কাতিউশার গল্প

কাতিউশার গল্প

চতুর্থ মুদ্রণ: এপ্রিল ২০১৪
আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড। ৪৫ বেনিয়াটোলা লেন, কলকাতা ৯। পৃ. ১০৪, মূল্য: ১০০.০০
প্রথম সংস্করণ: জানুয়ারি ২০০৬
প্রচ্ছদ: বিপ্লব মণ্ডল
উৎসর্গ: কাগজের কুচি উড়ছে সন্ধের হাওয়ায়…/দীর্ঘকবিতা’র দিন শেষ

.

আপত্তি নেই কোথাও কোনও।
মুঠোর ভেতর রোদ ফুরনো’র দিন
বয়েস হল পায়রাদেরও
সকাল নিজের আলস্যে রঙিন
চৌকো রেলিং, তিনকোনা প্রেম
যে যার মতো সময় মাপে রোজ
তাকাই, কিন্তু ঠোঁট উলটে নিই
যেন গভীর রহস্যে নিখোঁজ…
চোখের কোণে জাহাজকুচি
সবাই ভাবে ভিন্নরুচির ছেলে—
ওপার থেকে আসছে এপার
আস্তে-আস্তে, সাবধানে পা ফেলে…

চোখে জ্বলছে। জল।
আজ নিভিয়ে দাও উড়ন টিপকল।
জর্দা। মাথাঘোরা।
তুমি দিনের শেষে লোকজনের খোরাক।
বিষাদ। নেকটাই।
আমি ঘুমের ট্রেন থামিয়ে দিতে যাই—
খেলার নীচে খেলা।
ঘড়ি চেঁচিয়ে ওঠে, তোমরা ভাবো অ্যালার্ম
আমি তো জানি, খুন।
মরাসন্ধে, বিড়ি, ক্যারাম, মৈথুন
বাদাম নেই। খোসা।
এসো, বিক্রি করি শেষবারের মতো
মৃত বন্ধুদের পোশাক…

উড়ে যা বারবার।
তোর ডানা এসে বিঁধুক কার্নিশে
আমারও কারবার,
আমি সাদাজল মিশিয়েছি বিষে
খেয়ে তো চিৎপাত
লোকে ম’রে যাচ্ছে হাপুস হুপুস
আমিও ফিটফাট,
বাঁকা দু’নয়নে চশমার ঘুষ
উড়ে যা বারবার
এসে কার্নিশে বিঁধুক তোর ডানা…
ওড়াও কারবার।
আমি চেষ্টা ক’রে দেখেছি, সোজা না।
বন্দুকের মিথ
কাঁধে নিয়ে ঘুরছি সাজানো জঙ্গল
কর্মা ও করিৎ
দুই ভাই, আহা, শিকারপাগল।
পাতার মশমশ
পায়ে নববুট, নবতর স্টেপ
খেজুরের রস,
আর মাঝেমধ্যে হাঁড়ির আক্ষেপ
রহস্যের নাম?
জানি, লেখা আছে উল্কায়, উকুনে…
বড় তো হলাম
মরা ভাল্লুকের গল্প শুনে শুনে।

আকাশ নীচে পড়ছে ভেঙেচুরে
বিকেলবেলা, কে দেবে তার দাম
মাটির শোক খাচ্ছে কুরে কুরে
গরিব কোনও সাপের মতো, ট্রাম…
আমাকে ওরা পাঠিয়ে দিল দূরে—
আমি ঘুমের ওষুধ জানতাম।
আস্থা নেই। আস্থা ব’লে হয় না কিছু আর।
সময় কেটে যায়…
তোমার থেকে ছিনিয়ে আনি আমার সংসার
বিক্রিভাবনায়
ভাবনা নেই। ভাবনা ব’লে হয় না কিছু আর।
কী দুশ্চিন্তায়
তোমার হাতে উঠিয়ে দিই বিনীত উপহার
অবুঝ ধান্দায়…
ধান্দা নেই। ধান্দা ব’লে হয় না কিছু আর।
নকশা পালটায়
তোমার থেকে ছিনিয়ে আনি আমার সংসার
সময় কেটে যায়…

ভুল কুয়াশা
ব্যর্থ ছবি
বেলুনঅলা
পেছন পেছন
ওমরাও জান
আশার গলা
পায়ের নীচে
সন্ধেবেলার
ধর্মতলা
দিন পড়ছে। চাদর যেমন কাঁধ থেকে…
সবচে’ উঁচু টিলার ওপর সন্ধেরং
অলস পায়ে খাদ নেমেছে জঙ্গলে…
তপ্ত, স্বাধীন, তামাটে এক সভ্যতা
হাজার বছর পোষ মেনেছে নেকড়ে দল।
আদিম কোনও শস্যবোনা সপ্তাহে
এক পৃথিবী রসদ নিয়ে ফিরছে সব
লিহাজ ক’রে ডাকছে আমায় ‘গাঁওবুড়া’
বয়েস হল। দৃষ্টি দূরে। শক্তি নেই।
সবচে’ উঁচু টিলার ওপর সন্ধেরং…
পাথর নিয়ে খেলছে নরম বাচ্চারা
একলা ব’সে দেখব গুহার এক কোণে—
ইচ্ছে যদি না করে তো খেলব না।

তোমা বিনা বাজে লাগে
কাটে না এ ঘড়িপলছিন…
ছিনিয়ে নিয়েছি রাগে
মুঠোভরা চতুর বক্সিং
শিং ভেঙে, হ্যাঁ, বাছুর
ফলে নেই গোঁতানোর দম
দমকে দামিনী দূর
বাঁহাতে সময় বড় কম
কমার্স পড়েছিলাম,
এখনও পাইনি কোনও কাজ
কাজলে পুড়েছে কাম
এই না হলে, সজনী, সমাজ!

ভেঙে যাবে সন্ততিরা
আমি কাঁধে নেব সেই দোষ…
তোমাকে ভেবেছি নীরা
নিজেকে ভেবেছি শঙ্খ ঘোষ

ঝুড়ি আঁকড়ে নেমে আসছে বট
খুরিভর্তি উঠে আসছে চা
ঠোঁটে মাংস, আহা স্পিকটিনট
যত পারবি দূরে ঘুরতে যা
রাতে সেই তো পাড়া, ভগ্নতট
বাড়ি ফিরতে ছিঁড়ে যাচ্ছে পা…
কারা খুলছে মাথাভর্তি জট
যত মস্তি তত যন্ত্রণা… !

ঈগল বানাক বাড়িঘর
আমি একা থাকি
পাহাড়ে পাঠাই গুপ্তচর
জঙ্গলে জোনাকি
শিকারি বসাই পদে-পদে
লুকোই হরিণ
আঙুল ডুবিয়ে লিখি হ্রদে:
‘জলে ঝাঁপ দিন’
আমার কঠিন চরাচর
সহজ চালাকি…
ঈগল বানাক বাড়িঘর,
আমি একা থাকি।

হেরে যাওয়ার গন্ধ আর অভ্যেসের ধাঁধা
পিঁপড়েদের শান্ত পায়চারি
ময়দানের মাটিতে দু’পা শেকল দিয়ে বাঁধা
চিবুক তোলো, আকাশকারবারি
ট্যাক্সি ছোটে কালোহলুদ চিতার মতো তেজি
চতুর্দিকে হাঁ ক’রে আছে হোটেল
নিয়ন থেকে গড়িয়ে নামে তরল ইংরেজি
হাজার লোক সিঁড়িতে নামে ওঠে…
কে আর অত খবর রাখে ব্যস্ততার দিনে,
কবে তোমার বন্ধ হল ওড়া
সন্ধে তার পোশাক ঝাড়ে, আলতো আস্তিনে
কুর্নিশের পালক, ছেঁড়াখোঁড়া…

তুমি তার মহাকাশ
সে তোমার মহাকাশচারী
আমার ভেতরে জাগে
অধমের অধম ভিখারি
দিন চলে যায়, ভাবি
আমি তাকে কী বা দিতে পারি…
বাবার বানানো হাসি
মায়ের বানানো তরকারি

ঝগড়াটবে ফুটিয়ে রাখি মীমাংসার ফুল
সহজ চালে ফুঁ দিয়ে বলি— ‘ধ্যুৎ!’
কফির কাপে কুয়াশা আর আমরা মশগুল
চামচ ঘোরে… মিষ্টি কী নিখুঁত
বাইরে কেন দাঁড়িয়ে আছ? ক্লান্ত… এলোচুল
ভেতরে এসো, সন্দেহের দূত!

বছর ঘোরে। কেন যে মেঘ করেছে এই শীতে,
বৃষ্টি নয়। ঠান্ডা অভিশাপ।
আমার হাত ছন্দ ভেঙে ঝোলায় বঁড়শিতে
তোমার পায়ে অশৌচের ছাপ…
সকালগুলো বদমেজাজি। দুপুর খিটখিটে
সন্ধে, রাত, অসহ্য আলাপ
অনেক আগে বুঝেছিলাম চুমুক দিতে দিতে
চায়ের চেয়ে বড় চায়ের কাপ

যদি আজ ফিরে আস
পুরনো, খারাপ রাস্তা ধ’রে
যদি ঢুকে আস আজ
বাতিল যন্ত্রের মতো, নিজের শহরে
যদি আজ নিতে আস
চুনকামের সোঁদা গন্ধ, ধুলো, পলেস্তারা…
যদি দিতে আস আজ
এত এত দিনকার বকেয়া পাহারা,
টিভি, ফ্রিজ, টেলিফোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু
কেউ যদি আজ তোমাকে না-ও চেনে, ঠিক
কুকুর তোমাকে চিনবে।
তুমি তার রক্তের মালিক।

মাঠের রোদে শোয়াও আমায়
কিন্তু কথা বোলো না
কাদের নিয়ে প্লেন উড়ে যায়
আজও জানা হল না…

বালিতে গেঁথে গেছে শিবির, ক্যাম্প।
দু’পাশে জলপাই রঙের ট্রাক
যেদিকে চোখ যায়, শ্রমিকমুখ
বিদেশি মেয়ে, হাতে কফির কাপ
দু’চোখে চিকচিক প্রাচীন রোদ
অতীত বিক্রির ভবিষ্যৎ…
দু’দিন, দশদিন, দু-চার মাস
কিছুতে উঠছে না অবুঝ ক্যাম্প।
ড্রিলার, ঢুকে যাও। কী লজ্জা?
ক্ষমতা গর্জাক আকাশময়…
খুঁড়েছ? খুঁড়ে ফ্যালো।
খুঁড়েছ? খুঁড়ে দ্যাখো।
খুঁড়েছ? খুঁড়ে নামো হাজার মাইল…
আমাকে পাওয়া অত সহজ নয়।

আজ আর তোমার স্বপ্ন না
সারারাত দেখলাম
সামনের বাড়ির বড় ছেলে
পুষেছে একখানা সিংহ, দু’খানা বাঘিনী
আর তার বউ
কোথা থেকে একটা লোককে এনে
বেঁধে রেখে খাওয়াচ্ছে তাদের।
শেষরাতে চোখের তলায়
জমা হল হাড় মাংস
ছালপালক
না-খাওয়া চিত্কার…
একদিকে ভালই,
সেখানে কোথাও তুমি নেই

আমারই কবিতা ছিল একবিকেল গাছের তলায়।
চোখ লেগে গেছিল আরামে
উঠে দেখি নেই।
হয়তো হাওয়ার সঙ্গে, ঝরা পাতাদের সঙ্গে
উড়ো খবরের সঙ্গে চ’লে গেছে বহুরাস্তা দূর…
তুমিও, শুনেছি, দূরে থাকো
তাকে দেখতে পেলে বোলো, সে যেন সত্বর ফিরে আসে
আমি ফেলছি অভিমান
সে যেন নিভিয়ে আসে রাগ
কীভাবে চিনবে ভাবছ?
পরনে ফতুয়া-প্যান্ট,
বাঁ গালে প্রুফের কাটাদাগ।

আমাকে দ্যাখে টিভি
চোখ রাঙায়, চোখ নামায়, হাসে।
রাত বাড়লে, রোজ
আমার ঘরে দেয়াল থেকে ঝাঁপায় টিকটিকি
টিভিও তাকে কপাৎ ক’রে খায়
রিমোট হাতে সামনে ব’সে মুগ্ধ আমি দেখি—
কীভাবে ওই একরত্তি প্রাণী
ডাইনো হয়ে যায়…!

‘এখনও অটোয়।’… ‘বাড়িতে ঢুকিনি।’…
‘তুমি পরে কোরো।’… ‘আপনি কেমন?’
‘রাস্তায় আছি।’… ‘রাতে কথা হবে।’…
সেলফোনে কারা পেয়েছে আমাকে…
তাদের সঙ্গে ভাগ ক’রে নিই
অটোর আওয়াজ, ট্রাম ঘড়ঘড়…
পুলিশের চোখ, মুড়ির গন্ধ…
একমুহূর্ত তাদের সঙ্গে
সিগন্যাল দিয়ে জোড়া কলকাতা…
এখনও বাড়িতে ঢুকিনি যেহেতু,
সেলফোনে যারা পেয়েছে আমাকে
তাদের সঙ্গে একজোট হয়ে
হাতে-পায়ে ধ’রে কথাগুলো সব
রাতের দিকেই ঠেলে দিই…

স্বর্গ হলেও হত,
নরকে ধান ভানতে চায় না ঢেঁকি
শব্দ লিখে কী হবে আর
পাঁউরুটিতে মাখন মাখাও—
দেখি

সবাই মিলে চিবুক তোলো
আকাশ থেকে ফুলকি হয়ে খসে পড়ছে শব্দআলো
কী খুশি আর কী হাততালি
লম্বা, সরু, টাটকা বাজি…
নিচু নজর উঁচু করার এই তো সুযোগ
ঘাড়ব্যথা হোক
নীচে তাকাও,
ভাঙা পাঁচিল
রকেট উড়ে যাবার পরে
অন্ধকারে, ভূতের মতো ফাঁকা বোতল…

আবার এসেছে বরফের যুগ
যেদিকে তাকাই, পাথুরে বরফ
জমাট কুয়াশা… কনকনে হাওয়া…
পৃথিবীতে কেউ কোত্থাও নেই
না, ঠিক তা নয়, আমাকে ছাড়াও
একটা নেকড়ে বেঁচে আছে শুধু।
নেভা পায়ে এসে সামনে বসেছে।
আমাকে দেখছে। আমিও দেখছি।
দেখতে-দেখতে হাজার বছর
পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও
কে যে কাকে খাবে, বোঝা যাচ্ছে না

ছোট ঘুম। ছোট জাগা।
ছোট আড়মোড়া। ছোট হাই।
ছোট ছেলেমেয়েদের চোখ
দোকানে ভাঙাই।
মহাকাশ নেই। পাড়া।
তারা নেই। বাচ্চাদের ক্রেশ।
কাগজের কুচি উড়ছে সন্ধের হাওয়ায়…
দীর্ঘকবিতা’র দিন শেষ

ইলেকট্রিকের তারে সন্ধে, কাক ফিরছে ডেরায়…
যে যার মতো বাড়ি ফিরছে নিজের
আস্তে-আস্তে ওপর দিকে মুখ তোলো, ক্যামেরা
ছাদের মেঝে পুরনো আর ভিজে
৩০ বছর বেরোয়নি সে। ডাকেওনি অন্যেরা
চিলেকোঠায় ঘুমিয়ে আছে লিজেন্ড…

বাড়ি থেকে বার ক’রে দিলে
মানুষ কোথায় আর যায়,
জরুরি কাজের ভান ক’রে
ঘুরে মরে পাড়ায়-পাড়ায়
সন্ধে নেমে এলে, চুপচাপ
ব্রিজ থেকে ট্রেন যাওয়া দ্যাখে
সময় লোহার মতো ভারী
আলো নিভে আসে একে-একে…
নিজের গায়েই এসে লাগে,
যত থুতু ছোড়ে সে আকাশে
ভাবে, ম’রে যাওয়া ছিল ভাল…
তারপর, বাড়ি ফিরে আসে।

ভেবেছিলাম পুবদিকের হিসেব নির্ভুল
দিন কাটল কাচগাঁথা পাঁচিলে
এল বাগান ভর্তি ক’রে বিপদগাছে ফুল…
ছোট্ট টবে উল্কা পুঁতেছিলে।
বিকেলে মন যতই হোক উদাস, খিটখিটে
হাসা নিয়ম, দাঁত উপড়ানো ঝড়ে
বসেছ সেই পাঁচিলে, আর গা থেকে কাঁচামিঠে
মুগ্ধতার মাংস খ’সে পড়ে…

সবার সেই এক চিৎকার—
‘আমার দাম বেশি তোর চে’!’
রোলারে পিষে যাওয়া চিন্তা
এখনও ধুকপুক করছে…
তা দেখে বাঁকা হাসি। খ্যাক খ্যাক।
রোলার। তার গায়ে মরচে।

আমায় ভেঙে, বাঁকিয়ে, মুড়ে যেমন খুশি বানাও
তোমার যে-কোনও দরকারে
হাঁটতে-হাঁটতে পৃথিবী শেষ এক সন্ধেবেলা
ব’সে হাঁপাও। দ্যাখো, আরে—
দিগন্তে কে বসিয়ে গেছে একটা টেডি বিয়র…
সে তো বোমাও হতে পারে!

মার খেয়ে এসে রোজ
মুখ রাখি তোমার খোলা পিঠে
পিঠ নয় আর। সে তখন
চনমনে রোদভর্তি বিশ্রামরঙের খোলা মাঠ
যেদিকে দু’চোখ যায়
ট্র্যাক্টর, কারখানা, যুদ্ধ, কারশেড কোথাও কিছু নেই…
শুধু কোমরের কাছ থেকে
ছোট্ট-ছোট্ট ঘাস উঠে, ঘাড়ের একটু নীচে
ভাগ হয়ে চলে গেছে দু’ কাঁধের দিকে…
মার খেয়ে এসে আমি কোন দিকে যাব—
তোমার পিঠেও দুটো পথ।

ফ্রিজে রাখা ছিল মগজ।
চিন্তার জল টপ-টপ ক’রে গড়িয়ে
মেঝে, সিঁড়ি, গেট, পাড়া টপকিয়ে
ছড়িয়ে পড়ল শহরে।
যত লোক ছিল, সকলের পায়ে একফোঁটা ক’রে লাগল
এখন সবার চলাফেরা খাওয়া ওঠাবসা ঘুম কন্ট্রোল করে
ফ্রিজে রাখা সেই মগজ…

কীভাবে বুলডোজার ভেঙে দেয় ঘর
কীভাবে গাছের গলা কেটে নেয় বৈদ্যুতিক করাত
কীভাবে মাটির নাকচোখ উপড়ে নিয়ে
তাকে সমতল ক’রে আনে ক্রেন
কীভাবে, কীভাবে এত এত বছরের ভিত
খুঁড়ে ফ্যালে ঝন্ঝন্ ড্রিলার…
আমাকে না। যন্ত্রকে বোঝাও।

তোমার প্রিয় রঙের নাম দাবানল
তোমার পোষা হাওয়ার নাম হারিকেন
পুড়িয়ে দাও যখন খুশি, যা খুশি
উড়িয়ে নাও যে-কোনও পথচারীকে…
এত দাপট। এত দাপট? তুমিও
অস্ত যাবে ঠান্ডা কোনও তারিখে…

আমার বরাদ্দ ছাই
তোমার না হয় কিছু ধুলো
থাকি ঘরে বন্দি হয়ে
তোমাকে দিলাম জানলাগুলো
পিঠে বেঁধে নিয়ে যাও,
সমুদ্রের ধারে গিয়ে খুলো—
সবাই তোমার লোক, জানি।
আমি তো আমার
মাঠে দাঁড়িয়ে বোঝা যায় না, মাঠের শেষ থেকে
এখনও আমি কতটা বিচ্যুত
কবিতা নয়। যে ক’রে হোক নিজের চারপাশে
ভিড় জমিয়ে খুশি থাকার ছুতো
সরেও আসি। ঠিক যেভাবে একটু ক’রে, রোজ,
চাদর থেকে আলগা হয় সুতো…

উল্কা পড়ে, শুনেছি, কোথাও
হাওয়ার নাম, জেনেছি, দখিনা
সে হাওয়াও অন্য পাড়া যায়
আমি ছোট। আটকাতে পারি না।
শুধু মেঘ ক’রে এলে ভাবি,
মা কোনও আঘাত পেল কিনা…

মেট্রো হবে। রডের ওপর হাতুড়ি ঝ’রে পড়ে
গলির বাঁকে গুবরে পোকা অটো
শব্দ করে গুমরে পথ চলার
ঢালাই আর পাথরকাটা রোজ
জিরাফ হয়ে গলা বাড়ায় আমার ভাবনার
ঊর্ধ্বে বারোতলা
দুপুর কিছু মনেও পড়ে যায়।
দেখা না দেওয়া পাখির ডাক
খাবার পর অলস হাতপাখা
তার মধ্যে ঝিম ধরানো বেসুরো টানা গলা…
এখন শুধু বিকেল আর সন্ধে। আমি ভাবি,
দুপুরগুলো বিক্রি নেই
মরেও গেছে হয়তো সেই শোনপাপড়িঅলা

দুপুরে পাতা খসার মতো কোনও
বাহানা চাইছিলাম
শুয়ে থাকার গন্ধ আসে…শোনো—
শীতের শেষ টিলা
ফুঁ দিয়ে ভাঙি। আঘাতে ওড়ে ধুলো
আমারই মুখ ফিকে
গড়িয়ে যায় বিকেলবেলাগুলো
আমার নিচু বিকেলবেলাগুলো
ময়দানের দিকে…

সহ্য হত না আলো।
চোখ জ্বলে যেত। তারপর ঝাঁকে-ঝাঁকে
ফেলে দেওয়া ভাঁড়, ভাঙা বোতলের কাচ
এ.সি. পেয়ি চেক, রকেটের ডানা
জানলা’র গ্রিল, রাতজাগা ঘড়ি
বাতিল গল্প, আজেবাজে হাসি
চোখের মণিতে বিঁধল।
অন্ধ।
এখন আলোই আমার তাকানো সহ্য করতে পারে না।

ভারী ভারী অভিমান পিঠে বেঁধে নিয়ে
রওনা হয় ছোট ছোট মাপের মানুষ
ঢালু ঢালু উপত্যকা পায়ে পায়ে হেঁটে তারা ওদিকে পৌঁছবে।
এদিকে তাদের বাড়ি, ভিজে জামা, খুলে রাখা কল
না-বন্ধ রেডিয়ো-টিভি কাঁদে…
হাওয়া দেয় খুব
হাওয়া-মোরগের ডানা কাঁপে
খেতে দোলে ঘুম পাওয়া রাক্ষসের মতো
কাঁচা-পাকা ঝগড়ার ফসল…
মানুষ মিলিয়ে যায় ছোট হতে-হতে…
হাওয়া-মোরগের কিচ্ছু করার থাকে না।
একেকদিন রাত নামলে ঘাড়ে ভর করে
জঙ্গল-জঙ্গল খেলা, সে-ই কবেকার
ছমছম ঝোপের গায়ে গা লাগিয়ে বেশ
সস্তা দূরবিন দিয়ে দূরত্ব শিকার
প্রতিশোধ নিতে, দ্যাখো, জোনাকি হয়েছে
জামা থেকে ঝেড়ে ফেলা অফিসপরাগ
ফাইল উলটিয়ে তাঁবু, পেন গেঁথে খুঁটি
মনে-মনে এঁকে নেওয়া তাঁর পায়ের দাগ…
নেশা চুপ। ঝিঁঝি চুপ। মেট্রোরেল চুপ।
গড়াতে-গড়াতে থামে বোতলের সীমা
এত যে জঙ্গল খেলা, বোঝাও আমাকে
যে-কোনও চাঁদের রাতে নেকড়ের মহিমা

কারও ছায়া পড়ে না মাটিতে
এখানে সবাই এত সৎ
বাঁকা হুল্লোড়ের পাশ দিয়ে
ঢালু হয়ে নেমে গেছে পথ…
নিচু দরজা…লন্ঠনের আলো…
ভূতের পানীয় ভবিষ্যৎ
টেবিলে টেবিলে ভারী মাথা
গেলাসে পরির দস্তখত…

অপচয় জন্তু বটে কিছু।
ঢুকেছে আমার ঘরে কী ভারী শরীর টেনে-টেনে
এত এত এতদিন ধ’রে
আমার অক্ষরজ্ঞান, চিন্তাভাবনা, লেখাপত্র
কামড়ে, চুষে, খেয়ে ফিরে গেছে।
এখন সারাসকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধে, রাত
না-খাওয়া কঙ্কাল হয়ে বিছানায় পড়ে আছে
আমার তাকানো।
অপচয় জন্তু বটে কিছু!
তাকে কোনওভাবে পোষ মানাতে পারিনি।
ভেবেছিলে প্রেম?
মনে করেছিলে ভালবাসা?
ওর কাজ পাশে ঘুরে-ঘুরে
শুধু অনুমান করা তোমার তামাশা
তুমি ভুল ভাবতে পারো, আমরা জানি ওর ছোট্ট বুকে
প্রোগ্রামিং করা আছে বোবাকালা মোহ
মন ব’লে কিচ্ছু নেই, তাই
তোমার পরিধি ছেড়ে বেরোতে পারে না উপগ্রহ।

মা যখন কাঁদে,
আমি অন্য ঘরে বসে থাকি।
মায়ের কান্না’র শব্দ সাত-সমুদ্র পার ক’রে
পৌঁছয় আমার কাছে। শুনি।
মায়ের কান্নার গন্ধ হাজারটা মশলার ঝাঁঝ ফুঁড়ে
আছড়ায় আমার মুখে। শুঁকি।
মায়ের কান্নার স্পর্শ রোদে মেলা জামা থেকে
টপ্‌টপ্ ঝ’রে পড়ে। ছুঁই।
শুনি, শুঁকি, ছুঁই…
শুধু দরজা ফাঁক ক’রে ভেঙে পড়া মা’র দিকে
তাকাতে পারি না।
ভয় হয়।
মা যখন কাঁদে,
আমি অন্য ঘরে ব’সে থাকি।

একঘেয়েমি দাঁড়িয়ে গেছে অভ্যেস—
দিনের গায়ে গড়িয়ে নামে সন্ধে।
কিছু মানুষ বাড়ি ফেরায় ব্যস্ত
কিছু মানুষ আড্ডা-তাস-বার-ক্লাব…
গাড়ির দল হুমড়ি খায় রাস্তায়।
ব্যস্ততার প্রতিটা মোড়ে সিগন্যাল
পোকার মতো গাড়ির ঝাঁক থিক্‌থিক্।
সবুজ রং। আবার সব ছুটল—
দূর থেকে বোঝাও খুব শক্ত
এর মধ্যে কোন গাড়ির ব্রেক নেই

লতার গলার মতো উঁচু-উঁচু ফ্ল্যাট
ছাদ থেকে প’ড়ে গেছে ছায়া
ভেঙে টুকরো। যে যা পারে কুড়িয়ে পালাল
‘মেরা হি থা। কিসনে উঠায়া?’—
ব’লে হাঁকছে চৌকিদার। তার পায়ে রোদ
দিন ছুটে যাচ্ছে এঁকেবেঁকে
লতার গলার মতো উঁচু-উঁচু ফ্ল্যাট
ছায়া পড়েছিল ছাদ থেকে…

লোক উঠে যায়, লোক নেমে যায়, দাঁড়িয়ে থাকি ঠায়…
বাসেক্কে বাস ট্রেনেক্কে ট্রেন ছাড়ি
একটু বেশি রাতের দিকে পা রাখি পাড়ায়
তাও মনে হয় ফিরছি তাড়াতাড়ি
কারণ জানতে চাইলে বলব, ফিরে আসাই যায়।
বানিয়ে দিও ফেরা’র মতো বাড়ি—

মৃত্যু নয়। স্রেফ কেটে পড়া।
তার আগে চুটিয়ে আড্ডা, ঘোরাফেরা
গান, চুমু, লিকার চা (কড়া)
লেখা নয়। ঠোঙার রসদ
মহাকাল-ফহাকাল বাজে কথা।
যার ভাগে যতটুকু রোদ…
তুমি নয়। পুরোটাই আমি।
আমার ভেতরে ভাঙছে যত তুমি-ওরা-তারা
গতকাল— এক্ষুনি— আগামী!

চাদর দাঁতে কাটো, ঘষো কপাল দিয়ে বালিশ
দু’হাত বোলাও কোলবালিশের স্তনে
শান্তি পাও না। সারাটা রাত মাথার ভেতর চলে
অদ্ভুত নাচ, রংচঙে, চনমনে
বন্ধ টিভি’র স্ক্রিন চুঁইয়ে সাপের মতো নামে
আঠালো নীল রক্ত, বিনোদনের…

ভাঙে ঘুম অনেক বেলায়
ভারী চোখ, গলার আওয়াজ
ছিল কাজ, দিচ্ছে হাওয়া
পায়ে পা জড়িয়ে গেছে
তবুও ইচ্ছে করে
যে-সকাল নষ্ট হল,
তার দাম চাইতে বেরোই

ভোজপুরী গান বাজে আমাদের পাড়ার সেলুনে।
সঙ্গে পেটি, ধনাধন ঢোল
মনে হয় গুটখায় সুর দিয়েছে কেউ।
দু’ মিনিট শুনে
কান ঝাঁ-ঝাঁ করে। ভাবি বন্ধ করতে বলব, দেখি
সেসব গানের তালে আমার মাথায় চলছে খচরমচ কাঁচি
চকাচক চমকে যাচ্ছে ক্ষুর…
বাইরে মার্চ। হলকা’র দুপুর।
দু’ গলি পরেই আমি থাকি।
কিন্তু যারা চুল কাটছে,
গানগুলোই তাদের সঙ্গী এই মেজো বাঙালি পাড়ায়
কেননা তাদের ঘর হাজার-হাজার গলি দূর।

তুমিও শান্তিই চাও। একটা রাত, একটু ঘুম
অন্যের না-বাঁচা দিয়ে কেনা
তোমাকে জড়িয়ে শুয়ে প্রেমিকা না পাগলিনি
তার হাতের রক্ত উঠছে না
হঠাৎ কী এত হাওয়া, জানলায় দাঁড়াও, দ্যাখো
দুলে উঠছে সবুজ হইচই
জঙ্গল এগিয়ে আসছে তোমার ঘরের দিকে…
ভবিষ্যত্বাণী তো ছিলই
মাটিতে আঙুল ঘষলে জিন এসে হুকুম চাইছে
কে বলেছে, কলকাতা অসুখী?
ইটে জল দিলে ফ্ল্যাট ঝমাঝম উঠে যাচ্ছে
সঙ্গে ভেঙে পড়বার ঝুঁকি।
জানলা খুললে ছায়াপথ। লুকোচুরি খেলছি একা,
ফাঁকা ঘরে ইকো হচ্ছে-‘টুকি—’
স্বপ্ন দেখছি আমি, নাকি স্বপ্নই আমাকে দেখছে…
না বুঝে আকাশে মাথা ঠুকি

এই দেখুন গুহা
রক্তদাগ, শ্যাওলা, চামচিকে
এই যে তিন দেয়াল
শব্দ আর সংখ্যা আর পাথর ঘ’ষে বানানো ছবি, ফিকে…
এই দেখুন মেঝে
পায়ের ছাপ, পিছল ইতিহাস
সোঁদাগন্ধ, ফসিল…
এখানে রোদ ঢোকে না বারো মাস
বাইরে যান, ওই দেখুন মহান বড় আকাশ,
ওখান থেকে ঝাঁপিয়ে প’ড়ে
চরম তাড়া খাইয়েছিল হাজার নিন্দুক
এই গুহায় লুকিয়েছিল শেষবারের মতো
স্বার্থপর রাক্ষসের মুখ…

এত যে সভ্যতা, যুদ্ধ, সম্পর্ক, হতাশা, জ্ঞান,
নেশা, জিন, ক্ষমতা, ঈশ্বর…
সমস্ত আসলে খেলা। সাময়িক। বাহবানির্ভর।
হাততালি ফুরিয়ে এলে, কোটি-কোটি বছরের পর
একদিন সন্ধেবেলা খেল্ শেষ ক’রে
আকাশ গুটিয়ে নিয়ে ফিরে যাবে ক্লান্ত বাজিকর

দেশলাই তার বারুদ খসায়
উড়তে-উড়তে জং ধরে পালকে
একেকটা দিন এমন আসে
মেঘের নীচে আগুন খোঁজে লোকে

ধ্বংস হাঁ করেছে
আমার পুরনো মাথা তার মুখে ঠুসে দিয়ে বলি ‘এই যে, খা—’
সে খায় জমানো সন্ধে, ডাকটিকিট, ছেড়ে আসা বন্ধুদের গলি,
হাভাতে বসন্তকাল, অচেনা ফ্রকের ঘের, গান…
এরকম অনেককিছু আরও।
এখন আমার মাথা নেই।
তার বদলে এবড়োখেবড়ো কাটাগলা থেকে
উঠেছে সার্কিট, কচি, সরু-সরু প্যাঁচে
কয়েকদিন হল
ধ্বংস তার ভারী লেজ আছড়াতে-আছড়াতে ফিরে গেছে।

আমাকে যেন শিখিয়েছিল কে
‘অযথা হাতে আকাশ ধরবি না’
দিন পেরিয়ে সবাই জেনেছে
মনখারাপ জমেই হয় মিনার
তার নীচেই ছোট্ট বসতি
বালতি টানে অন্ধ স্মৃতিহীনা…
টিপকলের আওয়াজে বুঝে নিই
আজ বিকেলে বৃষ্টি হবে কিনা
রোদের ইস্পাত। নয়তো ঝড়জল
বৃষ্টি পড়ছে…
আমার পা নিখুঁত। ওপরে চামড়া
তলায় সর্ষে
ভরেছি কিটব্যাগে শব্দ, স্বাদ, রং,
স্পর্শ, গন্ধ…
আমাকে যেতে হয় লোকের দরজায়।
দরজা বন্ধ।

ঝাপসা হাওয়া বৃষ্টি…
বান্ধবীর গলায় ভাঙা গান
কাতিউশার গল্প—
এখন তার রাশিয়া খান খান
ঝাপসা হওয়া বৃষ্টি
বান্ধবী’র কপালে দাও টিপ
কাতিউশার জন্যে
রাশিয়া নয়, ছোট্ট কোনও দ্বীপ।

মোহরের গন্ধ মেরে-মেরে
ঘাসকে জাগাই।
হিংস্র, তবু ব্রেকফাস্ট।
দাঁতে ছেঁড়া পাঁউরুটি, কালো কফি, বাসি রোশনাই
ফিরি কি ফিরি না বাড়ি… ঘড়ি ছেড়ে চলে গেছে
আমার সময় নেই তাই
ব্যর্থতা আতসবাজি। মহাকাশযান।
শেষ অব্দি কিছু না থাকা। পোড়াদাগ। ছাই।
রাত জেগে জল ঢালি, জল ঢালি, জল
কত বড় হবে, বনসাই

উল্কা পড়ে যেসব জায়গায়
গরম বাড়ে, অনেক বড়-বড়
গর্ত হয়ে যায়।
চমকে ওঠে গবেষণার দিন
দু’মাস পর পরিধি জুড়ে ছড়িয়ে প’ড়ে থাকে
প্যাকেট, ক্যান, বোতল, ন্যাপকিন
পাপড়ি ম্যালে ‘প্রহিবিটেড জোন’
হিসেব থেকে বোঝা যায় না ঠিক কে পতন ঘটিয়েছিল—
অভিমান না মাধ্যাকর্ষণ
উল্কা পড়ে যেসব জায়গায়,
আস্তে-আস্তে নাগরদোলা, রেস্টুরেন্ট বসে,
ক্লাউন ক’রে খায়
কার্নিভাল কামড়ে ধরে মাটি
উইক-এন্ডে আমরা যাই
টিকিট কেটে গর্তে নেমে হাঁটি…

পৃথিবী উন্নত। মানছি। তাও
সূর্য এসেছিল আগে
তরল তিনভাগ বলে না কিছু আর।
লড়াই চলে একভাগে…
সিংহ চেনা যায় উদাসীনতা দেখে
বোলতা চেনা যায় রাগে

সরীসৃপ সরীসৃপ সরীসৃপ সরীসৃপ যাও
শুকনো পাতা বুকে মাড়িয়ে আঠালো বয়ে চলা—
একইরকম তোমার পন্থাও।
ছোটবেলায় দু’তিনখানা হাত
আদর করেছিল ভীষণ… হিসহিসানি বজায় আছে তাই,
উপড়ে ফেলে দিয়েছে বিষদাঁত।
সরীসৃপ সরীসৃপ সরীসৃপ আমার যাতায়াত
তোমার। সব্বার।
ঝাঁপির নীচে ঘুমোয় রোজগার…
পাড়ার পর পাড়ায় ঘুরে বীন বাজায় ব্যর্থ বাবুরাম—
সাপের খেলা দ্যাখে না কেউ আর।

লোকে ছোট বলে। ছোট লাগে।
লোকে ছোট ভাবে। ছোট হই।
উঠে গিয়ে বসি খোলা মাঠে
দূরে রংচং…হইচই…
দু’খানা উল্কা খ’সে পড়ে…
জোনাকির ভার অল্পই
রাত বাড়ে। ছায়া বেড়ে চলে
ছোট ছলে আর কৌশলে
আমার স্বপ্নে ঘুরে মরে
ছোট-ছোট লোক। কাঁধে মই…
পাহাড় পেরিয়ে তিনটে গ্রাম
পার ক’রে প্রাসাদ, জঙ্গল…
তারও আছে ছোটখাটো নাম,
সেও কিছু ব্যাপারে সফল
এই এত পড়ন্ত বিকেলে
দুর্গের দেয়ালে ঠাসা পিঠ
ভাবছে বুড়ো কচ্ছপের ছেলে—
‘হেরে গেলে জেতাই উচিত’
ভেবে সে রওনাও দিচ্ছে জোরে।
যদিও ফুরিয়ে আসছে দম,
ছুড়ে দিচ্ছে পাথরে-পাথরে
ভেঙে যাওয়া পিঠের কসম!

আসিনি ছিনিয়ে নিতে কিছু।
সকলেরই ভবিষ্যৎ ছাই…
গ্রহ-তারা-অস্কার তোমার
আমি স্রেফ জল খেতে চাই।

পুরনো বাংলোয় ফিরে গেছি
গরম বিকেলবেলা, অটো ভেঙে-ভেঙে
উঁচুমাথা গাছে-গাছে পশলা-পশলা হাওয়া দিচ্ছে…
দাঁড়াই গেটের সামনে। একা।
ওই সেই বারান্দা আর ওই সেই বাগান
ওই সেই শোবার ঘর পার ক’রে ডাইনিং, কিচেন
ওই সেই বসন্ত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত-লেখা-বেঁচে থাকা
ওই সেই অনেক আমি পুরো বাড়িটায়
বাগানে চুপচাপ ব’সে বই পড়ছে কেউ একটা মেয়ে
সে আর কী ক’রে বুঝবে কার কাছে কীসের কত দাম,
হঠাৎ আমার দিকে তাকাল অবাক হয়ে—
যেভাবে বাইরের লোক দেখে
একদিন আমিও তাকাতাম…

ফুটোকৌটো বাজাবেন যে-কোনও গানের সঙ্গে
ফুটোকৌটো বাজিয়ে দেখবেন
বাবা বা গোপাল জর্দা, হলদিরাম রসগোল্লা
কমপ্ল্যান অথবা ল্যাকটোজেন
বাজিয়ে দেখবেন
রবীন্দ্রসংগীত, হিন্দি, অতুলরজনীশ্যামা
মাঝেমধ্যে মনে পড়লে একটা-দুটো বাউল দৈবাৎ
ভাববেন লোকাল ট্রেনে ভাববেন পাবলিক বাসে গানটা গাইছেন
দেখেও দেখছে না লোকে শুনেও শুনছে না শুধু
মাঝেমধ্যে ফুটোকৌটো তাক ক’রে পয়সার ঝনাৎ—
বুঝবেন সুরের মধ্যে কীভাবে যুগ-যুগ ধ’রে
ভেসে যাচ্ছে ভাত… রক্ত… ভাত…

একেকটা লোক ভেলকি দেখায়
ময়লা ছোট চাদর পেতে
গড়ের মাঠে সন্ধেবেলা একেকটা লোক
ব্লেড গেঁথে ব্লেড গেঁথে সুতোয়
গলার মধ্যে নামিয়ে দেয়।
ঢোকায়, আবার বার ক’রে নেয়।
আবার ঢোকায়, বার ক’রে নেয়।
এক ফোঁটা রক্তও পড়ে না।
হাততালি! হাততালি!
সন্ধে শেষে খুচরো গুনে
একেকটা লোক চাদর গোটায়…
একমাত্র সুতোই জানে,
কণ্ঠনালীর সঙ্গে ব্লেডের কী সম্পর্ক…
বাস ছুটছে ভিআইপি-ইএম বাইপাস ধ’রে
সন্ধেরাত… বসন্তের হাওয়া…
চৌকো চৌকো জানলা দিয়ে দূরে-দূরে দেখা যাচ্ছে
গাছপালা, জলাজমি, বিজ্ঞাপন, অন্ধকার, বাড়ি আর ফ্ল্যাট
তাদের জানলায়, ছাদে, বারান্দায় একলা-একলা মানুষের ঝাঁক
আরও দূরে হাত মেলা ট্রান্সফরমার, গ্রাম
তারও দূরে জঙ্গল, বিপদ…
এত কিছু পিঠে নিয়ে ঘুমোতে পারে না আর
অভিমানে, রাগ ক’রে, হেরে বা বিষণ্ণ হয়ে
কেউ ছেড়ে চ’লে যায় পাছে—
সেই ভয়ে, ছোট-ছোট মেয়েদের ঘুম দিয়ে তৈরি এই শহর
রাতের পর রাত জেগে আছে…

জেমস ক্লিপ জুড়ে-জুড়ে রঙিন শেকল বানিয়েছি
হলুদ-সবুজ-লাল, আবার হলুদ…
দুপুরের সাফল্য এটুকু।
মার্চ মাসে মেঘ করলে, দু’দিন অঝোরে বৃষ্টি হলে
ঠান্ডা ভেজা হাওয়া দিলে বিকেলে রাস্তায় নেমে
জুলাই-জুলাই মনে হয়
জুলাই মাসের দিকে কোনও বাস যাবে না এখন।
বরং বিচ্ছিরি কাজে, ভুলভাল অনিচ্ছেয়
নিজেকে তাড়িয়ে নিয়ে যাব
সন্ধেয় সাফল্য বলতে এ-ই…
রাতে বাড়ি ফিরে দেখব, জেমস ক্লিপে বানানো শেকল
স্যাঁতসেঁতে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছে একা…
আজ ওকে পরার কেউ নেই।

সমুদ্র দ্যাখেনি রিকশাঅলা
তার তেষ্টা গেলাসই মেটায়
কারণ, সমুদ্র অব্দি সে কোনও সওয়ারি পায় না
সকলেই আগে নেমে যায়।

তোমার অসুখ, তুমি কোথাও যাবে না।
শূন্যে ভেসে থাকা এই ঘর থেকে দেখবে নীচে
দিগন্ত ছাড়িয়ে যাওয়া ধূ-ধূ জাঙ্কইয়ার্ড…
গত সভ্যতার সব রকেট-জাহাজ-ট্রাক-বাস-লরি-ভ্যানের কঙ্কাল
কয়েক হাজার ক্রেন সারাদিন ধ’রে
সেসব কঙ্কাল নিয়ে ছোড়াছুড়ি খেলে যাচ্ছে
হার-জিত নেই, শুধু রোদে তেতে যাওয়া টিন, লোহার গোঙানি
তোমার অসুখ, তুমি কোত্থাও যাবে না।
শূন্যে ভেসে থাকা এই ঘর থেকে দেখতে পাবে
সূর্য নিভে এলে
রোবটপাখিরা বাঁকাডানা মুড়ে নেমে আসছে দূরের পাহাড়ে
ওপারে মানুষ থাকে।
যত সন্ধে হয়, তত জীবনানন্দের বিক্রি বাড়ে।

বাল্‌ব খেতে পারে একটা লোক
গিনেস-এ উঠেছে তার নাম।
হাজার লোকের সামনে একটা স্টুডিয়ো-য়
প্রমাণের জন্যে তাকে আনা হয়েছিল—
গোটা দশ-বারো বাল্‌ব থালায় সাজিয়ে তার খাওয়া শুরু হল।
প্রথমে বাল্‌বের কাচ, তারপর টাংস্টেন, এমনকী হোল্ডারও
দাঁত দিয়ে কুড়মুড় ভেঙে, খচরমচর কামড়ে চুষে
কোঁৎ ক’রে গিলে ফেলল। ওই বারোটাই।
তারপর হাঁ ক’রে দেখাল
এক ফোঁটা রক্ত নেই মুখের কোথাও।
জানাল সাক্ষাৎকারে, সকালে-দুপুরে-রাতে
বাল্‌ব খেতে খুবই ভালবাসে।
বাল্‌ব খেতে পারে একটা লোক।
কিন্তু আলো খেতে পারে না সে।
এ মালিক, সে পরিচারিকা
মাঝরাতে পার ক’রে স্ত্রী-সন্তান-সমাজ-পরিখা
ওদের মিলন হল বিছানার পাঁচফুট ওপরে
মিলিত শরীর দুটো শূন্যে ভেসে থাকে, শূন্যে ঘোরে…
নীচে মেঝে। পৃথিবী। বাস্তব।
এই প্রৌঢ় ফিরে গিয়ে আগুন লাগাবে ঘরে
পুড়ে ছাই হয়ে যাবে সব…
এখন, মিলন শেষে, সাইকেল চালাচ্ছে সে
মাঠ কামড়ে পড়ে আছে মরা জ্যোৎস্না। চাঁদের পদবি।
আহুতি। আহুতি চাই।
আহুতি! আহুতি!
মনে পড়ে স্যাক্রিফাইস, তারকভ্স্কির শেষ ছবি।

কুয়াশা নেই এমন কোনও দিন হয় না আর
ফর্সা, ভারী হাওয়ার ভেতর গা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
হাজার তলা ফ্ল্যাটের ঝাঁক
ক্যাকটাসের মতো তাদের শরীর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে
দু’ তিন লক্ষ খচাৎ এসি মেশিন
ভেতরে হিমযুগ।
ভেতরে সব টাইবাঁধা মুখ জন্মাচ্ছে, বড় হচ্ছে
কাজ করছে। কাজ।
মৃত্যু পেলে মাটির নীচে পাঁচশো তলা কবরখানা
সার বাঁধা সব ফার্নেস আর কফিন…
কিন্তু একটা বিশাল, কুঁজো, কালো, রোমশ ভয়ের ম্যামথ
সারাটাদিন হাজার তলায় থপথপিয়ে হেঁটে বেড়ায়
থুম্বা মেরে বসেও থাকে, ঝিমোয়…
সময়মতো না যদি খোলে ফ্লপি!

নাম কেউ জানে না পরির।
সন্ধের নেভানো পাড়া, ও আসে, এ যায়,
পাখি ভেবে নিজেকে, শরীর
ছাত থেকে ঝাঁপ দিয়ে শিকে বিঁধে যায়
রেডিয়ো ঘুমের নীচে বাজে…
খবর, কমেন্ট্রি, গান, আড্ডা, প্রতিবেশী…
কার যেন বেসুরো রেওয়াজে
সন্ধের পাড়ার মতো আমিও নিভেছি
ফিরে আসে সব অপমানই
এতদিনে তোমাদের জ্বালাব-নেভাব
আসলে তো আমারই গোঙানি
জেনারেটরের শব্দ ব’লে যাকে ভাবো…!
বিষয়কে থেঁতলে দিয়ে চলে গেল জিপ
তুমি কাছে গিয়ে দেখলে, বেঁচে নেই
বিষয়কে ঠুকরে খেয়ে পালাল ঈগল
তুমি কাছে গিয়ে দেখলে, মরে গেছে
বিষয়কে পাহাড় থেকে ছুড়ে ফেলল কেউ
তুমি কাছে গিয়ে দেখলে, প্রাণহীন
গরম, আঠালো রক্ত, কখনও মাংসের কুচি
লেগে থাকল তোমার জামায়…

গুটিসুটি শুয়ে আছি
এক হয়ে গেছে হাঁটু-মুখ
ঠান্ডায় কী করে বাঁচি…
মাঝেমধ্যে কফিতে চুমুক
পুরনো ওভারকোট
ছাতা ধরে সাধের চুরুটে
এখন বিরুদ্ধ জোট,
পাশে ছিল, শীতের শুরুতে।
ওরা তো উন্নততর।
ওরা ঠিক আমার মতো না।
আমাকে গোয়েন্দা করো,
তুমি হও খুনের ঘটনা।
যেখানে সকালবেলা কাগজ আসে না, কোনও বাজার বসে না
যেখানে বরফ প’ড়ে সাদা হয়ে আছে গাছ, খাদের রেলিং
যেখানে খেতের পর খেত শুয়ে আছে শুধু, ঝগড়াঝাঁটি নেই
যেখানে বিকেল হলে সূর্য ছোট, নরম, গোলাপি
যেখানে সন্ধের পর পাহাড়ের গায়ে গায়ে ফুটে ওঠে টিমটিম বসতি
আর এই সবকিছুকে দু’পাশে বিছিয়ে রেখে
যেখানে একটাই রাস্তা চলে গেছে দূর থেকে দূর থেকে দূরে…
সেখানে আমাকে তুমি, হে কম্পিউটার গেম, রোজ নিয়ে যেও

এখনও সফর বাকি। অতিথিশালায়
এসেছে নরম পথ পেরোতে-পেরোতে
একটা সময়ের পর, কড়া রোদ লেগে
যে-কোনও লোকের ঘড়ি উলটোদিকে ছোটে
জলে ফেলেছিলে ঢিল, এখন সেসব
লাফিয়ে মাছের মতো উঠে আসবে হাতে
সারাদিন মার খাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে
সারারাত কেটে যাবে কাহিনি বানাতে
তারপর আবার ছুট। রাস্তা গেছে দূর…
সে-রাস্তার শেষে তুমি রাজা না ফকির?
পাশাপাশি থাকে, কিন্তু কোনও মিল নেই
চড়াই পাখির সঙ্গে উতরাই পাখির
‘আর জাস্ট দশ মিনিট।’ ‘মিনিট দশেকে পৌঁছে যাব।’
‘এসে গেছি, দশ মিনিট।’ ‘দশ মিনিট ওয়েট করো প্লিজ়!’
বাস-ট্রেন-রাস্তাঘাট-অফিস-সিনেমাহল-পাড়া
যে যেখানে কথা বলে ফোনে
দশ মিনিটে পৌঁছবে, জানায়।
ফোনের অপর প্রান্তে যে অপেক্ষা করছে, হয়তো সে-ও
অন্য কাউকে জানিয়েছে দশ মিনিটে পৌঁছনোর কথা
শুনে মনে হয়
এখন যে-কোনও জায়গা যে-কোনও জায়গার চেয়ে দশ মিনিট দূরে

বয়েস বোঝা যাচ্ছে না তোমারও
সবাই জোরে ছুটছে। যদি পারো
আস্তে চলো, কাছিম
সামনে পাহাড়, টিটকিরি, বিসিএস
তোমার পিঠে পৃথিবী তুলে দিয়ে
নিশ্চিন্তে আছি।

মানুষ আজও ফারাক খোঁজে ডাইনি আর অপ্সরায়
ফকির একটু দূরে ব’সে আলতো বিড়ি ধরায়
ছিলে আমার শব্দভাণ্ডার।
ভরাট তোমার শরীর থেকে
একটা ক’রে শব্দ তুলে
লেখায় লাগালাম।
এখন আমার রচনাসংগ্রহ,
তোমার কঙ্কাল।

দূরত্বমেশিন এনে বসিয়েছি সমুদ্রের তীরে।
পাম্প ক’রে একে-একে সমস্ত সম্পর্ক তুলে জলের ওপারে ফেলে দিয়ে
একা বসে আছি।
সন্ধে হয়ে আসে।
আস্তে-আস্তে ফুটে উঠছে তারা, ট্রলারের আলো, কাঁচা ফসফরাস…
এখানে সমস্ত শেষ। এখানে সবকিছুর শুরু।
কেবল হোটেলই পারে ভাঁজ করে গুটিয়ে আনতে
আমাকে আমার পৃথিবীতে
তা জেনেও ব’সে আছি
নিজের সবকটা দাঁত আলুথালু সৈকতে বিছিয়ে…
হাঙরের ভাষা শিখে নিতে।

খেতের পর খেত পেরিয়ে বিছিয়ে আছে সন্দেহের বীজ
গলির পর তস্য গলি শেষ না হওয়া ফ্ল্যাটবাড়ির ভ্রূণ…
পিস্তলের গরম গুহা… আলতো চাপে ঢুকেছে কার্টিজ…
ধাক্কা… টান… ধাক্কা… টান… অর্গ্যাজ়ম… শান্তি… আহ্… খুন…
ঠোঁটের কষ গড়িয়ে নামে, রক্ত নয়, বীর্য নয়, দোষ
আর যা কিছু প্রমাণ, সব আলতো করে কাঁচিয়ে নেয় ক্ষুর
যে দ্যাখে এই দৃশ্য, তার পা চেপে ধরে জ্যান্ত খোরপোষ
সাক্ষী যাও, ধরো গে হাত, নতুন কোনও মাফিয়া বন্ধু’র।

তোকে কী দেবার নয়, আর কী দেবার—
খোলা কবিতার খাতা, বাঁধা জানোয়ার।

সভ্যতার শেষ সুযোগ। শান্ত সব হাওয়া
পকেট থেকে কয়েন ঘাসে খ’সে পড়ার আওয়াজ
শুনতে পাবে যেদিন, উঠে ঘুরতে যেও কাছেই
এতদিনের নিয়ম, ভেঙে নষ্ট হয় পাছে,
কেউ চড়েনি, আপনমনে দুলছে একা সি-সঅ
পার্ক থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ঈষৎ
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে হালকা হতে পারো
সভ্যতার শেষ সুযোগ। সময় নেই। কারণ,
এক বিকেলে গড়িয়ে দিয়ে ছোট্ট পৃথিবীকে
চলেও যাবে মানুষ, আরও কম কথার দিকে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *