৩৯. নায়দের যুধিষ্ঠির সান্ত্বনা

নায়দের যুধিষ্ঠির সান্ত্বনা

বৈশম্পায়ন বলিলেন, পাণ্ডবগণ এইরূপে শোকাকুল হইলে, তপোধনগণের অগ্রগণ্য দেবর্ষি নারদ ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আপনার জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র বৃথানলে দগ্ধ হয়েন নাই। আমি গঙ্গাতীরনিবাসী মহর্ষিগণের প্রমুখাৎ শ্রবণ করিয়াছি, অন্ধরাজ গঙ্গাদ্বার হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া অরণ্যপ্রবেশকালে যজ্ঞসম্পাদনপূৰ্ব্বক যজ্ঞীয় অনল পরিত্যাগ করিলে, যাজকেরা সেই অনল নির্জ্জন বনে নিক্ষেপ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিয়াছিলেন। ক্রমে সেই অনল বর্দ্ধিত হওয়াতে তদ্বারা সমুদয় বন দগ্ধ হইয়া যায়। আপনার জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র সেই স্বীয় যজ্ঞানলে দগ্ধ হইয়া ইহলোক পরিহারপূর্ব্বক পরমগতি লাভ করিয়াছেন। আপনি আর তাঁহার নিমিত্ত শোক করিবেন না। আপনার জননী কুন্তীও গুরুশুশ্রূষানিবন্ধন সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন, সন্দেহ নাই। অতএব এক্ষণে আপনি ভ্রাতৃগণের সহিত সমাগত হইয়া তাঁহাদিগের তর্পণাদি ক্রিয়া সম্পাদন করুন।”

ধৃতরাষ্ট্রাদির ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া

দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিলে ধৰ্ম্মপরায়ণ ধৰ্ম্মরাজ ভ্রাতৃগণ, অন্তঃপুরস্থ কামিনীগণ ও রাজভক্তিপরায়ণ পুরবাসিগণের সহিত একবস্ত্র পরিধানপূৰ্ব্বক ভাগীরথীর তীরে গমন করিলেন। অনন্তর তাঁহারা সকলেই গঙ্গার পবিত্রজলে অবগাহনপূর্ব্বক যুযুৎসুকে অগ্রসর করিয়া শাস্ত্রানুসারে অন্ধরাজ, গান্ধারী ও কুন্তীর তর্পণক্রিয়া করিতে লাগিলেন। পরিশেষে সেই উদকক্রিয়া সম্পন্ন হইলে তাঁহারা সকলে তথা হইতে প্রত্যাগমনপূৰ্ব্বক নগরের বহির্ভাগে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় ধৰ্ম্মপরায়ণ মহাত্মা যুধিষ্ঠির বিধিজ্ঞ মানবগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে সুহৃদগণ! তোমরা গঙ্গাদ্বারের সন্নিহিত কাননে সমুপস্থিত হইয়া জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশে কর্ত্তব্য কাৰ্য্যসমুদয় সম্পাদন কর।” এই বলিয়া তিনি আত্মীয়গণকে গঙ্গাদ্বারে প্রেরণপূৰ্ব্বক স্বয়ং নগরের বহির্ভাগে অবস্থান করিতে লাগিলেন। ক্রমে একাদশ দিন1 অতীত হইল। দ্বাদশ দিনে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পবিত্র হইয়া বিধিপূৰ্ব্বক জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তীর শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পাদনপূর্ব্বক ব্রাহ্মণদিগকে দক্ষিণা প্রদান করিলেন।

অনন্তর তিনি ধৃতরাষ্ট্রের উদ্দেশে সুবর্ণ, রজত, গাভী ও মহামূল্য শয্যাসমুদয় এবং গান্ধারী ও ভোজনন্দিনী কুন্তীর নামোল্লেখপূর্ব্বক উৎকৃষ্ট বস্তুসমুদয় প্রদান করিলেন। ঐ সময় ব্রাহ্মণগণ শয্যা, খাদ্যদ্রব্য, মণি, রত্ন, যান, আচ্ছাদন ও সমলঙ্কৃত দাসী প্রভৃতি যাহা যাহা প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, ধৰ্ম্মরাজ জননী কুন্তী ও গান্ধারীর উদ্দেশে তাঁহাদিগকে তৎসমুদয় প্রদান করিলেন।

অনন্তর দানক্রিয়া সমাপন হইলে ধৰ্ম্মরাজ ভ্রাতৃগণ ও অন্যান্য ব্যক্তিগণের সহিত নগরমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তাঁহার আদেশানুসারে যেসমুদয় লোক গঙ্গাদ্বারে গমন করিয়াছিল, তাহারা ধৃতরাষ্ট্রাদির অস্থিসমুদয় গন্ধমাল্যাদিদ্বারা অর্চ্চিত করিয়া গঙ্গায় নিক্ষেপপূৰ্ব্বক হস্তিনায় প্রত্যাগমন ও নরপতির নিকট সেই বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। এইরূপে সমুদয় কার্য্য সম্পন্ন হইলে, দেবর্ষি নারদ ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে আশ্বাসিত করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। ধৰ্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির মাতা, জ্যেষ্ঠতাত ও অন্যান্য আত্মীয়দিগের নিধননিবন্ধন নিতান্ত দুঃখিত হইয়া রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। এইরূপে নরপতি ধৃতরাষ্ট্র কুরুক্ষেত্রযুদ্ধাবসানে সমরনিহত পুত্র, জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধবদিগের উদ্দেশে বিবিধ বস্তু দান করিয়া পঞ্চদশ বৎসর নগরে ও তিন বৎসর বনে অতিবাহিত করিয়াছিলেন।

নারদাগমনপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত