৩. যাদবনরনারীর দুর্লক্ষণ দুঃস্বপ্ন-দর্শন

যাদবনরনারীর দুর্লক্ষণ দুঃস্বপ্ন-দর্শন

বৈশম্পায়ন, বলিলেন, হে মহারাজ! ঐ সময় প্রতিদিন রজনীযোগে বৃঞ্চিবংশীয়দিগের দুঃস্বপ্ন-দর্শন হইতে লাগিল। কামিনীগণ নিদ্রিতাবস্থায় দেখিতে লাগিলেন যেন, এক শুভ্রদশনা [স্বচ্ছদন্তবিশিষ্টা] কৃষ্ণবর্ণা রমণী হাস্য করিতে করিতে তাঁহাদের মঙ্গলসূত্র [সধবার চিহ্ন হস্তেবদ্ধ রক্তবর্ণের ডোরকাদি] অপহরণপূর্ব্বক ধাবমান হইতেছে এবং পুরুষগণ দেখিতে লাগিলেন যেন, ভয়ঙ্কর গৃধ্রগণ অগ্নিহোত্ৰগৃহ ও বাসগৃহমধ্যে তাঁহাদিগকে ভক্ষণ করিতেছে। এইরূপ দুঃস্বপ্নদর্শনে তাঁহাদের চিন্তার আর পরিসীমা রহিল না। অনন্তর ভীষণাকার রাক্ষসগণ তাঁহাদিগের অলঙ্কার, ছত্র, ধ্বজ ও কবচসমুদয় অপহরণ করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। বাসুদেবের অগ্নিদত্ত বজ্রতুল্য চক্র সকলের সমক্ষেই আকাশে গমন করিল। উঁহার অশ্বসমুদয় দারুকের সমক্ষেই আদিত্যবর্ণ রথ লইয়া সাগরের উপরিভাগ দিয়া প্রস্থান করিল এবং অপ্সরাগণ বলদেবের তালধ্বজ ও বাসুদেবের গরুড়ধ্বজ অপহরণপূৰ্ব্বক দিবারাত্রি যাদবগণকে তীর্থযাত্রা করিতে আদেশ করিতে লাগিল।

যাদবদিগের প্রভাসযাত্রা—মদ্যপানমত্ততা

এইরূপ দুর্নিমিত্তসমুদয় উপস্থিত হইলে, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয় বীরগণ সকলেই সপরিবারে তীর্থযাত্রা করিতে ইচ্ছা করিয়া বিবিধ ভক্ষ্য, ভোজ্য, পানীয় ও মদ্য-মাংস প্রস্তুত করিতে লাগিলেন এবং অচিরাৎ হস্তী, অশ্ব ও রথারোহী অসংখ্য সৈন্যে পরিবৃত হইয়া নগর হইতে বহির্গত হইলেন। তৎকালে তাঁহাদের ও তাঁহাদের সৈন্যসমুদয়ের শোভার আর পরিসীমা রহিল না। অনন্তর তাঁহারা সকলে সেই প্রভাসতীর্থে সমুপস্থিত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন গৃহে অবস্থানপূর্ব্বক স্ত্রীগণের সহিত অনবরত পানভোজন করিতে লাগিলেন।

ঐ সময় যোগবিদ্‌ অর্থতত্ত্ববিশারদ মহাত্মা উদ্ধব যাদবগণকে প্রভাসতীর্থে অবস্থিত অবগত হইয়া, তথায় গমনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে সম্ভাষণ করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব কালবিপর্য্যয়নিবন্ধন তাঁহাকে নিবারণ করা অকৰ্ত্তব্য বিবেচনা করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে অভিবাদন করিলেন। মহাত্মা উদ্ধব বাসুদেবকর্ত্তৃক এইরূপে সম্মানিত হইয়া, তেজোদ্বারা শূন্যমাৰ্গ আচ্ছাদনপূৰ্ব্বক তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। তৎপরে মহারথ যাদবগণ কালের বশীভূত হইয়া ব্রাহ্মণের নিমিত্ত সমাহৃত অন্নসমুদয় সুরামিশ্রিত করিয়া বানরদিগকে প্রদান করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে প্রভাসতীর্থ নট, নর্ত্তক ও মত্ত ব্যক্তিগণে পরিপূর্ণ এবং অসংখ্য তূরীশব্দে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। বলদেব, সাত্যকি, গদ, বভ্রু ও কৃতবর্ম্মা বাসুদেবের সমক্ষেই সুরাপান করিতে আরম্ভ করিলেন। পরিশেষে সাত্যকি সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক মত্ত হইয়া কৃতবর্ম্মাকে উপহাস ও অবমাননা করিয়া কহিলেন, “হার্দ্দিক! ক্ষত্রিয়মধ্যে কেহই এরূপ নির্দ্দয় নাই যে, নিদ্রিত ব্যক্তিদিগকে বিনাশ করিতে পারে। অতএব তুমি যে কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ, যাদবগণ কখনই তাহা সহ্য করিবেন না।”

যাদবগণের পরস্পর কলহসূচনা

সাত্যকি এই কথা কহিলে মহারথ প্রদ্যুম্নও কৃতবর্ম্মাকে অবজ্ঞা করিয়া সাত্যকির বাক্যের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর কৃতবর্ম্মা অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া বামহস্ত সঞ্চালনদ্বারা সাত্যকির ঐ বাক্যে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “শৈনেয়! মহারাজ ভূরিশ্রবা ছিন্নবাহু হইয়া সংগ্রামে প্রায়োপবেশন করিলে যখন তুমি তাঁহার মস্তকচ্ছেদন করিয়াছ, তখন তোমার তুল্য নৃশংস আর কেহই নাই।” কৃতবর্ম্মা এই কথা কহিলে, মহাত্মা বাসুদেব তাঁহার বাক্যশ্রবণে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তির্য্যগভাবে তাঁহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন। তখন সাত্যকি স্যমন্তকমণির অপহরণবৃত্তান্ত উল্লেখ করিয়া, কৃতবর্ম্মা অক্রূরদ্বারা যেরূপ মহারাজ সত্রাজিতের বিনাশসাধন করিয়াছিলেন, তাহা আনুপূর্ব্বিক কীৰ্ত্তন করিতে লাগিলেন। সত্রাজিতের দুহিতা সত্যভামা সাত্যকির মুখে সেই পিতৃবধবৃত্তান্ত শ্রবণ করিবামাত্র কোপাবিষ্টচিত্তে রোদন করিতে করিতে বাসুদেবের ক্রোড়ে উপবিষ্ট হইয়া তাঁহার কোপানল উদ্দীপিত করিলেন। তখন সাত্যকি সহসা গাত্রোত্থান করিয়া সত্যভামাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভদ্রে! আমি শপথ করিয়া কহিতেছি, আজ ঐ পাপপরায়ণ কৃতবর্ম্মাকে দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডীর পথের পথিক করিব। পূৰ্ব্বে ঐ দুরাত্মা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাকে সহায় করিয়া শিবিরমধ্যে নিদ্রিত ব্যক্তিদিগকে নিহত করিয়াছিল। সেই পাপে আজ ইহার আয়ু ও যশঃ নিঃশেষিত হইয়াছে।”

মহাবীর সাত্যকি এই বলিয়া বাসুদেবের সমক্ষেই খড়গদ্বারা কৃতবর্ম্মার মস্তকচ্ছেদনপূর্ব্বক অন্যান্য বীরগণকে প্রহার করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা বাসুদেব তাঁহাকে নিবারণ করিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকট ধাবমান হইলেন। ঐ সময় সেই মদমত্ত ভোজ ও অন্ধকবংশীয়গণ কালপ্রভাবে বিমোহিত হইয়া সাত্যকিকে পরিবেষ্টন করিলেন। মহাত্মা বাসুদেব কালের গতি বিবেচনা করিয়া তদ্দর্শনে কিছুমাত্র ক্রুদ্ধ হইলেন না। তখন তাঁহারা সকলে সমবেত হইয়া উচ্ছিষ্টপাত্ৰদ্বারা সাত্যকিকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন।

যাদবগণের পরস্পর যুদ্ধ—ধ্বংস

মহাবীর সাত্যকি এইরূপে ভোজ ও অন্ধকগণকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইলে, রুক্মিণীনন্দন মহারথ প্রদ্যুম্ন যুযুধানের পরিত্রাণার্থ সংগ্রামস্থলে সমুপস্থিত হইয়া বাহ্বাস্ফোটনপূৰ্ব্বক ভোজদিগের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। মহাবীর সাত্যকিও বাহ্বাস্ফোটনপূৰ্ব্বক অন্ধকদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। ঐ সময় ভোজ ও অন্ধকদিগের সংখ্যা অধিক ছিল বলিয়া মহাবীর প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকি তাঁহাদিগকে কোনক্রমে পরাজিত করিতে পারিলেন না। ঐ বীরদ্বয় কিয়ৎক্ষণমাত্র সংগ্রাম করিয়া পরিশেষে বাসুদেবের সমক্ষেই সেই ভোজ ও অন্ধকগণকর্ত্তৃক নিহত হইয়া ভূতলে শয়ন করিলেন।

তখন মহাত্মা বাসুদেব স্বীয় পুত্র প্রদ্যুম্ন ও সাত্যকিকে বিনষ্ট দেখিয়া কোপাবিষ্টচিত্তে একমুষ্টি এরকা [ঈষিকা—শরতৃণ] গ্রহণ করিলেন। বাসুদেব এরকা-মুষ্টি গ্রহণ করিবামাত্র উহা মুষলরূপে পরিণত হইল। তখন তিনি তদ্বারা সম্মুখবর্ত্তী ভোজ ও অন্ধকগণকে নিপাতিত করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় অন্ধক, ভোজ, শৈনেয় ও বৃষ্ণিগণও কালবশতঃ পরস্পর সেই এরকাঘাতে বিনষ্ট হইতে লাগিলেন। তৎকালে কোন ব্যক্তি ক্রুদ্ধ হইয়া একটিমাত্র এরকা গ্রহণ করিলেও উহা বজ্রের ন্যায় লক্ষিত হইতে লাগিল। ফলতঃ ঐ স্থানের সমুদয় এরকাই ব্রহ্মশাপপ্রভাবে মুষলরূপে পরিণত হইয়াছিল। ঐ সময় বীরগণ কোপাবিষ্ট হইয়া যেসকল এরকা নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, তৎসমুদয় মুষল ও বজ্রস্বরূপ হইয়া অভেদ্য পদার্থ ভেদ করিতে লাগিল। পিতা পুত্রকে ও পুত্র পিতাকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিলেন।

কুকুর ও অন্ধকবংশীয় বীরগণ মত্ত হইয়া অনলে নিপতিত পতঙ্গের ন্যায় প্রাণত্যাগ করিতে লাগিলেন। তৎকালে তথা হইতে পলায়ন করিতে কাহারও প্রবৃত্তি হইল না। ঐ সময় মহাত্মা মধুসূদন কালের গতি পরিজ্ঞাত হইয়া মুসলীভূত এরকা গ্রহণপূর্ব্বক সেই ঘোরতর হত্যাকাণ্ড দর্শন করিতে লাগিলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁহার সমক্ষেই এরকাঘাতে শাম্ব, চারুদেষ্ণ, অনিরুদ্ধ ও গদের প্রাণবিয়োগ হইল। তখন তিনি স্বচক্ষে তাঁহাদের মৃত্যু দর্শন করিয়া কোপাবিষ্টচিত্তে তত্রত্য সমুদয় বীরের প্রাণসংহার করিলেন। ঐ সময় মহাত্মা বস্তু ও দারুক মহামতি মধুসূদনের সমীপে দণ্ডায়মান ছিলেন। তাঁহারা সেই বীরসমুদয়কে নিহত দেখিয়া দুঃখিতচিত্তে বাসুদেবকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “জনার্দ্দন! এক্ষণে ত’ আপনি অসংখ্য লোকের প্রাণসংহার করিলেন। অনন্তর চলুন, আমরা তিনজনে মহাত্মা বলভদ্রের নিকট গমন করি।”