ডাক্তার তরফদার হাডসন হিল থেকে সরাসরি এসেছেন কক্সবাজার সদর থানায়। তিনি ডাক্তার হাডসনের শেষ পরিণতির দিকে মনোনিবেশ করতে চাচ্ছেন না। কিন্তু মন তাকে বারবার টেনে নিচ্ছে ডাক্তার হাডসনের দিকেই। তার কেন যেন মনে হচ্ছিল আজই তিনি উখিয়া থানার সাহায্য নিয়ে হাডসন হিলের উপরে উঠবেন, তারপর মাটি খুঁড়ে দেখবেন সত্যি ডাক্তার হাডসনের দেহাবশেষ ওখানে আছে কি না। উখিয়া থানায় যাওয়ার কারণ, হাডসন হিল এলাকাটা পড়েছে উখিয়া থানার মধ্যে। পরে অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফিরে এসেছেন কক্সবাজারে। এখন আছেন সদর থানায়।
ওসি সাহেবের নাম আনিসুর রহমান। শরীরটা তার বেশি শুকনা। তবে কাজেকর্মে তৎপর, প্রাথমিক কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন ডাক্তার তরফদার। রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর কক্ষের কথা বলতেই তিনি বললেন, আপনি কি ঐ রুমে থাকছেন স্যার?
হ্যাঁ।
আপনি কি নিজেই নিয়েছেন রুমটা, নাকি ওরা দিয়েছে?
আমি নিজেই নিয়েছি।
ঐ রুমটা তো হোটেল মালিকের ছেলের ব্যবহারের জন্য। কী যেন নাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে বাশার। বড় বদ ছেলে। নারী-মদ নিয়ে ফুর্তি করত ঐ রুমে। পরে আর কী, ধরা খেল, মামলা হলো, এখন জেলে।
কতদিন থাকবে জেলে?
বেশি দিন থাকবে বলে মনে হয় না। বাদীর সাথে আপস করে ফেলেছে শুনেছি। তবে আমরা চার্জশিট দিয়ে দিয়েছি।
বাদী আপস করল কেন?
হিসাবটা খুব সোজা স্যার। বাদী সুবিধার মেয়ে ছিল না। বুঝতেই পারছেন কী বলতে চাচ্ছি। সোজা কথায় কলগার্ল বা পতিতা। বাশার মাঝে মাঝেই ঐ রুমে কলগার্লদের নিয়ে যেত, আমোদ-ফুর্তি করত। ঐ মেয়ের সাথে পেমেন্ট নিয়ে গন্ডগোল হয়েছিল। ব্যস, মেয়ে দিয়েছে ধর্ষণের মামলা করে। তাতে নিজের অপকর্মে নিজেই ফেঁসে গেছে বাশার। শেষে আর কী করবে, মেয়ের সাথে টাকার বিনিময়ে সমঝোতায় এসেছে। সম্ভবত তাড়াতাড়ি জামিন পেয়ে যাবে। আর মেয়ে টাকা পেয়ে যদি কোর্টে সাক্ষী না দেয় কিংবা তার বুঝার ভুল হয়েছে বলে বক্তব্য দেয়, কোর্টের পক্ষে তখন শাস্তি দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বাশারের শাস্তি পাওয়া উচিত। কারণ তার মনের মধ্যে শুধু কুচিন্তা। ২২১ নম্বর রুমের দরজার দুই পাল্লার উপরের দিকে দুটো ঘোলা বা অস্বচ্ছ কাঁচ আছে দেখবেন। ডান পাশের কাঁচটা এমনভাবে লাগানো ছিল যে ধাক্কা দিলে নিঃশব্দে খুলে যায়। তখন যে কেউ ওখান দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খুলে ফেলতে পারবে। কী ভয়ংকর পরিকল্পনা, ভাবতে পারছেন? ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি নিজে ঐ কাঁচ স্থায়ীভাবে লাগানোর ব্যবস্থা করেছি। আসলে হোটেল ব্যবসার সাথে অনৈতিক ব্যবসা এমনভাবে জড়িয়ে গেছে যে একটা আর-একটা ছাড়া যেন চলে না।
এমনকি হতে পারে যে দরজার ঐ কাঁচ সরিয়ে ছিটকিনি খুলে আগেও সে কোনো অপকর্ম করেছে।
হতেই পারে। হয়তো আমাদের কাছে রিপোর্ট হয়নি। বাশার না করলেও হোটেলেও অন্য কেউ করতে পারে অপকর্ম।
আপনারা হোটেল বা করে দিচ্ছেন না কেন?
হোটেল বন্ধ তো সমাধান না স্যার। এক হোটেল বন্ধ হলে অন্য হোটেলে শুরু হবে এই অপকর্ম। তা না হলে ফ্ল্যাট বাড়ি ভাড়া করবে। আসলে এগুলোর একটা স্থায়ী সমাধান দরকার। একজনের টাকা আছে, সে খরচ করবে, অন্যজনের টাকা প্রয়োজন, সে সবকিছুর বিনিময়ে টাকা নেবে। সামাজিক চাহিদা এবং সরবরাহের এই হিসাবনিকাশ বন্ধ করা বড় কঠিন। বাশারকে গ্রেফতার করার পর আমরা রেইনবো রেইন হোটেল সিলগালা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কোর্টের অর্ডার নিয়ে সাত দিন পর আবার খুলেছে মালিক। তবে এখন মালিকপক্ষ অনেক সতর্ক। হোটেলে যেন আর কোনো অপকর্ম না ঘটে সে বিষয়ে সবসময় সজাগ থাকে তারা। আমরা সর্বত্র সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টাও করে যাচ্ছি।
ডাক্তার তরফদার ওসি সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে হোটেলে ফিরে এলেন। তারপর লম্বা একটা ঘুম দিলেন। হোটেলে সালাম ড্রাইভারের জন্যও একটা রুম রেখেছেন তিনি। সালামের সাথে বসে রাতের খাবার খেলেন। তারপর এলেন ২২১ নম্বর কক্ষে। পরীক্ষা করে দেখলেন সত্যি দরজার উপরের অংশ ঘোলা কাঁচের। ধাক্কা দিয়ে বুঝতে পারলেন সরানো সম্ভব না কাঁচটা, তবে আগে সম্ভব হতো। সেক্ষেত্রে হাত দিয়ে দরজা খোলা কঠিন হতো না কারো জন্য। রাতে যদি কোনো নারীকে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়, তাহলে এই ঘরে প্রবেশ করে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করা অসম্ভব কিছু নয়। জেসমিনের সাথে ঐরকম কিছু ঘটতে পারে। কারণ পরের দিন তার তলপেটে ব্যথা হয়েছিল। নাজমুল হোসেন জানিয়েছেন, কক্সবাজার ভ্রমণের সময়ই তলপেটে ব্যথা শুরু হয় জেসমিনের। সবকিছু কীভাবে যেন মিলে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষটা কে? হোটেল বয়, নাকি বাশার। বাশার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ এই কক্ষের সবকিছু তার নিজের হাতে করা। কক্ষটা আবার সে দোতলায় রেখেছে যেন প্রয়োজনে পিছনের বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে পালানো যায়। ভয়ংকর এই বিষয়টা প্রমাণের এখন একমাত্র উপায় সিসি ক্যামেরা। হোটেলের প্রবেশ পথ এবং করিডোরে সিসি ক্যামেরা আছে। এতদিন আগের ভিডিও ফুটেজ থাকার কথা নয়। তারপরও যদি থাকে, এই আশায় ডাক্তার তরফদার উদিমকে ডাকলেন। উদিম বলল, হোটেলের সব জায়গায় সিসি ক্যামেরা আছে স্যার। তবে…
তবে কী?
লাগানো হয়েছে মাত্র দুই মাস আগে। কিন্তু আপনি যে তারিখের কথা বলছেন সেটা তো ছয়-সাত মাস আগের।
হ্যাঁ।
ঐ সময় তো সিসি ক্যামেরা ছিল না স্যার!
ও আচ্ছা।
একটু থেমে ডাক্তার তরফদার আবার বললেন, এই কক্ষের বারান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। সত্যি সুন্দর। কিন্তু আমার মন যেন ভরছে না। আমি সমুদ্রের পাড়ে বসতে চাই। এত রাতে কি যাওয়া যাবে?
স্যার আপনি চাইলে আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারব। তবে…
আবার তবে কেন?
নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে। অবশ্য ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ শুরু করার পর থেকে ছিনতাই কমে গেছে। রাতে ওদের টহল পার্টি থাকে। যদিও পুলিশ কাউকে রাত দশটার পর বিচে থাকতে দেয় না, আমি অনুরোধ করলে থাকতে দেবে। ট্যুরিস্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর স্যার আমার পরিচিত।
তুমি তাই করো।
ঠিক আছে স্যার। আর কিছু লাগবে? কোনো খাবার বা ড্রিংকস!
তুমি ইচ্ছে করলে আমাকে গরম কফি দিতে পার। বহুদিন কফি খাই না। কফি বানানোর মেশিন আছে তোমাদের?
জি স্যার আছে। আপনি কি নিয়মিত কফি খান?
আগেই বলেছি বহুদিন ভালো কফি খাওয়া হয় না। আজ খাব। খেতে ইচ্ছে করছে। আসলে কি জানো, হঠাৎ হঠাৎ মন এমন কিছু পেতে চায় যেগুলো পাওয়া অনেক কষ্টের। মনের চাওয়াটা যদি বৈধ হয়, কষ্ট হলেও অর্থ খরচ করে মাঝে মাঝে এই চাওয়াটাকে পাওয়ায় রূপান্তরিত করতে হয়। এতে যে মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায় তা একেবারেই স্বর্গীয়।
বুঝতে পেরেছি স্যার।
উদিম চলে গেলে ডাক্তার তরফদার বারান্দায় এলেন। তারপর তাকালেন সমুদ্রের দিকে। তিনি অনুধাবন করছেন, এই বারান্দাটা অসম্ভব সুন্দর, অথচ সংলগ্ন কক্ষটাতেই ঘটেছে সবচেয়ে অসুন্দর ঘটনা। কক্ষটার দিকে ফিরে এবার তিনি বিড়বিড় করে বললেন, পৃথিবীতে সকল সুন্দরের মাঝে একটা অসুন্দর থাকে, একটা খুঁত থাকে, একটা কষ্ট থাকে। পরিপূর্ণ, নিখুঁত আর চিরস্থায়ী সুন্দর বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই।
*
দুপুর তিনটা।
জেহান চোখ বুজে পড়ে আছে বিছানায়। ভালো লাগছে না তার। আজ ছিল জেসমিনের জন্মদিন, অথচ জেসমিনের সাথে তার দেখা হয়নি। কী অবিশ্বাস্য! প্রত্যেক বছর সে জেসমিনের জন্মদিনে জেসমিনকে চকলেট দেয়। আজ পারল না। এজন্য খুব খারাপ লাগছে, একই সঙ্গে অস্থিরতা তাকে যেন পাগল করে ফেলছে সকাল থেকে। এই সবকিছুর জন্য দায়ী রাশেদ। রাশেদ ভয়াবহ গুজব ছড়াচ্ছে। সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে জেসমিনের সন্তানের বাবা হলো জেহান। যদিও কেউ বিশ্বাস করছে না, কিন্তু আলোচনা তো হচ্ছে সর্বত্র। আর প্রমাণস্বরূপ তার মানিব্যাগে থাকা জেসমিনের ছবির কথা তো বলছেই।
দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকাল জেহান। জেসমিন দাঁড়িয়ে আছে। হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠল সে। চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, আ…আ…আপু তুমি!
চারপাশে চোখ বুলাল জেসমিন। তারপর বলল, তোমাকে দেখতে এলাম।
আ…আমি তো কল্পনাও করতে পারছি না!
হ্যাঁ, অনেক দিন আগে এসেছিলাম তোমাদের বাড়িতে। তারপর আর আসা হয়নি।
বসো, বসো।
না, বসব না।
কেন?
আসলে বাড়িতে ভালো লাগছিল না। তাই বের হয়েছি। খালাম্মার সাথে কথা বলছিলাম এতক্ষণ। এখন চলে যাচ্ছি।
আমি চা দিতে বলব?
না, খালাম্মাও জিজ্ঞেস করেছিলেন, চা খাব না। ভাবলাম তোমার সাথে দেখা হয় না বেশ অনেকদিন। আজ না হয় দেখা করে যাই। তুমি আসো না কেন আমাদের বাড়িতে?
ইয়ে… মানে…তু…তুমি অসুস্থ।
তাতে কী? তুমি জানো আমি তোমাকে পছন্দ করি। সময় পেলে চলে আসবে। দুজনে গল্প করব।
জি আপু, অবশ্যই আসব।
আর… হ্যাঁ আপু।
আমি জানি, আমাকে নিয়ে তুমি অনেক ভাবো, অনেক চিন্তা করো। এত ভাবাভাবির দরকার নেই। আমি ভালো আছি। আমার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি ভালোমতো পড়াশুনা করো। আসি জেহান।
জেহানকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বের হয়ে গেল জেসমিন।
জেহানের খুব ইচ্ছে ছিল জেসমিনের সাথে আরো কিছুক্ষণ গল্প করার। কিন্তু পারল না। আসলে জেসমিন যে তার ঘরে আসবে কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। আজ জেসমিনকে বেশি সুন্দর লাগছিল, কারণটা কী সে জানে না। এজন্যই হয়তো তার কথা বলার আগ্রহটাও বেশি ছিল।
আবার খাটে এসে শুয়ে পড়ল জেহান। হালকা মাথা ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করল সে। ভাবল, কিছুক্ষণ এভাবে নিরিবিলি শুয়ে থাকবে, তাতে যদি মাথা ব্যথা কমে। হঠাৎই চুলে আলতো স্পর্শ অনুভব করল। চোখ খুলে দেখে তার মা বসে আছেন পাশে। জেহান চোখ খুলতে মরিয়ম বললেন, কী হয়েছে তোর?
জেহান খানিকটা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, না মা, কিছু না।
তাহলে এই অসময়ে শুয়ে আছিস যে!
জেহান ঘড়ি দেখল। সন্ধ্যা সাতটা বাজে। দুপুরে শোয়ার পর এত লম্বা ঘুম তার হয় না। আর জেসমিনের তার ঘরে আসার ব্যাপারটা যে ছিল স্বপ্ন এতক্ষণে যেন অনুধাবন করল সে।
কথা বলছিস না কেন?
জেহান উঠে বসে মাথা ঝাঁকি দিল। তারপর বলল, এই তো কথা বলছি মা।
তোর আঙুলের কী অবস্থা?
ব্যথা নেই এখন।
আর কখনো রাশেদের সামনে যাবি না। ছেলেটা বড় বজ্জাত।
ঠিক আছে মা, যাব না।
উঠে হাত-মুখ ধুয়ে নে। এই অসময়ে ঘুমানো ঠিক না। তোর নাস্তা কি পাঠিয়ে দেব এখানে?
হ্যাঁ মা, দাও।
মরিয়ম উঠে চলে গেলেন। জেহান হাত-মুখ ধুয়ে এসে দেখে নাস্তা রেখে গেছে তার মা। কিন্তু তার নাস্তা খেতে ইচ্ছে করছে না। মনটা বড় অস্থির অস্থির লাগছে। তার ঘরের জানালা দিয়ে জেসমিনদের বাড়ি দেখা যায়। সে জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল জেসমিনদের বাড়ির দিকে। কিন্তু না, দেখা গেল না জেসমিনকে। এখন একেবারেই ঘর থেকে বের হয় না জেসমিন। বড় একা হয়ে গেছে সে, কেউ নেই তার পাশে। ভাবতেই বুকটা হুহু করে উঠল জেহানের। তার খুব ইচ্ছে করছে জেসমিনের জন্য কিছু একটা করার। কিন্তু কী করবে? আর কীভাবেই বা করবে? রাশেদ তার সর্বনাশ করছে। তাকে আর জেসমিনকে নিয়ে কুৎসা রটাচ্ছে। নিশ্চয় এই কথা খালাম্মা মানে জেসমিনের মায়ের কানে গেছে। সেক্ষেত্রে তিনি কী ভেবেছেন, তা আর কল্পনা করতে চাচ্ছে না জেহান।
জেহান মুক্তোর মালাটা বের করল। এখনো দিতে পারেনি। জেসমিনকে। ঠিক করল আজ সে মালাটা জেসমিনকে দিবেই দিবে, যা থাকে কপালে। এরকম একটা ভাবনা থেকে জেসমিনদের বাড়িতে এলো না সে। কিন্তু পাওয়া গেল না জেসমিনকে। ডাক্তারের কাছে গেছে, জানাল জয় আর জনি।
জেহান আবার ফিরে এলো তার ঘরে। তারপর চেয়ারে বসে টেনে নিল ডায়ারিটা। লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন,
আজ তোমার জন্মদিন। অথচ আমি তোমাকে শুভেচ্ছা জানাতে পারলাম না। মুক্তোর মালাটাও দেয়া হলো না তোমাকে। জানি না, এই জীবনে আর দিতে পারব কি না। আসলে পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত, উপহার দিতে চাইলেও পছন্দের মানুষকে অনেক সময় উপহার দেয়া যায় না। তোমাকে আসলেই কিছু দিতে পারলাম না। না দিতে পারলাম উপহার, না দিতে পারলাম মন। একটা সত্য কি জানো, প্রিয়জনকে উপহার দিতে না পারার ব্যর্থতাটা ভয়ংকর কষ্টের। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় শেষ পর্যন্ত আমি ব্যর্থ হব না। একদিন না একদিন তুমি আমার ভালোবাসা বুঝবে এবং ফিরে আসবে আমার কাছে। আমি শুধু তোমাকে চাই, শুধুই তোমাকে। এজন্যই আমি অপেক্ষা করব বছরের পর বছর। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে আমার কষ্ট হলেও ধৈর্যহারা হবো না। প্রিয়জনের জন্য অপেক্ষা একই সাথে কষ্টের এবং আনন্দের। আনন্দের এ কারণে যে এই অপেক্ষার মধ্যে থাকে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির স্বপ্ন। ডাক্তার তরফদার স্যারের একটা কথা কি জানো, তিনি বলেছিলেন, ধারাবাহিক সুখ প্রকৃত সুখ উপলব্ধির তৃপ্তি দেয় না, মাঝে মাঝে দুঃখ থাকতে হয়, দুঃখের পর সুখটা হয় বড় তৃপ্তির আর পরিপূর্ণ উপভোগের। এজন্য পৃথিবীটা সুখ আর দুঃখে ভরা। সুখ-দুঃখের মালাটা একবার সুখ একবার দুঃখ, এভাবেই গাথা। তবে আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। আমার মালাটা শুধু দুঃখেরই। অবশ্য যখন সুখের সময়টা আসবে তখন তোমাকে নিয়ে আমি সুখী হব, লম্বা সময়ের জন্য। আমাদের সুখটা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সুখ। আর যদি কোনো কারণে তোমাকে না পাই, মনে রেখো, তোমাকে হারানোর সাথে সাথে আমিও হারিয়ে যাব। এটাই সত্য যে, তুমি যেদিন হারাবে আমার কাছ থেকে, আমি সেদিন হারাব এই পৃথিবী থেকে সুখে থেকো, শান্তিতে থেকো, হে প্রিয়তমা। শুভ জন্মদিন।
তোমারই
জেহান
সাধারণত চিঠি শেষ করার পর জেহান নিজের মধ্যে প্রশান্তি অনুভব করে। কিন্তু আজ করছে না। তার অস্থিরতা বাড়ছে তো বাড়ছেই। একটা পর্যায়ে সে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। ঘরের দরজা বন্ধ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
*
ডাক্তার তরফদার ঘুম থেকে উঠলেন সকাল সাড়ে নয়টায়। সাধারণত এতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ঘুমান না। আজ ঘুমিয়েছেন, কারণ সারারাত তিনি ইন্টারনেটে প্রেগন্যান্সির উপর পড়াশুনা করেছেন। যদিও তিনি ডাক্তার, গাইনির আধুনিক বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি অতটা অবহিত নন। তবে এটা সত্য, এক রাতের পড়াশুনায় বহুকিছু জানতে এবং শিখতে পেরেছেন তিনি। শিক্ষার কোনো শেষ নেই, শিক্ষার কোনো বয়স নেই এই সত্যটা যেন আবারও উপলব্ধি করলেন।
সকালে নাস্তা শেষ করে ফোন করলেন জেসমিনের বাবা নাজমুল হোসেনকে। ফোন ধরতেই জানতে চাইলেন জেসমিনের অবস্থা। নাজমুল হোসেন বললেন, ভালো না স্যার, সারাদিন ঘরের মধ্যে বসে থাকে আর কী যেন ভাবে।
ডাক্তার কী বলল?
হিউম্যানিটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তার পাইনি। নার্স দেখেছে। বলল, গর্ভের বাচ্চা যথেষ্ট বড় হয়েছে। নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করতে হবে। আর সিজার করে বের করতে হবে বাচ্চাকে। কিন্তু…
কিন্তু কী?
আমি সিজার করাতে চাচ্ছি না। সিজার করলে পেটে একটা দাগ থেকে যাবে, সারাজীবন ঐ দাগটা কষ্ট দেবে আমার মেয়েকে।
সন্তান যদি জন্ম নেয় সন্তান তো সামনেই থাকবে, দাগ কী কষ্ট দেবে?
আসলে স্যার আমার কথা বলার মতো অবস্থা নেই। এমন যদি হতো সন্তানটা জন্ম না হতো তাহলে সবচেয়ে খুশি হতাম বোধহয়। আর ঐ সন্তানের বাবা কে, তাও তত বের করতে পারলাম না। কী ভয়ংকর! এর মধ্যে আমার এক বন্ধু আমেরিকা থাকে, প্রস্তাব পাঠিয়েছে তার ছেলের জন্য আমার মেয়েকে বউ হিসেবে নিতে চায়। কীভাবে যেন জেসমিনের আগের একটা ছবি জোগাড় করেছে। খুব পছন্দ করেছে জেসমিনকে, এজন্য ফোন করেছে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের! তাকে কি বলা যাবে যে আমার মেয়ে গর্ভবতী, তার পেটে সন্তান আছে!
একটু ধৈর্য ধরুন। আশা করি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে। আমার কী মনে হয় জানেন?
কী মনে হয়?
এমন একটা সমাধান আপনারা পাবেন যা আপনাদের সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেবে। আগামীকাল জেসমিনকে ঢাকা নিয়ে যাবেন। আমি একজন ডাক্তারের ঠিকানা দিচ্ছি, নাম নুসরাত জাহান। বাংলাদেশের অন্যতম সেরা গাইনির ডাক্তার এবং আধুনিক ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন। সে কিছু পরীক্ষা করবে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব আমরা।
ঠিক আছে স্যার।
জেসমিন কি এখন কারো সাথেই কথা বলে না?
ছোট দুই ভাইয়ের সাথে কথা বলে মাঝে মাধ্যে। আর ওর মাকে একেবারেই সহ্য করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজের ভয় করে জেসমিনের সামনে যেতে। মানসিকভাবে একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছি।
আপনার দুই ছেলের নাম যেন কী?
জয় আর জনি।
চমৎকার। ওরা তো জমজ। তাই না?
হ্যাঁ।
ওদেরকে বলবেন যেন জেমসিনের সাথেই বেশি সময় কাটায়।
আচ্ছা।
আমি এখন তাহলে রাখছি। আপনি যেভাবেই পারেন ডাক্তার নুসরাত জাহানের কাছে নিয়ে যাবেন জেসমিনকে। গিয়ে আমার কথা বলবেন। সিরিয়াল লাগবে না। আমি আপনার মোবাইলে ঠিকানা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ভালো থাকবেন। আর আমি সবকিছু বলে দিয়েছি নুসরাত জাহানকে।
ডাক্তার তরফদার অতঃপর এলেন উখিয়া থানায়। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে সবকিছু খুলে বললেন ওসি সাহেবকে। ওসি সাহেব বললেন, ডাক্তার হাডসনের বিষয়টা তো অনেক পুরোনো ব্যাপার।
থানায় কি কোনো ডকুমেন্ট আছে?
না। সবকিছু তো পাকিস্তান আমলের। ঐ সময়ের কোনো ডকুমেন্ট সংরক্ষিত নেই।
আমি চাচ্ছি ডাক্তার হাডসনের মৃতদেহটা কবর থেকে উত্তোলনের জন্য।
বিষয়টা রহস্যময়। আমার নিজেরও আগ্রহের সৃষ্টি হচ্ছে। তবে ঘটনার সত্যতা কতটুকু, এ বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে।
আমার সন্দেহ নেই। ইরফান আলী আজ বয়োবৃদ্ধ, এই বয়সে এসে তার মিথ্যা তথ্য উপস্থাপনের কোনো যুক্তি দেখছি না। আমি কাজটা একাই করতে পারতাম, হয়তো মাটি খুঁড়তে দুইজন দিনমজুর লাগত। কিন্তু যেহেতু বিষয়টি হত্যা, বিদেশি ব্যক্তি এবং পাহাড়ি এলাকায় সংগঠিত, এজন্য আপনার সহায়তা চাচ্ছি। জিজ্ঞেস করতে পারেন আমার উদ্দেশ্য কী? সোজা কথায় বলব একটি সত্যকে উদ্ঘাটন করতে চাচ্ছি এবং সাধারণ মানুষকে সত্যটা জানাতে চাচ্ছি।
ওসি সাহেব এতক্ষণ সামনে ঝুঁকে ছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসে বললেন, ঠিক আছে স্যার, পুলিশ আপনার সাথে থাকবে। আপনি কখন কাজ শুরু করতে চান?
আজকে, এখনই।
আমি বলে দিচ্ছি আমার একটি টিমকে। আপনার সাথে থাকবে, আর আমিও আসব কিছুক্ষণ পরে। স্থানীয় একজন ভিডিও এবং ক্যামেরাম্যানকে বলে দিচ্ছি। তারা সবকিছু ভিডিও করবে। যেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর, এজন্য চাচ্ছি সবকিছুর ভিডিও হোক।
আমিও চাই। ধন্যবাদ আপনাকে।
ডাক্তার তরফদার দশ মিনিটের মাথায় পাঁচজন পুলিশের একটা দল নিয়ে রওনা দিলেন হাডসন হিলের উদ্দেশে। দেড় ঘণ্টা পর পৌঁছালেন হাডসন হিলে। আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন ইরফান আলীকে। এক নাতিকে নিয়ে তিনি এসেছেন। বসে আছেন একটা গাছের নিচে। ডাক্তার তরফদার দুজন দিনমজুরকে নিয়ে উঠতে শুরু করলেন পাহাড়ের উপর। পথটা সত্যি ঝুঁকিপূর্ণ। তার শরীর যেন পেরে উঠছে না। তারপরও তিনি উঠার চেষ্টা করছেন। তাকে সাহায্য করছে পুলিশের দলটি। মানুষের চলাচল এই পথে যে কম বোঝা যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে কিছু কিছু টুরিস্ট উপরে উঠে মাত্র। একটা জায়গায় পথটা বেশ খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে। আসলে এটা খাড়া একটা পাথর। একজন কনস্টেবল তাকে টান দিয়ে উপরে উঠিয়ে নিল। অন্যরাও উঠল একইভাবে। ভিডিওম্যান কামরুল বেশ সাহসী। সে একেবারে ঢালে ঝুঁকে, শুয়ে, বসে ভিডিও করছে। ভাবখানা এমন যেন সে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের জন্য একটা ডকুমেন্টারি বানাচ্ছে।
অবশেষে হাডসন হিলের উপরে উঠতে পারল সবাই। ছোট-বড় নানা আকারের পাথর রয়েছে উপরে। পশ্চিম পাশে দেখা গেল লাল, সাদা, ধূসর, খয়েরি, হলুদ রঙের অনেক পাথর। কেন এই জায়গাটাকে স্টোন গার্ডেন বলা হয় অনুধাবন করলেন ডাক্তার তরফদার। স্টোন গার্ডেনের ঠিক মাঝে লাল পাথরের একটা চত্বর। চারপাশে তিনটা খুঁটিও আছে। একটা ভেঙে গেছে। সম্ভবত এই খুঁটির উপরে ছাউনি তৈরি করা ছিল, অনুমান করলেন ডাক্তার তরফদার। তখন দেখতে দূর থেকে একটা কুঁড়েঘরের মতো মনে হবে। কুঁড়েঘরের ইংরেজি হাট (Hut)। এজন্য এই জায়গাটাকে বলা হতো রেড হাট, অর্থাৎ ভালোবাসার কুটির। লাল বড় পাথরটাকে বলা হতো লাভ স্টোন। আজ নিচ থেকে উপরে উঠার আগে ইরফান আলী রেড স্টোন আর রেড হাটের কথা বলেছেন তাকে।
পাহাড়ের উপরের অংশটা খুব বড় নয়, তিন হাজার স্কয়ার ফুটের মতো হবে। প্রায় সম্পূর্ণ চূড়াটাই পাথরে ঢাকা। শতবর্ষী সেগুন গাছ আছে তিনটা। ডাক্তার তরফদার একেবারে দক্ষিণে চলে এলেন। একটা জায়গায় তার মনে হলো কোনো পাথর নেই। ইরফান আলীর কথা মিলে যাচ্ছে। দিনমজুরদের ইশারা করতেই মাটি খুঁড়তে শুরু করল তারা। হাত তিনেক খোঁড়ার পরই পাওয়া গেল মাঝারি আকৃতির কয়েকটি পাথর। পাথরগুলো সরানোর পর দেখা গেল মানব হাড়ের অবশেষ। মুহূর্তেই খাড়া হয়ে গেল ডাক্তার তরফদারের শরীরের সবকটি লোম। ওসি সাহেব কিছুক্ষণ আগে এসেছেন, তারও একই অবস্থা। অকল্পনীয় একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে!
প্রায় পয়ষট্টি বছর আগে ডাক্তার হাডসনের দেহ মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল। এখন অবশিষ্ট আছে কঙ্কালের কিয়দংশ। খুলিটা কোনোরকম বোঝা যায়। একটা লকেট পাওয়া গেল। সোনার তৈরি। ডাক্তার তরফদার হাতে নিয়ে বললেন, এই লকেটটার কথাই সম্ভবত বলেছিলেন ইরফান আলী।
লকেটের দুটো অংশ। জোরে টান দিতে খুলে গেল। নিচের দিকে লেখা ‘হাডমিন’। লেখার উপরে দুপাশে দুটো ছবি, হলুদ হয়ে গেছে অনেকটা, তবে চেহারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ডাক্তার তরফদার আর দেরি করলেন না, দ্রুত নিচে নেমে এলেন। তার সাথে ওসি সাহেবও এলেন। ইরফান আলীকে দেখানোর সাথে সাথে তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো। আবেগঘন কণ্ঠে বললেন, হ্যাঁ, এ…এই… তো আমাদের সবার প্রিয় ডাক্তার হাডসন আর তার স্ত্রী এলিজা।
*
জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন কোকোনাট হিলে পাশাপাশি দুটো পাথরে বসে আছে। হালকা বাতাসে চুল উড়ছে জেসমিনের। মন কিছুটা হলেও বিষণ্ণ তার। ডাক্তার হাডসন বললেন, কী হয়েছে তোমার জেসমিন?
আমি চূড়ান্তভাবে মনস্থির করেছি যে তোমার এখানে চলে আসব।
আমিও চাই তুমি চলে আসো। আগেও বলেছি এ কথা।
চিকিৎসার নামে আজ আমাকে ঢাকা নিয়ে গিয়েছিল বাবা। ডাক্তারের নাম নুসরাত জাহান। বেশ কিছু টেস্টও করাল। আমি যেতে চাইনি। অনেকটা জোর করে নিয়ে গেছে। আমার ধারণা আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে ডাক্তার নুসরাত।
এমন মনে হওয়ার কারণ কী?
আমি জানি না। অবচেতন মন বলছে। আসলে কেউই চাচ্ছে না বাচ্চাটার জন্ম হোক, শুধু তুমি ছাড়া।
আমাদের সন্তান অবশ্যই পৃথিবীর আলো দেখবে।
তোমার হাতে আমাদের সন্তান প্রথম পৃথিবীর আলো দেখুক, আমি এরকমই চাই। এজন্যই আমি চলে আসব তোমার কাছে।
ডাক্তার হাডসন জেসমিনের মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। তবে এখানে এলে তোমার কিন্তু কিছুটা কষ্ট হবে।
তোমাকে তো পাব!
মৃদু হাসলেন ডাক্তার হাডসন। বললেন, আমি এ কথাটাই শুনতে চাচ্ছিলাম তোমার কাছ থেকে। কখন রওনা দেবে?
শেষ রাতে। প্রথমে বাড়ি থেকে যাব সায়েদাবাদ। সেখান থেকে বাসে করে আসব কক্সবাজার।
আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।
সমস্যা হবে না। মনে জোর আছে আমার। কক্সবাজার এসে একটা গাড়ি নিয়ে সরাসরি এখানে চলে আসব।
ঠিক আছে। কাপড়চোপড় গুছিয়েছ?
হ্যাঁ। বেশি কিছু আনব না।
অল্প হলেই হবে।
জেসমিন এবার ডাক্তার হাডসনের চোখের দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমাদের সন্তানের একটা নাম ঠিক করবে বলেছিলাম।
তুমি আসো, দুজনে একসাথে করব।
তুমিই করো।
না, দুজনে মিলে করব। ছেলে না মেয়ে হবে এখনো জানি না। তোমার কী ইচ্ছে, ছেলে চাও, নাকি মেয়ে?
ছেলে-মেয়ে একজন হলেই হলো। তবে কোনোভাবেই আমি আমার প্রথম সন্তানকে হারাতে চাই না। এজন্যই তোমার কাছে চলে আসা। আমার আশেপাশে সত্যি সবাই চাচ্ছে যেন আমার সন্তান জন্মগ্রহণ না করে। আমি বাবা-মায়ের কথাও শুনতে পেয়েছি। মা বলছিল, আমাকে নিয়ে দুরে কোথাও চলে যাবে। তারপর সন্তান জন্ম হলে কাউকে দিয়ে আবার ফিরে আসবে এখানে।
তাতে লাভ কী?
লাভ-লোকসান আমি জানি না। আমি শুধু চাই তোমার আমার সন্তানকে জন্ম দিতে।
এই আশা অবশ্যই পূরণ হবে। চলো এগোই।
দুজনে হাঁটতে শুরু করল। রাতটা আজ পূর্ণিমার রাত। চারপাশে ভরা জোছনার আলো। সাগরের তীরে আছড়ে পড়া ঢেউগুলো চিকচিক করছে। সেই ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে জেসমিন বলল, আমার একটা ইচ্ছা আছে।
কী ইচ্ছা?
এখানে আসার পর আমি তোমার সাথে সাগরে গোসল করতে চাই।
কিন্তু আমি সাগরকে বড় ভয় পাই।
কেন?
সাগর বড় ভয়ংকর! মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষকে টেনে নিয়ে যায়।
আমি তোমার হাত ধরে থাকব। তোমার কাছ থেকে কেউ আমাকে নিয়ে যেতে পারবে না।
কথাগুলো বলে হাডসনের বাহুতে মাথা রেখে ধীর-পায়ে হাঁটতে লাগল জেসমিন। মৃদু হাসলেন ডাক্তার হাডসন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, তুমি যেহেতু চাইছ অবশ্যই তোমাকে নিয়ে ঐ সাগরে গোসল করব আমি।
রাতটা হতে হবে পূর্ণিমার রাত।
তাই হবে।
জেসমিন এবার চোখ তুলে উপরের দিকে তাকাল। তবে ডাক্তার হাডসনকে সে আর দেখতে পেল না। প্রথমে খানিকটা চমকে উঠলেও পরে বুঝল সে ঘুম থেকে উঠেছে। আছে তাদেরই বাড়িতে। ঘড়ি দেখল। রাত সাড়ে চারটা বাজে। এরকমই একটা সময় তার উঠার ইচ্ছা ছিল। হাত-মুখ ধুয়ে বোরকা পরে নিল। বোরকার নিচে লাল শাড়ি। একটা ব্যাগ ঘুমানোর আগেই গুছিয়ে রেখেছিল। বাসা থেকে যখন সে বের হলো তখনো ফজরের আজান দেয়নি। কেন যেন নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো তার। বাবা-মা, ছোট ভাইদের ফেলে রেখে যেতে বড় কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই তার। নিজের সন্তানকে যে তার বাঁচাতেই হবে।
কেরানীগঞ্জ ব্যবসা কেন্দ্র। সারারাত এখানে গাড়ি চলাচল করে। একটা সিএনজি নিয়ে নিল জেসমিন। সমস্ত জীবনের সঞ্চয় এগারো হাজার টাকা তার সাথে আছে। এই টাকা দিয়ে সে কক্সবাজার চলে যেতে পারবে বলে তার বিশ্বাস। হাতে কিছু টাকাও থাকবে ওখানে পৌঁছানোর পর। একবার পৌঁছে গেলে আর সমস্যা হবে না। ডাক্তার হাডসন তার দায়িত্ব নেবেন। তখন দুজনে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারবে। এরকম একটা ভাবনা তার মনে শক্তি জোগাচ্ছে।
সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডে এসে নয় শ টাকা দিয়ে ঢাকা-কক্সবাজার সরাসরি বাসের একটা টিকিট কাটল। জানালার পাশে বসতে এক চিলতে রোদ এসে পড়ল তার কোলে। দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে, পৃথিবীটাকে যেন আজ তার কাছে মনে হচ্ছে বড় বেশি সুন্দর।
গাড়ি নারায়ণগঞ্জ পার হতে দুপাশে শুরু হলো ফসলের ক্ষেত। সিটে হেলান দিয়ে বাইরে তাকিয়ে প্রথমে সে দেখতে লাগল ক্ষেতগুলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আর ক্ষেত দেখা গেল না, শুধু সাগর। ঢেউগুলো এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। কী সুন্দর! আর সেই ঢেউয়ের মাঝে হাত ধরাধরি করে ছুটছে সে আর ডাক্তার হাডসন। দুজনেই খুবই উচ্ছ্বসিত আর দারুণ আনন্দিত। মনে হচ্ছে পৃথিবীর সকল সুখ বুঝি তাদের, শুধুই তাদের!
*
ডাক্তার তরফদার চট্টগ্রামে এসেছিলেন। কথা বলেছেন একজন বয়স্ক পাদ্রীর সাথে। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন তিনি। যখন ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন তখনই ফোন পেলেন ডাক্তার নুসরাত জাহানের। ফোন ধরতে নুসরাত জাহান বললেন, আপনার অনুমানই সত্য স্যার।
ধন্যবাদ নুসরাত তোমাকে। এখন কী করতে হবে?
সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে দেখলাম দেরি করা ঠিক হবে না। অপারেশন করে বাচ্চাটাকে জেসমিনের পেট থেকে বের করে আনতে হবে। আপনি চাইলে আমি অপারেশন করে দিতে পারি।
তুমিই করো। ভালো হবে। জেসমিনের বাবা-মা কি জানে?
না, জানে না।
তুমি তাদেরকে জানিয়ে দাও। আমি কথা বলব এখনই।
ঠিক আছে স্যার।
ডাক্তার তরফদার ফোন কেটে দিয়ে যখন নাজমুল হোসেনকে ফোন করতে যাবেন তখন নাজমুল হোসেনেরই ফোন পেলেন। উৎকণ্ঠিত গলায় তিনি বললেন, স্যার একটা দুঃসংবাদ আছে।
কী দুঃসংবাদ?
জেসমিনকে সকাল থেকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না!
কী বলছেন আপনি!
জি স্যার। টেবিলে শুধু একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছে, সেখানে লেখা, আমাকে ক্ষমা করো, আমি চলে যাচ্ছি আমার নীল চোখের ছায়ার কাছে।
ডাক্তার তরফদার চিন্তিত হয়ে পড়লেন। বললেন, আপনি আত্মীয়স্বজন, ওর বান্ধবী আর পরিচিতজনের বাসায় খোঁজার চেষ্টার করুন। পুলিশকেও জানাতে পারেন। আর আমি কোনো তথ্য পেলে আপনাকে জানাব।
আমার ভালো লাগছে না। মাথা ঠিক নেই। জেসমিনের মা সকালে দাঁত লেগে পড়ে গেছে। এখন ঠিকমতো কথা বলছে না।
আশা করছি সব ঠিক হয়ে যাবে। বিপদ আসে চলে যাওয়ার জন্য। আতঙ্কিত না হয়ে সাহসিকতা এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবেলা করাই দ্রুত বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্যতম উপায়। আশা করছি অতি শীঘ্র আপনাদের সকল বিপদ কেটে যাবে।
কথা শেষ করে ডাক্তার তরফদার ভাবতে শুরু করলেন। নীল চোখের ছায়া মানে কী বোঝাতে চাচ্ছে জেসমিন? নিশ্চয় স্বপ্নে যে ছায়া আসে তার কথা। এরকম ভাবতে ভাবতে তিনি সালামকে বললেন গাড়ি ঘোরানোর জন্য। তারপর ফোন হাতে তুলে নিলেন। তাকে এখন কয়েকটা ফোন করতে হবে।
গাড়ি যখন উলটো দিকে ছুটতে শুরু করেছে তখন রিং বেজে উঠল ফোনে। স্ক্রিনে নাম উঠছে হামিদের বোন হুশনার। হুশনা সাধারণত ফোন করে না। ফোন ধরতে হুশনা বলল, স্যার, হামিদ ভাইজান বড় পাগলামি করতেছে।
কী হয়েছে বলো।
চিৎকার কইরা হাত-পায়ের ছিকল খুইলা ফেলবার চাইতেছে।
কতক্ষণ হলো এমন করছে?
সারাদিন।
ডালিম দিয়েছিলে?
জি স্যার। কিন্তু খায় নাই।
মুখে কোনো কথা কি বলছে?
‘শিরিন শিরিন’ করতেছে স্যার। শিকল ধইরা টানাটানি করায় হাতের কব্জিতে রক্ত বাইর হইয়া আইছে। আমার আসলেই ভয় করতেছে।
ভয় পেও না। আমার বিশ্বাস কিছুক্ষণ পর সুস্থ হয়ে উঠবে। আমি ঢাকার বাইরে আছি। তা না হলে দেখতে আসতাম হামিদকে। যত তাড়াতাড়ি পারি আমি আসব।
স্যার আমার মনটা খারাপ।
চিন্তা করো না। আল্লাহর কাছে দোয়া করো।
ঠিক আছ স্যার।
ডাক্তার তরফদার একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বিকেল হয়ে গেছে। জেসমিন কোথায় আছে তিনি জানেন না। জেসমিনের ফোন নম্বরটাও তার কাছে নেই। থাকলে ফোন করতেন। একবার ভাবলেন ফোন নম্বরটা চেয়ে নেবেন নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে। পরে সিদ্ধান্ত পালটালেন। কারণ ধারণা করছেন, জেসমিন ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
এবার তিনি চোখ বুজলেন। গাড়ি ছুটে চলেছে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ তার কানে গানের সুর ভেসে এলো,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
*
জেসমিন কক্সবাজার এসে পৌঁছাল সন্ধ্যা সাতটায়। এখন তাকে যেতে হবে হাডসন হিলে। মেরিনড্রাইভে বড় বাস না চলায় একটা বেবিট্যাক্সি ভাড়া করবে বলে ঠিক করল সে। কিন্তু অধিকাংশ বেবিট্যাক্সিই যেতে চাচ্ছে না। কক্সবাজারের মধ্যেই চলাফেরা করে বেবিট্যাক্সিগুলো। কয়েকজনকে বলার পর অবশেষে মাঝবয়সি একজন বেবিট্যাক্সিওয়ালাকে পেল। ড্রাইভারের গোঁফটা বেশি চওড়া, দেখলে কেমন যেন ভয় ভয় করে। কিন্তু কোনো উপায় নেই, একটা বেবিট্যাক্সি তাকে নিতেই হবে।
বেবিট্যাক্সিতে উঠার সময় খসখসে গলায় ড্রাইভার বলল, এই রাইতের বেলায় আপনে হাডসন হিলে যাইবেন ক্যান?
কাজ আছে।
জায়গা নির্জন। রাইতে একা যাওয়ার জন্য ভালা না। তাছাড়া আপনে মাইয়া মানুষ, বিপদে পড়বার পারেন।
না পড়ব না। ওখানে আমার পরিচিত ব্যক্তি রয়েছে।
নাম কী তার?
ডাক্তার হাডসন।
কী বলতেছেন এইসব! উনি তো বহুত আগে মইরা গেছে।
না মারা যাননি। উনি বেঁচে আছেন।
আপনের মাথা কি ঠিক আছে? কবে জানি শুনলাম যে তার হাড়গোড়ও পাওয়া গেছে পাহাড়ের উপর।
মৃদু হাসল জেসমিন। তারপর বলল, আপনে ভুল শুনেছেন। উনি বেঁচে আছেন। গত রাতেও তার সাথে আমার কথা হয়েছে।
জানি না কী কইতেছেন আপনে! যাইহোক, আমার দরকার পৌঁছায় দেওয়া, আমি আপনেরে পৌঁছায় দিতেছি। তয় আবারো কইতেছি যে, জায়গাডা নির্জন, এত রাইতে যাওয়া ঠিক হবে না।
কথা বলতে বলতে বেবিট্যাক্সির গতি বাড়িয়ে দিল ড্রাইভার। জেসমিনের এখন বেশ ভালো লাগছে। এতক্ষণ গভীর উৎকণ্ঠা ছিল তার মধ্যে। হঠাৎই যেন সেই উৎকণ্ঠা হারিয়ে গিয়ে ফুরফুরে একটা অনুভূতি জায়গা করে নিয়েছে মনে। শারীরিক দুর্বলতাও ছিল মারাত্মক। ঢাকা থেকে আসার পথে গাড়ি দুইবার রেস্টুরেন্টে থামলেও সে খেতে পারেনি। প্রথমবার বমি বমি ভাব ছিল। দ্বিতীয়বার তলপেটে ব্যথা হচ্ছিল। এখনো হচ্ছে ব্যথাটা, তবে সহনীয়। জেসমিন অনুধাবন করছে, আর মাত্র কিছুটা পথ, তারপরই সে পৌঁছে যাবে তার প্রিয়, অতি প্রিয় মানুষটির কাছে।
একপাশে সমুদ্র আর অন্যপাশে পাহাড়। মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে। মেরিন ড্রাইভ। খুব সুন্দর লাগছে চারপাশটা। আকাশের চাঁদটাও একেবারে যেন পরিপূর্ণ আজ। পূর্ণিমা কি না সে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে জোছনা ছড়িয়ে আছে চারদিকে। আজ রাতটা যেন শুধুই জোছনা আর ভালোবাসার রাত।
রাস্তা একেবারে জনমানবশূন্য। উলটো দিক থেকে মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ি আসছে। মাইক্রোবাসই বেশি, অধিকাংশই ফিরছে টেকনাফ থেকে, বুঝতে পারছে জেসমিন। আর সে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষের কাছে, যার কাছে থাকবে জীবনের বাকি সময়টা, বেঁচে থাকবে যার ভালোবাসার ছায়াতলে। এরকম একটা মুহূর্তের জন্যই ছিল তার প্রতীক্ষা, দীর্ঘ প্রতীক্ষা। সেই স্বর্গীয় শুভক্ষণের দোরগোড়ায় এখন সে। ভাবতেই নিজের মধ্যে অন্যরকম শিহরন অনুভব করছে।
হাডসন হিলের পাশে থামলে ভাড়া মিটিয়ে দিল জেসমিন। হাতে ব্যাগ তুলে নিতে ড্রাইভার বলল, আমি কি আপনেরে সাহায্য করব ম্যাডাম?
না, দরকার নেই।
ও আইচ্ছা।
কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু ট্যাক্সি টান দিল না ড্রাইভার। জেসমিন অবাক হয়ে বলল, চলে যাচ্ছেন না কেন?
ড্রাইভার বড় বড় চোখে বলল, ইয়ে মানে ভাবতেছি এই নির্জন স্থানে আপনে আবার কোনো বিপদে না পড়েন। শ্যাষে ঐ বিপদ আবার আমার ঘাড়ে আইসা না পড়ে।
না পড়বে না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। মিষ্টি হেসে বলল জেসমিন।
ড্রাইভার আর অপেক্ষা করল না। বেবিট্যাক্সি টান দিল।
জেসমিনের নিজেকে হঠাৎই বড় নিঃসঙ্গ মনে হতে লাগল। ডানে বামে একটা গাড়িও এখন দেখা যাচ্ছে না, নেই কোনো মানুষও। সবুজ প্রকৃতিতে যেন শুধুই শূন্যতা। তবে এটা সত্য, আছে জোছনার পূর্ণতা।
জেসমিন উলটো ঘুরল। হাডসন হিলকে সে চিনতে পেরেছে। এখন সরু একটা পথ বরাবর দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে পৌঁছে যাবে সমুদ্রের তীরে। বামে থাকবে প্রিয় হাডসন হিল।
ব্যাগ টানতে গিয়ে জেসমিন অনুভব করল, বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। অতিরিক্ত কষ্টে হালকা ঘামতে শুরু করেছে। আগে যেদিন এসেছিল পথটাকে তার এতটা দীর্ঘ মনে হয়নি আজ যতটা মনে হচ্ছে। পা দুটো যেন ভেঙে আসছে। চোখের সামনে হঠাৎ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে আসছে সবকিছু। তবে আশার কথা, পথ আর বেশি নেই।
সমুদ্রের পানি চোখে পড়তে শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল জেসমিনের, শক্তিও ফিরে পেল। দ্রুত হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগল হাডসন হিলের সামনে। তাকাল ডানে বামে। কোথাও দেখা যাচ্ছে না ডাক্তার হাডসনকে। খানিকটা অবাকই হলো। তার আশা ছিল ডাক্তার হাডসন রাস্তা থেকে তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। এখানেও নেই ডাক্তার হাড়সন। উজ্জ্বল জোছনা থাকায় অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। শুধু দেখা যাচ্ছে না কাক্ষিত ডাক্তার হাডসনকে।
হাতের ব্যাগটা নিচে বালুর উপর রাখল জেসমিন। ঘেমে ভিজে গেছে শরীর, সৃষ্টি হয়েছে পানিশূন্যতার। ব্যাগে একটা বোতলে পানি ছিল। মুখে দিতে কিছুটা ভালো লাগল। কিন্তু মনের শূন্যতাটা যেন বাড়তেই থাকল। ধীর-পায়ে এবার সে এগিয়ে যেতে থাকল হাডসন হাউসের দিকে। বারবার। ডানে-বামে তাকাচ্ছে যদি হঠাৎ ডাক্তার হাডসনকে দেখা যায়। কিন্তু তার মনের আশা পূরণ হলো না। হাডসন হাউসের মধ্যে আলোর তীব্রতা একেবারে কম। তারপরও দেখা যাচ্ছে এক মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত। না নেই, কোথাও ডাক্তার হাডসন নেই। এবার বেশ ভীত হয়ে উঠল সে। ডাক্তার হাডসন থাকবেন না কেন? জেসমিনের ইচ্ছা হলো ‘হাডসন হাডসন বলে ডেকে উঠে। কিন্তু পরক্ষণে বাদ দিল চিন্তাটা। সে এতদিন ডাক্তার হাডসনকে কী বলে সম্বোধন করেছে ঠিক মনে করতে পারল না। মাথাটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, বাড়ছে পেটের ব্যথাটাও। এটা ভালো লক্ষণ না। ব্যাগে ওষুধ আছে, কিন্তু তার খেতে ইচ্ছে করছে না। সে অনুধাবন করল, ডাক্তার হাডসনের সাক্ষাৎ না পাওয়া পর্যন্ত স্থির হবে না মন।
জেসমিন বাইরে বের হয়ে এলো। তারপর উপরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল, আমি এসেছি, তুমি কোথায়, তুমি কোথায়?
চারদিকে কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই।
আমি এসেছি, তোমার কাছে, প্লিজ বের হয়ে এসো।
আগের মতোই নিশ্চুপ চারপাশটা। শুধু তীরে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
জেসমিন অনুমান করল, হয়তো ডাক্তার হাডসন শহরে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবেন। কিন্তু মন যে মানছে না। তার আজ শহরে যাওয়ার কথা না। কারণ তিনি জানেন যে সে আসবে। তাহলে কোথায় ডাক্তার হাডসন?
জেসমিন এবার কোকোনাট হিলের উদ্দেশে রওনা দিল। অর্ধেক পথ আসতে পায়ের একটা স্যান্ডেল ছিঁড়ে গেল তার। বাধ্য হয়ে দুটো স্যান্ডেলই খুলে ফেলতে হলো পা থেকে। বালির গভীরতা বেশি হওয়ায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে বেশ। একসময় অবশ্য সে এসে পৌঁছাল কোকোনাট হিলের সামনে। না, এখানেও নেই ডাক্তার হাডসন। তারপরও নিশ্চিত হতে আগের মতোই জোরে বলতে থাকল, আমি এসেছি, আমি জেসমিন এসেছি তোমার কাছে, তুমি কোথায়?
কোনো উত্তর নেই।
জেসমিন এবার নাম ধরেই ডাক দিল। ডাক্তার হাডসন, তুমি কোথায়? তুমি কোথায়?
শুধু ঢেউয়ের শব্দ কানে আসছে তার।
ডাক্তার হাডসন, ডাক্তার হাডসন!
না, কোনো সাড়াশব্দ নেই।
হতাশ হয়ে বালুর উপরই বসে পড়ল জেসমিন। তার এখন বেশ ভয় ভয় করছে। শরীরটাও কেমন যেন কেঁপে কেঁপে উঠছে। আগে তার শরীর কখনো এতটা কেঁপে উঠেনি। এই প্রথম।
কতক্ষণ সে বালুর মধ্যে বসে ছিল বলতে পারবে না। একসময় আবার উঠে দাঁড়াল। কিন্তু শরীরের শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে আসছে। তীব্র একটা অভিমান আর কষ্ট দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে তার বুকটাকে। ডাক্তার হাডসন তার সাথে প্রতারণা করেছে, ভয়ংকর প্রতারণা! তার পেটে ডাক্তার হাডসনের সন্তান, অথচ ডাক্তার হাডসন নেই, কোথাও নেই। কীভাবে সম্ভব!
আবার সে আসতে শুরু করল হাডসন হাউসের দিকে। অর্ধেক পথ আসার পর আর পারল না। পড়ে গেল নিচে। শরীরে অতিরিক্ত গরম লাগায় খুলে ফেলল বোরকাটা। তারপর উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। শেষে চার হাত-পায়ে ভর করে এগোতে থাকল হাডসন হাউসের দিকে। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তারপরও এগোচ্ছে। একসময় ঠিকই ভিতরে প্রবেশ করতে পারল। সাদা পাথরের উপর শুয়ে পড়ল কাত হয়ে। ক্লান্তিতে ধড়ফড় করছে বুক। পিপাসা পেয়েছে প্রচণ্ড। পাশেই ওয়াটার গার্ডেনে পানি জমে আছে, কিন্তু তার যাওয়ার শক্তি নেই। চোখ দুটো শুধু হাডসনের মূর্তির দিকে। দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে জেসমিনের। কিন্তু পারছে না। কারণ কথা বলার শক্তিও যেন নেই শরীরে। একইসাথে যোগ হয়েছে তৃষ্ণা, ভয়ংকর তৃষ্ণা। শেষে সিদ্ধান্ত নিল ওয়াটার গার্ডেনের কাছে যাবে। কিন্তু চেষ্টা করেও শরীর নাড়াতে পারছে না। তীব্র ব্যথা, বিশেষ করে তলপেটে। এরকম ব্যথা তার আগে কখনো ওঠেনি, এই প্রথম।
জেসমিন অনুধাবন করল তার মৃত্যু আসন্ন। কারণ এখানে এই হাডসন হিলে কেউ আসবে না তাকে সাহায্য করতে। আর এ সবকিছুর জন্য দায়ী ডাক্তার হাডসন। সে যে প্রতারণার শিকার বুঝতে পারছে এখন। কিন্তু কিছুই করার নেই ডাক্তার হাডসনকে ঘৃণা করা ছাড়া।
চোখের সামনে সবকিছু আবছা হয়ে আসতে শুরু করেছে আগে থেকেই। সময় যত যাচ্ছে দৃষ্টিশক্তি ততই ঝাপসা হয়ে আসছে। তাকিয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে এখন। কিন্তু সে তাকিয়ে থাকতে চায়, বাঁচতে চায় এ পৃথিবীতে। অথচ তাকে বাঁচানোর মতো কেউ নেই।
ঝাপসা দৃষ্টিতে হঠাই কাউকে যেন আসতে দেখল জেসমিন। বুঝতে পারল সবই দৃষ্টিভ্রম। মৃত্যুর আগে নাকি মানুষ অনেকের আত্মা দেখতে পায়। সেও ঐরকম কারো আত্মা দেখছে বলে অনুমান করল। তবে যখন তার সামনে হাঁটুগেড়ে বসে তার মুখে পানি দিল, তখন বুঝতে পারল তার অনুমান মিথ্যা ছিল। সত্যি তার পাশে একজন মানুষ এসে বসেছে, উনি আর কেউ নন, ডাক্তার তরফদার।
অ্যাম্বুলেন্স আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। ছিলেন ডাক্তারও। জেসমিনকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে উখিয়া থানার ওসিকে ধন্যবাদ দিলেন ডাক্তার তরফদার। ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন স্যার? ফোন পেয়ে আমি শুধু আপনার কথামতো কাজ করেছি। আপনার পরামর্শ অনুসারে আমার দশজন পুলিশ সদস্যকে আশেপাশের পাহাড়ে আর গাছের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তারা নজর রাখছিল জেসমিনের উপর।
ডাক্তার তরফদার উপরে-নিচে মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, এই নজর রাখাটাই প্রয়োজন ছিল। কারণ আগেই যদি জেসমিনকে আমরা আটকে দিতাম তাহলে সে ভাবত সত্যি ডাক্তার হাডসনের কাছ থেকে জোর করে তাকে আমরা আলাদা করে রাখছি। আসলেই যে ডাক্তার হাডসন জীবিত নেই, এখন সে বুঝতে পেরেছে। তাকে এই বিষয়টা বুঝতে দেয়ার উপায় বের করাই ছিল আমার চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য।
আপনার কথাগুলো বড় রহস্যময় স্যার। তবে আমি সত্যি রোমাঞ্চিত হই।
আসলে মানুষের মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াই তো! সত্যি কথা বলতে কি জানেন, পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চকর আর রহস্যময় জায়গা হলো মানুষের মন। যাইহোক, ডাক্তার হাড়সনের কঙ্কালের কী অবস্থা?
ব্রিটিশ এম্বেসিকে জানানো হয়েছে। তাদের একটা প্রতিনিধি দল আসবে। তারা সিদ্ধান্ত নেবে কী করা হবে তার দেহাবশেষ।
বড় কষ্ট হয় ডাক্তার হাডসনের জন্য!
আমারও।
আসলে কি জানেন, পৃথিবীতে ভাগ্য বলে একটা কথা আছে। এই ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। ভাগ্য মূলত সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। মহাবিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী ইচ্ছা হলো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। মানুষ অনেককিছু পরিবর্তন করতে পারলেও পারে না সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছাকে পরিবর্তন করতে। আসি, ভালো থাকবেন।
ডাক্তার তরফদার হাঁটতে শুরু করলেন। ওসি সাহেব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার তরফদারের দিকে। তিনি জীবনে বহু অদ্ভুত মানুষ দেখেছেন, কিন্তু ডাক্তার তরফদারের মতো অদ্ভুত মানুষ কখনো দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ডাক্তার তরফদার নামক মানুষটির পুরোটাই রহস্যে ঘেরা এবং পৃথিবীতে তিনি অদ্বিতীয়।
*
ডাক্তার তরফদার তার চেম্বারে বসে আছেন। তার সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে শিরিন। ডাক্তার তরফদার বললেন, আমি জানতাম চিঠি পেলে তুমি আসবে।
স্যার আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।
কেন?
জানি না স্যার।
তোমার পরিবার কি জানে তুমি এখানে এসেছ?
না স্যার, সিলেটে আপনার চিঠি পাওয়ার পর আমি সুযোগ খুঁজছিলাম। কিন্তু পাচ্ছিলাম না। পরে একটা বিয়ের দাওয়াত পেলাম ঢাকায়। পরিবারের সবাই এসেছি। রাতে অনুষ্ঠান। কিছু জিনিস কিনব বলে বাসা থেকে বেরিয়েছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারব। চার-পাঁচ ঘণ্টার মতো সময় আছে। আমি শুধু একবার, একবার ওকে দেখতে চাই স্যার।
বড় কষ্ট হবে তোমার।
তারপরও একবার আমি ওকে দেখতে চাই। অন্তত নিজেকে সান্তনা দিতে পারব।
তুমি কি এখনই যেতে চাও?
জি স্যার। কিন্তু কীভাবে যাব? আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে।
আমিও যাব। কিন্তু তোমার হাতে ওটা কী?
একটা ব্যাগ।
কী জন্য? স্যার পরে বলব।
ডাক্তার তরফদার ড্রাইভার সালামকে আসতে বললেন। তারপর রওনা দিলেন মানিকগঞ্জের উদ্দেশে। পথে জানতে পারলেন শিরিনের দুই সন্তান আছে। তার স্বামী-শ্বশুরকুল অনেক বড়লোক। সিলেটের ধনাঢ্য পরিবারগুলোর মধ্যে তাদের পরিবার একটি। তার নিজের টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই, স্বামী যথেষ্ট উদার মানুষ।
হামিদদের বাড়িতে এসে গাড়ি থেকে নামল শিরিন। তারপর ডাক্তার তরফদারের পিছন পিছন আসতে লাগল। ডাক্তার তরফদার হামিদের ছোট বোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন শিরিনের। শিরিন অবশ্য কোনো কথা বলল না। ব্যাগটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকল ডাক্তার তরফদারের পিছন পিছন। হামিদের ঘরে প্রবেশ করে একেবারে স্থির হয়ে গেল সে। হামিদ মাটিতে শুয়ে ছিল। ডাক্তার তরফদার ডাক দিলেন, হামিদ।
হামিদ ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল।
হামিদ!
চোখ দুটো কুঁচকে গেল হামিদের এবার।
কাকে নিয়ে এসেছি দেখতে পাচ্ছি?
শিকল দিয়ে বাঁধা হামিদের সমস্ত শরীর হঠাৎই কাঁপতে শুরু করল। ঠোঁট দুটো যেন বেশি জোরে কাঁপছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু বলতে চাচ্ছে সে। কিন্তু বলতে পারছে না। একদৃষ্টিতে শুধু দেখছে শিরিনকে। শিরিনের চোখে তখন পানি, পানি হামিদের চোখেও।
হামিদ উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেও পারল না। শরীর বড় দুর্বল তার। চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসার চেষ্টা করল। কিন্তু খুব বেশিদূর আসতে পারল না। শিকলে টান পড়ল।
শিরিন এবার কাঁপা হাতে ব্যাগের মধ্যে থেকে বড় একটা ডালিম বের করল। আগে থেকেই কাটা ছিল ডালিমটা। ভিতরে থেকে কয়েকটা কোয়া বের করে অশ্রুসিক্ত চোখে এগিয়ে যেতে শুরু করল হামিদের দিকে। হুশনা এসে টেনে ধরতে চেষ্টা করল শিরিনকে। শিরিন ঝাঁকি দিয়ে সরিয়ে নিল নিজের হাতটা। তারপর হামিদের একেবারে সামনে গিয়ে বসল। হামিদ তখন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে শিরিনের দিকে, তার চোখে অশ্রু বন্যা।
একটা একটা করে কোয়া বের করছে শিরিন আর মুখে তুলে দিচ্ছে। হামিদের। হামিদ সেই কোয়াগুলো চিবোচ্ছে। একবারের জন্যও চোখ ফিরাচ্ছে না। শিরিন কোয়া দিচ্ছে আর হামিদ খাচ্ছে। চোখে আগের মতোই অশ্রু। অবিশ্বাস্য এক দৃশ্য, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, তি সুন্দর আর স্বর্গীয় দৃশ্যটা যেন দেখছেন এখন!
ডালিমটা শেষ করতে প্রায় দশ মিনিটের মতো সময় লাগল। তারপর নিজের আঁচল দিয়ে হামিদের চোখের পানি মুছে দিল শিরিন। এতক্ষণে একটা কথাও বলেনি দুজন। একসময় উঠে দাঁড়াল সে। হামিদ তাকিয়ে আছে তো আছেই, একেবারে শিশুর মতো তার দৃষ্টি। দুচোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে নিচে। শিরিনও নিজের আবেগকে আটকে রাখতে পারছে না। বারবার ভিজে উঠছে চোখ। শেষ মুহূর্তে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলে ডান দিকে মাথা কাত করল হামিদ যেন সে তাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দিল। তারপর আর দাঁড়াল না শিরিন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে একেবারে উঠোনের মাঝখানে চলে এলো। হুশনা তখন তার সামনে। ভেজাকণ্ঠে বলল, হুশনা, বুইন আমার, মাফ করে দিও আমারে। এই ব্যাগে এক কোটি টাকা আছে। পারলে চিকিৎসা করিয়ে তোমার ভাইয়ের।
তারপর নিজের দুই হাতে থাকা চারটি স্বর্ণের চুরি খুলে হাতে পরিয়ে দিল হুশনার। বলল, বড় বোন হিসেবে আমি তোমাকে দিলাম, চারটি চুরিতে আটভরি স্বর্ণ আছে। হ…হয়তো আর দেখা হবে কি না জানি না, ত…তবে মনে থাকবে তোমাকে। তোমার জন্য আজও আমার ভালোবাসা বেঁচে আছে এই পৃথিবীতে, বড় কৃতজ্ঞ আমি তোমার কাছে। আ… আ…আসি রে হুশনা!
কথাগুলো বলে মুখে আঁচল চেপে গাড়িতে উঠল শিরিন।
হুশনা ডাক্তার তরফদারের কাছে এসে বলল, স্যার, আমি কী করব ভাইজানরে নিয়া?
ডাক্তার তরফদার আবার ঢুকলেন হামিদের ঘরে। হামিদ শুয়ে পড়েছে মাটিতে। তার হাতে বাঁশি। ডাক্তার তরফদার বেশ কয়েকবার তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হামিদ কোনো কথা বলল না। একসময় সে চোখ বুজল। তার মুখের কোনে এক চিলতে তৃপ্তির হাসি। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, হামিদকে এখন বিরক্ত করা ঠিক হবে না। বাইরে এসে হুশনাকে বললেন, আমি সাত দিনের মধ্যে আবার কোথাও হামিদকে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেব।
ডাক্তার তরফদার গাড়িতে উঠতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শিরিন। ভাঙা গলায় বলল, স্যার, আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা পূর্ণতা পেল না কেন?
ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, ‘মানুষের জীবনে অন্যতম বড় আনন্দ আর ভালোলাগা হলো প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা। তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, এই প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসার অধিকাংশই পূর্ণতা পায় না, কেন যেন ঝরে যায় অকালে।
ডাক্তার তরফদারের কথা শেষ না হতেই চলতে শুরু করল গাড়ি। দূর থেকে তখন ভেসে আসছে বাঁশির সুর, হামিদের বাঁশি,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়’।
ডাক্তার তরফদার অনুভব করলেন আজ অনেক অনেকদিন পর হামিদ সুন্দর বাঁশি বাজাচ্ছে। আজকের বাঁশির সুর যেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সুর, আগে কখনো এত সুন্দর সুর সে বাঁশিতে তুলতে পারেনি। আর তার পাশে, বসে থাকা শিরিন মুখে আঁচল চেপে কাঁদছে, হুহু করে কাঁদছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, শিরিনকে তিনি থামানোর চেষ্টা করবেন না, কারণ সে মন থেকে কাঁদছে। মন থেকে আসা কান্না প্রিয়জনের ভালোবাসা কিংবা প্রিয় কিছু হারানোর কান্না, এই কান্নার উপর মানুষের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, চাইলেও কেউ থামিয়ে রাখতে পারে না এই কান্নাকে।
*
Leave a Reply