১৬. অনুগীতাপর্ব্বাধ্যায়

অনুগীতাপর্ব্বাধ্যায়

জনমেজয় কহিলেন, ব্রহ্মণ্‌! মহাত্মা মধুসূদন ও অর্জ্জুন বিপক্ষগণকে সংহারপূৰ্ব্বক সেই সভায় বাস করিয়া কিরূপ কথোপকথন করিয়াছিলেন, কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাবীর অর্জ্জুন আপনাদিগের পৈতৃকরাজ্য অধিকার করিয়া বাসুদেবের সহিত সেই সভাতে বিহার করিতে লাগিলেন। অনন্তর তাঁহারা একদা সজ্জনগণসমভিব্যাহারে যদৃচ্ছাক্রমে স্বর্গের ন্যায় রমণীয় সেই সভার কোন এক প্রদেশে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ সময় অর্জ্জুন প্রীতিপ্রফুল্লচিত্তে সেই সভার শোভা সন্দর্শন করিয়া বাসুদেবকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মধুসূদন! যুদ্ধকালে আমি তোমার মাহাত্ম সম্যক্ অবগত হইয়াছি এবং তোমার বিশ্বমূৰ্ত্তিও নিরীক্ষণ করিয়াছি। তুমি পূৰ্ব্বে বন্ধুত্বনিবন্ধন আমাকে যে সমস্ত উপদেশ প্রদান করিয়াছিলে, আমি স্বীয় বুদ্ধিদোষে তৎসমুদয় বিস্মৃত হইয়াছি। এক্ষণে সেই সমস্ত জ্ঞাত হইতে পুনরায় আমার কৌতূহল উপস্থিত হইতেছে। তুমি অচিরাৎ দ্বারকায় গমন করিবে, অতএব এই সময়ে আমার নিকট পুনরায় তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন কর।”

অৰ্জ্জুনের প্রতি কৃষ্ণের পুনরায় গীতা-উপদেশ

অৰ্জ্জুন এই কথা কহিলে মহাত্মা বাসুদেব তাহাকে আলিঙ্গন পূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধনঞ্জয়! আমি তোমার নিকট নিগূঢ় ধৰ্ম্ম ও নিত্যলোকসমুদয়ের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়াছি। তুমি যে বুদ্ধিপূর্ব্বক সেই সকল বিষয় শ্রবণ ও অবধারণ কর নাই, ইহাতে আমি যারপরনাই দুঃখিত হইতেছি। পূর্ব্বে আমি তোমার নিকট যাহা যাহা বলিয়াছিলাম, তৎসমুদয় এক্ষণে আর আমার স্মৃতিপথে উদিত হইবে না। বিশেষতঃ আমার বোধ হইতেছে, তুমি অতি নির্ব্বোধ ও শ্রদ্ধাশূন্য; অতএব আমি আর কোনক্রমেই তোমাকে তাদৃশ উপদেশ প্রদান করিতে পারিব না। সেই ধর্ম্মোপদেশপ্রভাবে ব্ৰহ্মপদ অবগত হইতে সমর্থ হওয়া যায়। এক্ষণে পুনরায় আমি তাহা সমগ্ররূপে কীৰ্ত্তন করিতে পারি না। আমি তৎকালে যোগযুক্ত হইয়াই সেই পরব্রহ্মপ্রাপক বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়াছিলাম। যাহা হউক, এক্ষণে তোমার নিকট ব্রহ্মজ্ঞানসম্পাদক এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, তুমি অবহিত মনে শ্রবণ কর। তুমি ঐ ইতিহাস শ্রবণ করিলে উৎকৃষ্ট বুদ্ধিলাভপূৰ্ব্বক শ্রেষ্ঠ গতি প্রাপ্ত হইতে সমর্থ হইবে।

“একদা কোন এক ব্রাহ্মণ স্বর্গ ও ব্রহ্মলোক পরিভ্রমণপূর্ব্বক আমাদিগের নিকট আগমন করিয়াছিলেন। আমরা তাঁহাকে সমুচিত সৎকার করিয়া মোক্ষধৰ্ম্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে তিনি আমাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, মধুসূদন! তুমি প্রাণীদিগের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করিবার নিমিত্ত আমাকে যে মোক্ষৰ্ম্মের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে, তাহা শ্রবণ করিলে প্রাণীগণের মোহ নিরাকৃত হইয়া যায়। এক্ষণে আমি তাহা যথার্থতঃ কীৰ্ত্তন করিতেছি, অনন্যমনে শ্রবণ কর।

সিদ্ধিপথের উপদেশ—কাশ্যপ-সিদ্ধপুরুষ সংবাদ

‘পূৰ্ব্বে কাশ্যপ নামে ধৰ্ম্মপরায়ণ এক ব্রাহ্মণ এক সিদ্ধ ব্রাহ্মণের নিকট গমন করিয়াছিলেন। ঐ ব্রাহ্মণ লোকতত্ত্বাৰ্থকুশল [জগতের তত্ত্বনির্ণয়ে অভিজ্ঞ], সুখদুঃখ, জন্মমৃত্যু ও পাপপুণ্যতত্ত্বজ্ঞ, জীবন্মুক্ত, প্রশান্তচিত্ত, জিতেন্দ্রিয়, ব্রাহ্মীশ্রীসম্পন্ন [ব্রহ্মতেজোযুক্ত], অন্তর্দ্ধানগতিবেত্তা [সহসা অদৃশ্য হওয়া ব্যাপারে কুশলী], সর্ব্বত্র সঞ্চরণশীল ও শাস্ত্ৰমৰ্ম্মজ্ঞ। উনি প্রাণীগণ স্ব স্ব কৰ্ম্মপ্রভাবে যেরূপ গতিলাভ করিয়া থাকে, তৎসমুদয় বিলক্ষণ অবগত ছিলেন। উনি চক্রধারী সিদ্ধগণের সহিত গমনাগমন, উপবেশন ও নির্জ্জনে কথোপকথন করিতেন। তিনি পবনের ন্যায় অপ্রতিহত প্রভাবে সৰ্ব্বত্র গমন করিতে পারিতেন। বুদ্ধিমান কাশ্যপ তাঁহার এইরূপ গুণগ্রাম অবগত হইয়া বিস্ময়াবিষ্ট চিত্তে তাঁহার সমীপে গমনপূৰ্ব্বক কিয়দ্দিন, তথায় অবস্থান করিয়া শিষ্যের ন্যায় সেই মহর্ষির পরিচর্য্যা করিতে লাগিলেন।

‘তখন সেই সিদ্ধ মহর্ষি কাশ্যপের গাঢ়তর ভক্তিদর্শনে অনতিকালমধ্যে তাঁহার প্রতি প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, কাশ্যপ! আমি এক্ষণে উৎকৃষ্ট সিদ্ধির বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, তুমি অবহিতচিত্তে তাহা শ্রবণ কর। মনুষ্যেরা বিবিধ কাৰ্য্য ও পুণ্যযোগবলে উৎকৃষ্ট গতিলাভ ও দেবলোকে অবস্থান করিয়া থাকে। কোন ব্যক্তি নিরন্তর সুখলাভ, করিতে পারে না। উৎকৃষ্ট লোকসমুদয় অতিকষ্টে উপলব্ধ হইলেও তাহা হইতে বারংবার পতন হইয়া থাকে। আমি কাম, ক্রোধ, তৃষ্ণা ও মোহপ্রভাবে সতত পাপে লিপ্ত হইয়া অতি কষ্টকর অশুভ গতিসমুদয় প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। আমি বারংবার জন্মমৃত্যু ভোগ করিয়াছি। আমাকে বিবিধ ভক্ষ্যভোজ্য উপভোগ ও বিবিধ স্তনদুগ্ধ পান করিতে হইয়াছে। আমি বহুসংখ্যক জনকজননী দৃষ্টিগোচর করিয়াছি এবং বিবিধ সুখ ও বিবিধ দুঃখ প্রাপ্ত হইয়াছি। কতবার আমার প্রিয় বিচ্ছেদ ও অপ্রিয়সংযোগ উপস্থিত হইয়াছে। আমি বহু যত্নে ধনসঞ্চয় করিয়া তাহার উপভোগে বঞ্চিত হইয়াছি। আত্মীয়-স্বজন ও ভূপতিগণ বারংবার আমার অবমাননা করিয়াছেন।

‘আমি কতবার শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করিয়াছি। কতবার বধবন্ধন যাতনা অনুভব করিয়াছি, কতবার আমাকে নরকযন্ত্রণা, যমযন্ত্রণা ও জরাব্যাধিজনিত যন্ত্রণায় নিপীড়িত হইতে হইয়াছে। লৌকিক বিপদসমুদয় কতবার আমাকে আক্রমণ করিয়াছে। আমি এইরূপে বারংবার বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া পরিশেষে নিতান্ত বিরক্ত হইয়া লোকতন্ত্রপরিত্যাগপূৰ্ব্বক এই পথ অবলম্বন করিয়াছি। এক্ষণে মনঃপ্রসাদনিবন্ধন আমার সিদ্ধিলাভ হইয়াছে। ঐ সিদ্ধিপ্রভাবে আর আমাকে এই সংসারে আগমন করিতে হইবে না। অতঃপর যে পর্য্যন্ত আমার মুক্তিলাভ ও জগতের প্রলয় না হইবে, ততকাল আমি আপনার ও এই লোকসমূহের শুভগতিসমুদয় প্রত্যক্ষ করিব।

“আমি দেহত্যাগের পর এই সংসার হইতে এককালে সত্যলোকে গমন করিব এবং সেই সত্যলোক হইতে মুক্তিলাভ করিয়া ব্রহ্মের স্বরূপতা প্রাপ্ত হইব। তুমি আমার এই বাক্যে অণুমাত্র সন্দেহ করিও না। আমি আর কখনই এই মর্ত্যলোকে আগমন করিব না। এক্ষণে আমি তোমার প্রতি পরম প্রীত হইয়াছি, অতএব বল, আমাকে তোমার কি প্রিয়ানুষ্ঠান করিতে হইবে? তুমি যাহা লাভ করিবার অভিলাষ করিয়া আমার নিকট আগমন করিয়াছ, এক্ষণে তোমার তাহা প্রাপ্ত হইবার অবসর উপস্থিত হইয়াছে। এক্ষণে তোমার ইচ্ছা কি, তাহা স্বয়ং ব্যক্ত কর। আমি অচিরাৎ এই-সংসার পরিত্যাগ করিব, এই নিমিত্ত তোমাকে এইরূপ ত্বরা প্রদর্শন করিতেছি। আমি তোমার চরিত্র দর্শন করিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আমাকে যেকোন বিষয় জিজ্ঞাসা করিবে, আমি তাহা অকপটে কীৰ্ত্তন করিব। তুমি যখন আমাকে সম্যক্ জ্ঞাত হইয়াছ, তখন তোমার বুদ্ধি অতি উৎকৃষ্ট, তাহাতে আর সন্দেহ নাই।”