৫৭. পাণ্ডবাপুরে বিদুরের গমন

পাণ্ডবাপুরে বিদুরের গমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকর্তৃক বলপূর্ব্বক নিযুক্ত হইয়া অগত্যা সুশিক্ষিত মহাজব অশ্ব দ্বারা পণ্ডিত পাণ্ডবগণের সকাশে যাত্ৰা করিলেন। মহাবুদ্ধি বিদুর পথ অতিক্ৰম করিয়া দ্বিজাতিগণ কর্তৃক অভিনন্দিত হইয়া ইন্দ্ৰপ্ৰস্থনগরে প্রবেশ করিলেন। তদনন্তর কুবেরভবনোপম রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করিয়া ধর্ম্মাত্মা ধর্ম্মপুত্রের সমীপবর্তী হইলেন। মহাত্মা অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির তাঁহার যথাবৎ পূজাপূর্ব্বক সপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, “হে ক্ষত্তঃ! আপনার মানসিক অপ্ৰসন্নতা প্রকাশ পাইতেছে। আপনি ত’ কুশলে আগমন করিয়াছেন? দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি ভ্রাতৃগণ ধৃতরাষ্ট্রের অনুগত এবং অন্যান্য ক্ষত্ৰিয়গণ ত’ তাহার বশবর্তী আছে।”

বিদূর কর্তৃক ধৃতরাষ্ট্রের আদেশজ্ঞাপন

বিদুর কহিলেন, “ইন্দ্ৰকল্প মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁহার পুত্ৰগণ জ্ঞাতিগণে পরিবৃত হইয়া কুশলে আছেন। তিনি পুত্ৰগণের গুণে প্রীত ও বিগতশোক হইয়াছেন। সম্প্রতি অক্ষয় কুশল প্রশ্নপূর্ব্বক তোমাকে এই কহিয়াছেন যে, “হে পাৰ্থ! তুমি ভ্রাতৃগণের সহিত আগমন করিয়া তোমার সভানুরূপ এই সভা অবলোকন কর এবং দুৰ্য্যোধনাদির সহিত সুহৃদ্যুতে প্ৰবৃত্ত হও। তোমার সহিত সমাগম [একত্র মিলন] হইলে আমার ও কুরুকুলের প্রীতির পরিসীমা থাকে না।” হে রাজন! মহাত্মা ধৃতরাষ্ট্র দুরোদরবিধান [পাশক্রীড়াকারিগণের সম্মেলন] করিয়াছেন, তুমি সেই অক্ষকিতবদিগকে [ধূর্ত পাশক্রীড়াকারী] দেখিবে, এই নিমিত্ত আমি আসিয়াছি, যাহা উচিত হয়, কর।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “মহাশয়! দুরোদর কলহের আকর; অতএব কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাহাতে অভিলাভবন্ধন করে? আপনি কি অক্ষদেবনা উচিত কাৰ্য্য বলিয়া স্বীকার করেন? বলুন, আপনার আজ্ঞানুবর্তী হইয়া চলি।”

বিদুর কহিলেন, “দ্যূত যে অনর্থের মূল, তাহা আমি বিলক্ষণ অবগত আছি। আমি তাঁহাকে ইহা হইতে নিবৃত্ত করিতে যত্ন করিয়াছিলাম; কিন্তু তিনি আমাকে তোমার নিকটে প্রেরণ করিয়াছেন, এক্ষণে যাহা শ্রেয়স্কর হয়, তাহা কর।”

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “মহাশয়! আমি জিজ্ঞাসা করি, ধৃতরাষ্ট্ৰপুত্র ব্যতীত কোন কোন অক্ষদেবী [পাশক্রীড়াকারী] তথায় বিদ্যমানআছেন? বলুন, আমি তাঁহাদগকে শতবার পরাজয় করিব।” বিদুর কহিলের্ন, “অক্ষনিপূণ কৃতহস্ত [পাশায় পরিপক্ক দ্রুত ক্ষেপাদিতে ক্ষিপ্ৰহস্ত—পাকা হাত] রাজা শকুনি, বিবিংশতি, চিত্ৰসেন, রাজা সত্যব্রত, পুরুমিত্র এবং জয় তথায় উপস্থিত আছেন।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভয়ঙ্কর মায়াধারী অক্ষদেবিগণ সেখানে রহিয়াছে, বুঝিলাম, সমস্ত জগৎ বিধাতার আদেশবর্তী হইয়াই চলিতেছে, কদাপি স্বতন্ত্র থাকিতে পারে না। হে বিদুর! পুত্র পক্ষপাতী ধৃতরাষ্ট্রের শাসনক্রমে দুরোদারদেবনে [পাশা খেলায়] ইচ্ছা! করিতেছি না, আপনি বলিতেছেন বলিয়াই তাহাতে প্ৰবৃত্ত হইব। যদি আমাকে সভামধ্যে আহ্বান না করিত, তাহা হইলে শকুনির সহিত ক্রীড়া করিতাম না; যখন আহূত হইয়াছি, তখন নিবৃত্ত হইব না; ইহাই আমার সনাতন ব্ৰত।”

সদ্রৌপদী পাণ্ডবগণের আগমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, ধর্ম্মরাজ ধৃতরাষ্ট্রের আহ্বানে বিশেষ বিবেচনা করিয়া অনুযাত্রিকবর্গকে প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন। তিনি পরদিন দ্রৌপদী প্রভৃতি স্ত্রীগণ, ভ্রাতৃগণ, বিদুর, অনুচর ও সহচরবর্গসমভিব্যাহারে বাহ্লীকযােজিত রথে আরোহণ করিয়া যাত্রা করিলেন। যুধিষ্ঠির গমনকালে কহিলেন, “তেজ যেমন চক্ষুকে বিনষ্ট করে, দৈব সেইরূপ প্রজ্ঞাকে অপহরণ করে; সমস্ত মনুষ্যই পাশবদ্ধের ন্যায় বিধাতার বশবর্তী হইয়া আছে।” মহাত্মা যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বথামা, সোমদত্ত, দুৰ্য্যোধন, শল্য, সৌবল, দুঃশাসন প্রভৃতি অন্যান্য যে কেহ তথায় উপস্থিত ছিলেন, সকলের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাদের মস্তকাঘ্রাণ করিলেন। তদনন্তর পাণ্ডবগণ তারাগণ-পরিবৃত রোহিণীর ন্যায় স্নুষাগণবেষ্টিত গান্ধারীকে অভিবাদন করিলেন। কৌরবগণ প্ৰিয়দৰ্শন পাণ্ডবগণের দর্শন পাইয়া আহ্লাদের পরাকাষ্ঠ প্রাপ্ত হইলেন। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবধূগণ অপ্রশস্ত-মনে দ্রৌপদীর পরমোৎকৃষ্ট সম্পৰ্ত্তি দর্শন করিতে লাগিলেন। পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণ প্রথমতঃ ব্যায়াম করিয়া অন্যান্য কর্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন করিলেন। তদনন্তর দিব্য চন্দনভূষিত ও কৃতাহ্নিক হইয়া বিশুদ্ধমনে ব্রাহ্মণগণ দ্বারা স্বস্তিবাচন করাইয়া সমুচিত ভোজনানন্তর রমণীগণের সহিত শয়নগৃহে প্রবেশ করিলেন। পরপুরঞ্জয় পাণ্ডবগণ সুখে রাত্রিযাপন করিয়া প্ৰভাতে বন্দিগণ কর্তৃক স্তূয়মান হইয়া শয্যা হইতে গাত্ৰোত্থান করিলেন। প্ৰাতঃকালে সকলে কৃতাহ্নিক হইয়া কিতবাভিনন্দিত রমণীয় সভামণ্ডপে প্রবিষ্ট হইলেন।