১৯. মুক্ত মানবের লক্ষণ

মুক্ত মানবের লক্ষণ

“ব্রাহ্মণ বলিলেন, “হে তপোধন! যে ব্যক্তি স্থূল-সূক্ষ্ম দেহাভিমান পরিত্যাগপূৰ্ব্বক চিন্তাশূন্য হইয়া ব্রহ্মে লীন হয়েন, যিনি সকলের মিত্ৰ, সৰ্ব্বসহিষ্ণু, শান্তিনিরত, বীতরাগ, জিতেন্দ্রিয়, ভয়ক্রোধশূন্য ও অভিমানবিহীন, যিনি সকলের প্রতি আত্মবৎ ব্যবহার এবং যিনি জন্ম, মৃত্যু, সুখ, দুঃখ, লাভ, অলাভ, প্রিয় ও অপ্রিয় সমান জ্ঞান করিয়া থাকেন, যিনি কাহারও দ্রব্যে স্পৃহা এবং কাহারও প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন না করেন, যাঁহার শত্রু ও মিত্র নাই, যিনি ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই তিনই পরিত্যাগ করিতে পারেন, যিনি অপত্যস্নেহশূন্য, যিনি ধার্ম্মিক ও অধাৰ্ম্মিক নহেন, যাঁহার পূৰ্ব্বজন্মের কর্ম্মসমুদয় বিনষ্ট হইয়া যায়, অপুনরাগমননিবন্ধন যাঁহার চিত্ত প্রশান্ত হইয়াছে, যিনি কাম্যকৰ্ম্মবিহীন, যিনি এই জন্মমৃত্যু-জরাযুক্ত জগৎকে অনিত্য বলিয়া আলোচনা করেন, যাঁহার অন্তরে বৈরাগ্যবুদ্ধি নিরন্তর জাগরূক থাকে, যিনি সতত আত্মদোষ দর্শন করেন এবং যিনি অগন্ধ, অরস, অস্পর্শ, অশব্দ, অরূপ, অপরিগ্রহ, অনভিজ্ঞেয় [ব্যাপারহীন—নিষ্কৰ্ম্মা], অহঙ্কারশূন্য, স্বয়ম্ভু, নির্গুণ ও গুণভোক্তা পরমাত্মার দর্শনলাভে সমর্থ হয়েন, তিনি এই সংসারবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারেন। যিনি বুদ্ধিবলে দৈহিক ও মানসিক সঙ্কল্পসমুদয় পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনি দাহ্য পদার্থবিহীন অনলের ন্যায় নির্ব্বাণপদ প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। যিনি সৰ্ব্বসংস্কারনির্ম্মুক্ত, নির্দ্বন্দ্ব ও নিম্পরিগ্রহ হইয়া তপোবলে ইন্দ্রিয় নিগ্রহ করেন, তিনিই মুক্ত হইয়া সনাতন প্রশান্ত নিত্য পরম ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়েন।

যোগপথে মুক্তির উপায়প্রদর্শন

‘হে তপোধন! অতঃপর যোগিগণ যোগযুক্ত হইয়া যেরূপে বিশুদ্ধ চৈতন্যকে দর্শন করেন এবং যে সমস্ত নিগ্রহোপায় [সংযম] দ্বারা চিত্তকে বিষয়াসক্তি হইতে নিবৃত্ত করিতে হয়, আমি তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তীব্রতপানুষ্ঠান সহকারে ইন্দ্রিয়সমুদয়কে স্ব স্ব বিষয় হইতে প্রতিনিবৃত্ত করিয়া আত্মাতে চিত্তকে ধারণপূর্ব্বক মুক্তির নিমিত্ত যত্ন করা কর্ত্তব্য। তপস্বী ব্রাহ্মণ যোগবলে সতত মনদ্বারা হৃদয়ে আত্মাকে দর্শন করিতে চেষ্টা করিবেন। যখন তিনি হৃদয়ে আত্মাকে যোগ করিতে পারিবেন, তখনই তিনি একান্তমনে হৃদয়ে পরমাত্মার সাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ হইবেন।

যেমন স্বপ্নযোগে অদৃষ্টচর [অদৃষ্টপূৰ্ব্ব] বস্তু দর্শনপূর্ব্বক প্রবুদ্ধ হইলে পুনরায় তাহার জ্ঞানলাভ হয়, সেইরূপ সমাধিবলে বিশ্বরূপ আত্মাকে প্রত্যক্ষ করিয়া ধ্যানভঙ্গ হইলেও তাহার অভিজ্ঞানলাভ হইয়া থাকে। যেমন কোন ব্যক্তি মুঞ্জা হইতে ঈষীকা [মুঞ্জতৃণজাত অতিসূক্ষ্ম তীরতুল্য অস্ত্র] নিষ্কাশনপূর্ব্বক নিরীক্ষণ করে, সেইরূপ যোগীব্যক্তি দেহ হইতে আত্মাকে পৃথক্ করিয়া প্রত্যক্ষ করিয়া থাকেন। যখন যোগী যোগবলে আত্মাকে সম্যক্ নিরীক্ষণ করেন, তখন ত্রিলোকের অধিপতিও তাঁহার নিকট আধিপত্য করিতে পারেন না। তিনি ঐ সময় স্বেচ্ছানুসারে অনায়াসে দেবগন্ধর্ব্বাদির মূৰ্ত্তিপরিগ্রহ করিতে সমর্থ হয়েন। জরা, মৃত্যু, শোক ও হর্ষ আর তাঁহাকে আক্রমণ করিতে পারে না। তিনি দেবগণেরও দেবতা হইতে পারেন ও অচিরাৎ এই অনিত্য দেহ পরিত্যাগ করিয়া অক্ষয় ব্রহ্মকে লাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

‘লোকক্ষয় আরম্ভ হইলে তাঁহার অন্তরে কিছুমাত্র ভয়সঞ্চার হয় না। সমুদয় প্রাণী ক্লিশ্যমান হইলেও তাঁহার কোন ক্লেশ উপস্থিত হয় না। সেই শান্তচিত্ত, নিস্পৃহ যোগী সংসর্গ ও স্নেহসমুৎপন্ন ভয়ঙ্কর দুঃখ ও শোকপ্রভাবে কখনই বিচলিত হয়েন না। শস্ৰজাল তাঁহাকে সংহার ও মৃত্যু তাঁহাকে আক্রমণ করিতে পারে না। তাহা অপেক্ষা এই জীবলোকে আর কাহাকেও সুখী বলিয়া গণ্য করা যায় না। তিনি নিরুপাধিক আত্মাতে মনঃসংযোগপূৰ্ব্বক জরাজনিত দুঃখ পরিহার করিয়া নির্ব্বিঘ্নে নিৰ্ব্বাণসুখ অনুভব করিয়া থাকেন। যোগৈশ্বৰ্য্য উপভোগপূৰ্ব্বক যোগে শিথিল-প্রযত্ন হওয়া যোগীর কদাপি উচিত নহে। যোগীর যখন আত্মসাক্ষাৎকার লাভ হয়, তখন স্বয়ং সুররাজ ইন্দ্র উপস্থিত হইলেও তিনি তাঁহার নিকট কিছুমাত্র প্রার্থনা করেন না।

ধ্যানযোগে ব্ৰহ্মসাক্ষাৎকার

‘এক্ষণে ধ্যানপরায়ণ হইয়া যেরূপ গতি লাভ করা যায়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। জীব শরীরের মধ্যে মূলাধার প্রভৃতি যে যে চক্রে অবস্থান করিবে, মনকে সেই সেই চক্রে সংস্থাপন করা আবশ্যক। মনকে দেহের বহির্ভাগে স্থাপন করা কোনক্রমেই শ্রেয়স্কর নহে। যখন জীব সেই মূলাধারাদি চক্রে সর্ব্বাত্মক ঈশ্বরকে নিরীক্ষণ করে, সেই সময়ে সে কদাচই বহির্ব্বিষয়ে সংসক্ত হয় না। সর্ব্বাগ্রে ইন্দ্রিয়নিগ্রহ করিয়া নিঃশব্দ নির্জ্জন অরণ্যমধ্যে একাগ্রচিত্তে দেহের অভ্যন্তরে পূর্ণব্রহ্মকে চিন্তা করাই যোগী ব্যক্তির অবশ্য কর্ত্তব্য। সনাতন ব্রহ্ম শরীরের সমুদয় অংশেই দেদীপ্যমান রহিয়াছেন, অতএব তাঁহাকে সর্ব্বাঙ্গে চিন্তা করাই আবশ্যক। আপনার গৃহমধ্যে রত্ন সঞ্চিত থাকিলে সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া যেমন তাহা অনুসন্ধান করিতে হয়, সেইরূপ, ইন্দ্রিয়নিগ্রহপূর্ব্বক মনকে দেহমধ্যে প্রবেশিত করিয়া অপ্রমাদে হৃদয়নিহিত পরমাত্মাকে অনুসন্ধান করা আবশ্যক। এইরূপে নিরন্তর উদযোগসম্পন্ন ও প্রীতচিত্ত হইয়া ঈশ্বরকে অনুসন্ধান করিলে অনতিকালমধ্যেই তাঁহাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। জীব তাহার সাক্ষাৎকারলাভ করিতে পারিলেই সূক্ষ্মদর্শিতা লাভ করিতে পারে। সেই পরমাত্মাও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য নহেন। মনঃস্বরূপ চক্ষু-প্রদীপকে উজ্জ্বল করিয়া তাঁহাকে প্রত্যক্ষ করিতে হয়। তাঁহার কর, চরণ, চক্ষু, মুখ, মস্তক ও কর্ণ সৰ্ব্বত্রই বিদ্যমান রহিয়াছে। সেই সৰ্ব্বশকমান এই বিশ্বের আদ্যামধ্যে ওতপ্রোতভাবে বিরাজিত রহিয়াছেন, যোগী সৰ্ব্বাগ্রে দেহ হইতে পৃথগ্‌ভূত আত্মাকে দর্শন করিবেন এবং তৎপরে সেই আত্মাকে ব্রহ্মে লীন করিয়া চিত্তনিরোধপূৰ্ব্বক প্রফুল্লমনে নির্গুণ ব্রহ্মের সহিত সাক্ষাৎকারে প্রবৃত্ত হইবেন। ঐ নির্গুণ ব্রহ্মকে আশ্রয় করিলেই মোক্ষলাভ হয়।

“হে ব্রহ্মন্‌! এই আমি তোমার নিকট সমুদয় রহস্য কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে আমি চলিলাম; তুমি যথায় ইচ্ছা গমন কর। সিদ্ধ ব্রাহ্মণ কাশ্যপকে এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে তিনি সন্তুষ্টচিত্তে স্বাভিলষিত স্থানে প্রস্থান করিলেন।

“হে অর্জ্জুন! দ্বারকায় সমাগত ব্রাহ্মণ আমাকে মোক্ষধর্ম্মমূলক এইরূপ উপদেশ প্রদান করিয়া সৰ্ব্বসমক্ষে অন্তর্হিত হইলেন। আমি এক্ষণে তোমার নিকট যে যে উপদেশ কীৰ্ত্তন করিলাম, তৎসমুদয় তুমি একাগ্রচিত্তে শ্রবণ করিয়াছ। তুমি সংগ্রামকালে রথারূঢ় হইয়া আমার নিকট অবিকল এই সমুদয় উপদেশই শ্রবণ করিয়াছিলে। অকৃতজ্ঞ ও চঞ্চলচিত্ত ব্যক্তি কদাপি ইহা সম্যক অবগত হইতে পারে না। এই ধর্ম্মোপদেশ দেবগণেরও গোপনীয়। তোমা ভিন্ন অন্য কোন মনুষ্যই ইহা শ্রবণ করিবার উপযুক্ত নহে।

‘যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়ানিষ্ঠ মহাত্মারা দেবলোকে গমন করিয়া থাকেন। সেই যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়ার উচ্ছেদসাধনপূৰ্ব্বক জ্ঞানমার্গ অবলম্বন করিয়া মুক্তিলাভ করা দেবগণের অভিপ্রেত নহে। সনাতন ব্রহ্মই জীবের পরমগতি। জীব জ্ঞানমার্গ অবলম্বনপূর্ব্বক দেহ পরিত্যাগ করিয়া সেই ব্রহ্মে লীন হইয়াই মুক্তিলাভ করে। স্বধর্ম্মনিরত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের কথা দূরে থাকুক, পাপনিরত স্ত্রী, বৈশ্য, শূদ্রও এই আত্মদর্শনরূপ ধৰ্ম্ম আশ্রয় করিয়া অনায়াসে পরমগতিলাভে সমর্থ হয়।

“এই আমি তোমার নিকট এই যুক্তিযুক্ত ধৰ্ম্মসাধনোপায় ও সিদ্ধির বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। এই ধৰ্ম্ম অপেক্ষা সুখকর ধর্ম্ম আর কিছুই নাই। যে বুদ্ধিমান ব্যক্তি এই অসার বিষয়ভোগ পরিত্যাগ করে, সে এই উপায় অবলম্বনপূৰ্ব্বক অচিরাৎ পরমগতিলাভে সমর্থ হয়। ছয়মাসকাল প্রতিনিয়ত যোগসাধন করিলে যোগের ফললাভ হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই।”