০৫. পরের দিন রাত্রে

পরের দিন রাত্রে।

জীবনবাবুর বাড়িটা রাস্তার একেবারে শেষপ্রান্তে।

বাড়ির পেছনদিকে একটা ছোটখাটো সিনামোনের বাগান।

বাগানের দিককার একটা ঘরে কিরীটী ও তার বন্ধুদের থাকতে দেওয়া হয়েছে। ঘরে গোটা-চারেক জানলা—প্রত্যেকটাই গরাদহীন। বাইরের দেয়ালটা আইভিলতায় একেবারে ছেয়ে গেছে। চারিদিককার দেয়ালে চারটে স্কাইলাইট।

স্কাইলাইটগুলো রেকট্যাঙ্গুলার সাইজের এবং বেশ বড়, একজন মানুষ অনায়াসেই গলে যাতায়াত করতে পারে।

প্রত্যেক খাটে দুজন করে,-দুটো খাটে চারজন শোয়। ঘরের এক কোণে দেওয়াল ঘেঁষে একটা আলমারি বইয়ে একেবারে ঠাসা।

এক কোণে ঘোট একটা টেবিল, দুটো সোফা ও গোটা-কয়েক চেয়ার।

সুন্দর দাসের ঘরে কিরীটী যে বিষাক্তগন্ধী খামখানা পেয়েছিল, পকেট থেকে সেখানা বের করে সে টেবিলের উপর রাখল। তারপর সুইচ টিপে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে বলল, আজ রাত্রে এটা এই টেবিলেই রইল—দেখা যাক কিছু ঘটে কিনা।

সুব্রত বলল, কি ঘটবে, কিরীটী?

ঈষৎ হেসে কিরীটী বলল, বলিনি বুঝি তোমাকে? আজ আবার রক্তমুখী ড্রাগন আমাকে শাসিয়ে গিয়েছে।

তাই নাকি?

কিরীটী বলল, হ্যাঁ, রক্তমুখী ড্রাগন আজই দুপুরবেলায় একটা লোক মারফৎ একখানা কিরীটী চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, সেদিন পিস্তলের গুলিতে যদিও আমরা অনুসরণকারীকে নিরস্ত করেছিলাম, তাহলেও সে আমাদের নাম-ধাম-ঠিকানা সব কিছু জানতে পেরেছে।

সে বলে পাঠিয়েছে যে, প্রায় আমারই চোখের উপর, মানে আমার উপস্থিতির সময়েই সে সুন্দর দাসের দফা শেষ করেছে অথচ আমরা তার কিছুই কূলকিনারা করতে পারিনি, পারবও না। কাজেই সে উপদেশ দিয়েছে, আমরা যেন বাড়ি ফিরে যাই; নইলে অতি শীগগিরই সে আমাদেরও দফা শেষ করবে।

তারপর একটু থেমে বললে, আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রক্তমুখী ড্রাগন আজই আমাদের উপরে একটা attempt নেবে হয়ত। কারণ এমনি ধরনের খুনেদের স্বভাবই এই যে, তারা শাসানি যাকে দেয়, তাকে সময় দেয় খুবই কম,-কখনও বা একেবারেই সময় দেয় না;শত্রুকে তৈরী হবার সুযোগ দেবার পক্ষপাতী তারা একেবারেই নয়। আজ শাসানি দিয়েছে, হয়ত আজই তা কাজে পরিণত করবার চেষ্টা করবে। কাজেই আমিও আজ পরীক্ষার জন্য তৈরী হয়ে আছি।

কি রকম? কোন পাহারা রাখলে না, কিছুই করলে না-আলোটা পর্যন্ত নিবিয়ে দিলে। অথচ আশঙ্কা করছ, আজই শত্রুপক্ষ কিছু করে ফেলতে পারে! আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে কই?

সুব্রতর কণ্ঠস্বর একটু ক্ষুব্ধ।

একটু হেসে কিরীটী বলল, আছে আছে। এই নাও না আত্মরক্ষার জিনিস!

এই বলে সে পকেট থেকে একটা শিশি বের করে, সেই শিশির আরক প্রত্যেকের হাতের পাতায় ঢেলে দিল। আরকের তীব্র ঝাঁঝাল গন্ধে বোঝা গেল, সেটা এমোনিয়া সলুশন।

বেশ করে হাতে ঘষে নাও।

সকলে কিরীটীর কথামত কাজ করল।

আবার সুব্রত বলল, আত্মরক্ষার চমৎকার জিনিস বের করেছ তো কিরীটী!

রক্তমুখী ড্রাগন-এর দেওয়া বিষাক্তগন্ধী খামের ষড়যন্ত্র এড়াতে হলে, মনে হয় এই হচ্ছে একমাত্র ওষুধ।

সুব্রত বলল, একটা কথা কিরীটী, অবিশ্যি রক্তমুখী ড্রাগন নামটার মধ্যেই একটা বিভীষিকা ও সেই সঙ্গে রহস্যের ইঙ্গিত আছে এবং চিদাম্বরম ও সুন্দর দাস দুজনেই রক্তমুখী ড্রাগন- এর শিকার। রক্তমুখী ড্রাগন তোকে যে চিঠি দিয়ে শাসিয়েছে তাতে করে যেন আমার মনে হচ্ছে এর সব কিছুর পিছনে একটা দুর্ধর্ষ দল আছে এবং তাদের একটা বিশেষ উদ্দেশ্যও আছে।

কিরীটী বললে, ঠিকই অনুমান করেছিস। আমার তো অনুমান তাই।

একটা কথা কিরীটী—

কি?

ঐ বিষাক্ত গন্ধের মধ্যে নিশ্চয়ই কিছুর ইঙ্গিত আছে মনে হয়। তাই।

কিন্তু গন্ধটা–

অনেকদিন আগে, মনে পড়ে এক পর্যটকের বইতে পড়েছিলাম, তিনি বর্মার জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় এক ধরনের অদ্ভুত বুনো ফুল দেখেছিলেন, সেগুলো দেখতে অনেকটা সবুজ রংয়ের। সেই ফুলের গন্ধ ভারী অদ্ভুত; যেমন তীব্র, তেমনি ন্যক্কারজনক। সমস্ত শরীরের মধ্যে কেমন যেন এক ঝিম্ ঝিম্ ভাব আনে। এবং ঐ ফুলের গন্ধের এমন একটা আশ্চর্য শক্তি আছে যে, কোন বস্তুতে যদি একবার গন্ধটা লাগে, তার গায়ে যেন একেবারে জড়িয়ে যায়। গন্ধটার একটা অত আকর্ষণী শক্তিও আছে। এই বিষাক্ত গন্ধেই আকৃষ্ট হয়ে এসে মৃত্যুদূত প্রথমে ছুটে যায় সেই বিষাক্তগন্ধী জিনিসটার দিকে। সম্ভবত বিষাক্ত গন্ধের উত্তেজনায় তার রক্তলালসা জেগে ওঠে, তারপর নিকটবর্তী যে কোন লোকের রক্তপান করবার জন্য সে অতি নিঃশব্দে তার গলদেশে বিষ-দত্ত ফুটিয়ে দেয়-মরণের বিষাক্ত-চুম্বনে সে হতভাগ্য আর কোনদিনই জাগে না।

কথা বলতে বলতে শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বর কেমন যেন রহস্যময় বলে মনে হয়।

চুরেটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে কিরীটী আবার বলল, মনে পড়ে সুখলাল বলেছিল, দিতিনেক আগে এক রাত্রে মিঃ দাস হঠাৎ ভয় পেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন?…আমার মনে হয় ভয় পেয়েছিলেন ঐ বিষাক্ত গন্ধলোভী কুৎসিত-দর্শন মৃত্যুদূতকে ঘরে চোখের সামনে দেখে।

মৃত্যুদূত?

হাস্‌-স্‌-স্‌ …চুপ!..

বলেই কিরীটী তার ঠোটের ওপর তর্জনী-আঙুলটা রেখে সবাইকে নীরব হবার জন্য সঙ্কেত করল। সকলেই তার সঙ্কেত মেনে তৎক্ষণাৎ চুপ করে গেল।

বাইরে একটা মৃদু খসখস্ শব্দ। একটা অজানিত আশঙ্কা, একটা অস্বাভাবিক অশরীরী বিভীষিকা যেন অক্টোপাশের মত তার বাহু প্রসারিত করে অন্ধকারে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে।

নীচের বৈঠকখানার ওয়াল-ক্লকটায় ঢং ঢং করে রাত্রি দুটো ঘোষণা করল।

যে টিবিলটার ওপরে কিরীটী সেই বিষাক্ত-গন্ধী খামখানা রেখেছিল, সেই টেবিলটা তুলে নিয়ে সে নিঃশব্দ পায়ে উঠে বাগানের দিকটার দেয়ালে একটু তফাতে রেখে ফিরে এল।

সব চুপচাপ বসে। অন্ধকারে প্রত্যেকের নিঃশ্বাসের শব্দ নিঃশব্দে যেন চাপ বেঁধে উঠছে।

আকাশে চাঁদ উঠেছে, তারই আলো এসে স্কাইলাইটের ফাঁক ও খোলা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে।

একটা অস্পষ্ট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। বাগানের দিককার দেয়ালে লতিয়ে-ওঠা আইভিলতার পাতায় পাতায় বুঝি একটুখানি মৃদু শব্দ শোনা গেল। তারপরই অস্পষ্ট একটা আবছা কালো ছায়া স্কাইলাইটের উপরে জেগে উঠল। একটা ফ্যাকাশে রংয়ের বিশ্রী কুৎসিত চ্যাপটা মুখ ধীরে ধীরে স্কাইলাইটের ফাঁকে দেখা দিল।

কিরীটীর একপাশে রাজু, অন্যপাশে সুব্রত।…কিরীটী দুহাতে দুজনকে ইশারায় চুপচাপ থাকতে বললে।

দেখা গেল সরু সরু প্যাঁকাটির মত আঙুল-বিশিষ্ট একটা ছোট হাত ধীরে ধীরে স্কাইলাইটের শিকটা চেপে ধরল।…ক্রমে আরো একটা হাত তারই পাশে, নজরে পড়ল ওদের।

একসময় ডানহাতটা সরে গেল, এবং অল্পক্ষণ পরেই সেই হাতটা আবার দেখা গেল। এবারে দেখা গেল, সে হাতে একটা ছোট চৌকো বাক্স ধরা আছে।

আস্তে আস্তে হাতের উপর ভর দিয়ে সেই নিশাচর মূর্তি, বাঁদরের মত অদ্ভুত কায়দায় পাক খেয়ে, ফাঁক দিয়ে মাথা ও দেহের অর্ধেকটা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিল।

তারপরই মেঝের উপরে কিছু যেন পড়ার শব্দ পাওয়া গেল।

ঘরের মাঝে যেটুকু চাঁদের আলো এসেছে, তা কম হলেও যথেষ্ট। সেই আলোয় দেখা গেল, বাক্সটা থেকে বের হয়ে একটা অদ্ভুত কুৎসিত-দর্শন ইঞ্চি ছয়েক লম্বা ঘোর লাল রঙের পোকা তার বাঁকানো রোমশ বড় বড় তারের মত সরু সরু ঠ্যাং দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, টেবিলটার পায়ার গা বেয়ে সেই বিষাক্ত-গন্ধী থামটার দিকে চলেছে।

কিরীটী ক্ষিপ্রহন্তে গায়ের জামাটা খুলে টেবিলের ওপর ছুঁড়ে দিল, সঙ্গে সঙ্গে একটা লাফ দেওয়ার অস্পষ্ট শব্দ পাওয়া গেল। তারপর কিরীটী ছুটে রাস্তার ধারের জানলার দিকে গেল। চাঁদের আলোয় পরিষ্কার দেখা গেল—একটা কালো রঙের গাড়ি চলে যাচ্ছে।

সুইচ টিপে আলোটা জ্বালতে জ্বালতে কিরীটী বললে, পাখী পালিয়েছে। চল, মৃত্যুদৃতকে ভাল করে দেখা যাক।

বলতে বলতে কিরীটী টেবিলের ধারে এগিয়ে গেল ওবং টেবিলের জামাটির ওপর একটা লাঠি দিয়ে গোটাকয়েক ঘা দিয়ে জামাটা তুলতেই পরিপূর্ণ আলোকে দেখা গেল, লাল রংয়ের একটা পোকা। পোকাটা একটা বড় পিঁপড়ের মত দেখতে। তার মস্ত মস্ত দুটো শুড়। আর সেই শুড়ের গায়ে ছোট ছোট সব লোম। মাথার অনুপাতে দেহটা বেশ বড় এবং অসংখ্য সরু সরু কম্পমান পা।

কিরীটী পোকাটার দিকে চেয়ে বললে, এই তাহলে মৃত্যুদূত। যতদূর মনে হয়, এই পোকাটা Scolopendra গ্রুপের। এখন বুঝতে পারছি-মিঃ দাসের চাকর সুখলাল যে বলেছিল, মিঃ দাস অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, লাল বাঁকা বলে একটা কথা—সেটা তিনি লাল বাঁকা বলেননি, বলেছিলেন লাল পোকা এবং সেটা এই রকম একটা পোকা দেখেই।

তার ঘরে যে সিল্কের সুততা পাওয়া গেছল, সেটা দিয়ে এইরকম একটি পোকাকেই নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে মারবার জন্য। কিন্তু প্রথমবারের চেষ্টা নিষ্ফল হয়; সেইজন্য বোধ হয় দ্বিতীয় চেষ্টা করতে হয়েছিল।

মিঃ দাসের অফিস-ঘর থেকে মাত্র হাত-তিনেক ব্যবধানে গলির অন্য দিকে ছিল সেই পাঞ্জাবী ডাক্তারের বাড়ি। ডাক্তারের বাড়ির দোতলার ছাদে উঠে নিরিবিলিতে স্কাইলাইটের ফাঁক দিয়ে এই মরণ-পোকাকে সুতোর সাহায্যে প্রেরণ করা এমন কোন দুরূহ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস আমার হিসাবে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, মিঃ দাসকে হত্যা করার মধ্যে কি এমন কারণ থাকতে পারে? রক্তমুখী ড্রাগন তো ওঁকে হত্যা না করেও অনায়াসেই কাজ হাসিল করতে পারত, যেমন করে মিঃ চিদাম্বরকে লুকিয়ে ফেলে কাজ হাসিল করে নিয়েছে।

তার মানে? কি করে জানলে তা? তাছাড়া চিদাম্বরমকে লুকিয়ে রেখেছে, এখবর কি করে জানলে কিরীটী? আগ্রহে উদগ্রীব হয়ে সুব্রত জিজ্ঞেস করলে।

কিরীটী বললে, মিস্টার রামিয়ার কাছ থেকে আজই সকালে খবর পেয়েছি—চিদাম্বরমের সেক্রেটারীর কাছে রক্তমুখী ড্রাগনের এক পরোয়ানা এসেছে-একটা নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে এক লাখ টাকা না দিতে পারলে, চিদাম্বরকে তারা পৃথিবী থেকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে ফেলতেও পশ্চাৎপদ হবে না, এবং নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে টাকা পেলে, চিদাম্বরমকে তারা ফিরিয়ে দেবে অক্ষত দেহে; সে প্রতিশ্রুতিও সেই চিঠির মধ্যে আছে।