ডাক্তার তরফদার জেসমিনের ফাইলে লম্বা একটা লেখা লিখেছেন। ক্লান্তি দূর করতে এক কাপ দুধ চা শেষ করলেন তিনি। তারপর শেষবারের মতো পড়তে শুরু করলেন লেখাটা,
ডাক্তার হাডসন কীভাবে জটিল অসুখগুলো সারিয়ে তুলতেন, এ বিষয়ে একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা রয়েছে। মূল ব্যাপারটা ছিল পেনিসিলিন নামক অ্যান্টিবায়োটিকস্ প্রয়োগ। বিষয়টা বুঝতে হলে ব্যাকটেরিয়া ও সৃষ্ট রোগ সম্পর্কে খানিকটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েন হুক ১৬৬৫ সালে ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করেন এবং তাকে ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কারের স্বীকৃতি দেয়া হয় ১৬৭৭ সালে। তিনি ছিলেন একজন ডাচ বিজ্ঞানী। ফাদার অব মাইক্রোবায়োলজি হিসেবেও তিনি বহুল পরিচিত। তার ঐ আবিষ্কারের সাথে সাথে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কী কী রোগের সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে চলতে থাকে গবেষণা। উল্লেখযোগ্য রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে কলেরা, ডিপথেরিয়া, মেনিনজাইটিস, টিটেনাস, গনোরিয়া, সিফিলিস, ফুড পয়জনিং, নিউমোনিয়া, গ্যাসট্রিটাইটিস, সেলুলাইটিস আর নানা ধরনের ঘা-পাঁচড়া। এছাড়াও আরো অনেক সংক্রামক রোগ, ইনফেকশন সৃষ্টি হয় ব্যাকটেরিয়া দ্বারা।
ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ তৈরির গবেষণাও চলতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। অবশেষে সফল হন স্কটিশ ডাক্তার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং। তিনি পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন ১৯২৮ সালে। লন্ডনের সেন্ট মেরিস হাসপাতালে গবেষণা করার সময় ১৯২৮ সালের ৩ অক্টোবর তিনি লক্ষ করেন যে ছত্রাক এমন একটি রাসায়নিক পদার্থ উৎপাদন করে যা ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিকে বন্ধ করে দেয়। এই রাসায়নিক পদার্থটির নাম দেন পেনিসিলিন এবং এ বিষয়ে ১৯২৯ সালে একটি প্রতিবেদন লেখেন। প্রতিবেদনে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে এই পেনিসিলিন চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কিন্তু আলেকজান্ডার ফ্লেমিং কাউকে বোঝাতে সক্ষম হননি যে আসলেই তার আবিষ্কারটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এর মূল কারণ ছিল, ছত্রাক থেকে বেশি পরিমাণ পেনিসিলিন উৎপাদন সম্ভব না হওয়ায় বড় পরিসরে পেনিসিলিনের কার্যকারিতা নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। তবে তার প্রচেষ্টা থেমে থাকেনি। তিনি সবাইকে বিষয়টি জানাতে থাকেন এবং বলতে থাকেন ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে পেনিসিলিন অত্যন্ত কার্যকর। ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের শেফিল্ডের সিসিল জর্জ পেইনি নামের একজন ডাক্তার এক রোগীর শরীরের গনোকক্কোল নামক ব্যাকটেরিয়াকে দমন করতে সক্ষম হন পেনিসিলিন ব্যবহার করে। বিষয়টি জানাজানি হলে অনেকেই নড়েচড়ে বসেন।
ছত্রাক থেকে পেনিসিলিন উৎপাদন তখন সহজতর ছিল না। ১৯৪০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী হাওয়ার্ড ফ্লোরে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরিতে বেশ খানিকটা পেনিসিলিন উৎপাদনে সক্ষম হন। এই পেনিসিলিন ব্যবহার করে আলবার্ট আলেকজান্ডার নামক একজন পুলিশ অফিসারের মুখের ইনফেকশন তিনি প্রায় সারিয়ে তুলেছিলেন, কিন্তু পর্যাপ্ত পেনিসিলিনের অভাবে ঐ পুলিশ অফিসার পরে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু অন্য যাদের ছোটখাট ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন ছিল তারা সুস্থ হয়ে উঠে। এতে বাড়তে থাকে পেনিসিলিনের চাহিদা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি চাহিদার তুলনায় খুব কম পরিমাণ পেনিসিলিন তখন উৎপাদন করতে পারত।
১৯৪৩ সালে সকল সাফল্য নিয়ে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং দ্যা ল্যানসেট জানালে তার গবেষণালব্ধ ফলাফল প্রকাশ করেন। ১৯৪৩ সালের ৫ এপ্রিল গুরুত্ব উপলব্ধি করে ব্রিটিশ ওয়ার কেবিনেট (British War Cabine) পেনিসিলিনের উৎপাদন এবং প্রয়োগ বিষয়ে একটি পেনিসিলিন কমিটি গঠন করে। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বাণিজ্যিকভাবে পেনিসিলিন উৎপাদনে ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে আমেরিকা পেনিসিলিন সম্পর্কে জানতে পারে এবং তারা বিষয়টি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। ১৯৪৩ সালে আমেরিকার War Production Board সর্বমোট ২.৩ মিলিয়ন ডোজ পেনিসিলিন তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই পেনিসিলিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা শুরু হয় যা মৃত্যু কমিয়ে আনে প্রায় ১৫%। তখন পেনিসিলিন গ্রহণের মাত্র তিন থেকে চার ঘণ্টার মধ্যে শরীর থেকে প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে যেত। ফলে রোগীর শরীরে বেশিক্ষণ পেনিসিলিন কার্যকর থাকত না এবং ঘন ঘন ডোজের প্রয়োজন হতো। এজন্য পেনিসিলিন ব্যবহারের খরচ ছিল অত্যন্ত বেশি। সাধারণ মানুষের জন্য অকল্পনীয় ছিল মূল্য। শুধু যুদ্ধের সৈনিক কিংবা ধনী ব্যক্তিরা ব্যবহার করতে পারত। ক্ষেত্র বিশেষে এমনও ঘটনা ছিল যে, রোগীর মূত্র সংগ্রহ করে রাখা হতো যেন ঐ মূত্র থেকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পেনিসিলিন আলাদা করে আবার ব্যবহার করা যায়। কিন্তু এটা সন্তোষজনক কোনো সমাধান ছিল না। পুনরায় শুরু হলো গবেষণা এবং এমন একটা কিছু খোঁজা যা পেনিসিলিনকে শরীর থেকে বের হতে দেবে না। অনেক গবেষণার পর পেনিসিলিনের সাথে প্রবেনাসিড নামক একটি রাসায়নিক পদার্থ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হলো এবং দেখা গেল সত্যি শরীরে দীর্ঘক্ষণ পেনিসিলিন থাকছে এবং ভালো সাফল্য আসছে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেনিসিলিনের বহুল প্রয়োগ শুরু হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের জন্য আলেকজান্ডার ফ্লেমিং নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালে আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া পেনিসিলিনের বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করলেও অতিরিক্ত চাহিদা এবং মূল্যের কারণে আফ্রিকা এশিয়ার মতো মহাদেশে পেনিসিলিন পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য। ডাক্তার হাডসন প্রথমে কাজ করতেন ব্রিটেনের সামরিক হাসপাতালে। সেখানে তিনি যুদ্ধাহত সৈনিকদের উপর পেনিসিলিন প্রয়োগের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি বাংলাদেশে আসেন ১৯৪৪ কিংবা ১৯৪৫ সালের দিকে, চট্টগ্রামে বয়োবৃদ্ধ পাদ্রীর কাছ থেকে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। ডাক্তার হাডসন প্রথমে অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন, পরে কাজ নেন খ্রিষ্টান মিশনারি হাসপাতালে। কিছু মিশনারিজ-এর মাধ্যমে পেনিসিলিন তখন এই উপমহাদেশে আসত এবং মিশনারিজের ডাক্তাররাই শুধু প্রয়োগ করতে পারতেন। ডাক্তার হাডসনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকদের পেনিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা করার অভিজ্ঞতা থাকায় তিনি স্থানীয় রোগী যাদের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়েছিল তাদেরকেও পেনিসিলিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেন। এই পেনিসিলিনই ছিল তার ম্যাজিক ওষুধ কারণ তখনো পেনিসিলিন উপমহাদেশে সহজলভ্য হয়নি। পেনিসিলিন নামটা কাউকে তিনি জানাতেন না। কারণ সম্ভবত মিশনারিজ ছাড়া অন্য কোথাও সেটি ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বিদেশি সৈনিকদের চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল। ঐ সময় বাংলাদেশে মিত্রশক্তি ব্রিটিশ, অস্ট্রেলিয়ান ও আফ্রিকান অনেক সৈন্য অবস্থান নিয়েছিল। বার্মার সাথে যুদ্ধে তাদের অনেকে আহত হয়, কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করে। প্রমাণস্বরূপ চট্টগ্রাম এবং কুমিল্লায় রয়েছে ওয়ার সিমেটেরি যেখানে মিত্রশক্তির সামরিক সদস্যদের কবর রয়েছে। ঐ সামরিক সদস্যদের চিকিৎসায় জন্য পাঠানো হতো দুর্লভ পেনিসিলিন। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার কথা ভেবে সম্ভবত রয়ে যাওয়া অতিরিক্ত পেনিসিলিন ব্যবহার করতেন মানবিক ডাক্তার হাডসন। তার ঐ চিকিৎসার জাদুতেই বেঁচে গিয়েছিলেন ইরফান আলীসহ আরো অনেকে। তবে অ্যান্টিবায়োটিকসের অতিরিক্ত ব্যবহার শরীরের জন্য ক্ষতিকর। কারণ ব্যাকটেরিয়া রেজিস্ট্যান্স লাভ করে, অর্থাৎ অ্যান্টিবায়োটিকসূকে অকার্যকর করে দেয়ার ক্ষমতা সৃষ্টি হয় ব্যাকটেরিয়ার শরীরে। পেনিসিলিন এখন অধিকাংশ ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অকার্যকর। মানুষও পিছিয়ে নেই। পেনিসিলিনের উপর গবেষণা করে নতুন নতুন অ্যান্টিবায়োটিকস্ তৈরি করে ফেলেছে। এগুলোর ডোজও কম। তবে এক-একটির কার্যকারিতা ও ব্যবহার একেক রকম। এজন্য ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই অ্যান্টিবায়োটিকস গ্রহণ করা উচিত নয় এবং অতিরিক্ত ডোজ থেকে সম্পূর্ণই নিজেকে বিরত রাখা সমীচীন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ডাক্তার হাডসন তার স্ত্রীকে ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন। সম্ভবত সাথে করে অনেক পেনিসিলিনও এনেছিলেন। কিন্তু ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে জাহাজ বিকল হয়ে গেলে জাহাজ চলে আসে হাডসন হিলের কাছাকাছি। তিনি, তার স্ত্রী এলিজা এবং অনেকে সিদ্ধান্ত নেন নেমে যাওয়ার। জায়গাটা ভালো লাগায় থাকতে চান কয়েকটা দিন। কিন্তু এলিজার মৃত্যু তাকে আর ফিরে যেতে দেয়নি মিশনারিজে। ভালোবাসার টানে প্রিয় স্ত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন বছরের পর বছর। অবশেষে করুণ মৃত্যুবরণ করতে হয় তাকে। পাহাড়ের উপর মাটি দেয়ার প্রায় ষাট বছর পরও তার কঙ্কাল পাওয়ার বিষয়টি সত্যি বিস্ময়কর। সাধারণত কঙ্কাল মাটির সাথে মিশতে সময় লাগে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর। অবশ্য ব্যাপারটা নির্ভর করে পানির উপস্থিতি, আর্দ্রতা, মাটির ধরনের উপর। ডাক্তার হাডসনের লাশের নিচে এবং উপরে পাথর থাকায় এবং চারপাশের পাহাড়ের গঠনে পাথরের পরিমাণ বেশি থাকায় কঙ্কাল পরিপূর্ণভাবে মাটির সাথে মিশতে পারেনি। এজন্যই উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ডাক্তার হাডসনের কঙ্কাল।
এলিজার মৃত্যু হয়েছিল সম্ভবত সাগরের রিপকারেন্ট (Rip Current) এবং আন্ডারটো (Undertow)-এর কবলে পড়ে। প্রতিদিন গড়ে সাগরের প্রায় ৬০০০ ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ে। তারপর ঢেউগুলো আবার ফিরে যায় সাগরে। কোনো কারণে ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ার আগে যদি ভেঙে যায় এবং ফিরে যাওয়ার সময় অভিকর্ষজ ত্বরণ বা বাতাসের কারণে অতিরিক্ত গতি লাভ করে তখন সৃষ্টি হয় রিপ কারেন্টের। দুইপাশের পানি একত্রে ফিরে যাওয়ার ধাক্কায় এই স্রোতের গতি অনেক বেশি হয় যা মানুষকে দ্রুত ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। খুব ভালো সাতারুকেও অনেকদূর ভাসিয়ে নিতে পারে রিপ কারেন্ট। একটি রিপ কারেন্ট গড়ে ১৬ মিটার পর্যন্ত চওড়া হয়। তবে কতদূর ভাসিয়ে নেবে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। বিষয়টি নির্ভর করে সাঁতরানোর দক্ষতা এবং স্রোতের টানের উপর। আশার কথা রিপ কারেন্ট মানুষকে সমুদ্রের তলদেশে টেনে নেয় না, শুধু ভাসিয়ে ভাসিয়ে টানতে থাকে। এজন্য আতঙ্কিত না হয়ে ভেসে থেকে রিপ কারেন্ট থেকে বাঁচা সম্ভব। কেউ রিপ কারেন্টে আক্রান্ত হলে তাকে মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখতে হবে, জোরে জোরে সাহায্য চাইতে হবে, বিচের সাথে আড়াআড়ি সাঁতরাতে হবে। বিচের সাথে আড়াআড়ি সাঁতরে যদি রিপ কারেন্টের বাইরে চলে আসা যায় তাহলে পাশের ঢেউ তাকে ধাক্কা দিয়ে তীরের দিকে নিয়ে আসবে। রিপ কারেন্টের মধ্যে থেকে কখনো তীরের দিকে সাঁতরানোর চেষ্টা করতে নেই, এতে শুধু শক্তির অপচয় হয়। রিপ কারেন্টের গতি সাগরের দিকে এত বেশি থাকে যে আগত বড় বড় ঢেউয়ের মধ্যে দিয়ে মানুষকে সাগরের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। যেহেতু রিপ কারেন্ট গড়ে সর্বোচ্চ ১৬ মিটার বা ৫০ হাতের কাছাকাছি চওড়া হয়, এতটুকু আড়াআড়ি সাঁতরাতে পারলে রিপ কারেন্ট থেকে বাঁচা সম্ভব। রিপ কারেন্টে কেউ আক্রান্ত হলে প্রশিক্ষিত ব্যক্তি ব্যতীত সেই রিপ কারেন্টের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাউকে উদ্ধারের চেষ্টা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু না। কারণ যিনি উদ্ধার করতে যাবেন, তিনিও মৃত্যুবরণ করতে পারেন। উদ্ধারকারীদের রিপ কারেন্টে মৃত্যুর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে। কোনো কারণে রিপ কারেন্টের সাথে যদি আন্ডারটো (Undertow) যুক্ত হয় তাহলে মানুষের বেঁচে থাকা আরো কঠিন হয়ে পড়ে। আন্ডারটো হলো মানুষকে পানির নিচে টেনে নিয়ে যাওয়ার শক্তিসম্পন্ন ঢেউ। তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের উচ্চতা যখন খুব বেশি হয়, তখন ঐ ঢেউ অভিকর্ষজ বলের টানে খুব দ্রুত নিচের দিকে যেতে থাকে। পানির নিচের দিকে যাওয়ার এই প্রবণতাকে বলে আন্ডারটো। কোনো মানুষ এই আন্ডারটোতে পড়লে সে শ্বাস নিতে পারে না। যদি সাগরতীরে পানির গভীরতা বেশি হয় এবং উঁচু-নিচু পাথর থাকে সেক্ষেত্রে আহত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এজন্য পাথুরে সাগর তীরে নামা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। যদি কোনো কারণে রিপ কারেন্ট আর আন্ডারটো একইসাথে হয় এবং ঐ স্রোতের মধ্যে দুর্ভাগ্যবশত মানুষ পড়ে, তাহলে তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে পড়ে। একটা আন্ডারটোর উপর যদি বড় আর-একটা ঢেউ এসে পড়ে তাহলে মানুষ ভেসে উঠার আগেই পানির চাপে আবার নিচে চলে যায়। মৃত্যু তখন অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই রিপ কারেন্ট এবং আন্ডারটোর গতি ভাটার সময় বৃদ্ধি পায় বেশি। কারণ তখন পানির টান এমনিতেই তীরের বিপরীতমুখী হয়। এ কারণে ভাটার সময় রিপ কারেন্ট কিংবা আন্ডারটো আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। বিষয়টি উপলব্ধি করে ভাটার সময় সাগরে নামা নিরুৎসাহিত করা হয়। লাল পতাকা টাঙানো হয় সর্বত্র। সাগরে গোসল করার ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে জোয়ারের সময়টা বেশি নিরাপদ। ২০২০ ও ২০২১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতি বছর শুধু আমেরিকাতেই রিপ কারেন্টের কারণে ১০০-এর উপর মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
এলিজা যখন সাগরে ডুবে যায় তখন ছিল সন্ধ্যা এবং বাতাসও ছিল বেশি। খুব ভালো সাঁতারু ছিল না সে। হয়তো রিপ কারেন্ট আর আন্ডারটো একসাথে হওয়ায় পানির নিচ থেকে আর উঠতে পারেনি এলিজা। দ্রুত অন্ধকার নেমে আসায় তাকে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। দূরে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলেও জানা যেত, কারণ সে ছিল ব্রিটিশ নাগরিক। বিদেশি নাগরিকের মৃতদেহ প্রাপ্তি বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করত। কিন্তু সেরকম কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা যেতে পারে সাগরেই মিশে গেছে এলিজার মৃহদেহ।
ডাক্তার তরফদার চেম্বার থেকে বের হয়ে এলেন। বারান্দায় দেখলেন নীল চোখের ছোট্ট ইকবাল আর তার মা রিতা বসে আছে। ইকবাল পরির পায়েস খাচ্ছে। বড় পছন্দ তার।
রিতা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আসলে না আইসা পারলাম না। ইকবাল পায়েস খাবেই। পরির পায়েস। না দিলে কান্নাকাটি কইরা পাগল বানায় ফেলায়। তাই নিয়া আইছি। কিছু মনে করবেন না স্যার। নিজে যাইয়া ফ্রিজ থাইকা নিয়া আইছে।
ডাক্তার তরফদার ইকবালের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, তোমার যখন ইচ্ছে হয় তখন চলে আসবে আর পায়েস খাবে। ইচ্ছে করলে নিয়েও যাবে।
ইকবাল মিষ্টি একটা হাসি দিল। নীল চোখের মানুষ যখন হাসে তখন বড় সুন্দর লাগে তাকে দেখতে। ফর্সা ইকবালকে সত্যি দারুণ লাগছে। আজ।
রিতা এবার বলল, স্যার ওর সমস্যা তো ঠিক হইল না।
কী সমস্যা?
যা দ্যাখে আর শুনে সব মনে রাখবার পারে।
এটা তো ভালো গুণ।
আমার খুব ভয় করে!
ভয়ের কিছু নেই। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে। অত চিন্তা কোরো না।
সবসময় স্যার আমার চিন্তা হয় ওরে নিয়া! একটানা একটু শান্তি, একটু সুখ চাই স্যার আমি।
সুখেই আছো ত অনেক মানুষ আছে যারা তোমার থেকে অসুখী। সুখের পাশাপাশি দুঃখ থাকবে এটা স্বভাবিক। আর এটাও তোমাকে মনে রাখতে হবে যে, একটানা সুখ মানুষের ভালো লাগে না। মানুষ যখন বেশি সুখী হয় তখন বাস্তবে না হলেও কল্পনায় অসুখী হওয়ার চেষ্টা করে। কারণ সে জানে, অসুখী হওয়ার পর আবার সে সুখী হবে। তখন সুখের অনুভবটা হয় সর্বোচ্চ। মানুষের জীবনে সুখী অসুখী হওয়ার এই চক্রটা হলো সুখচক্র। আমরা সবাই কম-বেশি সুখচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছি।
কথার মাঝেই ইকবাল ঘরের ভিতর ঢুকে গেল। রিতা বলল, দ্যাখছেন স্যার, কত বড় বেয়াদব! আপনের অনুমতি পর্যন্ত নিল না। মাঝখানে যে কয়েকবার আইছিল করিম চাচার অনুমতি নিছিল। আপনেরে দ্যাখলে ওর সাহস বাইড়া যায়। ভাবখানা এমন যেন তার নিজের বাড়ি।
পেয়ালার পাশাপাশি প্লাস্টিকের ছোট ছোট কাপেও রাখা হয় পরির পায়েস। দুই হাতে চারটা কাপ নিয়ে এসেছে ইকবাল। রানু রাগে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল ইকবালের গালে। বলল, এতগুলা কাপ আনা লাগে নাকি! স্যার কী মনে করবে।
ইকবালের চোখে সাথে সাথে পানি চলে এলো।
ডাক্তার তরফদার একটু বিরক্তই হলেন। বললেন এভাবে মারছ কেন ওকে? আগেও তোমাকে নিষেধ করেছি। খবরদার আর এরকম করবে না। আর বলে দিচ্ছি এই বাড়ির সব পায়েস ওর, সবকিছু ওর। কথাগুলো বলে ডাক্তার তরফদার ইকবালকে ভিতরে নিয়ে গেলেন। তারপর ফ্রিজে যতগুলো পায়েসের কাপ ছিল একটা কার্টুনে ভরে দিয়ে দিলেন। ইকবালের চোখের অশ্রু তখনো থামেনি। ডুকরে ডুকরে কাঁদছে সে। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, নীল চোখের মানুষ হাসলে যেমন সুন্দর লাগে, কাঁদলেও তেমন সুন্দর লাগে। নীল চোখের মানুষ সত্যি সৌভাগ্যবান, একমাত্র ডাক্তার হাডসন ছাড়া। বড় করুণ মৃত্যু হয়েছিল তার। তার মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল টেকনাফ এলাকায় দুটো শিশুর নীল চোখ নিয়ে জন্ম নেয়ার ঘটনা। অথচ কেউ বুঝতে চায়নি ঐ নীল চোখের শিশু ডাক্তার হাডসনের সাথে কারো শারীরিক সম্পর্কের ফলে জন্ম হয়নি। মানুষের চোখের রঙের জন দায়ী ক্রোমোজমের ১৬তম জিন। একজন মানুষের চোখের রং কীরকম হবে তা নির্ভর করে চোখের আইরিশে কতটুকু মেলানিন আছে তার উপর। চোখে স্বাভাবিক পরিমাণ মেলানিন থাকলে চোখটিকে ব্রাউন বা বাদামি দেখায়। মেলানিনের পরিমাণ কিছুটা কম হলে চোখ সবুজ দেখায়, আর যদি একেবারে কম হয় তাহলে নীল দেখায়। মেলানিন যত বেশি হবে চোখের আইরিশ ততই আলো শোষণ করবে। নীল চোখের মানুষের চোখে মেলানিন কম থাকায় বেশি আলো শোষণ করতে পারে না, আলো চোখ থেকে বাইরের দিকে প্রতিফলিত হয় বেশি। এজন্য নীল চোখকে উজ্জ্বল দেখায় এবং চোখ দেখতেও সুন্দর লাগে। পৃথিবীতে দেশভেদে প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষের চোখ বাদামি। মাঝে মাঝে আমরা এই বাদামি চোখকে কালো বলে ভুল করি। আয়নার সামনে গিয়ে আমরা যদি আমাদের দেশের আট-দশজনের চোখ উজ্জ্বল আলোতে পরীক্ষা করি তাহলে বিষয়টা বুঝতে পারব। বাদামি চোখের পর সবচেয়ে বেশি হয় নীল চোখ, প্রায় ১৫ ভাগ। বাকি ১০ ভাগ মানুষের চোখ হয় সবুজ, ধূসর কিংবা অন্য রঙের। কক্সবাজারে যে দুটো শিশুর চোখ নীল ছিল তাদের চোখে কোনো কারণে মেলানিনের পরিমাণ কম হয়েছিল, হতে পারে বিবর্তনগত পরিবর্তনের কারণে। আমাদের দেশে বাদামি (আমরা কালো বলি) চোখের বাবা-মায়ের এমন অনেক সন্তান রয়েছে যাদের চোখের রং নীল, সবুজ কিংবা ঘোলাটে (Cat’s Eys)। ডাকাত মাহাতাব অজ্ঞতার কারণে নীল চোখের সন্তান হওয়ায় সন্দেহ করেছিল তার স্ত্রীকে এবং দায়ী করেছিল ডাক্তার হাডসনকে। এই নীল চোখের অন্যতম উদাহরণ ইকবাল যে কি না তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এজন্য আমাদের সমাজে নীল, ধূসর কিংবা সবুজ চোখ দেখলে কাউকে অহেতুক দোষারোপ করা উচিত নয়। বুঝতে হবে এটা স্বাভাবিক বিবর্তনের ফল অথবা প্রকৃতির চাওয়া।
ডাক্তার তরফদার সামনে ঝুঁকে এসে ইকবালের কপালে একটা চুমু খেলেন। চোখে অশ্রু থাকলেও ইকবাল এবার হেসে দিল। নীল চোখের মানুষ একই সাথে হাসছে আবার কাঁদছে। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিরল এবং সুন্দর দৃশ্যটি তিনি এখন দেখছেন।
*
হুশনা বসে আছে ডাক্তার তরফদারের সামনে। এই প্রথম হুশনা তার চেম্বারে এসেছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে মন খুব খারাপ। ডাক্তার তরফদার বললেন, আমার মনে হচ্ছে তুমি ভয়ংকর কিছু বলতে এসেছ?
স্যার!
বলো।
স্যার হামিদ ভাইজান গত পরশুদিন মারা গেছে।
ডাক্তার তরফদার কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। দীর্ঘদিন ডাক্তারি পেশায় থাকায় রোগীর মৃত্যুর খবরে তার চোখে পানি খুব একটা আসে না, বুকের মধ্যেই কষ্টটা চেপে রাখতে পারেন। তবে আজ পারলেন না। চোখ দিয়ে তার টপটপ করে পানি বেরিয়ে এলো।
হুশনা মুখে আঁচল চেপে বলতে থাকল, স্যার, রাত তিনডার দিকে আজানের শব্দে ঘুম ভাইঙ্গা যায় আমার। ঘুম থাইকা উইঠা দেখি ভাইজান আজান দিতেছে। আমার ভাইজানরে আমি কোনোদিন আজান দিবার দেখি নাই। আজান দেওয়া শ্যাষ হইলে আমার কাছে এক গ্লাস পানি চাইল। আমি পানি দিলাম। ভাইজান নামাজ পড়ল। তারপর বলল, আমার সময় হইয়া আইছেরে হুশনা, সময় হইয়া আইছে। তুই আমারে নিয়া ভাবিস না। আমি ভালোই থাকব। ক্যান জানস? মায়ে আমারে নিবার আইছে। সাদা কাপড় পইরা বাইরা দাঁড়ায় আছে। তুই ভালো থাকিস বুইন, বড় যত্ন করছস আমার। কিন্তু আমি কিছু করবার পারলাম না। আ…আর, আমার। মরণের খবর কাউরে জানাবি না। তরফদার স্যাররেও না, বড় কষ্ট পাবে হে। ক্যান জানস? আমারে বড় ভালোবাসে স্যার। স্যাররে আমি কিছু দিবার পারি নাই। তয় আমারে মাটি দিবার পর যাইয়া এই বাঁশিড়া দিবি। স্যাররে বলবি, স্যার যেন আমারে মনে রাখে। আর আমারে এই ঘরেই মাটি দিবি। আর বলবি, আমি আত্মা হইয়া মাঝে মাঝে স্যারের বাড়িতে যাব, স্যাররে দেখব, বড় ভালো মানুষ হে, বড় ভালো মানুষ!
কথাগুলো বলে হুশনা মুখে আঁচল চাপল আর ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকল। ডাক্তার তরফদার একেবারে নির্বাক হয়ে গেছেন। কিছুতেই তিনি তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না।
কিছুক্ষণ পর হুশনা চোখ মুছে হাতের বাঁশিটা বের করে বলল, স্যার, এই যে আপনের বাঁশি।
ডাক্তার তরফদার কাঁপা হাতে বাঁশিটা নিলেন।
হুশনা বলল, স্যার আমি শিরিন আপার কথা মনে করায় দিছিলাম। তারেও জানাবার নিষেধ করছে।
ডাক্তার তরফদার এখনো চুপ। কথা বলার মতো শক্তি যেন ফিরে পাচ্ছেন না তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের পানি আটকাতে চেষ্টা করছেন।
স্যার, এক কোটি টাকার আমার আর দরকার নাই। সোনার চুরিগুলাও। আমি আমার ভাইরে নিঃস্বার্থভাবে সেবা করছি। আমি টাকা আর চুরিগুলা ফিরায় দিবার চাই শিরিন আপারে।
ডাক্তার তরফদার ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে বললেন, ঠিক হবে না। তুমি বরং একটা আশ্রয়কেন্দ্র করো। হামিদের মতো যারা আছে তারা যেন এই আশ্রয়কেন্দ্রে এসে থাকতে পারে, যেন তাদের চিকিৎসা হয় আর তোমার মতো সেবক পায়। এতে তোমার ভাইয়ের আত্মা বড় শান্তি পাবে।
আমি একা পারব না স্যার।
তোমার সাথে না হয় আমি থাকব। আমাদের দেশে বহু ধনী মানুষ আছে যারা তোমার ভাইয়ের মতো মানুষদের সাহায্য করতে চায়। আমি তাদের কয়েকজনকে তোমার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেব। আর ঐ আশ্রয় কেন্দ্রের নাম তোমার ভাইয়ের নামেই রেখো। হতে পারে হামিদ আরোগ্য সেন্টার, হামিদ মানবিক কেন্দ্র, হামিদ আশ্রয় কেন্দ্র অথবা হামিদ ক্লিনিক।
স্যার ঠিক আছে, আপনে যখন বলছেন আমি অবশ্যই করব। আমার এলাকার চেয়ারম্যান বড় ভালো মানুষ। সেও এইরকম একটা কথা বলতেছিল।
তাহলে তো ভালোই হয়।
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে উঠে গেল হুশনা। তাকে বিদায় দিতে বাইরে এলেন ডাক্তার তরফদার। এসে দেখেন মুখ কালো করে জেহান বসে আছে। বললেন, কী হয়েছে জেহান?
স্যার আমার আর ভালো লাগছে না।
কেন?
জেসমিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
কী বলছ!
জি স্যার। হেডস্যারের এক বন্ধুর ছেলের সাথে। আমেরিকায় থাকে।
তারা কি সবকিছু জানে?
জি স্যার, জানে।
জেসমিনের শরীরের কী অবস্থা এখন?
ভালো স্যার। জেসমিনকেও খুব খুশি দেখলাম। মনে হচ্ছে সেও চাচ্ছে বিয়েটা হয়ে যাক। আসলে আমেরিকায় চলে যেতে পারবে।
ওর তো আঠারো বছর হয়নি।
হয়ে গেছে স্যার।
পড়াশুনা শেষ করবে না?
জেহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মনে হচ্ছে না। স্যার বড় কষ্ট হচ্ছে আমার। আমার জন্য আপনি কিছু করুন।
তোমার বাবা-মা কি জানে জেসমিনের বিয়ের কথা?
জানে স্যার। কিন্তু তারা জেসমিনকে দেখতে পারে না। তাদের কথা বিয়ের আগে যে মেয়ের পেটে বাচ্চা হয় সে কখনো ভালো হতে পারে না। শুধু তাই না, দুজনেই বিশ্বাস করে জেসমিনের সন্তানটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। এজন্য জেসমিনের নাম শুনলেই রেগে উঠছে। রাশেদ ভাই আমাকে জড়িয়ে আবার গুজব ছড়ানোতে বিব্রতকর অবস্থায় আছি আমি। রাশেদ ভাই পরে যাকে ভালোবেসেছিল সে অবশ্য প্রেগন্যান্ট না। কেউ মিথ্যা গুজব ছড়িয়েছে। এতে আমার উপর অনেকের সন্দেহ বাড়ছে। কিন্তু স্যার বিশ্বাস করেন জেসমিনের সাথে আমার অন্য কোনো সম্পর্ক নেই।
আমি বিশ্বাস করি। আর এখন তো বিষয়টা প্রমাণিত। কারণ জেসমিনের বাচ্চার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে।
কেউ বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।
ধীরে ধীরে করবে। রাশেদের কী অবস্থা?
চাঁদাবাজির অভিযোগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। এখন জেলে আছে। মনে হচ্ছে না তাড়াতাড়ি ছাড়া পাবে। সাধারণ ছাত্রদের কাছ থেকে জোরপূর্বক চাঁদা নেয়ার অভিযোগে কলেজ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে।
একটু থেমে জেহান আবার বলল, স্যার আমি বোধহয় পাগল হয়ে যাব। কিছুই ভালো লাগে না। আমি কী করব?
ডাক্তার তরফদার জেহানের কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করবে। মনে রাখবে, জেসমিন জীবনের সবকিছু নয়। তুমি হয়তো জেসমিনকে পছন্দ করো, তাকে ভালোবাসো। কিন্তু জেসমিন তোমাকে ভালোবাসে বলে কোনো প্রমাণ নেই আমাদের হাতে। ভালোবাসার বন্ধন একটি মন দিয়ে হয় না, দুটি মনের সম্মতি লাগে। তাছাড়া জেসমিনের বাবা-মা, তোমার বাবা-মা কেউ রাজি হবেন না। সমাজও মেনে নিতে চাইবে না, কারণ জেসমিন বয়সে তোমার বড়। প্রেমের বিয়ে আমাদের সমাজ এমনিতেই মানতে চায় না, আর তোমাদের হচ্ছে অসম প্রেম। প্রতিবন্ধকতাও বেশি। এত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে জেসমিনকে পাওয়া তোমার জন্য সত্যি অসম্ভব। তোমাকে বাস্তবতা মানতে হবে। মনে রাখবে, ‘অসম সম্পর্ক সাময়িকভাবে সুখ দিতে পারলেও, সুখকে স্থায়ী করতে পারে না।’
জেহান শূন্য দৃষ্টিতে তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। ডাক্তার তরফদার বললেন, এসো আমার সাথে ভিতরে এসো। তোমার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করব।
চেম্বারের ভিতরে এসে ডাক্তার তরফদার দেখলেন জেহান নেই। তিনি আবার বাইরে এলেন, কিন্তু দেখতে পেলেন না জেহানকে। বড় আবেগী হয়ে পড়েছে সে। এরকম আবেগ যে কোনো সময় বড় ধরনের বিপদের কারণ হতে পারে। ডাক্তার তরফদার জেসমিনের ফাইলটা টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন।
মানুষের জীবনে প্রেম যেমন আনন্দের, তেমনই কষ্টের। তবে এই প্রেম ভালোবাসা মাত্রাতিরিক্ত হলে তখন শুধুই কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একজন নারী বা পুরুষের অন্য একজন পুরুষ বা নারীর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত অস্বাভাবিক প্রেমকে বলে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডার (Obsessive Love Disorder}. অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত মানুষ তার পছন্দের মানুষকে ভালোবাসতে চায়, কাছে পেতে চায়, তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, কল্পনা করে, তাকে খুশি করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে, তাকে পাওয়ার জন্যও সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে। এটি একটি মানসিক সমস্যা। এমনকি প্রিয়জনকে পাওয়ার জন্য নিজের সামাজিক অবস্থান, ব্যক্তিত্বকেও ভুলে যায় ব্যক্তিটি। আর ইচ্ছামতো সবকিছু না চললে হিংস্র হয়ে উঠতে পারে যে কোনো সময়, নতুবা নীরবে শুধু কষ্ট পেতেই থাকে। নীরব এই কষ্ট এক সময় বিষণ্ণতার (Depression) সৃষ্টি করে যা তার স্বাভাবিক জীবনকে ব্যাহত করে এবং আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। জেসমিনকে নিয়ে জেহান ভুগছে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে। জেসমিনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার দিন সে যখন নিশ্চিত হবে তার পক্ষে আর জেসমিনকে পাওয়া সম্ভব নয় তখন ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে। জেহানের মতো জেসমিনও ভুগেছে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে। কল্পনায় সে ভেবে নিয়েছিল ডাক্তার হাডসনকে তার প্রিয় মানুষ হিসেবে। বয়ঃসন্ধিকাল বিশেষ করে বারো থেকে আঠারো বছর একজন ছেলে কিংবা মেয়ের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে ছেলেদের শরীরে সৃষ্টি হয় টেসটেসটেরন হরমোন, যে হরমোন একজন ছেলেকে পুরুষ হিসেবে গড়ে তোলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ওয়েস্ট্রেজন এবং প্রজেস্টিরিন নামক দুটো হরমোন। এই দুই হরমোন একজন মেয়েকে পরিপূর্ণ নারী হিসেবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। বয়ঃসন্ধিকালে সৃষ্ট এই দুই হরমোন শারীরিক যেমন পরিবর্তন ঘটায় তেমনি ঘটায় মানসিক পরিবর্তনও। এজন্য বয়ঃসন্ধিকালে একজন ছেলে কিংবা মেয়ের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। লিঙ্গভেদে শরীরে পর্যাপ্ত টেসটেসটেরন কিংবা ওয়েস্ট্রেজনের উপস্থিতি তাদেরকে প্রেম করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং না পাওয়া পর্যন্ত স্থির থাকতে দেয় না। যারা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারাই হয়তো সফল হয়। আর যারা পারে না তাদের কেউ কেউ অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারে। এই মানসিক অসুখটা যে শুধু বয়ঃসন্ধিকালে সৃষ্টি হবে তা কিন্তু নয়। যে কোনো বয়সে যে কারো হতে পারে। হামিদের মধ্যে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে মৃত্যুই হয়েছিল তার শেষ পরিণতি। জেসমিনের ক্ষেত্রে ঘটনাটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারের সাথে তার ছিল তীব্র হ্যালুসিনেশন (Hallucination)। কক্সবাজার যাওয়ার আগে তার রাশেদের প্রেমে পড়ার মতো অবস্থা ছিল। কিন্তু বাদ সাধে শিক্ষাসফর। কল্পনায় সে যেমন একজন পুরুষকে খুঁজছিল ঠিক সেরকমই সুদর্শন, ভদ্র, মার্জিত একজনকে পেয়ে যায় হাডসন হিলে। নাম তার ডাক্তার হাডসন। ডাক্তার হাডসনের নীল চোখ, তীব্র ভালোবাসা, তার মানবিকতার গল্প দারুণভাবে আকৃষ্ট করে জেসমিনকে। এই আকর্ষণের টানে তার মন থেকে মুছে যায় রাশেদের অবস্থান। সেখানে শক্ত অবস্থান করে নেয় ডাক্তার হাডসন। এই অবস্থানের অন্যতম কারণ ছিল তার স্ত্রীর নাম। সবাই জানে ডাক্তার হাডসনের স্ত্রীর নাম এলিজা। কিন্তু কম মানুষই জানে তার পুরো নাম ছিল এলিজা জেসমিন। এই নামটা লেখা আছে হাডসনের মূর্তির ঠিক পাশে যেখানে এলিজার মূর্তি তৈরির কথা ছিল। সম্ভবত ব্যাপারটা নজরে পড়েছিল জেসমিনের। ডাক্তার হাডসন ভালোবাসায় ভরা বুক নিয়ে বসে আছে স্ত্রী এলিজা জেসমিনের জন্য, আর জেসমিন গিয়ে হাজির হয়েছে হাডসন হিলে। এই দুয়ের সমন্বয় জেসমিনের অবচেতন মনে এক অবিশ্বাস্য অনুরণন সৃষ্টি করে এবং সে বিশ্বাস করতে থাকে ডাক্তার হাডসন জীবিত আছে এবং তাকে সে প্রচণ্ড ভালোবাসে। তারপর থেকে শুরু হয় কল্পনায় ডাক্তার হাডসনকে পাওয়ার ইচ্ছা। কোনোভাবে হয়তো শুনেছে তিনি লাল রং পছন্দ করতেন। জেসমিনও শুরু করে লাল রঙের শাড়ি পরা। সতের বছরের জেসমিনের শরীরে তখন ওয়েস্ট্রেজন হরমোনের দারুণ আধিক্য। যার ফলে ঐ হরমোন তাকে বারবার বাধ্য করত পুরুষের কথা ভাবতে। এই ভাবনা প্রসারিত হতো অবচেতন মনে। অবচেতন মন তার সামনে নিয়ে আসত ডাক্তার হাডসনের চেহারাকে। এজন্য কল্পনায় ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বকে বিশ্বাস করা এবং কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা তৈরি হতো তার মধ্যে। ঐ কল্পনায় সে ডাক্তার হাডসনকে আমন্ত্রণ জানাত নিজের কাছে এবং তার সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতো। বয়ঃসন্ধিকালে এরকম চিন্তা, চেতনা বা স্বপ্নে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন একটা প্রাকৃতিক ফিজিওলজিক্যাল প্রক্রিয়া। এজন্য পেটের অভ্যন্তরের সন্তানকে জেসমিন মনে করত ডাক্তার হাডসনের সন্তান এবং ডাক্তার হাডসনকে মনে করত নিজের স্বামী। পরবর্তী সামাজিক চাপে সে যখন একা হয়ে যায় তখন সারাদিন ডাক্তার হাডসনকে নিয়েই ভাবত। তার একাকিত্বের জগতে ভালোলাগার একমাত্র সঙ্গী ছিলেন ডাক্তার হাডসন। এতে ডাক্তার হাডসনের প্রতি সে আরো আসক্ত হয়ে পড়ে। কল্পনার গভীরতা তার এত বেশি ছিল যে সে সচেতন জীবন এবং অবচেতন মনের কল্পনার জীবন, এই দুই জীবনের পার্থক্য বুঝতে পারত না। তাই ধীরে ধীরে অবিশ্বাস করতে থাকে নিজের বাবা-মাকে এবং হয়ে উঠে সিজোফ্রেনিক (Schizophrenic)। একসময় এই অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতা ঘর ছাড়তে বাধ্য করে তাকে। চলে যায় কক্সবাজারে হাডসন হিলে। ঐখানে গিয়ে যখন বুঝতে পারে আসলেই ডাক্তার হাডসন বেঁচে নেই তখন আবার সে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। জেসমিনের এরকম প্রেমে পড়া এবং কক্সবাজারে চলে যাওয়াটা অবিশাস্য মনে হলেও বাস্তবে মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে সম্ভব। সত্যি কথা বলতে কি, ডাক্তার হাডসনের প্রতি তার তীব্র ভালোবাসাও ছিল এক ধরেন অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডার। এদিকে জেসমিন জানে না তাকে ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে বসিয়ে অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে ভুগছে তার থেকে বয়সে ছোট জেহান। জেহান যদি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠে তাহলে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে জেসমিনের। আর যদি প্রতিশোধপরায়ণ না হয়ে ঠান্ডা থাকে তাহলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে জেহানের নিজের। অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত জেহান এখন এক মহাসংকটের নাম। কারণ সে তার ভালোবাসার কথা বলতে পারছে না তার প্রেমিকাকে, মূল কারণ নিজের উপর আস্থার অভাব। মানসিক এই ভয় বা সংকটের নাম ফিলোফোবিয়া (Philophobia)। ফিলোফোবিয়া পূর্বে প্রেম প্রত্যাখ্যানের ইতিহাস থেকে হতে পারে অথবা হতে পারে জেনেটিক কারণে! জেহানের ফিলোফোবিয়ার কারণ সম্ভবত জেনেটিক, এজন্য তাকে সুস্থ করে তোলা সত্যি বড় কঠিন।
লেখা শেষ করে ডাক্তার তরফদার চেয়ারে হেলান দিলেন। তার সামনে একটা বাঁশি। বাঁশিটা হামিদের বাঁশি। এই বাঁশি আর কখনো বাজবে না, ভাবতেই তার বুকটা হুহু করে উঠল। হামিদের মৃত্যু শুধু একটা সাধারণ মৃত্যু নয়, এক নির্মল পবিত্র ভালোবাসার মৃত্যু। এভাবে কত ভালোবাসার যে জন্ম হয় আর কত ভালোবাসার যে মৃত্যু হয় তার কোনো হিসাব নেই। পৃথিবীতে টাকাপয়সা, অর্থকড়ি, হীরা-জহরতের হিসাব থাকলেও মহামূল্যবান ভালোবাসার কোনো হিসাব থাকে না। বড় অদ্ভুত এই পৃথিবী!
ডাক্তার তরফদার সামনে ঝুঁকে বাঁশিটা তুলে নিয়ে বইয়ের পাশে খাড়া করে রাখলেন। তারপর আবার হেলান দিলেন চেয়ারে। চোখ তার ঝাপসা হয়ে আসছে। আজ তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে, খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এই কান্নাটা যতটা না হামিদের জন্য তার থেকে বেশি নির্মল এক ভালোবাসার নিষ্ঠুর মৃত্যুর জন্য। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আজ কাঁদবেন। যতক্ষণ ইচ্ছা হয় কাঁদবেন। এই কান্নার কারণেই একসময় তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল।
ডাক্তার তরফদার উপলব্ধি করলেন দরজা দিয়ে কেউ একজন ভিতরে প্রবেশ করছে। বুঝলেন হামিদ। থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আছে। দুই হাতে শিকল। কোমরেও শিকল। এসে বসল টেবিলের উলটো পাশের চেয়ারে। তার দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার আমি চইলা আইছি, বড় ভালো লাগে আপনেরে, অনুমতি দিলে একটু বাঁশি বাজাই।
ডাক্তার তরফদার বললেন, কেন?
পৃথিবীতে আইজও তিনডা নির্মল ভালোবাসার নিষ্ঠুর মৃত্যু ঘটছে। কেন এত ভালোবাসা মইরা যাইতেছে জানি না স্যার! এই দুঃখে বাঁশি বাজাব, কষ্টের বাঁশি, করুণ বাঁশি।
ডাক্তার তরফদার টেনে টেনে বললেন, পৃথিবী ধীরে ধীরে কৃত্রিমতায় ভরে যাচ্ছে। কৃত্রিমতা আজ ভালোবাসায়ও। মানুষ আজ দুই-তিনজনের সাথে প্রেম করে, রাখে একাধিক গার্লফ্রেন্ড কিংবা বয়ফ্রেন্ড, উদ্যাপন করে ডিভোর্স, ব্রেকআপে কাটে কেক। কী নিষ্ঠুর! কী নির্মম! ভালোবাসা যেন সৃষ্টি হচ্ছে ঝরে যাওয়ার জন্য। আর এই ঝরে যাওয়া ভালোবাসাগুলোই দুঃখ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে চারদিকে। আসল ভালোবাসার চাইতে ঝরে যাওয়া ভালোবাসার সংখ্যাই এখন যেন বেশি। ফেসবুক, টুইটারে আজ আমাদের কত বন্ধু, কত সম্পর্ক, কত শুভাকাঙ্ক্ষী অথচ কয়টা সম্পর্ক আমাদের আত্মার, কয়টা প্রকৃত ভালোবাসার। ভালো না লাগলে মুহূর্তের মধ্যে কাউকে আমরা ব্লক করছি, কাউকে আনফ্রেন্ড করছি, কাউকে ডিলিট করছি। আহারে সম্পর্ক, আহারে বন্ধুত্ব, আহারে ভালোবাসা! কত সহজেই না হত্যা করছি, দূরে সরিয়ে দিচ্ছি, ঝরিয়ে দিচ্ছি! ভালোবাসা আজ মন জোছনার গহিনে মুক্ত নয়, বন্দি যেন চকচকে মুঠোফোনের অ্যাপসে। চিঠি লেখা আজ আটকে গেছে এসএমএস-এ, প্রিয়জনের মুখ দর্শন বন্দি ভিডিওকলে, জন্মদিনের শুভেচ্ছা কৃত্রিম অটো মেসেজে। মহামূল্যবান ভালোবাসা আজ আমাদের কাছে সত্যি যেন হয়ে উঠেছে সস্তা ইলেকট্রন প্রবাহের সাময়িক ঝলকানি। আমরা এ যুগের মানুষেরা অনুধাবন করতে পারছি না যে, ফেসবুক, টুইটার কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ভালোবাসাকে হত্যা করতে করতে আমরা বাস্তব জীবনেও আমাদের প্রকৃত ভালোবাসাকে সহজেই দূরে সরিয়ে দিতে কিংবা হত্যা করতে শিখে যাচ্ছি। আর এজন্যই প্রকৃত ভালোবাসায় ভরপুর সুন্দর পৃথিবী ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে ভালোবাসাহীন নির্মম নিষ্ঠুর পৃথিবীতে।
ডাক্তার তরফদারের কথার মাঝেই বাজতে শুরু করেছে বাঁশি। বাঁশিতে আজ বাজছে সেই করুণ সুর, প্রিয় ভালোবাসাকে হারানোর সুর
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
ঝাপসা চোখ আরো ঝাপসা হয়ে আসছে ডাক্তার তরফদারের। তার চোখের সামনে এখন মিষ্টি মোলায়েম একটা আলো। এই আলো মনের জোছনার আলো, সংক্ষেপে বলে ‘মন জোছনা’। বড় পূত-পবিত্র এই মন জোছনা। প্রত্যেক মানুষের মনে এই মন জোছনা থাকে। বয়ঃসন্ধিকালে মন জোছনায় সৃষ্টি হয় বিপরীত লিঙ্গের কারো প্রতিচ্ছবি। মন আর মস্তিষ্ক একত্রে সকল পছন্দ, ভালোলাগা আর স্বপ্নকে সমন্বয় করে সৃষ্টি করে এই প্রতিচ্ছবি। তারপর খুঁজে বেড়ায় প্রতিচ্ছবির মানুষটিকে। যদি পায় আর জীবনসঙ্গী করতে পারে তাহলেই জীবনটা হয় আনন্দের। এই আনন্দ সুখের আনন্দ, মন জোছনার আনন্দ। আর যদি সঙ্গীকে পেয়েও হারায়, তাহলে মন জোছনার এই জগৎটা হয় কষ্ট আর কান্নার। ডাক্তার তরফদার এখন যে মনটাকে দেখতে পাচ্ছেন সেই মনটা কষ্টের মন, সঙ্গী করতে পারেনি প্রথম ভালোবাসার মানুষটিকে। তাইতো এই মনের জোছনা আজ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে বিবর্ণ পৃথিবীতে, এ যে বড় কষ্টের ‘মন জোছনার কান্না!
*
আজ জেসমিনের বিয়ে। ডাক্তার তরফদার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। তার অবশ্য আসার ইচ্ছা ছিল না। তারপরও তিনি এসেছেন। কারণ জেহানের জন্য তাকে আসতে হয়েছে। জেহানকে তিনি চোখে চোখে রাখছেন। বেশ উফুল্ল জেহান। আগে তাকে কখনো এতটা উৎফুল্ল দেখেননি ডাক্তার তরফদার। এটাই তার আচরণের সন্দেহজনক দিক, যা অনুমান করেছিলেন তাই ঘটছে জেহানের ক্ষেত্রে। জেহানের আচরণের বৈপরীত্য বলছে আসলেই সে একজন একিউট অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডারের রোগী, কারণ জেসমিনের বিয়েতে তার কখনোই হাসিখুশি থাকার কথা নয়।
ডাক্তার তরফদার এক ফাঁকে জেহানের বাবা আবুল হাসেমের সাথে পরিচিত হলেন। পরিচয়ের মাঝেই আবুল হাসেম সাহেব বললেন, দেখলেন কী ভাগ্য মেয়েটার! এই বয়সে অন্যের সন্তান পেটে ধরেছিল। আর এখন কিনা বিয়ে করে চলে যাচ্ছে আমেরিকায়!
আপনি বোধহয় সবকিছু শোনেননি!
সবই শুনেছি। নুসরাত জাহান নামক এক ডাক্তারকে দিয়ে এমন নাটক তৈরি করেছে যা অবিশ্বাস্য। ঐ নাটক সবাই বিশ্বাস করলেও আমি করিনি। যাইহোক, আমি জেসমিনের মঙ্গল কামনা করি। সে সুস্থ থাকলে আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই।
আবুল হাসেমকে জেহানের ভালোবাসার কথা বলা উচিত কি উচিত না এ ব্যাপারে যথেষ্ট ভেবেছেন ডাক্তার তরফদার। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলবেন না। কারণ তিনি জানতেন আবুল হাসেম একজন ব্যবসায়ী, আধুনিক ধ্যান ধারণা তার মধ্যে কম। জেহান যে জেসমিনকে সত্যি পছন্দ করে এ ধরনের কথা তাকে বললে তিনি কখনো বিশ্বাস করতেন না। তার এই অবিশ্বাস জেহানের উপর আরো মানসিক চাপ তৈরি করত এবং সংসারে ভয়ানক বিপর্যয় টেনে আনত। জেহানের মনে তার বাবা-মায়ের প্রতিও ঘৃণার জন্ম হতো। তবে তিনি অনুভব করছেন এখন বলার সময় এসেছে।
ডাক্তার তরফদার এবার সরাসরি তাকালেন আবুল হাসেমের চোখে। বললেন, আপনি জানেন আমি জেসমিনের অসুস্থতার বিষয়টা নিয়ে কাজ করেছি কিছুদিন।
জি শুনেছি।
আমি আর একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই আপনার সাথে।
কী বিষয়?
আপনার ছেলে জেহান এখন বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। এই ফাঁকে জেহানের ঘরটা আমি সার্চ করতে চাই।
কী বলছেন! কেন?
আপনাদের মঙ্গলের জন্য।
আবুল হাসেম রেগে উঠে বললেন, আপনি কি পুলিশ নাকি যে আমার ছেলের ঘর সার্চ করবেন। সে কি কোনো অপরাধের সাথে জড়িত?
আমি আপনাকে বিনয়ের সাথে বলছি সার্চ করা অতীব জরুরি। কারণ আমার ধারণা আজ রাতে জেহান আত্মহত্যার চেষ্টা করবে। তাকে বাঁচানো আমার দায়িত্ব।
আমার ছেলে আত্মহত্যা করবে কেন! কী সুন্দর হাসিখুশি সে, দেখেছেন? গত কয়েক মাসে তাকে এরকম হাসিখুশি কখনো দেখিনি।
এটাই সমস্যা। আপনার সন্তান অসুস্থ। কেউ না জানলেও আমি জানি। আমার কথা বিশ্বাস করুন। তা না হলে বড় বিপদ হতে পারে আপনাদের। কারণটাও বলে দেই, জেহান পছন্দ করত জেসমিনকে। জেসমিনের বিয়ে হয়ে যাওয়ার বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। আমাকে বলেছে জেহান। যেহেতু এই বিয়ে সে ঠেকাতে পারছে না তাই হাসিখুশির ভান করছে, তার মনে ভয়ানক এক কষ্ট রয়েছে যা তাকে বিষণ্ণতার চরমে পৌঁছে দিয়েছে। বিষণ্ণতা যেন প্রকাশ না পায় এজন্য কৃত্রিম হাসিতে ভরিয়ে রেখেছে মুখটা। আজ রাতে এই বাড়ি থেকে জেসমিন চলে যাওয়ার পরই ভয়ানক কিছু একটা ঘটবে। কী ঘটবে আমি জানি না। তবে ভয়ানক ঐ ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করতে হবে আমাদের।
আবুল হাসেম চরম বিরক্তি প্রকাশ করে দূরে সরে গেলেন। এর মধ্যে খাওয়াদাওয়ার দ্বিতীয় পর্ব শেষ হয়েছে। ডাক্তার নুসরাতও এসেছেন আজ। চলে যাওয়ার সময় জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেন বললেন, ম্যাডাম, আপনার জন্যই আমার মেয়ে আজ নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে।
নুসরাত জাহান ডাক্তার তরফদারকে দেখিয়ে বললেন, আমার জন্য না, তরফদার স্যারের জন্যই বেঁচে গেছে জেসমিন। স্যারই প্রথমে ধারণা দেন বিষয়টি সম্পর্কে। কক্সবাজার থাকা অবস্থায়ই তিনি আমাকে তার সন্দেহের কথা জানান। তা না হলে আমিও ভুল করতাম হয়তো। যাইহোক, ভালো থাকবেন, জেসমিন সুস্থ থাকুক, সুন্দর থাকুক এই কামনা করছি।
নুসরাত জাহান চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন আবুল হাসেম। তাকে কেন যেন এখন খানিকটা ভীত দেখাচ্ছে। কাঁপা কণ্ঠে বললেন, স্যার চলুন, আমাদের বাড়ি চলুন।
ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন আবুল হাসেম তাকে স্যার সম্বোধন করে কথা বলছে এখন। তার মানে আসলেই তিনি ভয় পেয়েছেন। জেহানের ঘর সার্চ করে ড্রয়ারের মধ্যে একশটা ঘুমের ওষুধ পাওয়া গেল। পাওয়া গেল জেসমিনকে নিয়ে লেখা ডায়ারিটাও। ডায়ারির মধ্যে শেষ চিঠির শেষ লাইনে লেখা, ভালোবাসাহীন পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অর্থহীন, তাই আজ রাতে আমিও চলে যাব পৃথিবী ছেড়ে, ভালো থেকো প্রিয়তমা আমার, প্রিয় জেসমিন।
আবুল হাসেম বিস্মিত কণ্ঠে বললেন, এ আমি কী দেখছি!
আপনি তো সব নিজের চোখে দেখছেন। চিঠিটা আজ সকালে সে লিখেছে। তারিখ আছে নিচে।
বিশ্বাস করতে পারছি না আমি!
বিশ্বাস করা না-করা আপনার বিষয়।
আসলেই কি সব সত্য!
ডাক্তার তরফদার মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, ঘুমের ওষুধ খেয়েই আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেহান। তবে আত্মহত্যা তাকে করতে দেয়া যাবে না। আমি আজ জেহানকে সাথে করে নিয়ে যেতে চাই। কারণ আপনারা চেষ্টা করলেও তাকে শান্ত রাখতে পারবেন না। শেষে দরজা আটকে না আবার গলায় দড়ি দেয়। আজ রাতে তাকে শান্ত রাখতে হলে তার প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে গল্প করতে হবে। আপনাদের সাথে সে এ বিষয়ে কথা বলতে পারবে না, কারণ সে জানে না তার ভালোবাসার বিষয়টা আপনি এখন জানেন। তাছাড়া আপনার সাথে স্বাভাবিকও হতে পারবে না। আমার সাথে পারবে, পারবে করিম চাচার সাথে। আমরা তার কথা যতই শুনব, ততই তার কষ্ট লাঘব হবে এবং হালকা হবে মন। আজ রাতে তার মন হালকা করাই হবে মূল উদ্দেশ্য।
আবুল হাসেম হঠাৎই ডাক্তার তরফদারের হাত ধরে বললেন, স্যার, জেহান আমাদের একমাত্র সন্তান। তাকে বাঁচান স্যার, তাকে বাঁচান!
ডাক্তার তরফদার কিছু বললেন না, ধীর-পায়ে বাইরে বের হয়ে এলেন। তার এখন প্রধান কাজ জেহানকে সাথে নিয়ে যাওয়া। তার বিশ্বাস জেহান তার সাথে যাবে।
*
রাত তিনটা।
ডাক্তার তরফদার তার চেম্বারে চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। তার সামনে জেসমিনের ফাইল। সকল বিষয়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি ফাইলে লিখেছেন। জেসমিনের গর্ভে সন্তান হওয়ার বিষয়টিও লিখে শেষ করেছেন কিছুক্ষণ আগে। চেয়ার ছেড়ে উঠার আগে আবার একবার পড়বেন বলে মনস্থির করলেন এবং পড়তে শুরু করলেন।
জেসমিনের গর্ভে সন্তান হওয়ার বিষয়টি একটি বিরল ঘটনা। মানুষ সাধারণত একটি সন্তান জন্ম দেয়। তবে মাঝে মাঝে জন্ম হয় জমজ শিশুর। জমজ শিশু সৃষ্টির ক্ষেত্রে মায়ের পেটে দুটো জ্বণ থাকে। এই দুই প্রাণ একে অপরের ভাই কিংবা বোন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, একটি ঐণ ঠিকই বেড়ে উঠছে, কিন্তু অন্যটির বৃদ্ধি হচ্ছে না। যে জ্বণটি বড় হয় না, সেটি বৃদ্ধি পাওয়া জ্বণের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকে। বছরের পর বছর। বড় জ্বশটির জন্ম হলে বাবা-মা ধরে নেয় যে তাদের একটি সন্তান হয়েছে। তারা ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না তার সন্তানের শরীরে রয়েছে আর-একটি সুপ্ত সন্তান। এমনকি জন্ম নেয়া সন্তান বড় হওয়া শুরু করলে নিজেও বুঝতে পারে না যে তার শরীরে রয়েছে তারই এক ভাই কিংবা বোন। সুপ্ত ঐ ভাই কিংবা বোনটি জীবনের কোনো এক পর্যায়ে হঠাৎ বড় হতে শুরু করে, প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি সে সংগ্রহ করে জন্ম নেয়া ভাই কিংবা বোনের শরীর থেকে। শরীরের ভিতরে থাকা ঐ সুপ্ত ভ্রুণটি যত বড় হতে থাকে ততই আকার নিতে থাকে মানুষের। থাকে মাথা, হাত, পা, গজায় চুল, গঠিত হয় হাড়। শিশু বড় হওয়ার এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলে ফেটাস ইন ফেটু (Fetus in Fetu)। প্রতি পাঁচ লক্ষ শিশু জন্মগ্রহণের ক্ষেত্রে মাত্র একটি এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। সাধারণত প্রথম শিশুটির জনের তিন-চার বছর পর থেকে বিশ বছরের মধ্যে বড় হতে শুরু করে দ্বিতীয় জ্বণ। শতকরা আশি ভাগ ক্ষেত্রে এই সুপ্ত ভ্রণটি তলপেটে বা শরীরের ফাপা জায়গায় বড় হয়। শরীরের অন্য জায়গায় বড় হতে থাকলে টিউমার বলে ভুল হয়। যদি ইউটেরাস এর পাশে বড় হতে থাকে তাহলে মনে হবে সন্তান বড় হচ্ছে। জেসমিনের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তার সুপ্ত বোনটি বড় হয়েছে তার ইউটেরাসের উপরে। গর্ভে সন্তান বড় হওয়ার স্থান মায়ের ইউটেরাস। এজন্য আলট্রাসনোগ্রাম দেখে জেসমিনের বোনটিকে মাতৃগর্ভে বড় হওয়া মানব সন্তান বলেই মনে হয়েছে। আর জেসমিনের পেটের শিশুটি যে তারই বোন ছিল তা প্রমাণিত হয়েছে ডিএনএ টেস্টে। শিশুটির ডিএনএ’র সাথে মিলে গেছে নাজমুল হোসেন এবং তার স্ত্রীর ডিএনএ। তাদের ক্ষেত্রে ফেটাস ইন ফেটু তত্ত্বটি আরো সমর্থনযোগ্য কারণ নিলুফার ইয়াসমিনের পরের দুই সন্তান যমজ, যাদের নাম জয় এবং জনি। এতে বোঝা যায় তার শরীর যমজ সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম। দুঃখের বিষয় হলো এ ধরনের জ্বণ বা শিশুকে বাঁচানো সম্ভব হয় না এবং শরীরের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করে। জেসমিনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কক্সবাজারে যখন সে ডাক্তার হাডসনের অনুসন্ধান করছিল তখন তার শরীরের অভ্যন্তরে থাকা শিশুটি মারা যায়। ঢাকা এনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করা সম্ভব হয়েছে বলে বেঁচে গেছে জেসমিন নিজেও।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একজন ডাক্তার ধরতে পারল না বিষয়টি? আসলে হিউম্যানিটি ক্লিনিকে আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টগুলো একজন টেকনিশিয়ান দেখে স্বাক্ষর করত। ডাক্তার না পাওয়ায় এই অপকর্মটিকে প্রশ্রয় দিত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি রোগীর শারীরিক অবস্থা দেখে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টও লিখত, টেস্ট পর্যন্ত করত না। জেসমিনের যে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্ট এবং আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়েছিল সেগুলোর রেকর্ড পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে আসলে যথাযথভাবে পরীক্ষাগুলো করা হয়নি। ক্লিনিকটি মানুষকে চিকিৎসার মাধ্যমে সেবা প্রদানের পরিবর্তে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের দিকেই জোর দিয়েছিল বেশি। এমনকি নার্সকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে চিকিৎসা প্রদান করার প্রমাণও মিলেছে। এজন্য পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে ক্লিনিকটি। মামলা করেছে ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। এরকম শত শত ক্লিনিক আর প্যাথলজিক্যাল ল্যাব গড়ে উঠেছে দেশের আনাচে-কানাচে, যেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ করা বড় জরুরি।
কোনো নারী গর্ভবতী হলে তাকে দোষারোপ করা উচিত নয়। জেসমিনের মতো অবস্থা যদি গ্রাম-গঞ্জে কোনো নারীর হয় তাহলে তার কী অবস্থা হবে নিশ্চয় অনুমেয়। শারীরিক সমস্যা যেন সামাজিক সমস্যায় পরিণত না হয়। মনে রাখতে হবে সকল সমস্যাই সমাজের সমস্যা, তাই সমাজের মানুষের উচিত মনগড়া গুজব না ছড়িয়ে সমস্যার দ্রুত সমাধান করা।
জেসমিন সত্যি সৌভাগ্যবান। জটিল পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেয়েছে সে। সিজোফ্রেনিয়া, অবসেসিভ লাভ ডিসঅর্ডার, হ্যালুসিনেশন, ডিপ্রেশন এগুলো একেবারে তাকে কাবু করে ফেলেছিল। এজন্য সে চলে গিয়েছিল কল্পনার জগতে ডাক্তার হাডসনের কাছে। ঠিক ঐ সময় ফেটাস ইন ফেটুর (Fetus in Fetu)* কারণে তার পেটের শিশুটি বড় হতে শুরু করলে ব্যথা শুরু হয়। ডাক্তার হাডসনের সাথে শারীরিক সম্পর্কের স্বাপ্নিক কল্পনার প্রভাবে নিজেকে গর্ভবতী ভাবতে শুরু করে এবং মানসিকভাবে মেনেও নেয়। এজন্য অবচেতন মনের কল্পনায় ডাক্তার হাডসন এবং শিশুটি হয়ে উঠে তার ভালোলাগার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বকে মিথ্যা অনুভব করার চেষ্টা করলেও উপেক্ষা করতে পারেনি শিশুটির অস্তিত্বের কারণে। একই সময়ে ডাক্তার হাডসনের নাম শোনা এবং শিশুটির বড় হয়ে উঠার বিষয়টি হয়তো কাকতালীয় বিষয়। পৃথিবীতে এমন অনেক কাকতালীয় ঘটনা ঘটে যেগুলো আমরা বিশ্বাস করতে চাই না, আবার বিশ্বাস না করেও থাকতে পারি না। যাইহোক, জেসমিন সুস্থ হয়েছে এটাই বড় কথা। তার জীবন হোক আরো সুখের, আরো আনন্দের।
[* Fetus in Fetu সম্পর্কে অধিকতর জানতে চাইলে Fetus in Fetu লিখে Google কিংবা You Tube-এ সার্চ দিলে বিস্তারিত জানা যাবে।]
ডাক্তার তরফদার চেম্বার থেকে বের হয়ে এলেন। বাইরের বাগানে। বেঞ্চের উপর শুয়ে আছে জেহান। তার পাশে করিম চাচা। কথা বলে যাচ্ছে দুজন। জেসমিনের বিয়ে শেষে রাত সাড়ে বারোটার দিকে জেহানকে নিয়ে এসেছেন তিনি। কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন। কিন্তু জেহানের কথা বলার আগ্রহ করিম চাচার সাথে বেশি। তাই তিনি সরে এসেছেন।
কাছে আসতে জেহান উঠে বসে বলল, স্যার, করিম চাচাকে কত অনুরোধ করলাম, কিছু বলল না।
ডাক্তার তরফদার করিম চাচার দিকে তাকালেন।
জেহান আবার বলল, চাচা, একটা কথা বলি। কোনো কারণে যদি জেসমিনের স্বামী মারা যায়, তাহলে কিন্তু আমি জেসমিনকে বিয়ে করব।
করিম চাচা নিশ্চুপ।
জেহান এবার বলল, চাচা, শুধু একবার, একবার বলুন, একটা দিনের জন্য হলেও কি জেসমিন আমাকে ভালোবাসবে?
করিম চাচা মৃদু হেসে বলল, অন্যের স্ত্রী আপনেরে ভালোবাসবে ক্যামনে?
ডাক্তার তরফদার ইচ্ছে করেই কথা বললেন না, এসে বসলেন বারান্দায়। করিম চাচা আর জেহান কথা বলছে বলুক। কেন যেন করিম চাচার সাথে কথা বলতে জেহানের আগ্রহটা বেশি, লক্ষ করেছেন তিনি। অবশ্য দূরে বসলেও তাদের কথোপকথন ঠিকই তার কানে আসছে।
জেহান এবার জিজ্ঞেস করল, চাচা কিছু একটা বলুন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
বিড়বিড় করে করিম চাচা এবার বলল, আপনের উচিত কিছুক্ষণ ঘুমান।
আমার ঘুম আসছে না। আমি জেসমিনকে দেখতে চাই। কীভাবে দেখব? কিছু একটা বলুন চাচা। আপনিতো ভবিষ্যৎ বলতে পারেন।
করিম চাচা এবার জোরে শ্বাস নিল। তারপর বলল, আপনে আজ মুক্তোর মালাডা দিয়েছেন জেসমিন ম্যাডামরে, তাই না?
জেহান চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি জানলেন কীভাবে? ঐ সময় তো অন্য কেউ উপস্থিত ছিল না। পৃথিবীর কারো এই বিষয়টা জানার কথা না যে বিয়ে উপলক্ষ্যে তাকে আমি একটা মুক্তোর মালা উপহার দিয়েছি।
ঐ মালাডা জেসমিন ম্যাডাম খুব পছন্দ করছেন। তিনি দেশে ফিরে আসবেন কোনো এক মাসের প্রথম শুক্রবার। সময় হবে বিকেল, আছর আর মাগরিবের মাঝামাঝি। ঐ দিন তার গলায় আপনের মুক্তোর মালাডা থাকবে।
জেহান লাফ দিয়ে উঠে বলল, সত্যি চাচা!
জি, এখন চলেন ঘুমাইতে যাই, অনেক রাইত হইছে।
জেহান আর কোনো কথা বলল না। উঠে হাঁটতে শুরু করল। সত্যি সে ঘুমাবে, দীর্ঘক্ষণ ঘুমাবে। অনেক, অনেকদিন পর আজ কেন যেন তার ভালো লাগছে। কারণ মুক্তোর মালাটা পছন্দ করেছে জেসমিন। নেয়ার সময় সে অবশ্য কিছু বলেনি। কিন্তু করিম চাচা বলেছে। করিম চাচা কখনো মিথ্যা বলে না এবং করিম চাচার ভবিষ্যদ্বাণীও মিথ্যা হয় না। আবার সে দেখতে পাবে জেসমিনকে, তারই দেয়া মুক্তোর মালা গলায় দেয়া অবস্থায়, পৃথিবীতে এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কী আছে!
*
শুক্রবার সন্ধ্যা।
ডাক্তার তরফদার চট্টগ্রাম যাচ্ছেন। উদ্দেশ্য হাডসন হিলে একটা রাত কাটাবেন। তার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। ইরফান আলীর আমন্ত্রণে যাচ্ছেন তিনি। একটা রাত হাডসন হিলে কাটাবেন, পূর্ণিমার রাত। সাথে নাকি ওসি সাহেবও থাকবেন।
ওসি সাহেব জানিয়েছেন, ব্রিটিশ এম্বেসির সম্মতি মোতাবেক ডাক্তার হাডসনের কঙ্কাল হাডসন হিল আর কোকোনাট হিলের মাঝে মাটি দেয়া হয়েছে। কবরটির নাম রাখা হয়েছে ‘হাডসন গ্রেভ’। ডাক্তার হাডসনের কোনো সন্তান না থাকায় হাডমিন লকেটটিকে বাংলাদেশ সরকারকে দিয়ে দিয়েছে এম্বেসি কর্তৃপক্ষ। লকেটটিকে হাডসন হাউস অর্থাৎ গুহার মধ্যে একটা চারকোনা বুলেটপ্রুফ কাঁচের অবয়বের মধ্যে রাখা হয়েছে। পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে ইদানীং। হাডসন হিল, কোকোনাট হিল, রেড হাট, স্টোন গার্ডেন, এলিজা স্টোন, হেভেন হিল, হাডসন গ্রেভ, ওয়াটার গার্ডেন, হাডসন হাউস, গ্রিন হিল, হাডসন ভাস্কর্য, হাডমিন লকেট, লাভ স্টোন দেখার জন্য এখন শত শত পর্যটক আসে। পর্যটকদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ থাকে এলিজা স্টোনকে নিয়ে। তারা আর যাই করুক বা না করুক এলিজা স্টোনে উঠে একটা ছবি তুলবেই তুলবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এলিজা স্টোন কখনো পানিতে ডুবে না। এমনকি পরিপূর্ণ জোয়ারের সময়ও না। এ যেন অমর ভালোবাসার চিরায়ত নিদর্শন।
পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে হাডসন হিলে বাংলাদেশ ট্যুরিস্ট পুলিশ একটা দপ্তরও খুলেছে। বিদেশিদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। তিন শ মিটার দূরে একটা ফাইভ স্টার হোটেল তৈরি হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে হাডসন হিল বাংলাদেশের অন্যতম একটা টুরিস্ট স্পটে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে।
এয়ারপোর্টে প্রবেশের রাস্তায় হঠাৎ ডাক্তার তরফদারের মনে হলো পরিচিত কাউকে তিনি দেখলেন। গাড়ি থামিয়ে ভালোমতো তাকাতেই দেখলেন জেহান। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল জেহান। দূর থেকে ডাক দিতে কাছে এসে মিষ্টি করে হাসল। অবাক হয়ে বললেন, এখানে কী করছ তুমি!
স্যার আপনি জানেন কী করছিলাম।
মানে?
অপেক্ষা করছি জেসমিনের জন্য। মাসের প্রথম শুক্রবার আছর থেকে মাগরিব পর্যন্ত আমি এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করি। কোনো একদিন জেসমিন আসবে। আমার দেয়া মুক্তোর মালাটা গলায় পরে থাকবে স্যার।
ডাক্তার তরফদার কী বলবেন কিছু বুঝতে পারলেন না। তিনি জেহানকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বললেন, জেহান, যদি পারতাম তাহলে তোমার মনের সব কষ্ট আমি নিয়ে নিতাম। তোমার মন জোছনার কান্না আমার হৃদয়টাকে ভেঙে দিচ্ছে। যাও, বাড়ি যাও।
জেহান হাত দিয়ে চোখ মুছে বল, স্যার আজও জেসমিন আসেনি। তবে একদিন আসবে, কারণ করিম চাচা বলেছে। করিম চাচা কখনো মিথ্যা বলে না, করিম চাচার ভবিষ্যদ্বাণী কখনো মিথ্যা হয় না।
কথাগুলো বলতে বলতে জেহান চলে গেল, শেষ মুহূর্তে ডাক্তার তরফদার তার চোখের পানি দেখতে পেয়েছিলেন। এই কান্না মন জোছনার কান্না।
ডাক্তার তরফদার উপলব্ধি করছেন, জেহান এখন অনেকটাই সুস্থ। তার সবকিছুই স্বাভাবিক। শুধু মাসের প্রথম শুক্রবার বিকেল থেকে সন্ধ্যা। পর্যন্ত এয়ারপোর্টে আগমনী লাউঞ্জের সামনে থাকে সে। কারণ জেসমিন একদিন আসবে, সত্যিই আসবে জেহানের দেয়া মুক্তোর মালা পরে। করিম চাচা বলেছে। করিম চাচা মিথ্যা বলে না, করিম চাচার ভবিষ্যদ্বাণীও মিথ্যা হয় না। আর যেদিন সত্যি জেসমিন আসবে মনের আশা পূরণ হবে জেহানের। জেহান সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে এটা সত্য, জেহান বোধহয় আর কোনোদিন কাউকে ভালোবাসতে পারবে না। কারণ তার মনের সব ভালোবাসা শুধু একজনেরই জন্য, আর সে হলো জেসমিন। জেসমিন বড় অভাগা, তার জন্য রক্ষিত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভালোবাসার ভান্ডারের সন্ধান সে পায়নি। পৃথিবীতে খুব কম নারী কিংবা পুরুষ আছে যারা তাদের জন্য রক্ষিত সবচেয়ে বৃহৎ ভালোবাসার ভান্ডারকে খুঁজে পায়। অবশ্য এদিক দিয়ে সৌভাগ্যবতী ছিল এলিজা জেসমিন। বুকভরা ভালোবাসা পেয়েছিল ডাক্তার হাডসনের কাছ থেকে। তার মৃত্যুর পরও সেই ভালোবাসা আর আশা নিয়ে বেঁচে ছিলেন ডাক্তার হাডসন। কিন্তু ভালোবাসায় আর পূর্ণতা আসেনি। বড় অদ্ভুত এই পৃথিবী, পৃথিবীর বড় বড় ভালোবাসাগুলো কেন যেন পূর্ণতা পায় না। পূর্ণতা পায়নি রোমিও জুলিয়েট, শিরি ফরহাদ, লাইলী মজনুর ভালোবাসা, বিচ্ছেদই ছিল যেন চূড়ান্ত পরিণতি। তেমনি কোনোদিন পূর্ণতা পাবে না জেহান-জেসমিনের ভালোবাসাও।
ডাক্তার তরফদার আরো উপলব্ধি করলেন, পৃথিবীতে ভালোবাসার কমতি নেই, আবার ব্যক্তিজীবনে ভালোবাসার পূর্ণতাও যেন নেই। অপূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে অধিকাংশ মানুষ বেঁচে থাকে পরিপূর্ণ ভালোবাসার আশায়। অথচ মানুষ জানে না, পরিপূর্ণ ভালোবাসা বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই। কারণ ভালোবাসার ব্যাপ্তি সীমাহীন। একজনকে যত ভালোবাসা যায়, ভালোবাসা ততই সৃষ্টি হয়। আর এই ভালোবাসার সৃষ্টিটাই হলো আনন্দ আর ভালোলাগা। ভালোবাসার বিভাজন ভালোবাসায় পূর্ণতা আনে না, আনে শুধু শূন্যতা। তাই বিভাজন নয়, ভালোবাসা যেন চিরায়ত হয় প্রথম প্রেমের মানুষটির জন্য, তাহলেই ভালোবাসা হবে সর্বোচ্চ আনন্দের আর উপভোগের।
ডাক্তার তরফদার দ্রুত পা বাড়ালেন। তাকে যে হাডসন হিলে পৌঁছাতে প্লেন ধরতে হবে। যখন এয়ারপোর্টে প্রবেশের দরজার একেবারে কাছে তিনি, তখনই গানের সুর ভেসে এলো তার কানে,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
Leave a Reply