০৩. ময়ের স্বগৃহে গমন–ভীমের গদ্যসংগ্রহপ্রস্তাব

৩য় অধ্যায়

ময়ের স্বগৃহে গমন–ভীমের গদ্যসংগ্রহপ্রস্তাব

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর ময়দানব অর্জ্জুনকে কহিল, “হে মহাভাগ! আপনাকে আমন্ত্রণ করিয়া এক্ষণে বিদায় হইতেছি, পুনর্ব্বার প্রত্যাগমন করিব। পূর্ব্বকালে কৈলাসের উত্তরভাগে মৈনাক-সন্নিধানে দানবগণ যজ্ঞানুষ্ঠানের বাসনা করেন। ঐ দানব যজ্ঞে আমি বিন্দুসরোবর-সন্নিধানে মণিময় রমণীয় দ্রব্যসম্ভার আহরণ করিয়াছিলাম। যে সমস্ত দ্রব্যজাত দানবরাজ বৃষপর্ব্বর সভামণ্ডপে অবস্থাপিত ছিল, যদি এক্ষণে তাহা বিনষ্ট হইয়া না থাকে, তবে গ্রহণ করিয়া অবিলম্বে আগমন করিব। পরে আপনার মনঃ-প্ৰহাদিনী, যশস্বিনী, অতি বিচিত্রা, সর্ব্বরত্নভূষিতা সভাস্থলী নির্ম্মাণ করিয়া দিব। আর বিন্দুসরোবরে এক গদা নিহিত রহিয়াছে, বোধ করি, দানবরাজ বৃষপর্ব্বা সংগ্রামে শত্ৰু সংহার করিয়া সুবর্ণমণ্ডিত, শত্রুনাশিনী, ভারসহা, সুদৃঢ়া ঐ গদা বিন্দুসরোবরে রাখিয়া দেন। যাদৃশ গান্তীব আপনার উপযুক্ত হইয়াছে, সেইরূপ শতসহস্ৰ-গদা-প্রভাব-শালিনী উক্ত গদাও ভীমসেনের অনুরূপ হইবে। আর বরুণপরিগৃহীত দেবদত্ত সুস্বন [গুরুগভীর রবকারী] মহাশঙ্খ [শঙ্খ শব্দের পূর্ব্বে মহা শব্দ প্রয়োগ অকবিজুষ্ট ও শাস্ত্ৰদুষ্ট। শঙ্খ শব্দের সহিত মহা শব্দ যোগ হইলে অর্থ হয়—মড়ার খুলি। এ নিয়ম বিশেষ্য স্থলে, বিশেষণ স্থলে নহে] ও তথায় নিহিত রহিয়াছে। আমি এই সমস্ত বস্তু আনিয়া নিঃসন্দেহে আপনাকে প্ৰদান করিব।

ময়ের সভা নির্ম্মাণোপযোগী দ্রব্যসংগ্ৰহ

অনন্তর ময়দানব এই বলিয়া অর্জ্জুনের নিকট বিদায়গ্ৰহণপূর্ব্বক পূর্বোত্তর-দিগ্বিভাগে প্রস্থান করিল এবং কৈলাসের উত্তরাংশে মৈনাক-সন্নিধানে মণিমণ্ডিত হিরন্ময়-শৃঙ্গশালী সুমহান এক পর্ব্বত দেখিতে পাইল। সেই স্থানেই রমণীয় বিন্দুসরোবর নিখাত রহিয়াছে। রাজা ভগীরথ ভগবতী ভাগীরথীর দর্শনমানসে বহুকাল তথায় বাস করিয়াছিলেন। ভূতভাবন ভগবান প্রজাপতি সেই স্থানেই অত্যুৎকৃষ্ট যজ্ঞশত অনুষ্ঠান করেন। মণিময় যূপ ও হিরন্ময় চৈত্যসকল দৃষ্টান্তরূপে তথায় রক্ষিত হয় নাই, কেবল তৎপ্রদেশের শোভা-সম্পাদনার্থই নির্মিত হইয়াছে। ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্ৰ যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া সেই স্থানে সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন ভূতভাবন ভগবান ভবানীপতি তথায় প্রজা সমস্ত সৃষ্টি করিয়া শত সহস্ৰ ভূতগণ কর্তৃক উপাসিত হইয়াছিলেন। নর, নারায়ণ, ব্ৰহ্মা, যম ও স্থাণু যুগসহস্ৰ অতিক্রান্ত হইলে তথায় যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া থাকেন। বাসুদেব ধর্ম্মসঞ্চয় করিবার নিমিত্ত শ্রদ্ধাবান হইয়া অবিচ্ছেদে বহু বৎসর তথায় যজ্ঞকাৰ্য্য সমাধান করেন। কেশবের সুবৰ্ণমালালকৃত যূপ ও শতসহস্ৰসংখ্যক ভাস্বর চৈত্যে তথাকার রমণীয় শোভা সম্পাদিত হইয়াছে। ময়দানব সেই স্থানে উপস্থিত হইয়া দানবরাজ বৃষপর্ব্বার অধিকৃত স্ফটিকময় সভা নির্ম্মাণোপযোগী সমুদয় দ্রব্যসামগ্ৰী, মহতী গদা, দেবদত্ত শঙ্খ ও কিন্নর এবং রাক্ষসরক্ষিত ধন সমস্ত গ্ৰহণ করিল।

ময় কর্তৃক পাণ্ডবসভা নির্ম্মাণ

অনন্তর মহাসুর ময় সমস্ত বস্তু সমভিব্যাহারে প্রত্যাগত হইয়া আলোকসামান্য, ত্ৰিলোকবিখ্যাত, মণিময়ী সভাস্থলী নির্ম্মাণ করিল; ভীমসেনকে গদা ও অর্জ্জুনকে দেবদত্ত মহাশঙ্খ সমৰ্পণ করিল। ঐ শঙ্খ ধ্বনিত হইলে লোকসকল কম্পিত হইত। সুবৰ্ণনির্মিত তরুরাজি-বিরাজিত সভামণ্ডপ চতুর্দিকে পঞ্চসহস্ৰ হস্ত বিস্তীর্ণ হইয়াছিল। পাণ্ডবসভা হুতাশন, সূৰ্য্য ও চন্দ্রের সভার ন্যায় সমধিক শোভা পাইতে লাগিল। তদীয় প্রভাপ্রভাবে [প্রভার ঔজ্জ্বল্যে] প্রভাকরের অতি ভাস্বরই [উজ্জ্বল—প্ৰদীপ্ত] প্রভাও নিতান্ত প্ৰতিহত হইল, তৎকালে আলোকসামান্য সেই সভা স্বীয় তেজঃপুঞ্জ দ্বারা যেন জ্বলিত হইয়া উঠিল। নবীননীরদসঙ্কাশ, অতি বিশাল, বিপুল, রমণীয়, পাপনাশক, শ্রমাপহারক, রত্নপ্রাকারমণ্ডিত, বহুচিত্রোপশোভিত, অত্যুত্তম দ্রব্যসম্ভারশালী, বহুলধনসম্পন্ন, গগনাব্যাপী, বিশ্বকর্ম্মানির্মিত যাদবসভা, দেবীসভা ও ব্রহ্মসভাও পাণ্ডবগণের সভার নিকট পরাজিত হইয়াছিল। ময়দানবের আদেশানুসারে গগনচর, মহাঘোর, মহাকায়, মহাবল, রক্তনেত্র, শুক্তিকর্ণ [ঝিনুকতুল্য কর্ণ–বড় ঝিনুকের মত কনওয়ালা], আয়ুধধারী, অষ্ট সহস্ৰ কিঙ্কর ও রাক্ষস ঐ রমণীয় সভার রক্ষণাবেক্ষণ করিত এবং আবশ্যকমতে বহন করিয়া উহাকে স্থানান্তরেও লইয়া যাইত। ময়দানব ঐ সভাস্থলে এক অপূর্ব্ব সরোবর প্রস্তুত করিয়াছিল, ঐ সরোবরের সোপান-পরস্পরা স্ফটিকময়, পরিসরবেদিকা [ঘাটলার সিঁড়ির মধ্যস্থিত চাতাল] সকল মণিনির্মিত, জল অতিস্বচ্ছ, পঙ্কশূন্য ও সুবর্ণ-নির্মিত মৎস্য-কূর্ম্ম-সাৰ্থ [দল—বাক]-সঙ্কুল। মণিময়-মৃণালে পরিশোভিত ও বৈদূর্য্যপত্রে সমলঙ্কৃত বিকশিত কনক-কমলকতুরজালে উহার অত্যদ্ভুত মনোহারিণী শোভা সম্পাদন করিয়াছিল। হংস, কারণ্ডব, সারস, চক্ৰবাক প্রভৃতি জলবিহঙ্গম তীরে ও নীরে বিহার করিয়া জনগণের নয়নের সার্থকতা সম্পাদন করিল। মুক্তাফল ও নানাবিধ রত্নে উহার চতুর্দিক সমাচ্ছন্ন হইয়াছিল। রাজাদিগের মধ্যে কেহ কেহ সরোবরসন্নিধানে উপস্থিত হইয়াও সহসা উহাকে সরোবর বলিয়া বুঝিতে পারেন নাই। প্রত্যুত, তাহারা অজ্ঞানবশতঃ সরোবরের উপরিভাগ দিয়া গমন করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন। সেই সভার উভয় পার্শ্বে ফল-পুষ্প কিশলয়োপ [নব পল্লব]-শোভিত নীলবৰ্ণ, সুশীতল-ছায়াসম্পন্ন মনোরম বহুবিধ উন্নত পাদপাবলী সন্নিবেশিত ছিল। অতি সুরভি কানন ও হংস-কারগুব-চক্রবাকোপশোভিত পুষ্করিণী সকল সভার চারিদিকে শোভা বিস্তার করিল। সমীরণ তত্ৰত্য জলজ ও স্থলজ পদ্মের গন্ধ গ্রহণপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের সেবা করিতে লাগিল। ময়দানব চতুর্দশ মাসে রমণীয় সভা-ভূমি নির্ম্মাণ করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সমাপ্তি-সংবাদ প্ৰদান করিল।