দু’-চার কথা

দু’-চার কথা

দ্বিতীয় সংস্করণ: আগস্ট ২০১৩
সপ্তর্ষি প্রকাশন। ৫১ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা ৯। পৃ. ২২, মূল্য: ৬০ টাকা।
প্রথম প্রকাশ: রোদ্দুর প্রকাশন, ২০০১
প্রথম সপ্তর্ষি প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
প্রচ্ছদ: বিপ্লব মণ্ডল
উৎসর্গ: লেখার টেবিল,/‘তুই’ বলছি/তোকেই দিলাম/ তুই তো জানিস/ কেমন ছিল/সন্ধেগুলো

গ্রন্থটির শুরুতে কবির কথায়—
এক দুপুরে আমার বাড়িতে হাজির শুভ্র। পদ্যচর্চা নামক কবিতার কাগজের সম্পাদক। রোদ্দুর প্রকাশনের পক্ষ থেকে বইমেলা উপলক্ষে কয়েকজন কমবয়েসি কবির ছোট বই বা মিনি বুক ছাপতে চান, আমার কাছেও দাবি একখানা পাণ্ডুলিপির। তার আগের বছরেই বেরিয়েছে ‘শেষ চিঠি’। তার পরেও যে কেউ আমার কাছে পাণ্ডুলিপি চাওয়ার স্পৃহা বা উৎসাহ দেখাতে পারেন, কল্পনায় ছিল না। বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার বেশ কিছুটা ফারাক, তাই সে-বছর বইমেলায় ‘দু-চার কথা’ নাম দিয়ে বেরিয়েছিল এক ফর্মার সেই পুস্তিকা।

পরবর্তী ইতিহাস অনেকটাই একরকম। পুস্তিকাটির বিলুপ্তি, স্বাতী ও সৌরভের ঝুঁকিপূর্ণ উৎসাহ, প্রথম-প্রথম আমার আশান্বিত হওয়া এবং আবারও, তাতে জল ঢেলে দেওয়া। সায়নকুমার দে নামক এক অত্যাশ্চর্য পাঠক ‘দু-চার কথা’র একখানা নমুনা হাজির করলেন। তাঁর কাছে ঠিক কোন দিক থেকে ঋণী থাকা উচিত, বুঝতে পারছি না। প্রথম আলো আর রোদ্দুর প্রকাশন আলাদা সময়ে আলাদা ভাবে ছেপেছিলেন এই দু’খানা পুস্তিকা। সপ্তর্ষি প্রকাশন একই সময়ে একসঙ্গে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করছেন ‘শেষ চিঠি’ আর ‘দু’-চার কথা’। পাঠকদের চাইতে, দ্বিতীয় এই প্রকাশে, তাঁদের ক্ষতির সম্ভাবনা বেশি।

শ্রীজাত

.

অন্ধকার প্যারাগ্রাফ ভ্রমরের ডানা পেতে চায়

দোয়াত ঘুমোয়, দূরে শান্তি বাজে বরফের মতো

আকাশ খিদের মুখে চিলেকোঠা ধরে ধরে খায়

পুরনো পাড়ায় সন্ধে…যাতায়াত…লোডশেডিং…ক্ষত…

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসছে, বুকে হেঁটে, গড়িয়ে, দৌড়িয়ে

ঝাঁকে ঝাঁকে বয়ে আসছে মধুর অথচ সর্বনাশা

কাকে কী বারণ করব, মানা করব কোন যুক্তি দিয়ে

মানুষের কাজে লাগে সবরকমের ভালবাসা।

এক চার ছয় আট দশ তেরো পনেরো সতেরো

একুশ তেইশ চব্বিশ আঠাশ তিরিশ ছত্তিরিশ

আরও…আরও বহুদূর…খাতা তো খুলেই আছে খেরো…

বাদবাকি নম্বরগুলো, নিজগুণে, ভাইটি, গুনে নিস…

চোখমুখ শক্ত করে সারাদিন ঘোরে আঁকেবাঁকে

দশরকম ব্যস্ততায় পার করে বরাদ্দ সময়

জানাতে পারে না কাউকে, বুকের ভেতরে চেপে রাখে—

রাত্রে কেঁপে কেঁপে ওঠে… ছেলেদের এইরকম হয়…

কাকার হোটেল খালি, উপরন্তু ভাল ঝাউবন…

এইসমস্ত কথা শুনে কী কুক্ষণে বেড়াতে গেলাম

বেশি চান করতে গিয়ে টুক করে ডুবে গেল মন

হেভি খেল দেখিয়েছ, হে সমুদ্র, তোমাকে সেলাম।

আটানা-চারানা করে কমতে কমতে শূন্যে যে দাঁড়ায়

যে বলে কাব্যের মধ্যে সব শালা শুদ্ধ পিউরিটান—

বাড়ি ফিরে এসে সে-ও দশমুখে পায়েসান্ন খায়

সকালে সকালে সে-ও হেঁটমুখো সূর্যের সন্তান।

রেডিয়ো নিজেই যেন বেছে বেছে এনেছিল গান

শ্রোতাদের অনুরোধে ভারী হয়ে ডুবে গেল ভেলা

খড়কুটো ভেসে রইল, ভেসে রইল ধাক্কা খাওয়া প্রাণ

কোথাও খদ্দের নেই, চাঁদ ওঠে, ভর সন্ধেবেলা…

কী উড়ুক্কু বেবিট্যাক্সি মনে পড়ে বেগুনিসবুজ!

একচক্ষু পরি আর খেলোয়াড় মনে পড়ে কত

মনে পড়ে ম্যানহোলের কান্না আর দৈত্য তরমুজ

আমার কিশোরবেলা আজ অব্দি দুঃস্বপ্নরত।

শব্দ ভেসে আসতে আসতে মাঝেমধ্যে দেরি হয়ে যায়

আমরাও নিরুপায়, রিসিভার হাতে ধরে থাকি

হঠাৎ অর্ধেক কথা শুনতে পাই, অর্ধেক হারায়

শব্দ খুঁটে খুঁটে খায় টেলিগ্রাফ তারে বসা পাখি…

সে যদি না মোমবাতি, কেন নিভে গেল এক ফুঁয়ে?

কেন ঠোঁট তুলে নিল, যদি সে-ও শ্যামজলে স্নাত?

আলো-অন্ধকার ঘরে, এই ছোটগল্প ছুঁয়ে ছুঁয়ে

সাহসের প্রজাপতি ওড়ে না…ওড়ে না…ওড়ে না তো!

বুক ভরা যাত্রী নিয়ে যেতে যেতে, অজানা কারণে

বিশাল জাহাজ কোনও যখন সমুদ্রে ডুবে যায়

মাইল মাইল জোড়া অগাধ মৃত্যুর এক কোণে

জল ডাকে মাস্তুলকে, চুপিচুপি আকাশ চেনায়…

পার্ট ভুলে গেছ আর মনে মনে ভাবছ সবই মায়া

হতভম্ব আত্মারাম, যদিও ঠোঁটের কোণে হাসি

ঢঙাঢঙ যুদ্ধ চলছে, বিবেক চেঁচাচ্ছে— ‘কাঁহা লায়া—’

কোথায় খুলেছ খাপ, হে শিবাজি, এটা তো পলাশি!

নিচু হয়ে যশ তুলছি, বেছে বেছে তুলছি হাততালি

ভিড়ে আর কোলাহলে ফেটে পড়ছে ছোট সভাগৃহ

তারপর যখন রাত, কিছু পাখি জেগে আছে খালি

তালাবন্ধ সভাঘর অন্ধকার, চুপচাপ, নিস্পৃহ…

তুমি যদি শঙ্খ ঘোষ হতে তবে জ্বালাতে যেতাম।

‘বোঝান, বুঝিয়ে দিন—’ এইরকম করতাম সমানে

কিন্তু তা হল না, দ্যাখো, এত পথ পেরিয়ে এলাম

তোমাকে জানে না খুব, যারা-যারা শঙ্খ ঘোষ জানে

‘হা ঈশ্বর, এ তোমার কেমন বিচার হল…’ —কাট্!

আরেকটু দরদ লাগবে…ঠিক হল না…আবার বলুন—

‘হা ঈশ্বর, এ তোমার কেমন বিচার হল…’ কাট্!

আরেকটু দরদ লাগবে…ঠিক হল না…আবার বলুন—

প্রাণের ওপর দিয়ে ট্রেন যায়, কেউ ছেড়ে গেলে।

সেকেন্ড ক্লাসের জানলা ঘেঁষে বসে শান্ত ভালবাসা

খুব অসুবিধে হয় ঠিকমতো টিকিট না পেলে

তাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে, তবে তো নিশ্চিন্তে ফিরে আসা…

রিভলভার হাতে নিয়ে যারা ঢুকছে পাড়ায়-পাড়ায়

তুমুল গণধোলাই খেয়ে যারা মরে যাচ্ছে রোজ—

তাদের কোথায় বাড়ি, কেনই বা এসব করতে যায়

সে কথা তো কোনওদিন জানায় না খবরের কাগজ…!

কামু কাফকা পড়া নেই? সমুদ্র দেখনি একবারও?

ফিল্ম-ফেস্টিভালে যাও না? বইমেলায়? কবিতা-উৎসবে?

বি-এস-সি পাশ করোনি? শর্টহ্যান্ড, কম্পিউটার পারো?

মাল খাওনি কোনওদিন? মেয়েছেলে? তোমার কী হবে?

সাইকেল রিকশার ভেঁপু…দূরে বড়রাস্তার আওয়াজ

রংবেরং ফেরিঅলা…বাড়ি-বাড়ি পড়া…গলা সাধা…

আরও দূরে নেভাসূর্য…ফেরাপাখি…রোজকার নমাজ…

সারাদিন জোড়া লেগে, মানুষেরা সন্ধেয় আলাদা

আমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চায় ওরা। বোঝো!

কিশোর হাঁসের দল, যত্ত পাগলের কারবার

পাহাড় তো দূরের কথা, লম্বা লাগে পানের বরজ-ও

পঁচিশ বছর গেল। আমার কি ডানা আছে আর?

কেমন এগিয়ে যাচ্ছি, টকাটক চিঠি লেখা যায়

ঘণ্টায় তিরিশ টাকা। গুমরে আছে কলম আর প্যাড

ছাতার তলায় দুটি নর-নারী, বৃষ্টিতে, হাওয়ায়…

আমি ভাবছি বরসাত, আসলে তো কন্ডোমের অ্যাড!

দু’চার কথার পর সব কথা এক মনে হয়

ধোঁয়া ওঠা কফিকাপে মিলেমিশে যায় সব মুখ

আস্তে-আস্তে হাঁটি, তবু কিছুতেই কাটে না সময়

শীতের গোধূলি আমরা, আমাদের কুয়াশাঅসুখ…

স্বপ্নে, নাকি কলঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই গান…

মেয়েলি জলের তোড়ে ধুয়ে-ধুয়ে যাচ্ছিল কেবল

গুনগুন রঙের গন্ধ, আধো-সুরে উপচে পড়া স্নান—

কে ছিল জানি না, কিন্তু গানটাই, গানটাই আসল

আজ লেখা এল কিছু? ক’বার চা হল, এই নিয়ে?

সকাল ফুরিয়ে আসছে, আর দেরি করাও যাবে না

অগত্যা কলম রেখে, চটজলদি স্নান সেরে বেরিয়ে

সরল ছেলের মতো খেতে বসছ। কোলোস্পা খাবে না?

তোমার বিষয়ে কিছু সত্যি যদি লিখতে পারতাম

ওড়াতে পারতাম যদি ভঙ্গুর পায়রা ঝাঁকে ঝাঁকে

হাত থেকে হুট করে ছেড়ে দিয়ে সন্ধের লাগাম

অন্তত একবার যদি চুমু খেতে পারতাম তোমাকে…

আষাঢ় টিনের চাল, শ্রাবণ একাকী ট্যাপকল

বাড়ন্ত বিদ্যুতে ঘেরা এই বর্ষাকাল আমাদের

পাড়া-পাড়া যায় বৃষ্টি, কারা কারা পায় বৃষ্টিজল

সেলাইমেশিনে মেঘ বোনা হয় তৃতীয় বিশ্বের

অধিকাংশ বাজে কথা, বেশিরভাগ ফালতু বকবকানি

ফাঁকিবাজ শব্দ দিয়ে ঘিরে রাখা এই রাজ্যপাট…

পাঠক, তুমি যা জানো, আমরা তার চেয়ে কম জানি

কবিতা লেখার নামে ভাট্ বকছি। বুঝলে? স্রেফ ভাট্!

পড়াশুনো অষ্টরম্ভা, চাকরি নেই, কাব্য জবুথবু

বাধ্য হয়ে চেপে রাখছি যাবতীয় কামনা-বাসনা

কাল যদি চাকরি পাই, যদি ভাল লিখতে পারি, তবু

আজকে দেখা মেয়েটিকে, জানি, আর দেখতেও পাব না

হরণ, অপহরণ, হিরে-জহরত, সোনা-চাঁদি

এই সমস্ত করো যদি, আরও বাড়াবাড়ি করো পাছে

অ্যালার্ট হয়েছি মোরা। কোথায় পালাবে, অপরাধী?

পৃথিবীর সব রাস্তা আগে থাকতে ফলো করা আছে!

আকাশে উড়ন্ত লাভা, আগুন লেগেছে বনে-বনে

পথে-পথে মরা সাপ, গাছে-গাছে ঘুড়ির কঙ্কাল

ঠোঁটে চুমু খেতে গিয়ে রক্ত চুষে ফেলছি আনমনে

এ কী দিন এল-আমরা পরস্পর ক্ষুধার্ত, ভয়াল!

প্রোপোজ করিনি তোকে। শুধু জাস্ট জানিয়ে রেখেছি।

স্বীকার করেছি শুধু হৃদয়ে ভানুমতী’র খেল

যদিও ইয়ার্কি মারছি, আসলে তো পাগলা হয়ে গেছি—

আমাকে কি কোনওদিনই সিরিয়াসলি নিবি না, কোয়েল?

সকালে ঘুম থেকে উঠে দুশো গ্রাম হেয়ার রিমুভার

দুপুরে ভাতের সঙ্গে প্রাক-রবীন্দ্র ক্লিনসিং লোশন

সন্ধেবেলা ছোট্ট করে ফোটানো ম্যাক্ডয়েল্‌স্‌ আর

রাতে ঘুমোবার আগে এক চামচ ঋত্বিক রোশন…

বিয়ে করতে পারলে আমি সারাদিন কবিতা লিখতাম।

কাজ থেকে ফিরে বউ পাশে বসত-‘কী, লেখা কেমন?’

আমিও তক্ষুনি তাকে সমস্ত কবিতা শোনাতাম—

এইরকম ইচ্ছে হয়…সাধ হয়…ভীষণ…ভীষণ…

ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে দেখা হবে চন্দনের বনে।

সুনীল’দা লিখেছিলেন, সে আর অজানা কার কাছে

কিন্তু আমাদের কালে প্রেম পুষে রাখতে হয় মনে

ভুরু-টুরু প্লাক হয়…তার ওপরে বীরাপ্পন আছে…

মনে করো কোনওদিন দেখা হয়ে গেল যেতে-যেতে

ভেতরে-ভেতরে বাড়ছে, চোখে নেই, সেও এক জল।

কে কথা আরম্ভ করব? সন্ধে হয়ে আসছে ধানখেতে…

সারল্য তোমার অস্ত্র, চতুরতা আমার সম্বল

মাথার প্রত্যেক কোষে ইদানীং গুপ্তচর ঘোরে।

জ্বর বাড়তে থাকে আর জ্বরের ভেতরে বৃষ্টিব্যয়—

ফোঁটায়-ফোঁটায় বিষ…আজকাল আমার শহরে

ঘুমের বড়ির সঙ্গে বিনামূল্যে শুঁয়োপোকা দেয়

সারারাত জেগে থাকলে কোথাও পিয়ানো শোনা যায়।

চাদরের কোণে-কোণে, ঘুমন্ত পর্দার ভাঁজে-ভাঁজে

স্বরলিপি আটকে থাকে। তাদের নিয়ে যেও বারান্দায়—

পিয়ানো শুনতে পাবে, তোমার ভেতরে যদি বাজে

ঈশ্বর দিলেন প্রাণ, তাই এত রঙ্গ দেখতে এলে

ঈশ্বর পাঠান তাই দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাও

ঈশ্বর চাইলেন তাই এতদিনে ডান্ডা হাতে পেলে—

সেই ডান্ডা দিয়ে তুমি ঈশ্বরকে ক্যালাবে? ক্যালাও…

দেখেছি চড়ুইপাখি, বন্যা আর বান্ধবীর বিয়ে

দেখেছি অসৎলোক, বহুবার, দেবতার বেশে

দেখেছি ঘরের ট্রাম ঘরে ফিরছে ইনিয়ে-বিনিয়ে

দেখেছি গমের খেতে একা মেয়ে, উত্তরপ্রদেশে…

গিটার বাদনরত মানুষের দুঃখ হল গান

আগুনের চারপাশে ক্লান্ত নাচ, হই হই পেরিয়ে

সে যায় নিজের কাছে, বাজায় নিজের অভিমান

ভোর হলে হাঁটা দেয় আবার গিটার কাঁধে নিয়ে…

কত অর্থহীন দরজা খুলে যায় বেকার বিস্ময়ে

পাঁউরুটির গন্ধে ভরা বিশাল সমুদ্র মারে ঢেউ

অগুনতি উলঙ্গ বেশ্যা তীরে শুয়ে আছে ভয়ে ভয়ে

তাদের যোনির মধ্যে চিঠি গুঁজে দিয়ে গেছে কেউ…

বন্ধু ভাঙে, বন্ধু যায়, বন্ধু ছাড়ে হঠাৎ আস্তিন

এসবই নিশ্চিন্ত করে। এসবই বলায়-‘ভালবাসি’

যেসব সম্পর্ক আর জোড়া লাগবে না কোনওদিন

তাদের নিথর কোলে আমি রোজ ফুল রেখে আসি

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *