০৭. যুদ্ধাদি রাজনীতি

যুদ্ধাদি রাজনীতি

ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “সন্ধিবিগ্রহের বিষয় বিশেষরূপে অবগত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। প্রবল প্রতিযোগীর সহিত সন্ধিস্থাপন ও দুর্ব্বল প্রতিযোগীর সহিত যুদ্ধ করিতে হয়। স্থিরচিত্তে আপনার বলাবল বিচার করিয়া পরিশেষে যুদ্ধযাত্রা করা কর্ত্তব্য। যদি শত্রু পরাক্রান্ত এবং তাহার সৈন্যসমুদয় বলবান্ ও সন্তুষ্টচিত্ত হয়, তাহা হইলে বুদ্ধিমান নরপতি তাহাকে আক্রমণ না করিয়া তাহার পরাজয়ের উপায় চিন্তা করিবেন। কিন্তু শত্রু যদি দুর্ব্বল হয়, তাহা হইলে তিনি অচিরাৎ তাহার অভিমুখীন হইয়া তাহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবেন। যাহাতে শত্রুগণ বিপন্ন, ভেদযুক্ত, নিপীড়িত ও ভীত হয়, সতত তাহার উপায় চিন্তা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। শাস্ত্রবিশারদ ভূপতি আপনার ও শক্তবর্গের উৎসাহ, প্রভূত্ব ও মন্ত্রণা, এই ত্রিবিধ শক্তি পর্য্যালোচনা করিয়া যদি আপনাকে অরাতিগণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া অবগত হইতে পারেন, তাহা হইলে যুদ্ধযাত্ৰা করিবেন। যুদ্ধযাত্রাকালে সৈন্যবল, ধনবল, মিত্রবল, ভৃত্যবল ও শ্রেণীবল [সাধারণ লোকবল] সংগ্রহ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। মিত্রবল অপেক্ষা ধনবল শ্রেষ্ঠ, আর শ্রেণীবল, ভৃত্যবল ও আচারবল এ তিন বলই পরস্পর সমান।

“রাজাদিগকে সময়ে সময়ে নানাপ্রকার বিপদে নিপতিত হইতে হয়। ঐ সকল বিপদ উপেক্ষা না করিয়া সামাদি উপায়দ্বারা ঐ সমুদয় হইতে মুক্তিলাভের চেষ্টা করাই তাঁহাদিগের অবশ্য কৰ্ত্তব্য। বুদ্ধিমান ভূপতি দেশ, কাল এবং আপনার গুণ ও বল সম্যক্‌রূপে বিচার করিয়া সৈন্যসংগ্রহপূর্ব্বক যুদ্ধযাত্রা করিবেন। যে রাজা স্বয়ং উন্নতিশালী ও পরাক্রান্ত এবং যাঁহারা সৈন্যসমুদয় হৃষ্টপুষ্ট, তিনি অকালেও যুদ্ধযাত্রা করিতে পারেন। পরাক্রান্ত ভূপতি শত্ৰুদিগকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত সংগ্রামস্থলে অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ, ধ্বজ, পদাতি ও শরপূর্ণ তূণীরসম্পন্ন বীরগণকে সন্নিবেশিত করিয়া যুক্তিসহকারে শুক্রাচার্য্যের বিহিত নীতিশাস্ত্রানুরূপ শকট, বজ্র বা পদ্মব্যূহ নির্ম্মাণপূৰ্ব্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবেন। আপনার অধিকারমধ্যেই হউক বা অন্যের অধিকার মধ্যেই হউক, যুদ্ধ উপস্থিত হইলে নরপতি চরদ্বারা শত্ৰুদিগেরও স্বয়ং আপনার সৈন্য পরীক্ষা করিয়া পরিশেষে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইবেন। সৈন্যদিগকে সন্তুষ্ট করিয়া বলবান ব্যক্তিদিগকে সংগ্রামমুখে প্রেরণ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। অগ্রে আপনার বলাবল পরিজ্ঞাত হইয়া পশ্চাৎ সন্ধি সংস্থাপন বা যুদ্ধযাত্রা করাই শ্রেয়। যেকোনরূপে হউক, আপনার প্রাণরক্ষা ও উভয় লোকের মঙ্গলচিন্তা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য।

“যে ভূপতি এই সমুদয় নিয়মের অনুবর্ত্তী হইয়া ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করেন, তিনি পরলোকে স্বর্গলাভ করিতে সমর্থ হয়েন। এক্ষণে তুমি আমার বাক্যানুসারে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া ধর্ম্মানুসারে প্রজাগণের হিতসাধন কর; নিশ্চয়ই ইহলোকে পরমসুখ ও পরলোকে স্বর্গলাভ করিতে পারিবে। পূর্ব্বে মহাত্মা ভীষ্ম, বিদুর ও বাসুদেব তোমাকে এইরূপ ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিয়াছিলেন, এক্ষণে আমিও প্রীতিপূৰ্ব্বক তোমার নিকট ইহা কীর্ত্তন করিলাম। সহস্র অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলে ভূপতির যেরূপ ফললাভ হয়, ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিলেই তাঁহার সেইরূপ ফললাভ হইয়া থাকে।”