৬. মহাভারত-শ্রবণ-বিধান—শ্রবণফল

মহাভারত-শ্রবণ-বিধান—শ্রবণফল

হে মহর্ষিগণ! মহারাজ জনমেজয় এইরূপে বৈশম্পায়নের মুখে মহাভারত-বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, ব্রহ্মন্‌! কিরূপ নিয়মে মহাভারত শ্রবণ করা কর্ত্তব্য, ভারতশ্রবণের ফল কি, উহা শ্রবণান্তে পারণ[উপবাসের পরদিন পিরণীয় ব্রাহ্মণভোজনান্তে উপবাস-কৰ্ত্তার নিজের জলযোগকে শাস্ত্র ‘রণ’ বা ‘পারণা’ বলিয়াছেন। এখানকার পারণ শব্দ এই অর্থে ব্যবহৃত নহে। পারণ শব্দের অর্থ যে তৃপ্তিজনক ব্যাপার, সে তৃপ্তি এ পারণেও আছে; তবে উপবাসান্তে জলযোগঘটিত নহে। এক একটি বিশেষ বিশেষ ঘটনার পাঠসমাপ্তি যে দিন হয়, পাঠকের পরিতৃপ্তির জন্য সেই দিনের দেয় দানব্যাপারের নাম পারণ।]সময়ে কোন্ কোন্ দেবতার পূজা করা কর্ত্তব্য, কোন কোন্ পর্ব্ব সমাপন হইলে কি কি বস্তু প্রদান করা উচিত এবং উহার পাঠকই বা কিরূপ হওয়া আবশ্যক, তৎসমুদয়ই কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! যেরূপ নিয়মে মহাভারত শ্রবণ করা কর্ত্তব্য এবং ভারতশ্রবণে যে ফললাভ হয়, তাহা কীৰ্ত্তন। করিতেছি, শ্রবণ কর।

মহাভারতমধ্যে ক্রীড়ার্থ [লীলা করিবার জন্য] ভূমণ্ডলে অবতীর্ণ দেবগণ, আদিত্যগণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, লোকপাল, মহর্ষি, গুহ্যক, গন্ধৰ্ব্ব, বিদ্যাধর, সিদ্ধ ও অপ্সরাগণ, গিরি, সাগর, নদী, গ্রহ, বৎসর, অয়ন ও ঋতুসমুদয় এবং মূর্ত্তিমান্ ভগবান্ স্বয়ম্ভু ও স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় জগতের বৃত্তান্ত সন্নিবেশিত রহিয়াছে। ভারতপাঠসময়ে মনুষ্যগণ উহাদিগের নাম ও কাৰ্য্যসমুদয় শ্রবণ করিয়া অচিরাৎ ঘোরতর পাপ হইতে বিমুক্ত হয়। সংযত ও শুচি হইয়া আনুপূৰ্ব্বিক এই ইতিহাস শ্রবণ করিতে আরম্ভ করিয়া সাধ্যানুসারে ভক্তিপূৰ্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে বিবিধ রত্ন, গাভী, কাংস্যময় দোহনপাত্র, অলংকৃতা কন্যা, বিবিধ যান, বিচিত্র হর্ম্ম্য [অট্টালিকা], ভূমি, বস্ত্র, সুবর্ণ, অশ্ব ও মত্তমাতঙ্গ প্রভৃতি বাহন, শয্যা, শিবিকা, অলংকৃত রথ ও অন্যান্য উৎকৃষ্ট দ্রব্যসমুদয় দান করা কর্ত্তব্য; অধিক কি কহিব, এই মহাভারত-শ্রবণসময়ে ব্রাহ্মণগণকে আত্মদান, পত্নীদান ও পুত্ৰদান করিয়াও সন্তুষ্ট করা উচিত। ভারতশ্রবণাভিলাষী ব্যক্তি হৃষ্ট ও অসন্দিগ্ধচিত্তে সাধ্যানুসারে ভক্তিপূৰ্ব্বক এই সমুদয় বস্তু প্রদান করিলে ক্রমশঃ মহাভারতশ্রবণ সমাপন করিতে সমর্থ হয়েন।

এক্ষণে সত্য, সরলতা, দমগুণ ও শ্রদ্ধাসম্পন্ন জিতক্রোধ ব্যক্তি যে উপায়ে এই ভারতশ্রবণে সিদ্ধিলাভ করিতে পারেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। পবিত্রতা ও শিষ্টাচারসম্পন্ন, শুক্লাম্বরপরিধায়ী, জিতেন্দ্রিয়, সৰ্ব্বশাস্ত্ৰপারদর্শী, ঈর্ষাপরিশূন্য, রূপবান, দমগুণযুক্ত, সত্যবাদী ও সম্মানার্হ ব্যক্তিকেই ভারতের পাঠকতাকার্য্যে নিযুক্ত করা কর্তব্য। পাঠক পরমসুখে সমাসীন হইয়া সমাহিতচিত্তে অদ্রুত অনতিবিলম্বিত ও স্পষ্টরূপে পাঠ করিবেন পাঠকালে ত্রিষষ্টি বর্ণ উচ্চারণ ও কণ্ঠাদি অষ্ট স্থলের সাহায্যে বর্ণ নিঃসরণ হওয়া আবশ্যক 3। পাঠক এই জয়াখ্য গ্রন্থপাঠের পূৰ্ব্বে নারায়ণ, নরোত্তম নর ও দেবী সরস্বতীকে নমস্কার করিবেন। শ্রোতা এইরূপ নিয়মে অবস্থানপূৰ্ব্বক পাঠকের নিকট মহাভারত শ্রবণ করিলে মহাফললাভে সমর্থ হইয়া থাকেন।

পারণ-দিন কর্তব্য

যিনি প্রথম পারণসময়ে বিবিধরূপে ব্রাহ্মণগণের তৃপ্তিসাধন করেন, তাঁহার অগ্নিষ্টোমযজ্ঞের ফললাভ হয় এবং তিনি অপ্সরাগণসমাকীর্ণ দিব্যবিমানে আরোহণ করিয়া মহা আহ্লাদে দেবগণের সহিত স্বর্গলোকে গমন করেন। যিনি দ্বিতীয় পারণ সমাপন করেন, তাঁহার অতিরাত্ৰযজ্ঞের ফললাভ হয় এবং তিনি দিব্যমাল্য, দিব্যবস্ত্র ও দিব্যগন্ধে বিভূষিত হইয়া রত্নময় দিব্যবিমানে আরোহণপূৰ্ব্বক দেবলোকে গমন করিয়া থাকেন। তৃতীয় পারণ করিতে পারিলে, দ্বাদশাহ উপবাসের ফললাভ এবং অপরিমিত-কাল দেবতার ন্যায় স্বর্গবাস হয়। চতুর্থ পারণ সমাপন করিতে পারিলে, বাজপেয়যজ্ঞের ফললাভ হইয়া থাকে। যিনি পঞ্চম পারণ সমার্পন করেন, তাঁহার বাজপেয়যজ্ঞের দ্বিগুণফললাভ হয় এবং তিনি অনায়াসে নবোদিত ভাস্করসদৃশ প্রজ্বলিত পাবকতুল্য দিব্যবিমানে আরোহণপূর্ব্বক দেবগণের সহিত স্বর্গে গমন করিয়া ইন্দ্রভবনে অপরিমিতকাল অবস্থান করিতে পারেন। ষষ্ঠ পারণ সমাপন করিতে পারিলে, পঞ্চম পারণের ফল অপেক্ষা দ্বিগুণ এবং সপ্তম পারণ সমাপন করিতে পারিলে তদপেক্ষা তিন গুণ ফললাভ হয়। সপ্তমপারণসমাপনকর্ত্তা কৈলাসশিখরসদৃশ, বৈদূর্য্যমণিবেদিকাযুক্ত, মণিমুক্তাপ্রবালখচিত, অপ্সরাগণসমাকীর্ণ, দিব্যবিমানে আরোহণ করিয়া দ্বিতীয় দিবাকরের ন্যায় অনায়াসে সমুদয় লোক পরিভ্রমণ করিতে সমর্থ হয়েন। যিনি অষ্টম পারণ সমাপন করেন, তাঁহার রাজসূয়যজ্ঞের ফললাভ হয় এবং তিনি মনের ন্যায় বেগশালী, চন্দ্রকিরণসমবর্ণতুরঙ্গমযুক্ত, দিব্যাঙ্গ নাসমাকীর্ণ, পূর্ণচন্দ্রসদৃশ দিব্যবিমানে আরোহণ করেন ও অতিমনোহরমূৰ্ত্তি কামিনীগণের কমনীয় ক্রোড়ে নিদ্রাভিভূত হইয়া পুনরায় তাহাদিগের নূপুরধ্বনি ও মেখলা শব্দশ্রবণে জাগরিত হয়েন। যিনি নবম পারণ সমাপন করেন, তাঁহার যজ্ঞশ্রেষ্ঠ অশ্বমেধের ফললাভ হয় এবং তিনি কাঞ্চনময় স্তম্ভ, বৈদূর্য্যমণিময় বেদিকা ও সুবর্ণময় অতি উৎকৃষ্ট গবাক্ষযুক্ত, অপ্সরা ও গন্ধৰ্ব্বগণে সমাকীর্ণ দিব্যবিমানে আরোহণ করিয়া দেবলোকে গমনপূৰ্ব্বক দিব্যমাল্য, দিব্যবস্ত্র ও দিব্যগন্ধে বিভূষিত হইয়া দেবগণের সহিত স্বর্গসুখ সম্ভোগ করেন। যে ব্যক্তি দশম পারণ সমাপন করিয়া ব্রাহ্মণগণের পূজা করেন, তিনি কিঙ্কিণীজালজড়িত, ধ্বজপতাকাশোভিত, রত্নময় বেদি, বৈদূর্য্যময় তোরণ ও প্রবালময় বলভী[ছাত]সংযুক্ত, অপ্সরা ও গন্ধৰ্ব্বগণে সমাকীর্ণ বিমানে আরোহণপূৰ্ব্বক সুবর্ণবিভূষিত অনলবর্ণ দিব্যমুকুট, দিব্যচন্দন ও দিব্যমাল্যে বিভূষিত হইয়া পরমসুখে লোকসমুদয়ে বিচরণ করেন এবং একবিংশতি সহস্র বৎসর গন্ধর্ব্বৰ্গণের সহিত ইন্দ্রালয়ে বাস করিয়া বহুদিন সূৰ্য্যলোক, চন্দ্রলোক ও শিবলোকে অবস্থানপূর্ব্বক পরিশেষে বিষ্ণুর সালোক্য প্রাপ্ত হয়েন।

আমার উপাধ্যায় মহর্ষি বেদব্যাস কহিয়াছেন যে, শ্রদ্ধান্বিত হইয়া এইরূপে ভরতশ্রবণ করিলে নিশ্চয়ই এইরূপ ফললাভ হয়। পাঠকালে পাঠককে হস্তী, অশ্ব প্রভৃতি বিবিধ বাহন, রথাদি যানসমুদয়, কটক, কুণ্ডল, ব্রহ্মসূত্র [যজ্ঞসূত্রপৈতা], বিচিত্র বস্ত্র ও গন্ধদ্রব্য প্রদান করিয়া দেবতার ন্যায় তাঁহার পূজা করিলে বিষ্ণুলোকলাভ হয়।

পর্ব্বানুষ্ঠান নির্ণয়

অতঃপর প্রত্যেক পৰ্ব্বে ক্ষত্রিয়দিগের জাতি, দেশ, সত্য, মাহাত্ম ও ধর্ম্ম প্রভৃতি শ্রবণ করিয়া ব্রাহ্মণগণকে যেসমুদয় দ্রব্য প্রদান করিতে হয়, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। প্রথমতঃ ব্রাহ্মণগণদ্বারা স্বস্তিবাচনপূৰ্ব্বক কাৰ্য্য আরম্ভ করিয়া পরিশেষে পর্ব্ব সমাপ্ত হইলে, সাধ্যানুসারে তাঁহাদের পূজা করা কর্ত্তব্য।

আদিপর্ব্ব পাঠসময়ে শাস্ত্রানুসারে পাঠককে গন্ধ ও বস্ত্র প্রদানপূৰ্ব্বক উৎকৃষ্ট মধু ও পায়স ভোজন করাইবে। আস্তীকপৰ্ব্বপাঠসময়ে ঘৃত, মধু ও ফলমূলযুক্ত পায়স ও গুড়ৌদন[চাউল-গুড়যোগে প্রস্তুত নাড়ু-বিবাহাদি শুভকার্য্যেও গুড়ৌদন প্রস্তুত করা হয়। বিবাহাদি কার্য্যে প্রস্তুত ঐ প্রকার নাড়ুর নাম— আনন্দনাড়ু।], অপূপ [পিষ্ঠক-পিঠে] ও মোদক [নারিকেলনাড়ু, খই-এর মোয়া প্রভৃতি] দ্বারা পাঠকের ভোজন সম্পাদন করা কর্ত্তব্য। সভাপৰ্ব্বপাঠসময়ে ব্রাহ্মণগণকে হবিষ্যান্ন ভোজন করাইবে। আরণ্যকপৰ্ব্বপাঠসময়ে ফলমূলাদিদ্বারা ব্রাহ্মণগণের তৃপ্তিসাধন এবং অরণীপৰ্ব্ব আরম্ভ হইলে ব্রাহ্মণদিগকে পূর্ণকুম্ভ, ধান্য, ফলমূল ও অন্ন প্রদান করা উচিত। বিরাটপর্ব্বপাঠসময়ে ব্রাহ্মণগণকে বিবিধ বস্ত্র; উদযোগপৰ্ব্ব আরম্ভ হইলে, তাঁহাদিগকে গন্ধমাল্যাদিদ্বারা বিভূষিত করিয়া অভিলাষানুরূপ আহার; ভীষ্মপৰ্ব্বপাঠসময়ে উৎকৃষ্ট যান ও সুসংস্কৃত অন্ন; দ্রোণপৰ্ব্ব পাঠসময়ে অতি উৎকৃষ্ট ভোজ্যদ্রব্য, শয্যা, শরাসন ও খড়গ; কর্ণপৰ্ব্বপাঠসময়ে অভিলাষানুরূপ উৎকৃষ্ট ভোজ্যদ্রব্য; শল্যপপাঠসময়ে গুড়ৌদন, মোদক, অপূপ ও বিবিধ অন্ন; গদাপৰ্ব্বপাঠসময়ে মুদগ[৬]মিশ্রিত অন্ন; ঐষিকপৰ্ব্বপাঠসময়ে ঘৃতান্ন এবং স্ত্রীপর্ব্বপাঠসময়ে বিবিধ রত্ন প্রদান করা কর্ত্তব্য। শান্তিপর্ব্ব পাঠসময়ে ব্রাহ্মণগণকে সর্ব্বগুণসমন্বিত হবিষ্যান্ন ভোজন করাইরে। অশ্বমেধপৰ্ব্বপাঠসময়ে অভিলাষানুরূপ ভোজ্যদ্রব্য প্রদান করিবে। আশ্রমবাসিকপপাঠসময়ে হবিষ্যান্ন ভোজন করাইবে। মৌষলপপাঠসময়ে চন্দনাদি ও মহাপ্রস্থানিকপৰ্ব্বপাঠসময়ে অভিলাষানুরূপ ভোজ্যদ্রব্য প্রদান করা উচিত। স্বর্গপৰ্ব্বপাঠসময়ে ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্যান্ন ভোজন করাইবে এবং হরিবংশ [হরিবংশ, মহাভারতের অষ্টাদশ পৰ্ব্বতিরিক্ত পরিশিষ্টস্থানীয় পৃথক্ গ্রন্থ। ভারতপাঠান্তে উহা পাঠ্য] সমাপন হইলে সহস্র ব্রাহ্মণ ভোজন করাইয়া প্রত্যেক ব্রাহ্মণকে এক এক নিষ্ক[স্বর্ণমুদ্রা—মোহর]সংযুক্ত এক-একটি গাভী ও দরিদ্রদিগকে অর্দ্ধনিষ্কসংযুক্ত এক-একটি গাভী প্রদান করিবে। সমুদয় পর্ব্ব সমাপ্ত হইলে সুন্দর-অক্ষরযুক্ত একখণ্ড মহাভারত পাঠককে প্রদান করা এবং হরিবংশপৰ্ব্বসমাপনসময়ে তাঁহাকে পায়সভোজন করান অবশ্য কর্ত্তব্য।

পাঠকের লক্ষণ ও তদুদ্দেশ্যে দানাদি মাহাত্ম্য

শাস্ত্রকোবিদ ব্যক্তি সৰ্ব্বলক্ষণসম্পন্ন পাঠকদ্বারা সমুদয় মহাভারত-সংহিতা পাঠ করাইয়া ক্ষৌম বা শুক্লবস্ত্র, মাল্য ও অলঙ্কার ধারণপূৰ্ব্বক সংযতচিত্তে পবিত্রস্থানে উপবেশন করিয়া গন্ধমাল্যদ্বারা মহাভারতপুস্তকের অর্চ্চনা, ব্রাহ্মণগণকে যথোচিত সৎকারসহকারে প্রভূত সুবর্ণ দক্ষিণা ও বিবিধ অন্নপানীয় প্রদান, এবং নর, নারায়ণ ও অন্যান্য দেবগণের নাম কীৰ্ত্তন করিবেন। এইরূপ কার্য্যানুষ্ঠান করিলে তাহার অতিরাত্র-যজ্ঞের ফললাভ হয়, সন্দেহ নাই।

এই মহাভারতের এক এক পৰ্ব্ব পাঠ সমাপ্ত হইলে শ্রোতার এক এক যজ্ঞের ফললাভ হইয়া থাকে। পাঠক উৎকৃষ্ট স্বরসংযোগসহকারে স্পষ্ট স্পষ্ট শব্দসমুদয় উচ্চারণ করিয়া মহাভারত পাঠ করিবেন। ভারতপাঠ সমাপ্ত হইলে ব্রাহ্মণদিগকে ভোজন করাইয়া অলঙ্কারাদি প্রদানদ্বারা পাঠককে পরিতুষ্ট করা শ্রোতার অবশ্য কর্ত্তব্য। পাঠকের তুষ্টিলাভ হইলে শ্রোতার উৎকৃষ্ট প্রীতিলাভ হয় এবং ব্রাহ্মণগণ পরিতুষ্ট হইলে দেবগণ তাঁহার প্রতি সুপ্রসন্ন হইয়া থাকেন। অতএব ধর্ম্মপরায়ণ মহাত্মারা ভারতপাঠাবসানে বিবিধ বস্তু প্রদানপূর্ব্বক ব্রাহ্মণগণকে পরিতুষ্ট করিবেন।

এই আমি আপনার নিকট ভারত শ্রবণ ও কীৰ্ত্তনের বিধি সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে আপনি শ্রদ্ধান্বিত হইয়া আমার উপদেশানুরূপ কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হউন। যে ব্যক্তি শ্ৰেয়োলাভের বাসনা করেন, তাঁহার সর্ব্বদা যত্নপূৰ্ব্বক মহাভারত শ্রবণ ও শ্রবণান্তে পারণ করা আবশ্যক। নিয়ত মহাভারত শ্রবণ ও কীৰ্ত্তন করা ধর্ম্মপরায়ণ মানবগণের অবশ্য কর্ত্তব্য।

যে ব্যক্তির গৃহে মহাভারতপুস্তক থাকে, জয় তাঁহার হস্তগত হয়, সন্দেহ নাই। ভারতের তুল্য পবিত্র ও পবিত্রতাজনক আর কিছুই নাই। ভারতমধ্যে বিবিধ পবিত্র কথা সন্নিবেশিত রহিয়াছে। দেবগণ সৰ্ব্বদা ভারতের উপাসনা করিয়া থাকেন। ভারতই পরমপদস্বরূপ। ভারত অপেক্ষা উৎকৃষ্ট শাস্ত্র আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না। ভারত হইতে মোক্ষলাভে সমর্থ হওয়া যায়। যে ব্যক্তি মহাভারত, ক্ষিতি, গো, সরস্বতীনদী, বাসুদেব ও ব্রাহ্মণগণের নাম কীৰ্ত্তন করেন, তাঁহাকে কখনই অবসন্ন হইতে হয় না। পরমপবিত্র বেদ, রামায়ণ ও মহাভারতের আদি, অন্ত ও মধ্য সর্ব্বত্রই হরিনাম কীৰ্ত্তিত রহিয়াছে। যাহাতে বিষ্ণুকথা ও বেদবাক্য সন্নিবেশিত আছে এবং যাহা পরমপবিত্র, ধর্ম্মের আকর ও সর্ব্বগুণসম্পন্ন, সেই ভারতসংহিতা শ্রবণ করা পরমপদাকাঙ্ক্ষী মানবগণের অবশ্য কর্ত্তব্য। যেমন সূর্য্যোদয় হইলে তিমিররাশি বিনষ্ট হয়, তদ্রূপ বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ হইয়া ভারতকথা শ্রবণ করিলে কায়িক, মানসিক ও বাচনিক এই ত্রিবিধ পাপ ধ্বংস হইয়া যায়। বিষ্ণুভক্তিপরায়ণ মহাত্মারা অষ্টাদশপুরাণ শ্রবণের ফললাভে সমর্থ হয়েন, সন্দেহ নাই। কি স্ত্রী, কি পুরুষ, যে হউক না কেন, বিষ্ণুভক্ত হইলেই বৈষ্ণ পদ লাভ করিতে পারে। কামিনীগণ পুত্রলাভবাসনায় এই বিষ্ণুকথাত্মক মহাভারত শ্ৰবণ করিবেন। যে ব্যক্তি উন্নতিলাভের নিমিত্ত হরিকথা শ্রবণ করেন, পাঠককে যথাশক্তি সুবর্ণ, সুবর্ণমণ্ডিতশৃঙ্গযুক্তা সবৎসা কপিলা ধেনু, অলঙ্কার, কর্ণাভরণ ও ভূমি দক্ষিণা প্রদান করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য।

যে ব্যক্তি নিরন্ত্রর মহাভারত শ্রবণ করেন অথবা অন্যকে উহা শ্রবণ করান, তিনি সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হইয়া বিষ্ণুপদ লাভ করিতে সমর্থ হয়েন এবং তাঁহার ঊর্দ্ধতন একাদশ পুরুষ ও পুত্ৰকলত্রের নিষ্কৃতিলাভ হইয়া থাকে। এই পবিত্র ইতিহাসের পাঠকাৰ্য্য সমাপ্ত হইলে দশসহস্র হোম করা নিতান্ত আবশ্যক। হে মহারাজ! এই আমি আপনার নিকট সমুদয় ভারতোপাখ্যান সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।

স্বর্গারোহণিকপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত

 [←1]

 ১। ক্ষত্রিয়ের অশৌচ দ্বাদশ দিন। ব্রাহ্মণের যেমন দশ দিনে অশৌচান্ত হইয়া একাদশ দিনে শ্রাদ্ধ হয়, ক্ষত্রিয়েরও তদ্রূপ দ্বাদশ দিনে অশৌচান্ত হইয়া এয়োদশ দিনে শ্রাদ্ধ হওয়া উচিত। দ্বাদশ দিনে শ্রাদ্ধ হইতে পারে না, কারণ, ঐ দিনের রাত্রি পর্য্যন্ত অশৌচ থাকে। মূল বচনেও আছে— “দ্বাদশেহনি তেভ্যঃ স কৃতশৌচো নরাধিপঃ। দদৌ শ্রাদ্ধানি বিধিরদ্দক্ষিণাবন্তি পাণ্ডবঃ।” বচনে যে ‘বিধিবদ’ বাক্য আছে, উহার অর্থ যথাবিধি। ঐ ‘যথাবিধি’ শব্দদ্বারা শ্রাদ্ধ ত্রয়োদশ দিনে করা হইয়াছিল, ইহাই বুঝিতে হইবে। বঙ্গানুবাদের ‘পবিত্র হইয়া’ কথায়ও দ্বাদশ দিনের অশৌচান্ত স্নানে পবিত্র হইয়া এইরূপই বুঝা যায়।

[←2]

নখ ও কেশসংসৃষ্ট জল, বস্ত্রাঞ্চলের জল এবং কলসীর মুখস্থিত জল ঐ নষ্ট করে। নখ ও কেশসংসৃষ্ট জলের দোষ সহজেই অনুমেয়। পরিহিত বস্ত্র শরীরের দোষ আকর্ষণ করে, সেই দুষ্ট জল অঞ্চল দিয়া ঝরিয়া পড়ে; এ জন্য বস্ত্রাঞ্চল জল দুষ্ট। কলসীতে জল ভরিবার সময় কোন দুষ্ট পদার্থ তন্মধ্যে প্রবেশ করিলে উহা ভাসিয়া উঠিয়া কলসীর মুখে গিয়া স্থান লয়। এই জন্য কুম্বমুখস্থিত জল দুষ্ট। কলসী ভরার পর একটা ঝাঁকি দিয়া মুখের খানিকটা জল ফেলিয়া দেওয়ার রীতিও নারীমহলে দেখা যায়।

[←3]

বর্ণের উচ্চারণস্থান ৮টি—হৃদয়, কণ্ঠ, মস্তক, জিহ্বামূল, দন্ত, নাসিকা, ওষ্ঠ ও তালু। বর্ণ—শিবমতে প্রাকৃত ও সংস্কৃত উভয়ে মিলিয়া ৬৩টি। স্বরবর্ণ ২১টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ক হইতে হ পর্যন্ত ৩৩টি এবং যমবর্ণ ২টি ও যুগ্মবর্ণ ২টি; এতদ্‌ভিন্ন অনুস্বার, বিসর্গ, জিহ্বামূলীয়, উপাধ্যানীয় এবং প্লুত—এই পাঁচটি। তন্ত্রে পঞ্চাশটি বর্ণের পরিচয় ‘পঞ্চাশল্লিপিভি’, ইত্যাদি প্রমাণদ্বারা পাওয়া যায়। তাহাতে স্বরবর্ণ বলা হইয়াছে ১৪টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ৩৩, অতিরিক্ত লকার এবং অনুস্বার ও বিসর্গ। উক্ত মতদ্বয়ের মধ্যে শিবোক্ত অতিরিক্ত স্বর সাতটি ও যম-যুগ্মবর্ণ চারটি এইমাত্র প্রভেদ। শিবোক্ত অতিরিক্ত স্বর সাতটি, যথা—প্রণব ওঁ দীর্ঘপ্রণব ঔ ও চন্দ্রবিন্দু ৩। অনুস্বার বা চন্দ্রবিন্দুস্থানীয় ৪; অনুস্বারের পর শ, ষ, স, হ থাকিলে এক প্রকার বর্ণের উৎপত্তি হয়, সাধারণতঃ উহার উচ্চারণ – ‘গূ’ এই আকারের হইয়া থাকে। যমবর্ণ ড়, ঢ় ২; যুগ্মবর্ণ ৎস হস ২।

কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত “মহাভারত” সমাপ্ত