৪২. শিশুপালের জন্ম রহস্য—কৃষ্ণ ভিন্ন অন্যের অবধ্যত্ব

শিশুপালের জন্ম রহস্য—কৃষ্ণ ভিন্ন অন্যের অবধ্যত্ব

ভীষ্ম কহিলেন, “এই শিশুপাল চেদিরাজকুলে জন্মগ্রহণ করেন। ভূমিষ্ঠ হইবার সময় ইনি ত্ৰ্যম্বক ও চতুৰ্ভুজ ছিলেন এবং জাতমাত্র রাসভসদৃশ চীৎকার করিতে লাগিলেন। ইহার মাতা, পিতা ও বন্ধুবান্ধব এই অনৈসৰ্গিক ব্যাপার অবলোকন করিয়া ভীত হইয়া ইহাকে পরিত্যাগ করিতে সঙ্কল্প করেন। চেদিরাজ, করিতেছেন, এমন সময়ে এই দৈববাণী হইল, “হে নৃপতে! তোমার শ্ৰীমান বলবান পুত্র জন্মগ্রহণ করিল, অতএব ইহা হইতে ভীত হইও না; অনাকুল হইয়া প্রতিপালন কর। হে নরাধিপ! যম ইহার অন্তক নহে। ইহার প্রাণ কেবল অস্ত্র দ্বারা নিহত হইবে। যিনি ইহার জীবনহন্তা, তিনি উৎপন্ন হইয়াছেন।” এই কহিয়া দৈববাণী নিস্তব্ধ হইলে ইহার জননী অপত্যস্নেহে অভিভূত হইয়া কহিতে লাগিলেন, “যিনি আমার এই পুত্রের প্রতি এই আকাশবাক্য প্রয়োগ করিলেন, তিনি দেবতাই হউন, বা অন্য কেহই হউন, আমি কৃতাঞ্জলি হইয়া তাঁহাকে নমস্কার করিতেছি। তিনি যথার্থতঃ প্রকাশ করিয়া বলুন, কোন ব্যক্তি আমার সন্তানের কালান্তক হইবে, আমি তাহার নাম শুনিতে ইচ্ছা করি।” তখন পুনরায় দৈববাণী হইল, “হে দেবি! তোমার পুত্ৰ যাহার অঙ্কদেশে আরোহিত হইলে ইহার পঞ্চশীর্ষ-ভুজঙ্গপ্রতিম অধিক ভুজদ্বয় ক্ষিতিতলে বিগলিত হইবে এবং যাঁহাকে নেত্ৰগোচর করিয়া ললাটনিহিত তৃতীয় লোচন তিরোহিত হইবে, তিনিই তোমার প্ৰাণাধিকের প্রাণসম্পত্তি অপহরণ করবেন।”

অন্যান্য পার্থিবগণ তাহাকে ত্ৰিনেত্ৰ ও চতুর্ভুজ এবং তাহার প্রতি সেই দৈববাণী শ্রবণ করিয়া দর্শনমানসে তথায় আগমন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন চেদিরাজ সমাগত ভূপতিগণকে সৎকার করিয়া একৈকক্রমে সকলের উৎসঙ্গে পুত্রকে আরোপিত করিলেন। শিশু এই প্রকার যথাক্রমে পৃথক পৃথকরূপে রাজসহস্রের অঙ্কারূঢ় হইলেন; কিন্তু দৈববাণীর নিদর্শন প্রাপ্ত হইলেন না। মহাবল বলরাম ও বাসুদেব দ্বারাবতী নগরীতে ছিলেন, ইহারা এই ব্যাপার শ্রবণ করিয়া পিতৃষ্বসাকে দেখিবার নিমিত্ত চেদিপুরী আগমন করিলেন। তাঁহারা জ্যেষ্ঠানুক্রমে ভূপতিকে ও পিতৃষ্বসাকে অভিবাদন ও অনাময় জিজ্ঞাসা করিয়া এবং তাঁহাদের কর্তৃক অভিনন্দিত হইয়া উপবিষ্ট হইলে দেবী যাদবী আহ্লাদ করিয়া শিশুপালকে দামোদরের ক্রোড়ে প্রদান করিলেন। তাঁহার অঙ্কে অর্পিত হইবামাত্ৰ ভুজন্দ্বয় স্বলিত ও ললাটস্থ ত্ৰিলোচনা তিরোহিত হইল। তখন শিশুপালজননী ত্ৰাসিত ও ব্যথিত হইয়া কৃষ্ণকে কহিলেন, “হে মহাভুজ! এই ভয়কাতরকে বরপ্রদান কর, তুমি আর্ত ব্যক্তির আশ্বাসন ও ভীত ব্যক্তির অভয়প্রদ।” শিশুপালজননীর এবম্প্রকার কাতরোক্তি শ্রবণ করিয়া কৃষ্ণ কহিলেন, “হে দেবি! ভীত হইবেন না, আমা হইতে আপনার ভয় নাই। হে পিতৃষ্বশসাঃ! আমি আপনাকে কি বর দিব, আমাকে কি করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন। আমার আয়ত্ত বা ক্ষমতার অতীত হইলেও আমি অবশ্য সম্পাদনা করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই। রাজমহিষী কৃষ্ণ কর্তৃক এই প্রকার অভিহিত হইয়া কহিলেন, “হে মহাবল যদুপ্রধান! শিশুপালের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করিতে হইবে, এই আমার প্রার্থনা।” তখন বাসুদেব কহিলেন, “পিতৃষ্বসা! আপনি শোক করিবেন না। আমি আপনার এই পুত্রের বধোচিত শত অপরাধ ক্ষমা করিব।”

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে বীর! মন্দবুদ্ধি পাপাত্মা শিশুপাল গোবিন্দের এইরূপ বরপ্রদানে দর্পিত হইয়া তোমাকে যুদ্ধার্থে আহ্বান করিতেছে।”