৪৩. ভীষ্ম-শিশুপালের পরস্পর অমর্ষ উক্তি

ভীষ্ম-শিশুপালের পরস্পর অমর্ষ উক্তি

ভীষ্ম কহিলেন, “শিশুপাল যে বুদ্ধিতে বাসুদেবকে আহ্বান করিতেছে, ইহা উহার নিজের বুদ্ধি নহে, বাসুদেবেরই এইরূপ অভিসন্ধি, সন্দেহ নাই। হে কৌন্তেয়! এই কুলকলঙ্ক অদ্য আমার যে প্রকার অবমাননা করিল, পৃথিবীমধ্যে কোন পার্থিব তেমন করিতে পারে? শিশুপালে নারায়ণের যে তেজোভোগ আছে, যাহার প্রভাবে সে দুর্বুদ্ধিপরতন্ত্র হইয়া আমাদিগকে গণনা না। করিয়া শার্দূলের ন্যায় তর্জন-গর্জন করিতেছে, মহাবাহু বাদুদেব অচিরকালমধ্যে সেই নিজ তেজ পুনরায় আদান করিবেন।”

শিশুপাল ভীষ্মবাক্য সহ্য করিতে না পারিয়া ক্ৰোধাভরে তাহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে ভীষ্ম! তুমি বন্দীর ন্যায় উত্থিত হইয়া নিরন্তর যাহার স্তুতিবাদ করিতেছ, আমার প্রভাব সেই কেশবেরই বটে; কিন্তু তোমার মন যদি কেবল পরের তোষামোদ করিয়াই সন্তুষ্ট থাকে, তাহা হইলে কেশবকে পরিত্যাগ করিয়া এই সকল ভুপালগণের স্তুতিবাদ কর। এই পার্থিবপ্রধান বাহ্লীকরাজ দরদের স্তুতিপাঠ কর, যিনি ভূমিষ্ঠ হইবামাত্ৰ পৃথিবী কম্পিত হইয়াছিল। হে ভীষ্ম! মহাবীর কর্ণের প্রশংসা কর, যিনি অঙ্গ ও বঙ্গদেশের অধ্যক্ষ এবং সহস্ৰাক্ষসদৃশ বলশালী; যে মহাবাহুর চাপবিকর্ষণ অতি ভয়ানক, কুণ্ডলদ্বয় সহজাত, দিব্য ও দেবনির্মিত এবং কবচ বালার্কসদৃশ; যিনি বাসবের ন্যায় দুৰ্জয় জরাসন্ধকে বাহুযুদ্ধে পরাজিত ও তাঁহার শরীর ভেদ করিয়াছিলেন। এই মহারথ দ্রোণের ও তৎপরে অশ্বথামার স্তব কর, যাঁহাদের একজন জাতক্ৰোধ হইলে চরাচর বিশ্ব নিঃশেষিত করিতে পারেন। ফলতঃ ইঁহাদিগের সমান যোদ্ধা দৃষ্টিগোচর হয় না। কি আশ্চৰ্য্য! সেই অনন্যসাধারণ বীরযুগলের প্রশংসা করিতে তোমার ইচ্ছা হয় না? হে ভীষ্ম! সাগরাম্বারা পৃথিবীতে যিনি অদ্বিতীয়, সেই রাজেন্দ্ৰ দুৰ্য্যোধনকে অতিক্রম করিয়া কৃষ্ণের স্তুতিবাদ করা কি ন্যায়ানুগত, না বুদ্ধিমানের কার্য্য? কৃতাস্ত্ৰ দৃঢ়বিক্রম রাজা জয়দ্ৰথ, প্রথিতবিক্রম কিন্নরাচাৰ্য্য দ্রুম, ভরতকুলের শিক্ষক বৃধ্য কৃপাচার্য্য, মহাধনুর্ধ্বর রুক্সিরাজ, ভগদত্ত, যূপকেতু, জয়ৎসেন, মাগধেশ্বর, বিরাট, দ্রুপদ, বৃহদ্বল, শকুনি, অবন্তিদেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ, পাণ্ড্য, শ্বেত, উত্তম, মহাভাগ শঙ্খ, বৃষসেন, বিক্রমশালী একলব্য ও মহারথ কালিঙ্গ, এই সমস্ত বীরপুরুষদিগের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনপূর্ব্বক কেশবের প্রশংসা করিতেছ কেন? হে ভীষ্ম! যদি তোমার নিতান্ত স্তব করিতে বাসনা থাকে, তবে কেন শল্য প্রভৃতি ভূপালগণের স্তব কর না? তুমি প্রাচীন ধর্ম্মবাদীদিগের উপদেশবাক্য শ্রবণ কর নাই; অতএব আমি কি করিব? পণ্ডিতেরা কহিয়া থাকেন যে, আত্মনিন্দা ও আত্মপূজা এবং পরনিন্দা ও পরস্তব সাধুদিগের অকর্তব্য। তুমি মোহবশতঃ ভক্তিসহকারে অস্তবনীয় কেশবের স্তব করিতেছ, কিন্তু ইহা কাহারও অনুমোদিত নহে; তুমি মুক্তিকামনায় সমস্ত জগৎ দুরাত্মা পুরুষে সমাবেশিত করিতেছ। যাহা হউক, তোমার এই বুদ্ধি প্রকৃতির অনুগত নহে; আমি পূর্ব্বেই কহিয়াছি যে, ভূলিঙ্গনামক শকুনি তোমার উপমার স্থান।” শিশুপাল এই কথা বলিয়া পুনর্ব্বার কহিলেন, “হে ভীষ্ম! শ্রবণ কর। হিমালয়ের অপর-পার্শ্বে ভুলিঙ্গনামক এক শকুনি বাস করে। তাহার বাক্য অর্থ-বিগৰ্হিত ও নিন্দনীয়। সে অন্যকে সাহস করিতে নিষেধ করে, কিন্তু আপনিই যে অতীব সাহসিক কর্মের অনুষ্ঠান করিতেছে, তাহা কিছুমাত্ৰ বুঝিতে পারে না। সেই নির্বোধ শকুনি সিংহের বদন হইতে দশনবিলগ্ন মাংসখণ্ড গ্রহণ করিয়া থাকে, কিন্তু সিংহ মনে করিলেই তাহার জীবন বিনাশ করিতে পারে। সে কেবল সিংহের অনুগ্রহে জীবিত আছে, সন্দেহ নাই, হে অধাৰ্মিক ভীষ্ম! তোমার বাক্যও সেই প্রকার প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং তোমার জীবনও সেই প্রকার ভূপালগণের অনুগ্রহাধীন; তাহারা মনে করিলেই তোমার প্রাণ সংহার করিতে পারেন। তোমার তুল্য নিন্দিতকর্ম্ম আর কেহই নাই।”

ভীষ্ম শিশুপালের এই প্রকার কটুবাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে চেদিরাজ! তুমি কহিতেছ, আমার জীবন এই মহীপালগণের ইচ্ছার অধীন, কিন্তু আমি ইহাদিগকে তৃণ, তুল্যও বোধ করি না।” ভীষ্ম এই প্রকার কহিলে ভূপতিগণ রোষাবিষ্ট হইয়া কেহ হাস্য করিয়া উঠিলেন, কেহ বা তাহার কুৎসা করিতে লাগিলেন। কোন কোন ধনুৰ্দ্ধর ভীষ্মের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “এই পাপগর্বিত দুর্ম্মতি ভীষ্ম ক্ষমাযোগ্য নহে, অতএব ইহাকে পশুর ন্যায় বধ করা অথবা প্ৰদীপ্ত হুতাশনে দগ্ধ কর।”

কুরুপিতামহ মতিমান ভীষ্ম তাঁহাদিগের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে নৃপতিগণ! তোমাদের কথোপকথন শেষ হইবার নহে, আমি এই অবসরে কিছু বলিতেছি, শ্রবণ করা। তোমরা আমাকে পশুর ন্যায় বধ করা বা কটাগ্নিতে [গৃহমধ্যে অবরুদ্ধ করিয়া যে অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করা হয়] দগ্ধ করা, আমি তোমাদের মস্তকে এই পদার্পণ করিলাম। আমরা গোবিন্দকে পূজা করিয়াছি, তিনিও সম্মুখে বিদ্যমান রহিয়াছেন। যাহার নিতান্ত মরণকণ্ডূতি হইয়া থাকে, তিনি গদাচক্ৰধারী বাসুদেবকে যুদ্ধে আহ্বান করুন; কিন্তু আমি নিশ্চয় বলিতেছি, আহ্বানকারী ব্যক্তিকে রণশায়ী হইয়া অবশ্যই যাদবদেব শ্ৰীকৃষ্ণের শরীরে লীন হইতে হইবে।”