১৭. জীবাত্মার দেহ আশ্রয় ও দেহত্যাগ

জীবাত্মার দেহ আশ্রয় ও দেহত্যাগ

কৃষ্ণ কহিলেন, “মহাত্মা সিদ্ধ এই কথা কহিলে, ধর্ম্মপরায়ণ কাশ্যপ তাঁহাকে নমস্কার করিয়া কহিলেন, “ভগবন্! জীবাত্মা কিরূপে এক দেহ পরিত্যাগ ও অন্য দেহ আশ্রয় করে আর কিরূপেই বা স্থূল ও সূক্ষ্মদেহ পরিত্যাগ করিয়া এই ক্লেশকর সংসার হইতে বিমুক্ত হয়? কিরূপে উহার শুভাশুভ কার্য্যের ফলভোগ হইয়া থাকে এবং দেহত্যাগের পর উহার কৰ্ম্মসমুদয় কোন্ স্থানে অবস্থান করে, এই সমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন। করুন।’

“মহর্ষি কাশ্যপ এইরূপ প্রশ্ন করিলে মহাত্মা সিদ্ধ তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহর্ষে! জীব দেহ আশ্রয় করিয়া যেসমুদয় আয়ুষ্করকার্য্যের অনুষ্ঠান করে, সেইসমুদয় কার্য্যের ক্ষয় হইলেই তাহার আয়ুক্ষয় হয়। তখন সেই বিপরীতবুদ্ধি আশ্রয় করিয়া নিরন্তর অসৎকার্য্যের অনুষ্ঠান করিতে আরম্ভ করে; স্বীয় শরীরের অবস্থা, বল ও কাল পরিজ্ঞাত হইয়াও অধিক পরিমাণে অহিতকর বস্তুভোজনে প্রবৃত্ত হয়; কোন দিন অতিভোজন ও কোন দিন একেবারে ভোজন পরিত্যাগ করে; কখন অপেয় পান এবং অপরিমিত দুষ্ট অন্ন, আমিষ ও পরস্পরবিরোধী গুরুতর বস্তুসমুদয় ভোজনে আসক্ত হয়; কোন দিন ভুক্ত বস্তু জীর্ণ না হইতে হইতেই ভোজন করে; কোন দিন দিবসে নিদ্রিত হয়; কোন দিন কঠিন পরিশ্রম ও বারংবার স্ত্রীসংসর্গ করিয়া শরীরের দৌর্ব্বল্য উৎপাদন করে; কোন দিন অনবরত বিষয়কৰ্ম্ম সম্পাদনবাসনায় মল-মূত্রাদির বেগধারণে প্রবৃত্ত হয় এবং কোন দিন অসময়ে ভোজন করিয়া শরীরস্থ বায়ুপিত্তাদি প্রকোপিত করে। জীব এইরূপ অত্যাচারে প্রবৃত্ত হইলে অচিরাৎ প্রাণনাশক রোগ আসিয়া উহাকে আক্রমণ করিয়া থাকে। কেহ কেহ আয়ুঃক্ষয় হইলে কুপথ্যসেবনাদি অত্যাচার না করিয়াও বুদ্ধিভ্রংশনিবন্ধন উদ্বন্ধনাদিদ্বারা দেহত্যাগ করে।

‘এই আমি তোমার নিকটে যে নিমিত্ত জীবের দেহত্যাগ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম। অতঃপর জীবাত্মা যেরূপে দেহ হইতে বহির্গত হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। জীবাত্মার দেহত্যাগের সময় শরীরান্তৰ্গত উষ্মা [তাপ] বায়ুবেগবশতঃ প্রকোপিত হইয়া দেহ উত্তপ্ত ও প্রাণ রুদ্ধ করিয়া সমুদয় মৰ্ম্মস্থান ভেদ করিতে থাকে। তখন জীবাত্মা মৰ্ম্মভেদী বিষম যন্ত্রণায় সমাক্রান্ত হইয়া দেহ হইতে অপসৃত হয়।

‘সমুদয় জীবই বারংবার জন্মমরণের বশীভূত হইয়া থাকে। জীব মৃত্যুসময়ে যেরূপ কষ্টভোগ করে, তাহাকে জন্মগ্রহণপূর্ব্বক গর্ভ হইতে বহির্গত হইবার সময়ও সেইরূপ কষ্টভোগ করিতে হয়। ঐ সময় সে তীব্র বায়ুপ্রভাবে শীতে কম্পিত ও ক্লেদে নিক্ষিপ্ত হইয়া থাকে। পঞ্চভূতের পৃথগ্‌ভাবসময়ে শরীরের অভ্যন্তরস্থ প্রাণ ও অপানবায়ু ঊৰ্দ্ধগামী হইয়া দেহকে পরিত্যাগ করে। তখন সেই দেহ বিশ্রী, বিচেতন এবং উষ্মা উচ্ছাসবিহীন হইয়া মৃত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়। জীবাত্মা ইন্দ্রিয়দ্বারা রূপরসাদি বিষয়সমুদয়ের আস্বাদগ্রহণ করিতে পারে, কিন্তু উহাদ্বারা আহারসম্ভব [ভুক্তদ্রব্য হইতে জাত] প্রাণকে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। সনাতন জীবই শরীরের মধ্যে অবস্থানপূৰ্ব্বক সমুদয় কাৰ্য্য সম্পাদন করে। পণ্ডিতেরা শরীরের সন্ধিস্থানসমুদয়কে মৰ্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। ঐ সমুদয় মৰ্ম্ম ভিন্ন হইলে জীব ঐ সমুদয়কে পরিত্যাগপূর্ব্বক বুদ্ধিকে রুদ্ধ করে। বুদ্ধি রুদ্ধ হইলে জীবাত্মা সচেতন হইয়াও কোন বিষয় পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয় না। ঐ সময় সমীরণ সেই নিরধিষ্ঠান [আশ্রয়চুত] জীবকে মহাবেগে চালিত করিতে থাকে। তখন জীবাত্মা সুদারুণ দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দেহকে কম্পিত করিয়া উহা হইতে বিনির্গত হয়।

কৰ্ম্মবশে স্বর্গ-নরকগামী জীবের কৰ্ম্মভেদ

‘জীব এইরূপে দেহচ্যুত হইলেও তত্ত্বত্ত্বক অনুষ্ঠিত কর্ম্মসমুদয় তাহাকে পরিত্যাগ করে না। সে ঐ সমুদয় কৰ্ম্মে সমাবৃত হইয়া পুনরায় ভূমণ্ডলে জন্মপরিগ্রহ করে। তখন জ্ঞানবান্ বেদবেত্তা ব্রাহ্মণগণ লক্ষণদ্বারা উহাকে পুণ্যবান বা পাপাত্মা বলিয়া পরিজ্ঞাত হইয়া থাকেন। যেমন চক্ষুষ্মান্ ব্যক্তিরা চক্ষুদ্বারা অন্ধকারে উড্ডীয়মান খদ্যোতকে দর্শন করে, তদ্রূপ জ্ঞানাপন্ন সিদ্ধ মহাত্মার জ্ঞানচক্ষু দ্বারা জীবের জন্ম, মরণ ও গর্ভপ্রবেশ দর্শন করিতে সমর্থ হয়েন। শাস্ত্রে জীবের স্বর্গ, মর্ত্য ও নরক এই ত্রিবিধ স্থান নির্দ্দিষ্ট আছে। কেহ কেহ এই কৰ্ম্মভূমিতে শুভাশুভ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া এই স্থানেই তাহার ফলভোগ করে, কেহ কেহ পুণ্যবলে স্বর্গারোহণ করিয়া বিবিধ ভোগ প্রাপ্ত হয় এবং কেহ কেহ অশেষ পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া অনন্তকাল নরকভোগ করিয়া থাকে। জীব একবার নরকে নিপাতিত হইলে তাহার তাহা হইতে মোক্ষলাভ হওয়া নিতান্ত কঠিন, অতএব যাহাতে নরকে নিপতিত হইতে না হয়, এরূপ চেষ্টা করা সকলের কৰ্ত্তব্য।

‘এক্ষণে জীবসমুদয় স্বর্গগামী হইয়া যে যে স্থানে অবস্থান করে, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। উহা শ্রবণ করিলে কৰ্ম্মগতি তোমার অবিদিত থাকিবে না। যাঁহারা ইহলোকে পুণ্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহারা দেহান্তে ঊর্ধ্বগামী হইয়া চন্দ্র, সূৰ্য্য অথবা নক্ষত্রলোক লাভ করিয়া থাকেন। কৰ্ম্মক্ষয় হইলে তাঁহাদিগকে পুনৰ্ব্বার সেই সেই স্থান হইতে নিপতিত হইতে হয়। পুণ্যশীল ব্যক্তিগণ বারংবার ঐ সমুদয় স্থানে গমন ও ঐ সমুদয় স্থান হইতে পরিভ্রষ্ট হইয়া মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন। স্বর্গেও উৎকৃষ্ট, মধ্যম ও নীচ ত্রিবিধ স্থান বিদ্যমান আছে, সুতরাং যাঁহারা স্বর্গে বাস করেন, তাঁহারাও আপন অপেক্ষা অন্যের শ্রীদর্শন করিয়া ঈর্ষান্বিত হয়েন। এই আমি তোমার নিকট জীবসমুদয়ের গতি কীৰ্ত্তন করিলাম; অতঃপর জীবের দেহপরিগ্রহের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ কর।”