২৮. হিংসা ও অহিংসা—যাজ্ঞিক-যতিসংবাদ

হিংসা ও অহিংসা—যাজ্ঞিক-যতিসংবাদ

“ব্রাহ্মণ বলিলেন, “হে ভদ্রে! আমি স্বয়ং গন্ধাঘ্রাণ, রসাস্বাদন, রূপদর্শন, স্পর্শানুভব, শব্দশ্রবণ ও বিষয়কামনা করি না। প্রাণ ও অপান বায়ু যেমন প্রাণীগণের সুষুপ্তিকালে কামোদ্বেষের প্রাদুর্ভাব না থাকিলেও স্বভাববশতঃ তাহাদের শরীরমধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক অন্নপাকাদি কার্য্য সম্পাদন করিয়া থাকে, তদ্রূপ আমার ইন্দ্রিয়গণও পূর্ব্বতন সংস্কারবশতঃ গন্ধঘ্রাণ প্রভৃতি কাৰ্য্য সম্পাদন করিতেছে। যোগানুষ্ঠাননিরত মহাত্মারা আপনাদিগের দেহমধ্যে যে বাহ্যবিষয়াতীত জীবাত্মাকে দর্শন করিয়া থাকেন, আমি সেই জীবাত্মার সহিত মিলিত হইয়া অবস্থান করিতেছি, এই নিমিত্ত কাম, ক্রোধ, জরা ও মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করিতেও সমর্থ হয় না। পদ্মপত্রে যেমন সলিলবিন্দু লিপ্ত হয় না, তদ্রূপ আমি কামদ্বেষশূন্য হওয়াতে বিষয়সমুদয় আমাতে লিপ্ত হইতে পারিতেছে না। জীবাত্মা জন্তুদিগের শরীরে নির্লিপ্তভাবে অবস্থানপূৰ্ব্বক স্বভাবসমুদয় দর্শন করিতেছেন, তিনি ভিন্ন আর সমুদয় পদার্থই অনিত্য। নভোমণ্ডল যেমন সূর্য্যের কিরণজালে লিপ্ত হয় না, তদ্রূপ তাঁহাকে কখনই কৰ্ম্মফলে লিপ্ত হইতে হয় না।

‘এক্ষণে আমি এই উপলক্ষ্যে অধ্বর্য্যু-যতিসংবাদ নামক এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

‘পূর্ব্বে এক সন্ন্যাসী কোন যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণকে যজ্ঞে পশুপ্রোক্ষণ করিতে দেখিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিয়াছিলেন, “ব্রহ্মন্‌! এরূপ হিংসাবৃত্তি আশ্রয় করা আপনার কখনই কৰ্ত্তব্য নহে।” সন্ন্যাসী এই কথা কহিলে, যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! আমি যজ্ঞে এই ছাগকে ছেদন করিলে ইহার, কিছুমাত্র অপকার হইবে না; প্রত্যুত যথেষ্ট উপকারই হইবে। এই পশু যজ্ঞে নিহত হইলে ইহার উৎকৃষ্ট গতিলাভ হইবে। শাস্ত্র যদি সত্যই হয়, তাহা হইলে শাস্ত্রানুসারে প্রোক্ষণকাৰ্য্য সম্পাদন করিলে ইহার পার্থিবংশ পৃথিবীতে, জলীয়ভাগ জলে, চক্ষু সূৰ্য্য, শ্রোত্র দিক্‌সমুদয়ে এবং প্রাণ আকাশমার্গে অবস্থান করিবে। আমি যখন শাস্ত্রানুসারে এই কার্য্যের অনুষ্ঠান করিতেছি, তখন কখনই আমাকে এই বিষয়ে অপরাধী হইতে হইবে না।”

‘সন্ন্যাসী কহিলেন, “ব্রহ্মন্! যদি এই যজ্ঞে ছাগের প্রাণবিয়োগ হইলে কেবল ইহার শ্ৰেয়োলাভ হয়, তাহা হইলে আপনার যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রয়োজন কি? বিশেষতঃ এই পশু পরাধীন। ইহার পিতা, মাতা, ভ্রাতা ও বন্ধুবর্গের অনুমতি গ্রহণ না করিয়া ইহাকে বধ করা আপনার কখনই কর্ত্তব্য নহে। আর যদি আপনি মন্ত্রদ্বারা এই পশুর প্রাণসমুদয়কে যথাস্থানে নিবেশিত করিয়া থাকেন, তাহা হইলে ইহার নিশ্চেষ্ট শরীরমাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে। অতএব ইহাতে ও কাষ্ঠে কিছুমাত্র প্রভেদ নাই; সুতরাং ইহার পরিবর্ত্তে কাষ্ঠদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করিবার বাধা কি?

“পূর্ধ্বতন পণ্ডিতেরা অহিংসাকেই সৰ্ব্বধৰ্ম্মের শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন; অতএব হিংসাবিহীন কার্য্যের অনুষ্ঠান করাই সকলের পক্ষে শ্রেয়ঃ। যদি আমি কখন হিংসা করিব না বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিতাম, তাহা হইলে আপনি আমার কাৰ্য্যের অশেষ দোষ নির্দ্দেশ করিতে পারিতেন। কিন্তু আমি সেরূপ দুষ্কর প্রতিজ্ঞা করি নাই। আমার মতে যথাসাধ্য প্রাণীগণের হিংসা না করাই পরমধর্ম্ম। আমি কেবল প্রত্যক্ষ হিংসাকেই দোষাবহ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকি।”

যাজ্ঞিক কহিলেন, “প্রভো! এই জগতীতলস্থ সমুদয় পদার্থেরই প্রাণ আছে। অতএব যখন আপনি গন্ধঘ্রাণ, রসাস্বাদন, রূপদর্শন, বায়ুসেবন, শব্দশ্রবণ ও কৰ্ত্তব্যাকৰ্ত্তব্য অবধারণ করিতেছেন, তখন আপনাকে কিরূপে হিংসাবিহীন বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে? হিংসা ভিন্ন কখনই আঘ্রাণাদি কাৰ্য্য সম্পাদিত হইতে পারে না। ইহলোকে হিংসা ভিন্ন কাহারও কোন কাৰ্য্য সিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা নাই। অতএব এক্ষণে আপনার মতে অহিংসা কি, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

‘সন্ন্যাসী কহিলেন, “ব্ৰহ্মন্! আত্মা দুই প্রকার—ক্ষর ও অক্ষর। পণ্ডিতেরা উপাধিযুক্ত আত্মাকে ক্ষর ও উপাধিবিহীন সনাতন আত্মাকে অক্ষর বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। যে ব্যক্তির আত্মা মায়ার সহিত মিলিত হইয়া প্রাণ, ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিরূপে ব্যবহৃত হয়, সেই ব্যক্তিরই হিংসাজনিত ভয় উপস্থিত হইয়া থাকে; আর যে ব্যক্তির আত্মা ঐ প্রাণাদি হইতে পৃথকভাবে অবস্থিত হইয়া নির্দ্বন্দ্ব ও সৰ্ব্বভূতে সমদর্শী হয়, তাহাকে কদাপি হিংসাজনিত ভয়ে ভীত হইতে হয় না। অতএব আমার মতে প্রাণাদি হইতে পৃথকভাবে অবস্থানই অহিংসা।”

‘তখন যাজ্ঞিক কহিলেন, “ভগবন্! আপনার বাক্য শ্রবণ করিয়া বোধ হইতেছে যে, ইহলোকে সাধুসংসর্গ লাভ করা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট কাৰ্য্য আর কিছুই নাই। এক্ষণে আপনার উপদেশে আমার বুদ্ধি অতিশয় নিৰ্ম্মল হইয়াছে। আমি নিশ্চয় বুঝিতেছি যে, আমার আত্মা কিছুতেই লিপ্ত নহে। সুতরাং এই বেদবিহিত যজ্ঞের অনুষ্ঠাননিবন্ধন আমাকে কখনই অপরাধী হইতে হইবে না।”

যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ এইরূপ যুক্তি প্রদর্শন করিলে সন্ন্যাসী তাঁহার বাক্যের উত্তর প্রদানে অসমর্থ হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণও মোহবিহীন হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। হে প্রিয়ে! এই আমি তোমার নিকট সন্ন্যাসী ও যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণের পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিলাম। মহাত্মা ব্রাহ্মণগণ শাস্ত্রালোচনাদ্বারা পূর্ব্বোক্তরূপ আত্মার প্রাণাদি হইতে পৃথকভাবে অবস্থানই মোক্ষলাভের উপায় বলিয়া পরিজ্ঞাত হইয়া তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিদিগের উপদেশানুসারে উহার অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন।’ ”