১. মৌষলপর্ব্বাধ্যায়—যুধিষ্ঠিরের বিবিধ অনিষ্টদর্শন

মৌষলপর্ব্বাধ্যায়—যুধিষ্ঠিরের বিবিধ অনিষ্টদর্শন

নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিয়া জয় উচ্চারণ করিবে।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর ষট্‌ত্রিংশ বৎসর সমুপস্থিত হইলে, ধৰ্ম্মরাজ বিবিধ দুর্নিমিত্তসমুদয় দর্শন করিতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিকে কর্করমিশ্রিত নির্ঘাত বায়ু প্রবাহিত হইতে লাগিল। পক্ষিগণ দক্ষিণাবৰ্ত্তমণ্ডল নির্ম্মাণপূৰ্ব্বক আকাশে পরিমণ করিতে আরম্ভ করিল। মহানদীসমুদয় স্রোতবিহীন ও দিক্‌মুদয় নীহারজালে সমাচ্ছন্ন হইল। অঙ্গারসমাযুক্ত উল্কাসকল গগনমণ্ডল হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। সূর্য্যকিরণ ধুলিজালে সমাচ্ছন্ন হইল। উদয়কালে সূর্য্যের প্রভা তিরোহিত ও সূৰ্য্যমণ্ডলে কবন্ধসমুদয় [মস্তকবিহীন দেহসমূহ] লক্ষিত হইতে লাগিল এবং সূৰ্য্য ও চন্দ্রের পরিধিমণ্ডল শ্যাম, অরুণ ও ধূসর এই ত্রিবিধবর্ণে রঞ্জিত হওয়াতে অতি ভয়ানক হইয়া উঠিল। তখন সেইসমুদয় ও অন্যান্য বিবিধপ্রকার দুর্লক্ষণদর্শনে যুধিষ্ঠিরের উদ্বেগের আর পরিসীম রহিল না।

যদুবংশধ্বংসশ্রবণে পাণ্ডবদিগের উদ্বেগ

কিয়দ্দিন পরে তিনি শুনিলেন, বৃষ্ণিবংশ মুষলপ্রভাবে বিনষ্ট হইয়াছে। বলদেব ও বাসুদেব উভয়েই ইহলোক পরিত্যাগ করিয়াছেন। তখন তিনি ভ্রাতৃগণকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “হে বীরগণ! ব্রহ্মশাপে বৃষ্ণিবংশ ত’ একবারে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে; এক্ষণে উপায় কি?”

যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে অন্যান্য পাণ্ডবগণ ঐ বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া একান্ত দুঃখিত হইলেন। শার্ঙ্গপাণি [শৃঙ্গনির্ম্মিত-ধনুকধারী] বাসুদেবের মৃত্যু সমুদ্রশোষের [সাগর শুকাইয়া] ন্যায় নিতান্ত অসম্ভব বলিয়া তাঁহাদের বোধ হইতে লাগিল। তখন তাঁহারা সকলেই শোকে একান্ত অভিভত ও ইতিকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া বিষন্নবদনে অবস্থান করিতে লাগিলেন।

জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্‌! মহাত্মা বাসুদেব বিদ্যমান থাকিতে মহারথ অন্ধক, বৃষ্ণি ও ভোজবংশীয়েরা কি নিমিত্ত নিহত হইল?

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভের পর ষট্‌ত্রিংশ বৎসর সমুপস্থিত হইলে, বৃষ্ণিবংশমধ্যে কালপ্রভাবে ঘোরতর দুর্নীতি সমুপস্থিত হইয়াছিল। তাহারা সেই দুর্নীতিনিবন্ধন পরস্পর পরস্পরের বিনাশসাধন করেন।

ঋষিশাপে যদুবংশধ্বংস-প্রসঙ্গ

জনমেজয় কহিলেন, ব্ৰহ্মন! বৃষ্ণি, অন্ধক ও ভোজবংশীয় মহাবীরগণ তৎকালে কাহার শাপে কালকবলে নিপতিত হইলেন, তাহা আপনি বিস্তারিতভাবে কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! একদা মহর্ষি বিশ্বামিত্র, কণ্ব ও তপোধন নারদ দ্বারকানগরে গমন করেন। সারণ প্রভৃতি কতিপয় মহাবীর তাঁহাদিগকে দর্শন করিয়া দৈবদুর্ব্বিপাকবশতঃ শাম্বকে স্ত্রীবেশ ধারণ করাইয়া তাঁহাদিগের নিকট গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে মহর্ষিগণ! ইনি অমিতপরাক্রম বভ্রুর পত্নী। মহাত্মা বভ্রু পুত্রলাভে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছেন। অতএব আপনারা বলুন, ইনি কি প্রসব করিবেন?”

সারণ প্রভৃতি বীরগণ এই কথা কহিলে, সেই সৰ্ব্বজ্ঞ ঋষিগণ আপনাদিগকে প্রতারিত বিবেচনা করিয়া রোষভরে তাঁহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “দূর্ব্বৃত্তগণ! এই বাসুদেবতনয় শাম্ব বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশবিনাশের নিমিত্ত ঘোরতর লৌহময় মুষল প্রসব করিবে। ঐ মুষলপ্রভাবে মহাত্মা বলদেব ও জনার্দ্দন ভিন্ন যদুবংশের আর সকলেই এককালে উৎসন্ন হইবে। মহাত্মা বলদেব যোগবলে কলেবর পরিত্যাগ করিয়া সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইবেন এবং বাসুদেব ভূতলে শয়ন করিয়া জরানামক ব্যাধের শরে বিদ্ধ হইয়া পরলোকে গমন করিবেন।”

মুনিগণ রোষারুণনেত্রে [ক্রোধরক্তবর্ণনেত্রে] সারণাদিকে [সারণ প্রভৃতি যাদবগণকে] এই কথা কহিয়া হৃষীকেশের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। মহাত্মা মধুসূদন তাঁহাদিগের নিকট ঐ বৃত্তান্ত অবগত হইয়া উহা অবশ্যম্ভাবী বিবেচনা করিয়া বৃষ্ণিবংশীয়দিগকে কহিলেন যে, মুনিগণ যাহা কহিয়াছেন, নিশ্চয় তাহা ঘটিবে।’ এই কথা কহিয়া, তিনি সেই শাপনিবারণের কোন উপায় উদ্ভাবনে সচেষ্ট না হইয়া পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

অনন্তর পরদিন প্রভাতে শাম্ব বৃষ্ণান্ধককুলনাশক [বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের নাশক] এক ঘোরতর মুষল প্রসব করিলেন। ঐ মুষল প্রসূত হইবামাত্র নরপতি সন্নিধানে সমানীত হইল। তখন তিনি রাজপুরুষগণদ্বারা সেই মুষল চূর্ণ করাইয়া সমুদ্রে নিক্ষেপ করাইলেন। ঐ সময় আহুক, জনার্দ্দন, বলদেব ও বভ্রুর বাক্যানুসারে নগরমধ্যে এই ঘোষণা হইলে যে, আজ অবধি নগরমধ্যে কোন ব্যক্তি সুরা প্রস্তুত করিতে পারিবে না। যে কেহ আমাদের অজ্ঞাতসারে সুরা প্রস্তুত করিবে, তাহাকে সবান্ধবে শূলে আরোপিত করা হইবে। এইরূপ ঘোষণা হইলে নগরবাসী লোকসমুদয় সেই শাসন শিরোধার্য্য করিয়া সুরা প্রস্তুতকরণে এককালে বিরত হইল।