৬০. বিদুরের দ্যূতদোষপ্ৰদৰ্শন

বিদুরের দ্যূতদোষপ্ৰদৰ্শন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, সেই সর্ব্বস্বপহারিণী দ্যূতক্ৰীড়া এইরূপ উত্তরোত্তর পরিবদ্ধিত হইলে সর্ব্বসংশয়চ্ছেদী বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! যেমন মুমূর্ষ ব্যক্তির ঔষধ-সেবনে মহতী অপ্ৰবৃত্তি জন্মে, তদুপ মদীয় উপদেশবাক্যে আপনার অভিরুচি হইবে না; তথাপি যাহা কহিতেছি, অবহিত হইয়া শ্রবণ করুন।”

পূর্ব্বে যে পাপাত্মা ভূমিষ্ঠ হইবামাত্র গোমায়ুর ন্যায় বিকৃত-স্বরে রোদন করিয়াছিল, সেই ভরত-কুলান্তক দুর্য্যেধন তোমাদের বিনাশের নিদানভূত সন্দেহ নাই! দুৰ্য্যোধনরূপী গোমায়ু গৃহে বাস করিতেছে, তুমি মোহবশতঃ তাহা বুঝিতে পারিতেছি না। হে মহারাজ! সুরাপ ব্যক্তি সুরাপান করিয়া যে পতিত হয়, সে কি তাহা জানিতে পারে? যেমন আকণ্ঠ মদ্যপান করিলে মত্ততাপ্রযুক্ত হয়ত জলে মগ্ন হয়, নতুবা কোনস্থানে নিপতিত হইয়া থাকে, সেইরূপ দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন দ্যূতমদে মত্ত হইয়াছে, মহারথ পাণ্ডবদিগের সহিত শত্রুতা করিয়া অচিরাৎ তাহার যে পতন হইবে, সে তাহা বুঝিতে পারিতেছে না। হে প্রাজ্ঞ! আমার বিদিত আছে, ভোজবংশীয় একজন রাজা পুরবাসিগণের হিতার্থ স্বীয় দুৰ্জাত পুত্রকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন এবং অন্ধক, যাদব ও ভোজ ইহারা কংসকে পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। পরে তাহাদিগের নিয়োগক্রমে কৃষ্ণ কর্তৃক কংস নিহত হইলে সেই সকল জ্ঞাতিবর্গ পরমহ্লাদে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। আপনিও অর্জ্জুনকে নিয়োগ করুন, তিনি পাপাত্মা দুৰ্য্যোধনের নিগ্ৰহ করিলে কৌরবেরা পরম-সুখে কালযাপন করিতে পারিবেন। কাকশৃগালতুল্য দুৰ্য্যোধনের পরিবর্তে ময়ূরশার্দুলসদৃশ পাণ্ডবদিগকে ক্ৰয় করুন। মহারাজ! আপনি শোকার্ণবে নিমগ্ন হইবেন না। শাস্ত্ৰে কথিত আছে, কুল রক্ষার্থে এক ব্যক্তিকে পরিত্যাগ করিবে, গ্রামরক্ষার্থে কুল পরিত্যাগ করিবে, জনপদরক্ষার্থে গ্রাম পরিত্যাগ করিবে এবং আত্মরক্ষার্থে পৃথিবী পরিত্যাগ করিবে। সর্ব্বজ্ঞ সর্ব্বশত্রুভয়ঙ্কর মহর্ষি শুক্রাচাৰ্য্য জম্ভনামক দৈত্যের পরিত্যাগকালে অসুরদিগকে কহিয়াছিলেন, কোন অরণ্যে কতকগুলি পক্ষী বাস করিত, তাহারা হিরণ্য নিষ্ঠাবন করিত। একদা সেই সমস্ত পক্ষিগণ নিজ নিজ নীড়ে বাস করিতেছে, ইত্যবসরে এক রাজা তথায় উপস্থিত হইলেন, তিনি সেই অদৃষ্টপূর্ব্ব অদ্ভুত ব্যাপার-সন্দর্শনে লোভাকৃষ্ট হইয়া এককালে হিরণ্যরাশি পাইবার মানসে নিরপরাধ পক্ষিগণের প্রাণ সংহার করিলেন। এইরূপ দুরাশাগ্ৰস্ত হওয়াতে কেবল তৎকালে হতাশ্বাস হইলেন, এমন নহে, ভবিষ্যৎলাভেরও সম্ভাবনা থাকিল না; অতএব আপনি বলবতী অর্থপূহানিবন্ধন পাণ্ডবদিগের অনিষ্টচেষ্টা করিবেন না, তাহা হইলে সেই মোহান্ধ পক্ষিহন্তার ন্যায় আপনাকেও অনুতাপ করিতে হইবে। হে ভারত! মালাকার যেমন উদ্যানস্থিত পুষ্পবৃক্ষে বারিসেচনপূর্ব্বক কুসুম চয়ন করে, তদ্রুপ আপনিও পাণ্ডবপাদপে স্নেহসলিল সেচন করিলে সুজাত পুষ্প পুনঃ পুনঃ গ্ৰহণ করিতে পরিবেন, অতএব অঙ্গারকারীর বৃক্ষদাহের ন্যায় সমূলে দগ্ধ করিবেন না। পাণ্ডবদিগের সহিত বিবাদ করিলে ভৃত্য, অমাত্য ও পুত্ৰগণ-সমভিব্যাহারে শমনসদনে গমন করিতে হইবে, সন্দেহ নাই; কারণ, পাণ্ডবেরা একত্ৰ সমবেত হইলে দেবতাপরিবৃত সাক্ষাৎ ত্ৰিদশাধিপতিও তাঁহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে পারেন না।”