ডাক্তার তরফদার বসে আছেন তার চেম্বারে। তার সামনে একটি বাচ্চা বসা। বয়স নয় বছর, নাম ইকবাল। চোখ দুটো স্বচ্ছ নীল। দেখলে কেমন যেন মায়ার সৃষ্টি হয়। সাথে এসেছে তার মা রিতা। খুব অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। ডাক্তার তরফদার বললেন, ইকবালের সমস্যা কী?
রিতা চোখ বড় বড় করে বলল, স্যার মেলা বড় সমস্যা।
কী সমস্যা?
স্যার ও একবার যা দ্যাখে তা ভুলে না। সব মনে রাখবার পারে।
এটা তো ভালো লক্ষণ।
স্যার যা পড়ে সব মুখস্থ হইয়া যায়।
দারুণ ক্ষমতা!
কঠিন কঠিন শব্দ যা আমরা দ্বিতীয়বার মনে রাখবার পারি না ইকবাল সব মনে রাখবার পারে।
সত্যি?
জি স্যার।
তাহলে বলতেই হয় ইকবাল খুব ক্ষমতাবান। তো তুমি কী করো? আর ইকবালের বাবা কোথায়? সে কী করে?
স্যার ইকবালের বাবা একটা গার্মেন্টসে লাইনম্যান পদে চাকরি করে। আমি বাসায়ই থাকি। ঘর সামলাই। মাঝে সেলাইয়ের কাজ করবার চেষ্টা করছিলাম। ইকবালের এই অসুখের পর থাইকা আমি আর পারতেছি না, ওরে সামলাতেই আমার সময় চইলা যায়।
ইকবাল তো অসুস্থ নয়, তার কিছু ক্ষমতা আছে বলছ, এটা দোষের কিছু না। যাইহোক, আমি ইকবালের সাথে কথা বলি।
ডাক্তার তরফদার এবার ইকবালের দিকে ফিরে ডাক দিলেন, এসো বাবা, আমার কাছে এসো।
ইকবাল কোনো কথা বলল না। শুধু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ডাক্তার তরফদারের দিকে।
ডাক্তার তরফদার মিষ্টি হেসে বললেন, কী নাম তোমার?
ইকবাল নিরুত্তর।
রিতা বলল, স্যার মাঝে মাঝে ও কথা বলে না। চুপ হইয়া যায়। কী যেন ভাবে। ওর ঐ দৃষ্টি দ্যাখলে আমার ভয় করে।
ডাক্তার তরফদার এবার নিজেই উঠে ইকবালের পাশের চেয়ারে বসলেন। তারপর বললেন, আমি তোমাকে কিছু কঠিন শব্দ বলব। তুমি মনে করতে পারো কি না আমি দেখব। যদি পারো বুঝব তুমি সত্যি অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী। হ্যাঁ, এখন তাকাও আমার দিকে।
ইকবাল ডাক্তার তরফদারের দিকে তাকাল। ডাক্তার তরফদার বললেন, তুমি বলবে ‘সাইক্লো পেন্টানো পার হাইড্রো ফিনানথ্রিন’।
নিশ্চুপ ইকবাল।
ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, আমি কী বলেছি, তুমি বলো।
ইকবাল একবার রিতার দিকে তাকিয়ে আবার তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, সাইক্রো পেন্টানো পার হাইড্রো ফিনানখ্রিন।
ডাক্তার তরফদার স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি স্টেরয়েডের মূল রাসায়নিক স্ট্রাকচারের ‘মৌলিক রিং’-এর নাম বলেছিলেন। রসায়নের একজন ছাত্রের প্রথম প্রথম এই ‘মৌলিক রিং’-এর সঠিক উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত ভেঙে যায়। আর নয় বছরের ইকবাল কিনা একেবারে সঠিক উচ্চারণটা বলল। তিনি বিস্মিত না হয়ে পারলেন না এবং বুঝলেন ইকবাল অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী।
এদিকে রিতা খুব উচ্ছ্বসিত। কারণ ইকবাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সে উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ডাক্তার তরফদারের দিকে। ডাক্তার তরফদারের সামনে একটা কবিতার বই ছিল। বইটা হাতে নিয়ে তিনি ইকবালকে বললেন, আমি একটা কবিতা পড়ব। আমার পড়া শেষ হলে তুমি আমাকে মুখস্থ শোনাবে। ঠিক আছে?
ইকবাল আগের মতোই চুপ থাকল।
ডাক্তার তরফদার পল্লিকবি জসিম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতার প্রথম আট লাইন পড়ে শোনালেন ইকবালকে। তারপর বললেন, যতটুকু পড়েছি তুমি আমাকে শোনাও তো।
আটটা লাইন হুবহু মুখস্থ বলল ইকবাল।
ডাক্তার তরফদার কবিতার বই বন্ধ করে রিতার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, কবে থেকে ইকবালের এই ক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে?
স্যার ছয় মাস হলো। আমরা প্রথমে পাত্তা দেই নাই। এখন দেখতেছি, দিনে দিনে ও ওর ক্ষমতা দেখাইতেছে, আর কথা বলা কমায় দিতেছে।
কথার মাঝেই উঠে গেল ইকবাল। তারপর কাউকে কিছু না বলে ঢুকে গেল ভিতরের রুমে। ডাক্তার তরফদার তো অবাক। তবে তিনি ইকবালের পিছনে গেলেন না। বরং রিতাকে বললেন, তুমি যাও।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো ইকবাল। তার হাতে পরির পায়েস। তিনটা বাটি এনেছে সে। একটা দিল তার মাকে, একটা ডাক্তার তরফদারকে। আর একটা সে খেতে শুরু করল।
ডাক্তার তরফদার বড়ই অবাক হলেন। বিড়বিড় করে বললেন, এই বাসার অন্যতম স্বাদের খাবারটা ইকবাল নিয়ে এসেছে। কীভাবে বুঝল?
স্যার জানি না। ইদানীং ইকবাল অনেককিছুই বুঝবার পারে। এজন্য আমি ভয়ে ভয়ে থাকি।
ভয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। ও ছোট মানুষ। ওকে অনেক অনেক ভালোবাসবে। সময় দেবে। আমি এই সপ্তাহের মধ্যে তোমাদের বাসায় একদিন আসব। এই মুহূর্তে কোনো সিদ্ধান্ত দিচ্ছি না। শুধু একটাই পরামর্শ, সবসময় ইকবালের সাথে থাকবে, ইকবালকে আপন করে রাখবে।
কোনো ওষুধ দেবেন না স্যার?
কী জন্য?
ইকবালের ব্রেইনের ক্ষমতা যেন কইমা যায়, যেন আমাগো মতো হয়।
ইকবাল সুস্থ আছে। তার কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। আমি তাকে আরো পর্যবেক্ষণ করব। আর হ্যাঁ মনে রাখবে, ওষুধে নয়, মনের অসুখ মন দিয়ে সারাতে হয়। তবে এটা সত্য, ইকবাল অসুস্থ নয়।
জি স্যার, তারপরও আমি..
কথা শেষ করতে পারল না রিতা। ইকবাল উঠে আবার ভিতরে গেল। সেও গেল তার পিছন পিছন। বের হয়ে এলো কিছুক্ষণ পর। ইকবাল এবার একটা ব্যাগের মধ্যে অনেকগুলো পরির পায়েস নিয়েছে। পরি এখন দুইভাবে পায়েস তৈরি করে। পেয়ালায়, আবার ছোট ছোট মাটির বাটি কিংবা প্লাস্টিকের কাপে। প্রায় বিশটা পায়েস ভরা কাপ নিয়েছে ইকবাল। লজ্জিত ভঙ্গিতে রিতা বলল, স্যার, ফ্রিজের পাশেই একটা পলিথিনের ব্যাগ আছিল। একা একাই সে ব্যাগে ভইরা সবগুলা পায়েস নিয়া আইছে।
ডাক্তার তরফদার বললেন, ইকবালের পছন্দ হয়েছে, তাই নিয়েছে। দোষের তো কিছু নেই। ওকে নিতে দাও।
কী লজ্জার কথা!
লজ্জার কিছু নেই। আমি ওকে আরো পায়েস দেব।
ডাক্তার তরফদার চেয়ার থেকে উঠে এসে এবার ইকবালের দিকে ঝুঁকলেন। বললেন, তোমার যখন পায়েস খেতে ইচ্ছে হবে চলে আসবে। ঠিক আছে?
ইকবাল মিষ্টি হাসল। তারপর পা বাড়াল বাইরের দিকে। ভাবখানা এমন যেন সব সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিচ্ছে। তার মায়ের জন্য অপেক্ষা করছে না। কিছুটা পথ এগিয়ে আবার ফিরে এলো সে। বলল, ডাক্তার তুমি বড় ভালো মানুষ।
রিতা ধমক দিয়ে উঠে বলল, ডাক্তার বললি ক্যান? স্যার বল। আর ‘তুমি’ কইরা বলতেছিস ক্যান? ‘আপনি’ কইরা বল।
তারপর রিতা ডাক্তার তরফদারের দিকে ফিরে বলল, স্যার, দ্যাখছেন, কত বড় বেয়াদব! আপনেরে ‘তুমি’ কইরা বলে!
এদিকে মায়ের ধমক খেয়ে ইকবাল বেশ ভয় পেয়েছে, নীল চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে। সে একবার রিতার দিকে তাকিয়ে আবার তাকাল ডাক্তার তরফদারের দিকে। শুদ্ধ ভাষায় বলল, ডাক্তার, তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।
ইকবালের কথা শুনে রিতা মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে, আবার ‘তুমি’ করে বলছে ইকবাল! সে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসল ইকবালের গালে। ইকবাল একেবারে চুপ হয়ে গেল।
ডাক্তার তরফদার রিতাকে ধমক দিয়ে বললেন, এসব কী করছো! ও ছোট মানুষ। এরকম আচরণ করতে আমি যেন আর না দেখি তোমাকে।
রিতা এবার হঠাৎই ডুকরে কেঁদে উঠল। তারপর বলল, স্যার আমি ইকবালরে আগে কখনো মারি নাই। আইজই প্রথম মারলাম। আসলে নিজেরে নিয়ন্ত্রণ করবার পারি নাই, আমারে ক্ষমা কইরা দিবেন স্যার।
ডাক্তার তরফদার ইকবালকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, তুমি অনেক বুদ্ধিমান ইকবাল। আমি তোমাদের বাড়িতে এসে তোমার সাথে সময় কাটাব, গল্প করব। ঠিক আছে?
ইকবাল কিছু বলল না। তার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এসেছে।
দেখে খুব খারাপ লাগল ডাক্তার তরফদারের, এদিকে রিতা তো কাঁদছেই। ডাক্তার তরফদার কী করবেন যখন ভাবছেন তখন দেখলেন ইকবাল বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। সামনে একটা চেয়ারে সুন্দর চেহারার তেরো-চৌদ্দ বছরের একজন কিশোর বসে ছিল। সে এতক্ষণ সবকিছু দেখছিল। তার হাতে একটা পায়েসের কাপ দিয়ে বের হয়ে গেল ইকবাল। রিতা তখন হাঁটতে শুরু করেছে ইকবালের পাশে। তার হাতে পায়েসের ব্যাগ।
ডাক্তার তরফদারের কাছে যে রোগী আসে তাদের অধিকাংশই আঠারো বছরের উপরে। আর অল্পবয়সিদের সাথে তাদের অভিভাবক থাকে। বসে থাকা ছেলেটির সাথে কোনো অভিভাবক নেই দেখে খানিকটা অবাকই হলেন তিনি। সামনে এসে বললেন, কী নাম তোমার?
লাজুক ভঙ্গিতে ছেলেটি বলল, জেহান স্যার।
জেহান, আগে এই নাম শুনিনি। তোমার নামের কি কোনো অর্থ আছে?
জি স্যার আছে। জেহান শব্দের অর্থ উজ্জ্বলতা।
ও আচ্ছা। এসো, ভিতরে এসো।
জি স্যার।
আর কেউ নেই সাথে?
না স্যার।
কী করো তুমি?
পড়াশুনা করি। ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে।
তাই নাকি। বয়স কত তোমার?
সতের বছর হতে আর একমাস বাকি
কিন্তু তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে তোমার বয়স তেরো-চৌদ্দ বছর। যাইহোক, তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষদের একজন, কারণ প্রকৃত বয়সের ছাপ তোমার চেহারায় পড়ছে না। অথচ মানুষ বয়স ধরে রাখার জন্য, নিজের চেহারা সুন্দর করার জন্য কত চেষ্টাই না করছে। পার্লারে যাচ্ছে, দামি কসমেটিকস ব্যবহার করছে, ভেষজ সামগ্ৰী শরীরে মাখছে, লেসার মেশিনের নিচে শরীর পেতে দিচ্ছে, ঠোঁট-নাক কেটে কসমেটিক সার্জারি করছে। অথচ মানুষ বুঝতে চায় না, মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য চেহারায় নয়, মনে। চেহারার কসমেটিক সার্জারির পরিবর্তে মনের শুদ্ধি সার্জারির গুরুত্ব অনেক বেশি। যাইহোক, এসো ভিতরে এসো, তোমার কথা শুনি।
ডাক্তার তরফদার ভিতরে প্রবেশ করে পিছনে ফিরলেন। কিন্তু দেখতে পেলেন না জেহানকে। তিনি আবার বাইরে বের হয়ে এলেন। না নেই, জেহান নেই। অবাকই হলেন তিনি, এক কিশোর হঠাৎ এসে হঠাৎ উধাও হয়ে গেল! তবে একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত, জেহান সুস্থ নয়, অসুস্থ। তার অসুস্থতার মাত্রা কী ধরনের কথা না বললে জানা যাবে না। অবশ্য একটা বিষয়ে তিনি আশাবাদী, জেহান আবার আসবে এবং অল্পদিনের মধ্যেই।
*
রাত সাড়ে নয়টা। জেসমিন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘরে প্রবেশ করলেন নিলুফার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকলেন, জেসমিন, জেসমিন!
জেসমিন মায়ের দিক মুখ ফিরিয়ে উলটো করে শুলো। নিলুফার বললেন, টেবিলে খাবার দিছি, খেতে আয়।
আমার ক্ষুধা নেই মা।
সেই দুপুরে কয়টা ভাত খেয়েছিস। আর কিছু খাসনি। না খেলে তো মারা যাবি।
না মা, আমার কিছু হবে না, তুমি নিশ্চিত থাকতে পার।
কীভাবে নিশ্চিত থাকব? যে বিপদ আমাদের পরিবারের উপর!
মা তুমি চিন্তা কোরো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কীভাবে ঠিক হবে? বিয়ে করিসনি, পেটে বাচ্চা নিয়ে বসে আছিস! এই কথা মানুষজন জানলে মুখ দেখাব কীভাবে? তোর বাবা তো এখনই ঘর থেকে বের হতে চাচ্ছে না। কে তোর এই সর্বনাশ করল! রাশেদ।
তু…তুমি রাশেদ ভাইয়ের কথা জানলে কীভাবে?
আমি আগেই জেনেছি। কানাঘুষা তাড়াতাড়ি ছড়ায়। যা হবার হয়েছে। তুই যদি চাস, তাহলে আমি রাশেদের সাথে কথা বলতে পারি।
কী কথা?
বিয়ে করে ফেলবি দুজন।
জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল, এই বয়সে আমি বিয়ে করব।
আমি তোর কথা কিছু বুঝতে পারছি না। এই বয়সে বাচ্চা নিয়ে ফেলেছিস, বিয়ে করতে দোষ কোথায়? এখন না করলে পরে রাশেদের পরিবারও রাজি হবে না।
রাশেদ ভাইয়ের কথা বারবার আনছ কেন?
সে-ই তো তোর এই সর্বনাশ করেছে। তার কথা আনব না কেন?
না রাশেদ ভাইয়ের কোনো দোষ নেই।
তাহলে তোর সন্তানের বাবা কে?
জেসমিন চুপ হয়ে গেল।
নিলুফার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, তুই বলছিস না কেন? আর কত জিজ্ঞেস করব। জিজ্ঞেস করতে করতে আমার মুখ ব্যথা হয়ে গেল।
জেসমিন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, মা, তুমি আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
তুই তো সারাদিন একাই থাকিস। খাবার কি এই ঘরে দিয়ে যাব?
না।
আমি আসলে তোকে বুঝতে পারছি না। তোর উচিত আমাদের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। যেভাবে তুই গো ধরে বসে আছিস, তাতে আমাদেরই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। যা খুশি কর, আর ভালো লাগে না। এই সংসার আমার জীবনটা অতিষ্ঠ করে তুলেছে।
রাগ করে চলে গেলেন নিলুফার। জেসমিন উঠে বাথরুমে ঢুকল। হাত-মুখ ধুয়ে নিল ভালোমতো। একটা বিষয় অবশ্য সত্য। মাঝে ক্ষুধা থাকলেও এখন তার ক্ষুধা কমে গেছে। খেতে ইচ্ছে করে না। না খাওয়ায় একটা সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে, বমি হচ্ছে না। গত মাসে প্রায় প্রত্যেকদিনই বমি করত সে, খুব কষ্ট হতো। এখন আর অতটা হচ্ছে না। কষ্টটা একেবারে থাকে না যখন ডাক্তার হাডসন আসেন। রাতে দিনে যে কোনো সময় চলে আসেন তিনি। আজ জেসমিনের খুব ইচ্ছে করছে ডাক্তার হাডসনের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। তাই মনে-প্রাণে প্রার্থনা করছে তিনি যেন রাতে আসেন। জেসমিন অবশ্য জানে। ডাক্তার হাডসন আসবেনই, কারণ এতদিন পর্যন্ত যখনই সে তাকে কামনা। করেছে তখনই তিনি এসেছেন। পৃথিবীতে এই একটা মানুষ কখনোই তাকে নিরাশ করেনি। প্রথম প্রথম ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বকে তার মিথ্যা বলে মনে হতো। কিন্তু যেদিন থেকে অনুভব করল সত্যি তার পেটে ডাক্তার হাডসনের সন্তান আছে সেদিন থেকে শতভাগ বিশ্বাস করতে শুরু করল যে ডাক্তার হাডসনের অস্তিত্বও সম্পূর্ণ সত্য। যদি সত্য না হতো, তার পেটে সন্তান আসবে কীভাবে? আর একটা বিশ্বাস তার জন্মেছে, তা হলো ডাক্তার হাডসন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, তা না হলে এভাবে চাইলে তিনি তার কাছে আসতে পারতেন না। আর তিনি যখন আসেন, জেসমিন অনুভব করে তার আর কোনো দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা থাকে না, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হয় সে।
জেসমিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। হঠাই হালকা বাতাসের ধাক্কায় কয়েকটা চুল এসে পড়ল তার মুখে। চোখ খুলে দেখে চারদিকে হালকা লালচে আলো। আর সেই আলোতে তারই পাশে বসে আছেন ডাক্তার হাডসন। সেই নীল পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরা। চোখ দুটোও নীল, গভীর সমুদ্রের টলটলে হালকা নীল পানির মতো, কী সুন্দর! খালি তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। জেসমিনের ইচ্ছা তার সন্তানের চোখও নীল হবে, সমুদ্রের পানির মতো স্বচ্ছ নীল!
ডাক্তার হাডসন বিড়বিড় করে বললেন, আজ তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব জেসমিন।
কোথায়?
হাডসন হিলে।
হাডসন হিল তো অনেক দূর! সেই কক্সবাজার।
হ্যাঁ, তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। আজ রাতটা তুমি আমার ওখানে থাকবে। তারপর শেষ রাতে আবার তোমাকে দিয়ে যাব।
আপনি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন?
অবশ্যই পারব। তবে একটা শর্ত আছে আমার।
কী শর্ত?
আমাকে তুমি করে বলতে হবে।
জেসমিন লাজুক ভঙ্গিতে বলল, আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। কীভাবে ‘তুমি করে বলব আপনাকে?
বিষয়টা বয়সের নয়, শুধুই সম্পর্কের। তুমি আমাকে একবার ‘তুমি’ বলা শুরু করে আবার আপনি বলতে শুরু করেছ।
আপনি অনেক গুণী মানুষ। এরকম গুণী মানুষকে তুমি করে বলা ঠিক না। আমি পারব না, আপনাকে আপনি করেই বলব।
ডাক্তার হাডসন খানিকটা নিচে ঝুঁকে এলেন। তারপর টেনে টেনে বললেন, না, ‘তুমি’ করে বলবে, শুধুই ‘তুমি’।
না, না…
হ্যাঁ, ‘তুমি’, শুধুই ‘তুমি’। আগে একবার পেরেছিলে, আজও পারতে হবে এবং আজীবনের জন্য।
জেসমিন চোখ বুজল। তারপর চোখ খুলে টেনে টেনে বলল, তু…তু…মি, তু…তুমি…
এই তো হয়েছে। এখন তৈরি হয়ে নাও, লাল শাড়ি পরবে।
লাল শাড়ি!
হ্যাঁ, লাল শাড়ি।
ঠিক আছে।
জেসমিন লাল শাড়িটা পরল। তারপর হাত ধরল ডাক্তার হাডসনের। মুহর্তেই ভালোলাগার এক অজানা শিহরন খেলে গেল তার সমস্ত শরীরে। সে অনুভব করল যেন উড়ছে, হাওয়ায় উড়ছে।
জেসমিন আর ডাক্তার হাডসন এখন হাডসন হিলে। খালি পায়ে প্রথমে তারা বালুতে নেমে এলো। জেসমিনের মনে হতে লাগল পৃথিবীতে আজকের চাইতে সুখের দিন বুঝি আর নেই। চারপাশটা কী সুন্দর! একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্র, চাঁদের আলোতে অপূর্ব লাগছে দেখতে। সমুদ্রের তীরে পড়ে থাকা পাথরটাকে আজ যেন একটু বেশি সুন্দরই মনে হচ্ছে। কেমন চকচক করছে। ঐ পাথরের উপরেই এসে বসল দুজন। সাগরের হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে লাগছে মুখে। একেবারে জুড়িয়ে যাচ্ছে মনটা।
ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত নিজের মধ্যে নিয়ে বললেন, তুমি সুন্দর জেসমিন, অপূর্ব সুন্দর!
জেসমিন কিছু বলল না, শুধু দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল।
তোমার কি ভালো লাগছে জায়গাটা?
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল জেসমিন।
তুমি কিন্তু কথা বলছ না!
এবার জেসমিন মৃদুস্বরে বলর, কী কথা বলব?
ভালোবাসার কথা।
আমি বলতে পারি না। শুধু অনুভব করতে পারি।
অবশ্য এটা সত্য, ভালবাসা যতটা না বলতে পারার, তার থেকে অনেক বেশি হলে অনুভবের। মুখে বললেই ভালোবাসা হয় না, অনুভব করতে হয়। তুমি কি আমাকে অনুভব করো?
আবারো উপরে নিচে মাথা দোলাল জেসমিন।
হঠাৎই ঝাঁপটা একটা বাতাস এসে জেসমিনের চুলগুলোকে মুখের উপর নিয়ে এলো। ডাক্তার হাডসন হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন চুলগুলো। চুল সরাতে না সরাতেই আর একটা বাতাসের ঝাঁপটা জেসমিনের শাড়ির আঁচলটা কাঁধের উপর থেকে সরিয়ে দিল। এবার অবশ্য ডাক্তার হাডসন ঠিক করে দিলেন না আঁচলটা। জেসমিন নিজের হাত দিয়ে শাড়ি ঠিক করতে গেলে ডাক্তার হাডসন জেসমিনের হাত ধরে বললেন, না, তুমি আমার, তোমার সবকিছুই আমার।
জেসমিন কিছু বলল না, নিজের মাথাটা এলিয়ে দিল ডাক্তার হাডসনের কাঁধে। ডাক্তার হাডসন ডান হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল জেসমিনকে। তারপর কাছে টেনে নিতে লাগল, অনেক অনেক কাছে!
*
রাত দুটা। জেহান বসে আছে তার ঘরে। ঘুম আসছে না। ইদানীং তার ঘুম আসে না। বড় অস্থিরতায় থাকে। মূল কারণ জেসমিন। সময় যত যাচ্ছে ততই জেসমিন তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। তাই জেসমিনকে হারানোর অজানা একটা ভয় কাজ করছে তার মধ্যে। নিজের ব্যর্থতার জন্য নিজেকেই দায়ী করে সে। কারণ এখন পর্যন্ত নিজের ভালোবাসা ভালোলাগার কথা বলতে পারেনি জেসমিনকে। বেশ কয়েকবার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। শেষ মুহূর্তে কেন যেন ভয় ভয় করে, মুখ থেকে কথা বের হয় না। শেষে অন্যকিছু বলে আসতে হয়, আর বুকভরা কষ্ট নিয়ে পার করতে হয় দিনটা।
জেহান সবুজ রঙের ডায়ারিটা বের করল। এই ডায়ারিটা গোপনে সংরক্ষণ করে সে। ডায়ারির পাতায় পাতায় জেসমিনকে লেখা তার চিঠি। সে লেখে ঠিকই কিন্তু একটাও পাঠাতে পারে না। সেই আগের কারণ, কেমন ভয় ভয় করে, চিঠি পাওয়ার পর আবার কী ভাববে জেসমিন! আজও জেহান একটা চিঠি লেখা শুরু করল।
প্রিয় জেসমিন,
ভালোবাসা নিও। এখন রাত দুইটা। অথচ তোমার চিন্তায় ঘুম আসছে না। তুমি ইদানীং কেমন যেন চুপ হয়ে গেছ। বাড়ি থেকেও বাইরে বের হও না। কলেজে তো যাওই না। জানি না কী হয়েছে তোমার। আজ পুরো বিকেলটা বসেছিলাম ছাদে। আশা ছিল তুমি একবার তোমাদের বাগানে বের হবে। কিন্তু বের হওনি। অথচ আগে প্রত্যেক বিকেলে তুমি বাগানে কাজ করতে। গাছগুলোকে তুমি যখন পানি দিতে আর পশ্চিমের হেলে পড়া সূর্যের আলো তোমার মুখে এসে পড়ত, আমি তোমার সৌন্দর্যে সত্যি পাগল হয়ে যেতাম। কী সুন্দর তুমি! আমি শুধু তোমাকে দেখি আর দেখি! মনে হয় সারাটাদিন তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। তুমি এত সুন্দর কেন! তুমি কি জানো তোমার হাসি আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ করে দেয়, আমার সমস্ত চঞ্চলতাকে স্থবির করে দেয়, আমি হয়ে পড়ে এক মূর্তি, ভালোবাসার মূর্তি। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি জেসমিন, দারুণ ভালোবাসি। অথচ সেই ভালোবাসার কথা তোমাকে বলতে পারছি না, বুঝাতে পারছি না। আমি অধম, সত্যি অধম। তবে আমি প্রতিজ্ঞা করছি তোমাকে বলব, আমার ভালোবাসার কথা তোমাকে বলব আর জয় করব তোমার মন। তারপর আমাদের জীবন হবে আনন্দের, বড় সুখের। তবে তুমি সত্যি পালটে যাচ্ছ, চুপচাপ থাকছ সবসময়। তোমাদের বাসায় গেলে খুব একটা কথাও বলো না, যদিও আগে বলতে। আমি অনুভব করি, তোমার কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কী হয়েছে বুঝতে পারছি না। কেউ কিছু বলে না। হেডমাস্টার স্যার আর তোমার আম্মা দুজনকেও কেমন যেন চিন্তিত দেখায় সবসময়, কথা বলতে গেলে মনে হয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। বুঝতে পারছি না কেন। তোমার এই মন খারাপ থাকা, বিষণ্ণ থাকা আমাকে এতটাই উদ্বিগ্ন করেছে যে আমি গিয়েছিলাম বিখ্যাত মনোচিকিৎসক ডাক্তার তরফদারের কাছে। মূল উদ্দেশ্য ছিল, তোমার বিষণ্ণতা কীভাবে দূর করা যায় তা জানা। আমি তার সাথে কথা বললেও তোমার বিষয়টা নিয়ে শেষ মুহূর্তে আর কথা বলতে পারিনি। কারণ আতঙ্কিত ছিলাম, যদি তিনি জিজ্ঞেস করেন তুমি আমার কী হও, তাহলে কী উত্তর দেব? আসলে আমি তোমার জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। এই না-পারা আমার জীবনের আর-এক ব্যর্থতা। জানি না তোমার জন্য আমাকে কত হাজারবার ব্যর্থ হতে হবে। আমি তোমাকে চাই, মন থেকে চাই। সামনাসামনি না পারলেও মনে মনে ভোমার কাছে আবেদন করছি, নিবেদন করছি, তুমি আমার হও। জানি না, কত সহস্ত্র নিবেদনে হবে তুমি আমার। তবে এটা সত্য, তোমার জন্য ব্যর্থ হতে, হারতে আমার লজ্জা লাগে না, কষ্ট লাগে না। বরং এই ভেবে তৃপ্তি পাই যে আমি হারলেও হারছি আমার প্রিয়তমার জন্য।
শুভরাত্রি!
প্রিয়তমা আমার।
চিঠি লেখা শেষ করার পর মনের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রশান্তি অনুভব করছে জেহান। সবসময়ই সে লক্ষ করেছে যখন জেসমিনকে সে গভীরভাবে অনুভব করে, একটা চিঠি লিখলে শান্ত হয়ে উঠে মনটা। এখন কিছুটা হলেও ভালো লাগছে। তাই সে বিছানায় এলো। অনুভব করছে ঘুম দরকার তার, আজ সারাটা দিন অস্থিরতায় থাকায় ক্লান্তিও গ্রাস করেছে তাকে। তাই শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল।
পরের দিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে জেসমিনদের বাড়িতে এলো জেহান। এই বাড়িতে আসার ক্ষেত্রে তার কোনো বিধিনিষেধ নেই। তবে বয়স যত বাড়ছে যাতায়াত ততই কমে আসছে। জেসমিন নিজেও আগে তাদের বাড়িতে আসত। ইদানীং আসে না বললেই চলে। গত ছয় মাসে তো একবারও আসেনি।
বাড়ির বারান্দায় দেখা হলো জয়ের সাথে। জয় মাথা উঁচু করে বলল, ভাইয়া, আমার চকলেট কোথায়?
জেহান পকেট থেকে চকলেট বের করে জয়কে দিলে। জয় খুশি হয়ে বলল, আমি জনিকে দিয়ে আসি।
ঠিক আছে, তোমার আপু কোথায়?
ঘরে আছে। তুমি যাও। আমি একটু আগে কথা বলে আসছি।
আর তোমার আম্মু?
রান্নাঘরে, ইলিশ মাছ রাঁধতেছে।
কথাগুলো বলতে বলতে জয় চলে গেল তাদের ঘরে। জনি ওখানে আছে।
জেহান এখন জেসমিনের ঘরের দরজার সামনে। মনে মনে ঠিক করল আজ সে ‘আপু’ সম্বোধন করবে না। আর পারলে নিজের ভালোবাসার কথাটাও বলবে, বলবে ডাক্তার তরফদারের কথা। এরকম একটা ভাবনা থেকে দরজায় টোকা দিল। তারপর ঢুকে গেল ভিতরে।
জেসমিন চেয়ারে বসে ছিল। তার দিকে তাকিয়ে বলল, জেহান তুমি!
তোমার সাথে কথা বলতে এলাম। কলেজে যাচ্ছ না, বাইরে বের হচ্ছ না, কেন?
ম্লান হাসল জেসমিন। বলল, শরীরটা একটু খারাপ।
কী হয়েছে?
দুর্বল দুর্বল লাগে।
ডাক্তার দেখাওনি?
হ্যাঁ দেখিয়েছি, ওষুধও খাচ্ছি। ডাক্তার বলেছে সময় লাগবে।
তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে তুমি খুব অসুস্থ। অনেকটা শুকিয়ে গেছ। চোখের নিচে হালকা কালি পড়েছে। কী ব্যাপার বলল তো!
জেহান, তুমি অত চিন্তা করো না। কলেজ কেমন চলছে?
ক্লাস তো হচ্ছে। কিন্তু সবাই জিজ্ঞেস করে, তুমি কেমন আছো? কিছু তো বলতে পারি না। আসলে তোমার অসুখটা কী তাও জানি না। টেবিলের উপর দেখছি আবার অনেক ওষুধ।
অধিকাংশই ভিটামিন আর আয়রন ট্যাবলেট। আর ঐগুলো যেগুলো দেখছ, ব্যথার ওষুধ, সাথে গ্যাস্ট্রিকের।
কীসের ব্যথা?
তলপেটে ব্যথা। কলেজে একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, মনে আছে?
হ্যাঁ, ঐ ব্যথা না কমে গেল!
এখনো কমেনি। হঠাৎ হঠাৎ ওঠে। এত বেশি যে সহ্য করা যায় না, মনে হয়…
কী মনে হয়?
থাক ওসব কথা। তুমি কি আমার একটা উপকার করতে পারবে?
কী উপকার?
বিষয়টা অত্যন্ত গোপনীয়।
জেহান নড়েচড়ে বসে বলল, অবশ্যই করতে পারব। আর সবকিছু গোপনও রাখব। তুমি আমার উপর শতভাগ আস্থা রাখতে পারো।
জেহান এমনভাবে কথাগুলো বলল যেন এরকম একটা মুহূর্তের জন্যই সে অপেক্ষা করছিল। একই সাথে সে অনুভব করছে, এখনই মোক্ষম সময়। নিজের ভালোলাগা আর ভালোবাসার কথা এই সুযোগে তার বলা উচিত। সে যখন এরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে বইয়ের ভাজ থেকে একটা খাম বের করে তাকে দিল জেসমিন। বলল, তুমি এই চিঠিটা রাশেদ ভাইকে দেবে।
জেহান তোতলাতে তোতলাতে বলল, রা…রা…রাশেদ ভাই!
হ্যাঁ, খুব অস্থিরতায় ভুগছেন উনি। আর বলবে যেন আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা না করে।
জেহান একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। ডিজিটাল এই যুগে প্রেমের গভীরতা কত বেশি হলে চিঠির আদানপ্রদান সম্ভব! তার ইচ্ছে হলো বলতে যে সে চিঠি দিয়ে আসতে পারবে না, কারণ সে জেসমিনকে ভালোবাসে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে বলল। জেসমিন কষ্ট পাক এমন কিছু সে করতে চায় না, জেসমিনের সুখ আর শান্তিই তার মূল লক্ষ্য।
বাইরে আসতে দেখা হলো জেসমিনের মা নিলুফারের সাথে। তিনি বললেন, কখন এসেছ জেহান?
এই তো কিছুক্ষণ হলো খালাম্মা।
তোমার আম্মা কেমন আছেন?
ভালো।
যাব যাব করে যাওয়া হয় না তোমাদের বাড়িতে। দেখি একদিন যাব।
আসবেন খালম্মা।
একটু থেমে জেহান আবার বলল, একটা কথা বলি…খা…লাম্মা, জেসমিনের শরীর বোধহয় খুব খারাপ। একেবারে দুর্বল হয়ে পড়েছে। ভালো একজন ডাক্তার দেখানো উচিত।
নিলুফার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ডাক্তার দেখিয়েছি, লাভ হয়নি। একজন মনোরোগবিশেষজ্ঞকে দেখাতে বলেছে ডাক্তার। তোমার হেডস্যার চেষ্টা করছে। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখাব। আসো, মুড়ি খাও, ঝালমুড়ি মাখিয়েছি।
না খালাম্মা, আজ খাব না। অন্য একদিন খাব। আসি।
সালাম দিয়ে বের হয়ে এলো জেহান। তার চোখে পানি। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। তার নিজের পছন্দের মানুষের চিঠি কিনা তাকে পৌঁছে দিতে হবে তার চিরশত্রুর কাছে। কী অবিশ্বাস্য! তারপরও সে কাজটা করবে, করবে এই ভেবে যে সে কথা দিয়ে এসেছে জেসমিনকে।
*
নিলুফার রান্নাঘর গুছিয়ে শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন রাত দশটার দিকে। প্রথমে বিছানা গুছালেন তিনি। শরীরটা বড় ক্লান্ত লাগছে তার। অবশ্য আজ, প্রায়ই ক্লান্ত লাগে। জেসমিন গর্ভবতী, এই সংবাদটা শোনার পর থেকেই মানসিক অবসাদ প্রতিদিনই বাড়ছে। এজন্য জোর পান না শরীরে। মন ভালো না থাকলে যে শরীর ভালো থাকে না এই সত্যটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছেন তিনি।
নাজমুল হোসেন ঘরে ঢুকলেন অনেকটা নিঃশব্দে। ওষুধের দোকানে গিয়েছিলেন তিনি। নিলুফার বললেন, ওষুধ পেয়েছ?
উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে নাজমুল হোসেন বললেন, হ্যাঁ পেয়েছি। এই যে ট্যাবলেট। আজ রাতে খাইয়ে দেবে। তাহলে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গর্ভপাত হবে।
নিলুফার কাঁপা হাতে লাল রঙের ওষুধ দুটো নিলেন।
নাজমুল হোসেন আবার বললেন, জেসমিন রাজি হবে তো?
রাজি হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় আছে! কার সন্তান পেটে ধরেছে এখন পর্যন্ত বলল না। ঐ সন্তান জন্ম দিলে সমাজে মুখ থাকবে নাকি আমাদের? আজ সারাদিন তো ব্যথায় ভুগল। ক্লিনিকেও নিতে হয়েছে। কলেজে পরীক্ষা পর্যন্ত দিতে পারল না। সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন এই ওষুধ না খেয়ে উপায় কী?
আমার নিজের যতটা না কষ্ট হচ্ছে, ওর কথা ভেবে বেশি কষ্ট হচ্ছে। এই বয়সে কত বড় একটা ভুল করে ফেলল!
শুধু ওর দোষ দিয়ে লাভ নেই। আমাদের সমাজেরও দোষ। ছোট ছোট বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন, কম্পিউটারে ইউটিউব, টেলিভিশনে শুধু উলটাপালটা হিন্দি সিরিয়াল, এইগুলা দেখেই তো নষ্ট হচ্ছে সবাই।
তুমি ঠিকই বলেছ। তবে সমাজের কথা চিন্তা করে এখন আর লাভ নেই। আগে ঘর সামলাই। আমার কাছে সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।
শুধু এলোমেলো না, রহস্যও আছে এর মধ্যে।
কী রহস্য?
গত তিন মাসে আমি অনেকদিন সকালে জেসমিনকে লাল শাড়ি পরে শুয়ে থাকতে দেখেছি। ও রাতে ঘুমায় সালোয়ার কামিজ পরে, অথচ সকালে দেখি শাড়ি। কী অদ্ভুত! রাতে শাড়ি পরে ঘুমাবে কেন?
কই! আগে বলোনি তো!
ঠিক ঐভাবে সন্দেহ হয়নি। হয়তো ভেবেছিলাম শখ করে পরেছে। বিষয়টা কেমন যেন সন্দেহজনক।
রাতে কি তাহলে বাইরে যায়?
তা তো সম্ভব না। সামনের গ্রিলে তালা দেয়া থাকে। ওর ঘরের জানালায়ও গ্রিল লাগানো। বাইরে যাবে কীভাবে? আবার চাবিও তো থাকে আমাদের ঘরে।
তালার দুইটা চাবি, আর-একটা কোথায়?
ওটাও আমার কাছে।
তাহলে?
ঠিক বুঝতে পারছি না। ওর কাণ্ডকারখানা যেন কেমন! বাচ্চা পেটে, খুব যে টেনশনে আছে মনে হয় না। মাঝে মাঝে গুনগুন করে গানও গায়।
নাজমুল হোসেন মাথা নেড়ে বললেন, না না, এভাবে বলো না। জেসমিন শুকিয়ে যাচ্ছে, চোখের নিচে কালি পড়েছে। লক্ষ করেছ?
হ্যাঁ। কিন্তু আমাদের সবকিছু খুলে বলবে না! ওর আচরণে মনে হয় আমরা ওর শত্রু। আমরা যে ওর মঙ্গল চাই তা ও বুঝতে পারছে না।
এমন একটা বিষয়, কথা বলাও অস্বস্তিকর। যাইহোক, তুমি ওকে ওষুধ দুটো খাইয়ে দাও। ওষুধ খাওয়ানোর পর তলপেটে ব্যথা উঠতে পারে। লক্ষ রাখতে হবে ওর উপর।
আমি তো চাই জেসমিনের ঘরে ঘুমাতে। জেসমিন রাজি হয় না। দেখি, আজকেও বলে দেখি।
কথাগুলো বলে ওষুধ হাতে নিলুফার এলেন জেসমিনের ঘরে। জেসমিন শুয়ে ছিল। জানালা দিয়ে দেখছিল বাইরের চাঁদ। নিলুফার আসলে নিজে থেকেই বলল, কী সুন্দর চাঁদ, দেখেছ মা?
হা, পূর্ণিমা বোধহয়।
আজ না, আগামীকাল।
বুঝলি কীভাবে?
চাঁদটা একটু ছোট ছোট মনে হচ্ছে।
রাতে বাইরে তাকিয়ে আছিস, ভয় করছে না?
কীসের ভয়?
কতকিছুর ভয়ই তো থাকে। তুই যেন ইদানীং বুঝেও অনেককিছু বুঝতে চায় না। শোন, ঝামেলা যা হবার হয়েছে। এখন সবকিছুর সমাধান করতে হবে। তোর বাবা ওষুধ নিয়ে এসেছে। এই ওষুধ দুটো খেয়ে নে।
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, কীসের ওষুধ!
নিলুফার কোনো ভণিতা ছাড়াই বললেন, গর্ভপাতের ওষুধ। এই ওষুধ খেলে পেট খালি হয়ে যাবে। তখন তুই নিশ্চিন্ত হতে পারবি। আমরাও বেঁচে যাব।
কী বলছ এসব!
কী বলছি মানে!
আ…আমি একটা মানুষকে মেরে ফেলব!
মানুষকে মারছিস কোথায়? জন্মই তো হয়নি ওর।
হয়নি, তবে জীবন তত সৃষ্টি হয়েছে, হৃদস্পন্দন তো আছে। আমি কীভাবে একটা মানুষকে হত্যা করব!
নিলুফার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, গর্ভপাত মানুষ হত্যার জন্য না, তোর জন্য চিকিৎসা। তুই যা করছিস! নিজেও মরবি, আমাদেরও মারবি। এই যে নে পানি, ওষুধ দুটো খেয়ে নে। আর দুই-একদিনের মধ্যে তোকে একজন মানসিক ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। তোর বাবা ডাক্তার ঠিক করছে।
ঠিক আছে ডাক্তারের কাছে যাব। তবে ওষুধ এখন খাব না।
তো কখন খাবি?
পরে খাব। টেবিলের উপর রেখে যাও।
এখন খেলে কী হয়?
জেসমিন বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না মা।
আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না?
না। যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
কথা শেষ করে আবার চাঁদের দিকে মুখ ফেরাল জেসমিন। নিলুফার আর কিছু বললেন না! টেবিলের উপর ওষুধ আর পানি রেখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বড় অস্বস্তি লাগছে তার।
জেসমিন বিছানা থেকে উঠল আধ ঘণ্টা পর। তারপর টেবিল থেকে ওষুধ দুটো নিয়ে বাথরুমে গেল। বেসিনে ফেলে ছেড়ে দিল কল। দুটো ওষুধই গলে হারিয়ে গেল পানির মধ্যে।
জেসমিন মৃদু একটা হাসি দিল। এতক্ষণ নিজের মধ্যে একরকম আতঙ্ক কাজ করলেও কেন যেন এখন বড় ভালো লাগছে। আজ তার ইচ্ছে হচ্ছে লাল শাড়ি পরে ডাক্তার হাডসনের সাথে সময় কাটানোর। বলবে, তাকে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার জন্য। জায়গাটা তার বড় পছন্দের। যখনই যায়, তখনই ভালো লাগে। এই পর্যন্ত কতবার যে গেছে তার কোনো হিসাব নেই। নির্জন পাহাড়ে সে আর শুধু তার প্রিয় ডাক্তার হাডসন! মাঝে মাঝে ভাবে সারাটাজীবন যদি ঐ হাডসন হিলে কাটিয়ে দিতে পারত।
ভাবনায় সুন্দর একটা ভালোলাগা নিয়ে চোখ বন্ধ করল জেসমিন। কতক্ষণ সে চোখ বন্ধ করে ছিল বলতে পারবে না। ঠুক ঠুক শব্দ শুনে চোখ মেলে তাকাল। তার ঘরের জানালার ওপাশে শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছিল বুঝি ডাক্তার হাডসন এসেছে। পরে যখন ‘জেসমিন, জেসমিন’ ডাক শুনল ভুল ভাঙল তার। ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রাশেদ।
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, ভাইয়া আপনি!
হ্যাঁ। অনেকদিন তোমাকে দেখি না। তাই আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না।
এত রাতে এসেছেন! এখন কয়টা বাজে!
সাড়ে বারোটা।
আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
আসলেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে তোমার! শুকিয়ে গেছ অনেকটা, চোখের নিচে কালি পড়েছে।
মৃদু হাসল জেসমিন। তারপর টেনে টেনে বলল, এজন্যই আপনাকে চিঠিতে লিখেছি যে আমাকে ভুলে যান। আমার ভালোবাসা আপনার জন্য নয়। চিঠিটা কি দেয়নি জেহান?
হ্যাঁ দিয়েছে। ঐ চিঠি পেয়েই মন খারাপ হয়ে গেছে। তুমি আমার ফোন পর্যন্ত ধরছ না ইদানীং।
ঐ যে বললাম, আপনার জন্য আমার আর ভালোবাসা নেই ভাইয়া, আমার ভালোবাসা নীল চোখের ছায়ার জন্য।
নীল চোখের ছায়া!
হ্যাঁ। নীল চোখ।
কী সব বলছো জেসমিন!
সত্য বলছি। এজন্য অনুরোধ করব আর আমাকে ফোন করবেন না, চিঠি লিখবেন না। আমার কাছে কোনোদিন আসবেনও না। আমি সত্যি অন্য কারো হয়ে গেছি। আর এটাও সত্য, কখনো আপনার ছিলাম না, এখনো নেই। মাঝে হয়তো আপনার সাথে কথা বলেছি, রিকশায় উঠেছি, মোটরসাইকেলে ঘুরতে গিয়েছি…
শুধু ঘুরতেই যাওনি, আমরা দুজনে দুজনার…
জেসমিন ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, প্লিজ ভাইয়া, যা কিছু ঘটেছে নিজের মধ্যেই রাখুন। আমি চাই না কোনো কারণে আপনি বিব্রত হন, আপনার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাক।
তোমার কথা আমি কিছু বুঝতে পারছি না জেসমিন।
প্লিজ আপনি যান। বাবা-মা এখনো জেগে আছে। যে কোনো সময় চলে আসতে পারে। আর-একটা কথা, কোনোদিনও এখানে আসবেন না। ভুলে যাবেন আমাকে, চিরদিনের জন্য। একটা কথা সত্য, আমি আপনাকে ঠকাতে পারব না।
আ…আমি…
জেসমিন আবার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে নিষেধ করল রাশেদকে। ফিসফিস করে বলল, আপনি চলে যান, সম্ভবত মা এদিকে আসছে, পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
রাশেদ আর কথা বলল না। চলে যাওয়ার জন্য লাফ দিয়ে পিছনের দেয়ালের ওপর উঠল। জেসমিন অবশ্য ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকল। নিলুফার ঢুকলেন ভিতরে। কপালে হাত রাখলেন জেসমিনের। তারপর বিড়বিড় করে বললেন, আমার এত সুন্দর মেয়েটার কী যে হয়ে গেল!
*
জেহানের মনটা খারাপ। কারণ জেসমিন আজও পরীক্ষা দিতে পারেনি। তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা। হিউম্যানিটি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সারাদিন ওখানে ছিল। সন্ধ্যার পর নিয়ে আসা হয়েছে বাসায়। সে গিয়েছিল দেখতে। কিন্তু কথা বলতে পারেনি। কারণ ঘুমিয়ে ছিল জেসমিন। অথচ জেসমিনের সাথে তার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে। কয়েকদিন আগে যেদিন শেষ কথা হয়েছিল, রাশেদকে দেয়ার জন্য চিঠি ধরিয়ে দিয়েছিল জেসমিন।
জেহান তার সবুজ ডায়ারিটাতে আবার লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন, মন ভালো নেই। কারণ, তোমাকে আজ দেখতে পেলাম না। তুমি অসুস্থ হলে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে যাই। কিছু ভালো লাগে না। শুধু মনে হয় তুমি কখন সুস্থ হবে আর তোমাকে দেখতে পাব। আজ তুমি পরীক্ষা দিতে পারলে না, তার মানে সামনের এইচএসসি পরীক্ষা তুমি দিতে পারবে না। বড় দুঃসংবাদ তোমার জন্য। তবে মন খারাপ কোরো না। আমি তো আছি। সামনে হয়তো আমাদের সাথেই তোমার ক্লাস করতে হবে। আমি নিশ্চিত করে বলছি, তোমাকে যত সাহায্য করতে হয় করব, তোমাকে ক্লাসনোট দেয়া, পড়া বুঝিয়ে দেয়া, অ্যাসাইনমেন্ট করে দেয়া সব আমার দায়িত্ব। ক্লাসের ফাঁকে তোমার সাথে সিঙ্গারা পুরি খাওয়ার আমার বড় শখ। দুজনে সিরাজ মামার দোকানে বসব আর সিঙ্গারা খাব। আমি কিন্তু তখন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকব। তুমি নিষেধ করতে পারবে না। সত্যি কথা কী, তোমার অবস্থান আমার মনে নয়, মনের অনেক অনেক গহিনে, যেখানে অন্য কেউ কোনোদিন পৌঁছাতে পারবে না। ঐ জায়গাটা শুধু তোমার, শুধুই তোমার। যখনই প্রয়োজন হবে, আমি তোমাকে বুকের ঐ গহিন থেকে বের করে আনব, তারপর দেখব, দেখব, আর দেখতেই থাকব। কেন জানো? তুমি সুন্দর, অপূর্ব সুন্দর। তোমার মতো সুন্দর আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। ভালো থেকো, সুন্দর থেকো, আর দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো প্রিয়তমা আমার।
চিঠি লেখা শেষ করার পরও ঘুম আসছে না জেহানের। কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে ছাদে উঠে এলো সে। হাঁটাহাঁটি করতে থাকল এ মাথা থেকে অন্য মাথা পর্যন্ত। জেসমিনদের বাড়ির প্রান্তে যখন আসে তখন প্রত্যেকবারই চোখ রাখে বাড়ির উপর, যদি একবার জেসমিনকে দেখা যেত। সে জানে জেসমিনকে দেখা যাবে না, তারপরও মন যে বারবার চায়!
হঠাৎই জেহানের চোখ পড়ল একজন পুরুষ বের হয়ে যাচ্ছে জেসমিনদের বাড়ির পিছনের দেয়াল ডিঙিয়ে। প্রথমে মুখটা দেখা না গেলেও পরে যখন পিছন ফিরল তখন দেখা গেল। আর কেউ নয় রাশেদ। এত রাতে রাশেদ এখানে ভাতেই ভাঙা মনটা আরো ভেঙে গেল জেহানের। তার মানে রাতে রাশেদকে বাড়িতে আসতে দিচ্ছে জেসমিন। কী অবিশ্বাস্য! যে জেসমিন আজ অসুস্থ, ক্লিনিকে ছিল সারাদিন, পরীক্ষা দিতে পারেনি, এমনকি সে নিজে গিয়েও দেখা করতে পারেনি, সেই জেসমিন কিনা আজ রাতেই কথা বলছে রাশেদের সাথে। নিশ্চয় ফোনে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। ভাবতেই শরীর কাঁপতে শুরু করল জেহানের। ভয়ংকর এই কষ্টটা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ছাদেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে বের হয়ে আসতে লাগল পানি। সিদ্ধান্ত নিল আজ সে কাঁদবে, যতক্ষণ ইচ্ছা হবে কাঁদবে। কেঁদে কেঁদে নিজের বুকের কষ্ট লাঘব করবে।
জেহান কতক্ষণ ছাদে বসে ছিল বলতে পারবে না। একসময় নিচে এলো, তারপর আবার টেনে নিল ডায়ারিটা। লিখতে শুরু করল,
প্রিয় জেসমিন, তুমি ভাবছ অন্যের প্রতি তোমার ভালোবাসা থাকলে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যাবে। না মোটেও না। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বড় নিখাদ, বড় খাঁটি। দিন যত যাবে এই ভালোবাসা ততই বাড়তে থাকবে। জানি না বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে। দুঃখ, এই ভালোবাসা তোমাকে দেখাতে পারছি না। তুমি আমাকে ভালোবাসো বা নাই বাসো, অন্তত আমার ভালোবাসাটা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম, তাহলে অন্তত মনে শান্তি পেতাম। তুমিও বুঝতে পারতে একজন মানুষ অন্য একজন মানুষকে কতটা ভালোবাসতে পারে, ভালোবাসার তীব্রতা আর গভীরতা কত দূর পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমার, আমি নিজেকে তোমার কাছে প্রকাশ করতে পারি না, বারবার ব্যর্থ হই। তুমি কি একবারের জন্য হলেও আমাকে বুঝতে পারো না? বুঝতে পারো না যে, তোমারই বাড়ির পাশের কেউ একজন তোমাকে দারুণ ভালোবাসে, তার হৃদয়ে শুধু তুমি, তুমি আর তুমি। একবার, শুধু একবার যদি তুমি বুঝতে পারতে আমি যে কী খুশি হতাম! যাইহোক, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারো, সেই অধিকার তোমার আছে। আমি তোমাকে নিষেধ করব না। তবে মনে রেখো, যাকে তুমি ভালোবেসেছ সে যদি তোমাকে ছেড়ে চলেও যায় আমি তোমাকে ঠিকই ভালোবাসব। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিনও কমবে না, কোনোদিনও না, শুধু বাড়তেই থাকবে, বাড়তেই থাকবে। এত বাড়বে যে হিমালয় পেরিয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে, আকাশ পেরিয়ে মহাকাশ, তারপর দূরে আরো দূরে… তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার ব্যাপ্তি সীমাহীন, প্রিয়তমা আমার।
চিঠি লেখা শেষ করার পর জেহান ডাইনিং রুমে এলো। পানি খেল এক গ্লাস। দেখল তার মা মরিয়মও ঘুম থেকে উঠেছেন। জেহানকে দেখে বললেন, কী রে, ঘুমাসনি?
না মা।
কেন?
ঘুম আসছে না।
কী বলছিস! কী হয়েছে?
জানি না মা, তুমি কি আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে?
আহারে আমার ছেলেরে! তোকে ঘুম পাড়িয়ে না দিলে কাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব। চল, চল।
শুয়ে পড়লে মরিয়ম জেহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলেন। জেহান একসময় বলল, মা, আমি যদি তোমার কাছে কোনো সাহায্য চাই করবে?
অবশ্যই করব। কী হয়েছে তোর, বল তো।
কিছু হয়নি।
কিছু একটা তো হয়েছে। তা না হলে সাহায্যের কথা বলবি কেন?
বললে রাখবে কি না বলো?
আমি তোর মা। রাখার মতো হলে অবশ্যই রাখার চেষ্টা করব। কী হয়েছে বল!
জেহান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে তার মাকে জেসমিনের কথা বলবে। যা থাকে কপালে হবে। কিন্তু বলতে গিয়েও বলতে পারল না। বলল, মা আমাদের ক্লাসে একটা ছেলে আছে, নাম হাবিব। হাবিবের দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেক টাকা লাগবে চিকিৎসা করতে। তুমি কি ওকে আপাতত হাজার দশেক টাকা দিতে পারবে?
মরিয়ম মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, এই সামান্য বিষয় নিয়ে এত চিন্তা করছিস! আমি তোর নানাকে বলে দিচ্ছি। তুই তো জানিস তোর নানা ডাক্তার আর তার ক্লিনিকও আছে। ওখানে হাবিবের ফ্রি চিকিৎসা করা হবে। আর দশ হাজার টাকা কালই তোকে দিয়ে দেব। তুই হাবিবকে দিয়ে আসিস। আরো যদি কিছু করা লাগে, বলবি। এটা তো ভালো উদ্যোগ, আমি চাই তুই এইসব ভালো উদ্যোগের সাথে থাকবি।
জেহান তার মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠল। মরিয়ম ভাবলেন তার সন্তান বড় খুশি হয়েছে, কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তিনি টের পেলেন না যে কী অসম্ভব এক কষ্ট ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে জেহানের হৃদয়টা!
*
পড়ন্ত বিকেল।
ডাক্তার ফারজানা আক্তারের কাছে এসেছেন নাজমুল হোসেন। সকালে এসেছিলেন তার স্ত্রী আর জেসমিনকে নিয়ে। আলট্রাসনোগ্রাম করতে দিয়েছেন তিনি। সকালেই করিয়েছেন, তবে রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন কিছুক্ষণ আগে। ডাক্তার ফারজানাকে রিপোর্ট দেখিয়ে তারপর তিনি বাসায় যাবেন।
ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর যখন নিশ্চিত হলেন ডাক্তার আসবেন তখন বেশ অস্থির হয়ে পড়লেন নাজমুল হোসেন। কী করবেন ভাবতে শুরু করলেন। পারুল নামের যে নার্স সবসময় সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে তাকে রিপোর্টগুলো দেখালেন নাজমুল হোসেন। পারুল আগে থেকেই চিনত নাজমুল হোসেনকে, তিনি যে স্কুলের হেডমাস্টার তাও জানত। বলল, স্যার, পেটের সন্তান তো বড় হয়ে গেছে!
নাজমুল হোসেন তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না…
রিপোর্ট যে ডাক্তার লিখেছেন উনার মতামত তো প্রেগন্যান্সিরই। আর এই যে পেটের ভিতরের ছবি দেখুন, বাচ্চাটা বেশ বড় হয়েছে। মাথা, শরীর বোঝা যাচ্ছে।
এখন আমি কী করব?
অ্যাবরশনের জন্য যে ওষুধ দিয়েছিলাম সেগুলো খাওয়াননি।
না, খাওয়াইনি।
সর্বনাশ, সময় তো পার হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চা বড় হয়ে গেলে অ্যাবরশন মানে গর্ভপাত আর সম্ভব হবে না।
আমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
ফারজানা ম্যাডাম বোধহয় আর আসবেন না।
আসবেন না মানে!
ম্যানেজমেন্টের সাথে সকালে তার ঝগড়া হয়েছে। যাওয়ার সময় বলে গেছেন আর আসবেন না। ফোনে কথা বলতে পারেন। কিন্তু লাভ হবে না। রিপোর্ট না দেখে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না।
অন্য কোনো ডাক্তার কি দেখানো যাবে?
আর কোনো গাইনির ডাক্তার নেই। আসলে কি জানেন স্যার, কেরানীগঞ্জে কোনো ডাক্তার থাকতে চায় না। সবাই থাকতে চায় ঢাকায়।
আমি তাহলে কী করব?
আগে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি আপনার মেয়ের পেটের সন্তানকে এই পৃথিবীর আলো দেখতে দেবেন, কি দেবেন না। পরিবারের সবার সাথে কথা বলুন। যদি জন্ম দিতে চান তাহলে নিয়মিত চেকআপ করাবেন। আর যদি না দিতে চান, দুই-একদিনের মধ্যেই গর্ভপাতের ওষুধ খাইয়ে দেবেন। আমি আবার ওষুধ লিখে দিচ্ছি, সিদ্ধান্ত আপনার। যত দেরি হবে, বিপদ তত বাড়বে। তখন হাসপাতালে ভর্তি করানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
কথাগুলো বলে পারুল একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখে দিল।
নাজমুল হোসেন বাসায় ফিরলেন রাত নয়টার দিকে। হাতে ওষুধ। মন খারাপ করে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। তারপর বাসায় ফিরেছেন। সবকিছু শোনার পর নিলুফার বললেন, আমাদের কিছু করার নেই এখন। ওষুধ খাওয়াতেই হবে জেসমিনকে। বড় বেয়াড়া হয়ে গেছে। ও। আমার কানে আজ একটা কথা এসেছে।
কী কথা?
রাশেদ নামের যে ছেলেটার সাথে ওর সম্পর্ক হয়েছিল তার সাথে মোটরসাইকেলে দূরে নাকি ঘুরতেও গিয়েছিল কয়েকবার।
নাজমুল হোসেন চোখ বড় বড় করে বললেন, কে বলল তোমাকে এই কথা?
আমাদের বাসায় যে রহিমা বুয়া কাজ করে, সে বলেছে।
তার মানে জেসমিনের পেটে যে বাচ্চা আছে তা রহিমা বুয়াও জানে!
অনেকেই জেনে গেছে।
কী সর্বনাশ!
এই কথা দিনের পর দিন লুকিয়ে রাখবে কীভাবে? তবে আমি এখনো স্বীকার করিনি কারো কাছে। স্বীকার করা যাবে না। তার আগেই ওষুধ খাইয়ে কলেজে পাঠাতে হবে জেসমিনকে। তা না হলে সন্দেহ বাড়তেই থাকবে।
তুমি কি নিশ্চিত হয়ে বলছ যে রাশেদের সাথে অনেক দূরে ঘুরতে যেত জেসমিন?
হ্যাঁ। সন্ধ্যায় আমি জেসমিনের বান্ধবী শান্তাকে ডেকেছিলাম। ওর কাছ থেকেও শুনেছি।
শান্তা কি জানে বাচ্চার কথাটা?
সরাসরি আমার সাথে কথা হয়নি। তবে আমার ধারণা ও অনুমান করতে পেরেছে।
নাজমুল হোসেন দাঁড়িয়ে ছিলেন। চেয়ারে বসে বললেন, আমার যে কী হবে? স্কুলের ছেলেমেয়েরা জানলে আর হেড মাস্টারগিরি থাকবে না। বড় বিপদে পড়ে যাব।
তুমি অত ভেবো না। আজ আমি ওকে ওষুধ খাওয়াবোই খাওয়াবো।
নাজমুল হোসেন আর কোনো কথা বললেন না। শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বড় ক্লান্ত লাগছে তার নিজেকে। নিলুফার জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার, খাবে না?
ক্ষুধা নেই।
মন খারাপ কোরো না। আমি একটা ব্যবস্থা করছি। আশা করছি আমাদের আপদ-বিপদ সব দূর হয়ে যাবে। কেন এ কথা বলছি জানো? জ্ঞাতসারে আমরা কখনো কোনো অন্যায় করিনি। আশা করছি বড় ধরনের কোনো বিপদে আমরা পড়ব না।
মুদু হাসলেন নাজমুল হোসেন। বললেন, আমরা তো মহাবিপদের মধ্যে আছি।
এই বিপদ থেকে আল্লাহই আমাদের উদ্ধার করবেন। আমি খাবার গরম করছি, তুমি খাবে। তারপর আমি যাব জেসমিনের কাছে। জেসমিনও রাতে খায়নি। ওকেও খাওয়াতে হবে।
জেসমিন অবশ্য রাতে খেল না। ওষুধ খাওয়ার কথা বলাতে প্রচণ্ড রেগে উঠল। নিলুফারও ছাড়লেন না আজ। বললেন, তুই যদি ওষুধ না খাস, তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি। তোর জন্য আজ আমাদের মানসম্মান সব শেষ!
এবার জেসমিন কিছু বলল না, চুপ করে বসে থাকল।
এই যে পানি, ওষুধ খা।
আগের মতোই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকল জেসমিন।
নিলুফার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। ঠাস করে একটা চড় কষালেন জেসমিনের গালে। তারপর পানি আর ওষুধ এগিয়ে দিলেন। জেসমিন এবারও ওষুধ নিল না। শুধু তার দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল।
হঠাৎই খুব খারাপ লাগতে শুরু করল নিলুফারের। তিনি জীবনেও জেসমিনের গায়ে হাত তোলেননি। আজ প্রথম তুললেন। ভয়ানক এক কষ্টে মুষড়ে উঠল বুকটা। আর অপেক্ষা করলেন না, ফিরে এলেন নিজের কক্ষে। নাজমুল হোসেন তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করে বুঝলেন ওষুধ খায়নি জেসমিন। মনটা তারও খারাপ হয়ে গেল। তাদের সংসারটা যে ধ্বংস হতে চলেছে তা এখন সম্পূর্ণই উপলব্ধি করছেন তিনি।
নাজমুল হোসেন কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলতে পারবেন না। তার ঘুম ভাঙল পাশের বাড়ির জেহানের চিৎকারে। সে চিৎকার করে বলছে, সবাই বের হয়ে আসেন, বের হয়ে আসেন, জেসমিন আত্মহত্যা করতেছে, আত্মহত্যা করতেছে।
জেহানের চিৎকার আর চেঁচামেচিতে বের হয়ে এলো সবাই। দেখল বাড়ির সামনে যে আমগাছটা আছে সেই আমগাছের সাথে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেয়ার চেষ্টা করছে জেসমিন। নিচে একটা চেয়ার। চেয়ারটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে জেসমিন। এখন ঝুলতে শুরু করেছে শরীরটা।
নাজমুল হোসেন জেসমিনের কাছে পৌঁছানোর আগে জেহান পৌঁছাল। দুই পা ধরে উপরের দিকে উঁচু করে ধরল জেসমিনের শরীর যেন গলায় চাপ না পড়ে। নাজমুল সাহেব কাছে আসতে বলল, স্যার, আমি ছাদে হাঁটতেছিলাম, হঠাৎ দেখি আত্মহত্যা করছে জেসমিন।
জেসমিনকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেলেন নাজমুল হোসেন। এর মধ্যে আশেপাশের অনেকেই জেগে গেছে। তাদের সবার মনে একটাই প্রশ্ন, কেন জেসমিন আত্মহত্যা করতে গেল?
*
কয়েকদিন পর জেহান কলেজ থেকে বাসায় ফিরছে। পথে দেখল রাশেদ তার এক বন্ধুর সাথে কথা বলছে। জেহান বিশ্বাস করে জেসমিনের বর্তমান অবস্থার জন্য রাশেদই দায়ী। কারণ সে রাতে রাশেদকে জেসমিনদের বাড়ি থেকে গোপনে বের হয়ে আসতে দেখেছে। কিন্তু জেসমিন কেন সবকিছু সবাইকে বলে দিচ্ছে না ঠিক বুঝতে পারছে না।
জেহান, জেহান!
ডাক দিল রাশেদ।
রাশেদের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। তারপরও পা বাড়াল জেহান।
কেমন আছো তুমি?
ভালো ভাইয়া।
তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।
হ্যাঁ, বলেন।
রাশেদ জেহানকে নিয়ে খানিকটা সরে এলো যেন তাদের কথা কেউ শুনতে না পায়। তারপর চারদিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী অবস্থা জেসমিনের?
আপনি খোঁজ নিচ্ছেন না কেন? ওকে তো আপনিই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এভাবেই বলতে ইচ্ছে হলো রাশেদের। তবে সে বলল না। রাশেদকে কিছুটা হলেও ভয় পায়। কারণ রাজনীতি করতে শুরু করেছে। সে। ইদানীং কিছু গুন্ডা টাইপের তোক নিয়ে ঘুরে। শেষে বলল, ভালো না, আজ একজন মানসিক ডাক্তারকে দেখাবে।
জেসমিন কি পাগল হয়ে গেছে?
না, হয়নি।
আমার মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। তা না হলে মানসিক ডাক্তার দেখাবে কেন? কয়েকদিন আগে নাকি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। তুমি তাকে বাঁচিয়েছ।
হ্যাঁ।
অত রাতে তুমি জানলে কীভাবে যে সে আত্মহত্যা করবে?
আমি ছাদে হাঁটছিলাম।
প্রতি রাতেই কি তুমি ছাদে হাঁটো?
না।
তাহলে যেদিন জেসমিন আত্মহত্যা করবে সেদিনই হাঁটছিলে। কীভাবে এতটা মিলল? তুমি কি আগে থেকে জানতে যে আত্মহত্যা করবে জেসমিন।
কী যা তা বলছেন ভাইয়া! আমি জানব কীভাবে?
রাশেদ টেনে টেনে বলল, তুমি ছোট মানুষ। সবকিছু জানার চেষ্টা করবে না। আর মনে রাখবে, অল্পবয়সে সবকিছু জানা ভালো না। তোমার কাজ পড়াশুনা করা, পড়াশুনা করবে। ঠিক আছে?
জি ভাইয়া।
আমি আগে কখনো জেসমিনদের বাড়িতে যাইনি। ভাবছি একবার যাব। কখন গেলে ভালো হয়?
জেহান বুঝতে পারল ডাহা মিথ্যা কথা বলছে রাশেদ। সে নিজে রাশেদকে দেখেছে জেসমিনদের বাড়ি থেকে বের হতে। তাও গভীর রাতে। আর আজ কিনা বলছে সে আগে কখনো জেসমিনদের বাড়িতে যায়নি।
রাশেদ আবার বলল, তুমি কি একটু কথা বলতে পারবে জেসমিনের সাথে? আমি সত্যি তার সাথে দেখা করতে চাই।
তাকে ফোন করেন।
ফোন ধরছে না।
আমার সাথেও তো কথা হয় না।
তারপরও তোমার বাসা তো পাশেই।
আচ্ছা আমি চেষ্টা করব।
তুমি তাহলে আমাকে জানাবে। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব। আসলেই তুমি খুব ভালো জেহান। এজন্যই তোমাকে এতটা পছন্দ করি। চলো ঐ দোকানে যাই, চা খাই।
না ভাইয়া, আমি চা খাব না। আসি।
আমাকে ফোন দেবে কিন্তু।
আচ্ছা ভাইয়া।
জেহান মাঝে মাঝে গাড়িতে করে কলেজে আসে। আজও গাড়ি এনেছে। গাড়িতে উঠে হাঁপাতে লাগল সে। হাঁপানোর কারণটা অবশ্য বুঝতে পারছে। রাশেদকে সে ভয় পেতে শুরু করেছে। দুটো কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ রাশেদ রাজনীতির সাথে জড়িত হওয়ার পর থেকে খানিকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, আর দ্বিতীয় কারণ হয়তো রাশেদ অন্যায় করতে শুরু করেছে। প্রথম অন্যায় করেছে জেসমিনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। এ কারণেই জেসমিন আজ প্রেগন্যান্ট। খবরটা সে ভাসাভাসা শুনেছে, নিশ্চিত নয়। ঠিক করেছে, জেসমিনের সাথে দেখা করতে পারলে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে। তবে এটা সত্য জেসমিনের পেটটাকে হালকা উঁচু মনে হয়েছে তার। আর এর জন্য রাশেদই যে দায়ী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রাশেদ এখন ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে একটা প্রশ্ন উঠছে, রাশেদ আবার কেন কথা বলতে চাচ্ছে জেসমিনের সাথে? হিসাবগুলো মিলছে না। আর হিসাব না মিললে সে অস্থির হয়ে ওঠে। এজন্য তার মধ্যে অস্থিরতা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
জেহান বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়ার পর দুপুরে ঘুম দিল। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে মোবাইল ফোনের রিং-এর শব্দে ঘুম ভাঙল তার। ফোন করেছে জেসমিন। জেসমিনের ফোন দেখে হাত-পা কাঁপতে শুরু করল তার। ফোন ধরতে, ওপাশ থেকে জেসমিন বলল, কেমন আছো?
ভা…ভালো। তুমি!
তোমাকে ধন্যবাদ জেহান। তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ।
ইয়ে… মানে…
তুমি না থাকলে হয়তো আমার লাশটা এতদিন পচে-গলে যেত।
কিছু বলতে গিয়েও পারল না জেহান, চুপ থাকল।
জেসমিন বলল, তবে কি জানো?
কী?
আমাকে তুমি বাঁচাতে পারবে না।
কী বলছ আপু?
সত্য বলছি।
আ…আমি তোমার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। তুমি তো বেঁচেই আছ। এখানে বাঁচা…
হ্যাঁ, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আত্মহত্যা করব। তুমি আর কতক্ষণ ঠেকাবে আমাকে?
তু…তুমি আত্মহত্যা করবে কেন?
আমার বাবা-মা আমার জন্য বড় কষ্টে আছে। জয় আর জনি এখনো বুঝতে পারছে না, তবে এটা সত্য, ওরাও একসময় কষ্ট পাবে আমার জন্য। আসলে কি জানো, আমার কিছু করার নেই, আমি… বড় অসহায়… আমি পারছি না… আর পারছি না…।
কথার মাঝেই কেঁদে উঠল জেসমিন। তারপর লাইন কেটে দিল।
জেসমিনের ফোন পাওয়ার পর খুব অস্থির হয়ে পড়ল জেহান। সে তাড়াতাড়ি ছাদে উঠল। না কোথাও দেখা যাচ্ছে না জেসমিনকে। একবার ভাবল জেসমিনদের বাড়ি যাবে। পড়ে বাদ দিল সেই চিন্তাটা, তার কেন যেন মনে হচ্ছে ইদানীং জেসমিনদের বাড়ির কেউ চায় না তাদের বাড়িতে অন্য কেউ আসুক।
জেহান আরো কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর পা বাড়াল বাইরে।
*
ডাক্তার তরফদার মানিকগঞ্জ এসেছেন। উদ্দেশ্য একজন রোগী দেখা। রোগীর বাড়িতে আছেন তিনি, নাম হামিদ। একটা ঘরের মধ্যে তার দুই হাত শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। কোমরেও একটা শিকল। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তিন ভাই, এক বোন তারা। ভাইদের মধ্যে হামিদ ছোট। অন্য দুই ভাই তার কোনো খবর রাখে না। বোনই মূলত দেখাশুনা করে হামিদকে। হামিদের প্রিয় একটা কাজ হলো বাঁশি বাজানো। তার একটা বাঁশের বাঁশি আছে। পাশেই থাকে। মাঝে মাঝে বাজায়। বড় করুণ সুর ঐ বাঁশির। কলেজে একটা অনুষ্ঠানে তার ঐ বাঁশির সুর শুনেই তার প্রেমে পড়েছিল ‘শিরিন’।
ডাক্তার তরফদার হামিদকে দেখা শুরু করেছেন বছরখানেক হলো। তার সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ। তিনি সবসময় আসতেও পারেন না। আবার হামিদের বোন হুশনারও এমন আর্থিক সংগতি নেই যে তাকে ঢাকা নিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা করাবে। তাই ডাক্তার তরফদার মাঝে মাঝে আসেন। আজ শেষ রাতে হঠাৎই তার হামিদের কথা মনে পড়ে। তখনই রওনা দেন মানিকগঞ্জের উদ্দেশে।
হামিদের বোন হুশনার বিয়ে হয়েছে পাশের বাড়িতে। এজন্য হুশনা যত্ন নিতে পারে হামিদের। অন্য দুই ভাই একই বাড়িতে থাকলেও তাদের অতটা সহমর্মিতা নেই যতটা আছে হুশনার। আগে হামিদের মা হামিদের যত্ন নিত, কিন্তু বছর তিনেক হলো সে মারা গেছে। তারপর থেকে হুশনাই দেখাশুনা করছে হামিদের।
হামিদের যে আচরণ তাতে তাকে প্রচলিত সমাজে ‘পাগল’ বলবে সবাই। ডাক্তার তরফদারের কাছে সে ক্রনিক এন্ড কমপ্লেক্স সিজোফ্রেনিয়ার (Chronic and Complex Schizophrenic) রোগী। তাকে সুস্থ করা সত্যি দুরূহ কাজ। তারপরও ডাক্তার তরফদার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বর্তমানে অবস্থা কিছুটা ভালো, মানুষ চিনতে পারে। তবে যে কোনো সময় আবার অবনতি হতে পারে। যখন মানসিক অবস্থা খুব খারাপ থাকে তখন সবাইকে সে ‘শিরিন মনে করে। শিরিন ছিল উপজেলা শহরের এক মেয়ে যাকে হামিদ ভালোবাসত। একই কলেজে পড়ত তারা। শিরিনের বাবা সরকারি কাজের জন্য এখানে বদলি হয়ে এসেছিলেন। শিরিন ভর্তি হয়েছিল হামিদদের কলেজে। প্রেমের সম্পর্ক অনেকটাই এগিয়েছিল তাদের। কিন্তু শিরিনের বাবা-মা রাজি না হওয়ায় একুশ বছর আগে বিয়ে হয়ে যায় শিরিনের। তারপর থেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে থাকে হামিদ। কয়েকবার শিরিনের শ্বশুড়বাড়ি সিলেট গিয়েও বিরক্ত করেছিল। একবার শিরিনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন প্রচণ্ড মারপিট করে হামিদকে। দুইমাস হাসপাতালে থাকার পর মানসিক অবস্থা আরো খারাপ হয় তার। যে কোনো মেয়েকে দেখলেই সে ‘শিরিন’ মনে করা শুরু করে। তার হাত ধরে প্রেমের কথা বলতে থাকে। থানায় অভিযোগ পড়তে থাকে। মামলাও হয় কয়েকটা। তবে ‘পাগল’ বলে খালাস পেয়ে যায়। শেষে সিদ্ধান্ত হয় শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার। সেই কারণে আজ অবধি প্রায় বিশ বছর ধরে শিকল বন্দি হামিদ। মাঝে মাঝে হুশনা তাকে ঘরের বাইরে নেয়। তাও অল্প সময়ের জন্য।
হামিদ সবসময় একটা থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে থাকে। টুর নিজ পর্যন্ত বিস্তৃত প্যান্টটা। একটা মাদুর আছে বসে থাকা আর শোয়ার জন্য। প্রস্রাব-পায়খানার বোধশক্তি তার আগে ছিল না। তবে ডাক্তার তরফদার চিকিৎসা করে বুঝাতে পেরেছেন যে তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। ঘরের মধ্যেই একটা মালশা আছে, ওখানেই সে প্রাকৃতিক ডাকের কাজগুলো সারে। আর এগুলো পরিষ্কার করে হুশনা। একজন বোন যে ভাইয়ের কতটা আপন হতে পারে, হুশনাকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
হামিদকে দেখতে এলে ডাক্তার তরফদার সাথে করে ডালিম নিয়ে আসেন। কারণ ডালিম হামিদের খুব প্রিয়। হামিদ ডালিমের ভক্ত হয় শিরিনের সাথে সম্পর্কের সময়। শিরিনের পছন্দ ছিল ডালিম। শিরিন নাকি প্রায়ই তাকে ডালিম উপহার দিত। শিরিনের দেয়া ডালিম বড় যত্ন করে খেত সে।
ডাক্তার তরফদার আজও ডালিম নিয়ে এসেছেন। ডালিম কেটে দিলে খাবে না হামিদ। আস্ত দিতে হবে। নিজে ভাঙবে, তারপর একটা একটা করে রোয়া খাবে। লাল একটা রোয়া মুখে দিয়ে হামিদ বলল, স্যার বড় মিষ্টি।
ডাক্তার তরফদার মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, তোমার মজা লাগছে।
হামিদ মাথা দুলিয়ে বলল, জি স্যার, মেলা মজা। আমি যখন স্যার সুস্থ হবো, তখন কী করব জানেন স্যার?
কী করবে?
বাংলাদেশের রাস্তাঘাট সবজায়গায় ডালিম গাছ লাগাব, শত শত ডালিম গাছ, হাজার হাজার ডালিম গাছ, লাখ লাখ ডালিম গাছ। বাংলাদেশ হবে ডালিমের বাংলাদেশ, লাল লাল ডালিম। ডালিমগুলা পাইকা গাছে ঝুইলা থাকবে। আমি শিরিনরে মেলা ডালিম দিব, মেলা। আর কারে দিব জানেন স্যার?
না জানি না।
আপনেরে দিব। তয় বেশি না, একটা।
ডাক্তার তরফদার কিছু বললেন না। কেন যেন তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন। হামিদের বলার ধরনটা একেবারে শিশুর মতো।
হামিদ আবার বলল, স্যার আর একজনরে দিব।
কে সে?
আমার মায়েরে দিব, মা।
তাই নাকি?
জি স্যার। মা প্রত্যেকদিন আমারে দেখবার আসে। ডালিম নিয়া আসে। তয় আমার জন্য ডালিম কিনতে মায়ের বড় কষ্ট হয়। ক্যান, জানেন স্যার? মায়ের অভাব। গরীব মানুষ তো, অত টাকাপয়সা নাই। মায়ে মেলা ভালো। আসলে কি জানেন স্যার? সব মা-ই ভালো। মায়ের মুত্যু হইলেও সন্তানের পাশে থাকে, যতদিন সন্তান বাঁইচা থাকে তারে আঁচলের নিচে আগলায় রাখে। সব সন্তানেরা বুঝবার পারে না, আমি পারি।
ডাক্তার তরফদারের কী যে হলো তিনি বলতে পারবেন না। তার চোখে পানি চলে এলো। মাঝে মাঝে তিনি প্রকৃতির উপর খুব রাগ হন। প্রকৃতি পৃথিবীর সুন্দর মনের মানুষগুলোকে এত কষ্ট দেয় যে সহ্য করা যায় না। হামিদের তেমন কোনো দোষ নেই, দোষ ছিল শুধু একটাই সে শিরিনকে ভালোবেসেছিল। তাই আজ বিশটি বছর শিকলবন্দি সে। তার থেকেও কষ্টের তার স্বপ্ন কোনোদিন হয়তো পূরণ হবে না। কারণ তার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ। কিছুক্ষণ আগে রক্তে গ্লুকোজ মেপেছেন তিনি। গ্লুকোজের মাত্রা চব্বিশ। ক্রনিক ডায়াবেটিসের রোগী সে। হার্টের অবস্থাও ভালো না। হৃদস্পন্দন অনিয়মিত। সবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কোনো ওষুধ হামিদ খাবে না। এজন্য দিন যত যাচ্ছে অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে।
হঠাই হামিদ ডেকে উঠল, স্যার!
বলল হামিদ।
স্যার আমার একটা কথা শুনবেন?
কী কথা?
আগে বলেন শুনবেন।
আচ্ছা শুনব।
আমারে একটু শিরিনের কাছে নিয়া যাবেন। মেলা দিন হইল তারে দেখি না, আমারে না দেইখাও হে বড় কষ্টে আছে।
ঠিক আছে নিয়ে যাব।
কবে নিবেন স্যার?
আমি শিরিনের সাথে কথা বলে নেই।
জি স্যার, বলেন। ঐ দিন আমারে একটা সুন্দর কাপড় কিনা দিবেন। আসলে কি জানেন স্যার, আমি তারে কত ভালোবাসছি আপনেরে বুঝাবার পারব না।
তুমি শিরিনকে অনেক ভালোবাস, তাই না?
তারে আমি মেলা ভালোবাসি, মেলা। আমার বুকের মইধ্যে খালি তার জন্যই সব ভালোবাসা, সব স্যার।
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাই ডুকরে কেঁদে উঠল হামিদ। তারপর চোখ মুছতে মুছতে বলল, স্যার আমার মনে বড় কষ্ট, আমার একটা সুন্দর কাপড়ও নাই স্যার। শিরিন যদি দ্যাখে আমার কোনো ভালো কাপড় নাই, কী যে কষ্ট পাবে! আমি তারে কষ্ট দিবার চাই না স্যার, কষ্ট দিবার চাই না। আমার খুব শখ তারে আমি একটু বাঁশি বাজায় শুনাব। আমার বাঁশি বড় পছন্দ করত সে। কতদিন আমার বাঁশি শুনে না। কী যে কষ্টে আছে স্যার, আপনেরে বুঝাবার পারব না।
ডাক্তার তরফদার কী বলবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। হামিদকে তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসেন। হামিদের প্রত্যেকটা কথা তার বুকের মধ্যে বিধে। তার এরকম কিছু রোগী আছে যাদের জন্য তিনি অনেককিছু করতে চান। অথচ কিছু করতে পারেন না। মেডিক্যাল সায়েন্স, সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স, প্যারাসাইকোলজিক্যাল সায়েন্স, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, সার্জিক্যাল সায়েন্স, স্পিরিচুয়াল সায়েন্স, মেডিটেশনাল সায়েন্স, ফিজিওথেরাপি সবকিছুর ঊর্ধ্বে এই রোগীরা। একজন ডাক্তার হিসেবে একজন রোগীর জন্য কিছু করতে না পারা যে কতটা কষ্টের তা ঐ ডাক্তার ছাড়া আর কেউ বোঝে না। কিন্তু ডাক্তার তরফদার মাঝে মাঝে অনুধাবন করেন, বিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেন, প্রকৃতি তার ক্ষমতা দিয়ে মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দেয় যে প্রকৃতির কাছে মানুষের বিজ্ঞান বড় তুচ্ছ।
হামিদের আর একটা সমস্যা হচ্ছে হামিদ পানি খেতে চায় না। ডাক্তার তরফদার নিজেও অনেকক্ষণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। একপর্যায়ে হামিদ খানিকটা রেগে ডাক্তার তরফদারের দিকে বোতলও ছুঁড়ে মারল। ডাক্তার তরফদার তারপরও চেষ্টা করে গেলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিফলই হতে হলো তাকে। একজন মানুষের দৈনিক যেখানে দুই লিটার পানির প্রয়োজন হামিদ সেখানে এক গ্লাস পানিও খেতে চায় না। এটা খুব খারাপ লক্ষণ।
ডাক্তার তরফদার যখন বিদায় নিলেন হামিদ তখন তার বাঁশিতে সুর তুলল,
প্রথম প্রেমের স্বপ্ন বুনে, হারিয়ে গিয়েও বহুদূরে,
কল্পনায় আছো তুমি, হৃদয়ে আছো তুমি,
আছো তুমি ভাবনায়, ভালোবাসার ঐ ‘মন জোছনার কান্নায়।
এক বুক কষ্ট নিয়ে ডাক্তার তরফদার বাসায় ফিরে এলেন। গেট দিয়ে প্রবেশের সময় দেখলেন সুন্দর চেহারার একটা ছেলে বসে আছে বারান্দায়। তিনি কিছু বলার আগেই ছেলেটি বলল, স্যার আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমার নাম জেহান, আগে একবার এসেছিলাম।
হ্যাঁ, মনে পড়েছে। কয়েকদিন আগে তুমি কিছু বলতে এসেছিলে আমাকে। না বলেই চলে গিয়েছিলে।
জি স্যার।
আসো ভিতরে আসো।
আচ্ছা স্যার।
ডাক্তার তরফদার ঘড়ি দেখলেন। বিকেল চারটা। মানিকগঞ্জ থেকে তার আরো আগে ফেরার কথা ছিল। পারেননি এ কারণে যে গাবতলীতে খুব জ্যাম ছিল। ঘণ্টাতিনেক ওখানেই নষ্ট হয়েছে।
ডাক্তার তরফদার জেহানকে বসিয়ে রেখে হাত-মুখ ধুতে গেলেন। এসে দেখেন জেহান নেই। তবে একটা চিঠি রেখে গেছে সে। চেয়ারে হেলান দিয়ে খুললেন সাদা খামের চিঠিটা। ভিতরে টানা টানা অক্ষরে লেখা,
স্যার,
আমার সালাম নিবেন। ক্ষমা করবেন এই কারণে যে আপনার সাথে সামনাসামনি সব কথা বলার সাহস আমার নেই। কারণ আপনি অনেক বড় মানুষ। অনেক সুনাম আপনার। সেই তুলনায় আমি একেবারেই নগণ্য, ক্ষুদ্র। আমার থেকে ক্ষুদ্র মানুষ বোধহয় এই পৃথিবীতে আর নেই। যাইহোক, স্যার আবারো সালাম নিবেন। আমি চিঠি লিখছি আমার নিজের জন্য নয়। একজনের জীবন বাঁচানোর জন্য। তাকে বাঁচানোর জন্য আপনার সাহায্য বড় প্রয়োজন। যদি অসহায় এক মেয়ের জীবন বাঁচাতে চান, তাহলে স্যার চিঠির উলটো পাশে লেখা নম্বরে আমাকে ফোন করবেন। আমি জানি আপনি ফোন করবেনই করবেন। কারণ আপনি চান না কেউ আত্মহত্যা করে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যাক। আপনি বড় উদার আর ভালো মনের মানুষ। এখন থেকে প্রত্যেকটি মুহূর্ত আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকব। বিষয়টি অতীব জরুরি।
ইতি
জেহান
ডাক্তার তরফদার চিঠিটা পরপর তিনবার পড়লেন। তারপর সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য দুই মিনিট সময় নিলেন। চিঠিটা ছোট হলেও যে খুব গুরুত্বপূর্ণ বুঝতে পারছেন তিনি। তা না হলে জেহান কখনোই তার কাছে আসত না, আগেও সে তার কাছে এসেছিল। তিনি ঠিক করলেন আত্মহত্যার ঘটনাটা প্রতিহত করবেন। তাই ফোন করলেন জেহানের চিঠির উলটো পাশে দেয়া ফোন নম্বরে। পরপর তিনবার ফোন করে যখন ফোন নম্বরটা বন্ধ পেলেন তখন সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বিতীয় কোনো উপায়ে জেহানকে তার খুঁজে বের করতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
শুধু ফোন নম্বর থেকে ঠিকানা বের করতে হলে সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন কোম্পানি কিংবা পুলিশের সহায়তা লাগবে। যদিও জেহান লিখেছে যে ফোনটি তার, তারপরও সন্দেহ থেকে যায় যে ফোনটি অন্য কারো কি না। প্রতারণা বা হয়রানির বিষয়টাও মাথায় রেখেছেন ডাক্তার তরফদার। সেক্ষেত্রে যার ফোন নম্বর তার ঠিকানা খোঁজা সমীচীন হবে না।
সবকিছু বিবেচনা করে ডাক্তার তরফদার থানায় আসাটাকেই যৌক্তিক মনে করলেন। থানার ওসি সাহেব আগে থেকেই তাকে চেনেন। সবকিছু শুনে একটা আবেদন চাইলেন ওসি সাহেব। ডাক্তার তরফদারের আবেদনের ভিত্তিতে একটা জিডি হলো। ওসি সাহেব বললেন, স্যার চিন্তা করবেন না, আমি মোবাইল ফোনের মালিকের ঠিকানা আপনাকে দেব। প্রয়োজনে পুলিশও আপনাকে সাহায্য করবে। তবে আমাদের কয়েক ঘণ্টা সময়ের প্রয়োজন।
ডাক্তার তরফদার রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন। রিকশা থেকে নামার পর তার কেন যেন বড় ক্লান্ত মনে হলো যুবকবয়সি রিকশাওয়ালাকে। ইচ্ছা করেই এক শ টাকা বেশি দিলেন। তারপর বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে বড় ক্লান্ত তুমি, খুব কি খারাপ লাগছে?
মনটা ভালো নাই স্যার।
কেন?
সারাদিন খালি কাম আর কাম। সকাল থাইকা সন্ধ্যা পর্যন্ত। বাড়ির সবাইর শুধু চাওয়া আর চাওয়া। এই চাওয়া-পাওয়ার যেন শ্যাষ নাই স্যার। ভাবখানা এমন যেন আমি তাগো জন্য কিছু করি নাই। অথচ স্যার যা আয় হয় সবই ব্যয় করি সংসারের জন্য।
মৃদু হাসলেন ডাক্তার তরফদফার। তারপর বললেন, মানুষ তোমার কাছ থেকে কী পেয়েছে সেই হিসাব তোমাকে সাধারণত সে দেবে না, তোমার কাছ থেকে কী কী পায়নি সেই হিসাব তোমাকে বারবার শোনাবে।
একটু থেমে ডাক্তার তরফদার আবার বললেন, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে পানিশূন্যতা রয়েছে তোমার শরীরে। দিনে আট থেকে দশ গ্লাস পানি খাওয়ার নিয়ম। তুমি রিকশা চালাও, পানি আরো বেশি খেতে হবে তোমাকে। পানি শরীরকে যেমন ঠান্ডা রাখে মনে এনে দেয় প্রশান্তি। ভালো থেকো।
গেটের ভিতর ঢুকলেন ডাক্তার তরফদার। সারাদিন বড় ব্যস্ততায় কেটেছে তার। ক্লান্তও লাগছে। বাড়ি ফিরে দেখেন দুজন রোগী বসে আছে। তাদের সাথে কথা শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে নিলেন। তারপর আবার ফোন করলেন জেহানকে। না, ফোন বন্ধ। তিনি নিশ্চিত হলেন বড় ধরনের কোনো রহস্য আছে জেহানের কার্যক্রমে। এই রহস্যটা তাকে ভেদ করতেই হবে।
*
Leave a Reply