২৬. যুধিষ্ঠির-ধৃতরাষ্ট্রের পরম্পর কুশলপ্রশ্নোত্তর

যুধিষ্ঠির-ধৃতরাষ্ট্রের পরম্পর কুশলপ্রশ্নোত্তর

বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর অন্ধরাজ একে একে সকলের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা করিয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তুমি ত’ ভ্রাতৃগণ ও পুরবাসীদিগের সহিত কুশলে অবস্থান করিতেছ? তোমার অনুজীবী, প্রজা, মন্ত্রী, ভৃত্য ও গুরুজনদিগের ত’ কোন অমঙ্গল হয় নাই; তাঁহারা ত’ নির্ভয়ে তোমার অধিকারমধ্যে বাস করিতেছেন? তুমি ত’ পূর্ব্বতন ভূপতিদিগের পদ্ধতি আশ্রয় করিয়াছ? অন্যায়লব্ধ ধনদ্বারা ত’ তোমার কোষ পরিপূরিত হয় নাই? তুমি ত’ কি শত্রু, কি মিত্র, কি উদাসীন সকলের সহিত সমান ব্যবহার করিয়া থাক? ব্রাহ্মণগণ ত’ তোমার নিকট যথাবিধি দানগ্রহণ করিয়া পরিতুষ্ট হয়েন? কি শত্ৰু, কি পৌরবর্গ, কি ভৃত্য, কি আত্মীয়স্বজন, সকলেই ত’ তোমার চরিত্রদর্শনে প্রীত হইয়া থাকে? তুমি ত’ শ্রদ্ধান্বিত হইয়া সৰ্ব্বদা পিতৃলোক, দেবতা ও অতিথিদিগের অর্চ্চনা করিয়া থাক? তোমার অধিকারস্থ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণ ত’ স্ব স্ব ধৰ্ম্মে নিরত রহিয়াছেন? তোমার রাজ্যে বালক, বৃদ্ধ ও বনিতাগণকে ত’ অর্থের নিমিত্ত লালায়িত ও শোকাকুল হইতে হয় না? তোমার গৃহে কুলস্ত্রীগণ ত’ যথোচিত সৎকৃত হইয়া থাকেন? আর তোমার রাজাধিকারলাভ হওয়াতে আমাদের নিষ্কলঙ্ক রাজবংশের ত যশোহানি হয় নাই?”

নীতিবিশারদ অন্ধরাজ এই কথা কহিলে, বাক্যবিশারদ ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আপনার প্রসাদে আমার সমুদয় বিষয়েই মঙ্গললাভ হইয়াছে। এক্ষণে আপনার তপস্যা ও শমদমাদিগুণ ত’ পরিবর্দ্ধিত হইতেছে? আমার জননী কুন্তী ত’ আপনার শুশ্রূষার অনুরক্ত হইয়া বনবাসক্লেশ সফল করিতে পারিবেন? শীতবাতবিশীর্ণা তপঃপরায়ণা জননী গান্ধারী ত’ পুত্রশোকে কাতর হইয়া আমাদিগকে অপরাধী জ্ঞান করেন না? মহাত্মা সঞ্জয় ত’ কুশলে তপানুষ্ঠান করিতেছেন? এক্ষণে মহাত্মা বিদুর কোথায়? তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আমাদের নিতান্ত ঔৎসুক্য হইতেছে।”

ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে, অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তোমার পিতৃব্য অগাধবুদ্ধি বিদুর অনাহারে অস্থিচর্ম্মাবশিষ্ট হইয়া ঘোরতর তপানুষ্ঠান করিতেছেন। ব্রাহ্মণগণ কখন কখন তাঁহাকে এই কাননের অতি নির্জ্জনপ্রদেশে দর্শন করিয়া থাকেন।”

বিদুরের সূক্ষ্মদেহ যুধিষ্ঠিরদেহে প্রবেশ

অন্ধরাজ এই কথা কহিতেছেন, এমন সময়ে মলদিগ্ধাঙ্গ [গাত্রে ধূলামাখা] জটাধারী দিগম্বর মহাত্মা বিদুর সেই আশ্রমের অনতিদূরে লক্ষিত হইলেন। ঐ মহাত্মা একবার আশ্রম দর্শন করিয়াই সহসা প্রস্থান করিলেন। ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির সেই ব্যাপার দর্শন করিবামাত্র সত্বর একাকীই তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। তখন মহাত্মা বিদুর ক্রমে ক্রমে নিবিড় অরণ্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। ধৰ্ম্মরাজ তদ্দর্শনে ‘হে মহাত্মন্! আমি আপনার প্রিয় যুধিষ্ঠির; আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আগমন করিয়াছি’ বলিয়া মহাবেগে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন।

অনন্তর অগাধবুদ্ধি মহাত্মা বিদুর সেই বিজন বিপিনে এক বৃক্ষ অবলম্বন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই অস্থিচর্ম্মাবশিষ্ট মহাত্মা ক্ষত্তার নিকট সমুপস্থিত হইয়া, ‘মহাশয়! আমি আপনার প্রিয়তম যুধিষ্ঠির, আপনার সহিত সাক্ষাৎকার করিতে আগমন করিয়াছি’ বলিয়া তাঁহার অগ্রে দণ্ডায়মান হইলেন।

মহাত্মা বিদুর ধৰ্ম্মরাজকে সেই নির্জ্জন প্রদেশে দণ্ডায়মান দেখিয়া যোগবলে তাঁহার দৃষ্টিতে দৃষ্টি, গাত্রে গাত্র, প্রাণে প্রাণ ও ইন্দ্রিয়ে ইন্দ্রিয়সমুদয় সংযোজিত করিয়া তাঁহার দেহমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন তাঁহার শরীর স্তব্ধলোচন [স্থিরনেত্র—স্পন্দনাদি-রহিত চক্ষু] ও বিচেতন হইয়া সেই বৃক্ষ অবলম্বন করিয়াই রহিল। ঐ সময়ে ধৰ্ম্মরাজ আপনাকে পূৰ্ব্বাপেক্ষা সমধিক বলশালী বোধ করিতে লাগিলেন। তখন বেদব্যাসকথিত স্বীয় পুরাতন বৃত্তান্তসমুদয় তাঁহার স্মৃতিপথে আরূঢ় হইল।

যুধিষ্ঠিরের প্রতি বিদুর বিষয়ক দৈববাণী

অনন্তর তিনি বিদুরের দেহ দগ্ধ করিতে উদ্যত হইলে এই দৈববাণী তাঁহার কর্ণগোচর হইল, “মহারাজ! মহাত্মা বিদুর যতিধৰ্ম্ম লাভ করিয়াছেন; অতএব আপনি উহার দেহ দগ্ধ করিবেন না। ইনি সান্তানিকনামক লোকসমুদয় লাভ করিতে পারিবেন। উহার নিমিত্ত শোক করা আপনার কদাপি বিধেয় নহে।”

ধৰ্ম্মরাজ এইরূপ দৈববাণী শ্রবণ করিয়া বিদুরের দেহ দগ্ধ করিবার অভিলাষ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অন্ধরাজের আশ্রমে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া তাঁহার নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিলেন। তখন সেই আশ্চর্য্য ব্যাপার শ্রবণে ভীমসেন প্রভৃতি পাণ্ডবগণ ও অন্যান্য লোকসমুদয়ের বিস্ময়ের পরিসীমা রহিল না। অন্ধরাজ সেই অদ্ভুত বৃত্তান্ত অবগত হইয়া ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তুমি আমার প্রদত্ত জল ও ফলমূল গ্রহণ কর। মনুষ্য যখন যে অবস্থায় অবস্থান করে, তখন তাহাকে সেই অবস্থানরূপ অতিথিসৎকার করিতে হয়।”

অন্ধরাজ এই কথা কহিলে, ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির তাঁহার বাক্যে অঙ্গীকার করিয়া ভ্রাতৃগণ ও অন্যান্য অনুযাত্রিকদিগের সহিত তাঁহার প্রদত্ত ফলমূল ভোজন ও জলপানপূৰ্ব্বক সে রাত্রি বৃক্ষমূলে অতিবাহিত করিলেন। ঐ রজনীতে আশ্রমবাসীদিগের সহিত পাণ্ডবগণের শাস্ত্রবিষয়ক বিবিধ কথোপকথন হইয়াছিল। তাঁহারা মহামূল্য শয্যা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জননীর চতুর্দ্দিকে ধরাশয্যায় শয়ন এবং ধৃতরাষ্ট্রের ন্যায় ফলমূলাদিদ্বারা আহারকাৰ্য্য সম্পাদন করিয়াছিলেন।