০৩. ভীমের ব্যবহারে ধৃতরাষ্ট্রের আন্তরিক শোক

ভীমের ব্যবহারে ধৃতরাষ্ট্রের আন্তরিক শোক

বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! ঐ সময় রাজা যুধিষ্ঠির ও দুর্য্যোধনপিতা ধৃতরাষ্ট্র এই উভয়ের প্রণয়ের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য দৃষ্ট হয় নাই। ধর্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মতনয় ও তাঁহার অন্যান্য ভ্রাতৃগণ সতত সাবধানে অন্ধরাজের পরিচর্য্যা করিতেন। কেবল মহাবীর বৃকোদরই তাঁহার প্রতি বিরক্ত ছিলেন। কৌরবপতি ধৃতরাষ্ট্র যখন স্বীয় পুত্র দুৰ্য্যোধনকে স্মরণ করিতেন, তখনই তিনি মনোমধ্যে বৃকোদরকে চিন্তা করিয়া যারপরনাই কষ্ট পাইতেন। মহাবীর বৃকোদরও ধৃতরাষ্ট্রের নামগন্ধ হইলেই ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিতেন। তিনি গোপনে গোপনে অন্ধরাজের অপ্রিয়কাৰ্য্য সাধন এবং কপট পুরুষদ্বারা তাঁহার আজ্ঞা লঙ্ঘন করিতেন। ধৃতরাষ্ট্রের দুৰ্ম্মন্ত্রণা ও দুর্ব্ব্যবহারনিবন্ধন যে তাঁহাকে অশেষ ক্লেশ ভোগ করিতে হইয়াছিল, তাহা তিনি কোনক্রমেই বিস্মৃত হইতে পারেন নাই।

এইরূপে পঞ্চদশবর্ষ অতীত হইলে একদা মহাবাহু ভীমসেন দুৰ্য্যোধন, দুঃশাসন ও কর্ণকে স্মরণপূৰ্ব্বক ক্রোধভরে ধৃতরাষ্ট্র ও গান্ধারীর অনতিদূরে যুধিষ্ঠির, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব, কুন্তী ও দ্রৌপদীর অজ্ঞাতসারে অন্যান্য বন্ধুবান্ধবগণের সমক্ষে বাহ্বাস্ফোট [আস্পর্ধা] করিতে করিতে কহিলেন, “হে বন্ধুগণ! আমি এই পরিঘাকার বাহুযুগলপ্রভাবে নানাশাস্ত্ৰপারদর্শী ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণকে নিহত করিয়াছি। আমার এই চন্দনচর্চ্চিত বাহুদ্বয়প্রভাবেই দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন পুত্র ও বান্ধবগণের সহিত শমনসদনে গমন করিয়াছে।”

মহাবীর ভীমসেন এইরূপ বিবিধ পরুষবাক্য প্রয়োগ করিলে বুদ্ধিমতী গান্ধারী সকল কাৰ্য্যই কালপ্রভাবে হইয়া থাকে, বিবেচনা করিয়া কিছুমাত্র দুঃখিত হইলেন না; কৌরবপতি ধৃতরাষ্ট্র ভীমের সেই ভীষণ বাক্যবাণে নিতান্ত ব্যথিত ও নির্ব্বেদযুক্ত হইলেন। তখন তিনি অবিলম্বে স্বীয় সুহৃদগণকে আহ্বানপূৰ্ব্বক বাষ্পকুলনয়নে তাঁহাদিগকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে বান্ধবগণ! যেরূপে কুরুবংশ ধ্বংস হইয়াছে, তাহা তোমাদিগের অবিদিত নাই। আমিই ঐ ঘোরতর অনর্থের মূল। কৌরবগণ আমার পরামর্শানুসারেই সংগ্রামে সম্মত হইয়াছিল। আমি যে জ্ঞাতিগণভয়াবহ দুৰ্ম্মতি দুৰ্য্যোধনকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়াছিলাম, মহাত্মা বাসুদেব ঐ দুরাত্মাকে উহার অমাত্যগণের সহিত নিহত করিতে উপদেশ প্রদান করিলে যে তাঁহার বাক্যে কর্ণপাত করি নাই—বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য্য, ভগবান বেদব্যাস, সঞ্জয় ও গান্ধারী আমাকে বারংবার হিতোপদেশ প্রদান করিলেও যে আমি পুত্রস্নেহে একান্ত অভিভূত হইয়া তাঁহাদের বাক্যে সম্মত হই নাই এবং মহামতি বাসুদেবের পরামর্শানুসারে যে গুণশালী মহাত্মা পাণ্ডুতনয়দিগকে তাহাদের পিতৃপরম্পরাগত রাজ্য প্রদান করি নাই, সেই সমুদয় এক্ষণে সহস্র সহস্র শল্যস্বরূপ হইয়া আমার হৃদয়ে বিদ্ধ হইতেছে।

“এক্ষণে পঞ্চদশ বৎসর পরিপূর্ণ হইবার পর অবধি আমি আপনার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। এখন আমি কোনদিন দিবার চতুর্থভাগে, কোনদিন বা অষ্টমভাগে ক্ষুধানিবারণাৰ্থ যৎকিঞ্চিত্র আহার করিয়া থাকি। গান্ধারী ভিন্ন আর কেহই উহা অবগত নহে। আমার এইরূপ নিয়ম যুধিষ্ঠিরের কর্ণগোচর হইলে তিনি অত্যন্ত অনুতাপ করিবেন বলিয়া আমি কাহারও নিকট উহা প্রকাশ করি না। প্রতিদিন অজিন ধারণপূর্ব্বক ভূতলে কুশোপরি শয়ান হইয়া এইরূপ জপানুষ্ঠান করিয়া থাকি। যশস্বিনী গান্ধারীও নিয়মানুষ্ঠান করিয়া থাকেন। আমার সমরবিশারদ শতপুত্র যুদ্ধে নিহত হইয়াছে বলিয়া আমি কিছুমাত্র দুঃখিত নহি কারণ, তাহারা ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে সংগ্রামে নিহত হইয়া অনায়াসে স্বর্গলোকে গমন করিয়াছে।”

যুধিষ্ঠির-সমীপে ধৃতরাষ্ট্রের স্বীয় দুঃখজ্ঞাপন

মহামতি ধৃতরাষ্ট্র বান্ধবগণকে এই কথা কহিয়া যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস কুন্তীনন্দন। তোমার মঙ্গললাভ হউক। আমি তোমাকর্ত্তৃক প্রতিপালিত হইয়া পরমসুখে অবস্থানপূর্ব্বক বারংবার প্রভূত মহামূল্য বস্তুসমুদয় দান ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করিয়া প্রচুর পরিমাণে পুণ্যসঞ্চয় করিয়াছি। পুত্রবিহীন গান্ধারী ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক আমার পরিচর্য্যা করিয়াছেন; যেসকল দুরাত্মা তোমার ঐশ্বৰ্য্য অপহরণ ও দ্রৌপদীর কেশাম্বর কর্ষণ [কেশ ও বসন] করিয়াছিল, তাহারা ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে সকলেই সময়ে নিহত হইয়া স্বর্গলোকে গমন করিয়াছে। অতএব তাহাদিগের উদ্ধারার্থ আমার কোন চেষ্টা করিবার প্রয়োজন নাই। এক্ষণে কেবল আমার, আপনার ও গান্ধারীর পক্ষে যাহা শ্রেয়ঃ, তাহারই চেষ্টা করা কর্ত্তব্য। তুমি ধার্ম্মিকদিগের অগ্রগণ্য, রাজা ও জীবগণের পরমগুরু, এই নিমিত্তই আমি তোমাকে কহিতেছি যে, তুমি আমাকে গান্ধারীর সহিত বনগমন করিতে অনুমতি কর। আমি সুবলনন্দিনীর সহিত বল্কলপরিধানপূর্ব্বক অরণ্যে অবস্থান করিয়া তোমায় আশীর্ব্বাদ করিব। শেষাবস্থায় পুত্রের প্রতি রাজ্যভার সমর্পণ করিয়া বনে গমন করাই আমাদিগের কুলোচিত কার্য্য। আমি তথায় বায়ুভক্ষণপূর্ব্বক অবস্থান করিয়া পত্নীর সহিত অতি উৎকৃষ্ট তপানুষ্ঠান করিব। তাহা হইলে তুমিও সেই তপস্যার ফলভাগী হইবে। কারণ, রাজ্যমধ্যে যেসমুদয় শুভ ও অশুভ কার্য্যের অনুষ্ঠান হয়, রাজা অবশ্যই তাহার ফলভাগী হইয়া থাকেন।”

যুধিষ্ঠিরের ধৃতরাষ্ট্র-সান্ত্বনা

মহামতি ধৃতরাষ্ট্র এই কথা কহিলে, ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির নিতান্ত বিষণ্নচিত্তে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “তাত! আপনি দুঃখিতচিত্তে কালহরণ করিলে, রাজ্য আমার কখনই প্রীতিকর হইবে না। হায়! আপনি এতদিন আহার পরিত্যাগ ও ভূতলে শয়ন করিয়া কালাতিপাত করিতেছেন, ইহা আমি বা আমার ভ্রাতৃগণ কেহই জানিতে পারি নাই। আমাকে ধিক! আমার তুল্য দুর্ব্বুদ্ধি রাজ্যলুব্ধ নরাধম আর কেহই নাই। আপনি স্বচ্ছন্দে আহারাদি করিতেছেন বলিয়া আমার বিলক্ষণ বিশ্বাস ছিল, কিন্তু আপনি তাহা না করিয়া গোপনে গোপনে আমায় বঞ্চনা করিয়া অনাহারে কালাতিপাত করিয়াছেন। আপনি দুঃখভোগ করিলে, আমার রাজ্য, ভোগ্যবস্তু, যজ্ঞ ও সুখে প্রয়োজন কি? এক্ষণে আপনার মুখে নিদারুণ বাক্য শ্রবণ করিয়া আমার রাজ্য ও আত্মাকে নিতান্ত ক্লেশকর জ্ঞান হইতেছে। আপনি আমাদিগের পিতা, মাতা ও পরমগুরু। অতএব আপনি আমাদিগকে পরিত্যাগ করিলে আমরা কোথায় অবস্থান করিব? এক্ষণে আপনি আপনার ঔরসপুত্র যুযুৎসুকে অথবা অন্য কোন ব্যক্তিকে যুবরাজ করিয়া স্বয়ং রাজ্যভোগ করুন। আমি অরণ্যে গমন করি। আমি জ্ঞাতিবধজনিত অকীৰ্ত্তিতে বিলক্ষণ দগ্ধ হইয়াছি, এক্ষণে আপনি বনগমনপূর্ব্বক আমাকে পুনরায় দগ্ধ করিবেন না। এই রাজ্যে আমার কিছুমাত্র অধিকার নাই। আপনি রাজ্যেশ্বর, আমি আপনার অধীন; অতএব আমি কিরূপে আপনাকে অনুমতি প্রদান করিব?

“আমরা দুর্য্যোধনের অত্যাচার স্মরণ করিয়া কিছুমাত্র ক্রুদ্ধ হই নাই। অবশ্যম্ভাবী ভবিতব্যপ্রভাবেই আমাদিগকে তৎকালে মোহের বশীভূত হইয়া ক্লেশভোগ করিতে হইয়াছে। দুর্য্যোধনাদি যেমন আপনার পুত্র ছিল, আপনি আমাদিগকেও সেইরূপ জ্ঞান করিবেন। জননী কুন্তী ও গান্ধারীতে আমার কিছুমাত্র ভেদজ্ঞান নাই। অতএব যদি আপনি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া বনে গমন করেন, তাহা হইলে আমি নিশ্চয়ই আপনার অনুগামী হইব। আপনি বনে গমন করিলে, এই নানারত্নবিভূষিতা সসাগরা পৃথিবী কখনই আমার প্রীতিকর হইবে না। অতএব আমি আপনাকে প্রণিপাত করিয়া কহিতেছি, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। এই রাজ্যস্থ সমুদয় পদার্থে আপনার সম্পূর্ণ অধিকার আছে এবং আমরাও আপনার একান্ত বশবর্ত্তী। অতএব আপনি আমাদিগের প্রতি প্রসন্ন হইয়া বিষাদ পরিত্যাগ করুন। আমি আপনার শুশ্রূষা করিয়া মনের সন্তাপ নিবারণ করিব।”

বানপ্রস্থধর্ম্মে ধৃতরাষ্ট্রের বাসনা

ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! এক্ষণে তপস্যা করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। বৃদ্ধাবস্থায় অরণ্যবাস আশ্রয় করা আমাদিগের কুলোচিত ধৰ্ম্ম। আমি বহুদিন রাজ্যমধ্যে বাস করিয়াছি এবং তুমিও আমার যথোচিত শুশ্রূষা করিয়াছ। এক্ষণে আমাকে অরণ্যগমনে আদেশ কর।”

মহামতি ধৃতরাষ্ট্র ধর্ম্মরাজকে এই কথা কহিয়া মহাত্মা সঞ্জয় ও মহারথ কৃপাচাৰ্য্যকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে বীরদ্বয়! এক্ষণে তোমরা আমার প্রতিনিধিস্বরূপ হইয়া ধৰ্ম্মরাজকে সান্ত্বনা কর। আমি স্বয়ং আর বাক্য চালনা করিতে পারি না। বার্দ্ধক্য ও বহুক্ষণ বাক্যব্যয়নিবন্ধন আমার মন অবসন্ন ও মুখ পরিশুষ্ক হইয়া গিয়াছে।” অন্ধরাজ এই বলিয়া গান্ধারীকে অবলম্বনপুৰ্ব্বক সহসা মৃতব্যক্তির ন্যায় সংজ্ঞাশূন্য হইলেন।

ধৃতরাষ্ট্রের বৈরাগ্য—বনবাসে অভিলাষ

তখন ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠতাতকে অকস্মাৎ মৃতকল্প দেখিয়া নিতান্ত ব্যথিতচিত্তে আক্ষেপ করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হায়! যে মহাত্মা এক লক্ষ হস্তীর বল ধারণ করিতেন, যাঁহার বাহুবলে ভীমের লৌহময় প্রতিমূর্ত্তি চুর্ণ হইয়া গিয়াছিল, আজ তিনি অবলাকে ধারণপূৰ্ব্বক মৃতকল্প হইয়া শয়ন করিলেন। আমার তুল্য অধার্ম্মিক ও নরাধম আর কেহই নাই। আমাকে ও আমার শাস্ত্রজ্ঞানে ধিক! আজ আমার নিমিত্তই ইঁহাকে এতদূর যন্ত্রণাভোগ করিতে হইয়াছে। আজ যদি ইনি এবং জননী গান্ধারী ভোজন না করেন, তাহা হইলে আমিও অনাহারে কালহরণ করিব।” এই বলিয়া ধর্ম্মরাজ সলিলসিক্ত হস্তদ্বারা অল্পে অল্পে তাঁহার মুখ ও বক্ষঃস্থল মার্জ্জিত করিতে লাগিলেন।

অনন্তর অন্ধরাজ যুধিষ্ঠিরের সেই রস ও ওষধিযুক্ত সুগন্ধময় পবিত্র করস্পর্শদ্বারা ক্রমে ক্রমে সংজ্ঞালাভ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “বৎস! তুমি পুনৰ্ব্বার হস্তদ্বারা আমার অঙ্গস্পর্শ ও আমাকে আলিঙ্গন কর। তোমার করস্পর্শদ্বারা আমার জীবনলাভ হইল। আমি তোমার মস্তকাঘ্রাণ ও তোমাকে আলিঙ্গন করিতে নিতান্ত বাসনা করিতেছি। আজ আমি দিবসের অষ্টমভাগে ভোজন করিব স্থির করিয়াছিলাম, এক্ষণে সেই সময় উপস্থিত হওয়াতে ও তোমাকে বহুক্ষণ বিবিধ বাক্যে সান্ত্বনা, করাতে আমার শরীর ও মন নিতান্ত অবসন্ন হইয়াছে। এই নিমিত্তই আমার সংজ্ঞা বিলুপ্ত হইয়াছিল। এক্ষণে তোমার অমৃতরসাভিষিক্ত করস্পর্শদ্বারাই আমার চৈতন্যলাভ হইয়াছে।”

অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র এই কথা কহিলে, ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির সৌহার্দ্দ্যনিবন্ধন করদ্বারা তাঁহার সৰ্ব্বগাত্র স্পর্শ করিতে লাগিলেন। তখন অন্ধরাজ কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া তাঁহাকে আলিঙ্গন ও তাঁহার মস্তকাঘ্রাণ করিলেন। বিদুর প্রভৃতি মহাত্মারা নিতান্ত দুঃখিত হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। উঁহারা নিতান্ত শোকাবেগনিবন্ধন যুধিষ্ঠিরকে কোন কথাই কহিতে পারিলেন না। তখন পতিপরায়ণা গান্ধারী অতিকষ্টে শোকাবেগ সংবরণপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন এবং সমুদয় কৌরবরমণী কুন্তীর সহিত সমবেত হইয়া বাষ্পকুললোচনে ধৃতরাষ্ট্রের চতুর্দ্দিক পরিবেষ্টন করিয়া রহিলেন।

বনবাস-সঙ্কল্পত্যাগে যুধিষ্ঠিরের অনুরোধ

অনন্তর অন্ধরাজ পুনৰ্ব্বার যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! তপস্যা করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইয়াছে, এই নিমিত্ত আমি ভুয়োভুয়ঃ তোমার নিকট বনগমনের অনুমতি প্রার্থনা করিতেছি। বারংবার বাক্যব্যয় করিলে আমার মন নিতান্ত অবসন্ন হয়; অতএব আর তুমি আমাকে কষ্ট প্রদান করিও না।”

মহামতি ধৃতরাষ্ট্র এই কথা কহিলে তত্ৰত্য যোধগণ তাঁহাকে বিবর্ণ, উপবাস-পরিশ্রান্ত ও অস্থিচর্ম্মাবশিষ্ট অবলোকন করিয়া সকলেই হাহাকার করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা যুধিষ্ঠির তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া শোক সংবরণপুৰ্ব্বক পুনরায় কহিলেন, “পিতঃ! আমি আপনার প্রিয়কাৰ্য্য সাধন করিতে যেরূপ উল্লসিত হই, রাজ্যভোগ ও জীবনরক্ষা করিতে সেরূপ সন্তুষ্ট হই না। অতএব যদি আমার প্রতি আপনার অনুগ্রহ থাকে ও আপনি আমাকে প্রিয় জ্ঞান করেন, তাহা হইলে এক্ষণে ভোজনক্রিয়া সম্পাদন করুন। পরে আমি আপনার বনগমনবিষয়ে বিবেচনা করিব।” ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে ধৃতরাষ্ট্র তাঁহার বাক্যে সম্মত হইয়া তাহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! আজ আমি তোমার অনুরোধে অবশ্যই পুরমধ্যে ভোজন করিব।”