের সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক ছিল। সম্রাটের গলফ জুয়ানে অবতরণকালে। ত্রয় ডফিন সম্পর্কে অনেক গুজব রটেছে। লোকে বলত গত বছর জানুয়ারিতে জেনারেল বার্ট্রান্ড গোপনে ত্রয় ডফিন গাড়িচালকের ছদ্মবেশে এসে সৈনিকদের পদক আর কিছু নাগরিককে মুদ্রা দান করে যায়। আসল কথা হল এই যে সম্রাট নেপোলিয়ঁন গ্রোনোবেলে এসে মেয়র যেখানে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেছিল সেখানে না থেকে তিনি ক্রয় ডফিনে চলে যান। বলেন, সেখানে তার এক পরিচিত লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। তাতে ক্রয় ডফিনের খ্যাতি চারদিকে পঁচিশ মাইল দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে দিগনের হয় দ্য কোলবার খ্যাতিও বেড়ে যায়। লোকে বলে ত্রয় কোলবার মালিক ত্রয় ডফিনের মালিকের জ্ঞাতি ভাই।

পথিক দিগনের ত্রয় কোলবার দিকে এগিয়ে যায়। হোটেলের রান্নাঘরটি রাস্তার দিকে ছিল। পথিক সেই ভোলা রান্নাঘর দিয়ে হোটেলে প্রবেশ করল। রান্নার উনোনগুলোতে তখন আগুন জ্বলছিল। হোটেলের মালিক তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিল। সে তখন ওয়াগনে করে আসা একদল লোকের খাবার তৈরি করছিল। লোকগুলো পাশের ঘরে কথাবার্তা বলছিল আর হাসাহাসি করছিল। ওয়াগনে করে আসা লোকেরা হোটেলে বেশি খাতির পায় একথা সবাই জানে।

দরজা দিয়ে পথিক রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই হোটেলমালিক বলল, আমি মঁসিয়ের জন্য কী করতে পারি?

পথিক বলল, খাবার আর একটা বিছানা চাই।

পথিককে খুঁটিয়ে দেখে হোটেলমালিক বলল, তা অবশ্যই পাওয়া যাবে, তবে তার জন্য আপনাকে টাকা দিতে হবে।

তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চামড়ার থলে বার করে পথিক বলল, আমার কাছে টাকা আছে।

হোটেলের মালিক বলল, তা হলে আপনি থাকতে পারেন। আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

চামড়ার থলেটা আবার তার পকেটে রেখে তার পিঠে সৈনিকদের মতো যে একটা ব্যাগ ছিল সেটা মেঝের উপর নামিয়ে রাখল। তার পর হাতের লাঠিটা ধরেই আগুনের পাশে একটা টুলের উপর বসে পড়ল পথিকটি। দিগনে শহরটা পাহাড়ের উপর অবস্থিত বলে অক্টোবর মাসেই সেখানে দারুণ শীত পড়ে। হোটেলমালিক রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকলেও মাঝে মাঝে পথিকের পানে তাকিয়ে কী দেখছিল।

হোটেলমালিক একসময় বলল, আপনার খাবার কি তাড়াতাড়ি চাই?

পথিক উত্তর করল, হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি।

ঘরের দিকে পেছন ফিরে বসে আগুনে গা-টা গরম করছিল পথিক। হোটেলমালিক জ্যাকিন লাবারে একটা খবরের কাগজ থেকে একটুকরো ছিঁড়ে তার উপর পেন্সিল দিয়ে দুই-এক লাইন কী লিখল। তার পর তার একটা বালকভৃত্যকে ডেকে সেই কাগজটা তার হাতে দিয়ে কী বলতেই ছেলেটা টাউন হলের দিকে তখনি চলে গেল। পথিক এসব কিছুই দেখতে পেল না।

সে হোটেলমালিককে জিজ্ঞাসা করল, খাবার শিগগির পাওয়া যাবে?

হোটেলমালিক বলল, হ্যাঁ, শিগগির পাওয়া যাবে।

ছেলেটি ফিরে এসে একটুকরো কাগজ এনে হোটেলমালিকের হাতে দিতেই সে সেটা ব্যগ্রভাবে ধরে নিল। তার পর একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে কী ভাবতে লাগল। পরে সে পথিকের কাছে গিয়ে দেখল পথিক এক মনে কী সব ভাবছে।

হোটেলমালিক বলল, দুঃখিত মঁসিয়ে, আমি এখানে আপনাকে থাকতে দিতে পারব না।

পথিকটি মুখ ঘুরিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কিন্তু কেন? আমি টাকা দিতে পারব না বলে আপনি কি ভয় করছেন? আপনি কি আগাম টাকা চান? আমি তো বলেছি আমার কাছে টাকা আছে।

কথাটা তা নয়।

তা হলে কী?

আপনার কাছে টাকা আছে। কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমার হোটেলে ঘর খালি নেই।

পথিক তখন শান্ত কণ্ঠে বলল, তা হলে আমাকে আস্তাবলে একটা জায়গা করে দিন।

সেখানে আমি থাকতে দিতে পারি না।

কেন পারেন না?

সেখানে ঘোড়াগুলো গোটা ঘরটা জুড়ে থাকে।

তা হলে খড়ের গাদার কাছে। খাওয়ার পর সেটা দেখা যাবে।

আপনাকে আমি খাবার দিতে পারব না।

হোটেলমালিকের দৃঢ় ও স্পষ্ট কণ্ঠস্বরে পথিকের সর্বাঙ্গ যেন কেঁপে উঠল। সে বলল, কিন্তু আমি ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছি। সকাল থেকে পথ হাঁটছি আমি। প্রায় চব্বিশ মাইল পথ হেঁটেছি। কিছু না কিছু আমাকে খেতেই হবে।

হোটেলমালিক বলল, আপনাকে কিছুই দিতে পারব না আমি।

 কিন্তু ব্যাপারটা কী?

সব খাবার ও ঘর সংরক্ষিত করে রেখেছে।

কাদের দ্বারা সংরক্ষিত হয়েছে।

ওয়াগনে করে আসা লোকেদের।

ওরা সংখ্যায় কত জন?

বারো জন।

কিন্তু কুড়ি জনের মতো খাবার ও ঘর আছে এখানে।

ওরা সব কিছুর জন্য আগেই অগ্রিম টাকা দিয়ে রেখেছে।

পথিক আবার বসে পড়ে আপন মনে বলতে লাগল, আমি একজন ক্ষুধার্ত পথিক। আমি এখানেই বসে থাকব।

হোটেলমালিক পথিকের ঘাড়ের উপর ঝুঁকে পড়ে বলে উঠল, চলে যাও এখান থেকে।

তা শুনে চমকে উঠল পথিক। সে কী বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই হোটেলমালিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলতে লাগল, আর কথা বলে লাভ নেই। তুমি কে, কী কর তা কি আমার কাছ থেকে শুনতে চাও? তোমার নাম হচ্ছে জাঁ ভলজাঁ। আমি টাউন হলে লোক পাঠিয়েছিলাম এবং দেখ কী লিখে দিয়েছে।

একটা কাগজের টুকরো পথিকের সামনে হোটেলমালিক ধরতেই তার উপরকার লেখাটা পড়ে ফেলল সে। তাতে লেখা ছিল, আমি সকলের সঙ্গেই দ্র ব্যবহার করতে চাই। দয়া করে চলে যান।

আর কিছু না বলে পথিকটি টুল থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে আনমনে বড় রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলতে লাগল সে। অপমানবোধের এক জ্বালাময় বিষাদ আচ্ছন্ন করে ছিল তার মনকে। কিন্তু যদি একবার সে মুখ ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকাত তা হলে সে দেখতে পেত হোটেলের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে হোটেলমালিক তার দিকে আঙুল বাড়িয়ে কী সব বলছে আর তার চারদিকে একদল লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারল তার এই আকস্মিক আসার কথাটা অল্প সময়ের মধ্যেই প্রচারিত হয়ে পড়বে সারা শহরে।

এসব কিছুই দেখতে পায় না সে। দুর্ভাগ্যপীড়িত মানুষ পেছন ফিরে কখনও তাকায় না। কারণ সে জানে দুর্ভাগ্য পেছন থেকে তাড়া করে মানুষকে। নিঃসীম নিবিড় হতাশার চাপে ক্লান্তির কথা ভুলে গিয়ে অজানা শহরের পথ দিয়ে লক্ষ্যহীনভাবে এগিয়ে চলল সে। হঠাৎ ক্ষুধার জ্বালাটা আবার অনুভব করতে লাগল সে। সে দেখল সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। রাত্রির মতো একটা আশ্রয় দরকার।

সে জানত কোনও ভালো বাসস্থান আর সে পাবে না। তার দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সে চায় গরিব-দুঃখীরা যেখানে থাকে সেই ধরনের ছোটখাটো একটা পান্থশালা। যেতে যেতে হঠাৎ সে দেখল যে পথ দিয়ে সে হাঁটছিল তার শেষ প্রান্তে একটা ঘরে একটা টর্চের আলো ঝুলছে। সেই আলোটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল সে।

র‍্যু দ্য সোফা অঞ্চলে ওটা হচ্ছে একটা ছোটখাটো হোটেল। হোটেলটার কাছে এসে পথিক জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ঘরের ভেতরটা দেখল। দেখল ঘরের ভেতরে টেবিলের উপর একটা আলো জ্বলছে। জনকতক লোক মদ পান করছে। হোটেল মালিক আগুনের পাশে বসেছিল আর উনোনে কী একটা রান্নার জিনিস সিদ্ধ হচ্ছিল। হোটেলে ঢোকার দুটো প্রবেশপথ ছিল –একটা সামনের দিকে আর একটা পেছন দিকে একটা উঠোনের উপর দিয়ে গোবরের স্কুপের পাশ দিয়ে। পথিক সামনের দিক দিয়ে যেতে সাহস পেল না। সে তাই পেছন দিকে উঠোন পার হয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল।

হোটেলমালিক বলল, কে আসে?

পথিক বলল, খাবার আর একটা বিছানা চাই শোবার জন্য।

তা হলে ভেতরে আসতে পার। দুটোই পাবে।

পথিক ঘরের ভেতর ঢুকে উনোনের জ্বলন্ত আগুনের আভা আর টেবিল ল্যাম্পের আলোর মাঝখানে দাঁড়াতেই উপস্থিত সকলেই তার পানে তাকাল। সে তার পিঠের ব্যাগটা যখন নামাল তখনও সকলে নীরবে তাকিয়ে ছিল তার পানে।

হোটেলমালিক বলল, উনোনে ঝোল সিদ্ধ হচ্ছে। এস বন্ধু, শরীরটা একটু গরম করে নাও।

পথিক আগুনের ধারে বসে তার ক্লান্ত পা দুটো ছড়িয়ে দিল। ঝোল সিদ্ধর একটা মিষ্টি গন্ধ আসছিল। মাথার টুপিটা মুখের উপর অনেকটা নামানো থাকায় তার মুখের যতটা দেখা যাচ্ছিল তাতে বোঝা যাচ্ছিল সে সচ্ছল সুখী পরিবারের লোক। কিন্তু দীর্ঘকাল দুঃখকষ্টে জর্জরিত হওয়ার ফলে তার অবস্থা এমন শোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখখানায় বিষাদ জমে থাকলেও সে মুখ দেখে বোঝা যায় তার চেহারা বেশ বলিষ্ঠ। বৈপরীত্যমূলক অদ্ভুত একটা ভাব ছিল সে মুখে। সে মুখে একদিকে ছিল আপাতোর একটা ছাপ আর অন্যদিকে ছিল আপাতপ্রভুত্বের এক ঔদ্ধত্য। তার ঘন ভ্রুযুগলের নিচে তার চোখ দুটো ঝোঁপের তলায় আগুনের মতো জ্বলছিল।

ঘরের মধ্যে যেসব লোক মদ পান করছিল তাদের মধ্যে একজন মৎস্য ব্যবসায়ী ছিল। আজ সকালে সে যখন ঘোড়ায় চেপে এক জায়গা দিয়ে আসছিল তখন এই পথিকের সঙ্গে দেখা হয়। পথিক নিদারুণ ক্লান্তির জন্য ওই মৎস্য ব্যবসায়ীকে তার ঘোড়ার উপর তাকে চাপিয়ে নেবার জন্য অনুরোধ করে কিন্তু মৎস্য ব্যবসায়ী তার উত্তরে জোরে চালিয়ে দেয় তার ঘোড়াটাকে। আবার কিছুক্ষণ আগে জ্যাকিন বারে যখন তার হোটেল থেকে এই পথিককে তাড়িয়ে দেয় তখনও ওই মৎস্য ব্যবসায়ী হোটেলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এখানে এসে সবাইকে সেকথা বলে দেয়। হোটেলমালিক সে কথা জানত না। পথিক এ হোটেলে এসে ঢুকে আগুনের ধারে বসতেই সে হোটেলমালিককে ডেকে তাকে জানিয়ে দিল কথাটা।

সে কথা শুনে হোটেলমালিক পথিকের কাছে এসে তার কাঁধে একটা হাত দিয়ে বলল, এখান থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে।

পথিক মুখ তুলে শান্তভাবে বলল, তোমরাও তা হলে জেনে ফেলেছ?

হ্যাঁ।

ওরা আমাকে ওদের হোটেল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

এখান থেকেও তোমায় তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু কোথায় যাব আমি?

অন্য কোথাও।

পথিক তখন হাতে লাঠিটা আর পিঠে ব্যাগটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। বড় রাস্তায় আসতেই একদল ছেলে কোথা থেকে এসে ঢিল ছুঁড়তে লাগল পথিকের উপর। সে তখন তার লাঠিটা ঘোরাতেই ছেলেগুলো পাখির ঝাঁকের মতো পালিয়ে গেল।

পথিক এবার একটা জেলখানার সামনে এসে দাঁড়াল। সে ফটকের সামনে একটা শিকলে ঝোলানো ঘন্টাটা বাজাতেই দরজা খুলে একজন প্রহরী বেরিয়ে এল।

পথিক তখন তার টুপিটা মাথা থেকে সরিয়ে বলল, মঁসিয়ে, আপনি দয়া করে রাতটার মতো এখানে আমাকে থাকতে দেবেন?

প্রহরী বলল, এটা কারাগার, পান্থশালা নয়। গ্রেপ্তার না হলে এখানে থাকতে পাওয়া যায় না।

এই বলে সে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

পথিক এবার বড় রাস্তা ছেড়ে একটা গলিপথে ঢুকে একটা বাগান দেখতে পেল। সেই বাগানের ভেতর একটা একতলা বাড়ি ছিল। সে বাড়ির একটা ঘরের খোলা জানালা দিয়ে আলোর ছটা আসছিল। পথিক জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর দৃষ্টি ছড়িয়ে দেখল, প্রশস্ত ঘরখানার মাঝখানে খাটের উপর একটা বিছানা পাতা ছিল। বিছানার উপর ক্যালিকো কাপড়ের একটা চাদর পাতা ছিল। ঘরের এককোণে একটা দোলনা ছিল। টেবিলে একটা পাত্রে মদ ছিল। প্রায় চল্লিশ বছরের একটা লোক টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসে একটি শিশুকে তার হাঁটুর উপর দাঁড় করিয়ে তাকে নাচাচ্ছিল। তার সামনে এক যুবতী নারী একটি শিশুকে স্তনদান করছিল। পিতা তার শিশুকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল আর মা হাসিমুখে তা দেখছিল। একটি পিতলের ল্যাম্পের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল ঘরখানা।

পথিক জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এই মধুর দৃশ্যটি দেখতে দেখতে ভাবতে লাগল। সে কী ভাবছিল সে-ই তা জানে। সে হয়তো ভাবছিল এই সুখী পরিবারে হয়তো আতিথেয়তার অভাব হবে না। যেখানে এত আনন্দ সেখানে একটুখানি বদান্যতা আশা করা হয়তো অন্যায় হবে না।

পথিক দরজার উপর মৃদু করাঘাত করল। কিন্তু ঘরের ভেতরে কেউ তা শুনতে পেল না। সে আবার দ্বিতীয়বার দরজায় করাঘাত করতে স্ত্রী তা শুনতে পেয়ে তার স্বামীকে বলল, কে হয়তো ডাকছে।

স্বামী বলল, ও কিছু না।

পথিক তৃতীয়বার দরজায় করাঘাত করতেই স্বামী এবার বাতিটা হাতে নিয়ে দরজা খুলল।

লোকটির চেহারাটা লম্বা। তাকে দেখে মনে হল সে একজন চাষি, কিন্তু কোনও কারখানায় মিস্ত্রির কাজ করে। সে চামড়ার একটা আলখাল্লা পরে ছিল। তার দ্রুযুগল ঘন।

পথিক বলল, মাপ করবেন মঁসিয়ে, আমি যদি আপনাকে টাকা দিই তা হলে আপনি কি আমাকে এক প্লেট ঝোল আর আপনার বাড়ির বাইরে বাগানের ধারে এই চাতালটায় রাতের মতো থাকতে দেবেন?

লোকটি বলল, টাকা দিলে কোনও ভদ্রলোককে অবশ্যই আমি আশ্রয় দেব। কিন্তু আপনি কেন কোনও হোটেলে গেলেন না?

হোটেলে কোন ঘর খালি নেই।

সে কি? আজ তো হাটবার নয়। আপনি লাবারতে গিয়ে একবার দেখেছিলেন?

হ্যাঁ গিয়েছিলাম।

তা হলে?

পথিক অস্বস্তিসহকারে বলল, কেন জানি না, ওরা আমাকে থাকতে দিল না।

অন্য হোটেলে দেখেছিলেন? যেমন র‍্যু দ্য শোফা?

পথিকের অস্বস্তি বেড়ে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, ওরাও আমাকে থাকতে দিল না।

লোকটির মুখের ওপর এবার এক অবিশ্বাসের ভাব ফুটে উঠল। লোকটি পথিকের আপাদমস্তক একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বলল, তুমি কি তা হলে

এই কথা বলেই সে ঘরের ভেতর ঢুকে বাতিটা নামিয়ে রেখে দেয়াল থেকে তার দোনলা বন্দুকটা এনে পথিককে বলল, বেরিয়ে যাও। চলে যাও এখান থেকে।

স্বামীর কথায় তার স্ত্রী ছেলে দুটিকে ধরে বলে উঠল, তবে কি ডাকাত?

পথিক বলল, আমি অনুরোধ করছি মঁসিয়ে, আমাকে এক গ্লাস জল দিন।

লোকটি বলল, বন্দুকের গুলি ছাড়া আর কিছুই পাবে না তুমি।

এই কথা বলেই সে দরজাটা বন্ধ করে দরজায় খিল দিয়ে দিল।

রাত্রি ক্রমশই গম্ভীর হয়ে উঠছিল। আল্পস পর্বতের তুহিনশীতল কনকনে বাতাস বইছিল।

সেই বাগানটা থেকে বেরিয়ে এসে গলির ধারে আরও একটা বাগানের মধ্যে দেখল পাতায় ঢাকা একটা কুঁড়ে রয়েছে। রাস্তা মেরামতের যারা কাজ করে তারা পথের ধারে এই ধরনের কুঁড়ে তৈরি করে অস্থায়ীভাবে সেখানে থাকার জন্য। পথিক ভাবল এখন কুঁড়েটার মধ্যে কোনও লোক নেই। সে তাই কাঠের বেড়াটা ডিঙিয়ে পার হয়ে কুঁড়েটার মধ্যে গিয়ে ঢুকল। ভেতরটা বেশ গরম। তার মধ্যে খড়ের বিছানা পাতা ছিল। সে তার পিঠ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে সেটা মাথায় দিয়ে শুতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা কুকুরের গর্জন শুনে কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে এল সে। সে বুঝল এই কুঁড়েটা কুকুর থাকার ঘর।

কুকুরটা পথিককে আক্রমণ করে তার পোশাকগুলো আরও ছিঁড়ে দিল। পথিক তার লাঠি ঘুরিয়ে কোনওমতে বেরিয়ে গেল বাগান থেকে।

সে আবার গলিপথে এসে পড়ল। একটা পাথরের উপর বসে আপন মনে বলে উঠল, আমি কুকুরেরও অধম।

সেখান থেকে উঠে শহরটাকে পেছনে ফেলে ক্রমাগত হাঁটতে লাগল সে। শহর থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে তার সামনে একটা ফাঁকা মাঠ দেখতে পেল। সম্প্রতি ফসল উঠে যাওয়ায় মাঠটাকে ন্যাড়া মাথার মতো দেখাচ্ছিল। রাত্রির অন্ধকার আর আকাশটাকে মেঘে ছেয়ে থাকার জন্য দিগন্তটা কালো হয়ে ছিল। আকাশে চাঁদ না থাকায় অন্ধকারটাকে আরও ঘন দেখাচ্ছিল।

পথিক দেখল সারা মাঠটার মধ্যে একটা মাত্র গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। নৈশ প্রকৃতির রহস্যময় আবেদনে সাড়া দেবার মতো কোনও সূক্ষ্ম সুকুমার অনুভূতি তার ছিল না। সমস্ত অন্ধকার আকাশ, নিঃসঙ্গ গাছ, শূন্য মাঠ, প্রান্তর সব কিছুকে এমন গভীরভাবে শূন্য মনে হচ্ছিল এবং সেই শূন্যতার কৃষ্ণকুটিল পটভূমিতে তার আপন অবস্থার নিঃসঙ্গতাটাকে এমন অসহনীয় মনে হচ্ছিল যে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না সেখানে। তার মনে হল মাঝে মাঝে প্রকৃতি এমনি করে প্রতিকূল হয়ে ওঠে মানুষের।

নিরুপায় হয়ে সে আবার দিগনে শহরে ফিরে এল। কিন্তু তখন নগরদ্বার রুদ্ধ হয়ে গেছে। সেকালে আক্রমণের আশঙ্কায় উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল শহরটা। দুদিকে দুটো ফটক ছিল। কিন্তু ফটক বন্ধ হয়ে গেলেও ভাঙা প্রাচীরের এক জায়গায় একটা ফাঁক দিয়ে শহরে প্রবেশ করল সে।

রাত্রি তখন আটটা বাজে। অজানা পথের এদিক-ওদিক ঘুরে এগোতে লাগল সে। একসময় সে বড় গির্জাটার পাশ দিয়ে যাবার সময় গির্জার দিকে ঘুষি পাকিয়ে হাতটা নাড়ল। সেই পথটার এককোণে একটা ছাপাখানা ছিল। এই ছাপাখানাতেই একদিন সম্রাট নেপোলিয়ঁনের ঘোষণাপত্র ছাপা হয়। অতিশয় ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে ছাপাখানার দরজার বাইরে একটা পাথরের বেলচার উপর পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল সে।

একজন বয়স্ক মহিলা বড় গির্জা থেকে বেরিয়ে এসে পথিককে সেখানে শুয়ে থাকতে দেখে তাকে বলল, এখানে কী করছ তুমি?

পথিক বলল, হে আমার সদাশয় মহিলা, তুমি দেখতে পাচ্ছ আমি কী করছি। আমি এখানে শুয়ে ঘুমোব।

এই সদাশয় মহিলা একজন মার্কুইপত্নী ছিলেন। তিনি বললেন, এই বেঞ্চিতে শোবে?

পথিক বলল, আমি উনিশ বছর কাঠের উপর শুয়েছি। এখন পাথরের উপর শুয়েছি।

তুমি কি সৈনিক ছিলে?

হ্যাঁ সৈনিক।

তুমি কেন কোনও হোটেলে গেলে না?

কারণ আমার টাকা নেই।

মার্কুই বললেন, হায়, আমার কাছে এখন মাত্র চার স্যু আছে।

কিছু না থাকার চেয়ে এটা ভালো।

পথিক মার্কুই-এর কাছ থেকে চার স্যু-ই নিল। মার্কুই তখন বললেন, এ পয়সাতে হোটেলখরচ হবে না। কিন্তু তুমি হোটেলে গিয়ে চেষ্টা করে দেখেছ? রাত্রিতে তুমি এখানে থাকতে পারবে না। তুমি নিশ্চয় শীতার্ত এবং ক্ষুধার্ত। নিশ্চয় কোনও দয়ালু ব্যক্তি তার ঘরে থাকতে দেবেন তোমাকে।

আমি প্রতিটি বাড়িতে খোঁজ করে দেখেছি।

তুমি কি বলছ কেউ তোমাকে—

প্রতিটি বাড়ি থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

মহিলাটি তখন পথিকের কাঁধে একটা হাত দিয়ে রাস্তাটার ওপারে বিশপের প্রাসাদের পাশে একটা ছোট বাড়ির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, তুমি প্রত্যেকটি বাড়িতে গিয়ে দেখেই বলছ?

হ্যাঁ।

ওই বাড়িটায় গিয়ে দেখেছ?

না।

তা হলে ওখানে যাও।

.

দিগনের বিশপ সারাদিনের কাজ সেরে শহর থেকে সন্ধ্যার সময় ঘুরে এসে তার ঘরে জেগে ছিলেন। তিনি তখন খ্রিস্টানদের কর্তব্য সম্বন্ধে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন। এ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ ও পণ্ডিতদের মতামতগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন। সব ধর্মীয় কর্তব্যগুলোকে দুভাগে বিভক্ত করে দেখতে হবে তাকে। প্রথমে সামাজিক কর্তব্য, তার পর ব্যক্তিগত কর্তব্য। খ্রিস্টানদের সামাজিক বা সম্প্রদায়গত কর্তব্যগুলোকে চার ভাগে বিভক্ত করেন সেন্ট ম্যাথিউ। এই সামাজিক কর্তব্যগুলো হল ঈশ্বরের প্রতি কর্তব্য, নিজের প্রতি কর্তব্য, প্রতিবেশীর প্রতি কর্তব্য আর সমস্ত জীবের প্রতি কর্তব্য। ব্যক্তিগত কর্তব্যগুলো বিশপ অন্য এক জায়গায় প্রকাশিত দেখেছিলেন। সেন্ট পিটার রোমানদের কাছে লিখিত একটি চিঠিতে রাজা এবং প্রজাদের কর্তব্যগুলো লিপিবদ্ধ করেন। তার পর একেসীয়দের কাছে লিখিত একখানি চিঠিতে ম্যাজিস্ট্রেট স্ত্রী, মাতা ও যুবকদের কর্তব্যগুলো নির্ধারণ করেন। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্তের কর্তব্যের কথাগুলো হিব্রুদের কাছে একটি চিঠিতে আর কুমারীদের কর্তব্যগুলো কোরিন্থীয়দের কাছে লিখিত একটি চিঠিতে লিপিবদ্ধ করেন। বিশপ বিয়েনভেনু বিভিন্ন জায়গায় লিখিত এইসব কর্তব্য বাছাই করে এক জায়গায় সেগুলো লিখে রেখেছিলেন যাতে সকল শ্রেণির লোকের মঙ্গল হয়।

সেদিন রাত্রি আটটার সময় বিশপ তাঁর হাঁটুর উপর একটা বড় বই খুলে রেখে সেটা পড়তে পড়তে কয়েকটা টুকরো কাগজে কী লিখছিলেন। এমন সময় ম্যাগলোরি একবার বিশপের ঘরে ঢুকে বিছানার পাশে আলমারি থেকে কী একটি জিনিস বার করে নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বিশপ যখন বুঝলেন খাবার টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে। এবং তার জন্য তার বোন অপেক্ষা করে বসে আছে তখন তিনি আর দেরি না করে বইটা নামিয়ে রেখে খাবার ঘরে চলে গেলেন। তাদের খাবার ঘরটা ছিল আয়তক্ষেত্রাকার এবং তার একটা দরজা রাস্তার দিকে আর একটা দরজা বাগানের দিকে ছিল। ঘরের মধ্যে আগুন জ্বলছিল।

ম্যাগলোরি তখন খাবার দেবার আগে টেবিলটা সাজাচ্ছিল আর বাপতিস্তিনের সঙ্গে কথা বলছিল। টেবিলের উপর একটা বাতি জ্বলছিল। দু জন মহিলারই বয়স ষাটের ওপর হয়েছিল। ম্যাগলোরর চেহারাটা ছিল মোটা আর বলিষ্ঠ। বাপতিস্তিনের চেহারাটা ছিল রোগা রোগা। ম্যাগলোরিকে দেখে চাষি ঘরের মেয়ে আর বাপতিস্তিনেকে সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা বলে মনে হত। ম্যাগলোরির উপরকার ঠোঁটটা মোটা আর নিচের ঠোঁটটা সরু ছিল। তার চোখে-মুখে এক উজ্জ্বল বুদ্ধি আর অন্তরে উদারতার ছাপ ছিল। ম্যাগলোরির চেহারার মধ্যে এক রাজকীয় ঔদ্ধত্যের ভাব ছিল। বাপতিস্তিনের মধ্যে এক শান্ত ও সাধু প্রকৃতির ভাব ছিল। সে কথা কম বলত। তার ধর্মবিশ্বাস প্রগাঢ় ছিল। প্রকৃতি তাকে মেষশাবক করে পৃথিবীতে পাঠায়, ধর্মবিশ্বাস তাকে দেবদূতে পরিণত করে।

বিশপ যখন খাবার ঘরে ঢুকলেন তখন ম্যাগলোরি বাপতিস্তিনেকে জোর গলায়। একটা বিষয়ের কথা বলছিল যেটা সে এর আগেও বলেছে এবং সেটা বিশপ জানেন। বিষয়টা হল বাড়ি ও সামনের দিকে দরজাটা বন্ধ করে রাখার কথা। আজ সে সেই পুরনো বিষয়টার সঙ্গে একটা ঘটনার কথা যোগ করে দিল। সে বলল আজ সন্ধ্যায় বাজার করতে গিয়ে শহরে একটা গুঞ্জব শোনে। অদ্ভুত চেহারা আর বেশভূষাওয়ালা একটা ভবঘুরে শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবাই বলছে আজ বেশি রাত পর্যন্ত জেগে থাকা বা দরজা খুলে রাখা উচিত নয়। আজকাল শহরের মেয়র আর পুলিশের বড় কর্তার সঙ্গে মনকষাকষির জন্য পুলিশি ব্যবস্থা ভালো নয়। কাজেই নাগরিকদেরই নিজেদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। সদর দরজায় তালা দিতে হবে আর সব ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখতে হবে।

বিশপ কথাগুলো শুনলেন। কিন্তু কোনও মন্তব্য না করে আগুনের ধারে গিয়ে বসলেন। ম্যাগলোরি দরজা বন্ধ করার কথাগুলো আবার বলতে লাগল।

বাপতিস্তিনে তার দাদাকে বিরক্ত না করে ম্যাগলোরিকে সমর্থন করার জন্য বিশপকে বলল, ম্যাগলোরি কী বলছে তা শুনেছ?

বিশপ বললেন, হ্যাঁ, কিছুটা শুনেছি।

তার পর তিনি হাসিমুখে ম্যাগলোরির দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাপার কী? আমরা কি কোনও ঘোরতর বিপদে পড়েছি?

ম্যাগলোরি তখন ঘটনাটার পুনরাবৃত্তি করল। বলল, লোকটা এক ভবঘুরে, ভয়ঙ্কর ধরনের এক ভিখিরি। সে জ্যাকিন লাবারের হোটেলে গিয়েছিল। কিন্তু তারা তাড়িয়ে দিয়েছে। গাসেন্দি বাজারের পথে পথে তাকে অনেকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। তার পিঠে সৈনিকদের মতো একটা ভারী ব্যাগ আছে আর তার মুখটা ভয়ঙ্কর রকমের দেখতে।

বিশপ বললেন, তাই নাকি?

বিশপের আগ্রহ দেখে ম্যাগলোরি ভাবল, বিশপ তার ভয়ের কথাটা সমর্থন করছেন। সে তখন উৎসাহিত হয়ে বলতে লাগল, হ্যাঁ মঁসিয়ে, আজ রাতে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে। চারদিকে পাহাড়ঘেরা এই ছোট্ট শহরটার রাস্তাঘাটগুলো পিচের মতো অন্ধকার। পথে একটা আলো নেই। আমি যা বলছি ম্যাদময়জেলের তাতে সমর্থন আছে।

বাপতিস্তিনে বলল, আমি কিছু বলছি না, দাদা যা করবেন তাই হবে।

ম্যাগলোরি বলল, আমরা বলছি কি মঁসিয়ে অনুমতি দিলেই আমি এখনি একজন কামারের কাছে গিয়ে আমাদের দরজা কিছু তালাচাবি করাতে পারি এবং ভালো খিল লাগাবার ব্যবস্থা করতে পারি। আমাদের দরজায় যা খিল আছে তাতে কোনও লোককে আটকানো যাবে না। যে কোনও লোক রাত্রিবেলায় ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। মঁসিয়ে আবার রাত দুপুরে বাইরে থেকে লোককে ডেকে আনেন।

এমন সময় দরজায় জোর করাঘাতের শব্দ হল।

বিশপ বললেন, ভেতরে এস।

.

ঘরের দরজা খুলে একজন লোক প্রবেশ করল। এই লোকটিই হল সেই পথিক যাকে আমরা আগেই দেখেছি। পথিক ঘরে ঢুকেই দরজার কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জ্বলন্ত আগুনের আভায় তার মুখটাকে খুব ক্লান্ত ও অবসন্ন দেখাচ্ছিল। তার পিঠে সেই ব্যাগটা আর হাতে একটা লাঠি ছিল। ছেঁড়া ময়লা বেশভূষায় তার চেহারাটা কুৎসিত আর ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছিল।

ম্যাগলোরি তাকে দেখে মুখটা হাঁ করে ভয়ে কাঁপতে লাগল। কোনও কথা বার হল না তার মুখ থেকে। বাপতিস্তিনে উঠে দাঁড়িয়ে ভয়ে চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার দাদার দিকে তাকিয়ে শান্ত হয়ে রইল।

বিশপ শান্তভাবে আগন্তুককে দেখতে লাগলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই আগন্তুক ঘরের তিনজনকে দেখে নিয়ে কড়া গলায় বলতে লাগল, শুনুন, আমার নাম জাঁ ভলজাঁ। আমি একজন মুক্ত জেল-কয়েদি। আমি উনিশ বছর জেলে ছিলাম। চারদিন আগে ওরা আমায় জেল থেকে ছেড়ে দেয় এবং আমি পন্তালিয়ের যাচ্ছি। আমি ঠুলো থেকে চারদিন পথ হেঁটে এখানে আসি। আজ আমি সকাল থেকে তিরিশ মাইল পথ হেঁটেছি, এই শহরে এসে আমি একটি হোটেলে যাই, কিন্তু হোটেলমালিক আমাকে তাড়িয়ে দেয়। কারণ আমি প্রথমে আমার জেল-ফেরতের হলুদ টিকিটটি টাউন হলের কর্তৃপক্ষকে বিধিমতো দেখাই। আমি তখন আর একটি হোটেলে যাই, তারাও আমায় চলে যেতে বলে। কেউ আমায় স্থান দিতে চায়নি। আমি কারাগারে যাই, কিন্তু রক্ষীও দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি একটা কুকুরের আস্তানায় রাত্রিবাসের জন্য যাই, কিন্তু কুকুরগুলোও আমায় তাড়িয়ে দেয় মানুষদের মতো। তার পর আমি শহরের বাইরে মাঠে যাই শোবার জন্য, কিন্তু আকাশে মেঘ থাকায় বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে দেখে চলে আসি। আমি একটা পাথরের বেঞ্চের উপর শুয়ে পড়ি। তখন একজন মহিলা আমাকে এই বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তাই আমি এখানে এসে দরজায় করাঘাত করি। এ বাড়িটা কি হোটেল? আমার কাছে টাকা আছে। উনিশ বছর জেলখানায় কাজ করে আমি একশো নয় ফ্রাঁ পনের স্যু পাই। আমি এখানে থাকা-খাওয়ার জন্য যা লাগবে, তা যাই হোক আমি দিতে রাজি আছি। আমি অতিশয় ক্লান্ত, বারো লিগ পথ আমি হেঁটেছি। আমি দারুণ ক্ষুধার্ত। আমাকে এখানে থাকতে দেবেন?

বিশপ বললেন, ম্যাদময়জেল ম্যাগলোরি, দয়া করে টেবিলে আর একটা খাবার জায়গা করবে?

ভলজাঁ কথাটা বুঝতে না পেরে জ্বলন্ত চুল্লিটার কাছে এল। বলল, আমার কথা আপনারা শোনেননি? আমি একজন জেলফেরত কয়েদি। আমি জেলে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করেছি।

সে তার পকেট থেকে একটা হলুদ কাগজ বার করে বলল, এই হল আমার হলুদ টিকিট। এই জন্যই সবাই আমাকে তাড়িয়ে দেয়। আপনারা এটা পড়তে চাইলে পড়ে দেখতে পারেন। আমিও পড়তে পারি। জেলখানায় শ্রেণিবিভাগ আছে। এতে লেখা আছে, জাঁ ভলজাঁ জেলের আসামি মুক্ত, তার জন্ম –সে উনিশ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেছে, তার মধ্যে হিংসার আশ্রয় নিয়ে ডাকাতি করার জন্য পাঁচ বছর, জেল থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করার জন্য চৌদ্দ বছর অতিশয় বিপজ্জনক লোক। এই হচ্ছে আমার পরিচয়। সকলেই আমায় তাড়িয়ে দিয়েছে। আপনারা আমাকে থাকতে দেবেন? এটা কি একটা হোটেল? আমাকে কিছু খাবার আর রাত্রির মতো থাকতে দেবেন? আপনাদের কি আস্তাবল আছে?

বিশপ বললেন, ম্যাগলোরি, অতিথিদের বিছানাটায় একটা পরিষ্কার চাদর পেতে দাও।

বিশপের কথা বিনা প্রতিবাদে মহিলা দু জন মেনে চলত, একথা আগেই আমরা বলেছি। ম্যাগলোরি বিশপের আদেশ পালন করতে চলে গেল।

বিশপ এবার লোকটির দিকে ঘুরে বললেন, আপনি বসুন মঁসিয়ে, শরীরটাকে একটু গরম করুন। কিছুক্ষণের মধ্যেই খাবার দেওয়া হবে এবং আপনি খেতে খেতেই বিছানা প্রস্তুত হয়ে যাবে।

লোকটি এবার বিশপের কথাটা বুঝল। তার চোখ-মুখের কঠোর ভাবটা সহসা কেটে গিয়ে তার জায়গায় বিস্ময়, অবিশ্বাস এবং আনন্দের ভাব ফুটে উঠল। সে শিশুসুলভ উচ্ছৃঙ্খলতার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। সে বলল, আপনারা সত্যিই আমাকে খাবার আর থাকার জায়গা দেবেন? আমি একজন জেল-কয়েদি হওয়া সত্ত্বেও আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না? আপনি আমাকে মঁসিয়ে বলে সম্বোধন করলেন। কিন্তু অন্য সবাই আমাকে বলেছে, বেরিয়ে যাও, কুকুর কোথাকার! আমি ভেবেছিলাম আপনারাও তাড়িয়ে দেবেন, তাই আমি আগেই সব কথা বললাম। আমার আসল পরিচয় দান করলাম। যে মহিলা আমাকে এখানে পাঠিয়েছেন তাঁর কাছে আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ। রাতের খাওয়া আর বিছানা।

তোশক, চাদর, বালিশ–উনিশ বছর আমি কোনও বিছানায় শুইনি। ঠিক আছে, আমার টাকা আছে, আমি দাম দিতে পারব। আপনার নামটা জানতে পারি স্যার? আপনি খুব ভালো লোক। টাকা আমি দেব। আপনি নিশ্চয় একজন হোটেলমালিক। তাই নয় কি?

বিশপ বললেন, আমি একজন যাজক এবং এখানেই থাকি।

যাজক! কিন্তু সত্যিই খুব ভালো যাজক। তা হলে আমাকে টাকা দিতে হবে না! আপনিই এই বড় গির্জার ভারপ্রাপ্ত যাজক? আমিই বোকা, আপনার মাথায় যাজকের টুপিটা আমি এতক্ষণ দেখিনি।

কথা বলতে বলতে পথিক তার পিঠের ব্যাগটা আর হাতের লাঠিটা ঘরের এক কোণে রাখল। তার পর হলুদ টিকিটটা পকেটের মধ্যে ভরে রেখে বসল। বাপতিস্তিনে তার দিকে তাকিয়ে তাকে দেখছিল। সে বলল, আপনি একজন মানুষের মতো মানুষ মঁসিয়ে। আপনি কোনও মানুষকে ঘৃণা করেন না। যাজক যদি মানুষ হিসেবে ভালো হয় তা হলে সত্যিই মানুষের উপকার হয়। তা হলে আমাকে কোনও টাকা-পয়সা দিতে হবে না?

বিশপ বললেন, না। কত পেয়েছেন আপনি? একশো নয় ফ্রাঁ?

আর পনেরো স্যু।

এ টাকা কতদিনে রোজগার করেছেন?

উনিশ বছরে।

পথিক বলল, টাকাটা আমার কাছে এখনও প্রায় সবটাই আছে। এই ক’দিনে আমি এর থেকে শুধু পঁচিশ স্যু খরচ করেছি। এ পয়সাটা আমি গ্রেসি নামে এক জায়গাতে গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে দিয়ে রোজগার করেছিলাম। আমাদের জেলখানায় মার্শেল থেকে একজন বিশপ আসতেন। জেলখানার ভেতরে যে বেদি ছিল তার সামনে তিনি সমবেত প্রার্থনার অনুষ্ঠান করতেন। তাঁর মাথার টুপিটাতে সোনার জরির কাজ করা ছিল। দুপুরের রোদে তাই চকচক করত টুপিটা। তাকে আমরা ভালো করে দেখতেই পেতাম না। তিনি আমাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে থাকায় কী বলতেন, তা শুনতেও পেতাম না।

ঘরের দরজাটা খোলা ছিল। বিশপ উঠে গিয়ে সেটা বন্ধ করে দিলেন। ম্যাগলোরি বাড়তি এক প্লেট খাবার নিয়ে এলে বিশপ বললেন, ওটা যথাসম্ভব আগুনের কাছে রাখ।

বিশপ এবার অতিথিকে বললেন, আল্পস পর্বত থেকে ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস বইছে। আপনার নিশ্চয় খুব শীত লাগছে মঁসিয়ে?

বিশপ যতবার পথিককে ‘মঁসিয়ে’ বলে সম্বোধন করেন পরম বন্ধুর মতো ততবারই তার মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এক ভূতপূর্ব জেলের কয়েদিকে এই ধরনের সৌজন্য দান করাটা লবণসমুদ্রে ভাসমান কোনও জাহাজডুবি মানুষকে সুপেয় জলদানের মতো বাঞ্ছিত অথচ অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা। অপমানিত মানুষই সম্মানের পিপাসায় আর্ত হয়ে ওঠে।

বিশপ বললেন, এই বাতিটার আলো তেমন জোর নয়।

তার মনের কথা বুঝতে পেরে ম্যাগলোরি বিশপের শোবার ঘর থেকেই দুটো রুপোর বাতিদান নিয়ে এসে তাতে দুটো বাতি জ্বালিয়ে খাবার টেবিলের উপর রাখল।

পথিক আবার বলল, মঁসিয়ে, আপনি বড় ভালো লোক। আপনি আমাকে ঘরে জায়গা দিয়ে আমার জন্য বাতি জ্বেলেছেন, আমাকে খাবার দিয়েছেন, অথচ আমি আমার কথা সব বলেছি।

বিশপ তাঁর একটি হাত পথিকের একটি বাহুর উপর রেখে বললেন, আপনার কিছুই বলার দরকার ছিল না। এ বাড়ি আমার নয়, খ্রিস্টের, তাঁর নামেই আমি ভোগ করি। এখানে। এলে কোনও মানুষকে তার নাম-ধাম বলতে হয় না, বলতে হয় শুধু কী বিপদে সে পড়েছে। আপনি বিপদে পড়েছেন, আপনি ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত, নিরাশ্রয়; সুতরাং আপনি এখানে স্বাগত। আপনাকে এ বাড়িতে স্থান দেওয়ার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানাবার কিছু নেই। যে কোনও নিরাশ্রয় ব্যক্তিই এখানে আশ্রয় চাইলে পাবে। এ বাড়িতে আমার থেকে আপনাদের অধিকারই বেশি। এখানকার সব কিছুই আপনাদের। কেন আমি আপনার নাম জিজ্ঞাসা করব? তাছাড়া আপনার নাম তো আমার আগেই জানা ছিল।

পথিক বিস্ময়ে চমকে উঠে বলল, আমার নাম আপনি জানেন?

বিশপ বললেন, অবশ্যই জানি। আপনার নাম হল ভাই।

পথিক বলল, মঁসিয়ে যাজক, আমি এখানে বড় ক্ষুধার্ত অবস্থায় আসি। কিন্তু এখন সে ক্ষুধা আমি অনুভব করতেই পারছি না। সব কিছু ওলটপালট হয়ে গেছে।

বিশপ অন্তরঙ্গভাবে বললেন, আপনি অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন।

হ্যাঁ, অনেক কষ্ট–কৃষিশ্রমিকদের মতো লম্বা আলখাল্লার মতো নোংরা পোশাক, হাতে শিকল, কাঠের তক্তার উপর শোয়া, তীব্র শীত-গ্রীষ্ম সহ্য করা, কঠোর পরিশ্রম, তার উপর মাঝে মাঝে চাবুকের আঘাত–এইসব কিছু সহ্য করতে হয়েছে আমাকে। এমনকি যখন আমি শুয়ে থাকতাম তখনও শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হত আমায়। কুকুরেরাও আমার থেকে ভালো থাকত। এইভাবে উনিশ বছর কাটাতে হয়েছে আমাকে। এখন আমার বয়স ছেচল্লিশ। আবার তার ওপর এক হলুদ টিকিট সঙ্গে আছে আমার। এই হল আমার কাহিনী।

বিশপ বললেন, তা থাক। শুনুন, একশো ধার্মিক যাজকের সাদা পোশাকের থেকে একজন পাপীর চোখে এক বিন্দু অনুতাপের অশ্রু ঈশ্বরের কাছে অনেক আনন্দদায়ক। আপনি যেখানে দুঃখভোগ করতেন সে জায়গাটি যদি আপনি সেখানকার মানুষদের প্রতি অন্তরে ঘৃণা আর ক্রোধ নিয়ে ত্যাগ করেন তা হলে আপনি আমাদের করুণার পাত্র হবেন, কিন্তু যদি আপনি কারও প্রতি কোনও অভিযোগ না রেখে শান্ত মনে সকলের প্রতি শুভেচ্ছা পোষণ করে সে জায়গা ত্যাগ করেন তা হলে আপনি মহত্ত্বে আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে যাবেন।

ম্যাগলোরি ততক্ষণে খাবারের সব ডিশ টেবিলের উপর সাজিয়ে দিয়ে গেছে। এক একটি ডিশে ছিল একটা করে বড় পাউরুটি, কিছু মাখন, কিছুটা তেল, নুন, কিছু শুয়োর ও ভেড়ার মাংস, আর ডুমুরের ঝোল। তার ওপর ছিল জল আর মদ। বিশপ দৈনন্দিন যে মদ ব্যবহার করতেন তার সঙ্গে অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত মদ থেকে আনা কিছু পুরনো ভালো মদ এনে পরিবেশন করল ম্যাগলোরি।

বিশপ তার নিজস্ব প্রথা অনুসারে অতিথিকে তার ডান দিকে বসালেন। তাঁর বোন বসল তার বাঁ দিকে। বিশপের মুখের প্রসন্ন ভাব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল তিনি অতিথিবৎসল।

বিশপ খেতে খেতে একসময় বললেন, টেবিলে একটা জিনিসের অভাব দেখা যাচ্ছে।

ব্যাপারটা বুঝতে পারল ম্যাগলোরি। এই বাড়িতে মোট ছয় জনের খাবার মতো রুপোর কাঁটাচামচ আছে। এই বাড়ির প্রথা হল এই যে কোনও অতিথি এলে খাবার টেবিলে ছয় জনের কাঁটাচামচ সব বার করে সাজিয়ে রাখতে হবে টেবিলে। এ যেন সামান্য কিছু একমাত্র ঐশ্বর্যের শিশুসুলভ ও নির্দোষ প্রকাশ। এই ঐশ্বর্যের এক আবরণ দিয়ে বিশপ যেন তার সংসারের দীনতা ও দারিদ্রকে ঢাকার প্রয়াস পেতেন।

ম্যাগলোরি রুপোর সব কাঁটাচামচ এনে খাবার টেবিলে পাতা সাদা ধবধবে কাপড়ের উপর সাজিয়ে দিল সেগুলো।

.

খাবার টেবিলে সেদিন কী কী কথা হয়েছিল তার বিবরণ মাদাম দ্য বয়শেনকে লেখা বাপতিস্তিনের একটি চিঠির অংশ থেকে বোঝা যাবে। বাপতিস্তিনে তাদের সেই অতিথি আর দাদার মধ্যে সে রাতে খাবার সময় যেসব কথাবার্তা হয়েছিল তার একটি পূর্ণ বিবরণ দান করে। সে লেখে,… লোকটা প্রথমে কোনও দিকে নজর না দিয়ে বুভুক্ষুর মতো খেয়ে চলেছিল একমনে। অবশেষে মদ পান করার পর সে বিশপকে বলল, মঁসিয়ে যাজক, ওয়াগনের লোকগুলো কিন্তু আপনাদের থেকে ভালো খায়।

সত্যি বলতে কি কথাটা শুনে আমি আঘাত পাই মনে। কিন্তু আমার দাদা সহজভাবে বললেন, তার কারণ আমার থেকে তারা বেশি পরিশ্রমের কাজ করে।

লোকটা বলল, না। কারণ তাদের বেশি টাকা আছে। আমি দেখছি আপনারা গরিব। হয়তো আপনি খুবই একটা ছোট গ্রাম্য যাজক। ঈশ্বর করেন যেন তাই হয়।

বিশপ বললেন, ঈশ্বর ন্যায়পরায়ণ, তিনি ঠিকই করেছেন।

একটু থেমে বিশপ আবার বললেন, মঁসিয়ে জাঁ ভলর্জ, আপনি কি পালিয়ে যাচ্ছেন?

ওই পথেই আমাকে যাবার আদেশ দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল সকাল হলেই আমাকে রওনা হতে হবে। এ পথে যাওয়া খুবই কঠিন। দিনে গরম, রাত্রিতে দারুণ ঠাণ্ডা।

আমার দাদা বললেন, আপনি এক ভালো অঞ্চলেই যাচ্ছেন। বিপ্লবে আমার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় একেবারে। আমি তখন ফ্রোশেকোঁতে চলে যাই এবং সেখানে দৈহিক শ্রমের দ্বারা জীবিকা অর্জন করি। ওখানে কাজের কোনও অভাব নেই। কাজ খুঁজতে আমার কষ্ট হয়নি, কারণ ওদিকে গোটা অঞ্চলটা কাগজের কল, তৈলশোধক কারখানা, লোহা আর তামার কারখানা, ঢালাই কারখানা প্রভৃতি কল-কারখানায় ভর্তি। ওই অঞ্চলের নাম লডস, শাতিলিয়ন, অজিনকোর্ট আর বোরে।

এইসব জায়গার নাম করার পর আমার দাদা আমার দিকে ফিরে বললেন, আচ্ছা ওই অঞ্চলে আমাদের কোনও আত্মীয় নেই?

আমি বললাম, আগে ছিল। অন্যদের মধ্যে মঁসিয়ে দ্য লুসেনেত আমাদের এক আত্মীয় ছিলেন। তিনি নগরদ্বারের এক ক্যাপ্টেন।

আমার দাদা বললেন, ১৭৯৩ সালের পর আমাদের আর কোনও আত্মীয় সেখানে ছিল না। আমাদের মধ্যে শুধু আমরাই অবশিষ্ট ছিলাম। ওখানে অনেক মাখনের কারখানা আছে। কারখানার মালিকরা হচ্ছে দুই শ্রেণির। একদল মালিক হল ধনী আর একদল মালিক হল গরিব চাষির দল। তারা কয়েকজন করে মিলে একটি করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। মাখন তৈরির কাজ শুরু হয় এপ্রিলের শেষের দিকে। তার পর জুনের মাঝামাঝি চাষিরা তাদের গরুগুলো পাহাড়ের উপত্যকায় চরাতে নিয়ে যায়।

আরও বেশি খাবার জন্য আমার দাদা অনুরোধ এবং উৎসাহিত করছিলেন তাকে। তিনি নিজে যে মদ কোনওদিন বেশি দাম বলে খান না, মভ থেকে আনা ভালো মদ তিনি তাকে খেতে বললেন, তার পর আমার দাদা মাখন তৈরির কথা বলছিলেন এবং মাঝে মাঝে থামছিলেন যাতে আমি এই আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারি। একটা জিনিস দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। লোকটি কী ধরনের ছিল তা আমি আগেই তোমায় বলেছি। আমার দাদা কিন্তু সন্ধে থেকে কখনও বা খাবার সময়েও লোকটার কোনও পরিচয় জানতে চাননি এবং তিনিও নিজের সম্বন্ধে কিছু বলেননি। সাধারণত একজন বিশপের পক্ষে একজন দুষ্কৃতকারীকে হাতের কাছে পেয়ে কিছু উপদেশ দানের এটাই ছিল সুবর্ণ সুযোগ। একইভাবে তিনি তার মনে রেখাপাত করতে পারতেন। অন্য কেউ হলে মৃদু ভর্ৎসনা আর নীতি-উপদেশের বাক্যদ্বারা তার দেহ ও আত্মাকে পাপের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে পারতেন। সহানুভূতির সঙ্গে এই আশা করতেন যে ভবিষ্যতে সে তার পথ পরিবর্তন করে ভালোভাবে বাঁচবে।

কিন্তু আমার দাদা লোকটা কোথায় জন্মেছে, সে কথাও তাকে একবার জিজ্ঞাসা করলেন না। তার জীবনকাহিনীর কথা জানতে চাইলেন না। তার জীবনকাহিনীর মধ্যে নিশ্চয় কিছু অপরাধের কথা ছিল। আমার দাদা সেইসব অপরাধের কথাগুলোকে পরিষ্কার এড়িয়ে গেলেন। আমার দাদা একবার পন্তালিয়েরের নির্দোষ, নিরীহ পার্বত্য অধিবাসীরা কিভাবে মুক্ত আকাশের তলে সন্তুষ্ট চিত্তে আনন্দের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করে চলে তার কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন পাছে তাতে লোকটা রুষ্ট হয়। আমার দাদার মনে তখন কী ছিল আমি পরে সেখানে জানতে পেরেছিলাম। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন জাঁ ভলজাঁ নামে সেই লোকটা আগে থেকেই হয়তো তার পাপচেতনায় জর্জরিত ছিল। তাই হয়তো তিনি তাকে তখনকার মতো সেই পাপচেতনার বোঝা থেকে তার মনটাকে মুক্ত করে তাকে অনুভব করাতে চাইছিলেন সে-ও আর পাঁচজনের মতো মানুষ। এটাও কি এক ধরনের বদান্যতা নয়? এক সূক্ষ্ম মানবতাবোধের বশবর্তী হয়ে এইভাবে ধর্মপ্রচার ও নীতি-উপদেশ দানের কাজ থেকে বিরত থাকা কি প্রকৃত যাজকের কাজ নয়? তার মনের ক্ষতটা নিয়ে ঘাটাঘাটি না করাটাও কি প্রকৃত সহানুভূতির ধর্ম নয়? আমার মনে হয় এটাই ছিল তার মনের আসল ভাব। তবে এটাও ঠিক যে তিনি তার এই ভাবের কোনও লক্ষণ আমার কাছেও কিছুমাত্র প্রকাশ করেননি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি জাঁ ভলজাঁর সঙ্গে একজন সাধারণ লোকের মতো খেয়ে গেলেন যেমন তিনি কোনও যাজক বা পদস্থ সরকারি অফিসারের মতো কোনও সম্মানিত অতিথির সঙ্গে খেতেন।

আমাদের খাওয়া যখন শেষ হয়ে আসছিল তখন দরজায় আবার করাঘাত হল। দরজা খুলতে দেখা গেল মাদাম গার্লদ ছেলে কোলে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমার দাদা ছেলেটার কপালে চুম্বন করে আমার কাছ থেকে পনেরো সু ধার করে মাদাম গার্লদকে দিলেন। জাঁ ভলজাঁ এদিকে কোনও নজর দিল না। তাকে তখন খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। মাদাম গার্লদ চলে গেলে আমার দাদা ভলজাঁর দিকে ঘুরে বললেন, আপনি তো এবার শুতে যাচ্ছেন। ম্যাগলোরি তাড়াতাড়ি খাবার টেবিলটা পরিষ্কার করে ফেলল। আমি বুঝলাম এবার আমাদের চলে যেতে হবে। লোকটাকে ঘুমোতে দিতে হবে। এই ভেবে আমরা উপরতলায় চলে গেলাম। কিন্তু কিছু পরেই আমি আমার ছাগলের চামড়ার কম্বলটা লোকটার কাছে পাঠিয়ে দিলাম, কারণ সেদিন খুব শীত ছিল এবং তাতে তার শরীরটা বেশ গরম হবে। আমার দাদা সেই জার্মানি থেকে কিনে এনেছিলেন। সেই সঙ্গে খাবার টেবিলে ব্যবহার করার জন্য হাতির দাঁতের বাটওয়ালা একটা ছুরিও কিনে এনেছিলেন। ম্যাগলোরি ফিরে এলে আমরা প্রার্থনার কাজ সেরে চলে গেলাম আর কোনও কথা না বলে।

.

তার বোনকে রাত্রির মতো বিদায় দিয়ে মঁসিয়ে বিয়েনভেনু দুটি রুপোর বাতিদানের মধ্যে একটি তুলে নিয়ে তাঁর অতিথিকে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। অতিথিদের শোবার ঘরে যেতে হলে বিশপের শোবার ঘরের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। ম্যাগলোরি তখন রুপোর কাঁটাচামচগুলো আলমারিতে গুছিয়ে রাখছিল।

অতিথির জন্য বিছানাটা পাতা হয়ে গিয়েছিল। লোকটা বিশপের সঙ্গে সেই শোবার ঘরটায় গিয়ে বাতিটা টেবিলের উপর রাখল।

বিশপ বললেন, ভালো করে শান্তিতে ঘুমোন। কাল সকালে এখান থেকে যাবার আগে আমাদের গরুর দেওয়া একপাত্র গরম দুধ পান করে যাবেন।

লোকটি বলল, ধন্যবাদ হে যাজক।

এই কথাটা বলার পরই হঠাৎ সে এক ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে দাঁড়াল, যা মেয়েরা দেখলে সত্যিই দারুণ ভয় পেয়ে যেত। কী আবেগের বশবর্তী হয়ে সে সেই মুহূর্তে এক ভয়ঙ্কর ভাব ধারণ করলে তা জানা যায় না, সে নিজেও হয়তো তা জানতো না। সে কি এর দ্বারা সতর্ক করে দিচ্ছিল বিশপকে অথবা ভয় দেখাচ্ছিল? অথবা এটা একটা তার সহজাত দুর্বার প্রবৃত্তির অদম্য আত্মপ্রকাশ? যা হোক, লোকটা সহসা ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশপের দিকে ভয়ঙ্করভাবে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, চমৎকার! কী আশ্চর্যের ব্যাপার।

আপনি আমায় আপনার শোবার ঘরের পাশেই শুতে দিচ্ছেন!

হঠাৎ সে এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সে হাসিতে এক দানবিক উচ্ছ্বাস ছিল। সে আবার বলল, আপনি কী করছেন তা একবার ভেবে দেখেছেন? আপনি কী করে। জানলেন যে আমি কখনও কাউকে হত্যা করিনি।

বিশপ শান্তভাবে বললেন, এটা ঈশ্বরের কাজ।

বিশপের ঠোঁট দুটি একবার প্রার্থনার স্বগত উচ্চারণে নড়ে উঠল, তিনি নিজেকে নিজে কী বলছিলেন। তার পর তিনি তাঁর ডান হাতটি তুলে দুটি আঙুল প্রসারিত করে লোকটিকে আশীর্বাদ করলেন। লোকটি তার মাথাটা একবারও নত করল না। বিশপ সেদিকে আর না তাকিয়ে নীরবে তাঁর শোবার ঘরে চলে গেলেন।

অতিথির বিছানার পাশে একটা পর্দা ফেলে দিয়ে বেদি থেকে বিছানাটাকে পৃথক করে রাখা হত। বিশপ একবার সেই পর্দার পাশে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করলেন। তার পর তিনি অন্যদিনকার মতো বাগানে চলে গেলেন। সেখানে পায়চারি করতে করতে সেইসব রহস্যের কথা ভাবতে লাগলেন যেসব রহস্য ঈশ্বর রাত্রির নীরব শান্ত অবকাশে সজাগ ব্যক্তির সামনে উদ্ঘাটিত করেন।

লোকটি এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল যে সে পরিষ্কার চাদরপাতা ভালো নরম বিছানাটার আরাম তার সজাগ সচেতন অনুভূতি দিয়ে উপভোগ করতে পারল না। সে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

বিশপ যখন বাগান থেকে তাঁর শোবার ঘরে চলে এলেন তখন রাত্রি প্রায় দুপুর। কিছুক্ষণের মধ্যে গোটা বাড়িটাই এক গভীর ঘুমের মধ্যে ঢলে পড়ল।

শেষরাতের দিকে জাঁ ভলজাঁ জেগে উঠল।

.

ব্রাই নামে একটি গাঁয়ের এক গরিব কৃষক পরিবারে জাঁ ভলজাঁর জন্ম হয়। শৈশবে সে লেখাপড়া শিখতে পারেনি। একটু বড় হলে সে ফেবারোলে গাছ কাটার কাজ করতে যায়। তার মার নাম ছিল ম্যাথিউ এবং তার বাবার নাম ছিল জাঁ ভলজাঁ। ডাক নাম ছিল ভাজা।

বাল্যকালে ভাবুক প্রকৃতির ছিল জাঁ ভলজাঁ। মনের মধ্যে কোনও বিষাদ না থাকলেও সে প্রায়ই কী সব ভাবত, তবে তার অন্তরটা ছিল সরল। তার চেহারার মধ্যে আকর্ষণ করার মতো কিছু ছিল না। কিশোর বয়সেই সে বাবা-মা দু জনকেই হারায়। তার মা প্রথমে রোগভোগে মারা যায়। তার বাবাও গাছ কাটার কাজ করত এবং একদিন গাছ কাটতে গিয়ে একটা গাছ তার উপর পড়ে যাওয়ায় সে মারা যায়। জাঁ ভলজাঁর আত্মীয় বলতে ছিল তার এক দিদি। তার দিদির স্বামী তখন বেঁচে থাকলেও দিদির সংসারে অভাব ছিল। তার সাতটা ছেলেমেয়ে ছিল। দিদির স্বামীও হঠাৎ মারা যায়। তখন তাদের বড় ছেলের বয়স আট। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর তার দিদিই জাঁ ভলজাঁকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। তখন তার বয়স চব্বিশ। দিদির সংসারেই থাকত-খেত সে। দিদির স্বামীর মৃত্যুর পর জাঁ ভলজাঁ খেটে দিদির সংসার চালাতে লাগল। বেশি খেটে কম মাইনে পেত সে। তার সারা যৌবন এই কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে কেটে যায়। যৌবনে কারও ভালোবাসা সে পায়নি। কোনও মেয়ের প্রেমের পড়ার কোনও সুযোগ পায়নি।

সারা দিনের কাজ শেষ করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে নীরবে রাতের খাওয়া সেরে ফেলত জাঁ ভলজাঁ। তার সামনে তার খাবারের পাত্র থেকে দু-এক টুকরো ভালো মাংস তুলে নিয়ে তার কোনও না কোনও ছেলেমেয়েকে দিত তার দিদি। জাঁ ভলজাঁ সেদিকে ইচ্ছা করেই কোনও নজর দিত না। তার দিদির বাড়ির কাছে একটা খামারে এক চাষি পরিবার বাস করত। দিদির ছেলে-মেয়েরা সেই চাষি পরিবার থেকে প্রায় দিনই তাদের মার নাম করে এক জগ করে দুধ এনে নিজেরা কাড়াকাড়ি করে খেত। তাদের মা জানতে পারলে তাদের মারত। কিন্তু জাঁ ভলজাঁ তা জানত এবং তার দিদিকে লুকিয়ে সেই দুধের দাম দিয়ে দিত।

গাছকাটার মরশুমে গাছকাটার কাজ করে রোজ চব্বিশ স্যু করে পেত। কিন্তু মরশুম শেষ হয়ে গেলে সে ফসল তোলা বা পশুচারণের কাজ করত। বছরের সব সময়েই সে কিছু না কিছু একটা করত এবং তার দিদিও কাজ করত। কিন্তু সাতটা ছেলেমেয়ের ভরণপোষণ চালাতে বড় কষ্ট হত তাদের। দারিদ্রগ্রস্ত এইসব ছেলেমেয়ে সব সময় অনাথ শিশুদের মতো ঘুরে বেড়াত। একবার শীতকালে জাঁ ভলজাঁদের সংসারে বড় দুঃসময় দেখা দিল। জাঁ ভলজাঁর তখন কোনও কাজ ছিল না। সে বেকার বসে ছিল। কোনও রোজগার ছিল না। সংসারে খাবার কিছু নেই, অথচ সাতটি ক্ষুধার্ত ছেলেমেয়ের মুখে কিছু না কিছু দিতে হবে।

কোনও এক রবিবার রাত্রিতে মবেয়ার ইসাবো নামে ফেবারোলের এক রুটির কারখানার মালিক যখন শুতে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ রুটি রাখার ভাড়ারঘরের জানালার কাঁচের সার্সি ভাঙার শব্দ শুনতে পায়। ইসাবো দেখে একটা লোক জানালার কাঁচ ভাঙার সেই ফাঁকটা দিয়ে একটা হাত ঢুকিয়ে একটা রুটি তুলে নিল। রুটি নিয়ে হাতটা বেরিয়ে গেল জানালা থেকে। ইসাবো তখন চোরটাকে তাড়া করল। লোকটা রুটি চুরি করে পালাচ্ছিল। কিন্তু ইসাবো তাকে ধরে ফেলল। চোরটার হাত থেকে তখনও রক্ত বার হচ্ছিল।

তখন চলছিল ১৭৯৫ সাল। বাড়ির দরজা ভেঙে বে-আইনি প্রবেশ ও চুরির অপরাধে অভিযুক্ত ভলজাঁর বিচার হয় স্থানীয় আদালতে। তার একটা ছোট বন্দুক ছিল। সেটা নাকি সে বৈধ ব্যাপারে ব্যবহার করত না। প্রমাণ পাওয়া গেল সে মাছ চুরি করত। মাছ চুরির কাজটা চোরাই মাল চালান করার মতোই অপরাধজনক। তবে একটা কথা বলা যেতে পারে, যারা পরের বাগানে গিয়ে পশুপাখি মেরে আনে বা মাছ চুরি করে তারা শহরের চোরাই মাল চালানকারী খুনি অপরাধীদের মতো কখনই ভয়ঙ্কর নয়। শহর মানুষকে হিংস্র এবং দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে। বন, পাহাড়, নদী, সমুদ্র মানুষকে হঠকারী করে তোলে। প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপ মানুষের মধ্যে বন্য দুর্বার ভাবটাকে জাগিয়ে তোলে বটে, কিন্তু তার মানবিক গুণ বা অনুভূতিগুলোকে ধ্বংস করে না।

বিচারে দোষী সাব্যস্ত হল জাঁ ভলজাঁ। সভ্য জগতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, এমন অনেক আইনের বিধান আছে, যা এক একটি মানুষের জীবনকে ভেঙে দেয়। এমন এক একটি মুহূর্ত আসে মানুষের জীবনে যখন সমাজ এক একটি মানুষকে ত্যাগ করে দূরে ঠেলে দেয়। তাকে নিঃস্ব ও সর্বহারা করে তোলে। জাঁ ভলজাঁ পাঁচ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।

১৭৯৬ সালের ২২ এপ্রিল যেদিন প্যারিসে মোতেনেত্তের বিজয়বার্তা ঘোষিত হয় সেদিন বিকেত্রের জেলখানায় জাঁ ভলজাঁ একজন শৃঙ্খলিত কয়েদি হিসেবে অবস্থান করছিল। যার বয়স এখন নব্বই এমন এক প্রাচীন কয়েদি তখন একই জেলখানায় ছিল। সেদিন জেলখানার উঠোনে কয়েদিদের চতুর্থ সারিতে শৃঙ্খলিত অবস্থায় জাঁ ভলজাঁ বসে ছিল। সে তার অজ্ঞ অশিক্ষিত সরল চাষি-মনে এই কথাই শুধু বুঝতে পেরেছিল যে তার অবস্থা সত্যিই ভয়ঙ্কর এবং তার অপরাধের অনুপাতে তার শাস্তিটা খুবই বেশি। যখন হাতুড়ির ঘা দিয়ে তার গলায় লোহার বেড়ি পরিয়ে দেওয়া হত তখন সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদত। সে তার হাত তুলে বোঝাতে চাইত সে যা কিছু করেছে তার বোনের সাতটি ছেলেমেয়ের জন্যই করেছে।

এরপর তাকে একটি মালবাহী গাড়িতে করে সাতাশ দিনের পথ অতিক্রম করে গলায় শিকল বাধা অবস্থায় তুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে তখন এক লাল আলখাল্লা পরিয়ে দেওয়া হয়। তার পূর্বজীবনের যা কিছু মুছে দেওয়া হয়। তার নামটাও যেন মুছে গিয়েছিল। সে যেন আর জাঁ ভলজাঁ নামে কোনও লোক ছিল না। সে শুধু একজন কয়েদি যার নম্বর ছিল ২৪৬০১। তার বোন ও বোনের ছেলেমেয়েদের ভাগ্যে কী ঘটল তার। কিছুই জানতে পারল না। কোনও গাছকে যখন করাত দিয়ে কাটা হয় তখন তার পাতাগুলোর অবস্থা কী হয়, তা সবাই জানে।

এ সেই একই পুরনো কাহিনী। এইসব দুঃখী মানুষ ঈশ্বরের সৃষ্ট জীব হলেও সহায়সম্বলহীন ও নিরাশ্রয় অবস্থায় যেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে কেন্দ্রচ্যুত হয়। নিষ্ঠুর ভাগ্যের বিধানে এইসব হতভাগ্যের দল আপন আপন জীবনের পথে চলে যায়। মানবজাতির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে সে পথ থেকে দূরে সরে পিছু কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায় তারা তা কে জানে! তাদের আপন আপন জেলা থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তাদের গাঁয়ের গির্জার গম্বুজ, গাঁয়ের পাশের ঝোঁপঝাড়ের কথা সব যেন ভুলে গিয়েছিল ভুলজা। মাত্র কয়েক বছরের কারাবাস অতীত জীবনের সব কিছু ভুলিয়ে দিয়েছিল যেন। তার মনের মধ্যে যে ক্ষত ছিল এতদিন একেবারে উন্মুক্ত, ক্রমে সেখানে যেন একটা ঢাকনা পড়ে গেল। তুলোতে থাকাকালে সে মাত্র একবার তার বোনের খবর পেয়েছিল। তুলোতে চার বছর থাকাকালে চতুর্থ বছরের শেষের দিকে সে খবর পায়। কার কাছ থেকে কিভাবে খবরটা পেল সে কেউ বলতে পারে না। তবে সে জেনেছিল তার বোনকে প্যারিসের পথে দেখতে পাওয়া গেছে। তার বোনের কাছে তখন শুধু তার কনিষ্ঠ সন্তান সাত বছরের একটি ছেলে ছিল। বাকি ছয়টি ছেলেমেয়ে কোথায় গেল, তা কেউ জানে না। তাদের মা-ও হয়তো জানে না। তার বোন একটি ছাপাখানায় কাজ করে কোনও এক জায়গায় থাকে। তার বাচ্চা ছেলেটাকে একটি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। সকালে উঠেই তাকে দু’টার সময় দোকানে হাজির হতে হয়। ছেলেটির স্কুল খোলে সাতটায়। তাই ছেলেটিকে সঙ্গে করে তার দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতে হয় এক ঘণ্টা, কারণ দোকানের ভেতর তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। শীতের সময় ছেলেটির বড় কষ্ট হয়। সে শীতে কুঁকড়ে কাঁপতে থাকে। বৃষ্টি এলে এক বৃদ্ধা দয়ার বশে ছেলেটিকে তার আস্তানায় আশ্রয় দেয়।

ছেলেটি সাতটা বাজলেই স্কুলে চলে যেত। ভলজাঁ শুধু তার বোনের এইটুকু খবরই পেয়েছিল। তার দিদির এই কাহিনী তার মনের মধ্যে অতীতের একটা রুদ্ধ জানালা খুলে হঠাৎ এক ঝলক আলো এনে তার প্রিয়জনদের কথা মনে পড়িয়ে দেয় এবং পরক্ষণেই সে জানালাটা রুদ্ধ হয়ে যায় চিরদিনের জন্য। তার পর থেকে সে তার দিদির আর কোনও খবর পায়নি, সে-ও তাদের দেখতে পায়নি।

তুলোঁর জেলখানায় থাকাকালে চতুর্থ বছরেই জেল থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে জাঁ ভলজাঁ। এ ব্যাপারে জেলখানার অন্যান্য কয়েদি তাদের প্রথা অনুসারে সাহায্য করে তাকে। জেল থেকে পালিয়ে গিয়ে দু’দিন গ্রামাঞ্চলে ঘুরে বেড়ায় সে। প্রতিমুহূর্তে ধরা পড়ার ভয়ে সচকিত হয়ে আহার-নিদ্রাহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়ানোটা যদি মুক্তি হয় তা হলে মাত্র দুদিনের জন্য সে-মুক্তি পেয়েছিল সে। প্রতিটি পথিক দেখলেই আঁতকে উঠত সে। কোনও কুকুর ডাকলে বা কোনও ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ পেলে চমকে উঠত। এইভাবে দু’দিন কাটাবার পর আবার সে ধরা পড়ে। ট্রাইব্যুনালের বিচারে আগেকার কারাদণ্ডের সঙ্গে নতুন করে তিন বছরের কারাদণ্ড যুক্ত হয়। এরপর ষষ্ঠ বছরে আবার একবার পালায় জেল থেকে। কিন্তু বেশিক্ষণ বাইরে থাকতে পায়নি। জেলখানায় নাম ডাকার সময় তাকে না দেখে প্রহরীরা তার খোঁজ করে। রাত্রিবেলায় ডকের কাছে এক জায়গায় তাকে দেখতে পেয়ে তাকে ধরে আনে। এবার সে প্রহরীদের সঙ্গে লড়াই করে এবং তাদের বাধা দেয় বলে এবার তার পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। তাকে দুটো শিকল দিয়ে বাঁধা হয়। দশম বছরে সে আবার পালায় এবং আবার ব্যর্থ হয়ে ধরা পড়ে। আবার তিন বছরে কারাদণ্ড বেড়ে গিয়ে সবসুদ্ধ মোলো বছরের কারাদণ্ড হয়। চতুর্থবার পালাবার অপরাধে আবার তিন বছর বেড়ে গিয়ে তার মোট কারাদণ্ড উনিশ বছরে গিয়ে দাঁড়ায়। ফলে ১৭৯৬ সালে কারাগারে প্রবেশ করে উনিশ বছর পর ১৮১৫ সালের অক্টোবর মাসে সে মুক্ত হয়। তার অপরাধ ছিল মাত্র একটা, একটি জানালার কাঁচের সার্সি ভেঙে একটা পাউরুটি চুরি করা।

এইভাবে একটি পাঁউরুটি চুরির ঘটনা একটি জীবনকে নষ্ট করে দেয়। জাঁ ভলজাঁর মতো ক্লদ গুয়েকও একটি পাউরুটি চুরি করে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনে। ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় প্রতি পাঁচটি ডাকাতির মধ্যে চারটির প্রত্যক্ষ কারণ হল ক্ষুধা।

জাঁ ভলজাঁ যখন প্রথম জেলখানায় যায় তখন সে কাঁদতে থাকে, ভয়ে কাঁপতে থাকে। কিন্তু যখন মুক্ত হয় তখন সে কিছুই করেনি, পাথরের মতো শক্ত হয়ে ছিল। নিবিড় হতাশা নিয়ে সে জেলে গিয়েছিল, কিন্তু যখন সে ফিরে আসে তখন আশা বা নিরাশা কিছুই ছিল না তার মনে। তার অন্তর্লোকে কী আলোড়ন বা পরিবর্তনের খেলা চলেছিল, তা কে জানে?

.

এ প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করা উচিত আমাদের। আমাদের মনে হয় এ সব দিকে সমাজের নজর দেওয়া উচিত। এটা সমাজেরই কাজ।

আমরা আগেই বলেছি জাঁ লেখাপড়া শিখতে পারেনি। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সে নির্বোধ ছিল। সহজাত বুদ্ধির একটা স্ফুলিঙ্গ তার মধ্যে ছিল। যে দুঃখ আগুনের দেহ এনেছিল তার জীবনে, সেই দুঃখই আলোর এক অপূর্ব জ্যোতি নিয়ে আসে। প্রথম প্রত্যূষের আলোর মতো সে জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার মনের প্রতিটি দিক-দিগন্ত। যতই সে বেত্রাঘাতে জর্জরিত হয়েছে, শৃঙ্খলের বন্ধনে আপীড়িত হয়েছে, কঠোর পরিশ্রমে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, নির্জন কারাকক্ষের নিঃসঙ্গতায় অশান্ত হয়ে উঠেছে, ভূমধ্যসাগরীয় সূর্যের জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ হয়েছে এবং কাঠের তক্তার কাঠিন্যে নিদ্রা তার বিঘ্নিত হয়েছে প্রতি রাত্রে, ততই সে নিজের বিবেকের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুধু ভেবেছে।

সে একাধারে নিজেই নিজের বিচারক ও জুরি হয়ে নিজের মামলার নিজেই বিচার করেছে।

সে যে অন্যায়ভাবে দণ্ডিত এক নির্দোষ নিরপরাধ লোক নয়, একথা সে স্বীকার করেছে। আবেগের আতিশয্যবশত যে কাজ সে করে ফেলেছে তা অবশ্যই নিন্দার্য।

যে পাঁউরুটি সে চুরি করেছিল তা চাইলে হয়তো সে পেত আর যদি চাইলে তাকে না দিত সে দান অথবা কর্মপ্রাপ্তি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারত। কিন্তু কোনও অর্ধভুক্ত মানুষ কি অপেক্ষা করতে পারে, এ প্রশ্ন কেউ করলে তার উত্তরে বলা যায় ক্ষুধার জ্বালায় খুব কম লোকই মরে। মানুষের দেহমন এমনভাবে গঠিত যে দীর্ঘকাল দুঃখকষ্ট ও নিদারুণ যন্ত্রণা ভোগ করেও সে কখনও মৃত্যুমুখে পতিত হয় না। তাকে আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরতে হত এবং তা হলে তার দিদির ছেলেমেয়েদের সুবিধা হত। সমাজকে গলা টিপে ধরে মারতে যাওয়ার আগে তার সীমিত ক্ষমতার কথাটা ভাবা উচিত ছিল। চুরির রাস্তা ধরে সে দারিদ্রের কবল থেকে মুক্ত হবে, তার এই ধারণাটাকে প্রশ্রয় দিয়ে নির্বোধের মতো কাজ করেছে সে। যে মানুষকে অখ্যাতির পথে নিয়ে যায় সে পথ কখনও মুক্তির পথ হতে পারে না। মোট কথা, সে যে অন্যায় করেছে একথা অকুণ্ঠভাবে স্বীকার করেছে সে।

কিন্তু এরপর নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে কতকগুলি। সে কি শুধু একাই এ কাজ করে বসেছে? কাজ করতে ইচ্ছুক কোনও লোক যদি কাজ বা খাদ্য না পায় তা হলে সেটা কি একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়? তাছাড়া দোষ স্বীকার করাটাই কি একটা ভয়ঙ্কর শাস্তি নয়? সে অপরাধ করে যত না অন্যায় করেছে, আইন তাকে লঘু পাপে গুরু শাস্তি দিয়ে কি তার থেকে অনেক বেশি অপরাধ করেনি? ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লায় শাস্তির দিকটা কি ঝুঁকে পড়েনি? এইভাবে একদিকের পাল্লা ভারী হয়ে ঝুঁকে পড়ায় তার ফল কিন্তু হিতে বিপরীত হয়ে যায়। সে অপরাধী তার দিকে পাল্লাটা না ঝুঁকে ঝুঁকল সেই দিকে যেদিকে চাপানো ছিল শাস্তির বোঝা। পালাবার চেষ্টার জন্য কারাদণ্ডের দেয়ালটা বারবার বাড়িয়ে দেওয়া কি দুর্বলের ওপর সবলের এক ধরনের আক্রমণাত্মক অত্যাচার নয়? এটা কি ব্যক্তির ওপর সমাজের অবিচার নয় এবং উনিশ বছর ধরে এই অত্যাচার-অবিচার অনুষ্ঠিত হয়ে আসেনি?

সে নিজেকে প্রশ্ন করল, কারও ওপর অর্থহীন প্রাচুর্য আর কারও ওপর নিষ্ঠুর অভাব আর নিঃস্বতা চাপিয়ে দেবার অধিকার সমাজের আছে কি না, একজন নিঃস্ব গরিবকে প্রয়োজন আর আতিশয্যের জাঁতাকলে পিষ্ট করার অধিকার আছে কি না–কাজের প্রয়োজন আর শাস্তির আতিশয্য। যেসব লোক সম্পদের সমবণ্টন চায় তাদের সঙ্গে এইরকম নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করাটা কোনও সমাজের পক্ষে এক দানবিক নির্মমতার কাজ নয়?

সে এইসব প্রশ্ন করল এবং সমাজকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দান করল।

সে ঘৃণার সঙ্গে সমাজকে ধিক্কার দিল। সে যেসব দুঃখকষ্ট ভোগ করেছে তার জন্য সমাজকেই দায়ী করল এবং সংকল্প করল যদি কোনওদিন সুযোগ পায় তা হলে সে সমাজের কাছে কৈফিয়ত চাইবে। পরিশেষে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, যে অপরাধ সে করেছে তার ওপর যে শাস্তি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে কোনও প্রকৃত সামঞ্জস্য নেই। আইনের দিক থেকে যদিও এই শাস্তিটা কোনও অন্যায় নয় তথাপি নীতির দিক থেকে অসংগতিপূর্ণ এবং অন্যায়।

জাঁ ভলজাঁ’র ক্রোধটা হয়তো অবান্তর এবং অবিবেচনাপ্রসূত মনে হতে পারে। কিন্তু তার ক্রোধের মধ্যে গভীর একটা জোরালো যুক্তি ছিল। তাই সে সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ হয়েছিল সমাজের ওপর।

তাছাড়া সমগ্রভাবে সমাজ তার ক্ষতি ছাড়া কিছুই করেনি। যে সমাজে প্রতিটি লোকই ন্যায়বিচারের নামে নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়েছে তার প্রতি। যারাই তার দেহ স্পর্শ করেছে তারাই তাকে আঘাত করেছে। শৈশব থেকে একমাত্র তার মা আর দিদি ছাড়া কারও কাছ থেকে শুনতে পায়নি সে একটু ভালোবাসার কথা বা কারও চোখে একটু সদয় দৃষ্টি দেখতে পায়নি। চরম দুঃখভোগের সময় তার শুধু বারবার মনে হয়েছে। গোটা জীবনটাই একটা সংগ্রাম এবং সে সংগ্রামে সে হেরে গেছে। এই সংগ্রামে ঘৃণাই ছিল তার একমাত্র হাতিয়ার এবং জেলখানায় যতদিন সে ছিল সে হাতিয়ারটাকে শান দিয়ে তীক্ষ্ণ করেছে এবং সেখান থেকে আসার সময়েও সেই তীক্ষ্ণ হাতিয়ারটাকে সঙ্গে করে এনেছে।

তুলোতে যাজকদের দ্বারা পরিচালিত একটা স্কুল আছে। যে হতভাগ্য শিক্ষাদীক্ষাহীন লোক পড়াশুনো করতে চায় তাদের সেখানে লেখাপড়া শেখানো হয়। সেই স্কুলে জাঁ ভলজাঁ কিছুদিন গিয়েছিল। তখন তার বয়স ছিল চল্লিশ। সেখানে সে লিখতে, পড়তে ও কিছু অঙ্ক কষতে শেখে। কিন্তু তখন তার মনে শুধু এই চিন্তাই ছিল যে তার মনের উন্নতিসাধন করা মানে যুক্তি দিয়ে তার ঘৃণার ভাবটাকে সুরক্ষিত করা। অনেক অবস্থায় দেখা যায় মানুষের শিক্ষা আর জ্ঞান তার কুভাব ও কুমতিকে বাড়িয়ে দেয়।

সমাজকে তার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী করে ধিক্কার দিতে গিয়ে ঈশ্বরের যে বিধান সমাজকে সৃষ্টি করেছে সেই বিধানের ওপরেই সে বিরূপ রায় দান করে বসে এবং সে বুঝতে পারে এটা তার অন্যায়। ফলে নিজেকেও সে ধিক্কার দেয়। সুতরাং তার উনিশ বছরের এই পীড়ন ও দাসত্বের কালে তার আত্মা একই সঙ্গে প্রসারিত ও সঙ্কুচিত হয়। একদিকে তার মধ্যে আলো প্রবেশ করে আর সঙ্গে সঙ্গে আর এক দিকে অন্ধকার প্রবেশ করে।

আমরা দেখেছি ভলজাঁ আসলে খারাপ প্রকৃতির লোক ছিল না। যখন সে কারাগারে যায় তখনও তার মধ্যে সদ্‌গুণ ছিল। কারাগারে থাকাকালে সমাজকে ধিক্কার দিতে গিয়ে পাপবোধ জাগে তার মধ্যে। ঈশ্বরকে ধিক্কার দিয়ে সে অধর্মাচরণ করছে একথা সে জানত।

এখানে একটা কথা ভাববার আছে।

কোনও মানুষের স্বরূপ বা স্বভাবটাকে কি সমগ্র ও মূলগতভাবে পাল্টানো যায়? যে মানুষ ঈশ্বরের বিধানে সৎ প্রকৃতির হয়ে জন্মেছে তাকে কি অন্য মানুষ অসৎ ও দুষ্ট প্রকৃতির করে তুলতে পারে? ভাগ্য কি মানুষের আত্মাকে নতুন করে অন্য রূপে গড়ে তুলতে পারে এবং কারও ভাগ্য খারাপ বলে সে-ও কি খারাপ হয়ে উঠতে পারে? প্রতিকূল অবস্থা বা দুর্ভাগ্যের চাপে কারও অন্তর কি একেবারে বিকৃত ও কুৎসিত রূপ ধারণ করতে পারে? কোনও উঁচু স্তম্ভকে কি নিচু ছাদ দিয়ে ঢাকা যায়? প্রতিটি মানবাত্মার মধ্যে কি দেবভাবের এমন এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নেই যা ইহলোকে ও পরলোকে অমর ও অবিনশ্বর, যা সহজাত সততার দ্বারা পুষ্ট ও সংরক্ষিত হয়ে গৌরবময় ও অনির্বাণ এক আলোকশিখায় পরিণত হয়, যাকে কোনও পাপ সম্পূর্ণরূপে নির্বাপিত করতে পারে না।

এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল প্রশ্ন। কোনও মনোবিজ্ঞানী যদি আইনের দ্বারা দণ্ডিত, সমাজ ও সভ্যতার দ্বারা ধিকৃত জাঁ ভলজাঁকে শ্রমহীন কোনও শান্ত অবকাশে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ বুকে নিয়ে চিন্তান্বিতভাবে বসে থাকতে দেখতেন তা হলে তিনি ওইসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতেন না।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে তিনি তা পারতেন না। সেই মনোবিজ্ঞানী পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারতেন জাঁ ভলজাঁর মনের মধ্যে যে দুরারোগ্য ব্যাধি ঢুকেছে তার জন্য তিনি দয়া বোধ করতেন কিন্তু তার কোনও প্রতিকার করতে পারতেন না। দান্তে যেমন নরকের দ্বারে গিয়ে এক বিশাল অন্ধকার খাদ দেখে চমকে উঠেছিলেন। তেমনি তিনি জাঁ ভলজাঁর আত্মার মধ্যে এক বিশাল শূন্যতা দেখে ভয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেন। তার কপালে ঈশ্বর যে আশার কথা তার আঙুল দিয়ে লিখেছেন সে কথা তিনি মুছে দিতেন।

কিন্তু ভলজাঁর ব্যাপারটা কী? তার যে আত্মিক সরল অবস্থার কথা আমরা পাঠকদের কাছে চিত্রিত করেছি, সে অবস্থাটা কি তার কাছেও তেমনি সরল ছিল? তার নৈতিক অধঃপতনের মধ্যে মূলে যেসব উপাদান কাজ করেছিল তা কি সে স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল? তার মতো অশিক্ষিত স্থল প্রকৃতির এক মানুষ কি কখন কিভাবে ক্রমান্বয়ে তার আত্মা ওঠানামা করতে করতে তার নীতিচেতনার শূন্য গভীরে তলিয়ে যায় তার গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে পারে? আমরা তা পারব না এবং আমরা সেটা বিশ্বাস করতে পারব না। এত দুঃখকষ্টের পরেও তার অজ্ঞতার জন্য সে সরলভাবে চিন্তাগুলোকে সাজিয়ে কোনও কিছু বিশ্লেষণ করতে পারল না। অনেক সময় সে তার আপন অনুভূতিরই তল খুঁজে পেত না। সে যে ছায়ার মধ্যে বাস করত, ছায়ার মধ্যেই কষ্ট ভোগ করত, সে ছায়াকে ঘৃণা করত, সে যেন নিজেকে নিজে ঘৃণা করত। সে একজন অন্ধ লোকের মতো মনের অন্ধকারে কী যেন হাতড়ে বেড়াত, স্বপ্নবিষ্টের মতো সেখানে থাকত সব সময়। মাঝে মাঝে অতিরিক্ত দুঃখভোগের জন্য এক প্রচণ্ড ক্রোধের আবেগে ফেটে পড়ত সে। সে ক্রোধের একটি অগ্নিশিখা তার সমস্ত আত্মাকে আলোকিত করে তার জীবনপথের সামনে-পেছনে যেসব নিয়তিসৃষ্ট ফাঁক ছিল তার উপর এক জ্যোতি বিকীরণ করত।

কিন্তু এইসব আলোর ছটা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই অপসৃত হয়ে পড়ত। ফলে আবার অন্ধকার ঘন হয়ে উঠত তার চারদিকে। সে কোথায় তা নিজেই বুঝতে পারত না।

এই ধরনের শাস্তির মধ্যে এমন এক নির্মম পাশবিকতা আছে, যা ধীরে ধীরে মানুষের মনটাকে ক্ষয় করে ফেলে তাকে পশুতে পরিণত করে তোলে। এক একসময় হিংস্র হয়ে ওঠে সে পশু। জাঁ ভলোর বারবার পালিয়ে যাবার চেষ্টা মানবাত্মার ওপর আইনের কঠোরতার এক অভ্রান্ত প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই নয়। সে কখনও কোনও সুযোগ পেলেই পরিণাম বা অতীত অভিজ্ঞতার কথা কিছু না ভেবেই বারবার পালাবার চেষ্টা করত। রুদ্ধদ্বার নেকড়ে বাঘের মতো দরজা খোলা পেলেই সে পাগলের মতো ছুটে যেত সেই দিকে। তার সহজাত প্রবৃত্তি তাকে সে দরজা দিয়ে পালাতে বলত, আর যুক্তিবোধ তাকে সেখানেই থাকতে বলত। এই ধরনের এক প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্বে অদৃশ্য হয়ে যেত তার যুক্তিবোধ। ফলে তার মধ্যে পশুটাই রয়ে যেত এবং সে ধরা পড়লে তাকে যে বাড়তি শাস্তি দেওয়া হত তা সেই পশুর হিংস্রতাকে বাড়িয়ে দিত।

একটা কথা অবশ্যই বলা উচিত যে জেলখানার অন্য কয়েদিদের থেকে জাঁ ভলজাঁর দৈহিক শক্তি অনেক বেশি ছিল। যে কোনও শক্ত কাজে সে ছিল চারটে লোকের সমান। সে অনেক ভারী ভারী বোঝা তুলতে পারত। একবার তুলোর টাউন হল মেরামতের একটা কাঠের ভারী বাড়ি পড়ে যাবার উপক্রম হলে সাহায্য না আসা পর্যন্ত ভলজাঁ কাঁধে করে বেশ কিছুক্ষণ সেটাকে ধরে রাখে।

তার দৈহিক শক্তির থেকে বুদ্ধি ও কৌশল আরও বেশি ছিল। যেসব দেয়াল বা কোনও খাড়া পাহাড়ে কোনও হাত-পা রাখার জায়গা নেই, সেসব দেয়াল বা পাহাড়ের উপর সে অবলীলাক্রমে উঠে যেত এক সুদক্ষ জাদুকরের মতো। এইভাবে যেকোনও তিনতলা বাড়ির ছাদের উপর উঠে যেতে পারত সে।

সে খুব কম কথা বলত এবং হাসত না কখনও। তার মুখ থেকে কোনও জোর হাসি বা অট্টহাসি বার করা খুবই কঠিন ছিল। কখনও সে মনে কোনও প্রবল আবেগ না জাগলে সে কখনও হো হো শব্দে হাসত না। তাকে দেখলেই মনে হত সে যেন সব সময় ভয়ঙ্কর এক চিন্তায় মগ্ন হয়ে আছে।

এইভাবে দিন কাটাত সে। এক অসংগঠিত অসংহত চরিত্রের অলস উপলব্ধি আর অসংগত বুদ্ধিবৃত্তির ভারী বোঝাভার নিয়ে এক অন্তহীন বিহ্বলতার সঙ্গে সে শুধু এই কথা অনুভব করে যেত যে এক বিরাট দানবিক শক্তি সব সময় পীড়ন করে চলেছে তাকে। অস্বচ্ছ অপ্রচুর আলোর যে বৃত্তসীমা তার জীবনকে ঘিরে রেখেছিল সে বৃত্তের বাইরে উধ্বালোকে তাকিয়ে সে কি কিছু দেখার চেষ্টা করত? যদি তা করত তা হলে সে ভয় আর ক্রোধের এক মিশ্র অনুভূতির সঙ্গে দেখতে পেত আইন, কুসংস্কার, মানুষের সমাজজীবন ও ব্যক্তিজীবনের অসংখ্য তথ্যপুঞ্জ সমন্বিত পিরামিডের মতো এক অদ্ভুত আকারের সুবিশাল সৌধ দাঁড়িয়ে আছে তার মাথার উপরে যে সৌধকে আমরা সভ্যতা বলে অভিহিত করে থাকি। সেই অদ্ভুত সৌধের পুঞ্জীভূত রূপটাই অভিভূত করত তাকে। তার মধ্যস্থিত উপাদানগুলো পৃথকভাবে স্পষ্ট করে বুঝতে পারত না সে। তবে মাঝে মাঝে সেই তথ্যপুঞ্জের ফাঁকে ফাঁকে কতকগুলি জিনিসকে স্পষ্ট করে দেখতে পেত সে যেমন জেলখানার প্রহরী, পুলিশ, বিশপ আর সবার উপর মুকুটমণ্ডিত সম্রাট। এইসব দূরস্থিত ঐশ্বর্যের বস্তুগুলো কমানোর পরিবর্তে বাড়িয়ে দিত তার মনের অন্ধকারটাকে। সে দেখত কত মানুষ আসা-যাওয়া করছে তার মাথার উপর দিয়ে। কত আইন, প্রথা, কুসংস্কার, গোঁড়ামি, মানবজীবনের কত ঘটনা প্রভৃতির অজস্র উপাদানে ঈশ্বর যে সভ্যতাকে জটিল করে তুলেছেন সে সভ্যতা শান্ত নিষ্ঠুর এক ঔদাসীন্যের চাপে তার আত্মাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছে। যারা দুঃখ-বিপর্যয়ের অতল গহ্বরে পতিত, যারা নরকের অন্ধকারে দিশাহারা, যারা সমাজ ও আইনের দ্বারা অবজ্ঞাত ও ধিকৃত সেইসব হতভাগ্য মানুষ তাদের ঘাড়ের উপর এক নিষ্করুণ সমাজের দুর্বিষহ বোঝাভার অনুভব করে চলে। সে বোঝাভার দেখে বাইরের লোকেরা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এই অবস্থার মধ্যে জাঁ ভলজাঁ কী সব ভাবত। কিন্তু কী ভাবত সে?

জাঁতাকলের মাঝখানে সামান্য এক শস্যদানার চিন্তা ছাড়া আর কোন চিন্তা বিষয়বস্তু হতে পারে তার কল্পনার সঙ্গে বাস্তব এবং বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা মিশে তার মনের কাঠামোটাকে এমন করে তুলেছিল যে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। জেলখানায় কঠোর শ্রমের কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে কী ভাবত সে। তার সে যুক্তিবোধ আগের থেকে আরও পরিণত ও আরও বিচলিত হয়ে উঠেছিল তা এক সহজ অবিশ্বাসের মধ্যে ঢলে পড়ত। যেসব ঘটনা তার সামনে ঘটত সেসব ঘটনার মানে বুঝতে না পেরে তাদের অকল্পনীয় ও অচিন্ত্যনীয় মনে হত। বড় অদ্ভুত মনে হত তার চারপাশের জগৎকে। নিজের মনে মনে বলত, এইসব কিছুই স্বপ্ন। যে প্রহরী তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত তাকে ভূত বলে মনে হত তাকে কোনও আঘাত না করা পর্যন্ত।

প্রকৃতিজগৎ সম্বন্ধে তার কোনও চেতনাই ছিল না। জাঁ ভলজাঁ সম্বন্ধে একথা বলা প্রায় ঠিক হবে সে সূর্যের কোনও অস্তিত্ব ছিল না তার কাছে। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন কোন সত্যের আলোয় প্রতিভাত হয়ে থাকত তার আত্মা।

জাঁ ভলজাঁর উনিশ বছরের সশ্রম কারাজীবন তার জীবন ও আত্মাকে যেন ভেঙেচুরে নতুন রূপে গড়ে তুলেছিল। ফলে সমাজের কাছ থেকে যে অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়ন তাকে সহ্য করতে হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মন তার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সমাজের প্রতি প্রতিশোধবাসনা জাগে তার অন্তরে। এই প্রতিশোধবাসনার বশবর্তী হয়ে সে দুই ধরনের কুকর্ম করে বসত। এক একসময় সে কোনও ভাবনা-চিন্তা না করে অন্ধ ক্রোধের আবেগে অনেক কুকর্ম করে বসত। আবার অনেক সময় ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করে অনেক অন্যায় করে বসত। তবে তার সকল অন্যায়, কুকর্ম বা অপকর্মের পেছনে সমাজের বিরুদ্ধে এক দুর্মর দুর্জয় প্রতিশোধবাসনা কাজ করে যেত। তার এই শেষোক্ত যুক্তিভিত্তিক কুকর্ম করার আগে তার মনের সব ভাবনা-চিন্তা পরপর তিনটি স্তর অতিক্রম করে এক সিদ্ধান্তে উপনীত হত। এই তিনটি স্তর ছিল–যুক্তি, সংকল্প আর গোঁড়ামি। তার সমস্ত আবেগ ও প্রবৃত্তি ক্রোধ, তিক্ততা আর পীড়নজনিত এক চেতনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও অনুশাসিত হত। তার এই ক্রোধাবেগ অনেক সময় কোনও নিরীহ নির্দোষ লোক তার সামনে পড়ে গেলে তার ওপরেও বর্ষিত হত। তার সমস্ত চিন্তার শুরু এবং শেষে ছিল মানব সমাজে প্রচলিত আইন-কানুনের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা। সাধারণত এই ভয়ঙ্কর ঘৃণা কোনও ঐশ্বরিক বিধানের দ্বারা প্রতিহত না হলে তা বাড়তে বাড়তে সমস্ত সমাজ, মানবজাতি ও ঈশ্বরের সৃষ্টি সকল বস্তুকে গ্রাস করে ধীরে ধীরে। তখন সে সমগ্রভাবে মনুষ্যবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। যে কোনও লোকের ক্ষতি করার এক দুর্বার বাসনায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। জেল থেকে বেরিয়ে যে হলুদ টিকিট তার কাছে সব সময় থাকত সে টিকিটের উপর লেখা ছিল, অতিশয় বিপজ্জনক ও ভয়ঙ্কর লোক। দিনে দিনে তার অন্তরাত্মাটা একেবারে শুকিয়ে যায়। জগৎ ও জীবনকে দেখার সহজ, স্বাভাবিক ও স্বচ্ছ দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে সে। তার উনিশ বছরের কারাজীবনের মধ্যে কোনওদিন একফোঁটা চোখের জল ফেলেনি সে।

.

জাহাজের যাত্রীটি লাফিয়ে পড়ল জলে।

কিন্তু জাহাজ থামল না। অনুকূল বাতাসের সহায়তায় ধ্বংসোনুখ জাহাজটা এগিয়ে চলেছে চরম পরিণতির দিকে। আত্মহননের লক্ষ্য থেকে কোনওমতেই বিচ্যুত হবে না যেন সে। সেই পথে অনিবারণীয় অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলতে লাগল সে।

লোকটা জলে ডুব দিয়ে আবার উঠে এল। সে দু হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু কেউ তার কথা শুনতে পেল না। বাতাসের আনুকূল্যে জাহাজ তার কাজ করে যেতে লাগল। কিন্তু যে যাত্রীটি জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপ দিল তার কী হল, তা জাহাজের নাবিক বা কোনও যাত্রীর সেদিকে কোনও নজর ছিল না। অন্তহীন বিশাল সমুদ্রে যেন সূচ্যগ্রপ্ৰমাণ এক চিহ্ন।

লোকটা হতাশ হয়ে অপস্রিয়মাণ জাহাজটার পানে তাকিয়ে ডাকতে লাগল। কিন্তু ভূতের মতো দেখতে জাহাজটা দ্রুত আড়াল হয়ে গেল তার দৃষ্টিপথ থেকে। কিছুক্ষণ আগেও সে ওই জাহাজেই ছিল। নাবিকরা অন্য সব যাত্রীর সঙ্গে ডেকের উপর ছিল। সে-ও তাদের সকলের সঙ্গে সমান ভাবে আলো-বাতাস ভোগ করেছে। কিন্তু তার একটু পরেই সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দেয়।

চারদিক থেকে দানবিক ঢেউগুলোর আঘাতের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল, সে চঞ্চল বাতাসের আঘাতে ঢেউগুলো সব উত্তাল হয়ে উঠল। তার মুখে সমুদ্রের নোনা জল এসে লাগতে লাগল। যে ভয়ঙ্কর সমুদ্রটা তাকে গ্রাস করতে চাইছে সেই অন্ধকার সমুদ্রটাই তার কাছে ঘৃণার এক মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠল।

তবু সে মরিয়া হয়ে সাঁতার কেটে যেতে লাগল। ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে তার শক্তি ক্ষয় হতে লাগল। সে মাথার উপর দেখল ঘন মেঘমালা আকাশটাকে আচ্ছন্ন। করে আছে। সারা সমুদ্রের অনন্ত পটভূমিজুড়ে মূর্তিমান মৃত্যুকে যেন হেঁটে বেড়াতে দেখল সে। পৃথিবীর দূর প্রান্ত থেকে অজানা কতসব দূরাগত শব্দের ধ্বনি শুনতে পেল সে। আকাশে মেঘমালার কোলে কোলে পাখি উড়ে বেড়াচ্ছিল। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার মাঝে দেবদূতেরা পাখা মেলে উড়ে আসে। কিন্তু সে দেবদূতেরা কী করতে পারে তার জন্য? তারা শুধু গান করতে করতে পাখা মেলে উড়ে যায় আর সে শুধু বাঁচার জন্য। সংগ্রাম করে যায়।

অনন্ত আকাশ আর অনন্ত সমুদ্রের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলল সে। সমুদ্র হচ্ছে এক বিশাল সমাধিগহ্বর আর আকাশ হচ্ছে শবাচ্ছাদন। তখন অন্ধকার ঘন হয়ে আসছিল। যতক্ষণ তার শক্তি ছিল দেহে ততক্ষণ সে সমানে সাঁতার কেটে এসেছে। এদিকে জাহাজটা তার যাত্রীদের নিয়ে অনেকক্ষণ আগেই কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। গোধূলির বিশাল ছায়ান্ধকারে এক অসহায় নিঃসঙ্গতার মাঝে সে শুধু অনুভব করল চারদিক থেকে অসংখ্য তরঙ্গমালা তার কাছে ছুটে আসছে। শেষবারের মতো একবার ভয়ে চিৎকার করে উঠল সে। কোনও মানুষকে ডাকল না। কিন্তু ঈশ্বর কোথায়?

যে কোনও বস্তু বা ব্যক্তি যার নাম ধরেই ডাকুক না কেন, কেউ কোনও সাড়া দিল না সে ডাকে। না সমুদ্রের জলরাশি, না অনন্ত প্রসারিত আকাশ কেউ সাড়া দিল না তার ডাকে। সে সমুদ্র ও বাতাসকে ডাকল। কিন্তু তারা যেন একেবারে বধির। তার চারদিকে গোধূলির ধূসর অন্ধকার, অন্তহীন নিঃসঙ্গতা আর উদ্দাম অবিরাম জলকল্লোল। তার অন্তরে তখন শুধু শঙ্কা আর অবসাদ, তার তলদেশে তখন অতলান্তিক শূন্যতা। পায়ের তলায় দাঁড়াবার কোনও জায়গা নেই। সে শুধু বুঝতে পারল তার দেহটা অন্ধকারে ভেসে চলেছে। ঠাণ্ডায় অসাড় হয়ে আসছে তার সর্বাঙ্গ। তার হাত দুটো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আছে, কিন্তু সে হাতে কিছুই ধরা নেই। শুধু বাতাস, সমুদ্রের কল্লোল আর আকাশের তারাদের অর্থহীন চাউনি। করবে সে? হতাশা চায় আত্মসমর্পণ, ক্লান্তি বা অবসন্নতা চায় মৃত্যু। সে-ও অবশেষে সব সগ্রাম ত্যাগ করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। সে ডুবে গেল।

এই হল মানবসমাজের এক অপরিণামদর্শী অগ্রগতি। তার চলার পথে কত জীবন, কত আত্মা নিষ্পেষিত হয়ে যাচ্ছে তার দর্পিত পদভরে। এ যেন এক আশ্চর্য মহাসমুদ্র যার মধ্যে নিষ্ঠুর আইনের দ্বারা নির্বাসিত কত মানুষ কোনও সাহায্য না পেয়ে নৈতিক মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হয়েছে। এই সমুদ্র হচ্ছে নির্মম নিষ্করণ এক সামাজিক অন্ধকার, দুঃখের অতলগর্ভ খাদ যার মধ্যে আইনে দণ্ডিত হতভাগ্য মানুষদের সমাজ ফেলে দেয়। যেসব মানুষের আত্মা এই সমুদ্রগর্ভে সমাধি লাভ করে তাদের কেউ উদ্ধার করতে পারে না।

.

জেলখানা থেকে বার হবার সময় জাঁ ভলজাঁ যখন তুমি মুক্ত’ এই কথা দুটো শুনল তখন সে যেন তা বিশ্বাস করতে পারছিল না, অবিশ্বাসের অন্ধকারে মনটা যেন ধাঁধিয়ে গেল তার। সহসা যেন আলোর একটা তীর এসে চোখ দুটোকে বিদ্ধ করল তার। সে আলো হল জীবনের আলো, জীবন্ত মানুষের আলো। কিন্তু ফুটে উঠতে না উঠতে সে আলো ম্লান হয়ে গেল মুহূর্তে। স্বাধীনতার কল্পনায় সে যেন অভিভূত হয়ে পড়ল। সেই মুহূর্তে এক নতুন জীবনের আশ্বাসে সঞ্জীবিত হয়ে উঠল সে। কিন্তু হাতে একটা হলুদ টিকিট পাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার স্বাধীনতার অর্থটা বুঝতে পারল।

এর পরেও ছিল আরও মোহমুক্তি। সে আগে ভেবেছিল এতদিন কারাগারে কাজ করে যে টাকা উপার্জন করেছে তা সব মিলিয়ে হবে একশো সত্তর ফ্রাঁ কিন্তু রবিবারগুলোর খাটুনি সে ভুল করে ধরেছিল। সেসব বাদ দিয়ে সে মোট পেল একশো উনিশ ফ্রাঁ পনেরো স্যু।

এর মানে সে বুঝতে পারল না। সে ভাবল তাকে ঠকিয়েছে তারা। জেলকর্তৃপক্ষ তার খাটুনির টাকা চুরি করে নিয়েছে।

জেল থেকে যেদিন সে ছাড়া পায় সেদিন সেখান থেকে বেরিয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে গ্রেসি নাম একটা জায়গাতে সে দেখল একটা কারখানার সামনে মাল নামানো হচ্ছিল। ওয়াগন থেকে। তখন সে সেখানে কুলির কাজ করতে চায়। সেখানে লোকের দরকার ছিল বলে মাল খালাস করার কাজে তাকে নিল তারা। সে যখন কাজ করছিল তখন একজন পুলিশ এসে তার পরিচয় জানতে চাইলে সে তার হলুদ টিকিটটা দেখায় তাকে। তার পর আবার কাজ করতে থাকে। দিনের শেষে একজন কুলিকে সে তাদের পারিশ্রমিক কত করে, তা জানতে চায়। তাকে বলা হয় এ কাজের রোজ হচ্ছে তিরিশ স্যু। কিন্তু ফোরম্যান লোকটা তার হলুদ টিকিট দেখতে পাওয়ায় সে তার কাছে থেকে মজুরি চাইতে গেলে সে তাকে মাত্র পঁচিশ স্যু দেয়। সে বার বার তিরিশ স্যু দাবি করলে ফোরম্যান তাকে বলে, নেবে নাও, না হলে আবার তোমাকে জেলে ঢুকতে হবে।

আবার সে বুঝতে পারল সে প্রতারিত হল। এর আগে সমাজ তাকে প্রতারিত করেছে। এবার সে পেল ব্যক্তিবিশেষের প্রতারণা। সে বুঝল জেল থেকে খালাস মানেই মুক্তি নয়। একটা লোক জেলখানা ত্যাগ করলেই সে মুক্ত হয় না, তার দণ্ড ঘোচে না। সমাজের কাছে সে চিরদণ্ডিতই রয়ে যায়।

গ্লেসিতে যে ঘটনা ঘটেছিল এই হল তার বিবরণ। দিগনেতে সে কী রকম অভ্যর্থনা লাভ করে, তা আমরা আগেই জেনেছি।

.

গির্জার ঘড়িতে দুটো বাজতেই ঘুম থেকে জেগে উঠল জাঁ ভলজাঁ।

বিছানার অতিরিক্ত আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতিই ঘুমটা দীর্ঘ হতে দেয়নি তার। সে উনিশ বছর কোনও বিছানায় শোয়নি, তবু তক্তার কাঠই ছিল তার একমাত্র শয্যা। সে তার পোশাক না খুলেই শুয়ে পড়েছিল বিছানায়। ঘুমটা তার খুব একটা দীর্ঘায়িত না হলেও সে চার ঘণ্টা ঘুমিয়েছিল আর তাতে তার দেহের ক্লান্তিটা দূর হয়ে যায় একেবারে। কখনই খুব বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোয় না ভলজাঁ।

চোখ মেলে অন্ধকারেই একবার তাকাল সে। তার পর আবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্য বন্ধ করল চোখ দুটো। কিন্তু গতকাল সারাদিন বিভিন্ন রকমের আবেগানুভূতি আর চিন্তার পীড়নে মস্তিষ্কটা গরম থাকায় ঘুমটা ভাঙার পর আর নতুন করে ঘুম এল না তার। সে আর ঘুমোতে পারল না; শুয়ে শুয়েই ভাবতে লাগল।

তার মনের মধ্যে জোর আলোড়ন চলছিল তখন। নতুন-পুরনো অনেক চিন্তা আসা-যাওয়া করতে লাগল তার মনে। অনেক চিন্তা এল আর চলে গেল। কিন্তু একটা চিন্তা বারবার ফিরে আসতে লাগল। সে চিন্তা অন্য সব চিন্তাকেই মুছে দিতে লাগল জোর করে। সে চিন্তা হল বিশপের টেবিলের উপর নামিয়ে রাখা রুপোর কাঁটাচামচগুলো।

খাবার সময় টেবিলের উপর সেগুলো দেখেছিল সে। তার পর দেখেছিল শোবার সময় ম্যাগলোরি সেগুলো বিশপের ঘরের ভেতর আলমারিতে রাখে। সে দেখে নিয়েছে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে বিশপের ঘরে ঢুকলেই ডান দিকের আলমারিতে আছে সেগুলো। সেই খাঁটি রুপোর জিনিসগুলো বিক্রি করলে তার থেকে অন্তত দুশো ট্র্য পাওয়া যাবে। সে উনিশ বছরের মধ্যে যা রোজগার করছে তার দ্বিগুণ, যদিও জেলকর্তৃপক্ষ তাকে না ঠকালে সে আরও কিছু বেশি পেত।

পুরো এক ঘণ্টা সে দারুণ অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে ভুগতে লাগল; কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারল না। গির্জার ঘড়িতে তিনটে বাজল। সে চোখ খুলে বিছানায় বসল। বিছানার পাশে পড়ে যাওয়া পিঠের ব্যাগটা কুড়িয়ে নিল। পা দুটো ঝুলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রইল সে। সারা বাড়িটার মধ্যে একমাত্র সে-ই জেগে ছিল। হঠাৎ পা থেকে জুতো দুটো খুলে পাপোশের কাছে রেখে দিয়ে আবার ভাবতে লাগল।

সেই কুৎসিত চিন্তাটা ভারী বোঝার মতো আবার আসা-যাওয়া করতে লাগল মনের মধ্যে। তার মাঝে মাঝে অন্য অপ্রাসঙ্গিক চিন্তাও আসতে লাগল। ব্রিভেত নামে জেলখানার এক কয়েদি তার পায়জামাটা পা থেকে গুটিয়ে বেঁধে রাখল সুতোর একটা দড়ি দিয়ে।

সকাল পর্যন্ত হয়তো এইভাবে বসে বসেই ভাবত ভলজাঁ। কিন্তু ঘড়িতে সাড়ে তিনটে বাজার একটা ঘন্টা পড়তেই সচকিত হয়ে ওঠে আবার।

এবার সে উঠে দাঁড়িয়ে কান পেতে শুনতে লাগল বাড়ির কোথাও কোনও শব্দ শুনতে পাওয়া যায় কি না। দেখল গোটা বাড়িটা তখনও নীরব। সে জানালাটা কোথায় তা বুঝতে পেরে সেদিকে এগিয়ে গেল। রাত্রির অন্ধকার ছিল তখনও। আকাশে সেদিন পূর্ণ চাঁদ থাকার কথা হলেও ভাসমান মেঘমালায় চাঁদটা মাঝে মাঝে চাপা পড়ে যাওয়ায় আলো-ছায়ার খেলা চলছিল আকাশে। মেঘে চাঁদটা ঢাকা পড়ে যেতেই অন্ধকারটা গাঢ় দেখাচ্ছিল।

ঘরের ভেতরটা গোধূলির ধূসর অস্পষ্ট আলোয় কিছুটা আলোকিত ছিল। তাতে ঘরের মধ্যে যাতায়াত করা যায়। জানালার কাছে ভলজাঁ দেখল জানালাটা শুধু একটা ছিটকিনি দিয়ে আঁটা আছে। কপাটটা খুললেই আর কোনও বাধা নেই। জানালাটা দিয়ে সহজেই বাগানে যাওয়া যায়। জানালাটা খুলতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া এসে ঘরে ঢুকতেই জানালাটা বন্ধ করে দিল সে। এবার বাগানটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। দেখল বাগানটা চারদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা আছে। পাঁচিলটাতে অবশ্য ওঠা সহজ। বাগানের ওপারে গাছে ঘেরা একটা বড় অথবা ছোট রাস্তা আছে।

বাগানটা খুঁটিয়ে দেখার পর সে আবার তার ঘরের মধ্যে ফিরে এল। মনে হল এবার একটা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছে। তার পিঠের ব্যাগটা খুলে সে তার মধ্যে তার জুতোজোড়াটা ভরে নিল। তার পর পিঠের উপর ঝুলিয়ে নিয়ে টুপিটা মাথায় পরল। ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ছোট লোহার রড বর করে সে বিছানার উপর রেখেছিল। রডটার একদিকে সূচালো। সে এটা নিয়ে কী উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে, তা বোঝা গেল না। তুলোঁর জেলখানায় সে যখন কাজ করত পাহাড়ে তখন এই ধরনের যন্ত্র পাথর কাটার কাজে ব্যবহার করত তারা।

সেই লোহার যন্ত্রটা এক হাতে নিয়ে ঘরের কোণ থেকে তার লাঠিটা তুলে আর এক হাতে নিল। তার পর সে পা টিপে নিঃশব্দে বিশপের শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দেখল দরজটা খোলা রয়েছে। বিশপ সেটা বন্ধ করেননি।

.

১০

ভলজাঁ কান পেতে কী শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু কোনও শব্দ ছিল না সে ঘরে।

ভলজাঁ প্রথমে তার আঙুলের ডগা দিয়ে দরজাটায় একটু ঠেলা দিল। দরজাটা একটু ফাঁক হল, অথচ কোনও শব্দ হল না। কিন্তু দরজার সামনেই একটা টেবিল ছিল পথরোধ করে। সে দেখল দরজাটায় আরও জোরে একটু ঠেলা দিলে টেবিলটা সরে যাবে। সে তাই এবার জোরে ঠেলে দিল দরজাটা এবং তাতে জোর একটা ক্যাচ করে শব্দ হল।

ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল ভলজাঁর। ভয়ের আবেগে সেই মুহূর্তে তার মনে হল দরজাটার যেন এক অতিপ্রাকৃত শক্তি আছে এবং তাই সেটা বাড়ির সবাইকে জাগিয়ে দেবার জন্য কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করছে। কাঁপতে কাঁপতে ভয়ে পিছিয়ে এল সে। তার মনে হল তার নাকের প্রতিটি নিশাসের শব্দ যেন ঝড়ের গর্জন। তবে তার মনে হল এ শব্দ ঠিক ভূমিকম্পের শব্দ নয় এবং তাতে নিশ্চয় বাড়িটা জেগে উঠবে না। তবু সে ভাবল দরজার শব্দটায় জেগে উঠবে বৃদ্ধ বিশপ। তার বোন চিৎকার করে উঠবে। চারদিক থেকে সাহায্য করার জন্য লোক ছুটে আসবে। তার কেবলি মনে হতে লাগল আবার তার সর্বনাশ হয়ে গেল।

যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। নড়াচড়া করতে সাহস পেল না। এইভাবে কয়েক মুহূর্ত পার হয়ে গেল। দরজাটা তার সামনে তেমনি ভোলা রয়ে গেছে। সে সাহস করে একবার ভেতরে দেখল। দেখল কেউ জেগে ওঠেনি বা কেউ নড়াচড়া করছে না। ঘরের মধ্যে কোনও শব্দ শুনতে পেল না সে। বুঝল শব্দটা তা হলে কাউকে জাগাতে পারেনি।

বিপদটা কেটে গেল। যদিও তার বুকের মধ্যে একটা আলোড়ন চলছিল তবু সে পেছন ফিরে চলে গেল না। তার একমাত্র চিন্তা শুধু কাজটা সেরে ফেলা। এবার সে বিশপের শোবার ঘরে ঢুকে পড়ল।

ঘরের ভেতরটা দারুণ শান্ত ছিল। তবে তখনও কিছুটা অন্ধকার থাকায় ঘরের ভেতরে চেয়ার-টেবিল, কাগজপত্র, বই, টুল, পোশাক-আশাক প্রভৃতি যেসব জিনিসপত্র ছিল তা সে বুঝতে পারল না। আধো-আলো আধো-অন্ধকারে সেগুলোকে এক একটা বস্তুপুঞ্জ বলে মনে হল। সাবধানে পা টিপে এগিয়ে যেতে লাগল ভলজাঁ। ঘরের অপর প্রান্ত হতে ঘুমন্ত বিশপের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ কানে আসছিল তার। হঠাৎ যেটা সে চাইছিল সেটা বিছানার পাশে পেয়ে যাওয়ায় চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।

প্রকৃতি যেন অনেক সময় আমাদের কর্মাকর্মের ওপর গুরুগম্ভীরভাবে মন্তব্য করে আমাদের ভাবিয়ে তোলে সে বিষয়ে। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে আকাশে মেঘ জমে ছিল। ভলজাঁ যখন বিশপের বিছানার পাশে থমকে দাঁড়িয়েছিল তখন হঠাৎ মেঘটা সরে যেতেই এক ঝলক চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে বিশপের মুখের উপর পড়ল। বিশপ শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। রাত্রিতে খুব শীত থাকার জন্য বিশপ সে রাতে হাত পর্যন্ত বাদামি। রঙের একটা পশমি জ্যাকেট পরেছিলেন। তাঁর মাথাটা বালিশের উপর ঢলে পড়েছিল। তার হাতের আঙুলে একটা যাজকের আংটি ছিল। তাঁর যে হাত দুটি কত মানুষের কত মঙ্গল করেছে, কত উপকার করেছে, সে হাত দুটি চাদরের বাইরে ছড়ানো পড়ে আছে। তাঁর মুখের উপর ফুটে আছে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, এক পরম তৃপ্তি আর পরম সুখের স্নিগ্ধ আলো, যে আলোর প্রতিফলন আর কোথাও দেখা যায় না। ধার্মিক লোকের আত্মা যে রহস্যময় স্বর্গীয় সুষমার অমৃতে মিলে মিশে এক হয়ে যায়।

মোট কথা, বিশপের মুখে তখন ছিল এক স্বর্গীয় জ্যোতি। এ জ্যোতি তার আপন অন্তরাত্মা থেকে বিচ্ছুরিত এক জ্যোতি, এ জ্যোতি তার আপন বিবেকের জ্যোতি। যে মূহূর্তে চাঁদের আলো জানালা দিয়ে এসে তাঁর অন্তরের জ্যোতির সঙ্গে মিলিত হয়ে এক হয়ে গিয়েছিল তখন সেই ঘরখানার নরম অন্ধকারে তাঁর মুখের উপর একটা স্বর্গীয় জ্যোতি ফুটে উঠেছিল। চাঁদের উজ্জ্বলতা, বাড়ি আর বাগানের নিস্তব্ধতা, নৈশ পরিবেশের অটল প্রশান্তি–এইসব কিছু শিশুসুলভ এক অনাবিল ঘুমের মধ্যে ডুবে যাওয়া বিশপের শ্রদ্ধাজনক মুখখানার উপর এনে দিয়েছিল এমন এক প্রশান্ত গাম্ভীর্য আর মহত্ত্ব, যা ক্রমশই অচেতনভাবে ঈশ্বরানুভূতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

সেই লোহার যন্ত্রটা হাতে নিয়ে নৈশ ছায়ার মধ্যে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জাঁ ভলজাঁ। বৃদ্ধ বিশপের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন ভয় হচ্ছিল তার। এমন দৃশ্য এর আগে কখনও দেখেনি সে। তার নীতি-চেতনার স্তরে দুই বিপরীত ভাবের এক তুমুল দ্বন্দ্ব চলছিল তখন। একদিকে এক পাপকর্মের অনুষ্ঠানে উন্মুখ প্রবৃত্তির পটভূমিকায় তার বিপন্ন বিবেকের অক্ষম উপস্থিতি আর একদিকে এক অসতর্ক ও নির্দোষ নিরীহ মানুষের সুগভীর নিদ্রা। এই নিঃসঙ্গ নীরব দ্বন্দ্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে জাঁ ভলজাঁ এক মহান ব্যক্তিত্বের অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন হয়ে উঠল ধীরে ধীরে।

জাঁ ভলজাঁ’র মনের সেই অনুভূতিটা অন্য কেউ তো দূরের কথা, সে নিজেই তা প্রকাশ করতে পারবে না। এক পরম প্রশান্তির সামনে অগ্রসরমান এক চরম হিংসার রূপকে কল্পনা করে নিতে হবে আমাদের। তার যে মুখে শুধু এক বিহ্বল বিব্রত বিস্ময় ছাড়া আর কিছুই ছিল না, সে মুখ দেখে তার মনের ভাব বোঝা সম্ভব ছিল না। সে নিচের দিকে মুখ নামিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার মনের কথা ধরতে পারাটা সম্ভব ছিল না কারও পক্ষে। তবে সে যে বিশেষ বিচলিত হয়ে পড়েছিল তা তার তখনকার চেহারা বা মুখচোখের ভাব দেখে বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কী ধরনের আবেগ ছিল তার মনের মধ্যে, তা বোঝা যাচ্ছিল না।

বিছানা থেকে তার দৃষ্টিটা সরিয়ে নিল ভলজাঁ। তখন তার মুখচোখের ভাব থেকে। একটা জিনিস স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। তার মন তখন পরস্পরবিরুদ্ধ দুটি স্রোতের টানে ভেসে চলেছিল–একদিকে মৃত্যু আর একদিকে মুক্তি। হয় তাকে ঘুমন্ত বিশপের মাথাটাকে ভেঙে গুঁড়ো করে দিতে হবে অথবা তার হাতটাকে চুম্বন করতে হবে।

কিছুক্ষণ এইভাবে কেটে যাবার পর ভলজাঁ তার বাঁ হাত দিয়ে মাথা থেকে টুপিটা তুলে আর ডান হাতে সেই লোহার যন্ত্রটা ধরে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগল। বিশপ তখনও শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। তার ভয়ঙ্কর দৃষ্টি যেন ভেদ করতে পারছে না বিশপের শান্ত নিদ্রার আবরণটাকে। বিছানার পাশে আলনার উপরে ক্রুশবিদ্ধ যিশুর একটা ছোট মূর্তি ছিল। যিশু যেন দু হাত বাড়িয়ে ঘরের মধ্যে দু জন লোকের একজনকে আশীর্বাদ আর একজনকে ক্ষমা দান করছেন।

ভলজাঁ হঠাৎ টুপিটা আবার মাথায় পরে ঘুমন্ত বিশপের দিকে না তাকিয়ে আলমারিটার কাছে চলে গেল। চাবিটা কাছে পেয়ে গেল বলে আর তালা ভাঙতে হল না। চাবি খুলে আলমারি থেকে রুপোর কাঁটাচামচের ঝুড়িটা নিয়ে আবার তার ঘরে চলে গেল। তার পর তার পিঠের ব্যাগটা খুলে তার মধ্যে রুপোর কাঁটাচামচগুলো ভরে নিয়ে বুড়িটা ফেলে দিল। ব্যাগটা পিঠে নিয়ে ছড়িটা হাতে ধরে খোলা জানালা দিয়ে বাগানে লাফ দিয়ে পড়ে পাঁচিলে উঠে বিড়ালের মতো একমুহূর্তে ওদিকের রাস্তাটায় পড়ল।

.

১১

পরদিন সকালে সূর্যোদয়ের সময় তার বাগানের কাজ করছিলেন মঁসিয়ে বিয়েনভেনু। এমন সময় ম্যাগলোরি ছুটতে ছুটতে উত্তেজিতভাবে তাঁর কাছে এল।

ম্যাগলোরি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বঁসিয়ে মঁসিয়ে, আপনি জানেন রুপোর জিনিসপত্র রাখা ঝুড়িটা কোথায়?

বিশপ বললেন, হ্যাঁ জানি।

ম্যাগলোরি বলল, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। জিনিসটা গেল কোথায় তা আমি বুঝতেই পারছিলাম না।

কিছুক্ষণ আগে খালি ঝুড়িটা বাগানের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখতে পান বিশপ। তিনি ঝুড়িটা তুলে ম্যাগলোরির হাতে দিয়ে বলেন, এই নাও।

ম্যাগলোরি বলল, কিন্তু এটা তো খালি। রুপোর জিনিসগুলো গেল কোথায়?

বিশপ বললেন, তা হলে তুমি রুপোর জিনিসগুলো চাইছ? সেগুলো কোথায় তা তো আমি জানি না।

ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন। সেগুলো চুরি গেছে। গতকাল রাতে যে লোকটা এসেছিল সেই সেগুলো চুরি করে নিয়ে গেছে।

এই বলে লোকটা অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট যে জায়গায় শুয়েছিল সেখানে ছুটে চলে গেল। সেখানে কাউকে দেখতে না পেয়ে আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে এল। বিশপ তখন ঝুড়ির চাপে পিষ্ট একটা ফুলগাছের উপর ঝুঁকে পড়ে কী দেখছিলেন।

ম্যাগলোরি বলল, মঁসিয়ে মঁসিয়ে, লোকটা চলে গেছে। রুপোর জিনিসগুলো সব চুরি করে নিয়ে গেছে।

কথা বলতে বলতে বাগানের চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল ম্যাগলোরি। দেখল রাস্তার দিকের বাগানের পাঁচিলের এক জায়গায় একটা-দুটো ইট খসে পড়েছে। ওই ভাঙা জায়গাটা যেন চোর পালানোর সাক্ষী হয়ে আছে।

ম্যাগলোরি বলল, ওই যে ওই পথে পালিয়েছে রাক্ষসটা। সে পাঁচিল পার হয়ে রাস্তায় চলে গেছে। আমাদের সব রুপোগুলো চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।

কিছুক্ষণ ভাববার পর বিশপ গম্ভীরভাবে ম্যাগলোরির দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বললেন, প্রথম কথা ওগুলো কি সত্যি সত্যিই আমাদের ছিল?

হতবাক ও হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে ম্যাগলোরি। কোনও কথা খুঁজে পেল না। কথাটার মানে কিছু বুঝতে পারল না।

বিশপ আবার বলতে লাগলেন, আমি দেখছি এতদিন ধরে জিনিসগুলো রাখা আমারই ভুল হয়ে গেছে। আসলে ওগুলো গরিব-দুঃখীদের জিনিস। যে লোকটা সেগুলো নিয়ে গেছে সে-ও গরিব নয় তো কি?

ম্যাগলোরি বলল, আমার বা আপনার বোনের জন্য বলছি না, মঁসিয়ে এবার থেকে কী করে খাবেন?

আপাত বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে বিশপ বললেন, টিন বা সিসের কাঁটাচামচ কিনে আনবে।

তার থেকে গন্ধ বার হবে।

তা হলে লোহার কাঁটাচামচ আনবে।

তার একরকম বাজে স্বাদ আছে।

তা হলে কাঠের কাঁটাচামচের ব্যবস্থা করবে।

কিছুক্ষণ পর খাবার ঘরের যে টেবিলে গতরাতে জাঁ ভলজাঁ বসে খেয়েছিল সেখানে বসে বিশপ তার বোনের পাশে বসে প্রাতরাশ খাচ্ছিলেন। একসময় খেতে খেতে তিনি খুশিমনে তার বোনকে বললেন, দেখ, আসলে কাঠের হোক বা যারই হোক, কোনও কাঁটাচামচের দরকাই নেই। একপাত্র দুধে একটা রুটি ডোবাতে কোনও কাঁটাচামচের দরকার হয় না।

ম্যাগলোরি নিজের মনে মনে স্বগতোক্তি করল, আর কীই-বা আশা করতে পার তুমি। একটা বাজে লোককে ঘরে থাকতে দিয়ে খাইয়ে ভালো বিছানায় শুইয়ে তার ফল পেলে কি না সেসব চুরি করে নিয়ে গেল। ঘৃণায় ও রাগে সর্বাঙ্গ আমার কাঁপছে।

বিশপ আর তাঁর বোন যখন প্রাতরাশ খাওয়ার পর টেবিল থেকে উঠে যাচ্ছিলেন তখন দরজায় কে করাঘাত করল বাইরে থেকে। বিশপ বললেন, ভেতরে এস।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঠেলে তিনজন পুলিশ একটা লোকের ঘাড় ধরে ঘরের মধ্যে ঢুকল। লোকটা হল জাঁ ভলজাঁ।

তিনজন পুলিশ ছাড়া একজন সার্জেন্ট দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এগিয়ে এসে বিশপকে ডাকল, মঁসিয়ে–

এ কথায় ভলজাঁ আশ্চর্য ও হতবুদ্ধি হয়ে বোকার মতো বলে উঠল, মঁসিয়ে! উনি তা হলে কুরে বা ছোট যাজক নন।

সার্জেন্ট তাকে ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর। উনি হচ্ছে মহামান্য বিশপ।

মঁসিয়ে বিয়েনভেনু তখন তাদের কাছে ছুটে এলেন। তিনি ভলজাঁকে দেখেই বললেন, তুমি তা হলে আবার এসেছ? তোমাকে দেখে আনন্দিত হলাম। তুমি কি রুপোর বাতিদান দুটো নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল? ওগুলোও খাঁটি রুপোর এবং দু’শো টাকা দাম হবে। আমি তো ও দুটোও দিয়েছিলাম। তুমি হয়তো ভুলে গেছ।

জাঁ ভলজাঁর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল। সে সেই বিস্ফারিত চোখের অপরিসীম বিস্ময় আর বিহ্বলতা নিয়ে তাকিয়ে রইল বিশপের পানে। তার সেই চোখমুখের অদ্ভুত ভাব থেকে তার মনের অনুভূতি অনুমান করা সম্ভব ছিল না।

সার্জেন্ট বিশপকে বলল, মঁসিয়ে, তা হলে কি ধরে নেব এই লোকটা যা বলেছে তা সত্যি? তাকে ছুটতে দেখে ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করি। তার পিঠের ব্যাগের মধ্যে এই রুপোর জিনিসগুলো পাই তাই–

বিশপ হাসিমুখে বললেন, আর ও বলেছে একজন বৃদ্ধ যাজক যার ঘরে রাত কাটিয়েছে সে তাকে ওগুলো দিয়েছে। এবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি। আপনারা অবশ্য ওকে এখানে ধরে আনতে বাধ্য। কিন্তু আপনারা ভুল করেছেন।

সার্জেন্ট বলল, তা হলে বলতে চান ওকে আমরা ছেড়ে দেব?

পুলিশরা ভলজাঁকে ছেড়ে দিতে সে আমতা আমতা করে বলল, আমি তা হলে এবার সত্যিই কি যেতে পারি?

ভলজাঁ যেন ঘুমের ঘোরে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলল কথাগুলো।

একজন পুলিশ বলল, তুমি কি শুনতে পাওনি?

বিশপ বললেন, এবার কিন্তু রুপোর বাতিদান দুটো নিয়ে যেতে ভুলবে না।

আলনার উপর থেকে বাতিদান দুটো এনে ভলজাঁর হাতে তুলে দিলেন বিশপ। তাঁর বোন ও ম্যাগলোরি কোনও কথা বলে অথবা কোনও প্রতিবাদসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হস্তক্ষেপ করল না বিশপের কাজে। ভলজাঁর হাত দুটো কাঁপতে লাগল। সে অন্যমনে যন্ত্রচালিতের মতো বাতিদান দুটো নিল।

বিশপ ভলজাঁকে বললেন, এবার তুমি শান্তিতে যেতে পার। এবার যদি কোনওদিন ঘটনাক্রমে এ বাড়িতে আস তা হলে আর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। এ দরজায় কোনওদিন তালা দেওয়া হয় না।

এবার পুলিশদের দিকে ঘুরে বিশপ বললেন, ধন্যবাদ ভদ্রমহোদয়গণ!

পুলিশরা চলে গেল। ভলজাঁ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, যেন মনে হল সে পড়ে যাবে। বিশপ তার কাছে গিয়ে বললেন, তুমি ভুলে যেও না তুমি কথা দিয়েছ তুমি তোমার সব টাকা দিয়ে এমন একটা কিছু কাজ করবে যাতে তুমি একজন সৎ লোক হয়ে উঠতে পার।

ভলজাঁর মনে পড়ল না কী প্রতিশ্রুতি সে দিয়েছে। সে তাই চুপ করে রইল। এর আগের কথাগুলোই বিশপ ধীরে ধীরে নিচু গলায় বললেন, জাঁ ভলজাঁ, হে আমার ভাই, এখন আর কোনও পাপ নেই তোমার মধ্যে। এবার থেকে তুমি শুধু ভালো কাজ করে। যাবে। তোমার আত্মাকে যত সব কুটিল চিন্তা আর অভিশাপ থেকে মুক্ত করার জন্য তোমার আত্মাকে কিনে নিয়েছি আমি এবং তার পর ঈশ্বরকে তা ফিরিয়ে দিয়েছি।

.

১২

শহর ছেড়ে একরকম ছুটতে ছুটতে ভলজাঁ গ্রামাঞ্চলে গিয়ে পড়ল। কোথায় কোন দিকে যাচ্ছে তার কিছু খেয়াল ছিল না তার। এইভাবে পথে পথেই সারা সকালটা কেটে গেল তার। এর মধ্যে কিছু সে খায়নি, কোনও ক্ষুধাও বোধ করেনি। যে অদ্ভুত চেতনা বা অনুভূতি তার মনটাকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তার মধ্যে ছিল এক ধরনের রাগ। কিন্তু এ রাগ কার ওপর তা সে জানে না। এই ঘটনায় সে সম্মান বা আঘাত কী পেয়েছে, তা সে বুঝতে পারছে না। গত কুড়ি বছরের মধ্যে কোনও কোনও অসতর্ক মুহূর্তে তার। মনে কোনও মমতামেদুর ভাব জাগলে সে কঠোরভাবে তা অবদমিত করেছে। তার মনের অবস্থা তখন সত্যিই বড় ক্লান্ত ছিল। সে ভয়ে ভয়ে বুঝল এতদিনের অন্যায় অবিচার আর দুর্ভাগ্যের চাপে তার মনের মধ্যে যে একটা ভয়ঙ্কর শান্ত নিষ্ক্রিয় ভাব গড়ে উঠেছিল, এখন সেটা ধসে পড়ছে। কিন্তু তার পরিবর্তে আবার কোন ভাব গড়ে উঠবে? এক একসময় আবার জেলখানায় ফিরে যেতে ইচ্ছা হয় তার, যা আগে কখনও হয়নি। জেলখানায় গেলে আর কিছু না হোক অন্তত কোনও দুশ্চিন্তা থাকবে না তার মনে। তখন বছরটা প্রায় শেষ হয়ে এলেও কিছু ফুল তখনও ছিল পথের ধারের বনে-ঝোপে। সেইসব বুনো ফুলের গন্ধে ছেলেবেলাকার কথা মনে পড়ল তার। বিস্মৃতির অতল গর্ভে সমাহিত সেইসব স্মৃতি সত্যিই দুঃসহ তার পক্ষে।

এইসব মানসিক অশান্তি আর গোলমালের মধ্য দিয়ে সারাটা দিন কেটে গেল তার। বিকালে সূর্য অস্ত যাবার সময় যখন সব বস্তুর ছায়াগুলো বড় বড় হয়ে উঠল তখন এক প্রান্তরের ধারে একটা ঝোঁপের পাশে সে বসল। প্রান্তরটা একেবারে ফাঁকা আর জনশূন্য। দূর দিগন্তের একদিকে আল্পস পর্বতের চূড়া অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। দিগনে শহর থেকে সে প্রায় সাত মাইল দূরে চলে এসেছে। একটা পায়ে চলা পথ তার পাশ দিয়ে প্রান্তরটা ভেদ করে দূরে চলে গেছে।

নিবিড় পথক্লান্তির সঙ্গে নিদারুণ মানসিক দুশ্চিন্তা আরও ভয়াবহ করে তুলেছিল তার চেহারাটা। এমন সময় এক জীবন্ত মানুষের শব্দ কানে এল তার। মুখ ফিরিয়ে দেখল একটা বছর দশেকের ছেলে গান গাইতে গাইতে সেই হাঁটা পথটা দিয়ে আসছে। তার পিঠের উপর বাঁধা একটা বাক্সের মধ্যে তার জিনিসপত্র সব ছিল। মনে হল সে একজন ভবঘুরে জাতীয় ছেলে যে গাঁয়ে গায়ে চিমনি পরিষ্কারের কাজ করে বেড়ায় ছেঁড়া পায়জামা পরে। পথ চলতে চলতে মাঝে মাঝে থেমে খেলা করছিল সে। তার হাতে চল্লিশটা স্যু ছিল, তা নিয়ে লোফালুফি করছিল সে। সেটা উপরে ছুঁড়ে দিয়ে উল্টো দিক। দিয়ে লুফে নিচ্ছিল। এই পয়সাই তার জীবনের একমাত্র সম্বল।

জাঁ ভলজাঁকে দেখতে না পেয়ে সে ঝোঁপটার ধারে দাঁড়িয়ে পয়সাটা নিয়ে আবার খেলা করতে শুরু করে দিল। এবার সে পয়সাটা গড়িয়ে দিতে লাগল। গড়াতে গড়াতে পয়সাটা ভলজাঁর পায়ের কাছে এসে পড়ল। পায়ের কাছে আসতেই পা দিয়ে পয়সাটা চেপে দিল ভলজাঁ।

ছেলেটা দেখেছিল তার পয়সাটা কোথা গেছে। সে সোজাঁ ভলজাঁর কাছে চলে এল। জায়গাটা একেবারে নির্জন। পথে বা প্রান্তরের কোথাও একজন মানুষ নেই। মাথার অনেক উপরে এক ঝাঁক উড়ন্ত পাখির কলবর ছাড়া আর কোনও সাড়াশব্দ নেই। অস্তম্লান সূর্যের কিছু আলো এসে ছেলেটার মাথার সোনালি চুল আর ভলজাঁর মুখের উপর পড়েছিল।

ছেলেটি বলল, মঁসিয়ে, আমার পয়সাটা দেবেন?

তার কণ্ঠে শিশুসুলভ এক সরল বিশ্বাসের সঙ্গে নির্দোষিতা আর অজ্ঞতার একটা ভাব ছিল।

ভলজাঁ বলল, তোমার নাম কী?

পেতিত গার্ভে মঁসিয়ে।

চলে যাও।

দয়া করে আমার পয়সাটা ফিরিয়ে দিন মঁসিয়ে।

জাঁ ভলজাঁ মাথা নিচু করে বসে রইল। কথাটার কোনও উত্তর দিল না।

ছেলেটি আবার বলল, দয়া করুন মঁসিয়ে।

ভলজাঁ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার পয়সা। একটা রুপোর মুদ্রা।

ভলজাঁ যেন কথাটা শুনতে পেল না। ছেলেটা তখন তার ভারী জুতোপরা পা-টা সরিয়ে পয়সাটা বার করার চেষ্টা করতে লাগল। সে বারবার বলতে লাগল, আমার পয়সাটা দিয়ে দিন। আমার চল্লিশটা স্যু। এবার কাঁদতে লাগল জোরে। ভলজাঁ এবার মাথাটা তুলল। সে আশ্চর্য হয়ে ছেলেটার পানে তাকাল। তার পর তার ছড়িটা খুঁজতে খুঁজতে ভয়ঙ্কর গলায় বলে উঠল, কে এখানে?

ছেলেটা বলল, আমি পেতিত গার্ভে মঁসিয়ে। আপনি দয়া করে পা-টা সরিয়ে আমার চল্লিশ স্যু মুদ্রাটা দিয়ে দিন।

ছেলেটা রেগে গিয়ে কড়া গলায় বলল, আপনি পা-টা সরাবেন?

ভলজাঁ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চলে যাও বলছি। এখনও আছে?

সে তার একটা পা দিয়ে তখনও ছেলেটার মুদ্রাটাকে চেপে রইল। পা-টা সরাল না।

ছেলেটা ভলজাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেল। কিছুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আর পেছন ফিরে না তাকিয়ে বা কোনও কথা না বলে ছুটে পালাল। ছেলেটা ছুটতে ছুটতে হাঁপিয়ে পড়েছিল। এক একবার পথের উপর দাঁড়াচ্ছিল। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। তার চাপা কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল ভলজাঁ। কিন্তু একটু পরেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল।

দেখতে দেখতে সূর্য অস্ত গেল। গোধূলির ছায়া ঘন হয়ে উঠল জাঁ ভলজাঁর চারদিকে। সারা দিন তার কিছুই খাওয়া হয়নি। গাঁয়ে জ্বর বোধ করছিল। যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল স্থির হয়ে। ছেলেটার চলে যাওয়ার পর এক পা-ও নড়েনি কোথাও। সহসা সে তার সামনে দেখল ঘাসের উপর নীল রঙের একটা ভাঙা পাত্রের একটা টুকরো পড়ে রয়েছে। গাঁয়ে জোর ঠাণ্ডা লাগতে বুকের উপর শার্টটা বেঁধে নিল। তার পর মাটির উপরে থাকা ছড়িটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে তার পায়ের তলায়। এতক্ষণ ধরে পড়ে থাকা চল্লিশ ব্যু’র মুদ্রাটা দেখতে পেল। ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগল সে।

তা দেখে এক বৈদ্যুতিক আঘাত পেয়ে যেন চমকে উঠল সে। আপন মনে বলে উঠল, এটা কী? মনে হল চকচকে রুপোর মুদ্রাটা তার উজ্জ্বল চোখ মেলে তাকিয়ে তাকে দেখছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সে সরে গিয়ে মুদ্রাটা হাতে তুলে নিয়ে তার চারপাশে নিরাপদ আত্মগোপনের এক আশ্রয় খুঁজতে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত এক জন্তুর মতো দৃষ্টি ছড়িয়ে তাকাতে লাগল।

কোনও দিকে কিছুই দেখতে পেল না সে। রাত্রির অন্ধকার নেমে আসছিল। গোটা প্রান্তরটা ঠাণ্ডা হিম হয়ে উঠেছে। তার উপর নীলচে এক কুয়াশা নেমে এসে গোধূলির শেষ আলোটুকু অকালে মুছে দিয়েছে। ছেলেটা যেদিকে পালায় সেই পথেই জোর পায়ে হাঁটতে লাগল ভলজাঁ। কিছুদূর যাওয়ার পর একবার থেমে আবার তাকাল চারদিকে। এবারও কিছুই দেখতে পেল না সে। তখন জোর চিৎকার করে ডাকতে লাগল, পেতিত গার্ভে! পেতিত গার্ভে!

সে একবার থামল। কিন্তু কারও কোনও সাড়া পেল না। এক কুয়াশাঘন অন্ধকার প্রান্তরের বিশাল শূন্যতা আর অখণ্ড স্তব্ধতার মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সে স্তব্ধতার মাঝে তার সব কণ্ঠস্বর নিঃশেষে তলিয়ে গিয়েছিল কোথায়। তীক্ষ্ণ কনকনে বাতাস বইতে লাগল। ঝোঁপঝাড়ের গাছগুলো প্রচণ্ড রাগে ডালপালা নেড়ে ভয় দেখাতে লাগল যেন তাকে।

আবার পথ হাঁটতে লাগল সে। সহসা ছুটতে শুরু করে দিল। ছুটতে ছুটতে মাঝে মাঝে পেতিত গার্ভের নাম ধরে হতাশ কণ্ঠে ভয়ঙ্করভাবে ডাকতে লাগল। পেতিত গার্ভে সে ডাক শুনতে পেলে কোথাও হয়তো লুকিয়ে পড়ত।

ভলজাঁ দেখল ঘোড়ায় চেপে একজন যাজক আসছে। সে তার কাছে গিয়ে বলল, মঁসিয়ে লে কুরে। একটা ছেলেকে এই পথে যেতে দেখেছেন? পেতিত গার্ভে নামে একটা ছেলে?

না, আমি কোনও ছেলেকে দেখিনি।

ভলজাঁ পাঁচ ফ্রাঁ’র দুটো মুদ্রা বার করে যাজকের হাতে দিয়ে বলল, দরিদ্রদের সেবার জন্য এটা নিন মঁসিয়ে লে কুরে… ছেলেটার বয়স বছর দশেক হবে। তার পিঠে একটা বাক্স ছিল। হয়তো সে চিমনির ঝাড়ুদার অথবা ওই ধরনের কিছু কাজ করে।

আমি তাকে দেখিনি।

পেতিত গার্ভে তার নাম। এখানকার পাশাপাশি কোন গাঁয়ে থাকে কি?

 যাজক বলল, আমি তা জানি না। মনে হয় সে এখানকার ছেলে নয়। বিদেশি কোনও ভবঘুরে। ওরা মাঝে মাঝে আসে।

আরও দুটো পাঁচ ফ্রাঁ’র মুদ্রা বার করে যাজকের হাতে দিয়ে ভাজা বলল, দরিদ্রদের সেবার জন্য এটাও রেখে দিন।

যাজক ঘোড়াটা চালিয়ে দিলে ভলজাঁ চিৎকার করে বলে উঠল, মঁসিয়ে লাব্বে, আমাকে গ্রেপ্তার করুন, আমি চোর।

যাজক ভয়ে ঘোড়াটাকে জোরে ছুটিয়ে চলে গেল।

যেদিকে যাচ্ছিল সেইদিকেই যেতে লাগল ভলজাঁ। অনেকক্ষণ ধরে ছুটল। পেতিত গার্ভের নাম ধরে অনেক ডাকল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না বা কোনও সাড়াও পেল না। মাঝে মাঝে পথের ধারে এক একটা ঝোঁপ বা বড় পাথরের ছায়া দেখে মনে হতে লাগল কোনও মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পরে দেখল সেটা দেখার ভুল। এক জায়গায় এসে ভলক্স দেখল তিন দিকে তিনটে পথ চলে গেছে। সেইখানে তিনটে পথের মুখের কাছে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার পর শেষবারের মতো একবার চিৎকার করে ডাকল, ‘পেতিত গার্ভে।’ এরপর আর একবার ডাকল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বার হচ্ছিল না। নিজের কথা নিজেই শুনতে পাচ্ছিল না। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না সে। এক অপরাধ-চেতনার গুরুভারের চাপে পা দুটো তার বসিয়ে দিচ্ছিল যেন কোনও অদৃশ্য শক্তি। একটা পাথরের উপর হাঁটু দুটোর মাঝে মাথাটা খুঁজে বসে রইল সে। আপন মনে বলে উঠল, আমি হচ্ছি হতভাগ্য এক শয়তান। মহাপাপী। অনুতাপের অপ্রতিরোধ্য বেদনার আবেগে পরিপ্লাবিত হয়ে উঠল তার সমস্ত অন্তর। সে কাঁদতে লাগল। গত উনিশ বছরের মধ্যে এই প্রথম কাঁদল সে।

আমরা জানি জাঁ ভলজাঁ যখন বিশপের বাড়ি থেকে চলে আসে তখন তার মনের অবস্থা এমন একটা আকার ধারণ করে, যা আগে কখনও করেনি। তার মনের মধ্যে তখন কী ধরনের আলোড়ন চলছিল, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না সে। বৃদ্ধ দয়ালু বিশপের সব কথা ও কাজের বিরুদ্ধে সে অকারণে শুধু তার অন্তরটাকে কঠোর করে তুলেছে। বিশপ তাকে একসময় বলেছিল, ‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছ এবার থেকে তুমি সৎ হবে। আমি তোমার আত্মাকে কিনে নিচ্ছি। সে আত্মাকে আমি বিকৃত যত সব কামনা আর কুচিন্তার হাত থেকে মুক্ত করে ঈশ্বরকে দান করছি।’ কথাগুলো বারবার তার মনে আনাগোনা করেছিল। কিন্তু আত্মাভিমানের যে দুর্ভেদ্য দুর্গ আমাদের সব পাপপ্রবৃত্তিকে এক নিরাপদ আশ্রয় দান করে সেই আত্মাভিমানের বশবর্তী হয়েই মনের তলায় চেপে রেখে দিয়েছিল বিশপের সেই কথাগুলোকে। অস্পষ্টভাবে হলেও একটা কথা বুঝতে পেরেছিল সে, বিশপের ক্ষমাই তার নিষ্ঠুর প্রকৃতির ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত হানে। সেই আক্রমণ ও আঘাতকে যদি সে সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করতে পারে তা হলে অক্ষুণ্ণ থেকে যাবে তার মানসপ্রকৃতির অবিমিশ্র নিষ্ঠুরতা, তা হলে চিরকালের জন্য পাথরের মতো কঠিন থেকে যাবে তার অন্তরটা; আর যদি সে আঘাত ও আক্রমণের কাছে আত্মসমর্পণ করে তা হলে এতদিন ধরে অসংখ্য মানুষের দুর্ব্যবহারে সে প্রবল ঘৃণা সঞ্জাত হয়েছিল তার মনে, যে ঘৃণা এখন তার অবিরাম সহচর হিসেবে বিরাজ করে তার অন্তরে সে ঘৃণাকে ত্যাগ করতে হবে তাকে চিরকালের জন্য। অস্পষ্টভাবে সে আরও বুঝতে পারল এখন শেষ লড়াইয়ের ক্ষণ এসে গেছে। এখন হয় তাকে জয়লাভ করতে হবে অথবা পরাভব স্বীকার করতে হবে সে যুদ্ধে। একদিকে তার অন্তর্নিহিত পাপ আর একদিকে সেই ধর্মাত্মা বিশপের পুণ্য–এই দুইয়ের সংগ্রামে একজনকে জিততেই হবে।

এইসব কথা ভাবতে ভাবতে নানা জটিল চিন্তার দ্বারা বিব্রত হয়ে মাতালের মতো টলতে লাগল। এইভাবেই সে আবার পথ হাঁটতে লাগল। দিগনেতে বিশপের বাড়িতে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার ফল কী হবে, সে বিষয়ে কি তার কোনও ধারণা আছে? এইসব ঘটনার সঙ্গে যেসব ব্যাপার জড়িয়ে আছে তা কি সে বোঝে? কেউ কি তার কানে কানে একটা কথা ফিস ফিস করে বলেনি যে সে আজ জীবনের এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে যেখানে মধ্যপথ বলে কিছু নেই। এখন থেকে হয় তাকে মানুষ হিসেবে খুব ভালো হতে হবে অথবা খুব খারাপ হয়ে উঠতে হবে, হয় তাকে বিশপের থেকে আরও অনেক বড় হতে হবে অথবা শয়তানের থেকে নীচ হতে হবে, হয় তাকে মানবতা ও মহত্ত্বের সর্বোচ্চ স্তরে উঠে যেতে হবে অথবা নীচতা ও হীনতার সর্বনিম্ন স্তরে নেমে যেতে হবে।

আমরা আবার এ প্রশ্ন করতে পারি, জাঁ ভলজাঁ কি তার মনের মধ্যে এসব কথা বুঝতে পেরেছিল? দুঃখ-বিপর্যয় অবশ্য মানুষের বুদ্ধিকে তীক্ষ্ণ করে তোলে। তবু ভলজাঁ এইসব জটিল ব্যাপারগুলো ঠিকমতো বুঝতে পেরেছিল কি না, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এ সব চিন্তা তার মনের মধ্যে ঢুকেছিল তার স্পষ্ট কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না, শুধু অস্পষ্টভাবে তার একটা ধারণা করে নিতে হয়। তাছাড়া এসব চিন্তা তার মনের মধ্যে ঢুকে তার মনটাকে এক বেদনার্ত ও দুর্বিষহ আলোড়নের মধ্যে ফেলে দেওয়া ছাড়া তার কোনও ভালো করতে পারেনি। নারকীয় এক কুটিল অন্ধকারে ভরা কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই বিশপের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকার তার মনশ্চক্ষুকে একেবারে বিহ্বল করে দিয়েছিল, দীর্ঘক্ষণ অন্ধকারে থাকার পর কোনও লোক হঠাৎ উজ্জ্বল দিবালোক দেখতে পেলে তার চোখ দুটো যেমন ধাঁধিয়ে যায়। বিশপের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, সততা ও শুচিতায় যে উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি এনে দিয়েছিল তার জীবনে, সে প্রতিশ্রুতি সঙ্গে সঙ্গে অভিশাপ হয়ে প্রবল ভয়ে কাঁপিয়ে তুলেছিল তাকে। সত্যি সত্যিই হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল সে। অন্ধকার কোটর হতে অকস্মাৎ নির্গত কোনও পেঁচা যেমন সূর্যোদয়ের আলোকবন্যায় বিহ্বল ও বিব্রত হয়ে পড়ে, তেমনি সহসা পুণ্যের উজ্জ্বলতায় চোখে অন্ধকার দেখছিল সে।

সে বুঝতে না পারলেও একটা জিনিস নিশ্চিত যে সে আর আগেকার সেই মানুষ নেই। তার অন্তরের মধ্যে একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছে, তার মনের কাঠামোটাই বদলে গেছে একেবারে। বিশপ তাকে এ কথা বলেনি বা তার অন্তরকে স্পর্শ করেনি একথা জোর গলায় বলে বেড়াবার মতো শক্তি তার আর নেই।

এই ধরনের মানসিক গোলমাল ও গোলযোগের মধ্যে পেতিত গার্ভের সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। সে তার চল্লিশ ব্যু ছরি করে। কেন সে এ কাজ করেছে? সে নিশ্চয়। এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে না। সুদীর্ঘ কারাবাস তার মনের মধ্যে যে অশুভ শক্তি জাগিয়ে তোলে সেই শক্তিই কি তার অন্তর্নিহিত কুপ্রবৃত্তিকে উত্তেজিত করে তোলে? হয়তো তাই, অথবা যতটা ভাবছি ততটা নয়। তবে মোট কথা, যে পেতিত গার্ভে নামে ছেলেটার পয়সা চুরি করেছিল সে মানুষ নয়, জাঁ ভলজাঁর মধ্যে যে একটা পশু ছিল সেই পশুটাই তার অভ্যাসগত ও প্রকৃতিগত পাশবিকতার বশে পয়সাটার উপর পা-টা চেপেছিল। আর তখন ভলজাঁর ভেতরকার মানুষটা নতুন চিন্তাগুলোর সঙ্গে বুদ্ধি দিয়ে লড়াই করে চলেছিল। সে যখন বুঝতে পারল তার ভেতরকার পশুটা এ কাজ করেছে। তখন সে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে।

আশ্চর্যের কথা এই যে, নতুন অবস্থার মধ্যে যে মানসিকতা তার গড়ে উঠেছিল তাতে সে বেশ বুঝতে পারল, যে কাজ সে করে ফেলেছে সে কাজের মানসিক প্রতিক্রিয়া সে সহ্য করতে পারবে না।

যাই হোক, তার এই শেষের কুকর্মটা তার মনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করল। তার মনের সব বিশৃঙ্খলা ভেদ করে এ ঘটনা এমন এক আলোকসম্পাত করল তার মনের ওপর যার ফলে তার মন ও বুদ্ধি অন্ধকার থেকে আলোটাকে পৃথক করতে পারল এবং রাসায়নিক বিশ্লেষণের মতো তার কাজের ন্যায়-অন্যায়ের উপাদানগুলো বিচার করে দেখতে পারল।

প্রথমেই সে কোনও নিমজ্জমান ব্যক্তির তৃণখণ্ড আঁকড়ে ধরার মতো কোনও কিছু নতুন করে চিন্তা করার আগে ছেলেটাকে খুঁজে তার পয়সাটা ফেরত দিতে চাইল। যখন সে তা পারল না তখন সে সত্যিই হতাশ হয়ে বসে পড়ল। যে মুহূর্তে সে ‘পাপী শয়তান এই কথা দুটো উচ্চারণ করল তখন সে ভেতরকার যে মানুষটা হতে এতদিন বিচ্ছিন্ন ছিল সে তাকে দেখতে পেয়ে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। অথচ বাইরে সে দেখল সে একটা রক্তমাংসের মানুষ, অপরাধী পাপী জাঁ ভলজাঁ যার হাতে ছড়ি, পিঠে চুরি করা জিনিসপত্রে ভরা একটা ব্যাগ, মুখখানা কালো এবং মনে কালো মুখখানার থেকে কালো কুটিল যত চিন্তা।

অতিরিক্ত দুঃখভোলা মানুষকে করুণাপ্রবণ করে তোলে। জাঁ ভলজাঁও কেমন যেন কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। জাঁ ভলজাঁ নামে মানুষটার মুখোমুখি হয়ে সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল কে ওই মানুষটা? নিজেকে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল সে।

এইসব মুহূর্তে যখন মনের সমুদ্রটা ভয়ঙ্করভাবে শান্ত হয়ে ওঠে এবং অন্তদৃষ্টিটা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে তখন আমাদের চিন্তাগুলো বাস্তব জগৎটাকে পরিহার করে গভীরে চলে যায়। তখন এই পরিদৃশ্যমান বাস্তব জগৎটাকে আর আমরা দেখতে পাই না, তখন শুধু আমরা আমাদের অন্তরের জগৎ, তার অন্তর প্রকৃতিটাকেই দেখতে পাই।

এইভাবে সে যখন নিজের মুখোমুখি হয়ে আপন অন্তরের রহস্যময় গভীরে তলিয়ে গিয়ে ভাবছিল তখন হঠাৎ বাইরে থেকে একটা টর্চের আলো এসে লাগল তার চোখে। প্রথমে সে ভাবল এটা তারই চেতনার আলো। কিন্তু ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে সে বুঝল একটা মানুষ এ আলো ফেলেছে আর সে মানুষ হল দিগনের সেই বিশপ।

তখন তার মনশ্চক্ষুর সামনে দুটো মানুষের মূর্তি ফুটে উঠল –একজন বিশপ আর একজন জাঁ ভলজাঁ। প্রথমে মনে হল জাঁ ভলজাঁর দানবিক চেহারাটার বিশাল ছায়ায় বিশপের মূর্তিটা ঢাকা পড়ে গেছে। কিন্তু ক্রমে ভাবতে ভাবতে সে দেখল বিশপের উজ্জ্বল জ্যোতির তীব্রতায় জাঁ ভলজাঁ মুখ লুকিয়ে পালিয়ে গেছে কোথায়। জাঁ ভলজাঁ একেবারে অদৃশ্য হয়ে যেতে বিশপ একাই দাঁড়িয়ে আছেন তার সামনে। তার দেহ থেকে বিচ্ছুরিত জ্যোতির প্লাবনে তার ছায়াচ্ছন্ন বিষাদগ্রস্ত আত্মাটা আলোকিত হয়ে উঠেছে যেন।

অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল জাঁ ভলজাঁ। কোনও বেদনার্ত বা শোকার্ত একজন নারী বা শিশুর থেকে আরও আকুলভাবে কাঁদল সে। কাঁদতে কাঁদতে সে দেখল এক নতুন দিনের প্রভাত-সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে তার আত্মাটা। সে এক আশ্চর্য দিন–একই সঙ্গে বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর। সে আলোর স্বচ্ছতায় সেসব জিনিস, তার বর্তমান ও অতীত জীবনের অনেক ঘটনা স্পষ্টভাবে দেখতে পেল যা সে এর আগে কখনও দেখতে পায়নি। তার অপরাধ, তার সুদীর্ঘকালীন অভিশাপ, তার কারামুক্তি ও প্রতিশোধবাসনা, তার অন্তরের ও বাইরের কঠোরতা, বিশপের বাড়ির ঘটনা, সবশেষে ছেলেটার পয়সা চুরির ঘটনা–সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সে। বিশপ তাকে মার্জনা করার পরেও এই শেষ চুরির ঘটনাটায় সে বড় লজ্জা পেল। সেসব কিছু দেখে সে নিজের জীবনের ও আত্মার একটা ছবি এঁকে ফেলল। সে ছবি যেমন কুৎসিত তেমনি ভয়ঙ্কর। তবু সে দেখল জীবন ও আত্মার জগতে এক নতুন দিনের প্রভাত-সূর্যের আবির্ভাব হয়েছে। আর সে দেখল এক স্বর্গীয় আলোর জ্যোতিতে এক শয়তান উদ্ভাসিত ও অভিন্নত হয়ে উঠেছে।

কতক্ষণ সে সেইখানে বসে বসে কেঁদেছিল? তার পর সে কী করেছিল এবং কোথায় গিয়েছিল? তা আমরা জানি না। তবে সেই রাত্রিতে গ্রেনোবল থেকে আসা এক ঘোড়ার গাড়ির ড্রাইভার দিগনের বড় গির্জাটার পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখে মঁসিয়ে বিয়েনভেনুর বাড়ির সামনে একজন মানুষ নতজানু হয়ে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *