৪৯. পিতৃসমীপে দুৰ্য্যোধনের পুনঃ-পরিবেদন

পিতৃসমীপে দুৰ্য্যোধনের পুনঃ-পরিবেদন

জনমেজয় বৈশম্পায়নকে সম্বোধন করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে ব্ৰহ্মবিত্তম! যাহাতে আমার পিতামহ পাণ্ডবগণ ব্যসনাপন্ন হইয়াছিলেন, সেই মহান অনর্থকর দ্যূতক্রীড়া কিরূপে হইয়াছিল, তথায় কোন কোন ব্যক্তি সভ্য ছিলেন, কোন কোন ব্যক্তিই বা অনুমোদন এবং কে কে বা প্ৰতিষেধ করিয়াছিলেন? পৃথিবীনাশের মূলস্বরূপ এই সকল বৃত্তান্ত বিস্তারিতক্রমে শ্রবণ করিতে বাসনা করি। বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! যদি পুনরায় সবিস্তরে শ্রবণের নিমিত্ত অভিলাষ জন্মিয়া থাকে, তবে শ্রবণ কর। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া নির্জন প্রদেশে পুনর্ব্বার দুৰ্য্যোধনকে কহিতে লাগিলেন, “হে বৎস! মহাবুদ্ধি বিদুর কখনই আমাদের অহিতকর উপদেশ দিবেন না, বিশেষতঃ উদারবুদ্ধি বৃহস্পতি দেবরাজ ইন্দ্ৰকে যে সকল শাস্ত্রোপদেশ দিয়াছেন, তিনি তাহার মর্ম্ম পৰ্য্যন্ত অবগত আছেন। এবং উদ্ধব যেমন বৃষ্ণিবংশের, উনিও সেইরূপ কুরুবংশের প্রধান; অতএব বিদুর যখন অক্ষদেবনে [পাশাখেলা] অনুমোদন করেন নাই, তখন উহাতে আর প্রয়োজন নাই। হে পুত্ৰ! বিদুর যাহা কহিতেছেন, তাহাই উৎকৃষ্ট ও তোমার হিতকর, তাহার অন্যথা করিও না। দ্যূত হইতে সুহৃদ্ভেদ এবং সুহৃদ্ভেদ হইতে রাজ্যনাশ হয়; অতএব পাশক্রীড়ার অধ্যবসায় হইতে নিবৃত্ত হও। হে কৃতপ্রজ্ঞা! পুত্রের প্রতি পিতা-মাতার যাহা কৰ্তব্য তাহা করা হইয়াছে। প্রতিপালিত, অধীতবান, কৃতবিদ্য এবং সকলের জ্যেষ্ঠ বলিয়াই তুমি রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছ, অনন্যসুলভ ভোজনাচ্ছাদন ভোগ করিতেছ, পৈতৃক রাজ্য বৰ্দ্ধিত করিয়াছ ও প্রতিনিয়ত আজ্ঞা করিয়া দেবেশ্বরের ন্যায় দীপ্তি পাইতেছ তবে তোমার দুঃখের বিষয় কি বল?”

দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “হে রাজন! কাপুরুষেরাই অশন-বসনে পরিতৃপ্ত হইয়া থাকে এবং অধম পুরুষেরাই অমর্ষশূন্য হয়। হে রাজেন্দ্ৰ! এই সামান্য রাজলক্ষ্মী আমাকে প্রীত করিতে পারিতেছে না, আমি যুধিষ্ঠিরের দীপ্যমানা রাজলক্ষ্মী এবং সমস্ত পৃথিবী তাহার বশবর্তিনী দৃষ্টিগোচর করিয়া ব্যথিত হইয়াছি। আমি অত্যন্ত পাষাণহৃদয়, এই নিমিত্ত এরূপ দুঃখেও জীবিত রহিয়াছি। যুধিষ্ঠিরনিকেতনে কদম্ব, চিত্ৰক, কৌকুর, করস্কার ও নৌহজঙঘ প্রভৃতি বৃক্ষসকল ফলভারে আবর্জিত হইয়া রহিয়াছে; মহাগিরি হিমালয়, সাগর এবং অন্য কতিপয় জলপ্রায়-ভূমি ইহারা সকলেই রত্নাকর; এই সমস্ত রত্নাকর যুধিষ্ঠিরের সমৃদ্ধ গৃহে পরিভূত হইয়াছে। হে রাজন! যুধিষ্ঠির আমাকে জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ জানিয়া সৎকারপূর্ব্বক রত্নপরিগ্রহে নিযুক্ত করিয়াছিল। তথায় এত মহামূল্য রত্নজাত সঙ্কলিত হইয়াছিল যে, আমি তাহার ইয়াত্তা করিতে পারি নাই। আমার হস্ত সমুদয় রত্নগ্ৰহণ করিতে অসমর্থ হইয়াছিল। আমি পরিশ্রান্ত হইলে ভূপালগণ। সেই সমস্ত রত্নজাত হস্তে লইয়া দূরে দণ্ডায়মান রহিলেন। ময়দানব বিন্দুসরোবরে রত্নরাশি দ্বারা এরূপ স্ফটিকদলশালিনী প্ৰফুল্ল-নলিনী নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন যে, আমি তদর্শনে জলস্থ প্রফুল্ল কমল বলিয়া বোধ করিয়াছিলাম এবং সলিল ভ্ৰমে সভাকুট্টিমেই আপনার পরিচ্ছদ উৎক্ষিপ্ত করিলে বৃকোদর আমাকে শত্রু-সম্পত্তি দর্শনে বিভ্রান্ত ও রত্নানভিজ্ঞ মনে করিয়া উপহাস করিয়াছিল। আমি সমর্থ হইলে সেইখানেই তাহাকে নিপাতিত করিতাম; কিন্তু ক্ৰোধ প্ৰকাশ করিলে আমাদিগকেও শিশুপালের অনুগমন করিতে হইত, সন্দেহ নাই। হে ভারতবংশাবতংস! সেই শত্রুর উপহাস আমাকে দগ্ধ করিতেছে। হে মহারাজ! আমি পুনরায় সেইরূপ জলজশালিনী দীঘিকাকে সভাস্থলী মনে করিয়া তাহাতে পতিত হইয়াছিলাম। আমাকে পতিত দেখিয়া কৃষ্ণ, পার্থ, দ্রৌপদী ও অন্যান্য স্ত্রীগণ মর্ম্মান্তিক বেদনা প্ৰদান করিয়া হাস্য করিতে লাগিল। সমধিক দুঃখের বিষয় এই যে, কিঙ্করগণ আমাকে আর্দ্রবস্ত্ৰ দেখিয়া যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞানুসারে তাহার বস্ত্রাগার হইতে অন্যান্য বস্ত্ৰ আনিয়া প্ৰদান করিল। পিতঃ! আর এক প্রতারণার বিষয় শ্রবণ করুন, দ্বারবৎ প্রতীয়মান অদ্বার দ্বারা নিৰ্গত হইতে গিয়া ভিত্তিশিলায় আহত হইয়া ক্ষতললাট হইলাম, নকুল এবং সহদেব দূর হইতে আমাকে আহত দেখিয়া দুঃখ প্রকাশপূর্ব্বক বাহু দ্বারা গ্রহণ করিল। সহদেব আমাকে পুনঃ পুনঃ কহিতে লাগিল, “হে রাজন! এই দ্বার, এই দিকে আগমন করুন। ভীমসেন হাসিতে হাসিতে আমাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “হে ধৃতরাষ্ট্রাত্মজ! এ দিকে দ্বার।” এই সকল কারণে আমি অত্যন্ত পরিতাপিত হইয়াছি।”