১৭. বিলাপকারী পুত্রাদির প্রতি কুন্তীর সান্ত্বনা

বিলাপকারী পুত্রাদির প্রতি কুন্তীর সান্ত্বনা

বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর পাণ্ডবজননী কুন্তী অশ্রুবেগ সংবরণ করিয়া, পুত্রগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎসগণ! পুর্ব্বে তোমরা জ্ঞাতিগণকর্ত্তৃক কপটদ্যূতে পরাজিত হইয়া নিতান্ত দুঃখিত ও অবসন্ন হইয়াছিলে, এই নিমিত্ত আমি তোমাদিগকে যুদ্ধ করিতে উৎসাহিত করিয়াছিলাম। তোমরা মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্র, সুতরাং তোমাদিগের নাশ বা যশোহানি হওয়া নিতান্ত অনুচিত। তোমরা ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী, সুতরাং তোমাদিগের শত্রুর বশীভূত হওয়া কখনই উচিত নহে।

“তোমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠির ভূপতিদিগের অগ্রগণ্য ও ইন্দ্রতুল্য প্রভাবসম্পন্ন। অতএব উহার চিরকাল বনে অবস্থান করা নিতান্ত অনুচিত। অযুত নাগের তুল্য পরাক্রমশালী, পৌরুষান্বিত ভীমসেনের ও বাসবসদৃশ বিক্রমশালী ধনঞ্জয়ের অবসন্নভাবে কালহরণ করা কদাপি বিধেয় নহে। বালক নকুল ও সহদেবের ক্ষুধায় কাতর হওয়া এবং সভামধ্যে এই দ্রুপদান্দিনী কৃষ্ণার ক্লেশ সহ্য করা নিতান্ত অন্যায্য। আমি সমুদয় বিবেচনা করিয়াই তোমাদিগকে সংগ্রামে প্রোৎসাহিত করিয়াছিলাম। পূৰ্ব্বে যখন পাঞ্চালী দ্যূতে পরাজিত হইয়া সভামধ্যে তোমাদিগের সমক্ষেই কদলীর ন্যায় কম্পিত হইয়াছিলেন, যখন দুরাত্মা দুঃশাসন অজ্ঞানবশতঃ দাসীর ন্যায় ইঁহার কেশাকৰ্ষণ করিয়াছিল, তখনই আমি বুঝিয়াছিলাম যে, এই কুরুকুল এককালে দগ্ধ হইবে। পাপাত্মা দুঃশাসন এই পাঞ্চালীর কেশাকৰ্ষণ করিলে, যখন ইনি বারংবার সাহায্য প্রার্থনা করিয়া কুররীর ন্যায় রোদন করিয়াছিলেন, তখন আমার চৈতন্য একেবারে বিলুপ্ত হইয়াছিল। আমি এই নিমিত্তই তোমাদিগের তেজোবর্দ্ধনমানসে বাসুদেবের নিকট বিদুলা-সঞ্জয়সংবাদ কীৰ্ত্তন করিয়া তোমাদিগকে উৎসাহ প্রদান করিয়াছিলাম।

“তোমাদিগের বিনাশনিবন্ধন এই রাজবংশের ক্ষয় হওয়া উচিত নহে। যে ব্যক্তি বংশনাশের হেতুভূত হয়, তাহার পুত্রপৌত্রগণও শুভলোকলাভে বঞ্চিত হইয়া থাকে। আমি ভর্ত্তার রাজত্বসময়ে অশেষ সুখভোগ, বিবিধ মহাদান ও যথাবিধি সোমরস পান করিয়াছি। আমি যে বাসুদেবের নিকট বিদুলার বাক্য কীৰ্ত্তন করিয়া তোমাদিগকে উৎসাহিত করিয়াছিলাম, তাহা আমার আপনার সুখসাধনের নিমিত্ত নহে; কেবল তোমাদিগের হিতসাধনের নিমিত্তই আমি ঐ কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলাম। এক্ষণে রাজ্যভোগের বাসনা পরিহারপূর্ব্বক তপস্যাদ্বারা মহাত্মা পাণ্ডুর পবিত্রলোক লাভ করিতেই আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে। পুত্রনির্জ্জিত রাজ্যভোগে আমার কিছুমাত্র অভিলাষ নাই। অতএব আমি বনবাসী অন্ধরাজ ও তাঁহার মহিষীর শুশ্রূষা করিয়া তপস্যাদ্বারা এই কলেবর শুষ্ক করিব। তোমরা রাজধানীতে প্রতিগমন করিয়া পরমসুখে রাজ্যসম্ভোগ কর। তোমাদিগের ধৰ্ম্মবুদ্ধি পরিবর্দ্ধিত ও মন প্রশস্ত হউক।”