সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা।
নিলুফার বসে আছেন বারান্দায়। তার সামনে কুতুব ফকির। গলা থেকে পা পর্যন্ত কালো একটা পোশাক পরা। চুল-দাড়ি অনেক লম্বা। বয়স সম্পর্কে অনুমান করা কঠিন। পঞ্চাশও হতে পারে, ষাটের বেশিও হতে পারে। তাকে দেখে কেমন যেন ভয় ভয় করছে নিলুফারের। ইচ্ছে হচ্ছে বলেন, যেন বাড়ি থেকে চলে যায়। কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। কারণ তাকে নিয়ে এসেছে তারই জোবেদা খালা। জোবেদা খালার যখন সন্তান হচ্ছিল না তখন নাকি এই কুতুব ফকির তাকে পড়া পানি খাইয়ে আর ঝাড়ফুক দিয়ে দোয়া করে বলেছিল, “যা তোর সন্তান হবে। ঐ দোয়া পাওয়ার এক মাসের মাথায় গর্ভবতী হন জোবেদা খালা। সেই থেকে তার ভক্ত জোবেদা খালা। জোবেদা খালা তার আত্মীয়, শারীরিকভাবে লম্বা-চওড়া। কথাবার্তায় সবসময় কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। এজন্য ঠিক নিষেধ করতে পারছেন না তাকে। বাড়িতে ফকির নিয়ে আসার এই ব্যাপারটা তার স্বামী নাজমুল হোসেনও পছন্দ করেননি। প্রথমে দোটানায় থাকলেও বিকেলে জানিয়ে দিয়েছেন যেন কুতুব ফকির এই বাড়িতে না আসে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য না করতে পারেননি নিলুফার। মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ আশার আলো ছিল যে সুস্থ হবে জেসমিন। কিন্তু এখন বড় ভয় করছে তার।
কুতুব ফকিরের সাথে একজন কিশোর এসেছে। সে তার সাগরেদ। নাম হাসু। বয়স ষোলো-সতেরো হবে। কুতুব ফকির চেয়ারে চোখ বুজে নির্দেশ দিচ্ছে আর সে সব কাজ করছে। কুতুব ফকির বলছে, হাসু।
ফকিরবাবা বলেন।
পিশাইচটা কি আছে?
আমি বলবার পারতেছি না।
তুই পারবি ক্যামনে? তুই ছোড মানুষ। আমি পারব। আছে, পিশাইচটা আছে। কালা কুইচকুইচা। এইরকম পিশাইচ খুব কমই দেখা যায়। জীবনে এই নিয়া আমি তিনবার দেখলাম। যাইহোক, গত দুইবার আমি ঐগুলারে তাড়াইছি, এইবারও তাড়াব। মরিচ কোথায় মরিচ?
মালশায় আছে বাবা।
কয়ডা মালশা?
পাঁচটা আছে।
ভালো। এই মরিচে বড় ঝাল, দামেও ঝাল। বেশি টাকা দিয়া কিনা লাগছে। মরিচগুলা সামনে রাইখা এক রাইত ধইরা মন্ত্র পড়া হইছে। মরিচের ধোঁয়ায় দৌড়াইয়া পালাবে পিশাইচ। যা, তুই বাড়ির চাইরপাশে চাইরডা মালশা রাইখা আয়। আর একটা মালশায় মরিচ পুড়াব জেসমিনের সামনে, শিকড়গুলা নিচে দিস। দেখি ওর শরীরে কতক্ষণ বইসা থাকবার পারে ঐ পিশাইচ।
জোবেদা খালা এবার নরম গলায় বললেন, আর কিছু লাগবে, বাবা?
আপাতত দরকার নাই। তয় কিছু খরচপাতি হইছে। নগদে কিছু শিকড় কিনা লাগছে, দাম বেশি। হাজার পাঁচেক টাকা লাগবে।
হাজার পাঁচেক!
হ খরচটা একটু বেশিই। তয় কোনো উপায় নাই।
জোবেদা খালা নিলুফারের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস বললেন, পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে আসো।
এত টাকা তো ঘরে নাই।
কত আছে?
তিন হাজারের মতো হবে।
ঐ টাকাই আনো। আমি আর দুই হাজার টাকা দিয়া দিতেছি। ফকির বাবারে অসন্তুষ্ট রাখা যাবে না। তাইলে পিশাইচ তাড়ানো কঠিন হইয়া পড়বে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
বাড়িতে তিন হাজার এক শ টাকা ছিল। নিলুফার তিন হাজার টাকা এনে হাতে দিল জোবেদার হাতে। খালা তার নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে বের করল আরো দুই হাজার টাকা। তারপর পাঁচ হাজার টাকা ফকির বাবাকে দিয়ে বলল, বাবা, পিশাইচটা যেন এই বাড়িতে আর না থাকে।
ফকির বাবা ধমকে উঠে বললেন, না, থাকবে না। এই বাড়িতে আর থাকবে না পিশাইচ। ওরে শুধু এই বাড়ি না, গ্রামছাড়া করব, দ্যাশছাড়া করব। যা কালাপিশাইচ যা, ভাগ এইখান থাইকা, ভাগ?
কথাগুলো বলতে বলতে বাড়ির চারপাশে হাঁটা শুরু করল কুতুব ফকির। এককোনায় যাচ্ছে আর মালশার শিকড় মরিচে আগুন ধরাচ্ছে সে। যখন চারপাশের মালশায় আগুন জ্বালানো শেষ হলো তখন মরিচের ঝাঝে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম সবার। নিলুফার বললেন, খালা, বাড়ির মধ্যে থাকা তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
কষ্ট হইলেও থাকা লাগবে।
ফকির বাবা এরপর ঢুকলেন জেসমিনের ঘরে। জেসমিন আগে থেকেই জানত যে তাকে ফকির দিয়ে ঝাড়ফুক দেয়া হবে। সে রাজি ছিল না। নিষেধও করেছিল তার বাবা মাকে। ভেবেছিল সত্যি ফকির আসবে না। কিন্তু এখন ফকির দেখে রাগে কাঁপতে শুরু করল সে। তার উপর মরিত্রে ঝাঁজে চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছে। নিজে থেকেই বলল, আমার ঘরে ঢুকবেন না কেউ।
কুতুব ফকিরের হাতে একটা মালশা। মালশায় এখনো আগুন ধরানো হয়নি। ধরালে ঘরের মধ্যে মরিচের ঝাজ আরো বাড়বে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জোবেদা খালা মুখের উপর কাপড় চেপে ধরে রেখেছেন। একইভাবে ঝাঁজ থেকে নিজেকে রক্ষা করছেন নিলুফার।
কুতুব ফকির বলল, পিশাইচটা আমারে ভয় দেখাইতেছে, ঘরে ঢুকবার নিষেধ করতেছে।
খবরদার ঘরে ঢুকবেন না।
চিৎকার করে উঠল জেসমিন।
কুতুব ফকির এবার জোরে ধমক লাগাল, চুপ হারামজাদা! কোনোরকম চেঁচামেচি করবি না। ভালোয় ভালোয় এই বাড়ি থাইকা বাইরায় যা, নইলে মরিচের ঝাল দিয়া তোরে পুড়ায় দিব।
না এই ঘরে মরিচ জ্বালাবেন না।
ক্যান জ্বালাব না। তোর শরীর জ্বলবে, মন জ্বলবে, না? আমি তো চাই তুই জ্বইলা পুইড়া শ্যাষ হইয়া যাবি। এখন পর্যন্ত জেসমিনের মতো কতজনের সর্বনাশ করছস? আর সুযোগ পাবি না। পুরা বাড়ি ধোয়ায় ছাইয়া গেছে। পালাবারও পারবি না। তোর আইজ মরণ হবে, মরণ।
কথাগুলো বলতে বলতে মালশাতে আগুন ধরাল কুতুব ফকি মরিচের তীব্র ঝাঁজ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল ঘরের মধ্যে। ঝাঁজ সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দৌড় দিল জেসমিন। কিন্তু তার হাত ধরে বসল কুতুব ফকির। তারপর টেনে টেনে বলল, না তোরে পালাবার দিব না। তোরে আইজ আমি মাইরা ফেলাব, নিজের হাতে মারব। গামছা কই, দুইডা গামছা দ্যান, বাইন্দা ফেলাই ওরে।
জোবেদা খালা এবং নিলুফার দুজনের অবস্থাই খারাপ। চোখ, নাক দিয়ে পানি ঝরছে। এর মধ্যেই জোবেদা খালা বললেন, দুইটা গামছা দরকার, কোথায় পাব?
নিলুফার বললেন, না না। আমার মেয়েটা মরে যাবে। ওকে ছেড়ে দিন, ওকে ছেড়ে দিন। আর, ফকির বাবা, আপনি চলে যান। লাগবে না, লাগবে না পিশাচ তাড়ান।
কুতুব ফকির বলল, না না, আমার যাওয়া ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে পিশাইচডারে ছাড়াও যাবে না, তাইলে সর্বনাশ হইয়া যাবে। পিশাইচের সাহস বাইড়া যাবে। তখন আরো ক্ষতি করবে মানুষের। গামছা দ্যান, গামছা। শক্ত কইরা বাইন্দা রাখি। পুড়া মরিচের ঝাঁজ নাক-মুখ দিয়া শরীরে ঢকান লাগব। পিশাইচটা সমস্ত শরীরে বইসা আছে। তয় বড় কষ্ট হইতেছে পিশাইচের।
নিলুফার এবার এগিয়ে এসে নিজেই ছাড়িয়ে নিলেন জেসমিনকে। জেসমিন আর দাঁড়াল না। দৌড়ে ঢুকে গেল তার ঘোট দুই ভাইয়ের কক্ষে।
এদিকে খুবই রেগে গেল কুতুব ফকির। চোখ বড় বড় করে বলতে থাকল, এই বাড়িতে গজব পড়ক, গুজব। এত কাছে আইসাও মারবার পারলাম না পিশাইচটারে। আরো কতজনের যে সর্বনাশ করবে? না না, মানুষ কিছু বুঝে না, কিছুই বুঝবার চায় না, মানুষ বড় খারাপ, বড় খারাপ!
কথাগুলো বলে বাড়ির বাইরে বের হয়ে গেল কুতুব ফকির। তার পিছন পিছন গেলেন জোবেদা খালা। তিনিও খুব বিরক্ত এবং লজ্জিত নিলুফারের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য!
*
ডাক্তার তরফদারের আগে থেকেই ইচ্ছে ছিল কক্সবাজার ঘুরতে আসবেন। কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। এবার সুযোগটা নিয়েছেন তিনি। একটা মাইক্রোবাসে ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসেছেন। ড্রাইভার সালাম নামের এক যুবক। কখনো গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে সালামকে বলেন তিনি। যুবক বয়সি সালাম সবসময় হাসিখুশি থাকে। এজন্য সালামকে বেশ ভালো লাগে তার। ড্রাইভার হিসেবেও খুব ভালো। নিয়ম মেনে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে গাড়ি চালায়। তাছাড়া তাকে খুব শ্রদ্ধাও করে। তিনি ডাকলে অন্য যত বড় কাজ থাকুক না কেন চলে আসবে সে।
রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর রুমটা বুক দিয়ে এসেছিলেন ডাক্তার তরফদার। এজন্য ঐ রুমে উঠতে পেরেছেন। হোটেলটা মাঝারি আকৃতির। পাঁচতলা। এক তলায় ডাইনিং হল, রিসেপশন, ওয়েটিং রুম। দোতলা থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত থাকার রুম। প্রত্যেক তলায় বিশটি করে রুম। শুধু দোতলায় একটা রুম বেশি। এই রুমটাই হলো ২২১ নম্বর। রুম হিসেবে অতিরিক্ত হওয়ায় কেমন যেন খটকা লাগল ডাক্তার তরফদারের। কেন দোতলায় একটা রুম বেশি করা হয়েছে। বিষয়টা রহস্যজনক।
এখানে আসার আগে ডাক্তার তরফদার জেসমিনদের কলেজের প্রভাষক রাবেয়া খাতুনের সাথে কথা বলে এসেছেন। রাবেয়া খাতুন শিক্ষা সফরে কোথায় কোথায় গিয়েছিলেন সবই বলেছেন ডাক্তার তরফদারকে। রাতে যে তার থাকার কথা ছিল জেসমিনের সাথে সে কথাও বলেছেন এবং তিনি যে থাকেননি তাও গোপন করেননি। তবে এটাও উল্লেখ করেছেন যে, ২২১ নম্বর কক্ষে এমন কোনো অঘটন ঘটেনি যা উল্লেখ করার মতো।
রাবেয়া খাতুনের কাছ থেকে হাডসন হিলের মূর্তির কথা জেনেছেন ডাক্তার তরফদার। ঐদিন যে জেসমিন লাল শাড়ি পরেছিল, বকা খেয়েছিল তাও জেনেছেন। পরে জেসমিনের সাথে দেখা করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু জেসমিন তার সাথে কথা বলেনি। শেষে কথা হয় জেহানের সাথে। জেহান অনেক বেশি হতাশ এখন। সে জানিয়েছে জেসমিনের শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে এবং কারো সাথে কথা বলে না ইদানীং। এজন্য সে নিজে খুব অস্থিরতায় ভুগছে। আর বরাবরের মতো জেসমিনের কাছে তার ভালোলাগার আর ভালোবাসার কথা এখনো বলতে পারেনি। ডাক্তার তরফদার আসার আগে তার মাথায় হাত রেখে বলেছেন, মনে রাখবে, ‘আবেগে নয়, ভালোবাসা হয় প্রকাশে।
হোটেলে ডাক্তার তরফদার সবচেয়ে পুরাতন একজন বয় খুঁজে বের করলেন। নাম উদিম। উপজাতীয় হলেও সে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে। ম্যানেজারকে বলে দিলেন, উদিমই যেন তার রুমে কাজ করে। ম্যানেজার রাজি হলেন।
উদিম পানি নিয়ে এলে ডাক্তার তরফদার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বয়স কত উদিম?
চব্বিশ বছর।
কত বছর ধরে এই হোটেলে আছ?
স্যার দশ বছর। হোটেলের শুরু থেকেই।
তার মানে তোমার যখন বয়স চৌদ্দ তখন থেকেই তুমি কাজ শুরু করেছ এখানে। তাই না?
জি স্যার।
এত কম বয়সে কাজে নিল কেন তোমাকে?
বেতন কম দেয়া লাগত এজন্য স্যার। বড় মানুষ রাখলে টাকা বেশি দেয়া লাগে। আর ছোট মানুষ রাখলে পেটে-ভাতে রাখা যায়। আমাকে অবশ্য দুই হাজার টাকা বেতন দিত তখন, অন্যরা পেত ছয়-সাত হাজার টাকা।
এখন তোমার বেতন কত?
দশ হাজার টাকা।
তাহলে তো ভালোই। আচ্ছা একটা বিষয় বলো তো আমাকে, দোতলায় এই একটা রুম বেশি কেন? মানে এই ২২১ নম্বর রুমটা।
স্যার এই রুম করা হয়েছিল মালিকের ছেলের জন্য। সাধারণত ভাড়া দেয়া হয় না। তবে কাস্টমার বেশি হলে ভাড়া দেয়া হয়। বিশেষ করে শীতকালে ফাঁকা পাওয়া যায় না।
মালিকের ছেলে এই রুম দিয়ে কী করে?
মাঝে মাঝে আসে, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এখানে ফুর্তি করে।
আজ তো দেখছি একটা খাট। কখনো কি দুটো খাট ছিল?
প্রয়োজন হলে দিয়ে দেই স্যার। হোটেলে ছোট ছোট লোহার খাট আছে। উপরে ফোম। যখন যেখানে প্রয়োজন দিয়ে দেই। আপনের এই বেড তো ডবল বেড। আর একটা সিঙ্গেল খাট কি দিব? কেউ কি আসবে?
না আসবে না। যাইহোক, তোমার ঐ মালিকের ছেলে কোথায় এখন?
উদিম চুপ হয়ে গেল।
কী ব্যাপার, কথা বলছ না কেন?
স্যার জেলে আছে।
জেলে আছে মানে?
স্যার আসলে কী বলব, বড় লজ্জার কথা। এই কক্ষের মধ্যে সে এক মেয়েকে নিয়ে আসছিল। তারপর তার সাথে জোর করে শারীরিক সম্পর্ক করে। ঐ মেয়ে পরে মামলা করে দিয়েছে বাশার স্যারের নামে। আসলে স্যার, বাশার হলো মালিকের ছেলের নাম।
ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, ঐ রাতে তুমি ছিলে এখানে?
না, স্যার। বাশার স্যারের ডিউটি করার জন্য আলাদা এক বয় আছে। নাম লিটন। আমার মতোই বয়স।
আমি কি লিটনের সাথে কথা বলতে পারব?
এখন ডিউটি নেই স্যার। ডিউটিতে আসলে আমি আপনার কাছে নিয়ে আসব।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
এখন কি খাবার দিব স্যার?
না, ক্ষুধা নেই। রাতে ডাইনিংয়ে গিয়ে খাব। ইচ্ছে একটু সাগরপাড়ে যাব। সারাদিনের জার্নিতে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
ঠিক আছে স্যার। যখন প্রয়োজন হবে তখন ডাকবেন। আমি এই হোটেলেই থাকি। আপনি ডাক দিলে চলে আসব। আর এই কক্সবাজার এলাকা আমার চেনা। কোথাও যেতে চাইলে আমাকে বলবেন।
তা বলব। তুমি কি হাডসন হিল সম্পর্কে কিছু জানো?
আমি জানি স্যার, তবে বেশি জানি না। আনন্দভ্রমণ” বইতে লেখা আছে হাডসন হিল সম্পর্কে। আমি কি একটা বই আপনাকে দেব? পড়ে দেখতে পারেন।
ঠিক আছে দাও।
তবে কি স্যার…
হ্যাঁ, বলল।
‘আনন্দভ্রমণ’ বইতে যা লেখা আছে তা সব বিশ্বাস করবেন না। ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। আর ওখানে কিছু টুরিস্ট গাইড আছে। টুরিস্টদের কাছ থেকে টিপস পাওয়ার জন্য নিজেদের মতো গল্প তৈরি করে। আপনি ওখানে গেলে বুঝতে পারবেন।
অবশ্য এটা সত্য, ডাক্তার হাডসন বড় ভালো মানুষ ছিলেন।
তুমি জানলে কীভাবে?
শুনা কথা।
ও আচ্ছা।
ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করলেন, ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে জানতে হলে এমন কাউকে খুঁজে পেতে হবে যে ডাক্তার হাডসনের খুব কাছের ছিল। এরকম মানুষ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কারণ এখন ২০২২ সাল। আর ডাক্তার হাডসনের ঘটনা ১৯৫০ সাল কিংবা তার কাছাকাছি সময়ের। অর্থাৎ সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগের। এক্ষেত্রে তাকে কমপক্ষে নব্বই কিংবা এক শ বছর বয়সি কাউকে খুঁজে পেতে হবে। বিষয়টা একেবারে সহজ না।
*
মাঝ রাত জেগে আছে জেহান। ঘুম আসছে না। ইদানীং তার ঘুম খুব কম হয়। শরীরটাও কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগে। হয়তো ঘুম কম হওয়ার জন্য এমন হচ্ছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে আজ সে লম্বা একটা ঘুম দেবে। কিন্তু ঘুম যেন আজ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। জেহান এবার বিছানা থেকে উঠে ডায়ারিটা নিল। তারপর লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন,
তোমাকে খুব মনে পড়ছে। ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাত ধরে কিছুক্ষণ বসে থাকি। কিন্তু সেরকম সুযোগ নেই। তুমি ইদানীং কারো সাথে কথা বলো না। একেবারে একা হয়ে গেছ। তোমার রুম থেকেও বের হও না। ঘন্টার পর ঘণ্টা ছাদে দাঁড়িয়ে থেকেও দেখা পাই না তোমার! মনে বড় কষ্ট আমার। এত ভালোবাসি তোমাকে, অথচ তোমার ভালোবাসা পাই না। জানি না পাব কি না। তোমার জীবনে যা কিছু ঘটেছে সবকিছুর জন্য দায়ী রাশেদ ভাই, আমি জানি, কিন্তু বুঝতে পারছি না কেন তুমি তার নাম বলছ না। আমি চাই তার শাস্তি হোক। যে অপরাধ সে করেছে, তার কোনো ক্ষমা নেই। তুমি তোমার জীবন নিয়ে অতটা চিন্তা কোরো না। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি তোমাকে সবসময় ভালোবাসাব। যদি তোমার সন্তান জন্মগ্রহণ করে, তোমাকে পাওয়ার জন্য ঐ সন্তানসহ তোমাকে আমি গ্রহণ করব। সত্যি কথা বলতে কি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আর হ্যাঁ, রাশেদ ভাই যে সর্বনাশ তোমার করেছে তার জন্য তাকে পস্তাতে হবে। আমি কথা দিচ্ছি দুই-একদিনের মধ্যে আমি প্রতিশোধ নেব। এত বড় একটা অপকর্ম করে সে পার পেতে পারে না, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। প্রিয়তমা আমার, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না। ইদানীং খুব ইচ্ছে হয় তোমার হাত ধরে একটা দিন হাঁটি। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য বড় বেশি কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় তোমার বাড়ির সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু পারি না। ডাক্তার তরফদার স্যার বলেছেন, আবেগে নয়, ভালোবাসা হয় প্রকাশে। তোমার জন্য আমার আবেগ, ভালোলাগা, ভালোবাসার অভাব নেই, অথচ আমি প্রকাশ করতে পারি না। এজন্যই আমার ভালোবাসা তোমাকে বোঝাতে পারছি না। এবার আমি যেভাবেই হোক প্রকাশ করার চেষ্টা করব। তরফদার স্যার আর-একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। আর তা হলো, প্রিয়জনের কাছে প্রথম ভালোবাসার কথা বলে প্রকাশ করার থেকে লিখে প্রকাশ করা অনেক সহজ। আমি মুখে বলতে না পারলেও তোমাকে এ পর্যন্ত লেখা আমার সকল চিঠিগুলো দেব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তখন তুমি বুঝতে পারবে আমার এই বুকে তোমার জন্য কত ভালোবাসা জমে আছে। অবশেষে, এই কামনা করি তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠো। আর হ্যাঁ, ভাবছি, আগামীকাল ডাক্তার তরফদার স্যারের বাসায় যাব। ওখানে করিম চাচা আছে। সে ভবিষ্যৎ বলতে পারে। আমি তার কাছে গিয়ে জানতে চাইব তোমাকে আমি আমার জীবনে পাব কি না। আশা করছি আশার আলো থাকবে করিম চাচার কথায়। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো প্রিয়তমা আমার।
তোমারই ভালোবাসার
জেহান
চিঠি লেখা শেষ হলে আবার বিছানায় এলো জেহান। এবার শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল। গভীর ঘুম, ঠিক যেমনটা সে আশা করেছিল।
সকালে কলেজে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলো জেহান। বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে এপার আসতে ফুটপাতে এক গণককে বসে থাকতে দেখল। সে টিয়াপাখির মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করে। জেসমিনের কথা বলাতে গণক বলল, কোনো চিন্তা করবেন না, টিয়াপাখি শতভাগ সঠিক উত্তর দেবে।
কত টাকা লাগবে?
মাত্র দশ টাকা।
এই যে দশ টাকা নিন।
টাকা হাতে নিয়ে গণক টিয়াপাখিকে বলল, বাবা, তুমি আমাগো জানাও তো জেহান ভাইজান জেসমিনরে পাবে কি না?
টিয়া লাফ দিয়ে ডানে বামে গেল দুবার। তারপর নিচে রাখা অসংখ্য খাম থেকে একটা তুলে দিল গণকের হাতে। গনক মিষ্টি হেসে খামটা খুলল। তারপর বলল, এই যে দ্যাখেন ‘হ্যাঁ লেখা। তার মানে কী? আপনে আপনার জীবনে ভালোবাসার জেসমিনরে পাবেন।
জেহান খুব খুশি হলো। পঞ্চাশ টাকা অতিরিক্ত বকশিশ দিল গণককে। তারপর রিকশা নিয়ে রওনা দিল ডাক্তার তরফদারের বাসার উদ্দেশে।
করিম চাচাকে পাওয়া গেল বাড়িতেই। তার কাছ থেকে জানতে পারল ডাক্তার তরফদার কক্সবাজার গেছেন। জেহানের ইচ্ছা ছিল ডাক্তার তরফদারের সাথে কিছু কথা বলার। কিন্তু আজ আর সম্ভব হবে না বুঝতে পেরে কিছুটা হলেও মন খারাপ হলো তার। শেষে করিম চাচার কাছে আসার কারণটাও খুলে বলল সে।
করিম চাচা বাড়ির ভিতরের বইগুলো ঝেড়ে রাখছিল। অনেকদিন এক জায়গায় থাকলে বইগুলোর উপর ধুলো জমে যায়। সবকথা শোনার পর করিম চাচা বলল, পৃথিবীতে প্রেম ভালোবাসা সবকিছু না, আরো মেলা কিছু আছে।
তারপরও আমি জানতে চাই জেসমিন আমাকে ভালোবাসবে কি না।
পৃথিবীর সব মানুষই সবাইরে ভালোবাসে।
আমি ঐ ভালোবাসার কথা বলছি না। প্রেম-ভালোবাসার কথা বলছি চাচা। আমি জানি, আপনি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। প্লিজ আমাকে বলুন।
ভবিষ্যৎ জানলে জীবনের প্রতি আগ্রহ কইমা যায়।
তারপরও আমি জানতে চাই।
এইডা ঠিক না।
আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বড় বেশি কষ্ট হচ্ছে আমার।
করিম চাচা জেহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমি চা বানায় আনতেছি, চা খাইলে ভালো লাগবে।
না, আমি চা খাব না।
পৃথিবীতে অনেক কিছু খাবার ইচ্ছা না করলেও খাইতে হয়, অনেক কিছু করবার না চাইলেও করতে হয়। উলটাভাবে, অনেক কিছু করবার ইচ্ছা থাকলেও না কইরা বইসা থাকতে হয়, অনেক কিছু চাইলেও না পাইয়া দুঃখ কষ্ট বেদনা সহ্য করতে হয়। পৃথিবী যেমন পাওয়ার, তেমন না-পাওয়ারও। পৃথিবী যেমন সুখের, তেমনি দুঃখেরও।
আপনার কথাগুলো বড় জটিল করিম চাচা। আমি বুঝতে পারছি না, স্পষ্ট করে বলুন। আমি সুখী হতে চাই, সত্যি জেসমিনকে নিয়ে সুখী হতে চাই।
আমি চা নিয়া আসতেছি।
কথাগুলো বলে করিম চাচা রান্নাঘরে গেল। চা নিয়ে ফিরে এসে দেখল যে জেহান নেই। করিম চাচা চায়ের কাপটা পাশের টেবিলে রেখে আবার বইয়ের উপর মনোনিবেশ করল।
জেহান এবার এলো কলেজে। খুব উত্তেজিত হয়ে আছে সে। উত্তেজনার মূল কারণ রাশেদ। কলেজের মাঠের কোনায় একটা মেয়ের সাথে কথা বলছে। এই মেয়েটার সাথেই নতুন প্রেম শুরু করেছে সে। জেহান সিদ্ধান্ত নিল যেভাবেই হোক শায়েস্তা করবে জেহানকে। এজন্য তার একটা ছুরি দরকার। ছুরিটা সে কলেজের পাশের বাজার থেকে কিনল। বেশ ধারালো ছুরি, কাউকে হত্যা করার জন্য যথেষ্ট।
*
রেইনবো রেইন হোটেলের ২২১ নম্বর কক্ষে এমন কিছু ঘটেছে যার জন্য জেসমিন এখন গর্ভবতী, এই বিষয়টাকে ডাক্তার তরফদার একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছেন না। বিষয়টা যদি ধর্ষণ পর্যায়ের হয়ে থাকে, স্বাভাবিকভাবে লাজলজ্জার ভয়ে জেসমিন কাউকে কিছু বলতে চাইবে না। হয়তো সেরকম কিছু ঘটেছে। কিন্তু বিষয়টা প্রমাণ করা বড় কঠিন। কারণ একটা ব্যাপার তিনি বুঝতে পারছেন না, বাইরে থেকে ভিতরে কেউ প্রবেশ করবে কীভাবে? মূল দরজায় এবং বারান্দার সাথের দরজায় ছিটকিনি রয়েছে। এক্ষেত্রে বাইরে থেকে কারো পক্ষে ভিতরে প্রবেশ করা অসম্ভব। হতে পারে কেউ আগে থেকে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিল। কিন্তু যুক্তিটা বড় অবাস্তব। একজন অপরাধী এত বড় ঝুঁকি কীভাবে নেবে? অবশ্য যদি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র হয়, যাকে বলে অর্গানাইজড ক্রাইম, তাহলে হয়তো সম্ভব হতে পারে। বিষয়টাকে ডাক্তার তরফদার বেশ গুরুত্বের সাথে বিশ্লেষণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
‘আনন্দভ্রমণ’ বই পড়ে হাডসন হিল সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পেলেন না ডাক্তার তরফদার। একদিন আরো খোঁজখবর নিলেন। কিছুদিন হলো জায়গাটা পরিচিত পেয়েছে পর্যটন স্পট হওয়ার কারণে। হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে উদিমকে পাঠিয়েছিলেন হাডসন হিলে বয়স্ক কোনো মানুষ পাওয়া যায় কি না খুঁজে বের করার জন্য। উদিম একজনকে খুঁজে পেয়েছে। নাম ইরফান আলী। জনশ্রুতি আছে তার বয়স এক শ বছর। একসময় ব্যাংকের কর্মকর্তা ছিলেন। এখন বাড়িতেই থাকেন।
ডাক্তার তরফদার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রথমে তিনি হাডসন হিলে যাবেন। জায়গাটা দেখার জন্য তার নিজের মধ্যেই এক ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এরকম পরিকল্পনা থেকে সকাল আটটার সময় রওনা দিলেন হাডসন হিলের উদ্দেশে। সাথে ড্রাইভার সালাম আর হোটেল-বয় উদিম। উদিম থাকায় পথ চিনতে সমস্যা হলো না। হাডসন হিলে এসে ডাক্তার তরফদার বিস্ময়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলেন। এত সুন্দর জায়গা! সাগরের তীর ঘেঁষে উঁচু উঁচু পাহাড়। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা হাডসন হিল। সামনে ছোট-বড় গাছ। তারপর সমুদ্রের তীর আর সাগর। পাহাড়ের উপরের অংশটা দারুণ সবুজ। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কিছু কিছু গাছ এত বড় যে কল্পনা করা যায় না।
হাডসন হিলে আট-দশজন দেশি পর্যটক হাঁটাহাঁটি করছে। তিনি প্রথমে এলেন এলিজা স্টোন বা নীল পাথরে। উপরে উঠে চারদিকে তাকাতে এক কথায় নয়ন জুড়িয়ে গেল তার। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাতটা এখানেই কাটাবেন। দেশে-বিদেশে বহু জায়গায় ঘুরেছেন, কিন্তু এরকম জায়গায় কখনো এসেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। শরীরে বাতাসের পরশ এতটাই আরামদায়ক যেন মনে হয় সকল অস্বস্তি আর অসুস্থতাকে দূরে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
পাথরের উপরে অনেকে অনেককিছু লিখেছে। ডাক্তার তরফদার ছবি তুললেন, ভিডিও করলেন যেন পরবর্তীকালে যুক্তি-তর্ক বিশ্লেষণে কাজে লাগাতে পারেন। অতঃপর এলেন হাডসন গুহায়। ভিতরটা দেখে একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলেন। গুহার পিছনের দিকে একটা বিশাল মূর্তি। সেই মূর্তির সামনে সাদা পাথরের চত্বর। এখানে সাদা পাথর থাকার কথা নয়। কীভাবে এলো তা এক বিস্ময়! মূর্তিটার পরনের পোশাক অনেকটা পায়জামা পাঞ্জাবির মতো। চারপাশের দেয়ালে অনেক নাম লেখা। পুরো গুহাটার অনেক ছবি তুললেন তিনি, ভিডিও করলেন চারপাশটা। কেমন যেন ঠান্ডা ভিতরের অংশে, পরিবেশটা বেশ আরামদায়ক। একপাশে পাথুরে চৌবাচ্চায় পানি জমে থাকতে দেখলেন, পরিষ্কার পানি।
মূর্তিটার একেবারে কাছে এলেন ডাক্তার তরফদার। পাথরের তৈরি মূর্তি। পাহাড়ের সাথে যে পাথর থাকে সেই পাথর কেটে বানানো হয়েছে। কাছে এলে বোঝা যায় মূর্তিটা কত বড়। এত বড় একটা মূর্তি ডাক্তার হাডসন নিজে বানিয়েছেন বিশ্বাস করা কঠিন। বহু সময় লাগবে। পেশাদার ভাস্কর ছাড়া পাথর দিয়ে মূর্তি বানানো সহজ নয়। অথচ এই কাজটিই করেছেন ডাক্তার হাডসন। অবশ্য একটা সন্দেহ কাজ করছে ডাক্তার তরফদারের মনে। ডাক্তার হাডসন কেন নিজের মূর্তি নিজে বানাবেন। তার বানানো উচিত ছিল তার স্ত্রী এলিজার মূর্তি! অবশ্য পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কাজকর্ম অন্যদের সাথে মিলে না। সেই বিবেচনায় ডাক্তার হাডসনের নিজের মূর্তি বানানো সমর্থনযোগ্য হতে পারে।
স্থানীয় একজন টুরিস্ট গাইড পেলেন ডাক্তার তরফদার। নাম আকিব। তার কাছ থেকে জানতে পারলেন ব্রিটেনে ডাক্তার হাডসনের মৃত্যু হলেও তার আত্মা নাকি এখানে চলে এসেছে।
ডাক্তার তরফদার উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করলেন, কীভাবে বুঝলেন যে তার আত্মা এখানে থাকে?
রাতে অনেকেই দেখেছে স্যার।
কী দেখেছে?
একটা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষ ঘুরে বেড়ায়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কী রঙের পাঞ্জাবি?
নীল রঙের।
ও আচ্ছা। আপনি কখনো দেখেছেন?
না স্যার, দেখিনি। তবে একবার চেষ্টা করেছিলাম। শুনেছিলাম সন্ধ্যার পর গুহা থেকে বের হয় তার আত্মা। আমি আর আমার তিন বন্ধু রাত নয়টা পর্যন্ত ছিলাম। তারপর আর থাকতে পারিনি। ভয়ে শরীর কেমন যেন ছমছম করছিল।
এমন কেউ আছে যে রাতে ডাক্তার হাডসন বা তার আত্মাকে দেখেছে?
আমাদের গ্রামে আছে। নাম মোবারক।
আমি কি মোবারকের সাথে কথা বলতে পারি?
পারেন স্যার। আমি ব্যবস্থা করব। তাকে কি ডাক দেব?
দিতে পারেন।
আর একটা কথা স্যার। কী কথা?
ডাক্তার হাডসন কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের দেখলে তার উপর ভর করে বসে।
কী বলছেন এসব!
জি স্যার। আসলে তার স্ত্রী ‘এলিজা এখানে মারা গিয়েছিল তো, তাই তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ। তখন থেকেই মেয়েদের প্রতি ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। সুন্দরী কোনো মেয়ে দেখলে তার আত্মা ঐ মেয়ের প্রতি এখনো আগ্রহ অনুভব করে। মেয়েরাও ডাক্তার হাডসনকে খুব পছন্দ করে। কারণ বিদেশি ফর্সা মানুষ। গ্রামে অনেক মেয়েই নাকি ডাক্তার হাডসনকে রাতে তাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছে!
এমন কোনো মেয়ে পরিচিত আছে?
আমার নেই। তবে খুঁজলে বের করতে পারব।
পারলে ভালো হতো। আর আপনি কীভাবে জানলেন যে ডাক্তার হাডসন সুন্দরী মেয়েদের পছন্দ করে?
এই কাহিনি সবাই জানে, আমার মতো যত ট্যুরিস্ট গাইড আছে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর দেখবেন, যত মেয়ে এখানে আসছে সবাই ছবি তুলছে ডাক্তার হাডসনের মূর্তির সাথে।
এটা তো স্বাভাবিক যে তারা ছবি তুলবে। কারণ ডাক্তার হাডসনের মূর্তি তো আর কোথাও নেই। জীবনে হয়তো তারা এই সুযোগ একবারই পাবে। স্মৃতিটা ধরে রাখতে কে না চায়!
না স্যার, এত সহজভাবে নিবেন না বিষয়টা। বছর ত্রিশেক আগে এখানে এক সুন্দরী মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বয়স আঠার-উনিশ হবে। লাশটা পাওয়া গিয়েছিল সাগরের তীরে। শুধু ছায়া আর ব্লাউজ পরা ছিল। লাল শাড়িটা খানিকটা দূরে পড়ে ছিল। ঐ মেয়েটা কোথা থেকে এসেছিল জানা যায়নি। আশেপাশে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হদিস মেলেনি তার বাবা-মায়ের।
আপনার বয়স কত?
স্যার বাইশ বছর।
তো ত্রিশ বছর আগের ঘটনা কীভাবে জানলেন?
সবাই জানে স্যার। যাকে জিজ্ঞেস করবেন সে-ই বলবে।
লাশটা কী করা হয়েছিল?
মাটি দেয়া হয়েছিল। পরে কবরের ভিতর থেকে লাশটা আবার বের করেছিল কেউ। ধারণা করা হয় ডাক্তার হাডসনের আত্মাই করেছিল কাজটা।
কী বলছেন!
দ্বিতীয়বার মাটি দেয়ার পর অবশ্য ডাক্তার হাডসন কিংবা তার আত্মা আর আসেনি কবরের কাছে। তবে অনেকে বলে, ঐ মেয়েটার সাথে নাকি এখনো ডাক্তার হাডসন ঘুরে বেড়ায়। ডাক্তার হাডসনের সাথে মেয়েটার আত্মাও আছে এই হাডসন হিলে।
ডাক্তার হাডসন যদি মেয়েটিকে হত্যা করে থাকে তাহলে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কেন?
আমি বলতে পারব না স্যার। মোবারক বলতে পারবে।
আচ্ছা ঠিক আছে, মোবারককে ডাকার ব্যবস্থা করুন, দেখি সে কী বলে।
মোবারক এলো আধঘণ্টা পর। এই আধঘণ্টা ডাক্তার তরফদার চারপাশটা ঘুরলেন। সত্যি ভালো লাগার মতো জায়গা। সাগরের ঢেউয়ের শব্দের পাশাপাশি গাছের পাতার মধ্যে দিয়ে বাতাস যাওয়ায় একরকম শো শো শব্দ কানে আসে। এই দুটো শব্দ শুনতে বড় ভালো লাগে। একটা দিনের জন্য যদি কেউ এখানে বেড়াতে আসে নিঃসন্দেহে উপভোগ্য হবে দিনটা।
মোবারকের কাছ থেকে যে কাহিনি শুনলেন তা হলো, ‘মোবারক দুই বছর আগে ডাক্তার হাডসনকে এই হাডসন হিলের বিচে হাঁটতে দেখেছিল। সময় ছিল মাঝরাত। সে আর তার গ্রামের আরো দুজন মিলে সাগরে মাছ ধরে ফিরছিল। তাদের কাছে মাছও ছিল। ডাক্তার হাডসন তাদের কাছে আসেন এবং মাছ চান। ভয়ে ঐ মাছ ফেলে দৌড় দেয় মোবারক আর তার দুই সঙ্গী। সকালে তারা আবার আসে মাছের সন্ধানে। মাছ পায়নি তারা, শুধু পেয়েছিল মাছের কাটা।
ডাক্তার তরফদারের বেশকিছু প্রশ্ন করার ছিল মোবারককে। কিন্তু তিনি রলেন না। কারণ অশরীরীয় আত্মায় তিনি বিশ্বাস করেন না। ষাট-সত্তর বছর আগে মৃত কোনো ব্যক্তির আত্মা এই সাগরতীরে ঘুরে বেড়ায়, ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। তাই তিনি মনোযোগ দিলেন ইরফান আলীর সাথে সাক্ষাৎ করার বিষয়ে। ডাক্তার তরফদারের বিশ্বাস ইরফান আলী তাকে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।
*
জেহান কলেজে এসেছে। সে সুযোগ খুঁজছে কীভাবে রাশেদকে একা পাওয়া যায়। তাহলেই পেটের মধ্যে ছুরিটা ঢুকিয়ে দেবে। কিন্তু সুযোগ সে পাচ্ছে না। রাশেদ সবসময় তিন-চারজন সঙ্গী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ক্লাস থেকে বের হওয়ার সময় দেখা হলো শান্তার সাথে। ডাক দিল তাকে। কাছে যেতে বলল, জেসমিনের কী অবস্থা?
আমি জানি না আপু।
তোমার তো বাড়ির পাশে। কথা বলো না কেন?
আমি গতকাল গিয়েছিলাম। কিন্তু খালাম্মা বলল, কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না জেসমিন। একা একা থাকতে চায় সবসময়।
এটা একটা কথা হলো। আমি যাব ভাবছি।
একটু থেমে শান্তা আবার বলল, তুমি কি সংবাদটা শুনেছ?
কী সংবাদ?
রাশেদ ভাই নতুন যে মেয়েটার সাথে প্রেম শুরু করেছে, নাম মুনিরা, ওর সাথে ঝগড়াঝাটি হয়েছে।
না শুনিনি। কেন?
ভয়ংকর সংবাদ।
কী ভয়ংকর!
চারদিকে এই কথা কানে ভাসছে যে মুনিরা প্রেগন্যান্ট। মুনির পেটে রাশেদ ভাইয়ের সন্তান। মুনিরা রাশেদ ভাইকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য কিন্তু রাজি হচ্ছে না রাশেদ ভাই।
কী বলছেন আপনি আপু!
হ্যাঁ। আমার ধারণা কি জানো?
কী?
জেসমিনের পেটের সন্তানও রাশেদ ভাইয়ের। রাশেদ ভাই অস্বীকার করছে।
কীভাবে সম্ভব! একজন মানুষ এতজন মানুষের সাথে সম্পর্ক করবে কীভাবে? এটা তো অন্যায়।
তোমাকে বললাম এ কারণে যে তুমি জেসমিনদের বাড়ির পাশে থাকো। আমি ভাবছি বিষয়টা আমি জেসমিন আর খালাম্মাকে জানাব। তুমি পাশে থাকবে। জেসমিনের বাচ্চার একটা সুরাহা করা দরকার। তা না হলে পিতৃপরিচয়হীনভাবে বাচ্চাটা বড় হবে। এটা হতে পারে না। তুমি এই ফাঁকে সত্যতা যাচাই করে নাও।
আপনি বলেছেন এটাই সত্য।
আমি বলেছি বলে নয়, মুনিরার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী আমাকে বলেছে।
কী হচ্ছে কলেজে এসব? প্রিন্সিপ্যাল স্যার কিছু করছেন না কেন?
কেউ তো দরখাস্ত দিচ্ছে না। জেসমিন দেয়নি, দেয়নি মুনিরাও। একটা দরখাস্ত দিলে তদন্ত হতো, তখন কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিতে পারতেন প্রিন্সিপ্যাল স্যার।
জেহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আর পদক্ষেপ আপা! যা করার আমাদেরই করতে হবে।
আমরা করব কীভাবে?
দেখি কী করা যায়। আপনি কখন যাবেন জেসমিনদের বাড়িতে?
তোমাকে ফোন করে জানাব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
জেহান কলেজে এলোমেলো কিছুক্ষণ ঘুরল। খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করল মুনিরার প্রেগন্যান্ট হওয়ার বিষয়ে। কিন্তু নিশ্চিত কোনো তথ্য পেল না। শেষে যখন চলে আসবে তখন দেখল কলেজের পুকুড়পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ। নিজে থেকেই ডাক দিল তাকে।
জেহান যাবে কি যাবে না ভাবছে। কারণ রাশেদের সাথে একটি ছেলে আছে। অবশ্য সে কলেজের না, বাইরের কোনো জায়গার হবে। জেহানের বুকটাও ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। ছুরিটা পরিকল্পনামতো ব্যবহার করতে পারবে কি না সন্দেহ সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্যে। আর তাছাড়া সে কোনো সাক্ষী রাখতে চায় না। অথচ পাশের ছেলেটা যাবে বলে মনে হলো না।
জেহান কাছে পৌঁছাতে রাশেদ বলল, কেমন আছিস তুই জেহান?
কথা শুনে খানিকটা ভড়কে গেল জেহান। কারণ রাশেদ তাকে ‘তুই’ করে বলছে। আগে ‘তুমি’ করে বলত। সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ভালো ভাইয়া।
আমাকে তুই ভালোমতোই চিনস?
হ্যাঁ, চিনি।
আমি যতদূর জানি তোর বাপ অনেক বড়লোক। আমার কিছু টাকা দরকার। হাজার বিশেক। আমাকে ধার দেয়া লাগবে।
এত টাকা আমি পাব কোথায়?
তুই পাবি ক্যামনে? তোর বাপে দিবে। আনবার পারবি না?
না।
পারলে তোর কাছে এখন যা আছে দিয়া দে।
আমার কাছে?
হুঁ।
কথা বলেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার সাগরেদের দিকে চোখের ইশারা করল রাশেদ। তারপর বলল, ওর কাছে কত টাকা আছে দ্যাখতো জুবায়ের!
জুবায়ের এগিয়ে এসে রাশেদের পিছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে নিল। সাথে সাথে মাথা গরম হয়ে উঠল জেহানের। সে সাইড পকেট থেকে ছুরি বের করে আঘাত করে বসল জুবায়েরকে। তাতে জুবায়েরের ডান হাতে খানিকটা কেটে গেল। জেহানের এই ঔদ্ধত্য দেখে প্রচণ্ড খেপে উঠল রাশেদ। ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল জেহানকে। ততক্ষণে জুবায়ের মানিব্যাগ দেখে ফেলেছে। বলল, বস টাকা বেশি নাই। তয় এক মাইয়ার ছবি আছে।
ছবিটা দেখে রাশেদ বলল, তোর পকেটে জেসমিনের ছবি ক্যান?
জেহান যে কিছু বলবে সেই উপায় নেই, ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হতবিহ্বল হয়ে গেছে সে।
রাশেদ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, তুই তাহলে জেসমিনের সাথে আকামডা করছস! জেসমিনরে গর্ভবতী করছস! তলে তলে এত দূর! তোরে আমি ছাড়ব না। কলেজে আমি কাইলই সবকিছু ছড়ায়া দিব। তুই আকাম কইরা আমার নামে আজেবাজে কথা ছড়াইতেছস। আমার বদনাম করতেছস। আর ছুরি নিয়া চলা শুরু করছস? আমার উপর খবরদারি দেখাচ্ছি মজা।
কথা বলতে বলতে রাশেদ নিজে জেহানের বাম হাতের আঙ্গুল ধরে মোচড় দিল। তাতে মট শব্দে কনে আঙুলটা ভেঙে গেল জেহানের। আর দেরি করল না জেহান। কামড় বসিয়ে দিল রাশেদের হাতে। তাতে রাশেদ খানিকটা সরে গেলে সুযোগটা কাজে লাগাল সে। উঠেই দৌড় দিল। ততক্ষণে আরো কয়েকজন ছাত্র আসতে শুরু করেছে পুকুরের দিকে। অবস্থা বেগতিক দেখে দ্রুত সরে পড়ল রাশেদ।
তীব্র ব্যথায় জেহানের চোখে তখন পানি আসার অবস্থা। সে উঠে দাঁড়াতে কাছে আসা কয়েকজন ছাত্র জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? কী হয়েছে?
জেহান চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, আমার মানিব্যাগটা নিয়ে গেছে।
এবার অন্য এক ছাত্র বলল, কয়েকদিন আগে তো রাশেদ ভাই আমার মানিব্যাগ থেকে এক হাজার দুই শ টাকা জোর করে নিয়ে গেছে। বলেছে ধার, কিন্তু দেবে বলে মনে হয় না।
জেহান অবশ্য আর কিছু বলল না। সে হাঁটতে শুরু করল সামনের দিকে। তার হাতে খুব ব্যথা করছে। বুকেও ব্যথা আছে, এই ব্যথার তীব্রতাটা যেন বেশি। কারণ সে প্রতিশোধ নিতে পারেনি, ছুরিটা ঢুকিয়ে দিতে পারেনি রাশেদের পেটে কিংবা বুকে।
*
ডাক্তার তরফদার ইরফান আলীকে দেখে খানিকটা অবাকই হয়েছেন। যতটা বয়স্ক তাকে ভেবেছিলেন চেহারা দেখে ততটা বয়স্ক মনে হচ্ছে না। যখন বয়স জানতে চাইলেন ইরফান আলী মৃদ হেসে বললেন, বিরানব্বই বছর।
বিরানব্বই বছর বয়সে যে সকল মানুষ নিজের পায়ে হাঁটাচলা করতে পারে তারা সত্যি সৌভাগ্যবান। ইরফান আলী সেই সৌভাগ্যবানদের একজন। তবে তার একটা লাঠিতে ভর দিতে হয়, এই যা। ইরফান আলীর বাড়িটাও চমৎকার। একটা টিলার উপর ছোট্ট দোতলা বাড়ি। বারান্দায় বসে সাগর দেখা যায়। এত সুন্দর দৃশ্য যে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।
ডাক্তার তরফদার পরিচয়পর্বের কথা শেষ করে বললেন, আমি আসলে এসেছি ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে জানতে। আপনি বলেছেন আপনার বয়স বিরানব্বই বছর। বর্তমানে ২০২২ সাল। তার মানে ১৯৩০ সালে আপনার জন্ম। আর ডাক্তার হাডসন এসেছিলেন ১৯৪০-এর দশকে, তাই না?
ডাক্তার হাডসনের কথা শুনে প্রথমে একটু যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন ইরফান আলী। তারপর হঠাৎই মৃদু হেসে বললেন, আমার কাছে অনেক মানুষ এসেছে, অনেকে জানতে চেয়েছে ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে। তাও বহুদিন আগে। আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আপনি হচ্ছেন নতুন কেউ যিনি এসেছেন ডাক্তার হাডসন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে। আমি অবশ্যই আপনাকে সঠিক তথ্য দেব। সময় পালটে গেছে, আগের অবস্থা আর নেই।
সময় পালটে গেছে মানে?
ইরফান আলী চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছিলেন। এবার সোজা হয়ে বসে বললেন, ডাক্তার হাডসন এই এলাকায় এসেছিলেন ১৯৪৪ সালের কাছাকাছি সময়ে। সম্ভবত প্রথমে চাকরি করতেন অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালে। কারণ আমার মনে আছে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমি একটা জাহাজে অনেক বিদেশি সৈনিককে চলে যেতে দেখেছিলাম। কোন দেশের সৈনিক বলতে পারব না। অতটা মনে নেই।
ডাক্তার হাডসন কীভাবে এসেছিলেন?
উনি সম্ভবত সামরিক ব্যবস্থাপনায় এসেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে একটা খ্রিষ্টান মিশনারিজে কাজ নেন। তারপর যান ছুটিতে। পরে স্ত্রী এলিজাকে নিয়ে জাহাজে ফিরছিলেন। ডাক্তার হাডসন ছিলেন ব্রিটিশ। পূনরায় খ্রিষ্টান মিশনারিতে কাজ করবেন বলেই ফিরে আসছিলেন তিনি। জাহাজটা যখন চট্টগ্রামের কাছাকাছি তখন জাহাজে বড় ধরনের যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ঐ সময় বেশ ঝড় হয়েছিল দুইদিন। বাতাসের গতি ছিল অনেক বেশি। ঝড় আর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জাহাজটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। চলে আসে এইদিকে। অবশেষে অগভীর পানিতে নোঙর ফেলে। জাহাজের অধিকাংশ যাত্রী তখন তীরে নেমে আসে। তাদের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার হাডসন এবং এলিজা। প্রায় এক সপ্তাহ লেগেছিল জাহাজটি ঠিক করতে। ঐ এক সপ্তাহ ডাক্তার হাডসন এবং এলিজা সমুদ্রের তীরে হেভেন হিলে ছিলেন।
‘হেভেন হিল’ মানে?
হাডসন হিলের আগের নাম ছিল হেভেন হিল। আমারও জন্মের বেশ আগে এক ব্রিটিশ গবেষক দল সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করতে এসেছিল এই এলাকায়। জায়গাটার সৌন্দর্য দেখে তারা নাম রেখেছিল ‘হেভেন হিল, অর্থাৎ স্বর্গের পাহাড়। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষ সময়ে উপমহাদেশের সবাই যখন স্বাধীনতার জন্য মরিয়া এবং বাঙালিরা ইংরেজি পরিহার করা শুরু করে তখন এই হেভেন হিল হয়ে যায় ‘স্বর্গের পাহাড়’। স্বর্গের পাহাড় নামটা কালের বিবর্তনে হয় ‘স্বর্গস্বপ্ন’। জনশ্রুতি আছে, কোনো এক বিখ্যাত বাঙালি কবি এসে নাকি ‘স্বর্গস্বপ্ন’ নামটা রেখেছিলেন। ছোটবেলা জায়গাটার নাম স্বর্গস্বপ্ন বলেই শুনেছি। গুহায় প্রবেশের আগে ডান পাশে দেখবেন পাথরের উপর হেভেন হিল নামটা লেখা আছে। তার উপর আবার লেখা স্বর্গস্বপ্ন।
তাহলে এখন ‘হাডসন হিল’ বলে কেন সবাই?
আসলে ডাক্তার হাডসন এতটাই জনপ্রিয় ছিলেন যে ‘স্বর্গের পাহাড় কিংবা ‘স্বর্গস্বপ্ন’ নামটা তার জনপ্রিয়তার কাছে হারিয়ে যায়। আর নতুন নাম হয় ‘হাডসন হিল। ঐ নামটা এখনো প্রচলিত আছে। যাইহোক, বলছিলাম ডাক্তার হাডসনের কথা। যেদিন জাহাজ চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা দেবে তার একদিন আগে অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা ঘটে। সাগরে গোসল করতে গিয়ে ঢেউয়ের টানে ডুবে যায় তার স্ত্রী এলিজা। তাকে খুঁজতে গ্রামের সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমার এখনো মনে আছে, নৌকা নিয়ে আমরা কয়েকজন যুবক তখন অগভীর সাগরেও খোঁজাখুঁজি করেছিলাম। খুঁজছিলাম লাল কিছু, কারণ এলিজার পরা ছিল লাল পোশাক। লাশটা পাওয়াই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এলিজার লাশ আর পাওয়া যায়নি। স্ত্রী হারানোর শোকে একেবারে পাথর হয়ে যান ডাক্তার হাডসন। তিনি কেন যেন বিশ্বাস করতেন তার স্ত্রী মারা যায়নি, বেঁচে আছে এবং আবার ফিরে আসবে। যতদিন স্ত্রী ফিরে না আসবে ততদিন তিনি আর হাডসন হিল ছেড়ে যাবেন না, এরকমই সিদ্ধান্ত নেন।
কথা শেষ করে থামলেন ইরফান আলী। এরমধ্যে নাস্তা চলে এসেছে। এই সাগরতীরে মাল্টার জুস তৈরি করেছেন ইরফান আলীর বাসার লোকজন। সাথে আরো ছয় রকমের খাবার। অবাকই হলেন ডাক্তার তরফদার। জুস মুখে দিয়ে বললেন, ডাক্তার হাডসন সময় কাটাতেন কীভাবে? আর ডাক্তার হিসেবে তার যশ-খ্যাতির কারণ কী ছিল?
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন ইরফান আলী। তারপর বলতে থাকলেন, ডাক্তার হাডসনকে আমরা বলতাম জাদুর ডাক্তার। মৃতপ্রায় রোগী তার কাছে গেলে তিনি তাকে সুস্থ করে দিতেন। কীভাবে সম্ভব হতো তা সত্যি ছিল এক বিস্ময়! চিকিৎসক হিসেবে তার হাত ছিল আসলেই অসাধারণ। তার সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে। এক পর্যায়ে এমন অবস্থা হয় যে, সবসময় হাডসন হিলে কমবেশি মানুষ থাকত। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাত্র তিন বছরে তিনি বাংলা বলতে শিখে গিয়েছিলেন। ভাষাগত দূরত্ব কমে যাওয়ার কারণে মানুষের একেবারে মনের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকেন তিনি। ডাক্তার হাডসনের সাথে প্রথম থেকেই আমার কথোপকথন হতো। কারণও ছিল বটে। আমি তখন অল্প অল্প ইংরেজি বলতে পারতাম। যে কয়েকজন প্রথম প্রথম তার সাথে কথা বলত তাদের মধ্যে একজন ছিলাম আমি। বয়সে যুবক হওয়ায় আমার উৎসাহ ছিল বেশি। তবে আমি বেশি যেতে পারতাম না, কারণ আমাকে পড়াশুনার জন্য চট্টগ্রাম থাকতে হতো। হঠাৎ একবার আমার প্রচণ্ড জ্বর হলো। তারপর সমস্ত শরীরে এক ধরনের ফোস্কা উঠতে শুরু করল, ফোস্কাগুলো রূপান্তরিত হতে লাগল বড় বড় ঘায়ে। শরীর যেন আমার পচে যাচ্ছিল, আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সারা শরীর থেকে তখন পুঁজ বের হতো। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল আমি বাঁচব না। মাত্র সাত দিনের মাথায় এমন অবস্থা হয় যে আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছিলাম না। শুধু এটুকু বলব, অনেক কষ্টে চট্টগ্রাম থেকে এসে পৌঁছাই ডাক্তার হাডসনের কাছে। বিশ্বাস করুন, উনার ওষুধের ছোঁয়ায় চিকিৎসা শুরুর দ্বিতীয় দিনেই আমি ফল পেতে শুরু করি। কিন্তু কী অসুখ আমার হয়েছিল, আর কী ওষুধ দিয়েছিলেন তিনি, তা কখনো জানতে পারিনি। তবে ইনজেকশনের কথা মনে আছে। ইনজেকশন আনতে মাঝে মাঝেই চট্টগ্রাম মিশনারি হাসপাতালে যেতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অস্থায়ী সামরিক হাসপাতালের পাশাপাশি স্থানীয় সৈন্যদের জন্য ঐ মিশনারিজটা তৈরি করা হয়েছিল। ওখান থেকে আনা ইনজেকশন ছিল দারুণ কার্যকর। এমনও শোনা গেছে যে মিশনারিজের মাধ্যমে তিনি ব্রিটেন থেকে ওষুধ আনিয়েছিলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল যে, তিনি কারো কাছ থেকে কোনো ফি বা টাকাপয়সা নিতেন না। গ্রামের মানুষজনই তাকে খাবার পাঠিয়ে দিত। তার রোগীরা বিভিন্নরকম খাবার নিয়ে আসত তার জন্য। এখন যে পাহাড়টায় নারকেল বাগানটা আছে ওটা তার নিজের হাতে করা। তার কোনো রোগী তাকে কোনো নারকেল দিলে তিনি সেটা ঐ পাহাড়ে লাগাতেন। ঐ নারকেল গাছের কারণে পাহাড়টার নাম হয়ে যায় কোকোনাট হিল। আর একটা বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল, তিনি মাত্র একবেলা খাবার খেতেন। আর তা হলো দুপুরের ঠিক আগে। স্ত্রী এলিজা মারা যাওয়ার পর থেকে এই অভ্যাসটা গড়ে তুলেন তিনি। ধারণা করা হয়, হয়তো কখনো খাবারের অভাব হবে এরকম চিন্তা করে একবেলা খাবারে অভ্যস্ত হন তিনি। অবশ্য তার জন্য খাবার সংগ্রহ কঠিন ছিল না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে গাছের ডাল কেটে মাখা চোখা করে সমুদ্র থেকে মাছ ধরতে পারতেন তিনি। খুব ভালো সাঁতারুও ছিলেন। এত ভালো সাঁতারু হওয়া সত্ত্বেও স্ত্রী পানিতে ডুবে মারা গেল, এই দুঃখটা কিছুতেই সইতে পারতেন না। তার গলায় তার স্ত্রীর দেয়া স্বর্ণের একটা লকেট ছিল। ঐ লকেটটা খোলা বন্ধ করা যেত। ভিতরে একপাশে ছিল তার ছবি, অন্যপাশে তার স্ত্রীর ছবি। লকেট খুলে দিনে অনেকবার তিনি তার স্ত্রী এলিজার ছবিটা দেখতেন। এলিজার নামের দুটো অংশ ছিল। প্রথম অংশ এলিজা, দ্বিতীয় অংশ ঠিক মনে করতে পারছি না। হয়তো মনে পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। ডাক্তার হাডসনের পানির সমস্যাও ছিল না। হাডসন হিলের গুহা যেটাকে আমরা হাডসন হাউস বলি, ভিতরে ছোট্ট একটা পাথুরে চৌবাচ্চা আছে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ের উপর থেকে পানি গড়িয়ে ঐ চৌবাচ্চায় জমা হয়, অনেকটা ঝরনার মতো। এজন্য ঐ জায়গাটাকে বলা হয় ওয়াটার গার্ডেন বা পানির বাগান। চৌবাচ্চা একবার ভরলে দুইমাস পর্যন্ত পানি খাওয়া সম্ভব হতো। এজন্য বিশুদ্ধ পানির অভাব ছিল না তার।
যাইহোক, ব্যাংকে চাকরি হয়ে গেলে আমি স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম থাকতে শুরু করি। ডাক্তার হাডসনের সাথে যোগাযোগ কমে যায় আমার। তবে গল্প ঠিকই কানে আসতে থাকে। তার সুনাম আর খ্যাতি টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কক্সবাজার পেরিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে যায়। চট্টগ্রামের অনেক রোগী আসত তার কাছে। আসত বার্মা থেকেও। আমিও অনেক রোগী পাঠিয়েছি। বেশ কয়েকজন রোগী ভক্তও হয়ে যায় তার। তারা ঐ গুহার আশেপাশে অস্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করে। এই ভক্তদের মধ্যে একজন ছিলেন পাথর ব্যবসায়ী। নাম মনে নেই। তিনি ডাক্তার হাডসনকে সাদা আর লাল পাথর এনে দেন ভারতের রাজস্থান থেকে। গুহার মধ্যে টাইলসের মতো যে সাদা পাথর আছে সেগুলো ঐ ব্যবসায়ীই এনেছিলেন। ঐ জায়গাটাকে বলা হতো হোয়াইট গার্ডেন বা শ্বেত পাথরের বাগান। লাল আর রঙিন পাথরগুলো বসানো হয় পাহাড়ের উপর। পাথরের ঐ জায়গাটাকে বলা হতো স্টোন গার্ডেন। আপনি বোধহয় ওখানে যাননি?
ডাক্তার তরফদার নড়েচড়ে বসে বললেন, না যাইনি।
পাহাড়ের চূড়ার পুরোটার নাম ‘হিলটপ’। ডাক্তার হাডসন প্রায়ই ঐ হিলটপে বসে চারপাশে তাকিয়ে থাকতেন, যেন তিনি তার স্ত্রীকে খুঁজে ফিরছেন। আমিও বেশ কয়েকবার উঠেছি উপরে। জায়গাটা আসলেই সুন্দর। আর একটা বিষয়, গুহার ভিতরে ডাক্তার হাডসনের যে মূর্তিটা আছে সেটা তিনি নিজে তৈরি করেননি। তৈরি করেছে ইমরান নামের এক যুবক। চিকিৎসা নিতে এসে সে এখানে থেকে যায়। একটানা তিন বছর কাজ করে সে, তারপর চলে যায় ঢাকায়। নামটা মনে আছে, কারণ আমার ঘোট ভাইয়ের নামও ছিল ইমরান, অবশ্য আমার ছোট ভাই বেঁচে নেই। যাইহোক, ঢাকা থেকে ইমরান আর ফিরে আসেনি যদিও সে কথা দিয়েছিল যে ডাক্তার হাডসনের পাশে তার স্ত্রীর একটা পাথুরে মূর্তিও তৈরি করবে। বড় বড় করে নামও লিখে ফেলেছিল পাথরের উপর। ওখানে এলিজার পুরো নামটা পাবেন আপনি। যাইহোক, ইমরান ফিরে না আসায় আর এলিজার মূর্তিটা তৈরি হয়নি। পরে শুনেছিলাম যে, ভাস্কর ইমরান ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল পড়াশুনার জন্য, তারপর আর ফিরে আসেনি। সত্য-মিথ্যা নিশ্চিত করে বলতে পারব না।
কথাগুলো বলে ইরফান আলী কিছুটা সময়ের জন্য থামলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, আমাদের গ্রামে মাহাতাব হাকিম নামের এক ব্যক্তি ছিল। মূলত সে ছিল এই এলাকার অন্যতম ধনী এবং প্রভাবশালী। তার টাকার উৎস ছিল পাহাড়ের সেগুন কাঠ বিক্রি আর তৎকালীন বার্মার সাথে চোরাই মালের ব্যবসা। বার্মা থেকে কেউ কোনো মালামাল আনলে আর তাকে মাসাহোরা না দিলে কক্সবাজার টেকনাফ সড়কে সে নিজের লোক দিয়ে ঐ মালামাল জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিত। সোজা বাংলায় যাকে বলে ডাকাতি। যাইহোক, এই মাহাতাবের স্ত্রী কুলসুম একদিন অসুস্থ হয়ে পড়ে। কী এক রোগে তার পায়ে হাঁটুর নিচ থেকে পচন দেখা দেয়। মাহাতাব ছিল মাঝবয়সি আর কুলসুম ছিল অল্পবয়সি। তবে এটা সত্য মাহাতাব বড় ভালোবাসত কুলসুমকে। তাই তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসে ডাক্তার হাডসনের কাছে। ডাক্তার হাডসন প্রায় দুইমাস তার চিকিৎসা করেন। চিকিৎসার জন্য ডাক্তার হাডসনকে বেশ কয়েকবার মাহাতাবের বাড়িতেও যেতে হয়েছিল। কুলসুম সুস্থ হওয়ার পর মাহাতাব যেন আবার নতুন জীবন ফিরে পায়। নিজেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ডাক্তার হাডসনের প্রতি। কিন্তু জটিলতার উদ্ভব হয় যখন কুলসুমের সন্তান হয়। পুত্রসন্তান হওয়ায় খুশিই হয় মাহাতাব, কিন্তু যখন দেখে সন্তানের চোখ নীল তখন মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা হয় তার। তার ধারণা হয়, ঐ পুত্রসন্তান তার না, ডাক্তার হাডসনের। তা না হলে চোখ নীল হবে কেন? ঐ নীল চোখ নিয়ে গ্রামে বেশ কানাঘুষা চলতে থাকে। বিষয়টা সহ্য করতে পারছিল না মাহাতাব। আবার কিছু করতেও পারছিল না, কারণ গ্রামবাসীর কাছে ডাক্তার হাডসন ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়। তবে গোপনে সে ডাক্তার হাডসনের বিরুদ্ধে একটা জনমত তৈরি করতে থাকে। স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসক, ধর্মীয় নেতা এবং ভণ্ড কয়েকটা ফকির মিলে গুজব ছড়ায় যে ডাক্তার হাডসনের কাছে কোনো নিঃসন্তান নারী রোগী গেলে ডাক্তার হাডসন তাকে অজ্ঞান কিংবা সম্মোহিত করে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেন। গুজবটা চাপাই ছিল, কিন্তু ১৯৫৭ সালের দিকে গুজবটা বেশ জোরালো হয়। কারণ টেকনাফে আরেক মহিলার সন্তানের চোখ হয় নীল। ঐ মহিলা সন্তান জন্ম দেয়ার নয়-দশ মাস আগে চিকিৎসা নিয়েছিল ডাক্তার হাডসনের কাছে। এই সুযোগটা আর হাতছাড়া করেনি মাহাতাব। সে গুজব রটিয়ে দেয় যে, কোনো নারী রোগী ডাক্তার হাডসনের কাছে চিকিৎসার জন্য গেলে হাডসন রাতে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে ঐ নারীর কক্ষে আসে এবং তার সাথে সম্পর্ক করে তাকে গর্ভবতী করে নিজের সন্তান জন্ম দেয়। গ্রাম পর্যায়ের ধর্মীয় নেতারা এই কথাগুলো দ্রুত প্রচার করতে থাকে চারদিকে। মাহাতাব, গ্রামের মাতুব্বর, গোত্রপ্রধানসহ সকলে তখন আসে ডাক্তার হাডসনের কাছে এবং তাকে চলে যেতে বলে এখান থেকে। ডাক্তার হাডসন প্রথমে যেতে না চাইলেও পরে সবার অলক্ষ্যে একদিন সকালে চলে যান হাডসন হিল ছেড়ে। তাই সবাই জানে যে ডাক্তার হাডসন তার নিজ দেশ ইংল্যান্ডে চলে গেছেন। তার চলে যাওয়ার এক মাসের মাথায় আত্মহত্যা করে কুলসুম আর তার নীল চোখের সন্তান। সকালে আমগাছের ডালের সাথে তাদের ঝুলন্ত মরদেহ পাওয়া যায়।
ডাক্তার তরফদার জুস শেষ করেছেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনছিলেন তিনি। বললেন, ডাক্তার হাডসন কত সালে ইংল্যান্ড ফিরে গেছেন?
ইরফান আলী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আসলে কি, ডাক্তার হাডসন দেখতে ছিলেন খুবই সুন্দর। সাগরের পাড়ে তিনি যখন খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তার নীল চোখের দিকে। সত্যি দারুণ হ্যান্ডসাম ছিলেন তিনি। তার পছন্দের পোশাক ছিল নীল পাঞ্জাবি। তখন তো আর এখনকার মতো সুন্দর পাঞ্জাবি ছিল না, তারপরও তিনি ঐ নীল রঙের পাঞ্জাবিই পরতেন। টেকনাফ থেকে একবার বেশকটি পাঞ্জাবি তৈরি করেছিলেন। দুই-একজন আবার উপহারও দিত। তাকে আমি যতদিন দেখেছি অধিকাংশ সময় ঐ নীল পাঞ্জাবি পরাই দেখেছি। যাইহোক, আমারও ধারণা ছিল তিনি ব্রিটেনে চলে গেছেন। চট্টগ্রামে আমার ব্যাংকে তার একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। যদিও অর্থকড়ির প্রতি তার কোনো মোহ ছিল না, ঐ অ্যাকাউন্টটি তিনি করেছিলেন ব্রিটেন থেকে অর্থ আনার জন্য। কয়েকবার এনেছিলেনও, যদিও খুব সময় সাপেক্ষ এবং জটিল ছিল প্রক্রিয়াটা। ঐ অ্যাকাউন্টে তখন কিছু অর্থও ছিল তার। তিনি চলে যাওয়ার সময় নিয়ে যাননি। ভেবেছিলাম হয়তো ফিরে আসবেন এবং এজন্য নেননি। তার চলে যাওয়ার পর মাহাতাব আর গ্রামের মানুষজন হাডসন হিলের চারদিকে এমনভাবে বেড়া দিয়ে দেয় যেন কেউ আর ঐদিকে না যায়। কারণ কয়েকজন নাকি তখন ডাক্তার হাডসনের আত্মাকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল ঐ পাহাড়ে। যারা ঘুরে বেড়াতে দেখেছিল তারা ভাবত যে ডাক্তার হাডসন সমুদ্রে ডুবে মারা গেছেন। তবে তার আত্মা ঠিকই রয়ে গেছে। আসলে তারা ছিল ডাক্তার হাডসনের অন্ধভক্ত। যাইহোক, আমার ব্যাংকে মাহাতাব হাকিমেরও একটা অ্যাকাউন্ট ছিল। কুলসুমের মৃত্যুর পর মাহাতাব কেন যেন তার কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নেয়, দুর্বল হতে থাকে তার ব্যবসা-বাণিজ্য। ডাকাতি করাও বন্ধ করে দেয়। একসময় একেবারে ঘরকুনো হয়ে পড়ে। ১৯৮০ সালের দিকে মাহাতাবের এক সাগরেদ এসে জানায় যে মাহাতাব খুব অসুস্থ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি এবং আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি তখন ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। ব্যাংকের কাজ করে আমি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাই মাহাতাবের সাথে দেখা করার জন্য। আমি তাকে দেখে বড় অবাক হই। শরীর খুব দুর্বল, হাত-পা একেবারে শুকিয়ে গেছে। ডাক্তাররা চেষ্টা করেও সুস্থ করতে পারছিল না তাকে। আমাকে দেখে তার চোখে পানি চলে আসে। সে আমার কাছে জানতে চায় কত টাকা আছে তার অ্যাকাউন্টে। জানাই, প্রায় দুই কোটি টাকা। এরপর মাহাতাব আমাকে যা বলে তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। তার কথার সারমর্ম ছিল এরকম যে, ডাক্তার হাডসন মারা যাননি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। নীল চোখের বাচ্চাটাকে একেবারেই সহ্য করতে পারত না মাহাতাব। বারবার মনে হতো বাচ্চাটা ডাক্তার হাডসনের। কিন্তু সে কিছু করতে পারছিল না। তাই সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিশোধস্বরূপ ডাক্তার হাডসনকে হত্যা করবে। ঐ পরিকল্পনা থেকেই তার যে ডাকাত দল ছিল তাদেরকে সাথে নিয়ে একদিন শেষ রাতে ডাক্তার হাডসনের আস্তানায় হাজির হয়। তারপর গলা কেটে হত্যা করে ডাক্তার হাডসনকে। লাশ সমুদ্রে ফেলে দিলে ভেসে আসতে পারে এই আশঙ্কা থাকায় হিলটপের একেবারে দক্ষিণে মাটি দেয় তাকে। অতঃপর কাটা দিয়ে আটকে দেয় হিলটপে উঠার রাস্তা। পরে যারা তখন গুজব ছড়াচ্ছিল যে ডাক্তার হাডসনের আত্মাকে দেখা যাচ্ছে, তাদের গুজবকে নিজেরাও ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। এতে ঐ সময় সবার মধ্যে দাবি উঠে হাডসন হিলে গমনাগমন নিষিদ্ধ করার জন্য। বাস্তবে তাই ঘটে, চারপাশে বাঁশ আর খেজুরের কাঁটাওয়ালা ডাল ব্যবহার করে বেড়া দেয়া হয়। ফলে কেউ আর যেতে পারত না ওখানে। এদিকে মাহাতাব নির্যাতন অত্যাচার বাড়িয়ে দেয় কুলসুম আর তার ছেলের উপর। বিশেষ করে সন্তানের প্রতি তার নির্যাতন ছিল অসহনীয়। কুলসুম তাকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করে নীল চোখের ছেলেটি তারই। কিন্তু বুঝতে চাইত না মাহাতাব, বরং ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে কুলসুমের উপরও। পরে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে কুলসুম আর তার নীল চোখের ছোট্ট সন্তানকে। রাতে লাশ ঝুলিয়ে রাখে গাছের সাথে। সকালে গ্রামের সকলের উপস্থিতিতে মাটি দেয়। থানা খবর পায় দুই দিন পর। কারো কোনো অভিযোগ না থাকায় থানা পুলিশও দুজন মানুষের মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তবে স্ত্রী আর সন্তানকে হত্যার পর নিজের ভুল বুঝতে পারে মাহাতাব এবং কেমন যেন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে যায়। তার জীবনে ঘটে মারাত্মক ছন্দপতন। সবকিছুতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে এবং ঘরেই সময় কাটাতে থাকে বেশি। বয়স বাড়লে নিজের বাড়িতে একটা ছোট্ট দাঁতব্য হাসপাতাল করার সিদ্ধান্ত নেয় সে, যেখানে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হবে সাধারণ মানুষকে। ঐ হাসপাতালের নাম রাখা হয়। হাডসন হাসপাতাল। হাসপাতালটি চালু হওয়ার আট মাসের মাথায় মারা যায় মাহাতাব। বর্তমানে ঐ হাসপাতালে সাধারণ মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দেয়া হয়। হাসপাতাল তৈরিতে অল্প কিছু টাকা খরচ হয়েছিল, কারণ মাহাতাবের বাড়িতেই হয়েছিল হাসপাতালটি। বাকি টাকা ব্যাংকে ছিল। ঐ টাকা প্রত্যেক ছয় বছরে দ্বিগুণ হয়েছে, সুদে-আসলে গত চল্লিশ বছর ধরে দ্বিগুণ হতে হতে এখন হয়েছে এক শ বিয়াল্লিশ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে বড় একটা হাসপাতাল করা যাবে। কেন যেন মৃত্যুর আগে হাসপাতালটা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার অব অ্যাটর্নির মাধ্যমে আমাকে দিয়ে গিয়েছিল মাহাতাব। ব্যাংকের টাকার নমিনিও করে যায় আমাকে। বয়স হওয়ায় আমি এখন আর পারছি না। একটা কমিটি করে দায়িত্ব তাদের কাছে হস্তান্তর করে দেব আগামী সপ্তাহে।
কথাগুলো বলে ইরফান আলী আবার থামলেন।
ডাক্তার তরফদার জীবনে বহু ঘটনা শুনেছেন। কিন্তু এতটা রোমাঞ্চকর আর হৃদয়বিদারক ঘটনা শোনেননি কখনো। তিনি কী বলবেন ঠিক ভেবে পাচ্ছেন না।
ইরফান আলী আবার বলতে থাকলেন, মৃত্যুর তিন দিন আগে মাহাতাবের অনুরোধে তার সাগরেদরা তাকে কুলসুমের কবরের পাশে নিয়ে যায়। ঐ কবর ছেড়ে মাহাতাব আর ফিরে যায়নি। তিনদিন শুধু সে কুলসুম আর নীল চোখের সন্তানের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। মৃত্যুর পর তার নির্দেশনামতো তার সাগরেদরা কুলসুমের কবরেই মাটি দেয় তাকে। এই হচ্ছে মাহাতাব আর ডাক্তার হাডসনের কাহিনি। সত্যি কথা বলতে কী, ডাক্তার হাডসনের করুণ মৃত্যুর কথা আমিও কাউকে কোনোদিন বলিনি। বলে কী লাভ? কারণ আমিও সত্যটা জেনেছিলাম তার মৃত্যুর তেইশ বছর পর। সম্ভবত তাকে হত্যা করা হয়েছিল ১৯৫৭ সালের দিকে আর মাহাতাব আমাকে বলেছে ১৯৮০ সালে। তাই নিজের মধ্যেই রেখেছিলাম সবকিছু। যেহেতু বয়স হয়ে গেছে, আর বেশিদিন বাঁচব না, তাই জানিয়ে গেলাম আপনাকে। আপনি ইচ্ছা করলে যে কাউকে বলতে পারেন।
কথাগুলো বলে ইরফান আলী এক গ্লাস পানি খেলেন। ডাক্তার তরফদার বললেন, আপনি কি কখনো হিলটপে ডাক্তার হাডসনের লাশ খুঁজে দেখেছিলেন?
না দেখিনি। কারণ অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। ডাক্তার হাডসন নিখোঁজ হওয়ার পর পাকিস্তান আমলে ব্রিটিশ এমব্যাসি থেকে দুইবার এই গ্রামে প্রতিনিধি দল এসেছিল তার খোঁজে। অবশ্য তখন কেউ খোঁজ দিতে পারেনি ডাক্তার হাডসনের। পারবে কীভাবে? কেউ তো জানত না তার মৃত্যুর রহস্যটা, সবাই জানত তিনি ব্রিটেন কিংবা অন্য কোথাও চলে গেছেন। আর আগেই বলেছি আমি নিজে জেনেছি ১৯৮০ সালে। ১৯৮০ সালের আগে আমার ভাবনাও অন্যদের মতো ছিল।
আমি যদি হিলটপে খুঁজে বের করতে চাই ডাক্তার হাডসনের মৃতদেহটাকে?
এতদিনে কি আর লাশের কিছু অবশিষ্ট থাকবে?
আশা করছি কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।
চেষ্টা করতে পারেন।
ডাক্তার তরফদার আরো কিছুক্ষণ কথা বলে বের হয়ে এলেন ইরফান আলীর বাড়ি থেকে। তিনি অনুধাবন করছেন, তার হাত-পা কাঁপছে। দারুণ এক শিহরনে এই মুহূর্তে শিহরিত তিনি। ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, ডাক্তার হাডসনের দেহাবশেষ তিনি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন, নাকি করবেন না।
*
শান্তা এসেছে জেসমিনদের বাসায়। বসে আছে জেসমিনের কক্ষে। জেসমিন একেবারে শুকিয়ে গেছে। আগের সেই সুন্দর চেহারা আর নেই। চোয়ালটা পর্যন্ত চেপে গেছে। তবে পেটটা ফোলা। পেটে যে বাচ্চা আছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
শান্তা বলল, জেসমিন তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না!
জেসমিন মৃদু হেসে বলল, বাচ্চাটা হয়ে গেলে শরীর আবার ঠিক হয়ে যাবে।
মনে হচ্ছে না। বেশি খারাপ হয়েছে তোর শরীর। আর তুই নাকি কোনোকিছু খাওয়াদাওয়াও করছিস না। কেন?
খেতে ভালো লাগে না। মুখের রুচি চলে গেছে।
রুচি চলে গেলেও খেতে হবে।
দেখি, চেষ্টা করব। কলেজের কী খবর?
ঠিকঠাকই আছে সবকিছু। শুধু…
শুধু কী?
রাশেদ ভাইয়ের নতুন প্রেমিকা মুনিরার সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে মুনিরাও নাকি প্রেগন্যান্ট।
সত্যি নাকি?
আমি মুনিরার সাথে কথা বলেছি। সে অবশ্য তোর মতোই, স্বীকার করেনি।
হয়তো মুনিরা সত্য বলছে।
শান্তা খানিকটা রেগে উঠে বলল, এটা কোনো কোনো কথা হলো। রাশেদ ভাই একজনের পর একজনের সাথে প্রেম করবে, শারীরিক সম্পর্ক করবে, তারপর তাকে ছেড়ে চলে যাবে, তা কীভাবে সম্ভব?
জেসমিন এবার শান্তার চোখে তাকাল। তারপর বলল, তুই বোধহয় আমার কথাও ইঙ্গিত করছিস! সত্যি কথা বলতে কি আমার পেটের সন্তান রাশেদ ভাইয়ের না।
তাহলে কার?
নীল চোখের এক ছায়ার। এর বেশি বলতে ইচ্ছে করছে না।
বললে সমস্যা কোথায়? তোর জন্য আজ সবাই চিন্তায় আছে। হেডস্যার আর খালাম্মা কতটা টেনশনে আছে বুঝতে পারছিস? শুধু শুধু সবাইকে কষ্ট দিবি কেন? নামটা বলে ফেল, প্রয়োজনে তাকে বিয়ে করবি।
বিয়ে করতে একটু সময় লাগবে।
কেন?
কারণ মানুষটা বিদেশি।
বিদেশি! ভ্রূ কুঁচকে বলল শান্তা।
হ্যাঁ, শুধু এটুকু জেনে রাখ মানুষটা বিদেশি এবং খুব ভালো। ছায়া হয়ে আসে আমার কাছে।
তোর সাথে বিদেশি কারো পরিচয় হলো কবে? আমি তো কখনো দেখিনি। আর আমাদের এলাকায়ও তো কোনো বিদেশি নেই। ব্যাপারটা কী বল তো! আর ছায়া হয়ে আসবে কীভাবে? এ কথা তুই আগেও বলেছিস। মাথা ঠিক আছে তো তোর?
আর একটু ধৈর্য ধর। আমি তোদর সত্যি সারপ্রাইজ দেব!
অনেক সারপ্রাইজ দিয়েছিস! আর দরকার নেই। তুই বুঝতে পারছিস তোর চারপাশের অবস্থা কতটা সংকটময়! আমার মনে হয়, তুই একটা ঘোরের মধ্যে আছিস অথবা তোকে ভয় দেখিয়ে রেখেছে কেউ। এজন্য কিছু বলতে পারাছস না। ভয়ের কোনো কারণ নেই। আমরা সবাই তোর সাথে আছি। তুই খালি নামটা বল।
জেসমিন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, তুই শুধু শুধু চিন্তা করছিস!
শুধু শুধু চিন্তা করছি না। তুই কি জানিস তোর ছবি দেখে আমেরিকায় থাকা হেডস্যারের এক বন্ধু তার ছেলের সঙ্গে তোর বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
শুনেছি। কিন্তু সে কি জানে আমার পেটে সন্তান আছে?
তা জানে না। আগের ছবি দেখেছে।
যখন জানবে তখন আর বিয়ে করতে চাইবে না।
আমি তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিষয়টা বুঝাতে চেষ্টা করছি। বিয়ে হয়ে গেলে আমেরিকা চলে যেতে পারবি। আর তা না করে এখানে কার সাথে তুই সম্পর্ক করে বেড়াচ্ছিস! কেউ জানেও না, বুঝতেও পারছে না।
আমার জীবন আমার। সবার বুঝার দরকার নেই।
তোর এখনো আঠার বছর হয়নি। মুরব্বির মতো কথা বলিস না।
আঠার বছর হতে হতে বাকি নেই বেশিদিন। বাদ দে এসব কথা, পরীক্ষার ফরম ফিলআপ করেছিস?
না। সামনের মাসে।
আমিও করব।
তুই করে কী করবি? এই শরীর নিয়ে পরীক্ষা দিবি কীভাবে?
সেটা আমার ব্যাপার। ফরম পাঠিয়ে দিস আমার কাছে। পূরণ করে দেব। পরীক্ষার বিষয়টা মাথায় থাকলে দ্রুত সময় কাটবে। তবে এটা সত্য, শরীরটা ভালো না। মাঝে মাঝে তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। তখন পেইনকিলার খেতে হয়। অতিরিক্ত পেইনকিলার নাকি বাচ্চার জন্য ক্ষতিকর। তাই খেতেও পারি না বেশি। সহ্য করতে হয় ব্যথাটা!
ঠিক আছে, তুই যা ভালো মনে করিস। আজ তাহলে আসি। আর কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি। মনে রাখবি, আমি তোর পাশে ছিলাম, আছি এবং থাকব।
শান্তা উঠে গেলে জেসমিন ওষুধ হাতে নিল। তার পেটের ব্যথাটা আবার বাড়ছে। কেন যেন এখন তার হঠাৎ ভয় ভয় করছে, তার ধারণা ব্যথাটা বড় কষ্ট দেবে আজ। এত কষ্ট যা আগে সে কখনো ভোগ করেনি!
*
Leave a Reply