শেষ চিঠি

শেষ চিঠি

দ্বিতীয় সংস্করণ: আগস্ট ২০১৩
সপ্তর্ষি প্রকাশন। ৫১ সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা ৯। পৃ. ২২, মূল্য: ৬০ টাকা।
প্রথম প্রকাশ: প্রথম আলো প্রকাশন, ২০০০
প্রথম সপ্তর্ষি প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
প্রচ্ছদ: বিপ্লব মণ্ডল
উৎসর্গ: যে-ঘর আমার এসব লেখার সাক্ষী ছিল, তাকে

কাব্যগ্রন্থের প্রারম্ভে কবি বলেছেন—
সেটা ছিল ১৯৯৯। ‘প্রথম আলো’ নামে একখানা কবিতার কাগজ সম্পাদনা করতেন বীথি চট্টোপাধ্যায় ও তরুণ চট্টোপাধ্যায়। সে-বছর তাঁরা মনস্থ করলেন, যে-সমস্ত কমবয়েসি কবির কোনও বই নেই, তাঁদের মধ্যে থেকে বেশ কিছু কবির বই প্রকাশ করবেন ‘প্রথম আলো’-র পক্ষ থেকে। আমার কাছেও, কেন কে জানে, পাণ্ডুলিপি চাইলেন তাঁরা। আমার ধারণা ছিল না, এমনকী আমার লেখাও বই আকারে ছাপা হতে পারে। বীথিদি তরুণদার প্রস্তাবে, সেই কারণেই, বেশ সংকুচিত বোধ করেছিলাম। অনেকখানি দ্বিধা আর ১৬ পাতার একখানা পাণ্ডুলিপি জমাও দিয়েছিলাম।

আরও অনেকের পাশাপাশি ২০০০ সালের বইমেলায় তাঁরা প্রকাশ করেছিলেন আমারও পুস্তিকা, নাম ছিল ‘শেষ চিঠি’। কয়েক বছর যাবৎ এই পুস্তিকার কোনও অস্তিত্ব ছিল না, আমিও নিশ্চিন্ত ছিলাম। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সপ্তর্ষি প্রকাশন তার পুনর্মুদ্রণের ঝুঁকি নিতে চায়। আমার সংকোচ, এবারও, ধোপে টেকেনি। তবু, আশায় ছিলাম, কারণ আমার কাছে এ-পুস্তিকার একটিও নমুনা ছিল না। দুঃখের বিষয় সপ্তর্ষির কর্ণধার স্বাতী রায়চৌধুরী আর সৌরভের কাছে ছিল। সুতরাং আবার প্রকাশ। প্রথমবারের তুলনায় আমার সংকোচ কিছুটা কম, এ কথা বলতে পারছি না।

শ্রীজাত

.

সূচি

এ বছর বর্ষা এল, নিষ্ঠা, তোমার জ্বরের ঘোর, হাওয়ামোরগের মন, স্মৃতির অভাবে, স্বপ্নের সময়, কেয়া, মার্জনাসোপান, প্রার্থনা, আজ তোর গ্রাম থেকে, দুপুরে ঘুমের বদলে, অন্ধের ফানুস, পবনের পার, শেষ চিঠি, প্রথম কবিতা, হাভানা, কসরত, শিবির থেকে উদ্ধার করা কবিতা, আজও…, প্রহরী, যদি, তীর্থ তপোবন, পুকুরের ধারে, কাহিনি, ও শ্যাম, বন্ধুদের কথা, শয়তানের চোখ, দেবতার হাত

.

এ বছর বর্ষা এল

জুলাই মাসের নীচে মৈথিলি ভাষার মতো মিটিমিটি আলো

জ্বেলে গিয়েছিলে তুমি। সে বছর কী কারণে বর্ষা হল খুব

বাজের আওয়াজে যত ভয় থাকে, সব ওই চুলে শুষে নিয়ে

নতুন মায়ের মতো বুকের ভারের নীচে টেনে নিতে মুখ…

এ বছর বর্ষা এল সেইসব কথা নিয়ে। তুমি কি এখনও

ঢিলেঢালা জামা পরে দরজায় হেলান দিয়ে সন্ধে হওয়া দ্যাখো?

কী জানি কী হয় রোজ সন্ধেবেলা, একসময়ে সবকিছু ভুলে

নতুন মায়ের ঠোঁটে আগেকার মতো চুমু খেতে ইচ্ছে করে…

নিষ্ঠা

আমার ভিতরে নিষ্ঠা ঘুরে গেলে আমি তাকে শোনাতে পারিনি

আভোগী রাগের কষ্ট। পাখা থেকে শুধু নীচে টান ফেলে দিয়ে

অসহায় বুঝিয়েছি আমিও ছিলাম, কিন্তু কিছুতে তেমন

দ্রবীভূত নই বলে দেব কী যে, ইচ্ছে হয় পুষ্প করে দিই

সবার কণ্ঠের আলো আর তা পারি না দ্যাখো দরজার ওপারে

ঘুমের পাথর ঠেলে চলাচল করে দিনে রাত্রে করাঘাত—

এসব কিছু না তার কখনও কিছু না শুধু কীভাবে বোঝাবে,

তারও ঠান্ডা হয়ে আসে বোধশক্তি আধখাওয়া কোষের ভিতর…

তোমার জ্বরের ঘোর

‘দারুণ সুন্দর’ বলে তারিফ করেছি তাই বেড়েই চলেছে

তোমার জ্বরের ঘোর। আজ তুমি ভাল করে কথাও বলোনি।

কেবল বিছানা জুড়ে নীরবতা শুয়ে রইলে সারাটা দুপুর

কথার বদলে উড়ল দু’খানি বইয়ের পাতা ওলট-পালট

আমিও বলিনি। এই ‘না-কথা’র পিছু-পিছু তাড়া করে আসে

গ্রামীণ ভাবনারাশি, গোরুর গাড়ির নীচে ঝোলানো লন্ঠন

দেখি সে উদাত্তগতি পলকে উধাও আর সারামাঠ জুড়ে

তোমার জ্বরের ঘোর, আমার তারিফ, আর সাক্ষী কাশফুল…

হাওয়ামোরগের মন

হাওয়ামোরগের মন দোল খায় নিচু-নিচু খেতের ভিতর

সূর্য সে পড়োশি চেনা আর যত রেখারশ্মি আপনজনের,

গম হয়ে ধান হয়ে ভেদ করে গেছে তারও অতীত বোধহয়

বেশ, তবু চঞ্চু দিয়ে অর্ধেক রসদ শেষ করে দিতে দিতে

অবাক পুবদিকটুকু মেনে নিতে হয় লাল ঝুঁটির জ্বালায়

না হলে সে কবে টানাপালকের শানে ভর দিয়ে উড়ে যেত—

যেখানে কখনও কোনও ‘হ্যাঁ বুঝি,’ ‘না বুঝি’ নেই, সূর্য ডুবে গেলে

হাজার হাওয়ামোরগ নিশ্চিন্তে মাটিতে নামে, গল্প করে, গায়…

স্মৃতির অভাবে

যতই চিঠির খামে হাত রেখে তুলে নাও, যতই এড়াও

আজও কিন্তু পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ গায় অতীতের গান।

শস্যের সকালধোওয়া ইচ্ছে থেকে সিঁড়িনামা পায়ের অতল

আশ্চর্য বাধিত হয় দিনরাত ভেসে আসা মূর্ছার সুবাসে

নিজেই সেতুর পাশে আলস্যে হেলান দিয়ে, নিজেই, জীবন

প্রতিটি কণার নামে হিসেব ফিরিয়ে দেয় যেভাবেই হোক;

আজ বহুদিন হল যাকে তুমি ভুলে গেছ স্মৃতির অভাবে,

একদিন সে-ও ফিরে এসেছিল দরজায় টোকা দেবে বলে

স্বপ্নের সময়

ঘোড়ার খুরের নীচে হিরের পালিশ তার চমক জানায়

যেভাবে জানলার পর্দা বিদেশি বাতাস এলে বেশি বেশি ওড়ে,

কৌটোর ভিতর সব কেটে রাখা সুপুরি ভ্রমর হয়ে গেলে

ঘুম পায়। পাহাড়ি বাঁকের মুখে বসে থাকা বৃদ্ধটির মুখ

মনে পড়ে বারবার। যেন সে সংকেত থেকে ভাষায় আসার

মাঝপথে আটকে গিয়ে বিড়ি ধরিয়েছে, আর সেইসব ধোঁয়া

স্লেটের কালোর মধ্যে মৃত-মৃত বাচ্চাদের আঁকিবুকি হয়ে

আমাকে জড়িয়ে ধরে আজ রাতে কীভাবে যে অস্থির করেছে!

কেয়া

রুমালের শেষপ্রান্তে তোমার সুবাসটুকু ধরে রাখি, কেয়া

তোমার কোলের কাছে আমার বন্ধুকে আমি প্রেমিক পেলাম।

দেহাতি গঠন আর চান্দি টিপ মনে থাকবে, মনে থাকবে দেখা,

যে-দেখা গাছের নীচে শান্তিমতো কবিতার কাঁকর কুড়নো,

ভরদুপুরের ট্রাম যে-দেখার পাশ দিয়ে ক্লান্তি ফিরি করে

আর যে-দেখার সঙ্গে বাড়ি ফিরে কান্না ছিল, সেইভাবে চেয়ে

দেখেছি নতুন করে রাতজাগা, বালিশের ভরাট আদরে

দেখেছি আকাশে কোনও তারা নেই ছোট্ট একটা নাকছাবি ছাড়া…

মার্জনাসোপান

কে করে মার্জনা বলো জিভের ভিতরে জল ঢোকার পরেও

ঢেকে দেয় ও সোপান চেনে বলে যত তিথি সকলে কেমন

চুপচাপ বুঝি সব আদরে সময় নেয় যতেক সম্ভব

কিন্তু শেষে অল্প আলো নেভায় ছোটবেলার উতল তড়িৎ

কী বেশে ধরায় শক্ত প্রীতির তুষার কোনও-না-কোনও কারণে

গাছ যে অনন্ত চিতা সে-ও চেনে নিশাচল ভীতির উদয়

এখন বারান্দা কালো বিছানা দুশ্চিন্তা করে মার্জনাসোপান

দেখা সে অনেক হবে ভবিষ্যতে অবনত ক্রীড়ায়-ক্রীড়ায়

প্রার্থনা

পুষ্পের দোহাই, তার কথা যেন মনে থাকে সারাটা জীবন

যেন তার ধৈর্য থেকে ছুটি নেয় ছায়াঘেরা দীর্ঘ শনিবার

কত কবিতার বই, ক্যাসেট, বারান্দা, কত মেঘের পিদিম

যেন না ফুরোয়, যেন সঙ্গে থাকে পাশাপাশি ঘুম থেকে ওঠা,

সে দিন, মুহূর্ত, ছবি পালটে-পালটে দেয়ালের ওপাশের মুখ

এপাশে টাঙায় যেন, রোজ রাতে ঘরে ফিরে বিছানায় শুয়ে

নতুন পায়ের পাতা তৈরি হওয়া অব্দি আমি যেন বেঁচে থাকি—

আর এই প্রার্থনায় লুকনো চিঠির কথা যেন সেন া বোঝে…

আজ তোর গ্রাম থেকে

আজ তোর গ্রাম থেকে হেরে এল ছোট ছোট পুষ্করের দল

জলে ডোবা কাদামাঠ বলে দিল ফিরে যেতে, বিদায় জানাল—

কিন্তু কী আশ্চর্য দ্যাখ, ওদের চোখের পাতা খুলতে পারল না!

ওরা তো অমন ক’রে শুয়ে থাকতে গেছে, সোনা, খেলে দিতে গেছে

যে-খেলা পায়রার ছায়া, মুক্তো-মুক্তো, দানা-দানা, বরফ-বরফ

বোঝেনি, কেবল তোর ভালমন্দ, ভেবেছিল প্রেমের কবিতা

দেখালেই খেলা হবে, জেতা হবে…দিনশেষে কাকভেজা ভিজে

আজ তোর গ্রাম থেকে হেরে এল কতকিছু, আমারই পাঠানো…

দুপুরে ঘুমের বদলে

আমাকে শেখার জন্যে ধার করে নিয়েছিল সে-বাড়ির মেয়ে।

টেবিলে রাখার পর উন্মন ধরে না তার, ভেজা চুল ঝেড়ে

সে বোঝাতে চেয়েছিল— প্রেম আছে, আছে…ফর্সা, নরম আঙুলে

চিঠি লিখতে যাবে যেই, হঠাৎ পিছন থেকে মিশে ওঠে ভাই—

দুপুর সে-ভাইয়ের মুখে তুলে ধরে সবজান্তা দিদির কুসুম,

এদিকে টেবিলে আমি, প্রেম আছে…আছে… ভেবে রইলাম টেবিলে,

আর সেই দাহক দৃশ্য দেখতে বেলা পড়ে এল, তখন বুঝলাম,

জন্ম-জন্ম ধরে এই মেয়েটির সমস্ত শিরা ব্লেড দিয়ে কাটা…

অন্ধের ফানুস

অন্ধের ফানুস তাই ভেসে চলে দিকে দিকে মিথ্যে ঘ্রাণ নিয়ে

যার সে-বাণিজ্যইচ্ছা উদ্ভিদের শুভেচ্ছায় সুরভিনন্দিত

নজরে দুর্গের পর দুর্গ কি খেতের পর আরও চৌকো খেত

অথবা তুলোর স্বাদ আলো হয়ে ডুবে থাকে দুধের বাটিতে

সে শুধু নম্রতাটুকু হাত নেড়ে ফেলে গেছে নিজেদের বাড়ি

বাকি যা চলেছে অন্য কিছুর আশায় দূরে সবুজে-সাদায়—

নেবে কি দয়ার পর্দা ঢাকা দেওয়া রোদ্দুরের মেয়েটির ছাতা,

যদি তার দৃষ্টি থেকে থোকা থোকা আগুনের ফুল ঝরে পড়ে…

পবনের পার

শেষ হাওয়াটুকু দেবে বলে আমি বসে আছি পবনের পার

জামার এপার থেকে ওপার চলেছে ঝিম্ যাত্রীদের দল,

যখন চাঁদের নীচে জল জমে ফোঁটা ফোঁটা জ্যোৎস্নার পানীয়

টুপ করে ঝরে যাবে বলেই অপেক্ষা করছে নদীর উপর—

তীরের কুয়াশা এসে শুষে নেয় সে-দৃশ্যের বাকি আবছায়া,

শুধু এক সীমান্তের দাগ চলে পায়ে পায়ে রহস্যের দিকে

জানি এ সমস্ত আর জানি এই মাঝরাত চিরস্থির, তবু,

শেষ হাওয়াটুকু দেবে বলে আমি বসে আছি পবনের পার…

শেষ চিঠি

সময় বোঝাতে কোন অজানা স্টেশনে প্রেম দু’বার দাঁড়ায়?

যেখানে অনেকে নেই, তোমার চশমার কাচ মুছে দিতে গিয়ে

চোখ দেখা হয়েছিল। আজ সেই রাতভ’র চোখ মনে এলে,

সব কষ্ট একসঙ্গে মনে পড়ে, মনে পড়ে তোমার বুকের

জলপদ্মদুটি কত দুঃখ লেগে তবে গন্ধ ফিরিয়ে নিয়েছে

যেন সে-গন্ধের নীচে ডুবে মরে গেছে চোখ, অন্ধ হয়ে গিয়ে

আমি আজ ফিরে যাচ্ছি। অজানা স্টেশন থেকে ফিরে যাচ্ছি। কাল

এই মুক্তি এনে দেবে নতুন বন্ধন, তুমি ভালবেসে নিও—

প্রথম কবিতা

বইয়ের প্রথম পাতা। প্রথম কবিতা। তুমি হাতে করে তুলে

কৌতূহলে পড়ে দেখছ এখন কেমন আমি, বদলে গেছি কিনা—

কতদিন দেখা হয়নি। ভাল আছ? আমি আছি, ওই একরকম…

তোমাদের বাড়ি যেতে ভুলে গেছি, মনে আছে, আমাকেও তুমি

ভালর সুড়ঙ্গগুলো গোপনে দেখিয়েছিলে, আজ সেই ভাল

মাথায় পালক হয়ে লেগে আছে, বাকিটুকু তোমার কথায়

সময় পেরিয়ে নেয় কোনওমতে, আর আমিও বালিশ জড়িয়ে

ভাবি যে তোমার কাছে শুয়ে আছি…জল আসে…খুব জল আসে…

হাভানা

ওদিকে আলোর ঢেউ, এদিকে এলিয়ে থাকা আমার শরীর

মাঝে যে-সমুদ্র, তার ঠিকানা পালটানো হবে কাল ভোরবেলা।

বালি চিনতে অসুবিধে ছিল যত আজ তা-ও মিথ্যে হয়ে গেল

আশঙ্কা, পায়ের ছাপ, এরা তো থেকেই থাকে। নতুন হিসেবে

দূরেই যে-বাংলো, তারও জানলা থেকে সব চুল উড়ে পড়ে মুখে

বালি চিনতে অসুবিধে ছিল বলে কেউ নেই কোথাও, কোত্থাও—

ওদিকে আলোর ঢেউ, এদিকে এলিয়ে থাকা আমার শরীর,

মাঝের পানীয়টুকু হাভানার সুরে-সুরে সুদূর কেনি-জি…

কসরত

শিকলের বাক্য একটা চুম্বন ছেড়েছে সবে, সেইমাত্র সিঁড়ি

ঘুরে গিয়ে আটকে দিল। ধ্বনিপদ্ম এইসব কসরত শেখায়

পুরনো কাগজপত্র, আলো, হাত, কোলবালিশ, রেকর্ডের পিন

ছিটকে গিয়ে সে নতুন দৃশ্য তৈরি হল আর দৃশ্য তো দৃশ্যই

একা কুণ্ঠা কতদূর সহ্য করা যায় তার লুকোচুরি মার

আর তো খাবে না, সোজা লাইন ভেঙে ঢুকে আসবে ট্রেনের আওয়াজ

কী বলে, তখন দৃশ্য অভিজ্ঞতা হতে গিয়ে ডানধার ঘেঁষে

ছড়াবে যে-কুৎসা, তার নীচে রাস্তা…ঘিরে আছে শিকলের সিঁড়ি…

শিবির থেকে উদ্ধার করা কবিতা

সমস্ত যুদ্ধের শীর্ষে বসে থাকে পাখি, তার সন্ধেবেলা হয়।

যত যত খাদ্য লাগে, সে দ্যাখে উপর থেকে-পাওয়া যাচ্ছে কি না

লতাপাতাওলা টুপি এখানে-ওখানে প’ড়ে। চিঠির কাগজও…

পাহাড়ের ব্রহ্মতালু অলীক আলোয় ভাসে, হলকা গলে পড়ে…

আজ আর এখান থেকে চাষবাস দেখা যায় না; তুমি কোনওমতে

এলে না বলেই। নয়তো এতদিন ঝমাঝম যুদ্ধ দেখে দেখে

আস্ত ভালবাসা আমি গিলেই ফেলেছি। তুমি ছাউনিতে এলে

রাত্রে হাত ধরে আমি তোমাকে আমার দেহ পার করাতাম…

আজও…

যন্ত্রণা আসার হলে আজও আসবে, কক্ষ তার ধূপের ভিতর

গলিত নীলের শিষ ধরে রাখে, অসুখের আগের প্রহর

সকল মাঠের দিকে মুখ ফিরিয়েছে, মুখ তিলের দু’পাশে

ছোট হয়ে মিশে যায়, যাবে, যাকে মুখ বলে চেনাই যাবে না

আর কালো, ছুঁচলো ঘুমের পারে ভেসে ওঠা করসুপ্ত চোখ

তুলোবুক, আস্থা, ব্যথাদূরের আদলে তিনরাত্রি বাস করে

ডাবের ভিতরে প্রাণ ভরে নিয়ে যাবে, ঠিক নিয়ে যাবে, তিল,—

যন্ত্রণা আসার হলে আজও আসবে, আজও কিছু আটকানো যাবে না…

প্রহরী

ঘুমোতে দিইনি কিছু। সাপের মাথার মণি হারাবার পর

জেগে বসে থাকতে হয় সারারাত, যদি কোনও অভিশাপ আসে!

কৃষকের পেশিময় ছদ্মনাম মাঠ থেকে, কাদা থেকে উঠে

ঢুকে আসে এই ঘরে। গাছের কোটর থেকে অন্ধকার এসে

মুড়ে দিয়ে যায় ঊরু, পেট, বুক; জেগে থাকা চিন্তাটুকু শুধু

বোঝে বিষ উড়ে আসছে অসম্ভব গতিবেগে, সেইকথা ভেবে,

ভয় আর গন্ধ আর অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয়। আধো-অন্ধকারে

জীবনে প্রথমবার নারীকে বিবস্ত্র দেখে যেরকম লাগে…

যদি

সময় বিশেষে যদি ভাল থাকে কেউ, যদি সেরে যায় রোগ,

আলোর গতির যদি ঝরে পড়া থাকে, যদি কথা থাকে কোনও,

মুখের মালিন্যটুকু বকুলফুলের মতো সাজিয়ে রাখায়

ভাল যে বেসেছে, তাকে ভোলার কৌশল যদি মনে এসে থাকে,

যদি কোনও কোল থেকে গড়িয়ে নামার বেলা মুঠো খুলে সব

চিঠিপত্র পড়ে যায়, যদি দুপুরের পর বিকেল না হয়,

তাকিয়ে থাকার পর তাকিয়ে থাকাই যদি কাজ হয়, আর

ঘুমের সময়টুকু যদি শুধু ঘুমই আসে, তবে তা-ই হোক…

তীর্থ তপোবন

কে জানে, তোমারই শাস্ত্র ফুটে আছে বসতির দু’ধারে আমার

যে ধরি পোশাকি ক্ষুদ্র তৎপর জোনাকিঋতু পাতায় পাতায়

বলি অক্ষরের তন্দ্রা মাটিতে লুটোতে থাক, কেন সে কারওর

গভীর ঘরের নীচে আলোখড় মুখে ক’রে কষ্ট পেতে যাবে

আর যে ক’জন তাপ সম্মুখে ঝরেছে শেষ দিনের ভিতর

তাদের কোথায় নেবে কত দ্বিধাভোর যাবে স্বজল পেরিয়ে

তবে মিথ্যা কী তোমার ওপারে রয়েছে পড়ে, এদিকে এখানে

আমাকে দু’ধারে রেখে সে-ইচ্ছায় ভিজে ওঠে তীর্থ তপোবন…

পুকুরের ধারে

আমাদের প্রেম ছিল স্বস্তিহীন পুকুরের শেষ দুটি মাছ।

জল ঠিক চুম্বনের গন্ধ পেত, আর পেত তরঙ্গ রঙিন,

তরঙ্গ ছড়িয়ে যেত রাত রাত, গ্রাম গ্রাম, চিঠি চিঠি, দূর…

আমাদের প্রেম, তার শ্যাওলা আর অস্থিভাঙা ধূপের প্যাকেট

মনমরা গাছেদের গায়ে গায়ে বিলি হত, এগাছ-ওগাছ

যেতে যেতে একদিন কখন, কোথায় শেষ ধূপকাঠিখানি

আড়াল হয়েছে মাত্র, আর সেই গন্ধে, ঝাঁঝে আজ সন্ধেবেলা

পুকুরের ধারে এসে জড়ো হয় কৌতূহলী গ্রামের মানুষ…

কাহিনি

সে যত পুলকভূমি অস্তে ফেলেছিল, তার দ্বিগুণ পরাগ

কীভাবে কুড়িয়ে পেল পথের ওপাশে,-আজ সে এক কাহিনি।

কীভাবে বিশ্বাস তিনটে সন্ধ্যার উপরে উঠে দাঁড়াল সরল—

দেখল নীচে চিরন্তন জল; বর্ষাফলকের গায়ে বিলম্বিত

ছন্দে সে প্রথম তির ভেঙে ভেঙে সম্প্রদান করেছে অবোধ,

এখন যেন কী মনে নিয়েছে উদাসছায়া ব্রতহীন হেঁটে

দাঁড়িয়েছে অল্প ঝুঁকে। যে প্রশান্ত, দাঁড়িয়েছে সে-ই, আজও সে-ই,

তুমি কাঁদবে জেনেও যে হাত ধরে ফেলেছিল, লুকোতে পারেনি…

ও শ্যাম

ও শ্যাম, আঙিনা জোড়া বরষা নেমেছে আজি সম্মুখে তোমার

বাঁশির ভেতরে রাস্তা, গলি, বাড়ি, উপচে পড়া বাচ্চাদের মুখ

ধীরে ধীরে ভিজে যাচ্ছে, গলে যাচ্ছে, আর তুমি মাঝরাস্তা দিয়ে

অপূর্ব আপনমনে সে-বাঁশি বাজাচ্ছ, শ্যাম, লীলা না ছলনা?

যে জানে তোমায়, জানে তুমি আসছ, বাঁশিওলা, টুপি, ওভারকোট

গত শতাব্দীর, চোখে ধুলোচশমা, তুমি আসছ বর্ষার ছুটিতে

রাস্তার ভেতরে গলি, বাড়িভর্তি বাচ্চাদের মুখে মুখে বাঁশি—

বাঁশির ভেতরে রাস্তা, গলি, বাড়ি, উপচে পড়া বাচ্চাদের মুখ…

বন্ধুদের কথা

বন্ধুদের নামে-নামে আলো থাকে। বন্ধুদের বাড়িদের নামে

ছোট-বড় রাস্তা হয়। বন্ধুদের খুঁজে-পাওয়া পরিরা প্রত্যেকে

আলাদা-আলাদা ভাল। তাদের চুলের গন্ধে রাত শুরু হয়।

সবই বন্ধুদের হাতে ছোঁয়া লেগে জানা যায়; বন্ধুদের হাতে

নানারকমের আলতো রহস্য লুকনো থাকে, বন্ধুরা সবাই

ছোট সমুদ্রের ধারে কখনও বেড়াতে যায়-তারপর তাদের

পরিদের সঙ্গে আমি কথা বলে জানতে পারি, কতটা, কেমন

ভাল হলে তবে ওরা আমাকেও সঙ্গে নিত, না নিয়ে যেত না…

শয়তানের চোখ

শয়তানের চোখ দেখলে বোঝা যায়, শেষ কবে কবিতা লিখেছে।

হাতে বহু বছরের আঙুল, নখের ডগা, রক্তের পচন…

লোমের ঝালর ঠেলে মাটিমাখা দুটো চোখ আলোদের দিকে

এগিয়ে দিয়ে সে থাকে কর্কশ পাথরে ঘেরা নিজের গুহায়;

আস্তে-আস্তে সন্ধে হয়, পৃথিবীর টিমটিমে অন্ধকার নামে

তারপর সে-ও তার মনখারাপের মোম জ্বেলে নিয়ে, একা

হাজার রাজ্যের পুথি, পুরনো কয়েকটা খাতা গুছিয়ে-টুছিয়ে

ঝোলা কাঁধে চুপচাপ কখন যে হাজির হয় পাঠের আসরে…

দেবতার হাত

সাবধানে হাতের লেখা নকল করেছি আমি। দেবতার হাত।

যেন সে-বৈষম্যটুকু মুছে যেতে পারে, যেন সে-ভাষার রোদে

স্নান সেরে এসে তুমি সামান্য চাদর গায়ে বসে থাকতে পারো—

কখন কী মনে আসবে, কোথায় লুটিয়ে পড়বে নতুন শব্দেরা

সেই ভেবে তৈরি থাকি, অবাক দু’চোখ দ্যাখে দেবতার হাত

টগরগাছের ডাল হয়ে গেছে, সাদা রং, ও সাদা, তোমার

কত কী রেখেছি মনে, গন্ধে-গন্ধে ভরে আছে দেবতার ঘর,

কারও সঙ্গে কোনওদিন দেখা হলে তুমি তার লেখা দেখে দিও—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *