২৩. বায়ুসমীকরণ—প্রাণাদি বায়ুর প্রাধান্য বিতর্ক

বায়ুসমীকরণ—প্রাণাদি বায়ুর প্রাধান্য বিতর্ক

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘প্রিয়ে! অতঃপর অন্তর্যাগনিরত প্রাণাদি পঞ্চহোতার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। প্রাণ, তাপান, উদান, ব্যান ও সমান এই পঞ্চহোতা সব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে।

“ব্রাহ্মণী কহিলেন, ‘নাথ! আমি ইতিপূর্ব্বে আপনার মুখে স্ব স্ব বিষয়ে অবস্থিত নেত্র-কৰ্ণাদি সাতজন হোতার বিষয় শ্রবণ করিয়াছি, এক্ষণে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ প্রাণাদি পঞ্চ হোতার বিষয় বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করুন।

“ব্রাহ্মণ কহিলেন, ‘প্রিয়ে! বায়ু প্রাণকর্ত্তৃক পরিপুষ্ট হইয়া অপানরূপে, অপানকর্ত্তৃক পরিপুষ্ট হইয়া ব্যানরূপে, ব্যানকর্ত্তৃক পরিপুষ্ট হইয়া উদানরূপে ও উদানকর্ত্তৃক পরিপুষ্ট হইয়া, সমানরূপে পরিণত হয়। উহারা সকলেই স্ব স্ব প্রধান। উহারা সৰ্ব্বলোক পিতামহ ব্রহ্মার নিকট গমনপূৰ্ব্বক কহিয়াছিল, “ভগবন্! আমাদের মধ্যে কোন্ বায়ু প্রধান, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। আপনি যাহাকে প্রধান বলিয়া নির্দ্দেশ করিবেন, আমরা সকলেই তাঁহাকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া সম্মান করিব।” তখন ব্রহ্মা কহিলেন, “হে বায়ুগণ! তোমাদের পাঁচজনের মধ্যে যে ব্যক্তির লয় হইলেই অন্য চারিজন লয়প্রাপ্ত হইবে এবং যে ব্যক্তি সঞ্চারিত হইলেই অন্য চারিজন সঞ্চরণ করিবে, সেই তোমাদের মধ্যে প্রধান। এক্ষণে তোমরা যথা ইচ্ছা গমন কর।”

‘ব্রহ্মা এই কথা কহিলে প্রাণ অপানাদি অন্য বায়ুচতুষ্টয়কে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “হে বায়ুগণ! আমি তোমাদের সর্ব্বাপেক্ষা প্রধান। আমার লয় হইলেই তোমরা সকলে লয়প্রাপ্ত হও এবং আমি সঞ্চারিত হইলেই তোমরা সকলে সঞ্চরণ কর। এই দেখ, আমি লয়প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে তোমাদিগকে লীন হইতে হইবে।”

‘প্রাণবায়ু অপানাদি বায়ু-চতুষ্টয়কে এই কথা বলিয়া কিয়ৎকাল সংলীন থাকিয়া পুনরায় সঞ্চরণ করিতে লাগিল। তখন সমান ও উদানবায়ু তাহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “প্রাণ! তুমি আমাদের ন্যায় অপানাদি সমুদয় বায়ুতে ব্যাপ্ত হইয়া অবস্থান কর না, একমাত্র অপানই তোমার বশবর্ত্তী; তোমার লয় হওয়াতে আমাদের কিছুমাত্র হানি হয় নাই। সুতরাং তুমি আমাদের মধ্যে প্রধান নহ।” সমান ও উদান এই কথা কহিলে প্রাণ তাহাদের বাক্যে উত্তর প্রদানে অসমর্থ হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক সঞ্চরণ করিতে লাগিল।

‘তখন অপানবায়ু অন্যান্য বায়ু-চতুষ্টয়কে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, “হে বায়ুগণ! আমার লয় হইলে তোমাদের সকলকেই লয়প্রাপ্ত হইতে হয় এবং আমি সঞ্চরণ করিলেই তোমাদের সঞ্চার হইয়া থাকে। অতএব আমিই তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই দেখ, আমি বিলীন হই, তাহা হইলে তোমাদিগকে লয়প্রাপ্ত হইতে হইবে।”

‘অপানবায়ু এই কথা কহিবামাত্র ব্যান ও উদান তাহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “অপান! একমাত্র প্রাণই তোমার বশবর্ত্তী, সুতরাং তুমি আমাদের সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহ।” ব্যান ও উদান এই কথা কহিলে অপান তাহাদের বাক্যে উত্তরপ্রদানে অসমর্থ হইয়া পূৰ্ব্ববৎ সঞ্চরণ করিতে লাগিল। তখন ব্যানবায়ু অন্যান্য বায়ুচতুষ্টয়কে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “হে বায়ুগণ! আমি সংলীন হইলে তোমাদের সকলেরই লয় হয় এবং আমি সঞ্চরণ করিলেই তোমাদের সঞ্চার হইয়া থাকে, সুতরাং আমিই তোমাদের সৰ্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই দেখ, আমি বিলীন হই, তাহা হইলেই তোমাদের সকলকে লয়প্রাপ্ত হইতে হইবে।”

‘ব্যানবায়ু এই কহিয়া কিয়ৎকাল সংলীন থাকিয়া পুনরায় পূৰ্ব্ববৎ সঞ্চরণ করিতে লাগিল। তখন প্রাণাদি বায়ুগণ তাহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “ব্যান! একমাত্র সমানই তোমার বশবর্ত্তী, সুতরাং তুমি আমাদের সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহ।” প্রাণাদি বায়ুগণ এই কথা কহিলে ব্যান তাহাদের বাক্যে উত্তরপ্রদানে অসমর্থ হইয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূৰ্ব্বক পূর্ব্বের ন্যায় সঞ্চরণ করিতে লাগিল।

তখন সমানবায়ু অন্যান্য বায়ুগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “হে বায়ুগণ! আমার লয় হইলে তোমাদের সকলকেই বিলীন হইতে হয় এবং আমি সঞ্চরণ করিলেই তোমাদের সঞ্চার হইয়া থাকে; সুতরাং আমিই তোমাদের মধ্যে প্রধান। এই দেখ, আমি বিলীন হই, তাহা হইলে তোমাদের সকলকেই বিলীন হইতে হইবে।”

‘সমানবায়ু এই কথা কহিয়া কিয়ৎকাল সংলীন থাকিয়া পুনরায় সঞ্চরণ করিতে লাগিল, কিন্তু তন্নিবন্ধন অন্যান্য বায়ুচতুষ্টয়ের কিছুমাত্র হানি হইল না। তখন উদানবায়ু অন্যান্য বায়ুগণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, “হে বায়ুগণ! আমি সংলীন হইলে তোমাদের সকলকেই লয়প্রাপ্ত হইতে হয় এবং আমি সঞ্চরণ করিলে তোমাদের সঞ্চার হইয়া থাকে, সুতরাং আমিই তোমাদের মধ্যে প্রধান। এই দেখ, আমি সংলীন হই, তাহা হইলে তোমাদের সকলকেই লয়প্রাপ্ত হইতে হইবে।”

‘উদানবায়ু এই কথা কহিয়া কিয়ৎকাল সংলীন থাকিয়া পুনরায় সঞ্চরণ করিতে লাগিল। তখন প্রাণাদি বায়ুগণ তাহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, “উদান! একমাত্র ব্যানই তোমার বশবর্ত্তী, সুতরাং তুমি আমাদের সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহ।”

‘এইরূপে প্রাণাদি পঞ্চবায়ু, প্রত্যেকে সর্ব্বশ্রেষ্ঠতা লাভ করিবার চেষ্টা করিয়া কৃতকার্য্য হইতে না পারিলে ব্রহ্ম তাহাদিগের সকলকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে বায়ুগণ! তোমরা সকলেই স্ব স্ব প্রধান। তোমাদের মধ্যে একের লয় হইলে সমুদয়ের লয় হয় না, এই নিমিত্ত আমি তোমাদিগের সকলকেই প্রধান বলিয়া কীৰ্ত্তন করিতেছি। কিন্তু তোমরা কেহই স্বাধীন নহ। এই নিমিত্ত তোমাদের সকলকেই নিকৃষ্ট বলিয়া নির্দ্দেশ করিলেও করা যায়। তোমরা আমার আত্মার স্বরূপ। তোমরা একমাত্র হইয়া স্থান ও কাৰ্য্যভেদে পাঁচনামে নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাক। এক্ষণে তোমরা সকলে পরস্পর সুহৃদ্ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক পরস্পরের সাহায্যে নিরত হইয়া পরমসুখে অবস্থান কর। তোমাদের মঙ্গললাভ হউক।”