৪১. শিশুপাল কর্তৃক কৃষ্ণনিন্দা-ক্রুদ্ধ ভীমের সান্ত্বনা

শিশুপাল কর্তৃক কৃষ্ণনিন্দা-ক্রুদ্ধ ভীমের সান্ত্বনা

শিশুপাল কহিলেন, “মহাবল জরাসন্ধ আমার অভিমত রাজা ছিলেন। তিনি দাস বলিয়া এই বাসুদেবের সহিত সংগ্রাম করিতে ইচ্ছা করেন নাই। এই কেশব তাহাকে বধ করিবার নিমিত্ত ভীমসেন এবং ধনঞ্জয় দ্বারা যাহা করিয়াছিল, কোন ব্যক্তি তাহা ন্যায্য বলিয়া স্বীকার করিতে পারে? এই দুরাত্মা ব্রাহ্মণবেশ ধারণ করিয়া ছলপূর্ব্বক অদ্বার দিয়া প্রবিষ্ট হইয়া জরাসন্ধ ভূপতির প্রভাব দৃষ্টিগোচর করিয়াছেন। ধর্ম্মাত্মা জরাসন্ধ এই দুরাত্মাকে পাদ্য প্ৰদান করিতে উদ্যোগ করিলে আপনাকে অব্রাহ্মণ জানিয়া গ্ৰহণ করিতে ইচ্ছা করেন নাই। তিনি কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জ্জুনকে ভোজন করিতে কহিলে কৃষ্ণ এক অনৈসৰ্গিক কাণ্ড করিয়া তুলিল। হে মূর্খ! তুমি ইহাকে যে প্রকার মনে করিতেছ, ইনি যথার্থই যদি সেই প্রকার জগতের কর্তা হইতেন, তাহা হইলে ইনি আপনি আপনাকে ব্ৰাহ্মাণ বলিয়া জানিতেছেন না কেন? কিন্তু আমার এই আশ্চৰ্য্য বোধ হইতেছে যে, তুমি পাণ্ডবদিগকে সাধুগণের পথ হইতে আকৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছ এবং ইহারা সেই ব্যবহারকে সাধু বলিয়া স্বীকার করিতেছে। অথবা তুমি পৌরুষহীন বৃদ্ধ, তুমি যাহাদের সর্ব্বার্থপ্রদর্শক হইয়াছ, তাহাদের বিষয় বিস্ময়কর নহে।” মহাবল-পরাক্রান্ত ভীমসেন শিশুপালের সেই কঠোর বাক্য শ্রবণ করিয়া কুপিত হইলেন। তাঁহার সরোজসদৃশ স্বভাব-বিস্ফারিত ও লোহিত নেত্রদ্বয় ক্ৰোধাভরে অধিকতর রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল। পার্থিবগণ তাঁহার ললাটস্থ ত্ৰিশিখ ভ্রূকুটি ত্ৰিকূটস্থ ত্রিপথগামিনী গঙ্গার ন্যায় দর্শন করিতে লাগিলেন। ভীম দশনে দশন পীড়ন করিতে লাগিলেন, তাঁহার মুখমণ্ডল দেখিয়া বোধ হইল, যেন যুগান্তকালে কালান্তক সমস্ত সংসার গ্রাস করিতে ইচ্ছা করিতেছে। তিনি ক্ৰোধবেগে উত্থিত হইতেছেন, এমন সময়ে মহাবাহু ভীষ্ম তাহাকে ধারণ করিলেন, বোধ হইল যেন শশিশেখর ষড়াননকে গ্রহণ করিতেছেন। ভীষ্ম বিবিধ গৌরবান্বিত বাক্যে তাঁহাকে নিবারিত করিলে তাহার কোপশান্তি হইল। যেমন সমুদ্বেল মহাসমুদ্র ঘনকাল অতীত হইলে বেলাকে অতিক্রম করে না, তদ্রুপ অরিন্দম ভীম ভীষ্মের বাক্য উল্লঙ্ঘন করিলেন না। ভীমসেন ক্রোধাবিষ্ট হইলেও শিশুপাল নিজ পৌরুষ অবলম্বন করিয়া স্থির হইয়া রহিলেন। কুপিত সিংহ যেমন মৃগের প্রতি উপেক্ষা করিয়া থাকে, প্রতাপবান। শিশুপাল সেইরূপ ভীমপরাক্ৰম ভীমসেনকে রোষপরবশ দেখিয়া তাঁহার প্রতি উপেক্ষাপূর্ব্বক হাসিতে হাসিতে কহিলেন,“হে ভিষ্ম! ইহাকে পরিত্যাগ কর, আমার প্রতাপানলে ভীম-পতঙ্গ দগ্ধ হইবে, নরপতিরা নয়নগোচর করুন।” তদনন্তর কুরুশ্রেষ্ঠ প্ৰজ্ঞতম ভীস্ম চেদিরাজ-বাক্য শ্রবণ করিয়া ভীমসেনকে কহিতে লাগিলেন।