২. যুধিষ্ঠিরের কর্ণাদি ভ্রাতৃদৰ্শন-বাসনা

যুধিষ্ঠিরের কর্ণাদি ভ্রাতৃদৰ্শন-বাসনা

বৈশম্পায়ন বলিলেন, ধর্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মতনয় দেবর্ষি নারদকে এই কথা কহিয়া দেবগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে সুরগণ! আমি ত’ এস্থানে অমিতপরাক্রম রাধেয় এবং মহাবীর উত্তমৌজা ও যুধামন্যুকে দেখিতে পাইতেছি না। তাঁহারা কোথায়? আর শার্দ্দূলতুল্য মহাবলপরাক্রান্ত যেসকল নরপতি ও রাজপুত্রগণ আমার নিমিত্ত সমরানলে শরীর আহুতি প্রদান করিয়াছেন, এক্ষণে তাঁহারাই বা কোন্ স্থানে অবস্থান করিতেছেন? তাঁহারা কি এই স্বর্গালোকপরাজয়ে সমর্থ হয়েন নাই? যদি সেই মহারথগণ এই স্বর্গলোক লাভ করিয়া থাকেন, তাহা হইলে আমি তাঁহাদিগের সহিত এই স্থানেই অবস্থান করিব। আমি সেইসমুদয় মহাত্মা এবং জ্ঞাতি ও ভ্রাতৃগণ ব্যতীত এ স্থানে বাস করিতে বাসনা করি না। জ্ঞাতিগণের উদকক্রিয়াসময়ে ‘বৎস! তুমি কর্ণের উদ্দেশে জলাঞ্জলি প্রদান কর’, মাতার এই বাক্যশ্রবণাবধি আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। বিশেষতঃ এই আমার এক মহাদুঃখের কারণ যে, আমি মাতারতুল্য [মাতার চরণযুগল তুল্য] সেই অমিতপরাক্রম কর্ণের চরণযুগল দর্শন করিয়াও তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করিলাম না। আমরা কর্ণের সহিত মিলিত হইয়া সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলে ইন্দ্রও আমাদিগকে পরাজিত করিতে সমর্থ হইতেন না। যাহা হউক, এক্ষণে সেই মহাবীর যেখানে অবস্থান করুন না কেন, তাঁহাকে দর্শন করিতে আমার নিতান্ত বাসনা হইতেছে। আমার মতানুসারে মহাবীর অর্জ্জুন তাঁহাকে নিপাতিত করিয়াছে বলিয়া আমার হৃদয় শোকানলে দগ্ধ হইতেছে। ভীমপরাক্রম ভীমসেন আমার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর; এক্ষণে আমি সেই বৃকোদর, ইন্দ্রপ্রতিম মহাবীর অর্জ্জুন, যমসদৃশ যমজ নকুল ও সহদেব এবং ধর্ম্মচারিণী পাঞ্চালীকে দর্শন করিতে বাসনা করি। আমি আপনাদিগকে সত্য কহিতেছি, আর আমার এ স্থানে অবস্থান করিবার বাসনা নাই। ভ্রাতৃবিহীন হইয়া স্বর্গে অবস্থান করিলে আমার কি সুখোদয় হইবে? যে স্থানে আমার ভ্রাতৃগণ অবস্থান করিতেছে, সেইখানই আমার স্বর্গ।”

যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতৃগণদর্শন-প্রসঙ্গে নরকদর্শন

ধর্ম্মাত্মা ধৰ্ম্মনন্দন এই কথা কহিলে, দেবগণ তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “বৎস! যদি তোমার ভ্রাতৃগণের নিকট গমন করিবার একান্ত বাসনা হইয়া থাকে, তাহা হইলে শীঘ্ৰ তথায় গমন কর, আর বিলম্ব করিও না। আমরা সুরপতি ইন্দ্রের আদেশানুসারে তোমার সমুদয় অভিলাষ পরিপূর্ণ করিব।” এই কথা বলিয়া তাঁহারা একজন দেবদূতকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “দূত! তুমি অচিরাৎ যুধিষ্ঠিরকে উঁহার আত্মীয়গণের নিকট নীত করিয়া তাঁহাদের সহিত উহার সাক্ষাৎকার করাও।” দেবগণ এই কথা কহিবামাত্র দেবদূত যুধিষ্ঠিরের অগ্রবর্ত্তী হইয়া এক অতি ভীষণ পথ দিয়া তাঁহাকে আত্মীয়গণের নিকট লইয়া চলিলেন। ঐ পথ অতি দুর্গম ও ঘোরতর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। পাপাত্মারাই সতত ঐ পথে গমনাগমন করিয়া থাকে। উহা পাপাত্মাদিগের দুর্গন্ধ, মাংসশোণিতের কর্দ্দম, দংশ, মশক, ভল্লুক, মক্ষিকা, মৃতদেহ, অস্থি, কেশ, কৃমি ও কীটে পরিপূর্ণ। উহার চতুর্দ্দিকে প্রদীপ্ত হুতাশন প্রজ্বলিত হইতেছে। অয়োমুখ [লৌহতুল্য তীক্ষ্ণমুখ] কাক ও গৃধ্রুগণ এবং সূচিমুখ পর্ব্বতাকার প্রেতগণ উহাতে নিরন্তর পরিভ্রমণ করিতেছে। ঐ প্রেতগণের মধ্যে কাহার কাহার কলেবর মেদ ও রুধিরে লিপ্ত এবং কাহার কাহার বাহু, কাহার কাহার ঊরু, কাহার কাহার হস্ত, কাহার কাহার উদর ও কাহার কাহার চরণ ছিন্ন।

ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই শবদুর্গন্ধযুক্ত অতি ভয়ঙ্কর স্থানে নানা প্রকার চিন্তা করিয়া গমন করিতে করিতে দেখিলেন, উষ্ণোদক পরিপূর্ণ নদী, নিশিত [শাণিত] ক্ষুরসমাকীর্ণ অসিপত্রবন [অস্ত্রের ন্যায় ধারালপত্রযুক্ত বন], লৌহময় ফলকসমুদয় ও তীক্ষ্ণকণ্টকযুক্ত শাল্মলিবৃক্ষ [শিমুলগাছ] ঐ স্থানে বর্ত্তমান রহিয়াছে; চতুর্দ্দিকে লৌহকলসপরিপূর্ণ তৈল ক্কাথিত [জ্বাল দেওয়া—অতি উষ্ণ] হইতেছে এবং পাপাত্মারা নিরন্তর বিষম যন্ত্রণাভোগ করিতেছে। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই নিতান্ত দুর্গম স্থান দর্শন করিয়া দেবদূতকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহাত্মন্! আর আমাদিগকে এরূপ পথে কত দূর গমন করিতে হইবে? ইহা কোন্ স্থান এবং আমার ভ্রাতৃগণই বা কোন্ স্থানে অবস্থান করিতেছে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”

ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিবামাত্র দেবদূত প্রতিনিবৃত্ত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “রাজন্‌! আগমনকালে দেবগণ আমাকে এই আদেশ দিয়াছেন যে, যুধিষ্ঠির যে স্থানে গমন করিয়া পরিশ্রান্ত হইবেন, তুমি তথা হইতে উঁহাকে লইয়া প্রতিনিবৃত্ত হইবে। অতএব আপনি যদি নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া থাকেন, তাহা হইলে এই স্থান হইতে প্রতিগমন করুন।” তখন দুঃখশোকসন্তপ্ত রাজা যুধিষ্ঠির ঐ স্থানের দুর্গন্ধে একান্ত পরিক্লিষ্ট হইয়া তথা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন। তিনি প্রতিনিবৃত্ত হইবামাত্র চতুর্দ্দিক হইতে এইরূপ করুণবাক্য তাঁহার কর্ণগোচর হইল যে, “হে ধৰ্ম্মনন্দন! আপনি আমাদিগের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়া মুহূৰ্তৰ্কাল এই স্থানে অবস্থান করুন। আপনার আগমনে সুগন্ধ পুণ্য-সমীরণ প্রবাহিত হওয়াতে আমরা পরমসুখী হইয়াছি। আমরা বহুকালের পর আপনাকে দর্শন করিয়া পরম আহ্লাদিত হইতেছি; অতএব আপনি ক্ষণকাল এই স্থানে অবস্থান করিয়া আমাদিগকে সুখী করুন। আপনার আগমনে আমাদিগের অনেক যন্ত্রণা দূর হইয়াছে।”

পরমদয়ালু, রাজা যুধিষ্ঠির সেই করুণবাক্য শ্রবণে একান্ত দুঃখিত হইয়া তথায় দণ্ডায়মান হইলেন। ঐ সময় বারংবার ঐরূপ বাক্য তাঁহার শ্রবণগোচর হইতে লাগিল; কিন্তু কোন কোন ব্যক্তি যে ঐ বাক্য প্রয়োগ করিতেছে, তিনি কোনমতে তাহা অবধারণ করিতে পারিলেন । তখন তিনি সেই পরিবেদনশীল [শোক] ব্যক্তিদিগকে উদ্দেশ করিয়া কহিলেন, “হে দুঃখাৰ্ত্ত ব্যক্তিগণ! তোমরা কে? আর কি নিমিত্তই বা এ স্থানে অবস্থান করিতেছ?”

নরকে পতিত ভীমাদি-দর্শনে যুধিষ্ঠিরের দুঃখ

ধর্ম্মরাজ এই কথা কহিবামাত্র তাঁহারা সকলেই একবারে চতুর্দ্দিক হইতে ‘আমি কর্ণ, আমি ভীমসেন, আমি অৰ্জ্জুন, আমি নকুল, আমি সহদেব, আমি ধৃষ্টদ্যুম্ন, আমি দ্রৌপদী এবং আমরা দ্রৌপদীর পুত্র এই বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতে লাগিলেন। তখন রাজা যুদ্ধিষ্ঠির তাঁহাদের বাক্য শ্রবণ করিয়া মনে মনে চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘হায়! কি দৈববিড়ম্বনা! আমার ভীমসেন প্রভৃতি ভাতৃগণ, কর্ণ, দ্রোপদী ও দ্রৌপদীর পুত্রগণ এমন কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছেন যে, উঁহাদিগকে এই পাপগন্ধযুক্ত ভীষণ স্থানে অবস্থান করিতে হইল। এই আমি ত’ ঐ পুণ্যাত্মাদিগের কোন দুষ্কৃত দেখিতে পাই না। এক্ষণে ধৃতরাষ্ট্রতনয় রাজা দুৰ্য্যোধন কি নিমিত্ত পাপপরায়ণ হইয়াও অধর্ম্মনিরত অনুচরগণের সহিত ইন্দ্রের ন্যায় সমৃদ্ধিসম্পন্ন পরম পূজিত হইয়া এই স্বর্গলোকে অবস্থান করিতেছে, আর আমার ভ্রাতৃগণই বা কি নিমিত্ত পরমধাৰ্ম্মিক, সত্যপরায়ণ, শাস্ত্রপারদর্শী ও ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মনিরত হইয়াও ঘোর নরকে নিমগ্ন হইয়াছে, আমি ইহার কিছুই নির্ণয় করিতে সমর্থ হইতেছি না। এ কি আমার নিদ্রিতাবস্থা, না জাগরিতাবস্থা? আমার কি চিত্তবিভ্রম উপস্থিত হইয়াছে?”

রাজা যুধিষ্ঠির শোকাকুলিতচিত্তে এইরূপ চিন্তা করিয়া, নিতান্ত ক্রুদ্ধ ও দেবগণকে নিন্দা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি সেই দেবদূতকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “ভদ্র! তুমি যাহাদিগের দূত, তাঁহাদিগের নিকট অচিরাৎ গমন করিয়া নিবেদন কর যে, আমি এই স্থানেই অবস্থান করিলাম। আমি আর তথায় গমন করি না; আমার দুঃখিত ভ্রাতৃগণ আমার আগমনে পরম আহ্লাদিত হইয়াছে।” ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির এই কথা কহিলে, দেবদূত দেবরাজ ইন্দ্রের নিকট গমন করিয়া তাঁহার অভিপ্রায়সমুদয় ব্যক্ত করিলেন।