১৯. জরাসন্ধবধ-পর্ব্বাধ্যায়

জরাসন্ধবধ-পর্ব্বাধ্যায়

বাসুদেব কহিলেন, “হে যুধিষ্ঠির! হংস ও ডিম্ভক নিহত হইয়াছে; কংসও সগণে মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইয়াছে। এক্ষণে জরাসন্ধবধের সময় সমুপস্থিত। সমস্ত সুরাসুর একত্ৰ হইলেও যুদ্ধে জরাসন্ধকে পরাজয় করিতে পারে না; অতএব আমার মতে উহাকে প্রাণযুদ্ধে জয় করা উচিত। দেখুন, আমি নীতিজ্ঞ, ভীমসেন বলবান এবং অর্জ্জুন আমাদের রক্ষয়িতা, অতএব যেমন তিন অগ্নি একত্ৰ হইয়া যজ্ঞ সম্পন্ন করেন, সেইরূপ আমরা তিনজন একত্ৰ হইয়া জরাসন্ধের বধসাধন করিব। আমরা তিনজন নির্জনে আক্রমণ করিলে জরাসন্ধ অবশ্যই একজনের সহিত সংগ্রাম করিবে। সে অবমাননা, লোভ ও বাহুবীৰ্য্যে উত্তেজিত হইয়া ভীমের সহিত যুদ্ধ করিবে, সন্দেহ নাই। যম যেমন উদ্ধতলোকের বিনাশে সমর্থ, সেইরূপ মহাবল পরাক্রান্ত মহাবাহু ভীমসেন বৃহদ্ৰথতনয়কে সংহার করিতে পরিবেন। অতএব যদি আপনি আমার হৃদয়জ্ঞ হন এবং যদি আমার প্রতি আপনার বিশ্বাস থাকে, তবে শীঘ্ৰ ভীম ও অর্জ্জুনকে ন্যায়স্বরূপ আমার হস্তে সমর্পণ করুন।’

বৈশম্পায়ন কহিলেন, ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভগবান কৃষ্ণের বাক্য শ্রবণানন্তর প্রফুল্লমুখে উপবিষ্ট ভীম ও অর্জ্জুনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কৃষ্ণকে কহিলেন, “হে অরাতিনিসূদন! তুমি আর ওরূপ কহিও না। তুমি পাণ্ডবগণের অধিপতি; আমরা তোমারই আশ্রিত। তুমি যাহা যাহা কহিলে, তৎসমুদয়ই যুক্তিসিদ্ধ বটে, লক্ষী যাহাদের প্রতিকূলা, তুমি কখনই তাহাদের নিকট থাক না। যখন আমি তোমার নির্দেশানুবর্তী রহিয়াছি, তখন আমার জরাসন্ধকে বধ করিবার, বদ্ধ ভূপতিদিগকে কারাগার হইতে মুক্ত করিবার এবং রাজসূয় যজ্ঞ সুসম্পন্ন করিবার আর অপেক্ষা কি আছে? অতএব হে নরোত্তম! এক্ষণে যাহাতে এই সমুদয় কাৰ্য্য ত্বরায় সম্পন্ন হয়, অপ্ৰমত্তচিত্তে তাঁহাই কর। আমি তোমাদের তিনজন ব্যতিরেকে ধর্ম্মার্থ-কামারহিত ও রোগার্তের ন্যায় দুঃখিত হইয়া জীবনধারণ করিতে নিতান্ত অসমর্থ। অর্জ্জুন তোমা বিনা জীবনধারণ করিতে পারে না, তুমিও অর্জ্জুন ব্যতীত ক্ষণকাল থাকিতে পার না। এই ভূমণ্ডলে তোমাদের দুই জনের অজেয় কেহই নাই। আর এই মহাবীৰ্য্য-সম্পন্ন শ্ৰীমান বৃকোদর তোমাদের দুইজনের সমভিব্যাহারে থাকিলে কি না সম্পন্ন করিতে পারে? সৈন্য সুশিক্ষিত হইলে উত্তমরূপে যুদ্ধকাৰ্য্য সমাধা করে, অশিক্ষিত সৈন্যেরা অকর্ম্মণ্য হয়, তন্নিমিত্ত উহাদিগকে উত্তমরূপে শিক্ষা প্ৰদান করা বিচক্ষণ ব্যক্তিগণের কর্তব্য। যেমন ধীবরগণ যে স্থানে ছিদ্র থাকে, সেই স্থান দিয়া অভিলষিত স্থানে জল লইয়া যায়, তদ্রুপ বুদ্ধিমান ব্যক্তি উপদ্রবশূন্য প্রদেশেই জড় সৈন্য লইয়া গমন করে; মহাবীরের নিকট কদাচ লইয়া যায় না। অতএব আমরা নীতিবিধানজ্ঞ লোকবিশ্রুত গোবিন্দকে আশ্রয় করিয়া কাৰ্য্যসিদ্ধিবিষয়ে যত্ন করিতেছি। হে যদুবংশাবতংস! তুমি প্রজ্ঞা, নীতি, বল, ক্রিয়া ও উপায়-সম্পন্ন, অতএব ভীম ও অর্জ্জুন কাৰ্য্য সিদ্ধির নিমিত্ত তোমাকেই অগ্রসর করিবে; এইরূপে আমাদের কাৰ্য্যসিদ্ধির নিমিত্ত অর্জ্জুন তোমার অনুগমন করুক এবং ভীম অর্জ্জুনের অনুগমন করুক, তাহা হইলেই বিক্রম, নীতি, জয় ও বল সিদ্ধ হইবে, সন্দেহ নাই।”

জরাসন্ধ-বধে ভীমাদির যাত্রা

বৈশম্পায়ন কহিলেন, বিপুলতেজাঃ বাসুদেব যুধিষ্ঠিরের এই বাক্য শ্রবণানন্তর ভীমার্জ্জুন সমভিব্যাহারে তেজস্বী স্নাতক ব্রাহ্মণগণের পরিচ্ছদ পরিধানপূর্ব্বক মগধদেশে যাত্ৰা করিলেন। সুহৃদগণ মনোহর বাক্য দ্বারা তাহাদিগকে অভিনন্দন করিতে লাগিলেন। ক্ৰোধে অভিতপ্ত, জ্ঞাতিবর্গের হিতসাধনে একান্ত উৎসুক এবং চন্দ্ৰ, সূৰ্য্য ও অগ্নির ন্যায় তেজস্বী সেই তিনজনের কলেবর তৎকালে অধিকতর প্রদীপ্ত হইয়া উঠিল। অগ্ৰে ভীমসেন, তৎপশ্চাৎ সংগ্রামে বিজয়ী ধর্ম্মার্থকাম-প্রবর্তয়িতা মহাত্মা শ্ৰীকৃষ্ণ, তদনন্তর অর্জ্জুন হমন করিতেছেন দেখিয়া সকলেই মনে করিল, এইবার জরাসন্ধ নিশ্চয় নিহত হইবে। তখন কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জ্জুন কুরুদেশে উত্তীর্ণ হইয়া কুরুজঙ্গলের মধ্য দিয়া রমণীয় পদ্মসরে গমন করিলেন। তৎপরে কালকূট অতিক্রম করিয়া গণ্ডকী, মহাশোণ, সদানীরা এবং একপর্ব্বতকে [একমাত্র পর্ব্বত দ্বারা রক্ষিত দেশ] স্থিত নদী-সমুদয় ক্ৰমে ক্রমে উত্তীর্ণ হইলেন। তদনন্তর রমণীয় সরযু অতিক্রম করিয়া পূর্ব্বকোশলা দেখিতে পাইলেন। তথা হইতে মিথিলা ও মিথিলা হইতে মালায় গমনপূর্ব্বক চর্ম্মণ্বতী নদী পার হইলেন। তৎপরে গঙ্গা ও শোণ অতিক্রম করিয়া তিনজনে পূর্ব্বমুখে মগধদেশে গমন করিতে লাগিলেন। তাহারা কিয়ৎক্ষণ পরে গোধনসমাকীর্ণ হ্রদতড়াগাদিযুক্ত নানাবিধ বৃক্ষে আবৃত গোরথ পর্ব্বতে আরোহণ করিয়া মগধপুর দেখিতে পাইলেন।