৩০. সহদেব-দিগ্বিজয়

সহদেব-দিগ্বিজয়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, অনন্তর সহদেব ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কর্তৃক পূজিত [মাঙ্গল্যবিধানে সৎকৃত] হইয়া মহতী সেনা-সমভিব্যাহারে দক্ষিণদিকে যাত্রা করিলেন। তিনি প্রথমতঃ মথুরা নগরী জয় করিলেন। তৎপরে মৎস্যরাজ তদীয় বলবীৰ্য্যের বশীভুত হইলেন। অনন্তর অধিরাজাধিপতি মহাবল দস্তবক্রকে জয় ও তাহাকে করদ করিয়া স্বরাজ্যে স্থাপিত করিলেন। তৎপরে সুকুমার ও নরাধিপ সুমিত্ৰকে বশীভূত করিয়া পটচ্চর ও অপর মৎস্যদিগকে পরাজয় করিলেন; তৎপরে নিষাদভূমি, গোশৃঙ্গ পর্ব্বত ও শ্রেণীমান পার্থিবকে বল প্রকাশ করিয়া বশীভূত করিলেন। তৎপরে নবরাষ্ট্রকে জয় করিয়া কুন্তিভোজের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। কুন্তিভোজী প্রীতিপূর্ব্বক সহদেবের শাসন শিরোধাৰ্য্য করিলেন। অনন্তর স্রোতস্বতী চর্ম্মন্বতীর তীরদেশে পূর্ব্ববৈরী, বাসুদেব কর্তৃক পরাজিত জম্ভকাত্মজ মহারাজকে দেখিলেন। তিনি সহদেবের সহিত ঘোরতর সংগ্রাম করিলেন। পরিশেষে সহদেব তাহাকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া দক্ষিণাভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। তথায় সেক ও অপরসেক সহদেবের নিকট পরাজিত হইলেন। সহদেব তাহাদিগের নিকট কর গ্রহণ ও বিবিধ রত্ন আহরণ করিয়া তাহাদিগেরই সমভিব্যাহারে নর্ম্মদা নদীর অভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। তথায় সুমহৎ সৈন্যসমূহ পরিবৃত অবন্তিদেশসমুৎপন্ন মহাবীর বিন্দানুবিন্দদ্বয়কে যুদ্ধে জয় করিয়া তাহাদিগের নিকট বিবিধ রত্ন গ্রহণপূর্ব্বক ভোজকটপুরে গমন করিলেন। সেই স্থানে নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ মহারাজ ভীষ্মকের সহিত দুই দিবস ঘোরতর সংগ্ৰাম হইতে লাগিল, পরিশেষে তাহাকে পরাজয় করিয়া কোশলাধিপতি, বেণ্বানদীর তীরস্থ নৃপতি আরণ্যক ও অযোধ্যার পূর্বাংশের অধীশ্বরদিগকে সমরে পরাজয় করিলেন। তৎপরে নাটকেয় ও হেরম্বকদিগকে যুদ্ধে জয় করিয়া মারুধ ও মুঞ্জগ্রাম বলপূর্ব্বক অধিকার করিলেন। পরে নাটবিক, অর্বুক ও সেই সমস্ত আরণ্যক নৃপতিদিগকে জয় করিতে লাগিলেন। তদনন্তর বাতাধিপতিকে হস্তগত ও পুলিন্দাদিগকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া সহদেব দক্ষিণাভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। পাণ্ড্যরাজ্যের সহিত এক দিবস যুদ্ধ হইল। তিনি পাণ্ড্যরাজকে পরাজয় করিয়া দক্ষিণাপথে প্রস্থান করিলেন। ত্ৰিলোকবিখ্যাত কিষ্কিন্ধ্যা নাম্নী বানরনগরীতে উপস্থিত হইয়া বানররাজ মৈন্দ ও দ্বিবিদের সহিত সাত দিবস ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাঁহারা কিছুতেই পরিশ্রান্ত বা বিকারপ্রাপ্ত হইলেন না। তখন তাঁহারা সাতিশয় হৃষ্ট ও সন্তুষ্ট হইয়া সহদেবকে প্রীতিপূর্ব্বক কহিলেন, “হে পাণ্ডবা-শার্দুল! তুমি আমাদিগের নিকট বিবিধ রত্ন গ্রহণপূর্ব্বক এ স্থান হইতে প্ৰস্থান কর। তুমি যে কাৰ্য্য সমাধা করিতে উদ্যত হইয়াছ, তদ্বিষয়ে তোমার শ্রেয়োলাভ হইবে।” অনন্তর তিনি তথা হইতে রত্ন গ্ৰহণ পূর্ব্বক মাহিষ্মতী নগরীতে গমন করিলেন। তথায় মহারাজ নীলের সহিত সহদেবের সৈন্যক্ষয়কর ঘোরতর সংগ্ৰাম আরম্ভ হইল। সকলের প্রাণসঙ্কট উপস্থিত, ভগবান হুতাশন ঐ যুদ্ধে নীলরাজকে সাহায্য দান করিতে লাগিলেন। সহদেবের সৈন্যমধ্যে অশ্ব, রথ, হস্তী, পুরুষ ও কবচ-সমুদয় প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। এই বিস্ময়কর ব্যাপারসন্দর্শনে কুরুনন্দন সহদেব ইতিকর্তব্যতা বিমূঢ় হইয়া রহিলেন।

মাহিষ্মতীর অজেয়তা

জনমেজয় কহিলেন, হে তপোধন! সহদেব রাজা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের আয়োজন করিতেছেন, ভগবান্‌ বহ্নি কি নিমিত্ত রণক্ষেত্রে তাঁহার বিপক্ষতাচরণ করিলেন? বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! এইরূপ কিংবদন্তী আছে যে, পূর্ব্বে মাহিষ্মতীবাসী ভগবান পাবক পারদরিক বলিয়া গৃহীত হয়েন। নীলরাজের সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী এক কুমারী কন্যা ছিল, সে সর্ব্বদা পিতার বোধন সাধনের নিমিত্ত অগ্নির উপাসনা করিত। অগ্নি ঐ রাজকুমারীর রমণীয় ওষ্ঠ্যপুটবিনিগত বায়ু ব্যতিরেকে ব্যজন দ্বারা উপবীজ্যমান হইলেও প্ৰজ্বলিত হইতেন না। অনন্তর বহ্নি ব্ৰাহ্মণরূপ পরিগ্ৰহ করিয়া সেই পদ্মাপলাশিলোচনা সুদৰ্শন কন্যার সহিত স্বেচ্ছাক্রমে বিহার করিতে লাগিলেন এবং রাজাকে অনাদর করিয়া সকলের গৃহেই গমনাগমন করিতেন। ধর্ম্মপরায়ণ রাজা এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়া শাস্ত্রানুসারে তাঁহাকে শাসন করিলেন। তখন ভগবান অগ্নি ক্ৰোধে অধীর হইয়া প্ৰজ্বলিত হইলেন। রাজা এই অদ্ভুত ব্যাপারদর্শনে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া বিপ্ররূপী বহ্নির শরণ গ্রহণপূর্ব্বক শুভদিনে শুভলগ্নে তাঁহাকে কন্যা সম্প্রদান করিলেন। অনল নীলরাজদুহিতাকে পরিগ্রহ করিয়া প্রসন্ন হইয়া তাঁহাকে কহিলেন, “মহারাজ! বর প্রার্থনা কর।” রাজা এইরূপ অভিহিত হইয়া আপনার ও সৈন্যসামন্তের অভয় প্রার্থনা করিলেন। তদবধি এই বৃত্তান্ত না জানিয়া যে-কোন নরপতি মাহিম্মতী পুরী জয় করিতে ইচ্ছা করেন। ভগবান অগ্নি তাহাকে দগ্ধ করিয়া থাকেন। তদবধি এই নগরীতে কেহই স্ত্রীলোকদিগকে স্বেচ্ছানুসারে গ্রহণ করিতে পারেন না। অগ্নি মহিলাগণকে ‘আবরণীয়া হও’ এই বলিয়া বর দান করায়, তদবধি তাহারা স্বৈরিণী হইয়া ইচ্ছানুসারে ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিয়া থাকে। এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া ও অগ্নিভয়ে ভীত হইয়া রাজগণ মাহিষ্মতী নগরী পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন।

এইরূপে উপাখ্যান সমাপন করিয়া বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! সহদেব সৈন্যদিগকে অগ্নিপরীত [অগ্নি দ্বারা বেষ্টিত] ও একান্ত ভীত দেখিয়া আচলের ন্যায় নিশ্চল হইয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে শুচি হইয়া আচমনপূর্ব্বক পাবককে এইরূপ স্তব করিতে লাগিলেন, “ভগবন! আমি আপনার প্রসাদেই দিগ্বিজয় করিতেছি, আপনাকে নমস্কার করি। আপনি দেবগণের মুখস্বরূপ ও আপনিই যজ্ঞ। জগৎকে পবিত্ৰ করিতেছেন, এই নিমিত্ত আপনার নাম পাবক। বহনীয় দ্রব্যজাত বহন করিয়া থাকেন, এই কারণে হব্যবাহন হইয়াছেন। আপনা হইতে বেদ জন্মিয়াছে, এই জন্যই সকলে আপনাকে জাতবেদা বলিয়া থাকে। হে বিভাবসো! আপনিই চিত্ৰভানু, সুবেশ ও অনল। আপনিই স্বৰ্গদ্বারস্পর্শী হুতাশন, জ্বলন ও শিখী; আপনিই বৈশ্বানর, পিঙ্গে শ, সর্ব্বতেজোনিধান ও কুমারসূ [কাৰ্ত্তিকেয়ের ধারণকর্তা]; আপনিই ভগবান রুদ্রগর্ভ ও হিরণ্যকৃৎ। হে অনল! আপনি আমাকে তেজঃপ্রদান করুন; বায়ু প্ৰাণদান ও পৃথিবী বলাধান করুন; জল মঙ্গলসাধন করুন। ভগবান! আপনা হইতে বারি সম্ভূত হয়, আপনি সুরশ্রেষ্ঠ ও দেবগণের মুখস্বরূপ; আপনি এক্ষণে আমাকে পবিত্র করুন। ঋষি, ব্ৰাহ্মণ, দেবতা ও অসুরগণ। যে সমস্ত যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, আপনি তথায় অবস্থান করিয়া থাকেন। এক্ষণে সত্য দ্বারা আমাকে পবিত্র করুন। হে আগ্নে! আমি প্রীতি ও শুচি হইয়া আপনাকে স্তব করিতেছি, এক্ষণে আপনি আমাকে তুষ্টি, পুষ্টি, শ্রুতি ও প্রীতি প্ৰদান করুন।”

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! যিনি এইরূপ আগ্নেয় মন্ত্র উচ্চারণপূর্ব্বক হোম করিয়া থাকেন, তিনি সম্পত্তিশালী, দান্ত ও সর্ব্বপাপ হইতে বিমুক্ত হন।

অগ্নির স্তুতিবাদ করিয়া সহদেব তাঁহার নিকট এই প্রার্থনা করিলেন, “ভগবন! হব্যবাহন! আপনি এই যজ্ঞে কোন বিঘ্ন সম্পাদন করিবেন না।” এইরূপ প্রার্থনানন্তর তিনি ভূতলে কুশ বিত্তীর্ণ করিয়া বিধিপূর্ব্বক পাবকের অভিমুখে উপবেশন করিলেন। যেমন মহাসাগর তীরভূমি অতিক্রম করে না, সেইরূপ অগ্নিভীত ও উদ্বিগ্ন সৈন্যগণ এবং সম্মুখে আসীন নরদেব সহদেবকে অতিক্রম করিলেন না; অনন্তর অগ্নি অতিমন্দ-গমনে প্ৰণত সহদেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সান্ত্ববাদ প্রয়ােগপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে কুরুনন্দন! উত্থিত হও। তোমার ও ধর্ম্মানন্দন যুধিষ্ঠিরের অভিপ্রায় সম্যক অবগত হইয়াছি; তথাচ যে পৰ্য্যন্ত নীল রাজার বংশে কোন বংশধর রাজা থাকিবেন, তদবধি আমি এই নগরী রক্ষা করিব, এক্ষণে তোমার যেরূপ মনোরথ তাহা সফল হইবে।”

ইহা শ্রবণে মাদ্রীতনয় হৃষ্টান্তঃকরণে উত্থিত হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নমস্কার করিয়া বহ্নির পূজা করিলেন। বহ্নি প্রতিনিবৃত্ত হইলে পর মহারাজ নীল তদীয় আদেশানুসারে সহদেবসন্নিধানে উপনীত হইয়া শাস্ত্রানুসারে তাহার অর্চনা করিলেন। সহদেব পূজাগ্রহণপূর্ব্বক নীলরাজাকে হস্তগত করিয়া দক্ষিণাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। নরদেব সহদেব প্রভূত পরাক্রমশালী ত্ৰৈপুররক্ষককে স্বদেশে স্থাপন করিয়া পৌরবেশ্বরকে বলপূর্ব্বক আপনার বশীভূত করিয়া রাখিলেন। অনন্তর দৃঢ়তর যত্নসহকারে সুরােষ্ট্রাধিপতি কৌশিচাৰ্য্য আকৃতিকে আপনার বশবর্তী করিলেন; সুরাষ্ট্ররাজ্যে অবস্থান করিয়াই তিনি ভোজকটস্থ মহাপাত্র রাজা রুক্মী ও পরমধাৰ্মিক দেবরাজ-সখা মহারাজ ভীষ্মকের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। ভীষ্মক ও তাঁহার পুত্র উভয়েই সহদেবের শাসন শিরোধাৰ্য্য করিলেন। তৎপরে মাদ্রীসূত সহদেব প্রীতিপূর্ব্বক বাসুদেবের সহিত সাক্ষাৎ ও তাঁহার নিকট হইতে উৎকৃষ্ট দ্রব্যজাত গ্রহণপূর্ব্বক পুনরায় গমন করিতে লাগিলেন। তৎপরে সুর্পারক, তালাকাট ও দণ্ডকদিগকে বশীভূত করিলেন। তদনন্তর সগরদ্বীপবাসী ও স্লেচ্ছাযোনিসভূত ভূপতি, নিষাদ, রাক্ষস, কৰ্ণ, প্রাবরণ, নররক্ষস-যোনিজ কালমুখ, কোলগিরি, সুরভিপট্টন, তাম্রাক্ষ দ্বীপ, রামক পর্ব্বত ও তিমিঙ্গিল বশীভূত করিয়া একপাদ পুরুষ, বনবাসী কোরক, সঞ্জয়ন্তী নগরী ও করহাটক, এই সকলকে কেবল দূত দ্বারা আপনার বশবর্তী করিয়া কর আহরণ করিলেন। পরে পাণ্ড্য, দ্রাবিড়, ওড্র, কেরল, অন্ধ, তালবন, কলিঙ্গ, উষ্ট্র, কণিক, রমণীয়া আটবী পুরী ও যবনপুর দূত দ্বারা নিজােয়ত্ত করিয়া কর সংগ্ৰহ করিলেন। তৎপরে মহাত্মা বিভীষণের নিকট দূত পঠাইলেন। বিভীষণ প্রীতিপূর্ব্বক তাঁহার শাসন শিরোধাৰ্য্য করিয়া বিবিধ রত্ন, অগুরু, চন্দনকাষ্ঠ, দিব্য আভরণ, মহার্হ বসন ও মহামূল্য মণি প্রেরণ করিলেন। মহারাজ! এইরূপে ধীমান্য সহদেব বল, সাত্ত্ববাদপ্রয়োগ ও বিজয় দ্বারা পার্থিকদিগকে করদ করিয়া প্রত্যাগমন করিলেন এবং ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে জয়লব্ধ সমস্ত দ্রব্যজাত সমর্পণপূর্ব্বক কৃতকৃত্য হইয়া পরমসুখে বাস করিতে লাগিলেন।