৫. কৌরবাদির স্ব স্ব কৰ্ম্মগত গতিসাফল্য

কৌরবাদির স্ব স্ব কৰ্ম্মগত গতিসাফল্য

জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্‌! মহাত্মা ভীষ্ম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র, বিরাট, দ্রুপদ, শঙ্খ, উওর, ধৃষ্টকেতু, জয়ৎসেন, সত্যজিৎ, দুর্য্যোধনের পুত্রগণ, শকুনি, কর্ণের মহাবলপরাক্রান্ত পুত্রগণ, জয়দ্ৰথ, ঘটোৎকচ প্রভৃতি মহাবীরগণ ও অন্যান্য ভূপালসমুদয় কতকাল স্বর্গভোগ করিয়াছিলেন? উঁহারা কি ভোগাবসানে স্ব স্ব প্রকৃতিতে লীন হইয়াছিলেন অথবা তাঁহাদের অন্য গতিলাভ হইয়াছিল? ইহা শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। তপঃপ্রভাবে আপনার কিছুই অবিদিত নাই, অতএব আপনি ঐ সমুদয় আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! কৰ্ম্মভোগের অবসানে সকলেই যে স্ব স্ব প্রকৃতি লাভ করিতে পারে, এরূপ নহে। এক্ষণে অগাধবুদ্ধিসম্পন্ন সৰ্ব্বতত্ত্বজ্ঞ ভগবান্ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন আমার নিকট সংগ্ৰামনিহত বীরগণের মধ্যে যাহার যেরূপ গতি কীৰ্ত্তন করিয়াছিলেন, আমি সেই দেবগুহ্য বিষয় আনুপূর্ব্বিক আপনার নিকট কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন।

মহাত্মা ভীষ্ম বসুগণের লোক লাভ, দ্রোণ বৃহস্পতির শরীরে প্রবেশ, কৃতবর্ম্মা মরুদগণের মধ্যে প্রবেশ, প্রদুম্ন সনৎকুমারের শরীরে প্রবেশ, অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর সহিত কুবেরলোক লাভ, মাহাত্মা পাণ্ডু কুন্তী ও মাদ্রীর সহিত ইন্দ্রলোক এবং মহারাজ বিরাট, ধ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, নিশঠ, অক্রূর, শাম্ব, ভানু, কম্প, বিদূরথ, ভূরিশ্রবা, শল, ভূরি, কংস, উগ্রসেন, বসুদেব, উত্তর ও শঙ্খ বিশ্বদেবগণের শরীরে প্রবেশ করিয়াছেন। ভগবান্ চন্দ্রের পুত্র মহা বর্চ্চা অৰ্জ্জুনের পুত্র হইয়া জন্মগ্রহণপূৰ্ব্বক অভিমন্যুনামে বিখ্যাত হয়েন। তিনি ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মানুসারে ঘোরতর সংগ্রামে কলেবর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরিশেষে চন্দ্রের শরীরে প্রবিষ্ট হইয়াছেন।

মহাবীর কর্ণ সূৰ্য্যের, শকুনি দ্বাপরের ও ধৃষ্টদ্যুম্ন অনলের শরীরে প্রবেশ করিয়াছেন। ধৃতরাষ্ট্রের দুৰ্য্যোধন ভিন্ন অন্যান্য পুত্র রাক্ষসগণের অংশে জন্মগ্রহণ করে। তাহারা শস্ত্রপূত হইয়া স্বর্গলাভ করিয়াছে। মহাত্মা বিদুর ও ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ধৰ্ম্মে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। বলদেব অনন্তরূপী হইয়া রসাতলে গমন করিয়াছেন। উনি সৰ্ব্বলোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মার আদেশানুসারে প্রতিনিয়ত পৃথিবী ধারণ করিতেছেন। সনাতন নারায়ণের অংশে যাঁহার জন্ম হইয়াছিল, সেই মহাত্মা বাসুদেব নারায়ণে প্রবিষ্ট হইয়াছেন। তাঁহার ষোড়শসহস্র বনিতাও কালক্রমে সরস্বতীজলে নিমগ্ন হইয়া কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক অপ্সরাবেশে তাঁহার সহিত মিলিত হইয়াছেন।

যুদ্ধমৃত কুরু-পাণ্ডবসৈন্যগণের গতি

ভীষণ সংগ্রামে ঘটোৎকচ প্রভৃতি যেসমুদয় রাক্ষস ও যেসমুদয় মহাবীর নিহত হইয়াছিলেন, তাঁহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ দেবলোক ও কেহ কেহ যক্ষলোক লাভ করিয়াছেন। দুর্য্যোধনের অনুগত নিশাচরদিগেরও ইন্দ্রলোক, কুবেরলোক ও বরুণলোক প্রভৃতি উৎকৃষ্ট লোকসমুদয় লাভ হইয়াছে।

হে মহারাজ! এই আমি আপনার নিকট কৌরব ও পাণ্ডবগণের চরিত্র আদ্যোপান্ত সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।

সৌতি কহিলেন, হে মহর্ষিগণ! সর্পসত্রাবসানে [সর্পযজ্ঞ সমাপনান্তে] মহারাজ জনমেজয় ভগবান্ বৈশম্পায়নের মুখে এইরূপ ভারত-ইতিহাস শ্রবণ করিয়া যারপরনাই বিস্ময়াপন্ন হইলেন। অনন্তর তাঁহার যাজকগণ সেই যজ্ঞের অবশিষ্ট কার্য্যসমুদয় সমাপন করিলেন। ঐ সময় মহর্ষি আস্তীক ভুজঙ্গমদিগের মুক্তিলাভনিবন্ধন পরম পরিতুষ্ট হইলেন এবং ব্রাহ্মণগণ প্রভূত দক্ষিণা ও যথোচিত সম্মান লাভ করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন। মহারাজ জনমেজয় এইরূপে যজ্ঞ সমাপন ও ভারত শ্রবণ করিয়া পরিশেষে সেই তক্ষশিলা হইতে হস্তিনায় প্রত্যাগমন করিলেন।

ফলশ্রুতি—মহাভারতের মাহাত্ম্য

হে মহর্ষিগণ! এই আমি আপনাদিগের নিকট ব্যাসের আজ্ঞায় বৈশম্পায়নকর্ত্তৃক কীৰ্ত্তিত পবিত্র ভারতোপাখ্যান সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম। ইহার তুল্য পবিত্র ইতিহাস আর কিছুই নাই। সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, সাঙ্খযোগবেত্তা, অণিমাদি ঐশ্বৰ্য্যসম্পন্ন, সৰ্ব্বজ্ঞ, ধৰ্ম্মজ্ঞানবিশারদ, ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন মহাত্মা পাণ্ডব ও অন্যান্য ক্ষত্রিয়গণের কীৰ্ত্তি বিস্তার করিবার নিমিত্ত দিব্যজ্ঞানপ্রভাবে এই অপূৰ্ব্ব ইতিহাস রচনা করিয়া গিয়াছেন।

যে ব্যক্তি পৰ্ব্বে পৰ্ব্বে এই পবিত্র ইতিহাস অন্যকে শ্রবণ করান, তিনি পাপনির্ম্মুক্ত হইয়া ব্রহ্মের স্বরূপত্ব লাভ করিতে পারেন। যে ব্যক্তি সমাহিত হইয়া এই বেদব্যাস-প্রণীত ভারতোপাখ্যান শ্রবণ করেন, তাঁহার কোটি কোটি ব্রহ্মহত্যাদি পাপ বিনষ্ট হইয়া যায়। যে ব্যক্তি শ্রাদ্ধকালে ব্রাহ্মণগণকে ইহার কিয়দংশমাত্র শ্রবণ করান, তাঁহার পিতৃগণ অক্ষয় অন্নপান লাভ করিয়া থাকেন। ব্রাহ্মণ দিবসে মন ও ইন্দ্রিয়গণদ্বারা বিবিধ পাপকার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া সায়ংসন্ধ্যাসময়ে ভক্তিপূৰ্ব্বক ইহার অল্পাংশমাত্র পাঠ করিলে অনায়াসে দিনকৃত পাপ হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারেন; আর তিনি রাত্রিযোগে স্ত্রীসংসর্গনিবন্ধন যে পাপকার্য্যের অনুষ্ঠান করেন, প্রাতঃসন্ধ্যাসময়ে ইহার কিয়দংশমাত্র পাঠ করিলে তাঁহার সেই রাত্রিকৃত পাপ বিনষ্ট হইয়া যায়।

এই পবিত্র ইতিহাস সর্ব্বাপেক্ষা মহৎ ও ইহাতে ভরতবংশীয়দিগের চরিত্র কীৰ্ত্তিত আছে বলিয়া ইহার নাম মহাভারত হইয়াছে। যে ব্যক্তি এই মহাভারতের অর্থসমুদয় পরিজ্ঞাত হইতে পারেন, তিনি সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হয়েন। এই মহাভারতে ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ চারিবৰ্গই বর্ণিত হইয়াছে। ইহাতে যাহা আছে, তাহা অনুসন্ধান করিলে অন্যত্র প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে; কিন্তু ইহাতে যাহা নাই, তাহা আর কুত্রাপি নাই। মোক্ষাভিলাষী ব্রাহ্মণ, রাজা ও গর্ভবতী স্ত্রীর এই জয়াখ্য পবিত্র ইতিহাস শ্রবণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। ইহা শ্রবণ করিলে স্বৰ্গকামীদিগের স্বর্গ, জয়াকাঙ্ক্ষীদিগের জয় এবং, গর্ভবতী রমণীদিগের পুত্র বা সৌভাগ্যবতী কন্যা লাভ হইয়া থাকে।

মহাভারত-শ্লোকসংখ্যা—প্রকাশ-পারম্পর্য্য

মোক্ষলাভার্থী সিদ্ধপুরুষ মহাত্মা বেদব্যাস ধৰ্ম্মকামনায় ষষ্টিলক্ষ শ্লোক রচনা করিয়া এই মহাভারত-সংহিতা প্রস্তুত করেন। ঐ ষষ্টিলক্ষ শ্লোকের মধ্যে দেবলোকে ত্রিংশৎ লক্ষ, পিতৃলোকে পঞ্চদশ লক্ষ ও যক্ষলোকে চতুর্দ্দশ লক্ষ শ্লোক বিদ্যমান রহিয়াছে। এই মনুষ্যলোকে উহার একলক্ষ মাত্র শ্লোক বর্ত্তমান আছে। পূর্ব্বে দেবর্ষি নারদ দেবগণকে, অসিতদেবল পিতৃগণকে, মহাত্মা শুকদেব রাক্ষস ও যক্ষদিগকে এবং মহর্ষি বৈশম্পায়ন মনুষ্যদিগকে এই ইতিহাস শ্রবণ করাইয়াছিলেন। যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণগণকে অগ্রসর করিয়া এই ব্যাসোক্ত বেদসম্মিত পবিত্র ইতিহাস শ্রবণ করান, তিনি ইহলোকে সুখসম্ভোগ ও কীৰ্ত্তিলাভ করিয়া চরমে পরমা সিদ্ধি লাভ করিতে পারেন, সন্দেহ নাই। যে ব্যক্তি ভগবান্ বেদব্যাসের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হইয়া মহাভারতের কিয়দংশ মাত্র অন্যকে শ্রবণ করান, তাঁহারও পরমসিদ্ধিলাভ হইয়া থাকে।

পূর্ব্বে ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়ন স্বীয় পুত্র শুকদেবকে এই ভারতসংহিতা অধ্যয়ন করাইয়াছিলেন। এই মহাভারতমধ্যে কীৰ্ত্তিত আছে যে, “মনুষ্যগণ এই সংসারমধ্যে অসংখ্য মাতা, পিতা ও পুত্ৰকলত্রের সহিত মিলিত ও তাহাদের বিয়োগে দুঃখিত হইয়া থাকে। এই সংসারে সহস্র সহস্র হর্ষের কারণ ও শত শত ভয়ের কারণ বিদ্যমান আছে। ঐ সমুদয় প্রতিনিয়ত মূঢ় ব্যক্তিদিগকেই আক্রমণ করিয়া থাকে; পণ্ডিতদিগের নিকট কখনই আগমন করিতে পারে না। আমি ঊৰ্দ্ধবাহু হইয়া বৃথা রোদন করিতেছি, কেহই আমার বাক্য শ্রবণ করিতেছে না। ধৰ্ম্মোপার্জ্জনের নিমিত্তই অর্থ ও কামে লিপ্ত হওয়া মনুষ্যের কর্ত্তব্য। কাম, ভয়, লোভ বা জীবনরক্ষার নিমিত্ত ধর্ম্ম পরিত্যাগ করা কখনই কর্ত্তব্য নহে। ধর্ম্ম ও জীব নিত্য এবং সুখ-দুঃখ ও জীবের উপাধি-শরীর অনিত্য বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি প্রাতঃকালে গাত্রোত্থান করিয়া পবিত্রচিত্তে মহাভারতের এই অংশটি পাঠ করেন, তিনি নিশ্চয়ই পরমসিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন। সমুদ্র ও হিমাচলের ন্যায় এই মহাভারতও রত্ননিধি [রত্নের আকর—স্থূলরত্ন মণিমাণিক্যাদি থাকে সাগর ও পর্ব্বত প্রভৃতি স্থানে; আর মহাভারতে আছে জ্ঞানরত্ন; তাই মহাভারত জ্ঞানরত্নের আকর; রত্নকামনায় শ্রবণ করিলেও মহাভারতমাহাত্ম্যে তাঁহার ত আনুষঙ্গিক লাভ হয়ই—বিশেষতঃ জ্ঞানরত্নই লাভ হয়।] বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। যিনি সমাহিতচিত্তে এই পবিত্র ইতিহাস পাঠ করেন, তাঁহার নিশ্চয়ই পরমসিদ্ধিলাভ হয়। যে মহাত্মা ভগবান কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ওষ্ঠপুটবিনিঃসৃত [অধরোষ্ঠবিনির্গত] পাপনাশন পরমপবিত্র ভারতকথা শ্রবণ করেন, তাঁহার আর পুষ্করজলে [পুষ্করতীর্থজলে—পুষ্কর হ্রদে] অভিষিক্ত হইবার আবশ্যক কি?