৩৭. নারদাগমনপৰ্ব্বাধ্যায়

নারদাগমনপৰ্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! পাণ্ডবগণ তপোবন হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইবার পর দুই বৎসর অতীত হইলে একদা তপোধনাগ্রগণ্য দেবর্ষি নারদ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তখন ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মা যুধিষ্ঠির তাঁহার যথোচিত সৎকার করিয়া তাঁহাকে আসন প্রদান করিলেন। দেবর্ষি নারদ সেই আসনে উপবিষ্ট হইলে, ধৰ্ম্মরাজ তাঁহার কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! বহুদিনের পর আপনার সহিত আমাদের সাক্ষাৎকার হইল। আপনি কোন্ কোন্ দেশ দর্শন করিয়াছেন, ইহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। আপনিই আমাদিগের পরমগতি। অতএব আজ্ঞা করুন, আমাকে আপনার কোন্ কাৰ্য্য সাধন করিতে হইবে।”

ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে দেবর্ষি নারদ তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমি বহুকালের পর তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিলাম, এরূপ বিবেচনা করিও না। আমি ধৃতরাষ্ট্রের তপোবনে তোমাদিগকে দর্শন করিয়াছি। এক্ষণে আমি গঙ্গা ও অন্যান্য তীর্থসমুদয় দর্শন করিয়া তপোবন হইতে আগমন করিতেছি।”

যুধিষ্ঠিরের ধৃতরাষ্ট্র-প্রশ্নে নারদের প্রত্যুত্তর

তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! গঙ্গাতীরনিবাসী মহাত্মারা আমার নিকট আমার জ্যেষ্ঠতাত মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্রের কঠোর তপানুষ্ঠানের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। এক্ষণে তিনি, জননী গান্ধারী ও কুন্তী এবং সূতপুত্র সঞ্জয় ইঁহারা সকলে কিরূপে কালহরণ করিতেছেন, আপনার মুখে তাহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। যদি আপনার সহিত তাঁহাদিগের সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে, তাহা হইলে তাঁহাদিগের সংবাদ আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।”

দেবর্ষি নারদ ধৰ্ম্মরাজকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আমি তোমার জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্রের তপোবনে যে যে বিষয় দর্শন ও শ্রবণ করিয়াছি, তৎসমুদয় আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তোমরা তপোবন হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলে অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র অগ্নিহোত্র, পুরোহিত এবং গান্ধারী, কুন্তী ও সঞ্জয়ের সহিত কুরুক্ষেত্র হইতে গঙ্গাদ্বারে সমুপস্থিত হইয়া বায়ুভক্ষণপূৰ্ব্বক কঠোর তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলেন। ঘোরতর তপস্যা করাতে অন্ধরাজের শরীর অস্থিচর্ম্মাবশিষ্ট হইল। মহর্ষিগণ তাঁহাকে যথোচিত সৎকার করিতে লাগিলেন। গান্ধারী কেবল জলমাত্র পান করিয়া এবং কুন্তী একমাসের পর একদিন ও সঞ্জয় পাঁচদিনের পর একদিন মাত্র ভোজন করিয়া কালহরণ করিতে লাগিলেন। যাজকেরাও বিধিপূৰ্ব্বক হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে আরম্ভ করিলেন।

নারদকর্ত্তৃক ধৃতরাষ্ট্রাদির তনুত্যাগ-কথন

“এইরূপে ছয় মাস অতীত হইলে অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র কাননাভিমুখে যাত্রা করিলেন। ঐ সময় মহাত্মা সঞ্জয় অন্ধরাজের এবং তোমার জননী কুন্তী গান্ধারীর চক্ষুস্বরূপ হইয়া তাঁহাদের সমভিব্যাহারে গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর একদা অন্ধরাজ গঙ্গাসলিলে অবগাহন করিয়া স্বীয় আশ্ৰমাভিমুখে আগমন করিতেছেন, এমন সময় দাবানল প্রচণ্ড বায়ুসহযোগে ভীষণরূপে প্রজ্বলিত হইয়া সমুদয় বন দগ্ধ করিতে লাগিল। মৃগযূথ ও সর্পসমুদয় সেই তীব্রদহনে দগ্ধদেহ হইয়া প্রাণত্যাগ করিতে আরম্ভ করিল এবং বরাহগণ নিতান্ত তাপিত হইয়া জলাশয়মধ্যে প্রবিষ্ট হইল। ঐ সময় অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও কুন্তী অনাহারনিবন্ধন নিতান্ত ক্ষীণ হইয়াছিলেন বলিয়া, কোনক্রমেই তথা হইতে পলায়নপূর্ব্বক সেই বিষম বিপদ হইতে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইলেন না। ক্রমে দাবানল তাঁহাদিগের সন্নিহিত হইল। তখন অন্ধরাজ সঞ্জয়কে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘সূতনন্দন! তুমি অবিলম্বে এ স্থান হইতে পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা কর; আমরা এই অনলেই জীবন পরিত্যাগ করিয়া, পরমগতি লাভ করিব।’

“অন্ধরাজ এই কথা কহিলে, মহাত্মা সঞ্জয় তাঁহার বাক্যশ্রবণে নিতাও উদ্বিগ্ন হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, মহারাজ! এই বৃথাগ্নিদ্বারা প্রাণত্যাগ করিলে আপনার সদ্গতিলাভের সম্ভাবনা নাই; আর এই অনল হইতে আপনার পরিত্রাণেরও কোন উপায় দেখিতেছি না। অতএব এক্ষণে কর্ত্তব্য কি, অবিলম্বে তাহা কীর্ত্তন করুন।’

“ওখন অন্ধরাজ পুনরায় তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘মহাত্মন্। যখন আমরা গৃহাশ্রম পরিত্যাগ করিয়াছি, তখন এই দাবানলে প্রাণত্যাগ করিলে কখনই আমাদিগের অসদগতি হইবে না। বিশেষতঃ জল, বায়ু বা অনলসহযোগে অথবা প্রায়োপবেশনে প্রাণত্যাগ করা তাপসগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। এক্ষণে তুমি অবিলম্বে এ স্থান হইতে পলায়ন কর।’ এই বলিয়া কৌরবনাথ গান্ধারী ও কুন্তীর সহিত পূর্ব্বাস্য হইয়া অনন্যমনে উপবেশন করিলেন। তখন সঞ্জয় তাঁহার সেই অবস্থা দর্শন করিয়া তাঁহাকে প্রদক্ষিণপুৰ্ব্বক আত্মসংযম করিতে কহিলেন। অন্ধরাজও সঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণ করিয়া অচিরাৎ গান্ধারী ও কুন্তীর সহিত আত্মসংযম করিলেন। ঐ সময় ইন্দ্রিয়রোধনিবন্ধন তাঁহাদিগের শরীর কাষ্ঠবৎ নিশ্চল হইয়া রহিল। অনন্তর তাঁহারা তিনজনেই সেই দাবানলে সমাপ্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন। মহাত্মা সঞ্জয় অতিকষ্টে সেই অনল হইতে আত্মরক্ষা করিয়া গঙ্গাকুলে মহর্ষিগণের নিকট আগমন ও সেই বৃত্তান্ত নির্দ্দেশপূৰ্ব্বক হিমালয়ে প্রস্থান করিলেন; ঐ সময় আমি সেই তাপসগণের নিকট উপবিষ্ট ছিলাম। সঞ্জয়ের মুখে সেই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিবামাত্র তোমাদিগকে উহা জ্ঞাপন করিবার নিমিত্ত তথা হইতে যাত্রা করিলাম। আগমনসময়ে অন্ধরাজ, গান্ধারী ও কুন্তীর কলেবর আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে। তাপসেরা সেই আশ্রমে সমুপস্থিত হইয়া অন্ধরাজের এবং কুন্তী ও গান্ধারীর পরলোকগমনের বিষয় শ্রবণপূৰ্ব্বক তাঁহাদের সদ্গতিলাভে শঙ্কা করিয়া কিছুমাত্র শোক করেন নাই। আমি তাঁহাদের মুখেও উঁহাদের মৃত্যুবৃত্তান্ত সবিশেষ অবগত হইয়াছি। যখন সেই কৌরবনাথ, গান্ধারী ও কুন্তী স্বেচ্ছাপূৰ্ব্বক অনলে প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, তখন তাঁহাদের নিমিত্ত শোক করা কদাপি বিধেয় নহে।”

দেবর্ষি নারদ এইরূপে ধৃতরাষ্ট্রাদির পরলোকগমনবৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিলে, মহাত্মা পাণ্ডবগণের শোকের আর পরিসীমা রহিল না। ঐ সময় অন্তঃপুরে ভয়ঙ্কর আর্ত্তনাদ হইতে লাগিল, পুরবাসিগণ হাহাকার করিতে আরম্ভ করিল এবং মহাত্মা যুধিষ্ঠির মাতাকে স্মরণপূৰ্ব্বক ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে উৰ্দ্ধবাহু হইয়া উচ্চৈঃস্বরে বারংবার আমাকে ধিক্! বলিয়া রোদন করিতে লাগিলেন।