৩৫. অর্ঘ্যাভিহরণ-পৰ্ব্বাধ্যায়

অর্ঘ্যাভিহরণ-পৰ্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, তদনন্তর অভিষেক-দিবসে সৎকারার্হ মহর্ষি ও ব্রাহ্মণগণ রাজগণ-সমভিব্যাহারে অন্তর্ব্বেদীতে প্রবেশ করিলেন। নারদপ্রমুখ মহাত্মারা রাজগণের সহিত তথায় অধ্যাসীন হওয়াতে সেই প্রদেশ কি অনির্ব্বচনীয় শোভায় শোভিত হইয়াছিল। অমিততেজাঃ দেবতা ও দেবর্ষিগণ ব্ৰহ্মভবনে সমবেত হইয়া বিরামকাল প্রাপ্ত হইয়া নানাপ্রকার জল্পনা করিতে লাগিলেন। কেহ কহিলেন, ইহা এইরূপ হইবে, কেহ কহিলেন, “এ প্রকার নহে; এইরূপ ঘোরতর বিসংবাদিতাপ্রযুক্ত অত্যন্ত বিতণ্ডা উপস্থিত হইল। কেহ কেহ শাস্ত্রপ্রতিপন্ন যুক্তিপ্রদর্শন দ্বারা সামান্য অর্থের গৌরব ও গুর্ব্বার্থের লাঘব করিতে লাগিলেন। মেধাবী ব্যক্তি অন্য কর্তৃক উদাহৃত অর্থ অগ্রাহ্য করিলেন। ধৰ্মাৰ্থকুশল, মহাব্ৰতসকল, ভাষার্থকোবিদ পণ্ডিতবর্গকত প্রকার বিচার করিতে লাগিলেন। বেদীবেদজ্ঞ দেব, দ্বিজ ও মহর্ষিগণে সমাকীর্ণ হইয়া নক্ষত্রমালাবিভূষিত অতি বিস্তীর্ণ নভোমণ্ডলের ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিল। রাজা যুধিষ্ঠিরের সেই বেদীসন্নিধানে শূদ্র বা কোন ব্ৰতবিহীন অশুচি ব্যক্তির বাসাধিকার ছিল না।

নারদের যজ্ঞবিষয়ক অন্তর্গূঢ় রহস্যচিন্তা

দেবর্ষি নারদ ধর্ম্মরাজের যজ্ঞবিধানজা লক্ষ্মী নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় সন্তোষ লাভ করিলেন। অনন্তর সমস্ত ক্ষত্ৰিয়গণকে অবলোকন করিয়া চিন্তাৰ্ণবে নিমগ্ন হইলেন। পূর্ব্বে ব্ৰহ্মভবনে ভগবানের অংশাবতরণ বিষয়ে যে পুরাবৃত্ত শ্রবণ করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাহা তাহার স্মৃতিপথে আবির্ভূত হইল। তখন সেই ক্ষত্রসমাগম দেবসঙ্গম জানিয়া তিনি মনে মনে পুণ্ডরীকক্ষ নারায়ণকে স্মরণ করিলেন। সুরারিনিসূদন নারায়ণ প্রতিজ্ঞাপ্রতিপালনার্থ স্বয়ং ক্ষত্ৰিয়কুলে অবতীর্ণ হইলেন এবং দেবতা দিগকে আদেশ করিলেন, “তোমরা পরস্পর হিংসা করিয়া পুনর্ব্বার স্ব স্ব লোক প্রাপ্ত হইবে।” ভগবান নারায়ণ দেবতা দিগকে এইরূপ আদেশ করিয়া স্বয়ং যদুবংশে জন্মপরিগ্ৰহ করিলেন। নক্ষত্রমধ্যগত চন্দ্ৰমা যেমন শোভা পান, তদ্রুপ ভগবান অন্ধকবৃষ্ণিবংশমধ্যে বিরাজিত হইতে লাগিলেন। ইন্দ্রাদি সুরগণ য়াঁহার বাহুবলের উপাসনা করেন, সেই অরিবিমর্দ্দন হরি এক্ষণে মনুষ্যভাব অবলম্বন করিলেন। কি আশ্চৰ্য্য! ভগবান স্বয়ম্ভু পুনর্ব্বার এই ক্ষত্ৰিয়াদিগকে সংহার করিবেন। যাহার উদ্দেশ্যে লোক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করে, সেই যজ্ঞেশ্বর স্বয়ং আসিয়া বহুমান প্রদর্শনপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের মহাধ্বরে অবস্থিতি করিতেছেন। সর্ব্বজ্ঞ নারদ নারায়ণকে স্মরণ করিয়া এই সমস্ত চিন্তা করিতে লাগিলেন।

ভীষ্মানুমোদনে শ্ৰীকৃষ্ণকে অর্ঘ্যপ্রদান

অনন্তর ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হে ভারত! রাজাদিগের যথার্হ সৎকার-বিধান কর। আচাৰ্য্য, ঋত্বিক, সম্বন্ধী, স্নাতক, নৃপতি এবং প্রিয়ব্যক্তি এই ছয়জন অর্ঘ্যাহ্য; ইহারা অর্ঘ্য পাইবার মানসে বহুদিবসাবধি আমাদিগের অনুগত হইয়া রহিয়াছেন; অতএব ইহাদের সকলের নিমিত্ত এক একটি অর্ঘ্য আনয়ন কর, পরে যিনি সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ও সমর্থ হইবেন, তাহাকেই অর্ঘ্য প্রদান করিবে।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে পিতামহ! আপনি কাহাকে অর্ঘ্যদানের উপযুক্ত পাত্ৰ মনে করিয়াছেন, বলুন।” ভীষ্ম স্বীয় বিবেকশক্তি দ্বারা কৃষ্ণকে আর্ঘ্যার্হ নিশ্চয় করিয়া কহিলেন, “যেমন জ্যোতিষ্ক সমুদয়ের মধ্যে ভাস্করের প্রভা সর্ব্বাতিশায়িনী, তদ্রুপ এই সমস্ত লোকের মধ্যে তেজ, বল ও পরাক্রম বিষয়ে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ; যেমন তিমিরাবৃত প্রদেশে সূৰ্য্যরশ্মিসমাগমে লোকের অন্তঃকরণ প্ৰফুল্ল হয়, যেমন নির্ব্বাত স্থানে বিশুদ্ধ বায়ু সঞ্চালিত হইলে আহ্লাদের পরিসীমা থাকে না, তদ্রুপ কৃষ্ণের সমাগমে আমাদিগের সভা উদ্ভাসিত ও আহ্লাদিত হইয়াছে; অতএব তাঁহাকে অর্ঘ্য প্ৰদান করাই কর্তব্য।” অনন্তর সহদেব ভীষ্ম কর্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া কৃষ্ণকে যথাবিধি অর্ঘ্য প্রদান করিলেন। কৃষ্ণ শাস্ত্রদৃষ্ট বিধিপূর্ব্বক সেই অর্ঘ্য প্রতিগ্ৰহ করিলেন।

মহাবল পরাক্রান্ত শিশুপাল কৃষ্ণের পূজা সহ্য করিতে না পারিয়া সভামধ্যে ভীষ্ম, যুধিষ্ঠির এবং কৃষ্ণকে তিরস্কার করিতে লাগিলেন।