৪৫. দ্যূতপর্ব্বাধ্যায়

দ্যূতপর্ব্বাধ্যায়

ব্যাসদেব শিষ্যগণে পরিবৃত হইয়া পাণ্ডবগণসম্মুখে সমুপস্থিত হইলেন। রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে আশু আসন হইতে উত্থিত হইয়া পাদ্য এবং আসন প্ৰদানপূর্ব্বক পিতামহ ব্যাসের পূজা করিলেন। ভগবান দ্বৈপায়ন কাঞ্চনময় আসনে আসীন হইয়া যুধিষ্ঠিরকে উপবেশন করিতে কহিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণের সহিত উপবিষ্ট হইলে বাগ্বিনাসবিশারদ ভগবান ব্যাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে কুরুবংশধর কৌন্তেয়! তুমি অসুলভ সাম্রাজ্য প্রাপ্ত হইয়া সমস্ত কুরুদেশের উন্নতিসাধন করিলে। তোমা হইতে কুরুবংশ উজ্জ্বল হইল। হে ক্ষত্ৰিয়প্রধান! আমি পূজিত হইয়াছি, এক্ষণে তোমাকে আমন্ত্ৰণ করিতেছি, আমি প্রস্থান করিব।” রাজা যুধিষ্ঠির পিতামহের পাদগ্ৰহণ করিয়া কহিলেন, “ভগবন্‌! দেবর্ষি নারদ কহিয়াছিলেন, দিব্য, আন্তরীক্ষ ও পার্থিব এই ত্ৰিবিধ উৎপাত উপস্থিত হইবে, শিশুপালের পতন হওয়াতে কি সেই উৎপাত বিলুপ্ত হইয়া গেল? হে পিতামহ! এই বিষয়ে আমার অতি দুরূহ সংশয় উপস্থিত হইয়াছে, আপনি ব্যতীত ইহার মীমাংসা করে, এমন কেহই নাই।”

অনন্তর তাহা শুনিয়া ব্যাস কহিলেন, “হে রাজন! সেই ত্ৰিবিধ উৎপাত ত্ৰয়োদশ বৎসর ব্যাপিয়া হইবে। তাহাতে সমস্ত ক্ষত্ৰিয়ের বিনাশ হইবে। দুৰ্য্যোধনের অপরাধে এবং ভীমার্জ্জুনের বলে তোমাকে উপলক্ষ্য করিয়া সমস্ত ক্ষত্রিয়ভূপতিগণ কালক্রমে ক্ষয়প্রাপ্ত হইবে। হে রাজেন্দ্ৰ! নিশাবসানে তুমি স্বপ্নে দেখিবে, ত্রিপুরান্তক মহাদেব বৃষভারূঢ় হইয়া শূল ও পিনাক ধারণ করিয়া শমনাধিষ্ঠিত দক্ষিণদিক নিরীক্ষণ করিতেছেন। হে বিশাম্পতে! সেই স্বপ্নদর্শনে তুমি চিন্তিত হইও না, কারণ, কালকে কেহই অতিক্রম করিতে পারে না। তোমার মঙ্গল হউক, তুমি অপ্ৰমত্ত, স্থিতিমান এবং দমপরায়ণ হইয়া পৃথিবী পরিপালন কর। এক্ষণে আমি কৈলাসপর্ব্বতে গমন করি।” এই বলিয়া ভগবান ব্যাস সমস্ত শিষ্য-সমভিব্যাহারে কৈলাসপর্ব্বতে প্ৰস্থান করিলেন।

ব্যাসের ইঙ্গিতে যুধিষ্ঠিরের নির্ব্বেদ

পিতামহ প্ৰস্থান করিলে রাজা যুধিষ্ঠির শোকাকুল হইয়া উষ্ণ নিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক বারংবার সেই বিষয়েরই চিন্তা করিতে লাগিলেন। তিনি ভাবিলেন, ‘পৌরুষ দ্বারা দৈব শক্তি অতিক্রম করা অতীব দুরূহ কর্ম্ম। মহর্ষি যাহা কহিতেছেন, তাহা অবশ্য ঘটিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।” মহাতেজঃ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে পুরুষশ্রেষ্ঠগণ! দ্বৈপায়ন যাহা কহিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিলে? আমি তাহার বাক্য শ্রবণ করিয়া প্ৰাণ-পরিত্যাগে স্থিরনিশ্চয় হইয়াছি। যদ্যপি কালক্রমে আমিই সমস্ত ক্ষত্ৰিয়বিনাশের হেতু হইলাম, তবে আমার জীবনধারণে প্রয়ােজন কি?” ইহা শ্রবণ করিয়া ধনঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! বুদ্ধিভ্রংশকর ভয়ানক মোহে আবিষ্ট হইবেন না। যাহা কল্যাণকর হয়, বিবেচনা করিয়া তাহার অনুষ্ঠান করুন।” সত্যধৃতি যুধিষ্ঠির মধ্যে মধ্যে ব্যাসদেবের কথাই চিন্তা করিয়া ভ্রাতৃগণকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে ভ্ৰাতৃগণ! তোমাদিগের মঙ্গল হউক, আমার প্রতিজ্ঞা শ্রবণ কর। আমি অদ্যাবধি ভ্রাতৃগণের বা অন্যান্য ভূপতিবর্গের প্রতি পরুষবাক্য প্রয়োগ করিব না; জ্ঞাতিগণের নির্দেশবর্তী হইয়া যোগসাধন করিব; কি পুত্র, কি ইতর ব্যক্তি, সকলের প্রতিই একরূপ ব্যবহার করিব; তাহা হইলে আমার আর ভেদের আশঙ্কা থাকিবে না। সুহৃদ্ভেদ হইতেই সংগ্ৰামঘটনা হয়; আমি বিগ্রহকে সুদূরপরাহত করিয়া কেবল সকলের প্রিয়কাৰ্য্যই অনুষ্ঠান করিব; তাহা হইলে লোকমধ্যে নিন্দাস্পদ হইব না। যদি এই ত্ৰয়ােদশ বৎসর জীবিত থাকিতে হয়, ইহা ভিন্ন আর কোন কাৰ্য্য করিব না।” যুধিষ্ঠিরের হিতাভিলাষী ভীমাদি ভ্রাতৃগণও জ্যেষ্ঠের বাক্যে অনুমোদন করিলেন। ধর্ম্মরাজ ভ্রাতৃগণের সহিত সভামধ্যে সমারাঢ় হইয়া সমস্ত নৃপগণের প্রস্থানানন্তর পিতৃগণ এবং দেবতাদিগকে পরিতৃপ্ত করিতে লাগিলেন। সহামাত্য যুধিষ্ঠির কৃতমঙ্গল ও ভ্রাতৃগণে পরিবৃত হইয়া পুরপ্রবেশ করিলেন। দুৰ্য্যোধন এবং সৌবল শকুনি সেই রমণীয় সভাতেই সমাসীন রহিলেন।