হাডসন হিলে ডাক্তার হাডসনের হাত ধরে হাঁটছে জেসমিন। হাডসন হিলকে আজ বেশি সবুজ মনে হচ্ছে। চারদিকে ছোট বড় প্রত্যেকটি গাছে নতুন পাতা। এ যেন সবুজের মেলা! জেসমিন বলল, আজ এত সবুজ কেন চারপাশটা?
ডাক্তার হাডসন বললেন, কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ছোট ছোট গাছগুলো সতেজ হয়ে উঠেছে। এজন্য সবুজ লাগছে সব।
আগে হাডসন হিল কখনো এতটা সবুজ ছিল না।
তা ছিল না। এতটা সুন্দরও ছিল না।
না না, হাডসন হিল সবসময় সুন্দর।
হয়তো, তুমি যেদিন প্রথম এসেছ সেদিন থেকেই বেশি সুন্দর।
জেসমিন ডাক্তার হাডসনের চোখে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। ডাক্তার হাডসন বললেন, সত্যি জেসমিন তুমি সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর! তুমি
আমার জীবনটাকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছ।
তাই বুঝি!
হ্যাঁ।
তুমি আমাকে এখানে নিয়ে আসছ না কেন?
তুমি কি থাকতে পারবে এই পাহাড়ে, গুহার মধ্যে? মাঝে মাঝে ভয় পাই। বড় কষ্ট হবে তোমার।
তুমি থাকতে পারলে আমি পারব না কেন?
হয়তো পারবে। তবে এখানে বেঁচে থাকাটা একেবারে সহজ না। আমি তো আছি বহুদিন ধরে। তো প্রায় সত্তর আশি বছর। ভ্যস্ত হয়ে গেছি। তবে তোমাকে নিয়ে আসব, দ্রুতই নিয়ে আসব। আর…
আর কী?
ডাক্তার হাডসন টেনে টেনে বললেন, তোমার সন্তানের পরিচর্যা দরকার। এখানে এই জায়গায় আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এজন্য ভাবি চিকিৎসার অভাব হয় কি না।
তুমি ডাক্তার। তুমি থাকতে চিকিৎসার ঘাটতি হবে কেন?
শুধু ডাক্তার থাকলে হবে না। ওষুধপত্র, সরঞ্জামাদি থাকতে হবে। তবে তোমাকে নিয়ে আসার কথা ভাবছি। তোমাকে অবশ্য ধৈর্য ধরতে হবে। অধৈর্য হয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে, এটা ঠিক না।
আসলে মায়ের কথায় বড় কষ্ট পেয়েছিলাম। সহ্য করতে পারছিলাম না আর, ঐদিন আশা করছিলাম তুমিও পাশে থাকবে। কিন্তু তুমি এলে না। তাই একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
হতাশা মানুষকে শেষ করে দেয়। হতাশ হবে না। সামনে আমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ।
জেসমিন খানিকটা অস্থির হয়ে বলল, আমি আর বাড়ি থাকতে চাচ্ছি না। বাড়িতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে। করে না।
কেন?
জানি না, আমি সত্যি এখানে চলে আসতে চাই। তোমার কাছে।
ডাক্তার হাডসন মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, সময় হলেই নিয়ে আসব, চলো আজ তোমাকে পাহাড়ের উপর নিয়ে যাব।
পাহাড়ের উপর।
যে পাহাড়টার নিচে আমাদের গুহা ঐ পাহাড়টার চুড়ায় উঠার একটা পথ আছে। এদিকে মানুষজন না আসায় বহুদিন ধরে বন্ধ আছে পথটা। চলো যাই। তবে ধীরে ধীরে উঠতে হবে, তা না হলে হাঁপিয়ে উঠবে।
পেটে সন্তান নিয়ে কি পাহাড়ে উঠা ঠিক হবে?
আমি আছি, সমস্যা হবে না। খারাপ লাগলে বলবে।
আমার কিন্তু ভয় করছে।
ভয় পাবে না, মনে সাহস রাখো। আর আমি তো আছি।
আসলেই, তুমি থাকলে মনে বড় জোর পাই।
কথা বলতে বলতে পাহাড়ে উঠার পথের কাছে চলে এলো দুজন। পথটা প্রথম দিকে ভালো থাকলেও পরের দিকে অমসৃণ বেশি। ছোট-বড় পাথর অনেক। ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত ধরে রেখেছেন। অসুবিধা হচ্ছে না এগিয়ে যেতে। তবে মাঝপথে বড় একটা চওড়া পাথর থাকায় দাঁড়াতে হলো। পাথরটা প্রায় বুক সমান উঁচু। উপরে উঠতে হলে এই পাথরে উঠতে হবে প্রথমে। ডাক্তার হাডসন বললেন, এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠার ক্ষেত্রে এটাই বড় প্রতিবন্ধকতা। স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষ উঠতে পারবে না। দ্বিতীয় কাউকে টেনে তুলতে হবে। এজন্য এই পাহাড়ের চূড়ায় সবাই উঠতে পারে না। তবে আমি একা উঠতে পারি। কারণ দীর্ঘদিনের চর্চায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি।
ডাক্তার হাডসন পাথরের উপর এতটাই সাবলীলভাবে উঠে গেলেন যে দেখে অবাকই হলো জেসমিন। তারপর তাকে টেনে তুললেন উপরে। দুজন আবার হাঁটতে শুরু করল। দুপাশে এখন বড় বড় সেগুন গাছ। এক-একটা গাছ এত মোটা যে দেখে সত্যি অবাক হচ্ছে জেসমিন। বলল, এই গাছগুলোর বয়স কত হবে?
এক শ বছরের নিচে হবে না।
এক শ বছর!
হু, এক শ বছর তো হবেই। আমি যখন এখানে প্রথম আসি তখনো এই গাছগুলো এমনই বড় ছিল। মাঝের এই বছরগুলোতে শুধু মোটা হয়েছে।
আমি সত্যি অবাক হচ্ছি।
সামনে আরো বড় আর মোটা গাছ আছে। এই গাছগুলো এই পাহাড়ের বিশেষ সৌন্দর্য। একেবারে সবুজ করে রেখেছে চারপাশটা। চলো এগোই।
একসময় হাডসন হিলের চূড়ায় এসে পৌঁছাল দুজন। সামনের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গেল জেসমিনের। নিজের অজান্তেই উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, এত সুন্দর! সাগরটাও অপূর্ব! আর কতদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
হ্যাঁ, সাগর উপর থেকে দেখলে ভালো লাগে।
আমার সত্যি দারুণ লাগছে।
জায়গাটা আমারও পছন্দের। নাম কী রেখেছি জানো? হিল টপ।
সুন্দর নাম।
ঐ পাথরটা দেখতে পাচ্ছ, চলল ওটার উপর গিয়ে বসি।
হ্যাঁ, চলো। পাথরটার নাম কী জানো?
কী নাম?
লাভ স্টোন।
লাভ স্টোন!
হু, এখানে বসলে শুধু একজন অন্যজনকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হবে। তুমি যখন বসবে তখন দেখবে আমার কাঁধে মাথা রেখে বসার ইচ্ছে হচ্ছে তোমার।
জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন ‘লাভ স্টোনের উপর বসল। হাডসন বললেন, একটা কাজ করতে পারি আমরা। এই লাভ স্টোনের উপর আমাদের নাম লিখে রাখতে পারি।
কীভাবে নাম লিখব?
পাথর দিয়ে। আমি তোমার নাম লিখব আর তুমি আমার নাম লিখবে। পারবে?
জেসমিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, অবশ্যই পারব।
ডাক্তার হাডসন ছোট ছোট দুটো চোখা পাথর নিয়ে এলেন। একটা দিলেন জেসমিনকে আর একটা নিলেন নিজে। তারপর দুজনেই পাথরের উপর ঘষে ঘষে নাম লিখতে শুরু করল। জেসমিন লিখছে ডাক্তার হাডসনের নাম, আর ডাক্তার হাডসন লিখছেন জেসমিনের নাম।
পাথরের উপর পাথর দিয়ে লিখতে গিয়ে মাঝে মাঝে বড় পাথরটাতে ছোট পাথর দিয়ে আঘাত করতে হচ্ছে। এতে শব্দ হচ্ছে। সময় যত যাচ্ছে শব্দ যেন তত বাড়ছে। শব্দটা কানে বাজছে, একসময় জেসমিন শব্দটা সহ্য করতে পারল না। দুই হাতে কান চেপে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু শব্দ হচ্ছেই, একই সাথে তাকে কেউ ডাকছেও। কে ডাকছে ঠিক বুঝতে পারল না। যখন চোখ খুলল, বুঝল সে শুয়ে আছে তার ঘরে। আর দরজায় কড়া নেড়ে তাকে ডাকছে তার মা।
তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামল জেসমিন। কখন সকাল হয়ে গেছে টের পায়নি। সিদ্ধান্ত নিল আগে লাল শাড়িটা পালটে ফেলবে। লাল শাড়ির জন্য আজ আর সে বকা খেতে চাচ্ছে না!
*
ডাক্তার তরফদার রাত এগারোটার সময় ঠিকানা পেয়েছিলেন। থানা থেকে একজন সাব-ইন্সপেক্টর এসে দিয়ে গেছে। মোবাইলের সিম রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে আবুল হাসেম নামের একজনের নামে, ঠিকানা কেরানীগঞ্জ। নাম দেখে কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন ডাক্তার তরফদার, সিমটা তাহলে জেহানের নয়। অবশ্য জেহানের বয়স কম, এজন্য তার অভিভাবক কারো সিমটা কিনে দেয়ার সম্ভাবনা বেশি। হয়তো জেহান ব্যবহার করছে। সেক্ষেত্রে তাকে আরো নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হতে হবে। তাই তিনি আর গত রাতে কেরানীগঞ্জ যাওয়ার চিন্তা করেননি। তাছাড়া, রাত হয়ে যাওয়া এবং অতিরিক্ত ক্লান্তির কারণেও যাওয়া সম্ভব ছিল না।
ডাক্তার তরফদার থানার জিডিতে লিখেছিলেন যে, একজন মেয়ে আত্মহত্যা করবে বলে একজন ছেলে তাকে খবর দিয়েছে। এই সংবাদের ভিত্তিতে মেয়েটির জীবন রক্ষা যোক বলে আবেদন করেন জিডিতে। এই জিডি মূলে মোবাইলের রেজিস্ট্রেশন নম্বর জোগাড় করা হয়েছে এবং সংবাদদাতা হিসেবে তাকে দেয়া হয়েছে থানা থেকে। বিষয়টার সম্পূর্ণই আইনগত ভিত্তি রয়েছে। ডাক্তার তরফদার এই বিষয়ে সবসময় সতর্ক থাকেন, আইনের বাইরে কিংবা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয় এরকম কিছু তিনি কখনোই করেন না। গতরাতে সাব-ইন্সপেক্টর এলে তদন্ত শুরু করবে কি না জানতে চায়। ডাক্তার তরফদার সম্মতি দিয়ে বলেছেন, তিনি তদন্ত চান, তবে জেহানের পরিচয় যেন ফাঁস না হয়। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে, জেহান নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায় অথবা জেহানের কোনো মানসিক সমস্যা আছে। এই মানসিক সমস্যার কারণেই তার আগ্রহটা বেশি।
রাতে গাঢ় ঘুম হয়েছে ডাক্তার তরফদারের। সকালে এক কাপ গরম চা খাওয়ার পর একেবারে ঝরঝরে হয়ে গেল শরীর। তিনি আর দেরি করলেন না, চলে এলেন কেরানীগঞ্জে। যে ঠিকানা তাকে দেয়া হয়েছে সেটা একটা দোতলা বাড়ির ঠিকানা। বাড়িটাকে খুব বেশি আধুনিক মনে হলো না। তবে প্রাথমিকভাবে বাড়ির মালিক বিত্তবান বলে ধারণা করলেন তিনি।
ডাক্তার তরফদার সকালেও কয়েকবার কল করেছেন। কিন্তু বন্ধ পেয়েছেন জেহানের নম্বর। তার ধারণা এই বাড়ির আশেপাশেই থাকে জেহান। হঠাৎ তার মনে হলো তিনি অতিআগ্রহ দেখাচ্ছেন কি না। পরে নিজেকে আশ্বস্ত করলেন এই ভেবে যে, না তিনি সঠিক পথেই আছেন। কারণ কিশোরবয়সি জেহান পরপর দুবার তার কাছে সমস্যা নিয়ে এসেছে কিন্তু বলতে পারেনি। তাকে সাহায্য করা তার নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি একজন মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে এই সংবাদও পেয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে ঐ আতাহত্যা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করাও তার কর্তব্য। এজন্য তিনি খুঁজছেন জেহানকে।
বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে একটা মুদি দোকান আছে। পাশে একটা হোটেল। ডাক্তার তরফদার হোটেলের ভিতরে বসে চায়ের অর্ডার দিলেন। যে ছেলেটা চায়ের অর্ডার নিল সে কিশোরবয়সি। তাকে জেহানের কথা জিজ্ঞেস করতে সাথে সাথে বাড়িটা দেখিয়ে বলল, ঐ বাড়িতে থাকে স্যার।
তোমার পরিচিত?
হ স্যার। বাড়ির সবাই প্রায়ই সিঙ্গারা-পুরি নেয় এই হোটেল থাইকা।
তুমি কি জেহানকে ডেকে আনতে পারবে?
আমি ডাকলে আসবে কি না জানি না। তারা মেলা বড়লোক। তয় আমার সাথে পরিচয় আছে, কথাবার্তা অতডা হয় না।
তুমি জেহানকে গিয়ে বলবে যে ডাক্তার তরফদার এসেছে।
ঠিক আছে স্যার।
কী যেন নাম তোমার?
বুল।
ঠিক আছে বাবুল। আর যদি না আসে যেন এখনই আমার সাথে ফোনে কথা বলে। এই যে আমার নম্বর। বিষয়টা বড় জরুরি। বলবে আমি মাত্র পনেরো মিনিট থাকব এখানে, তারপর চলে যাব।
আচ্ছা স্যার।
ডাক্তার তরফদার চায়ের সাথে একটা সিঙ্গারা নিলেন। সিঙ্গারা সত্যি বড় স্বাদের হয়েছে। উপরের অংশে সাদা সাদা, মাঝে আবার পোড়া পোড়া। মুখে দিলে মচমচ করে। আলুর সাথে বাদাম দেয়া হয়েছে, পিয়াজের পরিমাণও বেশি। প্রকৃত সিঙ্গারার যে বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত তার সবগুলোই আছে এই দোকানের সিঙ্গারায়। এরকম সিঙ্গারা এখনকার মানুষ বানাতে পারে না। সবই কেমন যেন কৃত্রিম হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি তিনি অনুভব করেন, দিন যত যাচ্ছে ততই কৃত্রিমতায় ভরে উঠছে পৃথিবী। একদিন ভালোবাসাও কৃত্রিম হয়ে যাবে। কৃত্রিম ঐ ভালোবাসা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে মানুষকে। মানুষ তখন জানবে না, কোনো একদিন এই পৃথিবী ভরপুর ছিল অকৃত্রিম, উপভোগ্য আর অফুরন্ত ভালোবাসায়।
বাবুল ফিরে এলো দুই মিনিট পর। বলল, স্যার আমি কইছি। কিন্তু জেহান ভাইজান কিছু বলে নাই।
ও আচ্ছা। তুমি আমাকে আর-একটা সিঙ্গারা দাও।
জি স্যার।
তবে এখন না, জেহান এলে দেবে।
জেহান ভাইজান আসবে কি না ঠিক জানি না।
আমি জানি আজ সে আসবে।
আইচ্ছা স্যার।
ঠিক চার মিনিট পর জেহান এলো। তার চোখে-মুখে ভয়। ডাক্তার তরফদার নিজেই কাছে ডাকলেন তাকে। বসতে বললেও বসল না প্রথমে। সিঙ্গারা খেতে বললে তখন বসল।
ডাক্তার তরফদার অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি জানেন এইসব ক্ষেত্রে কোন কথা দিয়ে শুরু করলে জেহানের কাছ থেকে কথা বের করা যাবে। তিনি সরাসরি বললেন, মেয়েটি কে যে আত্মহত্যা করবে?
স্যা…স্যা…র…
তাড়াতাড়ি বলে ফেলল। দেরি কোরো না। তুমি যদি তাকে পছন্দও করে থাকো আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাকে সাহায্য করব।
আ…আমি স্যার…
আমি মেয়েটির নাম জানতে চাচ্ছি এবং ঠিকানা।
কাউকে বলবেন না স্যার।
না, বলব না। তুমি আমার সাহায্য চেয়েছ, তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি। এখন বলো মেয়েটির নাম কী, আর ঠিকানা কোথায়?
স্যার নাম জে..জেসমিন। আর ঠিকানা পাশের ঐ বাড়ি।
হাত দিয়ে জেসমিনদের বাড়ি দেখিয়ে দিল জেহান। ডাক্তার তরফদার কিছুটা আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে জেহান আবার চলে না যায়। এখন তিনি নিশ্চিত জেহান যাবে না। কারণ জেহানের জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল জেসমিনের নাম উচ্চারণ করা এবং বাড়ির ঠিকানা বলা। সে কঠিন কাজটা সম্পাদন করেছে। এখন ফলাফল চাইবে। এমনই হয়ে থাকে।
ডাক্তার তরফদারের অনুমানই সত্যি হলো। সিঙ্গারায় কামড় দিয়ে জেহান বলল, স্যার, জেসমিনকে বাঁচাবেন কীভাবে?
আমি ওদের বাড়ি গিয়ে কথা বলব।
জেহান চোখ বড় বড় করে বলল, আমার কথা আবার বলে দেবেন নাকি স্যার?
তোমার কথা কেউ জানবে না।
ধন্যবাদ স্যার, বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
আমি যদি জেসমিনদের বাড়ি যাই, জেসমিনের বাবা-মা কি আমার সাথে কথা বলবেন?
জানি না স্যার। তারা তো বাড়িতে এখন কাউকে ঢুকতে দেয় না।
কেন?
স্যার সত্য কা বলব?
সত্যই তো বলবে।
জেসমিন কীভাবে যেন প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে স্যার।
ডাক্তার তরফদার একটু সময় নিলেন। তারপর বললেন, কে এই কাজটা করেছে?
রাশেদ। আমাদের কলেজের ছাত্র। জেসমিনের সাথে প্রেম ছিল। আগে ঘুরতেও যেত একসাথে। এমনকি রাতে জেসমিনদের বাড়িতেও এসেছে। আমি নিজে দেখেছি। মাঝরাতে পিছনের দেয়াল টপকে বের হয়ে গেছে। কিন্তু এখন আর জেসমিনের খোঁজখবর রাখে না। ফার্স্ট ইয়ারের এক নতুন মেয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর রাজনীতি করছে।
তোমার সাথে কথা হয় জেসমিনের?
আগে হতো। এখন আর হয় না। কয়েকদিন আগে জেসমিন যখন রাতে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল আমি তাকে রক্ষা করেছিলাম। তারপর একবার ফোন করেছিল, ধন্যবাদ দিতে। আর বলেছিল আবার আত্মহত্যা করবে। তখনই আমি আপনার কাছে যাই।
আমাকে চিনলে কীভাবে?
স্যার আমার এক বন্ধুর মা পাগল ছিল। আপনি সুস্থ করে দিয়েছেন। সে আপনার গল্প বলেছে আমাকে। যেদিন জেসমিন ফোন করে আবার আত্মহত্যার কথা বলল, আমার আর ভালো লাগছিল না। তাই আপনার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি।
এখন তো সবকিছু বলতে পারছ।
পারছি স্যার। কিন্তু অনেক সময় অনেক কিছু বলতে পারি না।
জেসমিনকে কি বলেছ তোমার ভালোবাসার কথা?
ডাক্তার তরফদার সরাসরি প্রশ্নটা করলেন জেহানকে।
জেহান মাথা নিচু করে বলল, স্যার, অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।
কেন?
আমার থেকে সে বয়সে বড়।
তাহলে তাকে ভালোবাসো কেন?
মাথাটা আরো নিচু হয়ে গেল জেহানের। বিড়বিড় করে বলল, স্যার আমি জানি না, জেসমিনকে দেখলেই আমার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। জেসমিন এত সুন্দর! স্যার আমি কোনো কথা বলতে পারি না।
তুমি কি জেসমিনকে এখনো ভালোবাসো? মানে জেসমিন অন্য কারো সন্তান ধারণ করছে জেনেও।
এবার জেহান মাথা উঁচু করল। তার চোখে পানি। বিড়বিড় করে বলল, স্যার, আমি জেসমিনকে সবসময়ই ভালোবাসি।
এই কথাটা কি অন্য কেউ জানে?
না স্যার।
জেসমিন কি বুঝতে পারে যে তুমি তাকে ভালোবাসো?
না স্যার।
তাকে তুমি তোমার ভালোবাসার কথা, তোমার ভালোলাগার কথা বলোনি কেন?
ভয়ে বলিনি স্যার। তবে বুঝতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি।
জেসমিন এবং তার পরিবার সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জেনে ডাক্তার তরফদার বললেন, ঠিক আছে তুমি বাসায় যাও। আমি চেষ্টা করব জেসমিনকে বাঁচিয়ে রাখতে, তার আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে। আর হ্যাঁ মনে রেখো, ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়া যতটা না কষ্টের, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারা অনেক অনেক বেশি কষ্টের। এই কষ্টটা এক-দুই দিনের নয়, আজীবনের। তাই বুকের মধ্যে ভালোবাসা চেপে না রেখে প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে মন যেমন হালকা হয়, ভালোবাসায় জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়।
*
ডাক্তার তরফদার এলেন নাজমুল হোসেনের স্কুলে। স্কুলেই ছিলেন তিনি। ডাক্তার তরফদার নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, যে কোনোভাবেই হোক, আমি জানতে পেরেছি আপনার মেয়ে জেসমিন বড় ধরনের সমস্যায় আছে।
নাজমুল হোসেন বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আসলে আপনি কী বলতে চাইছেন?
আমি জেসমিন এবং আপনাদের সাহায্য করতে চাই।
কেন?
মানুষ হিসেবে অন্য একজন মানুষের জীবন বাঁচানো নৈতিক দায়িত্ব। ঐ দায়িত্ববোধ থেকেই বলছি কথাগুলো। আপনার মেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। কোনো কারণে কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে ঐ কারণ দূর না করতে পারলে আবার সে আত্মহত্যার চেষ্টা করবে। একজন মানুষ নিজেই যদি নিজেকে হত্যা করতে চায় কতক্ষণ আপনি তাকে আটকে রাখবেন, বরং তার সমস্যাটা চিহ্নিত করে তা দূর করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আপনি ঠিকই বলেছেন, কিন্তু আমার মনে হয় না জেসমিনের সমস্যা আপনি দূর করতে পারবেন।
চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
তা নেই। কিন্তু আপনি অনেক বড় মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ হবেন নিশ্চয়। আসলে এই চিকিৎসার অনেক খরচ। আমি…
আমি তো আপনার কাছে কোনো খরচ চাইনি।
তারপরও…
অর্থ অনেক কিছু মানি, তবে আপাতত আমার প্রয়োজন নেই। বরং প্রয়োজন একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা। আমি জেসমিনের সাথে কথা বলতে চাই।
জেসমিন তো কারো সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না ইদানীং। এমনকি ওর ছোট ভাইদের সাথেও কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে।
ডাক্তার তরফদার চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, এটা ভালো লক্ষণ না। অর্থাৎ জেসমিন একা হয়ে যাচ্ছে। একাকিত্ব মানুষের বড় শত্রু। মানুষ সামাজিক জীব, মানুষকে একা থাকার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। মানুষ যত একা থাকবে বিষণ্ণতা ততই জেঁকে ধরবে। বাড়বে আত্মহত্যারও ইচ্ছা।
নাজমুল হোসেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, আমার স্ত্রীও চায় না কেউ এখন জেসমিনের সাথে দেখা করুক।
এই কথার অর্থ হলো আপনারা কিছু গোপন করতে চাচ্ছেন।
এখন আর কিছু গোপন নেই, সবই ফাঁস হয়ে গেছে।
তাহলে আমাকে বিস্তারিত বলতে তো আপত্তি থাকা উচিত নয় আপনার। আর আমাকে চিকিৎসার সুযোগও দিতে পারেন। চিকিৎসা না হলে শুধু জেসমিন নয়, আপনার স্ত্রীও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আর ইতিমধ্যে আপনিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, আপনার চোখ ঐরকমই বলছে।
আমার মতো অবস্থা হলে আপনিও মানসিকভাবে ভেঙে পড়তেন।
স্বীকার করছি। এজন্যই সহায়তা করতে চাই আপনাদের।
চলুন তাহলে।
স্কুল থেকে বাড়ি দূরে নয়। দশ মিনিটের হাঁটা পথ। এই দশ মিনিটে ডাক্তার তরফদার যতটুকু পারলেন জেসমিন সম্পর্কে তথ্য নিলেন নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে। শুধু এটুকু অনুধাবন করলেন যে, হেডমাস্টার নাজমুল হোসেন মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত, তবে কাউকে তিনি কিছু বুঝতে দেন না।
বাড়ির একেবারে কাছাকাছি আসতে ডাক্তার তরফদার বললেন, কার সাথে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছিল জেসমিনের?
আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না। কিছুই বলে না জেসমিন।
তারপরও কাউকে না কাউকে তো আপনারা সন্দেহ করছেন?
রাশেদের কথা আপনাকে বলেছি। ওর সাথেই সম্পর্ক ছিল জেসমিনের।
রাশেদ কি জানে যে জেসমিনের পেটে সন্তান আছে?
আমাদের করো সাথে কথা হয়নি। জেসমিনের মা একবার ভেবেছিল রাশেদের পরিবারের সাথে কথা বলবে। কিন্তু নিশ্চিত প্রমাণ নেই আমাদের কাছে। জেসমিন মোটেও সহযোগিতা করছে না। একটু খুলে বললেই হতো। এখন তো আর আমাদের উপায় নেই। বাচ্চার জন্ম দিতেই হবে। সমাজে কী লজ্জায়ই না পড়ব আমরা!
মানুষের জীবনে নানারকম আপদ-বিপদ আসে। আবার এইসব আপদ বিপদ মানুষই মোকাবেলা করে। আপনি এত চিন্তা করবেন না। দেখি কী করা যায়!
বাড়ির বারান্দায় একটা চেয়ারে বসতে দেয়া হলো ডাক্তার তরফদারকে। নাজমুল হোসেন ডাকতে গেলেন জেসমিনকে। জেসমিন অবশ্য বের হতে রাজি হলো না। উলটো রাগ হয়ে বলল, আমাকে বিরক্ত কোরো না বাবা।
তুই একটু বুঝতে চেষ্টা কর।
না, আমি যাব না, আমার মতো থাকব। আর আমাকে নিয়ে তোমরা এত চিন্তা কোরো না। বাড়িতে ডাক্তার আনার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমার শরীরের কোথাও কোনো ব্যথা নেই এখন, আমি সুস্থ আছি।
যিনি এসেছেন উনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
আমার মন ভালো আছে।
কিন্তু আমাদের কারো মন তো ভালো নেই। তোকে বুঝতে হবে ব্যাপারটা। তোর জীবনটা সুন্দর করার জন্য কত কী-ই না আমরা করছি, আর তুই আমাদের সহযোগিতা করছিস না।
জেসমিন তার বাবার চোখে তাকাল। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে সরাসরি এলো ডাক্তার তরফদারের সামনে। একটা চেয়ারে বসে বলল, নিন আমাকে পরীক্ষা করুন। আমার কোনো অসুখ নেই, অথচ সবাই মিলে আমাকে এখন অসুস্থ বানাচ্ছে।
ডাক্তার তরফদার হেসে দিয়ে বললেন, আমি তো তাই বলছি, তুমি অসুস্থ নও, সবাই তোমাকে অসুস্থ বলছে।
তাহলে আপনি এসেছেন কেন?
এসেছি সবাইকে বুঝাতে যে তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
এখন বলে দিন।
ঠিক আছে আমি বলে দিচ্ছি। তুমি কি একটা প্রশ্নের উত্তর দেবে?
কী প্রশ্ন?
নাজমুল হোসেন আর নিলুফার পাশেই ছিলেন। ইশারা করতে তারা দরজার ওপাশে চলে গেলন। ডাক্তার তরফদার বললেন, এই বাসায় তোমাকে কে সবচেয়ে বেশি অসুস্থ মনে করে?
সবাই।
তুমি এখন থেকে একটা কাজ করবে।
কী কাজ?
ঘরের মধ্যে না থেকে বাসার কাজগুলো করবে, কঠিন কাজ না। সহজ কাজগুলো। দেখবে সবাই তোমার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে।
জেসমিন কিছু বলল না। ঝিম মেরে বসে থাকল।
ডাক্তার তরফদার এবার বললেন, তুমি কি আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?
জেসমিন চেয়ার ছেড়ে উঠে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। পুরো পানিটুকু খেলেন ডাক্তার তরফদার। তারপর বললেন, তোমার যখন খারাপ লাগবে তখন তুমি আমার চেম্বারে আসতে পারো। এই যে ভিজিটিং কার্ড। এখানে সবকিছু লেখা আছে। জানি আমার সাহায্য হয়তো তোমার লাগবে না। তারপরও যদি মনে করো আসতে পারো। ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি এখন তোমার ঘরে যেতে পারো।
জেসমিন তার ঘরে চলে গেল। ডাক্তার তরফদারকে নাস্তা করার কথা বললেও অপেক্ষা করলেন না তিনি। বাইরে বের হয়ে এলেন। নাজমুল হোসেনের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বললেন, জেসমিন সুস্থ নয়, মারাত্মক অসুস্থ। অসুস্থতার কারণটা খুঁজে বের করতে হবে। হতে পারে অল্প বয়সে গর্ভবতী হয়ে পড়েছে এজন্য। মারাত্মক অপরাধবোধ কাজ করছে ওর মধ্যে। এজন্য সে মানসিক চাপেও আছে। আজ থেকে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করবেন না ওর সাথে। আচরণ এমন করবেন যেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। বরং আপনারা খুশিই হয়েছেন তার পেটে সন্তান আসার জন্য, ব্যাপারটা যেন এমন থাকে। আর হ্যাঁ, জেসমিনের দুজন বান্ধবীর নাম আমাকে দেবেন যারা ওর খুব ঘনিষ্ঠ। আমি কথা বলতে চাই ওদের সাথে। আসি।
নাজমুল হোসেন কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখ দিয়ে পানি আসে আসে অবস্থা।
ডাক্তার তরফদার চলে আসার সময় ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারলেন না, পুরোটা সময় ছাদের উপর থেকে তার উপর নজর রাখছিল জেহান।
*
ডাক্তার তরফদার বাসায় এসে লম্বা একটা ঘুম দিলেন। শরীরটা তার ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগে। কারণটাও বুঝতে পারছেন না। শরীরে তার তেমন কোনো রোগ নেই। নেই ডায়াবেটিসও। তবে লক্ষণটা মনে হচ্ছে ডায়াবেটিসের। রক্তে গ্লুকোজ মাপার একটা ডিজিটাল মেশিন আগে থেকেই বাসায় ছিল। ঐ মেশিনে রক্তের গ্লুকোজ মাপলেন তিনি। মাত্র চার দশমিক এক। বুঝলেন শরীরে শর্করার অভাবে এমন হচ্ছে। তার অন্যতম একটা প্রিয় খাবার হলো পোলাওয়ের চালের পাতলা জাউ আর শুকনো মরিচ পিয়াজ দিয়ে বানানো ঝলবেশি আলুভর্তী। ঠিক করলেন আজ তিনি তার প্রিয় খাবারটা খাবেন। কিন্তু করিম চাচার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। বাইরে বের হয়ে এসে দেখলেন বাগানেও নেই। করিম চাচাকে নিয়ে এই একটা সমস্যা। হুটহাট বাইরে চলে যায়। বাড়ির কুকুর ভুলু তাকে দেখে শুধু লেজ নাড়ছে। ভুলুও মাঝে মাঝে করিম চাচার সাথে বাইরে চলে যায়। তবে আজ যায়নি। বাড়িতেই আছে।
ডাক্তার তরফদার ঠিক করলেন তিনি আজ পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ খাবেনই। প্রয়োজনে নিজে রান্না করবেন। অবশ্য রান্নাঘরে এসে বড় অবাক হলেন। করিম চাচা তার জন্য পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ বেঁধে রেখেছে। আলু ভর্তাও করেছে, সাথে শুকনো মরিচ ভর্তা। করিম চাচার এই ক্ষমতাটা অসাধারণ। সে বুঝতে পারে মানুষ ভবিষ্যতে কী চায় কিংবা মানুষের জীবনে কী ঘটতে যাচ্ছে। একেবারে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে করিম চাচা। পৃথিবীতে তার মতো এতটা নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে এমন কোনো মানুষ নেই বলেই বিশ্বাস করেন ডাক্তার তরফদার। অবশ্য তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো সে নিজেই করে, অন্য কেউ জানতে চাইলে কখনোই বলে না। তার একটাই কথা, ভবিষ্যৎ জানতে চেও না, নিজের ভবিষ্যৎ নিজে গড়ে নাও।
পোলাওয়ের চালের সাদা জাউ তৈরি করার বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। দুই লিটার পানিতে এক মুঠো সুগন্ধী পোলাওয়ের চাউল নিতে হবে। তারপর সিদ্ধ করতে হবে ধীরে ধীরে। একসময় সম্পূর্ণ চাল পানিতে গলে যাবে, হবে অনেকটা স্যুপের মতো। ইচ্ছে করলে একটা সিদ্ধ ডিম গুলিয়ে নেয়া যেতে পারে। তারপর নিতে হবে একটা বাটিতে, সাথে শুকনো মরিচের ঝাল ঝাল আলুভর্তা থাকবে। বাটিতে যখন জাউ ঢালা হবে তখন যেন ধোয়া উড়ে জাউ থেকে, নাকে এসে লাগা বাসনা ক্ষুধাকে আরো চাঙা করে তুলবে। অতঃপর একটা চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে খেতে হবে। স্বাদ হবে একেবারে অমৃতের মতো।
ডাক্তার তরফদার বাটিতে জাউ নিয়ে নিজের চেম্বারে এসে বসলেন। বেশ সময় নিয়ে তিনি জাউ খেতে শুরু করলেন। স্বাদ সত্যি অসাধারণ। তার থেকে বড় কথা দুর্বলতা কেটে গেছে। নিজেকে সম্পূর্ণ সতেজ মনে হচ্ছে তার। তাই একটা কাগজ টেনে জেসমিন বিষয়ে লিখতে শুরু করলেন
জেসমিন সম্পর্কে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে তা পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে জেসমিন গর্ভবতী। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো কে তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে তা সে বলতে চাচ্ছে না। একজন মেয়ে সাধারণত এ ধরনের তথ্য লুকিয়ে রাখে না। রাখতে পারে তখনই যখন তাকে ভয় দেখানো হয় কিংবা সে নিজেই বিশ্বাস করে না যে সে গর্ভবতী। যেহেতু আলট্রাসনোগ্রামে বাচ্চার অবয়ব স্পষ্ট দেখা গেছে বলে জানিয়েছেন তার বাবা সেক্ষেত্রে সে যে গর্ভবতী, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাহলে কে তাকে ভয় দেখাচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন। কারণ তার আশেপাশে এমন কেউ নেই যে তাকে ভয় দেখাতে পারে। রাশেদের সাথে তার সম্পর্ক ছিল ঠিকই, কিন্তু রাশেদ যে তাকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু রাশেদের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে জেসমিনের, কারণটা কী? হতে পারে ঐ গর্ভের সন্তান। রাশেদ হয়তো চাচ্ছে সন্তানকে মেরে ফেলতে, জেসমিন চাচ্ছে না। পৃথিবীতে কোনো নারীই চায় না তার গর্ভে সৃষ্ট হওয়া কোনো মানব ভ্রুণের মৃত্যু হোক। এজন্য হয়তো রাশেদ আর জেসমিনের মধ্যে মনোমালিন্য চলছে। জেসমিন হয়তো চেষ্টা করছে রাশেদকে বোঝনোর জন্য যে সন্তানকে সে জন্ম দিতে চায়। রাশেদ রাজি না হওয়ায় হতাশাগ্রস্ত সে। এই হতাশা থেকেই আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। এই মুহূর্তে তার জীবন রক্ষার অন্যতম উপায় রাশেদ আর তার মধ্যে মিল করিয়ে দেয়া। এক্ষেত্রে কথা বলতে হবে রাশেদের সাথে। রাশেদ সবকিছু স্বীকার করবে কি না সন্দেহ আছে। কারণ রাশেদ ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে চাচ্ছে এখন। সম্পর্কের বিষয়ে আরো নিশ্চিত হতে জেসমিনের ঘনিষ্ঠ কোনো বান্ধবীর সাথেও কথা বলা প্রয়োজন। তবে সবার আগে দরকার জেসমিনের উপর নজর রাখা। আত্মহত্যার চেষ্টা প্রতিহত করার জন্য নজরদারি বড় জরুরি। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে জেহান। জেহান সত্যি ভালোবাসে জেসমিনকে। কিন্তু জেসমিন জেহানকে ভালোবাসে না, ভালোবাসার সম্ভাবনাও কম। কারণ জেহান বয়সে ছোট। বাংলাদেশি সংস্কৃতিতে একজন মেয়ে সাধারণত তার থেকে কম বয়সি একটি ছেলেকে ভালোবাসার মানুষ কিংবা স্বামী হিসেবে ভাবতে অভ্যস্ত নয়। জেহানকে আজ জানানো হয়েছে যে ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়া যতটা না কষ্টের, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করতে না পারা অনেক অনেক বেশি কষ্টের। এই কষ্টটা এক-দুই দিনের নয়, আজীবনের। তাই বুকের মধ্যে ভালোবাসা চেপে না রেখে প্রকাশ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এতে মন যেমন হালকা হয়, ভালোবাসার জয় হওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবে মনে হবে এমন কিছু কথা জেহানকে বলা ঠিক হয়নি, কিন্তু যৌক্তিকতা আছে। জেহানের বয়স এখনো আঠারো হয়নি। সে বয়ঃসন্ধিকালে আছে, টিনএজার। জেসমিনের প্রতি মারাত্মক দুর্বল। এই দুর্বলতা পরবর্তীকালে তার নিজের মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। সে যদি এখনই প্রত্যাখ্যাত হয় তাহলে তার নিজের মধ্যে আফসোস থাকবে না, অন্তত এই ভেবে মানসিক শান্তি পাবে যে সে চেষ্টা করেছে। পাশাপাশি জেসমিনের প্রতি তার মোহ কেটে যাবে। এই মোহ কেটে যাওয়াটা বড় জরুরি। মোহ কাটার অন্যতম উপায় ভালোলাগার কথাটা জেহানকে দিয়ে বলানো। এজন্য ভালোবাসায় প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কথাগুলো বলা হয়েছে জেহানকে। তবে জেহান জেসমিনকে ভালোবাসার কথা বলতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ জেহান তুলনামূলকভাবে ভীতু ধরনের ছেলে। এই ভয়ই তার অস্থিরতা আর কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেভাবেই হোক এই ভয় আর অস্থিরতা তাড়াতে হবে। তা না হলে জেহান নিজেও অস্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করবে। যাইহোক, এখন মূল বিষয় হচ্ছে জেসমিনের গর্ভের সন্তানের পিতা কে তা খুঁজে বের করা। এজন্য জরুরি হলো রাশেদ এবং জেসমিনের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে কথা বলা।
ডাক্তার তরফদার কলম রেখে আবার মনোযোগী হলেন জাউয়ের প্রতি। লেখায় অতিরিক্ত মনোযোগ থাকার কারণে শেষের দিকে জাউ খেতে ভুলে গিয়েছিলেন। ঠান্ডা হয়ে গেছে জাউ। চুলা থেকে আবার গরম জাউ নিয়ে এলেন। এসে বসলেন বারান্দায়। ভুলু তার পায়ের কাছে এসে কুঁইকুঁই করতে লাগল। তিনি বুঝলেন ক্ষুধা লেগেছে ভুলুরও। কুকুর জাউ খায় কিনা, ভাত খায় কিনা, ঠিক মনে করতে পারলেন না। তিনি উপলব্ধি করলেন, অনেক কিছুই তার ইদানীং মনে থাকে না, এটা ভালো লক্ষণ না।
ডাক্তার তরফদার পোলাওয়ের চালের জাউ এনে দিলেন ভুলুকে। জাউ থেকে ধোঁয়া উড়ছে, ভিতরে ঝাল আলুভর্তাও আছে, সুগন্ধ ছড়াচ্ছে চারদিকে। ভুলু বারবার শুঁকে ঘ্রাণ নিচ্ছে।
তিনি ভুলুকে বললেন, ভুলো খেয়ে দ্যাখো, রাজকীয় জাউ, অনেক আগে রাজা-বাদশাহরা খেত।
রাজা-বাদশা শব্দ শুনে লেজ নাড়াতে লাগল ভুলু। তারপর চার পায়ে খুব আরাম করে বসল। জাউ এখন তার মুখের সামনে।
ডাক্তার তরফদার এবার বললেন, খেয়ে নাও।
ভুলু নিচে তাকাল, জিহ্বাটা দিয়ে হালকা স্পর্শ করল জাউ। তারপর খেতেই থাকল, জাউ শেষ করতে খুব একটা সময় লাগল না তার। খাওয়া শেষে ঘেউঘেউ করে উঠল। বোঝা গেল আরো চায়।
ডাক্তার তরফদার উঠে গিয়ে পুরো জাউটুকু নিয়ে এলেন। তারপর ঢেলে দিলেন ভুলুর বাটিতে।
ভুলু মহাখুশি। লাফ দিয়ে উঠে দুবার চক্কর দিল ডাক্তার তরফদারের পাশে। তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে বসে পোলাওয়ের চালের রাজকীয় জাউ খেতে শুরু করল।
ডাক্তার তরফদার হাতের বাটি থেকে নিজেও এক চামচ জাউ মুখে দিলেন। আজ জাউটা বেশি স্বাদের হয়েছে। কারণ করিম চাচা খাঁটি ঘি দিয়ে বানিয়েছেন আলুভর্তা! আর খাঁটি ঘিয়ের যে কোনো খাবারই বড় স্বাদের হয়!
*
ডাক্তার তরফদার শান্তার সাথে কথা বলতে কলেজে এসেছেন। শান্তার ফোন নম্বর তিনি জোগাড় করেছেন জেহানের কাছ থেকে। নিজেই ফোন করে সময় নিয়েছেন। এখন কথা বলছেন লাইব্রেরিতে বসে। প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে প্রশ্ন করলেন ডাক্তার তরফদার, জেসমিনের সাথে তোমার পরিচয় কতদিনের?
শান্তা ঠোঁট কামড়ে বলল, স্যার কলেজে উঠে পরিচয়।
আমি যতদূর জেনেছি তোমার সাথেই জেসমিন সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল।
জি স্যার। কলেজে আসার পর আমরা দুজন একসাথেই থাকতাম, পাশাপাশি বসতাম, ঘুরতাম, চা-নাস্তা খেতাম।
জেসমিনের সমস্যাটা তুমি নিশ্চয় শুনেছ?
জি স্যার শুনেছি। কথা বলতেও গিয়েছিলাম। কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। বারবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর বাচ্চার বাবা কে? সুনির্দিষ্টভাবে কোনো উত্তর দেয়নি। খালাম্মা মানে জেসমিনের মা-ই আমাকে অনুরোধ করে বলেছিলেন যেন আমি বাচ্চাটার বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল ও খুব বিরক্ত।
কেন?
জানি না স্যার। হয়তো কিছু লুকাতে চাচ্ছে। অবশ্য লুকাবেও বা কেন? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
রাশেদের সাথে সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল জেসমিনের?
আমি ওকে নিষেধ করতাম। কিন্তু ও শুনত না। মাঝে মাঝে রাশেদ ভাইয়ার মোটরসাইকেলে করে অজানা কোথাও চলে যেত। জিজ্ঞেস করলে বলত না। শেষের দিকে ওদের ভালোবাসা এতটাই গম্ভীর হয়েছিল যে ক্লাস বাদ দিয়ে মোেটরসাইকেলে ঘুরত জেসমিন।
রাশেদ ছেলেটা কেমন?
প্রথমে ভালোই ছিল। মাস দুয়েক ধরে একেবারে পালটে গেছে। রাজনীতিতে ঢুকেছে। এখন একটা গ্রুপের নেতা সে। সবসময় ছয়-সাতজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে থাকে। শুনেছি স্থানীয় বাজারে চাদাবাজিও করে। কয়েকদিন আগে বাজারের দোকান মালিক সমিতির সাথে মারামারিও হয়েছে। থানায় জিডি হয়েছে। আর…আর…
আর কী?
জেসমিনকে বোধহয় ভুলে গেছে। খোঁজখবর নেয় বলে মনে হয় না। আর একটা মেয়ের সাথে ঘুরতে দেখি ইদানীং। মেয়েটা অবশ্য সুবিধার না। ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে হলেও আগেও একজনের সাথে প্রেম করেছে।
ডাক্তার তরফদার বুকের মধ্যে আটকে রাখা দমটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, তোমার কি মনে হয় রাশেদই জেসমিনের বাচ্চার বাবা?
অন্য কেউ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ জেসমিনকে একমাত্র রাশেদ ভাইয়ের সাথেই ঘুরতে দেখেছি। কিন্তু একটা যুক্তি মিলছে না।
কী যুক্তি?
জেসমিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওর বাচ্চা রাশেদের কি না। জেসমিন স্পষ্টভাবে বলেছে ‘না’। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম বাচ্চাটা কার তাহলে? মৃদু হেসে বলেছিল, আমি কারো জন্য বিপদের কারণ হতে চাই না, সব দায়িত্ব আমার। শুনে রাখ, বাচ্চাটার বাবা এমন কেউ যে তুই কল্পনাও করতে পারবি না। সময় হলে বাচ্চার বাবা ঠিকই বাচ্চার দায়িত্ব নেবে। আপাতত ধরে রাখ বাচ্চাটার বাবা এক মূর্তি যে কিনা আমাকে খুব ভালোবাসে। ছায়া হয়ে আমার কাছে আসেও।
মূর্তি কীভাবে বাচ্চার বাবা হবে? আবার ছায়া হয়ে আসবে? তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না।
কীভাবে বুঝবেন স্যার? জেসমিনের কথা তো আমিও বুঝিনি। আর এখন তো আরো বোঝা যায় না। সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকে।
জেসমিনের এই পরিবর্তনটা তোমার কবে থেকে চোখে পড়েছে?
কোন পরিবর্তন?
জেসমিনের নিশ্চুপ হয়ে যাওয়া, বিষণ্ণতায় ভোগা, কারো সাথে কথা না বলা।
শান্তা খানিকটা সময় নিয়ে বলল, স্যার মনে করতে পারছি না। সম্ভবত যখন থেকে বুঝতে পারে যে তার পেটে বাচ্চা আছে তখন থেকেই সে বেশি চুপ হয়ে যায়। তবে কক্সবাজার থেকে আসার পর পরিবর্তনটা চোখে পড়ে আমার। মাঝে মাঝে কী যেন ভাবত, অন্যমনস্ক হয়ে যেত।
ধন্যবাদ তোমাকে, আমার আর তেমন কিছু জানার নেই। নতুন কোনো তথ্য থাকলে আমাকে জানাবে। এই যে ভিজিটিং কার্ডে আমার ফোন নম্বর আছে। আর হ্যাঁ, তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে আমি জেসমিনকে সাহায্য করতে চাই। যখন এই বিশ্বাসটা তোমার মধ্যে জন্মাবে তখন দেখবে অনেক নতুন তথ্য তোমার মাথায় আসছে।
স্যার আমি আপনাকে বিশ্বাস করি।
আমি জানি। তারপরও তোমাকে বললাম যেন তুমি, আমি, আমরা সবাই মিলে জেসমিনকে সুস্থ করে তুলতে পারি।
জি স্যার।
ডাক্তার তরফদার রাশেদের সাথেও কথা বলবেন বলে ঠিক করেছেন। কলেজে একটা হোস্টেল আছে, রাশেদের সাথে দেখা করতে হোস্টেলে যেতে হবে। হাতে এখনো বিশ মিনিট সময় আছে। রাশেদ তার সাথে কেমন ব্যবহার করবে সেটা নিয়ে তিনি খানিকটা শঙ্কিত। কারণ জেসমিনের প্রতি তার আর টান নেই বলে তার ধারণা।
বিশ মিনিটের মধ্যে ডাক্তার তরফদার দুজন ছাত্রের সাথে কথা বললেন। মূল বিষয়-কলেজের রাজনীতি। রাজনীতির কথা বলতে রাশেদের কথাও এলো, তার চাঁদাবাজির কথা বলতেও ভুলল না দুই ছাত্রের কেউ। একই সাথে জানাল সে কলেজের জন্য একটা ত্রাস হয়ে উঠছে। নতুন যে হোস্টেল নির্মিত হবে, ঠিকাদারির কাজ নাকি তার পছন্দের মানুষকেই দিতে হবে। কলেজের একজন ছাত্র কীভাবে ঠিকাদার ঠিক করবে তা ঠিক বুঝতে পারলেন না ডাক্তার তরফদার। দিনে দিনে শিক্ষাব্যবস্থা যে একটি গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে এই ঘটনা যেন তারই উদাহরণ।
কলেজে মাঠের পাশে বড় একটা আমগাছ আছে। সেই গাছের নিচে কথা বলতে শুরু করলেন ডাক্তার তরফদার আর রাশেদ। নিজের পরিচয় দিয়ে ডাক্তার তরফদার বললেন, আমি তোমার কাছে এসেছি শুধু একজন মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য, তোমার উপর কোনো চাপ সৃষ্টি কিংবা তোমার চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করার জন্য নয়। যদিও বিষয়টি তোমার ব্যক্তিগত, তোমার কাছে জানতে চাইব তুমি কেন জেসমিনকে ছেড়ে চলে এসেছ?
রাশেদ সরু চোখে তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। তারপর টেনে টেনে বলল, জেসমিনই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
তাই বুঝি!
জি স্যার। আমাকে সে চিঠিও লিখেছে, এসএমএস দিয়েছে। সবই আছে আমার কাছে। হঠাৎ আমার ফোন ধরা বন্ধ করে দেয় সে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও একদিন রাতে দেয়াল টপকে আমি ওর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এরপর বোধহয় দুবার ফোনে কথা হয়েছে আমাদের। আমিই ফোন করেছিলাম। এখন আর আমার ফোন ধরে না।
ডাক্তার তরফদার বড় অবাক হলেন। রাশেদের কণ্ঠ আর চোখের ভাষা শুনে বুঝতে পারছেন রাশেদ সত্য কথা বলছে।
রাশেদ আবার বলল, স্যার, তবে এখন আর আমার কোনো আগ্রহ নেই জেসমিনের প্রতি।
কেন?
সত্যমিথ্যা জানি না। তবে শুনেছি ও প্রেগন্যান্ট। তার মানে কী? নিশ্চয় কারো সাথে ওর সম্পর্ক আছে!
অনেকে বলছে, এই সন্তান তোমার।
কথাটা শোনার পর রাশেদের রেগে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রাগল না। বলল, স্যার সবাই বলবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ জেসমিন আমার সাথে ঘুরেছে, আমার মোটরসাইকেলে উঠেছে, আমরা দূরেও গেছি ঘুরতে। তবে এটা সত্য আমাদের কোনো শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। অবশ্য…
অবশ্য কী?
শেষ যখন জেসমিনের সাথে আমার দেখা হয়, মানে যে রাতে আমি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলাম, জেসমিন আমাকে বলেছিল যে নীল চোখের ছায়াকে ভালোবাসে, আমাকে না।
নীল চোখের ছায়া কী?
জানি না স্যার। তবে ‘ছায়া’ শব্দটা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করেছে ও। ঐ দিনের পর আমি জেসমিনের সাথে একবার ফোনেও কথা বলেছিলাম, জিজ্ঞেস করেছিলাম তার প্রেগন্যান্সির বিষয়টি। বেশ সাবলীলভাবে সে বলেছিল যে তার পেটের বাচ্চা নীল চোখের ছায়ার বাচ্চা। ঐ দিনও জিজ্ঞেস করেছিলাম, নীল চোখের ছায়া আবার কী? বলেছিল, তার মনের মধ্যে একটা জোছনা আছে, সেই জোছনায় একটা ছায়া আসে। ছায়াটার চোখ নীল। ঐ নীল চোখের ছায়াটাই তার সন্তানের বাবা। পেটের ঐ সন্তানকে সে খুব ভালোবাসে এবং সে চায় সন্তানের জন্ম হোক। যেহেতু আমি ঐ সন্তানের বাবা না, তাই আমাকে সে তার কাছে যেতে বারণ করেছে। আরো বলেছে সে দ্রুতই চলে যাবে নীল চোখের ছায়ার কাছে। ঐ ছায়া নাকি থাকে সমুদ্রের তীরে, পাহাড়ের ঢালে। জেসমিনের কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল ও পাগল হয়ে গেছে। কথা বলার সময় কেমন যেন উদাস হয়ে যাচ্ছিল। তবে ওকে আমার মোটেও চিন্তিত মনে হয়নি। বরং মনে হচ্ছিল ঐ নীল চোখের ছায়ার কাছে যাওয়ার আনন্দে সে বিভোর। যেহেতু আমার প্রতি ওর আর কোনো আগ্রহ নেই, এজন্য আমিও আর ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি না। ধীরে ধীরে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছি।
তুমি কি জেসমিনের কথা বিশ্বাস করেছ?
জেসমিন নিজের মুখে আমাকে বলেছে।
ডাক্তার তরফদার লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, রাশেদ ধন্যবাদ তোমাকে। আমি চলে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে তোমাকে বলে যাই, সাবধানে থেকো, আর এই বয়সে রাজনীতিতে এতটা সম্পৃক্ত হবে না। বয়সটা পড়াশুনার। রাজনীতি করার জন্য সামনে অনেক সময় পাবে। তখন রাজনীতি করতে পারবে। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো।
ফিরে আসার সময় ডাক্তার তরফদার বড় চিন্তায় পড়লেন। কারণ তিনি নিশ্চিত রাশেদ তাকে মিথ্যা বলেনি। মানুষের কথা বলার ধরন আর দৃষ্টি দেখলে অনেকটাই বুঝতে পারেন তিনি। তাছাড়া কথাবার্তায় খুব সাবলীল ছিল রাশেদ। এরকম সাবলীলতা দিয়ে মিথ্যাকে ঢেকে রাখার ক্ষমতা মানুষের নেই বললেই চলে। তারপরও এখনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়নি, রহস্যের আরো গভীরে প্রবেশ করতে হবে-উপলব্ধি করলেন তিনি। আর কয়েকটা শব্দ তার মাথায় ঘোরাফেরা করতে লাগল। এই শব্দগুলো হলো নীল চোখ, ছায়া, পাহাড়, সমুদ্র, মূর্তি।
*
শেষ রাত। হাডসন হিলে সাগরের তীর ধরে হাঁটছে জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন। বরাবরের মতো জেসমিনের পরা লাল শাড়ি আর ডাক্তার হাডসন পরেছে নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। বাতাসের গতি আজ তুলনামূলকভাবে বেশি। এজন্য ভালোলাগাটাও যেন বেশি উপভোগ্য। দেখা হওয়ার পর দুজন প্রথমে বেশ কথা বলেছে। কিছুক্ষণ হলো চুপচাপ হাঁটছে।
বড় একটা ঢেউ পায়ে আছড়ে পড়তেই ডাক্তার হাডসন বললেন, কেমন লাগছে তোমার?
জেসমিন মিষ্টি হেসে বলল, অসাধারণ!
আমারও খুব ভালো লাগছে।
সত্যি?
হ্যাঁ, তোমার পাশে থাকতে, তোমার হাত ধরে হাঁটতে বড় ভালো লাগে।
হাত তো আজ ধরোনি তুমি!
ডাক্তার হাডসন মিষ্টি করে হাসলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে জেসমিনের বাম হাত ধরে বললেন, এই তো ধরলাম।
এই হাত আর ছাড়বে না।
ছাড়তে চাইও না।
জেসমিন এবার বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আর এই হাডসন হিল থেকে যাব না।
ডাক্তার হাডসন ভ্রু কুঁচকে বললেন, কেন?
এই হাডসন হিল আমার দারুণ পছন্দের। আমার চিন্তা-চেতনা আর স্বপ্নে যে স্বর্গ, সেই স্বর্গ হলো হাডসিন হিল। যতদিন বেঁচে থাকব, এখানেই থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোমার পাশে, তোমারই পরশে।
কী সুন্দর করে কথা বলছ তুমি আজ!
জেসমিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, এখানে এলে আমার কেন যেন দারুণ ভালো লাগে। ভালোলাগাটা আরো বাড়ে যখন তুমি পাশে থাকে। এজন্য বলতে পারো, এই হাডসন হিলের প্রেমে পড়ে গেছি।
ডাক্তার হাডসন চোখ বড় বড় করে বললেন, হাডসন হিলের প্রেমে পড়লে আমার কী হবে?
হাডসন হিল তো তোমারই। হাডসন হিলের প্রেমে পড়া মানে তোমার প্রেমে পড়া। তুমি অনুমতি দিলে আমি চলে আসব।
হঠাৎ এখানে আসার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছ কেন?
বাড়িতে না আমার আর ভালো লাগে না। সবাই জেনে গেছে যে আমার পেটে একটা বাচ্চা আছে। বাচ্চাটা যে তোমার তা আমি কাউকে বলতে পারছি না।
বলছ না কেন?
কারণ তুমি আমার সাথে আমাদের বাড়িতে থাকো না। তুমি থাকো এই হাডসন হিলে। কেউ বিশ্বাস করবে না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখানে চলে আসব। তখন যে কেউ এলে দেখতে পাবে তোমাকে। ইদানীং বড় খারাপ লাগছে বাবা-মায়ের জন্য। বড় কষ্ট পাচ্ছে তারা। অহেতুক সন্দেহ করছে রাশেদ ভাইকে।
রাশেদ ভাই কে?
আমাদের কলেজের বড় ভাই। সে আমাকে খুব পছন্দ করত। আমরা দূরে ঘুরতেও গিয়েছিলাম। তোমাকে সবকিছু খুলে বলছি এ কারণে যে
আমি তোমার কাছে কিছু লুকাতে চাই না। রাশেদ ভাইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছিল সত্যি, তবে তা জোরালো ছিল না। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমি অনুধাবন করি, আমার ভালোবাসাটা মূলত তোমারই জন্য।
ডাক্তার হাডসন কিছু বললেন না। চুপ থাকলেন।
জেসমিন আবার বলল, তুমি কি আবার আমার উপর রাগ করলে? তোমাকে আমি সরল মনে সবকিছু খুলে বলেছি।
মৃদু হাসলেন ডাক্তার হাডসন। বললেন, না জেসমিন, রাগ করিনি। বরং তোমার স্পষ্টবাদিতা এবং সরলতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমারওতো স্ত্রী ছিল, তাকে বড় ভালোবাসতাম। তুমি সবই জানো। এই সমুদ্রে হারিয়ে গেছে সে। ভেবেছিলাম জীবনে আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না। কিন্তু তোমাকে দেখার পর বুঝতে পারি, তোমার জন্য আমার এক মহাসমুদ্র ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে। ঐ ভালোবাসা তোমাকে দিতে না পারলে আমি শান্তি পাব না। আসলে কি জানো, আমাদের অতীত নিয়ে না ভেবে বর্তমান নিয়েই ভাবা উচিত। সহজ সরল কথাটা হলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর এটাই সত্য। কী বলো তুমি?
এবার জেসমিন দুই হাত দিয়ে ডাক্তার হাডসনের বাহু ধরল। তারপর নিজের ভরটা ডাক্তার হাডসনের শরীরে ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমিই আমার সব, সবকিছু। আমি চলে আসব, আসব আমার এই সাগর তীরের স্বর্গে, যে স্বর্গে শুধু আছো তুমি, আর থাকব আমি।
ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আমি তো তোমার অপেক্ষায়ই আছি।
জেসমিন আর কিছু বলল না। পানির মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগল। সমুদ্রের ঢেউগুলো যখন পায়ে এসে পড়ছে দারুণ ভালো লাগছে জেসমিনের। আর বাতাসের ছোঁয়া তো আছেই। সবচেয়ে বড় কথা সে পাছে তার প্রিয় মানুষ ডাক্তার হাডসনের ছোঁয়া যার একটু স্পর্শের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে সারাটা দিন।
হাঁটতে হাঁটতে তারা এলো নীল পাথরের কাছে। ডাক্তার হাডসন বললেন, উপরে উঠবে?
উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিল জেসমিন।
নীল পাথরে উঠতে হাঁপিয়ে গেল জেসমিন। সে পাথরের উপর শুয়ে জোরে কয়েকবার দম নিল। তারপর বলল, আসলে এখন অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
ডাক্তার হাডসন বললেন, খুব স্বাভাবিক। তোমার শরীরে তুমি তো শুধু একা নও, আরো একজন আছে, নতুন অতিথি।
তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু…
কিন্তু কী?
একটা বিষয় লক্ষ করেছি। ও না বড় হচ্ছে না।
বড় হচ্ছে না মানে?
মাসখানেক ধরে যেন আগের মতোই আছে। এতদিনে পেটটা তো আরো উঁচু হওয়া উচিত ছিল, তাই না?
কীভাবে বুঝলে?
ইন্টারনেটে দেখেছি।
ব্যতিক্রম হয়। তুমি এত চিন্তা কোরো না। বরং তোমার বেশি বেশি খাওয়াদাওয়া করা উচিত। পুষ্টির অভাব হলে গর্ভের সন্তান বড় হয় না।
তুমি একেবারেই খাওয়াদাওয়া করো না। কেন?
ভালো লাগে না।
এটা ঠিক না। ভালো লাগতেই হবে।
তোমার এখানে আসার পর খাব।
আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। তুমি এলে আমারও ভালো লাগবে। বড় বেশি অনুভব করি তোমাকে। একা একা আমারও ভালো লাগে না।
আমি চলে এলে তোমার একাকিত্ব আর থাকবে না।
কথার মাঝে বাতাসের ঝাঁপটায় চুল এসে পড়ল জেসমিনের মুখে। সেই চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ডাক্তার হাডসন হালকা একটা চুমু খেলেন জেসমিনের ঠোঁটে। জেসমিন নিজেই এবার এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ডাক্তার হাডসনকে। তারপর বিড়বিড় করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, দারুণ ভালোবাসি, তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, কখনোই না, তুমিই আমার জীবন, তুমিই আমার প্রাণ।
*
নিলুফার বসে আছেন জেসমিনের সামনে। জেসমিন জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। নিলুফার বললেন, সিদ্ধ ডিমটা খেয়ে নে। শরীর ভালো থাকবে।
জেসমিন না তাকিয়েই বলল, আমার শরীর ভালো আছে মা।
তুই বললে তো হবে না। আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোর শরীর দিনে দিনে ভেঙে পড়ছে।
তুমি আমাকে নিয়ে এতটা ভেবো না।
তোকে নিয়ে না ভাবলে কাকে নিয়ে ভাববো?
জয় জনিকে নিয়ে ভাবো। ওরা ছোট।
নিলুফারের খুব রাগ উঠছে। কিন্তু তিনি ঠিক করে রেখেছেন আজ রাগবেন না। তাই নিজের রাগটা সামলে বললেন, বলতো, তুই রাতে লাল শাড়ি পরিস কেন?
জেসমিন খানিকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, আমার ভালো লাগে মা।
শাড়ি পরে ঘুমাতে ভালো লাগবে কেন?
তুমি বুঝবে না।
কেন বুঝব না?
মা, আমি তো বড় হয়েছি, তাই না? আমার নিজের কিছু সিদ্ধান্ত আছে না! এখনো কি সবকিছুতে তোমরা মতামত দেবে? আমার পছন্দ অপছন্দ বলে কি কিছু থাকবে না?
তুই এরকম রেগে যাচ্ছিস কেন?
কথা বলতে আমার ভালো লাগছে না। এখন তুমি যাও মা। খাবার থাক, ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নেব। আর আমার খাবার নিয়ে তুমি আর কখনো চিন্তা করবে না। আমি নিজেই নিজের যত্ন নিতে পারি।
নিলুফারের ইচ্ছে হলো জেসমিনের গালে কষে একটা থাপ্পড় মারে। কিন্তু কাজটা করলেন না তিনি। আগের মতোই অনেক কষ্টে নিজের রাগ সামলালেন। তার ইচ্ছা ছিল জেসমিনের গর্ভের সন্তানটা নিয়ে কথা বলবেন আজ। কিন্তু জেসমিনের ব্যবহার দেখে বুঝতে পারলেন এখন আর ঐ বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। তাই তিনি বের হয়ে নিজের কক্ষে এলেন। এসে দেখেন চেয়ারে বসে কী যেন লিখছেন নাজমুল হোসেন। জানতে চেয়ে বললেন, কী লিখছ?
বদলির আবেদন।
মানে!
এখানে আর থাকা যাবে না।
কেন?
বুঝতেই পারছ। জেসমিন যে সন্তানসম্ভবা তা সবাই জেনে গেছে। আশেপাশের মানুষগুলো এখন কীভাবে যেন আমার দিকে তাকায়। ছাত্রছাত্রীদের দিকেও তাকাতে পারি না আমি। এই রকম পরিস্থিতিতে এখানে বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। আশেপাশের উপজেলায় চলে যেতে হবে।
তাহলে তো এই বাড়ি ছাড়তে হবে।
ভাড়া দিয়ে দেব।
কী বলছ?
আমি তো আর কোনো বিকল্প দেখছি না। মান-সম্মান নিয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। জেসমিনের জন্যও খারাপ লাগছে। ওর মানসিক অবস্থা নিশ্চয় আমাদের থেকে খারাপ।
জেসমিন তো নিজের সর্বনাশ নিজেই করেছে।
তা করেছে। কিন্তু এখন তো আর তাকে আমরা উপেক্ষা করতে পারব না। বাচ্চাটাকে জন্ম দিতেই হবে। তখন তাকে লালনপালন করা, বড় করা সবই করতে হবে।
নিলুফার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমরা কি দূরে কোনো জায়গায় বাচ্চাটার জন্ম দিতে পারি? তারপর হয়তো কোথাও রেখে আসলাম।
কোথাও রেখে আসব মানে?
এই যেমন ধরো, এতিমখানা।
তোমার কি মাথা খারাপ! জেসমিন মানবে নাকি? সে তো এখন পর্যন্ত বলল না বাচ্চার বাবা কে?
আমি নিশ্চিত রাশেদ।
প্রমাণ ছাড়া নিশ্চিত হওয়া কি ঠিক হবে?
তা হবে না। তবে একটা উপায়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারব। রাশেদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করে দিতে পারি। তখন ডিএনএ টেস্ট করতে হবে রাশেদকে। আমার বিশ্বাস বাচ্চা আর রাশেদের ডিএনএ মিলে যাবে।
সত্যি কথা বলতে কি কোনো মামলা-মোকদ্দমায় আমি যেতে যাচ্ছি না। এতে গন্ধ আরো বেশি ছড়াবে! পুলিশ জানতে চাইবে, উকিল জেরা করবে, শত্রুতা বাড়বে এলাকায়।
নিলুফার আবারো দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তারপর জানতে চাইলেন, ডাক্তার তরফদার কিছু বলেছেন? উনি কি কিছু করতে পারবেন?
মনে হচ্ছে না। আজ সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন। জেসমিনের রিপোর্টগুলো নিয়ে যেতে বলেছেন। ভাবছি যাব কি না।
আমার মনে হয় যাওয়াটাই ভালো হবে। ভদ্রলোক যেহেতু নিজে ফোন করেছেন, আমার বিশ্বাস কোনো না কোনো তথ্য তিনি দিতে পারবেন।
তা পারবেন। কিন্তু কী লাভ তাতে? জেসমিন আর ওর বাচ্চাটার কী হবে?
আসলে পোড়া কপাল আমাদের! এই বয়সে এসে এমনভাবে বেইজ্জতি হতে হবে কোনোদিনও ভাবতে পারিনি।
মন খারাপ কোরো না। লক্ষ রেখো জেসমিনের উপর। আবার যেন আত্মহত্যা করতে না যায়।
ঘরে সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে যদি আত্মহত্যা করে ঠেকাব কীভাবে?
নাজমুল হোসেন এবার চেয়ারে হেলান দিলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, তুমি এখন থেকে রাতে জেসমিনের পাশে ঘুমাতে পারো। তাহলে ও আর আত্মহত্যা করার সুযোগ পাবে না।
জেসমিন কি আমাকে তার পাশে ঘুমাতে দেবে? আমি তো তিন মাস আগে থেকেই বলতেছি, ও রাজি না। একা ঘুমাবে, এমনকি জয়, জনিকেও ঘুমাতে দেয় না পাশে।
বড় দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ভালো লাগছে না। এক কাপ চা খাওয়াবে?
দিচ্ছি। কিন্তু এই অসময়ে চা খাবে! ঘুম আসবে না তো।
দাও, অসুবিধা নেই।
সাথে আর কিছু দেব?
না।
পারলে জেসমিনের কাছে তুমি একটু যেও। তোমার কথা কম-বেশি হলেও শুনে। আমাকে কেন যেন ও পছন্দ করে না। যদি খাবারটা খাওয়াতে পারো বড় ভালো হয়।
ঠিক আছে যাচ্ছি।
নাজমুল হোসেন চেয়ার থেকে উঠে জেসমিনের কক্ষের সামনে এলেন। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ। রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এখন ঘুমানোর কথা নয় জেসমিনের। অথচ সে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। জেসমিন যে জেগে আছে নিশ্চিত তিনি। একবার ভাবলেন ডাকবেন, পরে বাদ দিলেন। অনুভব করলেন, কেমন যেন ভয় ভয় করে জেসমিনের সাথে কথা বলতে। কারণটা কী তা ঠিক জানেন না। তবে অনুধাবন করলেন, ‘হতাশাগ্রস্ত যে মানুষ আত্মহত্যা করতে চায় তাকে সবাই ভয় পায়। কারণ তার নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকে না। যখন মানুষের নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকে না তখন সে হয় সবচেয়ে দুর্বল কিংবা সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষ।
*
ডাক্তার তরফদার তার চেম্বারে বসে আছেন। মনটা বেশ খারাপ। কারণ হামিদের বোন হুশনা তাকে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে লিখেছে,
শ্রদ্ধেয় স্যার,
আশা করি ভালো আছেন। আমি ভালো নাই। ভালো নাই হামিদ ভাইজানও। তার পাগলামি আগের চাইতে বাড়ছে। এখন অনেক বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করে। গ্রামের সবাই পরামর্শ দিতেছে তারে মানসিক হাসপাতালে পাঠানোর জন্য। কিন্তু অত টাকা আমাগো নাই। আমার মনে হইতেছে, হামিদ ভাইজান বেশিদিন বাঁচবে না। ইদানীং বেশি ‘শিরিন শিরিন করতেছে। যদি শিরিনরে একবার আনা যাইত, মনে হয় অল্প হইলেও মনে শান্তি পাইত সে। অবশ্য জানি, বাস্তবে শিরিনরে নিয়া আসা কোনোভাবেই সম্ভব না। কারণ এখন সে অন্যের স্ত্রী এবং তার সংসার আছে। কেন যেন গতকাল হঠাৎ ভাইজান আপনের কথা বলতেছিল। আপনে নাকি শিরিনরে নিয়া আসবার পারবেন। জানি না, সত্য কি না। স্যার, চিঠি লিখা বিরক্ত করলাম। মনে কষ্ট নিয়েন না, সময়ে অসময়ে বিরক্ত করি। আসলে স্যার, আমি আমার ভাইজানরে বড় ভালোবাসি। পারলে একবার আইসেন। আপনের প্রিয় রুগীরে দেইখা যাইয়েন। ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
ইতি
হুশনা।
ডাক্তার তরফদার চিঠিটা পরপর দুবার পড়লেন। খামের উপর সিল দেখে বুঝলেন দুই দিন আগে চিঠিটা লিখেছে হুশনা। হুশনার এই একটা অভ্যাস, চিঠি লেখা। এই যুগে এইরকম মানুষ খুব কম আছে। হুশনার ভাষ্যমতে চিঠি লিখলে গুরুত্ব নাকি বেশি দেয়া হয়। হয়তো সত্য। ডাক্তার তরফদার অনুধাবন করছেন, সত্যি তার একবার যাওয়া উচিত হামিদকে দেখতে। কারণ হামিদ যে আসলেই বেশিদিন বাঁচবে না তা তিনি নিজেও অনুধাবন করছেন। তবে একবার যদি শিরিনের সাথে তার দেখা করিয়ে দেয়া যেত ব্যাপারটা মন্দ হতো না। এতদিন পর শিরিনকে দেখে হামিদের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা অবশ্য ভাবার বিষয়। শিরিন থাকে সিলেটে। ধনাঢ্য এক ব্যক্তির স্ত্রী সে। বছরখানেক আগে ঠিকানা জোগাড় করেছিলেন তিনি। একবার ভেবেছিলেন যোগাযোগ করবেন। পরে আর করেননি। শিরিনের ফোন নম্বর জোগাড় করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পারেননি। সিলেটে গিয়ে তিনি অবশ্য তার সাথে কথা বলতে পারবেন। কিন্তু তার ভয় আবার তার পারিবারিক জীবনে কোনো অশান্তি নেমে না আসে।
ডাক্তার তরফদার সিদ্ধান্ত নিলেন শিরিনকে একটা চিঠি লিখবেন। তবে সাংকেতিক ভাষায়। শিরিন যদি আজও হামিদকে ভালোবেসে থাকে, অবশ্যই সাড়া দেবে। কারণ, জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা হৃদয়ের দেয়ালে এমনভাবে অঙ্কিত থাকে যে চাইলেও মোছা যায় না।
‘বাঁশি, ডালিম’
ডাক্তার তরফদার মাত্র এই দুটি শব্দ লিখলেন মূল চিঠিতে। প্রেরক আর প্রাপকের ঠিকানা লিখলেন খামের উপরে। তারপর করিম চাচাকে দিলেন চিঠিটা পোস্ট করার জন্য। করিম চাচার ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতা রয়েছে। জিজ্ঞেস করলেই জানা যেত যে শিরিন চিঠি পাওয়ার পর আসবে কি আসবে না। ডাক্তার তরফদার, কখনোই জিজ্ঞেস করেন না। তিনি পছন্দ করেন, জীবন তার গতিতেই চলুক, অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত কোনো ক্ষমতার পূর্বাভাসে নয়।
চেম্বারে আবার বসতে না বসতে নাজমুল হোসেন এলেন। কুশল বিনিময়ের পর নাজমুল সাহেব নিজে থেকেই বললেন, স্যার বড় বিপদে আছি।
ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, বুঝতে পারছি, এজন্যই আসতে বলেছি আপনাকে। রিপোর্টগুলো এনেছেন?
হ্যাঁ এনেছি।
ডাক্তার তরফদার রিপোর্টগুলো দেখলেন। তারপর দেখলেন আলট্রাসনোগ্রামের ফিল্মগুলো। পেটে যে বাচ্চা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হাড়ের উপস্থিতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বললেন, নতুন একটা আলট্রাসনোগ্রাম কি করতে পারবেন? তাহলে বুঝতে পারতাম বাচ্চাটা কত বড় হয়েছে।
আমি তো করতে চাচ্ছি। কিন্তু রাজি হচ্ছে না জেসমিন। তার ধারণা জন্মেছে যে, আলট্রাসনোগ্রাম করলে বাচ্চার ক্ষতি হয়।
এখন কেমন আছে জেসমিন?
ভালো না, শুকিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে।
কথা বলছে আপনাদের সাথে?
আপনি যেদিন গিয়েছিলেন তারপর দুটো দিন ভালো ছিল। এখন আবার আগের মতো হয়ে গেছে। আর…
আর কী?
প্রায় প্রত্যেকদিন রাতেই লাল শাড়ি পরে ঘুমিয়ে থাকে। ঘুম ভাঙে অনেক দেরিতে।
পর্যাপ্ত ঘুম হওয়া ভালো। কিন্তু লাল শাড়ি পরবে কেন?
জানি না স্যার। সকালে উঠে অবশ্য ও পরিবর্তন করে ফেলে। কিন্তু ওর মা সকালে পিছনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেছে লাল শাড়ি পরা থাকে জেসমিন।
প্রত্যেক রাতেই?
বলতে পারেন।
ডাক্তার তরফদারের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। বললেন, লাল শাড়ি কি জেসমিনের খুব প্রিয়?
এরকম কিছু ছিল না। আগে তো ও শাড়িই পরত না। শাড়িটা ওর মায়ের। নিয়ে গিয়েছিল কক্সবাজার। তারপর আর ফেরত দেয়নি ওর মাকে। বড় অবাক হয়েছি।
বাঙালি নারীর শাড়ি পরা শুরু হয় মায়ের শাড়ি দিয়ে। মায়ের শাড়িই হয় তার প্রথম পছন্দের শাড়ি। তবে জেসমিনের লাল শাড়ি পরার যৌক্তিকতা ঠিক ঐরকম মনে হচ্ছে না। বিষয়টা রহস্যজনক।
নাজমুল হোসেন উপরে নিচে মাথা নেড়ে বললেন, আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না।
নতুনভাবে কাউকে কি সন্দেহ করছেন আপনারা?
নাজমুল হোসেন চুপ থাকলেন, কিছু বললেন না। কথা বলছেন না কেন?
আসলে, আসলে আমার মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা ভৌতিক। কোনো পিশাচের কাজ হবে এটা। সন্ধ্যার পর সম্ভবত ওর ঘাড়ে চড়ে বসেছে।
কী বলছেন এসব!
একজন ফকিরকে ডেকেছিলাম। কুতুব ফকির। সে বিষয়টা নিশ্চিত করেছে আর বলেছে ঐ পিশাচকে দূর করতে হবে, ছায়া হয়ে নাকি আসে। কাজটা সে-ই করবে।
কীভাবে দূর করবে?
ধোঁয়া দিয়ে দূর করবে। কী সব শিকড়ের ধোঁয়া! হাজার দশেক টাকা লাগবে। আমরা টাকা দিয়ে দিয়েছি। বড় বড় চোখ করে ডাক্তার তরফদার বললেন, কী বলছেন এসব! আপনি শিক্ষিত মানুষ! আপনি ভূত-প্রেত, পিশাচে বিশ্বাস করবেন কেন?
আসলে স্যার বিপদে পড়ে গেছি। মাথা ঠিক নেই।
ঐ কুতুব ফকিরের ফাঁদে পা দেবেন না। আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দিন। দেখি কিছু করতে পারি কি না।
আচ্ছা স্যার।
নাজমুল হোসেন চলে গেলে ডাক্তার তরফদার বাগানে এলেন। দেখলেন আকাশে অনেক মেঘ জমেছে, কালো মেঘ। সাথে বাতাসও আছে। তিনি বুঝতে পারলেন আজ বৃষ্টি হবে, অনেক বৃষ্টি। কেন যেন তার অবচেতন মন বলছে, এই বৃষ্টি মানুষের জন্য মঙ্গলময় হবে না, হবে ক্ষতির, মারাত্মক ক্ষতির। এটা একটা বাস্তব সত্য যে, বৃষ্টি সবসময় সবার জন্য সুন্দর আর মঙ্গলময় হয় না। দৃষ্টিনন্দন বৃষ্টিরও একটা কষ্টের রূপ থাকে।
ডাক্তার তরফদারের ভাবনার মধ্যেই প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হলো। এমন বৃষ্টিতে চা মন্দ না। তাই তিনি রান্নাঘরে এলেন। দুধ চা বানালেন এক কাপ। তারপর নিয়ে এসে বসলেন চেম্বারে। জেসমিনের ফাইলটা টেনে লিখতে শুরু করলেন,
জেসমিন মেয়েটি মানসিকভাবে অসুস্থ, বিষয়টা নিশ্চিত। তার অসুস্থতার প্রধান কারণ তার গর্ভবতী হওয়া। কিন্তু কীভাবে সে গর্ভবতী হলো এ বিষয়টি রহস্যময়। তার পেটের সন্তানের বাবা রাশেদের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকলেও তৃতীয় কেউও হতে পারে। এই মুহূর্তে রাশেদ অবশ্য সন্দেহের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। তবে তৃতীয় ব্যক্তিটি কে তা বড় রহস্যময়। এই রহস্য ভেদ করতে গিয়ে কিছু বিষয় নজরে এসেছে। প্রথম বিষয়টা হলো, ‘নীল চোখের ছায়া। এক্ষেত্রে নীল চোখের কেউ একজন তার পরিচিত বলে ধরে নিতে হবে, কিন্তু কে সে? দ্বিতীয় বিষয়টা হলো ‘লাল শাড়ি। রাতে জেসমিন মাঝে মাঝেই লাল শাড়ি পরে! কেন? বড় জটিল প্রশ্ন। একজন নারী শাড়ি পরে আমাদের সংস্কৃতির অংশ হিসেবে এবং তার নিজের সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তোলার জন্য। নিঃসন্দেহে এটাই সত্য যে, বাঙালি নারী সবচেয়ে সুন্দর শাড়ীতে। কিন্তু রাতে কেন শাড়ি পরবে জেসমিন? কোনো পুরুষের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করার জন্য, নাকি নিজের ইচ্ছাকে পূরণ করার জন্য দ্বিতীয় বিষয়টা সত্য হতে পারে, নিজের সন্তুষ্টির জন্য কেউ কেউ পছন্দের পোশাক পরে। নিজেকে সুন্দর দেখার এই প্রবণতার নাম নারসিসিজম (Narcissism)। কিন্তু জেসমিন নারসিসিজম-এ আক্রান্ত বলে মনে হয় না। কারণ দিনের বেলায় সে তার সৌন্দর্য নিয়ে যে খুব বেশি সচেতন থাকে, সেরকম কিছু জানা যায়নি। তবে একটা বিষয় লক্ষণীয়, যা কিছু ঘটছে সবই কক্সবাজার থেকে আসার পর। কক্সবাজারে রেইনবো রেইন হোটেলে একা সে একটা কক্ষে ছিল। ঐ কক্ষে কেউ তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করেছে কি না তা বিবেচনার বিষয় রয়েছে। ঐ কক্ষটাতে না গেলে জানা যাবে না। রেইনবো রেইন হোটেলের কক্ষ নম্বর ছিল ২২১। হোটেলে নানা ধরনের ঘটনা ঘটে, সেরকম কোনো ঘটনার স্বীকার হতে পারে জেসমিন। বিষয়টা হয়তো এরকম যে, হোটেল বয় কিংবা অন্য কেউ কিংবা একাধিক ব্যক্তি রাতে তার কক্ষে প্রবেশ করে তাকে বাধ্য করেছে শারীরিক সম্পর্ক করতে। অর্থাৎ জেসমিন ধর্ষিত হয়েছে। লজ্জায় অপমানে সে হয়তো বলতে পারেনি কাউকে। হতে পারে তার কলেজের কোনো শিক্ষক কাজটা করেছে। শিক্ষকের বিরুদ্ধে যাওয়া ছাত্রীদের জন্য বড় কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের শিক্ষাসফরে একজন মহিলা আর দুজন পুরুষ শিক্ষক ছিল। যে দুজন পুরুষ শিক্ষক ছিল তাদের বয়স কত জানতে হবে তাকে। অবশ্য বয়স কোনো বিষয় নয়। নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পুরুষের বয়সের প্রয়োজন হয় না, যে কোনো বয়সের পুরুষ একজন অল্পবয়সি নারীর প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে। এই আকর্ষণের মূল কারণ ‘টেসটেসটেরন হরমোন যা একজন মানুষের পুরুষ হিসেবে বেড়ে উঠার অন্যতম নিয়ামক যাইহোক, কক্সবাজারে যে কিছু একটা ঘটেছে এটা মাথায় রাখতে হবে। কিন্তু এই যুক্তিটা মিলছে না এ কারণে যে জেসমিনের শরীরে কোনো ধস্তাধস্তির দাগ ছিল না, তাছাড়া সে চিৎকার করতে পারত। অবশ্য যদি পানীয় কিংবা অন্যকিছুর সাথে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাকে অচেতন করা হয়ে থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। একটা প্রশ্ন অবশ্য থেকে যাচ্ছে, লাল শাড়ি কেন পরে জেসমিন? উত্তরটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। একটা মূর্তির কথা এসেছে। কক্সবাজারে অনেক মূর্তি আছে, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রতিমা, মূর্তি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঐ রকম কোনো ধর্মীয় উপাসনালয় দেখতে যায়নি জেসমিন। তাহলে কোন মূর্তি দেখতে গিয়েছিল? প্রশ্নটা করতে হবে শান্তাকে কিংবা তার অন্য বন্ধু-বান্ধবীদের। যে কেউ একজনের কাছ থেকে সঠিক উত্তর পাওয়া যাবে। অনুসন্ধানে আরো এসেছে পাহাড়-সমুদ্রের কথা। ঐ এলাকাটাও কক্সবাজার হবে। যাইহোক, সবকিছু মিলিয়ে এখন মনে হচ্ছে কক্সবাজারে রেইনবো রেইন হোটেলে যেতে হবে এবং খুঁজে পেতে হবে মূর্তির রহস্য।
ফাইলে উপরের অংশটুকু লিখে ডাক্তার তরফদার বারান্দায় এলেন। ঝড় শুরু হয়েছে, সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টি। কয়েকজন রিকশাওয়ালাকে রিকশা। দেখা গেল, তবে বাতাসের সাথে যেন পেরে উঠছে না তারা। দূরে কোথাও শব্দ হলো ভয়ংকর বজ্রপাতের। একজন মহিলাকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাতাসের বিপরীতে দৌড়াতে দেখা গেল যেন মহাবিপদে আছে সে।
ডাক্তার তরফদার আবারও উপলব্ধি করলেন, বৃষ্টি সবসময় সবার জন্য সুন্দর আর মঙ্গলময় হয় না। দৃষ্টিনন্দন বৃষ্টিরও একটা কষ্টের রূপ থাকে।
*
Leave a Reply