৩২. রাজসূয়িক-পর্ব্বাধ্যায়

রাজসূয়িক-পর্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! রাজা যুধিষ্ঠির প্ৰযত্নাতিশয়সহকারে প্রজামণ্ডলী রক্ষণাবেক্ষণ, সত্য প্রতিপালন ও অরাতিকুল সমূলে উন্মুলনা করিলে প্রজাসকল স্ব স্ব কর্তব্য কর্মের অনুষ্ঠানে তৎপর হইল। যথাশাস্ত্র করগ্রহণ ও ধর্ম্মতঃ রাজ্যশাসন করায় জলদমালা যথাকালে পৰ্য্যাপ্তপরিমাণে বারিবর্ষণ করিতে লাগিল; জনপদ সমৃদ্ধ হইয়া উঠিল; রাজার পুণ্যবলে কৃষি, বাণিজ্য ও গোরক্ষণ প্রভৃতি সমুদয় কাৰ্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হইতে লাগিল; কেহ কাহাকে প্রতারণা করিত না; দস্যু, তস্কর, ধূর্ত ও রাজপুরুষদিগের মুখে মিথ্যাকথা শুনিতে পাওয়া যাইত না; তৎকালে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ব্যাধিভয় ও অগ্নিভয় প্রভৃতি কিছুমাত্র অমঙ্গলঘটনা ঘটিত না; সামন্তভূপতিগণ জিগীষাশূন্য হইয়া কেবল উপহার প্রদান ও প্রিয়কাৰ্য্য করিবার নিমিত্ত যুধিষ্ঠিরের অনুসরণ করিতেন, তিনি কখন অধৰ্মাচরণপূর্ব্বক ধনাগমের চেষ্টা পাইতেন না, তথাপি তাঁহার এত ঐশ্বর্য হইয়াছিল যে, শত শত বৎসর অকাতরে ব্যয় করিলেও ক্ষয়প্রাপ্তির সম্ভাবনা ছিল না। মহীপতি কৌন্তেয় স্বীয় বাসভবন ও কোষাগারের পরিমাণ সবিশেষরূপে পরিজ্ঞাত হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠানের মানস করিলেন। তদীয় সুহৃদবর্গ একত্র ও পৃথক পৃথক হইয়া তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে মহারাজ! আপনার যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত অবসর উপস্থিত হইয়াছে, অতএব অবিলম্বে আরম্ভ করুন।”

যুধিষ্ঠির সমীপে কৃষ্ণের আগমন

সকলে উক্ত প্রকার জল্পনা করিতেছেন, ইত্যবসরে চরাচর শ্ৰেষ্ঠ ভূতভাবন ভগবান সনাতন বাসুদেব তথায় সমুপস্থিত হইলেন। যেমন প্রাচীর দ্বারা পুরী রক্ষিত হয়, তদ্রুপ তিনি যদুকুলের পরিরক্ষক ছিলেন। কৃষ্ণ বাসুদেবকে সৈন্যাধিকারে নিযুক্ত করিয়া ধর্ম্মরাজের নিমিত্ত অসংখ্য ধন ও অবিনশ্বর রত্নজাত গ্রহণপূর্ব্বক চতুরঙ্গিণী সেনা-সমভিব্যাহারে নগরে প্রবেশ করিলেন। তদীয় সৈন্যস্থ রথনির্ঘোষে রাজপুরী প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। যেমন সূৰ্য্যোদয়ে লোকের অন্তঃকরণ প্ৰফুল্ল হয় এবং নির্ব্বাত স্থানে বায়ু সঞ্চারিত হইলে সকলে অনির্ব্বচনীয় সুখানুভব করে, তদুপ কৃষ্ণের সমাগমে ভারতীকুল সুখহ্রদ ও আনন্দসাগরে নিমগ্ন হইল। তৎকালে জনপূর্ণ ভারতীকুল সমধিক সঙ্কুল হইয়া উঠিল। তত্ৰত্য জনগণ প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক কৃষ্ণের যথাবিধি সৎকার করিলেন।

কৃষ্ণের নিকট যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞানুমতি প্রার্থনা

ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃচতুষ্টয়, পুরোহিত ধৌম্য ও মহর্ষি দ্বৈপায়নপ্রমুখ ঋষিগণে পরিবৃত হইয়া অনাময়প্রশ্নপূর্ব্বক সুখাসীন কৃষ্ণকে কহিতে লাগিলেন, “হে বাসুদেব! কেবল তোমার অনুগ্রহে এই সসাগরা বসুন্ধরা আমার বশবর্তিনী হইয়াছে, তোমারই প্ৰসাদে আমি এই অতুল ঐশ্বৰ্য্যের অধিপতি হইয়াছি। এক্ষণে উক্ত সমস্ত ধনসম্পত্তি বিপ্রসাৎ করিতে বাসনা করি; কিন্তু আমার নিতান্ত অভিলাষ যে, তোমার ও অনুজগণের সহিত মিলিত হইয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করি; অতএব কাৰ্য্যারম্ভের অনুমতি করিয়া আমাকে চরিতার্থ করা। হে গোবিন্দ! তোমাকে ঐ যজ্ঞে দীক্ষিত হইতে হইবে, তুমি দীক্ষিত হইলেই আমি নিষ্পাপ হইব, সন্দেহ নাই। অথবা অনুজগণের সহিত আমাকেই দীক্ষিত হইতে আজ্ঞা কর। তৎকর্তৃক অনুজ্ঞাত হইলেই আমি অনুত্তম যজ্ঞানুষ্ঠানের ফলভাগী হইব, সন্দেহ নাই।”

কৃষ্ণাদেশে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ারম্ভ

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের ভুরিভুরি গুণকীর্তনপূর্ব্বক প্রত্যুত্তর করিলেন, “হে মহারাজ! আপনিই মহাক্ৰতু রাজসূয় অনুষ্ঠানের উপযুক্ত পাত্ৰ; অতএব অবিলম্বে যজ্ঞে দীক্ষিত হউন। আপনি যজ্ঞ সমাপন করিলে আমরা সকলেই কৃতকাৰ্য্য হইব। আমি আপনার হিতানুষ্ঠানে তৎপর থাকিলাম, আপনি স্বাভিলষিত যজ্ঞ আরম্ভ করুন। আপনি আমাকে যে কাৰ্য্যে নিয়োগ করিবেন, আমি তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদনা করিব।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! আমার ইচ্ছানুসারে যখন তুমি স্বয়ং উপস্থিত হইয়াছ, তখন আমার সঙ্কল্প সফল হইয়াছে এবং সিদ্ধিলাভে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।”

রাজা যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকর্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া ভ্রাতৃগণের সহিত রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠানের নিমিত্ত দ্রব্যসামগ্ৰী আহরণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর অমাত্যগণ ও সহদেবকে আজ্ঞা করিলেন, ‘ব্রাহ্মণেরা যে সমস্ত যজ্ঞাঙ্গদ্ৰব্য আয়োজনের অনুমতি করিয়াছেন, তাহা এবং অন্যান্য সমুদয় উপকরণসামগ্ৰী, মাঙ্গল্যদ্রব্য ও ধৌম্যোক্ত যজ্ঞসম্ভার-সকল সত্বর আনয়ন করাও । ইন্দ্ৰসেন, বিশোক এবং অর্জ্জুনসারথি পুরু, ইহারা আমার প্রিয়চিকীৰ্ষাৰ্থ অন্নাদি আহরণে নিযুক্ত হউন। তুমি ব্রাহ্মণগণের প্রিয়কাৰ্য্য-সাধনাৰ্থ মনোহর, সুরস, সুগন্ধি সমুদয় কাম্যবস্তুর আয়োজন কর।” যুধিষ্ঠিরের বাক্য সমাপ্ত না হইতেই সহদেব অতি বিনীতভাবে নিবেদন করিলেন, “প্ৰভো! আপনার আদেশের পূর্ব্বেই ঐ সকল কাৰ্য্য সম্পন্ন হইয়াছে।” অনন্তর মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন মূর্তিমান বেদস্বরূপ কতিপয় ঋত্বিক আনয়ন করিলেন এবং তিনি স্বয়ং সেই যজ্ঞের ব্ৰহ্মকাৰ্য্যে দীক্ষিত হইলেন। ধনঞ্জয়-গোত্ৰশ্রেষ্ঠ সুসামা সামগানার্থ ব্ৰতী হইলেন। ব্রহ্মিষ্ঠ যাজ্ঞবল্ক্য অধ্বর্ষ্যু, বসুপুত্র পৌল ও ধৌম্য হোতা এবং বেদবেদান্ত পারগ। তাহাদের শিষ্যবৰ্গ ও পুত্ৰগণ সদস্য হইলেন। তাহারা যজ্ঞবিষয়ে নানাবিধ তৰ্ক-বিতর্ক করিয়া স্বস্তিবাচনপূর্ব্বক সঙ্কল্প করিয়া সেই মহৎ যজ্ঞস্থানের শাস্ত্রোক্ত পূজা করিলেন। পরে শিল্পকারেরা অনুজ্ঞাত হইয়া তথায় দেবগৃহসদৃশ উত্তমোত্তম গৃহসমূহ নিৰ্মাণ করিল।

যজ্ঞ নিমন্ত্রণার্থ দূতপ্রেরণ

অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির সহদেবকে আজ্ঞা করিলেন, “হে ভ্ৰাতঃ! নিমন্ত্রণার্থ দ্রুতগামী দূতসকল সর্ব্বত্র প্রেরণ কর।” সহদেব রাজবাক্য শ্রবণমাত্র চতুর্দিকে দূতগণকে প্রেরণ করিলেন, তাহাদিগকে কহিয়া দিলেন, “জনপদস্থ সমস্ত ব্রাহ্মণ ও রাজগণকে নিমন্ত্রণ করিয়া আইস এবং বৈশ্য ও সম্মানযোগ্য সদ্বিদ্বাে্‌ শূদ্ৰদিগকে সমভিব্যাহারে আনয়ন করিও।” দূতেরা আজ্ঞা পাইয়া সমুদয় ব্রাহ্মণ ও রাজাদিগকে নিমন্ত্ৰণ করিয়া অপরাপর ব্যক্তিদিগের সহিত শীঘ্ৰ প্ৰত্যাগমন করিল।

যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞদীক্ষা

সেই সকল ব্রাহ্মণেরা যথাকলে যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞে দীক্ষিত করিলেন। ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির যজ্ঞে দীক্ষিত ও সহস্ৰ সহস্ৰ ব্রাহ্মণ, ভ্রাতৃগণ, সুহৃদবর্গ, জ্ঞাতিকুল, সহাচারিগণ, নানাদেশ হইতে সমাগত প্রধান প্রধান ক্ষত্ৰিয় সকল ও অমাত্যবর্গে পরিবৃত চতুর্দিক হইতে সর্ব্ববিদ্যাকুশল বেদবেদান্তপারগ ব্ৰাহ্মণেরা তথায় সমাগত হইতে লাগিলেন। শিল্পকারেরা ধর্ম্মরাজের শাসনক্রমে তাঁহাদিগের নিমিত্ত পৃথক পৃথক বাসস্থান নির্ম্মাণ করিল। সেই সকল আবসথ [গৃহ] বহুবিধ অন্নপানে পরিপূর্ণ, বিচিত্ৰ চন্দ্ৰাতপে [চাঁদোয়া] বিভূষিত এবং সর্ব্বসুখপ্রদ দ্ৰব্যজাতে সমাকীর্ণ। ব্রাহ্মণের রাজা কর্তৃক সৎকৃত হইয়া বাসপূর্ব্বক নৃত্যগীতাদি সন্দর্শনপূর্ব্বক নানাবিধ কথাপ্রসঙ্গে পরমসুখে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন। তৎপ্রদেশে ভোজনাসক্ত, আখ্যায়িকা-তৎপর ও আহ্লাদসাগরে নিমগ্ন বিপ্ৰগণের কোলাহলশব্দ সর্ব্বদা শ্রুত হইতে লাগিল। ফলতঃ তথায় সর্ব্বদা কেবল “দীয়তাং ভূজ্যতাং” এইমাত্র শব্দ শ্রুতিগোচর হইত। ধর্ম্মরাজ সমস্ত নিমন্ত্রিত জনগণকে পৃথক পৃথক গোসমূহ, শয্যা, অসংখ্য সুবর্ণ ও দিব্যাভরণভূষিতা রূপযৌবনবতী সর্ব্বাঙ্গ-সুন্দরী রমণী প্রদান করিলেন। সুরলোকাধিপতি ইন্দ্রের ন্যায় পৃথিবীর অদ্বিতীয় অধীশ্বর মহাত্মা পাণ্ডবের যজ্ঞ এইরূপে উত্তরোত্তর সুসমৃদ্ধ হইয়া উঠিল। অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির ভীষ্ম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, কৃপাচাৰ্য্য ও দুৰ্য্যোধনাদি ভ্রাতৃবর্গের নিমন্ত্রনার্থ নকুলকে হস্তিনাপুরে প্রেরণ করিলেন।