২. যদুপুরে ধ্বংসসূচক উপদ্রব উপস্থিতি

যদুপুরে ধ্বংসসূচক উপদ্রব উপস্থিতি

বৈশম্পায়ন বলিলেন, হে মহারাজ! বৃষ্ণি ও অন্ধকগণ এইরূপে সাবধান হইয়া অবস্থান করিতে আরম্ভ করিলে, কৃষ্ণপিঙ্গলবর্ণ মুণ্ডিতশিরা বিকটাকার কালপুরুষ প্রতিনিয়ত তাঁহাদিগের গৃহে পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তাঁহারা কোন কোন সময়ে ঐ পুরুষকে দেখিতে পাইতেন এবং কখন কখন তিনি তাঁহাদিগের দৃষ্টিপথের বহির্ভূত হইতেন। ঐ পুরুষ দৃষ্টিপথে নিপতিত হইলেই, তাঁহারা তাঁহার প্রতি অসংখ্য শরনিক্ষেপ করিতেন; কিন্তু কোনরূপেই তাঁহাকে বিদ্ধ করিতে পারিতেন না।

অনন্তর দিনে দিনে সেই নগরমধ্যে যদুবংশের বিনাশসূচক ভয়ঙ্কর ঝঞ্ঝাবাত প্রবলবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল। পথিমধ্যে অসংখ্য মূষিক ও ভগ্ন মৃৎপাত্রসমুদয় দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। রাত্রিযোগে মূষিকেরা গৃহমধ্যে নিদ্রিত ব্যক্তিদিগের কেশ ও নখচ্ছেদনপূৰ্ব্বক ভক্ষণ করিতে লাগিল। গৃহস্বামিগণ দিবারাত্রি অপ্রীতিকর শব্দে রোদন করিতে লাগিল। সারসেরা উলূকের ন্যায় ও ছাগগণ শৃগালের ন্যায় চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। কালপ্রেরিত রক্তপাদ পাণ্ডুবর্ণ কপোতগণ সতত যাদবদিগের গৃহমধ্যে বিচরণ করিতে প্রবৃত্ত হইল এবং গাভীর গর্ভে রাসভ [গাধা], অশ্বতরীর [খচ্চরের] গর্ভে করভ [করি-শিশু], কুক্কুরীর গর্ভে বিড়াল ও নকুলীর [বেঁজীর] গর্ভে মূষিক উদ্ভূত হইতে লাগিল।

ঐ সময় কৃষ্ণ ও বলদেব ব্যতীত যদুবংশীয় আর সকলেই ব্রাহ্মণ, দেবতা ও পিতৃগণের দ্বেষ এবং লজ্জাভয়পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান ও গুরুজনকে অবজ্ঞা করিতে লাগিলেন। পত্নীগণ পতিসংসর্গ ও পতিগণ পত্নীসংসর্গ পরিত্যাগ করিতে লাগিল। যাজককর্ত্তৃক প্রজ্বলিত হুতাশন নীল, লোহিত ও হরিদ্বর্ণ শিখা প্রকটিত করিয়া বামভাগে প্রবণ [উদ্দীপ্ত] হইতে লাগিলেন। সূর্য্যকে প্রতিদিন উদয় ও অস্তগমনসময়ে কবন্ধগণে পরিবৃত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। পাকশালামধ্যে সুসংস্কৃত অন্নসমুদয় আহার করিবার সময় তন্মধ্যে সহস্র সহস্র কীট লক্ষিত হইতে লাগিল। মহাত্মাদিগের জয় ও পুণ্যাহবাক্য কীৰ্ত্তন করিবার সময় অসংখ্য লোক সেই স্থান দিয়া ধাবমান হইতেছে বলিয়া বোধ হতে লাগিল; কিন্তু কেহই কাহারও দৃষ্টিপথে নিপতিত হইল না। যাদবগণ সকলেই নক্ষত্রসমুদয়কে পরস্পর নিপীড়িত দর্শন করিতে লাগিলেন; কিন্তু স্বীয় জন্মনক্ষত্র কাহারও দৃষ্টিগোচর হইল না, তাঁহাদিগের গৃহমধ্যে পাঞ্চজন্য নিনাদিত হইলে চতুর্দ্দিকে রাসভগণ ভয়ঙ্কর শব্দে চীৎকার করিতে লাগিল।

ঐ সময় একদা এয়োদশীতে অমাবস্যার সংযোগ হইলে মহাত্মা বাসুদেব উহা নিতান্ত দুর্লক্ষণ বিবেচনা করিয়া বৃষ্ণিগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে বীরগণ! ভারত-যুদ্ধকালে রাহু যেরূপ দিনে দিবাকরকে গ্রাস করিয়াছিলেন, এক্ষণে আমাদিগের ক্ষয়ের নিমিত্ত সেইরূপ দিন সমুপস্থিত হইয়াছে।” তিনি তাঁহাদিগকে এই কথা কহিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, এতদিনের পর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধাবসানে ষট্‌ত্রিংশ বর্ষ পরিপূর্ণ হইল। পূৰ্ব্বে গান্ধারী পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা সফল হইবার উপক্রম হইয়াছে। সৈন্যসমুদয় ব্যহিত হইলে ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভয়ঙ্কর দুর্নিমিত্তদর্শনে যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহার অনুরূপ ঘটনা দর্শন করিতেছি।”

মহাত্মা মধুসূদন মনে মনে এইরূপ চিন্তা করিয়া যদুকূল ধ্বংস করার বাসনায় বৃঞ্চিগণকে প্রভাসতীর্থে যাত্রা করিতে আদেশ করিলেন। তখন বৃষ্ণিগণও বাসুদেবের আজ্ঞানুসারে সকলকে প্রভাসতীর্থে গমন করিতে হইবে বলিয়া নগরের চতুর্দ্দিকে ঘোষণা করিতে লাগিলেন।