৮. আশ্রমাগত অর্জ্জুনের প্রতি ব্যাসের স্বাগত প্রশ্ন

আশ্রমাগত অর্জ্জুনের প্রতি ব্যাসের স্বাগত প্রশ্ন

বৈশম্পায়ন বলিলেন, এইরূপে সমুদয় কার্য্য সম্পাদন করিয়া মহাত্মা ধনঞ্জয় বেদব্যাসের আশ্রমে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, মহর্ষি ধ্যানে নিমগ্ন রহিয়াছেন। তখন তিনি তাঁহার নিকট গমন করিয়া ‘মহর্ষে! আমি অর্জ্জুন, আপনার নিকট আগমন করিয়াছি’ বলিয়া আত্মপরিচয় প্রদান করিলেন। মহর্ষি পাণ্ডুনন্দনকে অবলোকনপূর্ব্বক স্বাগত প্রশ্ন ও আসনপরিগ্রহ করিতে আদেশ করিয়া তাঁহাকে একান্ত দুঃখিত ও দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে দেখিয়া কহিলেন, “বৎস! কেহ কি তোমার গাত্রে নখ, কেশ, বস্ত্রাঞ্চল2 বা কুম্ভমূখস্থিত সলিল প্রক্ষেপ করিয়াছে? তুমি কি রজঃস্বলাগমন বা ব্রহ্মহত্যা করিয়াছ? যুদ্ধে কি কেহ তোমাকে পরাজয় করিয়াছে? আজ তোমাকে এমন শ্রীবিহীন দেখিতেছি কেন? তুমি ত’ কাহারও নিকট কখনও পরাজিত হও নাই। যাহা হউক, যদি প্রকাশ করিবার কোন বাধা না থাকে, তাহা হইলে কি নিমিত্ত আজ তোমার এরূপ শ্রীভ্রংশ হইয়াছে, তাহা অবিলম্বে কীৰ্ত্তন কর।”

অর্জ্জুনের যাদবধ্বংসসহ নিজ পরাজয়জ্ঞাপন

তখন অর্জ্জুন কহিলেন, “ভগবন্! সেই নবজলধরসদৃশ নীলকলেবর পঙ্কজলোচন পীতাম্বর ও বলদেব উভয়েই কলেবর পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন। ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশে যেসকল মহাত্মারা সিংহতুল্য মহাবলপরাক্রান্ত ছিলেন, ব্রহ্মশাপনিবন্ধন প্রভাসে পরস্পর পরস্পরের প্রতি মুসলীভূত এরকাপ্রহারপূৰ্ব্বক পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন। কালের কি আশ্চৰ্য্য গতি, যাঁহারা পূৰ্ব্বে অনায়াসে গদা, পরিঘ ও শক্তির প্রহার সহ্য করিতেন, এক্ষণে তাঁহারা সামান্য তৃণপ্রহারে নিহত হইলেন। এইরূপে সৰ্ব্বসমেত পাঁচলক্ষ লোক বিনষ্ট হইয়াছে। আর আমি বারংবার সেই প্রবল প্রতাপ যদুবংশীয়দিগের, বিশেষতঃ যশস্বী কৃষ্ণের, বিনাশবৃত্তান্ত স্মরণ করিতে সমর্থ হইতেছি না। মহাত্মা বাসুদেব বিনাশ, সমুদ্রশোষ [১], পর্ব্বতসঞ্চালন [২], আকাশপতন এবং অগ্নির শৈত্যপ্রভাবের ন্যায় নিতান্ত অবিশ্বাস্য বলিয়া বোধ হয়। এক্ষণে বাসুদেব ব্যতীত আর ক্ষণকাল জীবনধারণ করিতে আমার বাসনা নাই।

কৃষ্ণনাশে সবিশেষ বিষণ্ন অর্জ্জুনের কর্ত্তব্যপ্রশ্ন

“হে তপোধন! আমি এক্ষণে যাহা কহিলাম, ইহা অপেক্ষাও ক্লেশকর আর একটি বিষয় চিন্তা করিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। এক্ষণে আমি সেই বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। যদুবংশ ক্ষয় হইবার পর আমি দ্বারকায় গমনপূর্ব্বক তথা হইতে যাদবকুলকামিনীগণকে লইয়া আগমন করিতেছিলাম। পঞ্চনদদেশে দস্যুগণ আমাকে আক্রমণ করিয়া আমার সমক্ষেই অরণ্যে কামিনীগণকে অপহরণ করিয়াছে। তৎকালে আমি গাণ্ডীবশাসন ধারণ করিয়াও তাহাদিগকে পরাস্ত করিতে পারিলাম না। ঐ সময় আমার পূর্ব্বের ন্যায় বাহুবল রহিল না। আমি দিব্যাশাস্ত্ৰসমুদয় এককালে বিস্মৃত হইলাম। ক্ষণকালের মধ্যে আমার তূণীরস্থিত শরসমুদয় নিঃশেষিত হইল এবং যে শঙ্খচক্রগদাধায় চতুর্ভুজ পীতাম্বর পুরুষ আমার রথের অগ্রে অগ্রে ধাবমান হইয়া শত্রুসৈন্যসমুদয়কে দগ্ধ করিতেন, আমি আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না। ঐ মহাপুরুষ পুৰ্ব্বে অরাতিসৈন্যগণকে দগ্ধ করাতেই আমি তাহাদিগকে গাণ্ডীবনির্ম্মুক্ত শরনিকরে বিনাশ করিয়াছিলাম। এক্ষণে ঐ মহাত্মার অদর্শনে আমি নিতান্ত অবসন্ন হইয়াছি এবং আমার সর্ব্বশরীর ঘূর্ণিত হইতেছে। এক্ষণে কিছুতেই আমি শান্তিলাভে সমর্থ হইতেছি না। সেই বীরবর জনার্দ্দন ব্যতিরেকে আর ক্ষণকাল আমার জীবিত থাকিবার বাসনা নাই। নারায়ণ ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন শ্রবণ করিয়া অবধি আমার দিক্‌কল শূন্যময় বোধ হইতেছে। এক্ষণে আমি বীর্য্যবিহীন ও শুন্যহৃদয় হইয়া পরিভ্রমণ করিতেছি। অতএব অতঃপর আমার কর্ত্তব্য কি, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

কৃষ্ণতত্ত্ব-প্রকাশ—মহাপ্রস্থানে ব্যাসের উপদেশ

মহাবীর ধনঞ্জয় এই কথা কহিলে মহর্ষি বেদব্যাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “পার্থ! বৃষি ও অন্ধকবংশীয় মহারথগণ ব্ৰহ্মশাপে দগ্ধ হইয়াছেন, অতএব তাঁহাদিগের নিমিত্ত শোক করা তোমার কর্ত্তব্য নহে। ঐ বীরগণের নিধন অবশ্যম্ভাবী বলিয়াই মহাত্মা বাসুদেব উহা নিবারণে সমর্থ হইয়াও উপেক্ষা করিয়াছেন। তিনি মনে করিলে মহর্ষি-শাপখণ্ডনের কথা দূরে থাকুক, এই স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্বসংসারকেও অন্যরূপে নির্ম্মাণ করিতে পারেন। সেই পুরাতন মহর্ষি কেবল পৃথিবীর ভারাবতরণ করিবার নিমিত্তই বসুদেবের গৃহে উৎপন্ন হইয়াছিলেন। তিনিও তোমার প্রতি স্নেহনিবন্ধন তোমার রথের অগ্রে অগ্রে গমন করিতেন। এক্ষণে পৃথিবীর ভারাবতরণ করা হইয়াছে বিবেচনা করিয়া তিনি কলেবর পরিত্যাগ করিয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিয়াছেন।

“তুমি ও ভীমসেন, নকুল ও সহদেবের সাহায্যে গুরুতর দেবকাৰ্য্য সংসাধন করিয়াছ। এক্ষণে তোমরা সকলেই কৃতকাৰ্য্য হইয়াছ, অতএব অতঃপর ইহলোক হইতে প্রস্থান করাই তোমাদিগের শ্রেয়ঃ। লোকের মঙ্গললাভের সময় সমুপস্থিত হইলেই সুবুদ্ধি, তেজ ও অনাগতদর্শন [ভবিষ্যৎ দর্শন] প্রভৃতি উপস্থিত হইয়া থাকে, আবার অমঙ্গলসময় হইলেই তৎসমুদয়ের ক্ষয় হইয়া যায়। ফলতঃ কালই জগতের বীজস্বরূপ। কালপ্রভাবেই সমুদয় সমুৎপন্ন ও বিলীন হইয়া থাকে। কালই বলবান্ হইয়া আবার দুর্ব্বল এবং ঈশ্বর [প্রভু] হইয়াও অন্যের আজ্ঞাবহ হয়। এক্ষণে তোমার অস্ত্রসমুদয়ের কার্য্য শেষ হইয়াছে বলিয়াই উহারা যে স্থান হইতে আগমন করিয়াছিল, সেই স্থানে প্রতিগমন করিয়াছে। আবার যখন উহাদের কার্য্যকাল সমুপস্থিত হইবে, তখন উহারা পুনরায় তোমার হস্তগত হইবে। এক্ষণে তোমাদিগের স্বর্গগমন সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, অতএব তদ্বিষয়ে যত্নবান হওয়াই তোমাদিগের শ্রেয়ঃ।”

মহর্ষি বেদব্যাস এই কথা কহিলে, মহাত্মা অৰ্জ্জুন তাঁহার অনুজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক হস্তিনানগরে গমন করিয়া ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিকট বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়দিগের ক্ষয়বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিলেন।

মৌষলপরর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত