১৫.
তিশা একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে পড়ে আছে। তার হাত-পা-মুখ শক্ত করে বাঁধা। চাইলেই ইচ্ছেমতো নড়তে পরছে না। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। অনেকক্ষণ একইভাবে থাকাটা যে কী কষ্টের তা সে এরকম পরিস্থিতিতে না পড়লে কখনো জানতে পারত না। তাদের বাসার সবাই যে খুব বিপদে আছে এটাও সে বুঝতে পারছে। তিশা কালোমানুষের দলের সবার নাম জানতে পেরেছে কথোপকথনের মাধ্যমে। তার সামনেই সবাই একে অন্যের নাম ধরে অনেকক্ষণ কথা বলেছে। ইদ্রিস আলী, যে কিনা কালোমানুষ দলের নেতা, তার নামটা জানতে অবশ্য তাকে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। অন্য দুজন তাকে বস বলে ডাকায় তার নাম জানার কোনো উপায় ছিল না। ইদ্রিস আলী অবশ্য অন্য একজনের সাথে কথা বলার সময় নিজের নাম বলে। সেখান থেকেই তিশা জানতে পারে কালো মানুষের নেতা এই ইদ্রিস আলী।
তিশাকে যখন নিয়ে আসা হয় গাড়ির মধ্যে তখন তাকে একটুও নড়তে দেয়া হয়নি। প্রায় এক ঘণ্টা গাড়িতে থাকার পর গাড়ি একটা সরু রাস্তায় প্রবেশ করে। তখন কিছুটা হলেও তাকে নড়তে-চড়তে দেয়া হয়। এ সময়ে কয়েকবার সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছে। তার মনে হচ্ছিল তাকে কোনো ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছিল। অবশেষে যেখানে গাড়ি এসে থামে সেখানে আবারো মাথা উঁচু করে বাইরের দিকে তাকায় সে। আর তখনই লেখা দেখে সাইনবোর্ডটি। সেখানে লেখা ছিল : ‘ওয়েভ গার্মেন্টস, গাজীপুর’। তিশা অনুমান করতে পারে তাকে গাজীপুরের ওয়েভ গার্মেন্টেসে নিয়ে আসা হয়েছে।
সেই থেকে সুযোগ খুঁজছে তিশা, কীভাবে নিজের অবস্থান কাউকে জানানো যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে-ধরনের কোনো সুযোগ আসেনি। মোবাইলটা প্রথমেই তার কাছ থেকে নিয়ে নেয় ইদ্রিস আলী। তারপর আর দেয়নি। এখানে আশেপাশে অন্য কোনো মানুষও নেই। তিশা অনুমান করতে পারে এটা একটা পরিত্যক্ত গার্মেন্টস্। পুরাতন ভবন ছাড়া আর কিছু নেই। এখানে কারো সাহায্য আশা করা বৃথা। তাই যা করার তা তার নিজেকেই করতে হবে।
সময় অনুমান করতে চেষ্টা করল তিশা। সে অপহৃত হয়েছে ছয়-সাত ঘণ্টা তো হবেই। এই লম্বা সময়ে তার কিছুই খাওয়া হয়নি। ক্ষুধায় চিনচিন করছে পেট। পানি পিপাসাও পেয়েছে। অথচ এতক্ষণে তাকে একফোঁটা পানি পর্যন্ত খেতে দেয়নি কালোমানুষদের কেউ। কয়েকবার ঘুম এলেও তৃষ্ণায় ঘুম ভেঙে গেছে তার। এ মুহূর্তে সত্যি কষ্ট হচ্ছে! পিপাসায় ফেটে যেতে যাচ্ছে বুকটা।
দরজা খোলার শব্দে সামনের দিকে তাকাল তিশা। হ্যাঁ, যা ভেবেছিল তাই। ইদ্রিস আলী ভিতরে ঢুকছে। ইদ্রিস আলী ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর এগিয়ে আসতে থাকল তিশার দিকে। তিশা ভেবেছিল এবার বোধহয় এরা কেউ তার জন্য কিছু খাবার এবং পানি নিয়ে আসবে। কিন্তু ইদ্রিস আলীর হাত খালি দেখে সত্যি খুব হতাশ হল সে।
ইদ্রিস আলী সরাসরি তিশার সামনে এসে বসল। তারপর তিশার মুখের উপর হাতের টর্চলাইটটি ধরে বলল : কিরে বাইচা আছস, নাকি মরছস?
ওম্ ওহ্…। কথা বলতে চেষ্টা করল তিশা।
ইদ্রিস আলী রুক্ষকণ্ঠে বলল : তোরে বাঁচাইয়া রাইখা আমার কোনো লাভ নাই। তারপরও তোরে বাঁচাইয়া রাখছি। ছোট মানুষ। তোর তো আর কোনো দোষ নাই। তোর বাপটাই যত ঝামেলা করল। ভালোয় ভাসোয় টাকা দিয়া দিলেই পারত। কিন্তু তা করল না। পুলিশরে জানাইল। আমাগো বিপদে ফেলাবার যাইয়া হে-ই বিপদে পড়ল, তোরেও বিপদে ফেলাইল।
ইদ্রিস আলী কথা শুনে তিশা অসহায় দৃষ্টিতে ইদ্রিস আলীর দিকে তাকাল।
ইদ্রিস আলী মুখ দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ করে বলল : কী আর করবি বল। কপালে কষ্ট থাকলে তা কি আর এড়ানোর উপায় আছে। কাইল সকাল পর্যন্ত আমরা তোরে বাঁচায় রাখব। এর মইধ্যে যদি তোর বাপ টাকা দিয়া দেয়, তাইলে বাঁচবার পারবি। নইলে ঘঁাচ কইরা কল্লাড়া নামাইয়া ফেলাব।
তিশা কিছুই বলল না। ঢোঁক গিলতে চেষ্টা করেও পারল না। গলাটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। ভয়ও পেয়েছে খুব।
ইদ্রিস আলী এবার তিশার আরো কাছে এগিয়ে এলো। তারপর হঠাৎই তিশার মুখের টেপটা একটানে খুলে ফেলল। তীব্র ব্যথায় তিশার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে
লো। তার মনে হল কেউ বুঝি ছুরি দিয়ে তার মুখের চামড়াটা তুলে নিল। দীর্ঘক্ষণ টেপটা মুখের সাথে লেগে থাকায় তা শক্তভাবে চামড়ার সাথে আটকে গিয়েছিল। সেটা ভোলার সময় সত্যি খুব ব্যথা পেল তিশা। তবে এখন ভালো লাগছে। কারণ দীর্ঘক্ষণ একভাবে থাকতে থাকতে তার দাঁত আর মাড়ি প্রায় লেগে এসেছিল।
এরইমধ্যে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেছে হারুন। সে কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল : বস, ওরে খাবার না দিলেই পারতাম। খালি পয়সা খরচ।
কথাটা শুনেই তিশা চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাল। দেখল হারুনের হাতে পানির বোতল আর একটা প্যাকেট। সে বুঝতে পারল প্যাকেটে কোনো-না-কোনো খাবার আছে। পানি আর খাবারের উপস্থিতি উপলব্ধি করে তার পিপাসা আর ক্ষুধা দুটোই যেন বেড়ে গেল।
হারুনের কথায় ইদ্রিস আলী বলল : একেবারে অমানুষ হইয়া গেলে কেমনে হয়।
কিন্তু ঝামেলা বাড়ায় লাভ কী? তুমি হুকুম দিলে এহনই এইডারে পরজগতে পাঠায় দেই।
অহেতুক খুন-খারাবির মইধ্যে না-জড়ানোই ভালো। আমাগো দরকার টাকা। টাকা পাইলেই হয়। কেরামত কোন্হানে?
বাইরা আছে।
কোনো কি দরকার আছে? আমরা যে এইহানে আছি কেউ জানবারও পারব না।
আছে থাউক সতর্ক থাকলে দোষ নাই। একটু থেমে হারুন তিশাকে দেখিয়ে বলল : ওরে কি খাবার দিব না দিব, না?
আনছস যহন দে। হাতটা খুইলা দে। খাওয়া শেষ হইলে আবার বাইন্দা রাহিল।
হারুন তিশার হাত খুলে দিয়ে বলল : কোনোরকম তেড়িবেড়ি করবি তত শরীর থাইক্যা কল্লা নামায় ফেলাব। যা দিলাম, খাইয়া চুপচাপ বইসা থাকবি।
তিশা কিছু বলল না। পানির বোতলটা হাতে পাওয়া মাত্র একবারেই অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে ফেলল। তারপর খেতে শুরু করল কেক আর কলা। সে বুঝতে পারছে বেঁচে থাকতে হলে খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তার ক্ষুধাটা এতটাই প্রকট যে এ-মুহূর্তে যে সে চরম সংকটের মধ্যে আছে সেটা সে ভুলে গেল।
খাবার দেখে খানিকটা বিরক্তই হল ইদ্রিস আলী। সে হালকা ধমকের সাথে বলল: খুঁইজা খুঁইজা খালি কেক আর কলা নিয়া আইলি? আর কিছু পাইলি না?
বস, এইহানে কিছু পাওয়া যায় না। তুমি ভালোমতোই জানো। এই কলা আর কেক জোগাড় করতে আমার দুই কিলো যাওয়া লাগছে।
কেকটাও তো ভালো না।
ইচ্ছা হইলে খাও, না হইলে না-খাও। আগেই তো কইছিলাম টঙ্গী থাইক্যা খাবার নিয়া যাই। তুমি রাজি হও নাই।
তোর মাথায় আসলেই কিছু নাই। এই বিচ্ছুডারে সাথে নিয়া টঙ্গীতে খাবার কিনি? আর দুপুরে খাবার কিনলে কি এহন খাবার পারতি?
তাইলে আর এত কথা কও কেন? খাইয়া নাও। আমি যাই কেরামতরে খাবার দিয়া আসি।
একথা বলে হারুন বাইরে বের হয়ে গেল।
তিশা এবার নিশ্চিত হল সে গাজীপুর আছে। কারণ সে জানে টঙ্গী গাজীপুরের মধ্যে। পাশাপাশি এটাও বুঝতে পারল তাকে এত সহজে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না। কারণ সবাই তাকে ঢাকায়ই খুঁজবে। এতদূর কেউ খুঁজতে আসবে না যদি-না সে কাউকে তার অবস্থান জানাতে পারে। কিন্তু তার যে-অবস্থা তাতে তার পক্ষে কাউকে তার অবস্থান জানানো অসম্ভব ব্যাপার।
তিশা লক্ষ্য করল ইদ্রিস আলীর দুটো মোবাইল। সম্ভবত সে এই মোবাইলগুলো দিয়েই ফোন করে। এ মুহূর্তে ইদ্রিস আলী খাবার না-খেয়ে মোবাইল দুটোর বাটনে টিপাটিপি করছে। কিছুটা অন্যমনস্ক সে। মনে হচ্ছে খাবার দেখে খুব বিরক্তও হয়েছে। তাই মেজাজটা খিঁচড়ে আছে।
হঠাৎই ফোন এল ইদ্রিস আলীর। স্ক্রিনে নম্বর দেখে লাফ দিয়ে উঠল সে। সাথে সাথে কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। এ মুহূর্তে পিছন ফিরে কথা বলছে সে। তার অন্য মোবাইলটা তিশার ঠিক সামনে চেয়ারের উপর পড়ে আছে।
সুযোগটা যে এভাবে চলে আসবে তিশা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। সে বুঝতে পারছে ঝুঁকি না নিলে কিছুতেই সে বাঁচতে পারবে না। তাই দ্রুত মোবাইলটা তুলে নিল। পরমুহূর্তে মনে পড়ল তার বাসার সবাই মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করেছে। নতুন নম্বর তার মুখস্থ নেই। কিছুটা হলেও দ্বিধায় পড়ল সে। তারপরই মনে পড়ল রিবিটের কথা। রিবিটের মোবাইল নম্বরটা তার আগে থেকেই মুখস্থ ছিল। তাই আর দেরি করল না, মাত্র কয়েকটা শব্দ লিখে ম্যাসেজ পাঠাল রিবিটের নম্বরে। তারপর মোবাইলটা রেখে দিল আগের জায়গায়।
তিশা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ইদ্রিস আলী তখনো কথা বলে চলছে। কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তমনে এবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করল তিশা। সে নিশ্চিত যেভাবেই হোক তাকে উদ্ধার করবে রিবিট।
.
১৬.
রিবিট আর শাহেদ তিশাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শাহেদ মোবাইলে কারো সাথে কথা বলছে। আর রিবিট তার মূল প্রোগ্রামে একটার-পর-একটা যুক্তি বিশ্লেষণ করে চলছে। কিন্তু কিছুতেই কোনো সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। তাই তার অভ্যন্তরে ইলেকট্রনপ্রবাহ কিছুটা হলেও অসম হয়ে উঠেছে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ইপি অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে শব্দহীনভাবে রিবিটকে জানাল : রিবিট, তোমার অভ্যন্তরে ইলেকট্রনপ্রবাহ ভারসাম্য হারাচ্ছে। এটা প্রমাণ করে যে মানুষের মতোই তুমি অস্থির হয়ে উঠছ।
আমি অস্থির না হয়ে পারছি না। কিছুতেই আমি তিশাকে উদ্ধারের কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছি না।
এটা তোমার একার দায়িত্ব নয়। মূল দায়িত্বটা পুলিশের। তুমি পুলিশকে সাহায্য করতে পারো মাত্র।
কিন্তু আমি তো আমার দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণসাধনের জন্য, তিশাকে উদ্ধারের জন্য।
তুমি তো তোমার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছ। সাহায্য করে যাচ্ছ সবাইকে।
কিন্তু আমি নিজে তো সন্তুষ্ট হতে পারছি না।
তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে এবং শান্তভাবে কাজ করতে হবে। তোমার মধ্যে ইলেকট্রনপ্রবাহের ভারসাম্য যতটা বিনষ্ট হবে তোমার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা ততটা হ্রাস পাবে। কাজেই তুমি ধীরস্থিরভাবে যুক্তিগুলোকে বিশ্লেষণ করো। আমি আশা করছি তুমি সমাধান পেয়ে যাবে। অন্তত কোনো-না-কোনো সূত্র পাবে।
রিটি বুঝতে পারল ইপি তাকে সঠিক পরামর্শই দিয়েছে। ইপির অন্যতম একটা কাজ হল তাকে দিকনির্দেশনা প্রদান করা, তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করা। ইপি এ-মুহূর্তে সেই কাজটিই করেছে। অবশ্য তার স্বাধীনতা কিংবা ক্ষমতা রয়েছে ইপির পরামর্শ গ্রহণ করার বা না-করার। তবে এ-মুহূর্তে সে ইপির পরামর্শ গ্রহণ করার সিদ্ধান্তই নিল। তাই ইলেকট্রনপ্রবাহকে সুষম করতে সে তিশাকে নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করবে না বলে ঠিক করল। কিন্তু তার চিন্তায় বাধ সাধল শাহেদ। ফোনে কথা বলা শেষ হলে শাহেদ বলল :
রিবিট, আমরা বোধহয় আরো দূরে সরে গেলাম।
তুমি কী বলতে চাচ্ছ শাহেদ?
ভেবেছিলাম গাড়ির নম্বর থেকে কোনো সূত্র পাব। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে অপহরণকারীরা গাড়িতে যে-নম্বর ব্যবহার করেছিল সেই নম্বরের কোনো গাড়িই নেই। এইমাত্র বিআরটিএ থেকে এ-বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছে।
কী বলছ তুমি! অবাক হয়ে বলল রিবিট।
হ্যাঁ রিবিট। অপহরণকারীরা পরিকল্পিতভাবে গাড়ির নম্বর পাল্টে নিয়েছিল অথবা তিশার দাদু ভুল নম্বর দেখেছিল।
তাহলে তো সম্ভাবনা আরো কমে এল।
হ্যাঁ। তাছাড়া শহরে যে-সকল স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে সেখান থেকেও আশাপ্রদ কোনো সংবাদ পাওয়া যায়নি।
এতে আমরা ধারণা করতে পারি তিশা শহরের মধ্যেই আছে।
যদি-না চেকপোস্টের কার্যক্রম শুরুর আগেই তিশাকে শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়ে থাকে।
রিবিট খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল : এখন আমাদের করণীয় কী?
সেটা নিয়ে আমিও ভাবছি। আমাদের লোকজন অবশ্য তিশার বাবার সাথে কয়েকবার কথাও বলেছে। তার কোনো শক্র কিংবা ক্ষতি করতে পারে এমন কেউ আছে কিনা জানতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সেরকম কারো তথ্য পাওয়া যায়নি।
আর মোবাইল ফোনের সন্ধান?
আমরা মোবাইল কোম্পানিকে বলেছি। যে মোবাইল থেকে সুমন সাহেবকে ফোন করে বিশ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে সেটা একটি আনোন নম্বর। ফলে কোন্ কোম্পানির মোবাইল নম্বর থেকে কলটি এসেছে তা বের করা কঠিন। তারপরও আমার সবগুলো মোবাইল কোম্পানির কাছে সাহায্য চেয়েছি। ঐ সময়ে সুমন সাহেবের কাছে যে কল এসেছে, কললিস্ট থেকে সেই কলারের মোবাইল নম্বরটি বের করা সম্ভব কিনা সেটাই চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কাজটি খুব কঠিন। আর যদি মোবাইল নম্বর পাওয়াও যায়, সংশ্লিষ্ট মালিককে নিশ্চয় এত সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ধীরে ধীরে জটিল আকার ধারণ করছে।
তাহলে আমাদের হাতে আর কোনো উপায় থাকল না। হতাশকণ্ঠে বলল রিবিট।
এখনো একটা সূত্র আছে। আর তা হল আগামীকালকের ঘটনার জন্য অপেক্ষা করা। অর্থাৎ জোড়া তালগাছের নিচে সুমন সাহেবের টাকা রেখে আসার ব্যাপারটা।
কিন্তু কালোমানুষ যখন জানবে চারপাশে পুলিশ আছে, নিশ্চয় ওরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে।
হয়তো উঠবে। কিন্তু এ ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। অবশ্য আমরা খুব সতর্কতার সাথে অপারেশন পরিচালনা করব। ইতিমধ্যে আমরা একটা টিম পাঠিয়েছি জোড়া তালগাছ এলাকাটা দেখে আসার জন্য। আশা করছি তারা কোনো ইতিবাচক তথ্য আমাদের দিতে পারবে।
অর্থাৎ আমাদের ‘যদির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
আমাদের অর্থাৎ পুলিশের কাজটা যদির উপরই নির্ভর করে বেশি। এভাবেই আমাদের কাজ করতে হয়। কখনো আমরা সফল হই, আবার কখনো হই না।
রিবিট কিছু বলল না। তার মধ্যেকার ইলেকট্রনপ্রবাহ আবার অসম হতে শুরু করেছে। অর্থাৎ মানুষের মতো অস্থিরতা বাড়ছে। সে বুঝতে পারছে সে যতই চেষ্টা করুক না কেন, এই অসম ইলেকট্রনপ্রবাহকে সে সুষম করতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে তিশাকে উদ্ধার করতে পারবে। আর তার মধ্যে এই অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ তার অনুভূতি। ইপির অনুভূতি নেই বলেই ইপির কোনো অস্থিরতা নেই। ইপিকে মাঝে মাঝে তার সত্যি হিংসা হয়, কারণ অনুভূতি না-থাকার কারণে ইপির দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা অনুভব করার ক্ষমতা নেই।
রিবিট যখন এসব নিয়ে ভাবছে তখন হঠাই ইপি বলল : রিবিট, তোমার একটা ম্যাসেজ এসেছে।
কে পাঠিয়েছে?
অপরিচিত নম্বর থেকে।
কী লিখেছে?
লেখাটা অদ্ভুত।
তুমি পড়ো। আমার পড়তে ইচ্ছে করছে না।
ইপি পড়তে শুরু করল :
Wave Garments, Gazipur
Kalo Manus- Idris Ali, Harun and Keramot.
Ribit help me.
Tisa.
এ মুহূর্তে রিবিটের ইলেকট্রনপ্রবাহ পূর্বের তুলনায় আরো বেড়েছে। সে বুঝতে পারছে তার অভ্যন্তরের মূল প্রোগ্রাম তিশাকে উদ্ধারের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুঁজে পেয়েছে।
.
১৭.
গাজীপুরে একটি ওয়েভ গার্মেন্টস্-এর খোঁজ পাওয়া গেল। তবে গার্মেন্টসটির পুরো নাম ‘নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস’ যেটা কিনা গাজীপুরে প্রবেশের মেইন রাস্তার পাশে। রাত এগারোটার সময় সাদা পোশাকে পুলিশ সম্পূর্ণ গার্মেন্টটিকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু গার্মেন্টস্ দেখে রিবিটের নিজেরই সন্দেহ হল। গার্মেন্টটি সম্পূর্ণ সচল অবস্থায় আছে। রাত এগারোটার সময়ও কাজ করছে সকল কর্মীরা। কর্মীর সংখ্যা এক হাজারের কম হবে না। বোঝা যাচ্ছে খুব ব্যস্ত গার্মেন্টস। এখানে কাউকে অপহরণ করে রাখা হবে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
সাদা পোশাকের পুলিশ সম্পূর্ণ গার্মেন্টসৃটিকে ঘিরে ফেললেও ভিতরের কেউ টের পেল না। গার্মেন্টসের মালিকের সাথে প্রথম কথা বলল শাহেদ এবং ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। মালিক তো কথা শুনে অবাক। সে নিজেই সাহায্য করতে এগিয়ে এল। ইদ্রিস, হারুন আর কেরামত নামের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে হাজির করা হল।
এদের কাউকেই সন্দেহজনক বলে মনে হল না পুলিশের কাছে। অবশ্য হারুন নামের একজনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। সে আজ অফিসে আসেনি। সকালে অসুস্থতার কথা জানিয়েছে। পুলিশ আর অপেক্ষা করল না। উঠেপড়ে লাগল হারুনকে খুঁজে বের করতে।
রিবিট অবশ্য গার্মেন্টসের মধ্যে প্রবেশ করেনি। সে বাইরে দাঁড়িয়েছিল। কেন যেন তার বিশ্লেষণ বলছিল এখানে তিশাকে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই ইপির সাথে এ-বিষয়ে আলোচনা করছিল সে। ইপিও তার বিশ্লেষণী মন্তব্য করছিল।
রিবিট বলল : ইপি, তুমি কি মনে করো তিশা আমাদেরকে ভুল ঠিকানা দিয়েছে?
কোনোভাবেই সেটা হতে পারে না।
তাহলে কি তিশার নাম দিয়ে অন্য কেউ এই ম্যাসেজ পাঠাল যেন আমরা ভুলপথে পরিচালিত হই?
সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না।
ঐ নম্বরটায় ফোন করতে পারলে ভালো হত। কিন্তু অপরিচিত নম্বর হওয়ায় যোগাযোগের কোনো উপায় নেই। তবে আমি নিশ্চিত তিশা এখানে নেই। এত মানুষের মধ্যে কাউকে কিডন্যাপ করে লুকিয়ে রাখা কঠিন।
তাহলে তিশা কোথায়?
তিশা যে-ঠিকানা লিখেছে সেখানেই। ওয়েভ গার্মেন্টস্, গাজীপুর।
আমরা তো ওয়েভ গার্মেন্টস গাজীপুরেই আছি।
না আমরা নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস-এ আছি। আমার বিশ্লেষণ বলছে কোথাও ভুল হয়েছে। এমনো হতে পারে গাজীপুরে একাধিক ওয়ে গার্মেন্টস্ আছে।
কিন্তু সে-ধরনের কোনো তথ্য তো পাওয়া যায়নি।
রিবিট কিছু বলল না।
এরই মধ্যে শাহেদ নিচে নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে সেও দ্বিধান্বিত। এতক্ষণ তার মধ্যে যে উৎসাহ ছিল এখন আর নেই। কাছে এসে বলল : রিবিট, আমাদের মনে হচ্ছে নতুন করে ভাবতে হবে।
কী রকম?
আগামীকাল সকাল এগারোটার পরিকল্পনা নিয়ে। জোড়া তালগাছের নিচে টাকাগুলো রেখে আসার সময়ই আমাদের আসল ফাঁদ পাততে হবে।
কিন্তু ওরা তো বুঝে যাবে।
এ ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। ইতিমধ্যে আমরা আমাদের নিরীক্ষণ শুরু করেছি। ব্যাপারটা খুব ঝুঁকিপূর্ণ এবং সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।
যদি কালোমানুষ সত্যি নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয় তাহলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর এসবক্ষেত্রে ঝুঁকি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই। একটু থেমে শাহেদ আবার বলল : তোমার কথার সূত্র ধরে বলছি, আমরা আমাদের ক্রিমিনাল ডেটাবেজ পরীক্ষা করে দেখেছি। ইদ্রিস আলী নামে কুখ্যাত কোনো সন্ত্রাসী নেই। তবে কেরামত নামে একজন আছে যে কিনা ভাড়াটে খুনী। তিশা যদি সত্যি কেরামত কর্তৃক অপহৃত হয়ে থাকে তাহলে বিপদের আশঙ্কাই বেশি।
আর হারুন?
হারুন নামে কয়েকজনই আছে। তবে সেরকম কুখ্যাত কেউ নেই। অবশ্য সন্ত্রাসীরা কে কখন কুখ্যাত হয়ে ওঠে তা বলা মুশকিল। এই দ্যাখো ওদের ছবি।
একথা বলে শাহেদ রিবিটকে কেরামত আর হারুনের ছবি দেখাল। তারপর পিছনের দিকে চলে গেল। রিবিট স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তার মধ্যে বিশ্লেষণের ঝড় বইছে। কিছুতেই মিলাতে পারছে না যুক্তিগুলো। তিশার ম্যাসেজটা যে মিথ্যা, কিছুতেই মানতে পারছে না সে।
রিবিটের সামনে দিয়ে গার্মেন্টেসের বড় বড় কার্টুনগুলো ট্রাকে ওঠানো হচ্ছে। তার একবার মনে হল এই কার্টুনগুলো পরীক্ষা করা হয়নি। পরবর্তীতে সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিল সে। আর যাইহোক, তিশাকে কার্টুনে ভরে গাড়িতে তোলার কোনো গ্রহণযোগ্য কারণ থাকতে পারে না।
কার্টুনগুলো দেখতে যেয়ে একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেল না সে। সে বুঝতে পারল না কেন ওয়েভ গার্মেন্টসের নাম নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস্ হল। অবশ্য আজকাল নামের আগে নিউ জুড়ে দেয়াটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই হল কিনা কিছুক্ষণ ভাবল রিবিট। কিন্তু সন্তোষজনক কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। এই গার্মেন্টসটা অনেক পুরোনো, প্রায় পনেরো বছর পূর্বের। কাজেই ‘নিউ লাগানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই বিশ্লেষণ থেকে রিবিট নতুন করে আবার সকল যুক্তি মেলাতে শুরু করল।
রিবিট এবার নিজেই মালিকের অনুসন্ধানে বের হল। মালিককে অবশ্য সে পেল না। মালিক পুলিশকে সাহায্য করতে ব্যস্ত। তবে রিবিট বয়স্ক একজন কর্মচারীর সাক্ষাৎ পেল। তাকে পেয়ে রিবিট জিজ্ঞেস করল : আপনি এখানে কতদিন কর্মরত আছেন?
পনেরো বছর। এই গার্মেন্টসের শুরু থেকেই।
আপনিই হয়তো তাহলে আমাকে সাহায্য করতে পারবেন। একটু থেমে রিবিট আবার বলল, এই গার্মেন্টসের নাম নিউ ওয়েভ গার্মেন্টস’ হল কেন?
আমি তো বলতে পারব না। মালিক বলতে পারবে।
ইয়ে..মানে আমি বলতে চাচ্ছিলাম নামের আগে ‘নিউ’ অর্থাৎ নতুন শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কেন?
ও তাই বলুন। এই ফ্যাক্টরিটি যখন তৈরি করা হয় তখন এখানে ‘ওয়েভ গার্মেন্টস্ নামে আর একটি ফ্যাক্টরি ছিল।
আর একটি ফ্যাক্টরি ছিল! উৎসাহ নিয়ে বলল রিবিট।
হ্যাঁ। সেটা অবশ্য এখান থেকে অনেক দূরে। বনের মধ্যে। তবে বছর-তিনেক হল ঐ গার্মেন্টসৃটি বন্ধ হয়ে গেছে। দুটো গার্মেন্টস্-এর নাম যেন এক না হয় সেজন্য আমাদের এই গার্মেন্টসের আগে ‘নিউ’ যোগ করা হয়েছে।
রিবিট সাথে সাথে বলল : অন্য গার্মেন্টস্ ফ্যাক্টরিতে কি এখন কেউ থাকে না?
না। সেটা পরিত্যক্ত। এখানে আসার আগে আমি সেখানে কাজ করতাম। তাও পনেরো বছর আগের ঘটনা।
রিবিট নিজের মধ্যে দারুণ উত্তেজনা অনুভব করল। সে বয়স্ক ভদ্রলোককে আর কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না। শুধু ওয়েভ গার্মেন্টসের ঠিকানাটা নিয়ে রওনা হয়ে গেল তার উদ্দেশে।
.
১৮.
রিবিট যখন ওয়েভ গার্মেন্টসের সামনে এসে দাঁড়াল তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। বিশাল এলাকা নিয়ে ওয়েভ গার্মেন্টস্। চারদিকটা তারকাটার বেড়া দিয়ে ঘেরা। তবে মূল গেটটা লোহার। গার্মেন্টসের চারপাশে ঘন শালবন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই এখানে এতবড় একটা গার্মেন্টসের ফ্যাক্টরি আছে। মূল রাস্তা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে।
রিবিট যখন বাইরের গেটে এসে দাঁড়াল ইপি তখন রিবিটকে সতর্ক করে দিয়ে বলল : রিবিট তুমি কি কাজটা ঠিক করছ?
কেন?
তোমার অবশ্যই পুলিশকে জানানো উচিত ছিল। তুমি ভয়াবহ ঝুঁকি নিচ্ছ। তিশাকে উদ্ধার করতে যেয়ে যদি সত্যি তিশার কোনো ক্ষতি হয় তুমি তার দায়
এড়াতে পারবে না।
আমি জানি ইপি। কিন্তু এ ছাড়া যে অন্য কোনো উপায় নেই। আমি পুলিশকে জানালে পুলিশ চারদিকটা ঘিরে ফেলবে এটা ঠিক। কিন্তু কালোমানুষ যদি পুলিশের অস্তিত্ব জেনে যায় তাহলে তারা তিশাকে হত্যা করতে পারে।
তোমার অবস্থান জেনে গেলেও কালোমানুষ তিশার ক্ষতি করতে পারে।
আমার যুক্তি বলছে আমি অধিকতর সতর্কতার সাথে কাজ করতে পারব।
আমি তোমাকে সম্পূর্ণ সমর্থন করতে পারছি না। তুমি অহেতুক ঝুঁকি নিচ্ছ।
আমি চেষ্টা করছি ইপি। আমাকে চেষ্টা করতে দাও।
আমি শুধু তোমাকে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করতে পারি রিবিট। কিন্তু আমার পরামর্শ গ্রহণ করা বা না-করা একান্তই তোমার। তবে এ-মুহূর্তে তোমাকে অনুরোধ করছি তুমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এসি শাহেদকে জানাও।
রিবিট কয়েক মুহূর্ত সময় নিল। তারপর বলল : ঠিক আছে ইপি। আমি জানাচ্ছি। তবে আমার বিশ্লেষণ বলছিল এ-মুহূর্তে না-জানালেও পারতাম।
রিবিট কথাটা বলল ঠিকই, কিন্তু একইসাথে ফোনের মাধ্যমে সে তার অবস্থান সম্পর্কে শাহেদকে জানিয়ে দিল। পাশাপাশি এটাও জানাল যে তিশার এখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
ওয়েভ গার্মেন্টসের কোথাও ইলেকট্রিক বাতি জ্বলছে না। তবে আকাশে চাঁদ থাকায় চারদিকটা কিছুটা হলেও আলোকিত। বিবিটের অবশ্য অসুবিধা হচ্ছে না। অন্ধকারে তার দেখার ক্ষমতা আছে। আর এই দৃষ্টিক্ষমতাবলেই সে দেখতে পারছে এখানে বড় বড় তিনটি চারতলা ভবন আছে। আশেপাশে আরো কিছু ছোট ভবনও রয়েছে। তিশাকে যে এই ভবনগুলোর কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে এ-বিষয়ে রিবিটের কোনো সন্দেহ নেই। কারণ জায়গাটা কাউকে লুকিয়ে রাখার জন্য উত্তম।
মূল গেট দিয়ে ভিতরে প্রবেশের সময় ওয়েভ গার্মেন্টসের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল রিবিটের। সাইনবোর্ডটি অনেক পুরাতন। অর্ধেক প্রায় ভেঙে পড়েছে। তবে লেখাটা স্পষ্টভাবে এখনও পড়া যায়। একসময় যে এই গার্মেন্টটা ভালো অবস্থানে ছিল তা নিচের পিচের রাস্তা দেখেই বুঝতে পারল রিবিট। মূল রাস্তা থেকে এত দূ্রে শক্ত পিচের রাস্তা করা যথেষ্ট খরচের ব্যাপার। মালিক পর্যাপ্ত লাভ করতে না পারলে কখনোই এত টাকা ব্যয়ে এতদূরে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি করত না।
রিবিষ্ট যখন ভাবছে কীভাবে তিশাকে খোঁজা শুরু করবে তখনই সূক্ষ্ম একটা বিষয় নজরে এল তার। নিচের রাস্তাটা ধুলো-বালি জমে থাকলেও তাতে গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট; গাড়ির চাকার দাগ দেখে রিবিট বুঝতে পারল গাড়িটা দু-একদিনের মধ্যেই এখান দিয়ে চলাচল করেছে। এতে তার সন্দেহ আরো ঘনীভূত হল। আরো একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত হল, এখানে কেউ-না-কেউ আছে। সম্পূর্ণ ফ্যাক্টরির কোথাও আলো না-জুলার ব্যাপারটা আরে রহস্যজনক মনে হল তার কাছে। মালিক নিশ্চয় এখানে পাহারায় কাউকে-না-কাউকে রাখবে। সে যদি এখানে সত্যি থেকে থাকে তাহলে কেন রাতে আলো জ্বালাবে না!
রিবিট রাস্তা ধরে এগোতে শুরু করল। খুব বেশিদূর এগোতে হল না তাকে। চারতলা একটা ভবনের নিচে এসে শেষ হয়েছে রাস্তাটা। রাস্তার একেবারে শেষ মাথায় ভবনটির নিচেই সে দেখতে পেল কালো গাড়িটাকে। পুরাতন মডেলের একটি টয়োটা প্রিন্টার। রিবিট বুঝতে পারল এই গাড়িটিই ব্যবহার করেছিল কালো মানুষেরা। সে আরো নিশ্চিত হল যখন গাড়ির মধ্যে একটা স্কুলব্যাগ দেখতে পেল। স্কুলব্যাগটিও যে তিশার সে-বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকল না রিবিটের। আর যখন গাড়ির রেজিস্ট্রেশন নম্বরটি দেখল তখন নিশ্চিত হল সে সঠিক জায়গায়ই এসেছে। তিশার দাদু যে-নম্বর বলেছিল সেই নম্বরের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে গাড়ির নম্বরটি।
বাইরে মূল দরজার সামনে এসে দেখল দরজাটি ভিতর থেকে বন্ধ। রিবিট বুঝতে পারল ভিতরে কেউ-না-কেউ আছে। তবে সে দরজায় ধাক্কা দিল না কিংবা অন্য কোনো শব্দ করল না। সে ধীরে চলো’ নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিল। সে উপলব্ধি করতে পারছে তার সামান্য ভুল তিশার ভয়ানক পরিণতির কারণ হতে পারে।
রিবিট মূল ভবনটির চারপাশে খুব সতর্কতার সাথে ঘুরে এল একবার। পিছনে একটা ভাঙা জানালা দেখে ঠিক করে রাখল যদি ঢুকতেই হয় তাহলে এই জানালা দিয়েই ভিতরে ঢুকবে। রিবিট এবার সময় নিয়ে অন্য ভবনগুলো ঘুরে দেখল। প্রত্যেকটি ছোট বড় ভবনই বাইরে থেকে তালা দেয়া। কোনোটিতেই আলো জ্বলছে না। প্রত্যেকটি ভবনের মূল দরজার সামনে ধুলোর আস্তরণ জমেছে। এমনকি তালাগুলোর উপরও একই অবস্থা।
সবগুলো ভবন দেখার পর রিবিট নিশ্চিত হল এখানে কেউ যদি থেকে থাকে সে ঐ গাড়ি-সংলগ্ন ভবনে আছে। তিশা যদি এখানে থাকে তাহলে ঐ ভবনেই থাকবে। রিবিট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল। সে ভবনের মধ্যে প্রবেশ করবে। তাই সে হেঁটে হেঁটে একেবারে পিছনে চলে এল। তারপর এল ভাঙা জানালটার কাছে। এই জানালার পাল্লা ভাঙা হলেও লোহার গারদগুলো ঠিকই আছে। কারো পক্ষে এই গারদের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়।
রিবিট জানালা দিয়ে ভিতরে তাকাল; ভিতরটা অন্ধকার হলেও দেখতে পেল সে। নাইটভিশন ক্ষমতা থাকায় অন্ধকারেও দেখতে পায় সে। তবে কিছু দেখতে অনেকটা সবুজাভ মনে হয়। রিবিট ভালোমতো তাকাতে বুঝতে পারল ভিতরের কক্ষটা অনেক বড়। এখানে-ওখানে কিছু ভাঙা চেয়ার-টেবিল ছাড়া আর কিছু নেই।
রিবিট দুহাতে লোহার দুটো গারদ টান নিতে বুঝতে পারল সাধারণ শক্তিতে এটা বাঁকানো সম্ভব নয়। সে অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ডেকে উঠল : ইপি।
ইতি সাথে সাথে উত্তর দিল : বলো রিবিট।
আমার শক্তি বৃদ্ধি প্রয়োজন।
ইপি একমুহূর্ত সময় নিল। তারপর বলল : বৃদ্ধি করা হয়েছে, লেভেল মিডিয়াম।
রিবিট এবার দুহাতে টান দিতেই খুলে এল জানালার গারদ দুটো। ও দুটোকে মাটিতে ফেলে একলাফে সে উঠে বসল জানালার উপর। তারপর শব্দহীন এক লাফে নেমে পড়ল কক্ষের ভিতরে। ভিতরে এতটাই ধূলো যে রিবিটের পা প্রায় এক সেন্টিমিটার ধূলোর মধ্যে ডেবে গেল।
রিবিট এখন যা-কিছু দেখছে সবই সবুজাভ। কিন্তু তার হাঁটতে কিংবা চলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। সে হাঁটতে হাঁটতে সামনের দরজার কাছে চলে এল। দরজাটা ভেজানো ছিল। পাল্লা ধরে টান দিতেই খুলে এল দরজাটা। এই দরজাটা লম্বা একটা করিডোরের সাথে সংযুক্ত। করিডোরটা এমাথা থেকে অন্যমাথা পর্যন্ত চলে গেছে। করিডোরের দুপাশে সারি সারি দরজা। রিবিট বুঝতে পারল এই ভবনটা মূলত গোডাউন হিসাবে ব্যবহার হত। চূড়ান্তভাবে তৈরি পোশাকসমূহ এখানে রাখা হত। এজন্য এখানকার কক্ষগুলো বেশ বড় বড়।
সম্পূর্ণ ভবনটিতে কীভাবে তিশাকে খুঁজবে সে-বিষয়ে বিশ্লেষণ করতে শুরু করল রিবিট। তিশাকে খুঁজে পেতে হলে প্রতিটি কক্ষ তাকে খুব সতর্কতার সাথে খুঁজতে হবে। তাছাড়া ভবনটি তার অপরিচিত। হাঁটার সময় টুকটাক শব্দও হতে পারে। সেরকম কিছু হলে নিজেকে লুকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। কোনোভাবে যদি কালোমানুষ জেনে যায় যে সে এখানে, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
রিবিট যখন একটা কক্ষ পরীক্ষা করে অন্য একটা কক্ষ পরীক্ষা করছে তখনই সে জানালা দিয়ে বাইরে টর্চের আলো দেখতে পেল। সে খুব সতর্কতার সাথে জানালার কাছে এসে বাইরে উঁকি দিতে বুঝল পুলিশ ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে চারপাশটা। টর্চের আলো পুলিশেরই ছিল। পুলিশ যে এত দ্রুত এখানে এসে পৌঁছাবে সে তা ভাবতে পারেনি।
রিবিট আরো দুটো কক্ষ পরীক্ষা করতে এসি শাহেদের ফোন এল। অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে শব্দহীনভাবে উত্তর দিল রিবিট। এটা বিশেষ এক পদ্ধতি। রোবট যে-কথাগুলো বলতে চাইবে তা সরাসরি টেলিফোন-নেটওয়ার্কে চলে যাবে। বাইরে থেকে দেখে মনে হবে রিবিট বুঝি চুপচাপ আছে। ঠিক এইভাবে রিবিট আর ইপি নিজেদের মধ্যেও কথা বলে।
এসি শাহেদ বলল : রিবিট তুমি কোথায়?
আমি ভবনের মধ্যে।
কোন্ ভবনে?
যে-ভবনের সামনে গাড়িটা আছে সেটার মধ্যে।
ওটার ভিতর থেকে তো বন্ধ। তুমি নিশ্চয় পিছনের জানালা দিয়ে ঢুকেছ। ওখানে দুটো লোহা ভাঙা দেখলাম।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছ।
তুমিই কি ভিতরে আলো জ্বালিয়েছিলে?
শাহেদের প্রশ্ন শুনে অবাক হল রিবিট। বলল : কই নাতো! আমি তো এই ভবনের মধ্যে কোনো আলো জ্বালাইনি।
তুমি কি একটু পরীক্ষা করে দেখবে কে আলো জ্বালিয়েছে?
এটা কোন্ জায়গায়?
একতলায়, একেবারে উত্তরপাশে।
আমি মাঝামাঝি আছি। ধীরে ধীরে ওদিকে অগ্রসর হচ্ছি।
ঠিক আছে তুমি এগোতে থাকো, আমরাও এগোচ্ছি।
শাহেদের সাথে কথা শেষ হতেই খুট একটা শব্দ কানে এল রিবিটের। সাথে সাথে সতর্ক হয়ে উঠল রিবিট। বুঝতে পারল আশেপাশে কেউ আছে। শব্দের উৎস লক্ষ্য করে বাইরে করিডোরে তাকাতে দেখল উত্তরপাশের একটা দরজা দিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এল একজন। লোকটা অল্পবয়সী। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে এর স্বভাব ভালো হতে পারে না।
রিবিট যে-কক্ষে দাঁড়িয়ে আছে সেই পর্যন্ত এল না লোকটা। তার আগেই ডানে ঘুরে চলে গেল বাইরে বেরোনোর মূল দরজার কাছে। এরই মধ্যে মোবাইলে কারো সাথে কথা বলতে শুরু করেছে সে। চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট।
রিবিট অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ইপিকে বলল : ইপি, লোকটিকে চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ রিবিট। আমি তোমার মেমোরিতে সংরক্ষিত ছবিগুলোর সাথে লোকটির চেহারা মিলিয়ে দেখেছি। এ হচ্ছে কেরামত, পেশাদার খুনী। ডিবি অফিসে এর ছবি সংরক্ষিত আছে। এসি শাহেদ তোমাকে কেরামত আর হারুনের যে-ছবি দেখিয়েছিল এ হচ্ছে সেই কেরামত।
কী সাংঘাতিক! তাহলে তিশা সত্যি এদের হাতে পড়েছে।
হ্যাঁ রিবিট, খুব সতর্ক থাকতে হবে।
রিবিট আর অপেক্ষা করল না। দ্রুত করিডোরের মাঝে এসে অপেক্ষা করতে লাগল দরজার পিছনে। এই দরজা খুলেই কেরামত বাইরে বেরিয়েছে। কেরামত দরজার ঠিক ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মোবাইলে এখনো কারো সাথে কথা বলছে সে। রিবিট স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে কথা। কেরামত বলছে : বস, মনে হয় সমস্যাই হইল। বাইরে সম্ভবত পুলিশ আছে… হালার বাপটা পুলিশরে এইবারও খবর দিছে…. মাইয়াভারে বাঁচায় রাইখা লাভ নাই… হ দেখতাছি… তুমি সতর্ক হও… আমি আসতাছি…।
মোবাইলের ওপাশে কেরামত কার সাথে কথা বলছিল রিবিট তা বুঝতে পারল না। ওপাশের লোকের কথাও শুনতে পাচ্ছিল না সে। তবে সে নিশ্চিত, এরা সবাই কালো মানুষের দলেরই সদস্য।
রিবিট দরজার পিছনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে ইলেকট্রনপ্রবাহ এখন খুব সুষম। খুব ধীরস্থিরভাবে কাজ করবে সে। কিছুই বুঝতে দেবে না কেরামতকে।
কেরামত ভিতরে প্রবেশের জন্য যেই না পা বাড়ল তখনই রিবিট খপ করে কেরামতের গলা চেপে ধরল। তারপর ভূমি থেকে প্রায় ছয় ইঞ্চি উপরে তুলে চাপা স্বরে বলল : তিশা কোথায়?
এমন কিছু যে ঘটবে কেরামত ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। সে চোখ বড় করে রিবিটের দিকে তাকাতে রিবিট আবার বলল : তিশা কোথায়?
জানি না।
তিশা কোথায়? এবার ধমকে উঠে বলল রিবিট।
জানি না। বলে কুৎসিত একটা হাসি দিতে চেষ্টা করল কেরামত।
রিবিট এবার হাতের চাপ আরো বাড়াল। তাতে কেরামতের দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হল। কিন্তু তারপরও সে বলল না তিশা কোথায়। এরই মধ্যে রিং বাজতে শুরু করল কেরামতের মোবাইলে। রিবিট কিছু করার আগেই ফোনের রিসিভ বাটনে চাপ দিল কেরামত। তারপর চিৎকার করে উঠে বলল : বস, বিপদ।
রিবিট আর কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না কেরামতকে। মাথার পিছনে স্পর্শকাতর স্থানে এমনভাবে আঘাত করল যে সাথে সাথে জ্ঞান হারাল কেরামত। কেরামতের মূল উদ্দেশ্যটা বুঝতে পেরেছে রিবিট। কেরামত ফোন কানে না-লাগিয়েই কথা বলেছে। তার মানে সে চেষ্টা করেছে তার বসকে বুঝিয়ে দিতে যে সে বিপদে আছে এবং সেক্ষেত্রে সে সফল হয়েছে।
রিবিট মোবাইলে শাহেদকে কেরামতের দায়িত্ব নিতে বলে নিজে বেরিয়ে এল করিডোরে। তার লক্ষ্য উত্তরে শেষমাথার করিডোরটা। রিবিটকে অবশ্য কষ্ট করতে হল না। সে পৌঁছানোর আগেই ঐ কক্ষ থেকে বেরিয়ে এল একজন। অন্ধকার থাকায় রিবিটকে দেখতে পেল না আগত ব্যক্তি। অনেকটা ছুটে আসছে সে। অথচ রিবিট ঠিকই দেখতে পাচ্ছে লোকটাকে চিনতেও পারল। এ আর কেউ নয়, হারুন। এর ছবিটাও তাকে আগে দেখিয়েছে শাহেদ। ছবিটা তার মেমোরিতে সংরক্ষিত আছে।
হারুনের হাতে টর্চ থাকলেও সে জ্বালাচ্ছে না। তার মূল লক্ষ্য বাইরের দরজা। দ্রুত সেখানে এসে কেরামতকে সাহায্য করা এবং দরজাটি বন্ধ করে দেয়া। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি মূল করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে রিবিট। তাই সে রিবিটকে অতিক্রম করার সময় ভয়ানক এক ঘুসি খেল তলপেটে। কিছু বুঝে উঠার আগেই দ্বিতীয় ঘুসি এসে লাগল চোয়ালে। ঘুসির তীব্রতায় হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেল টর্চলাইটটা।
রিবিট দুহাতে হারুনের কলার ধরে তাকে শূন্যে তুলে ফেলল। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল : তিশা কোথায়?
চোখের সামনে কিম্ভুতকিমাকার ধাতব এক চেহারা দেখে হারুন একেবারে হতচকিত হয়ে গেল। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল : ঐ..ঐ..ঘরে।
করিডোরের শেষমাথার ঘরটা দেখিয়ে দিল হারুন।
রিবিট হারুনকে আরো ছয় ইঞ্চি উপরে তুলল। তারপর ছুঁড়ে ফেলল পিছনের দেয়ালে দেয়ালের সাথে ভয়ানক আঘাতে কো করে বিশ্রী শব্দ করে উঠল হারুন। দ্বিতীয়বার অবশ্য সে আর শব্দ করার সুযোগ পেল না। তার আগেই রিবিটের ভয়ানক ঘুসিতে জ্ঞান হারাল সে।
আগের মতোই রিটি ফোন করে শাহেদকে হারুনের দায়িত্ব দিয়ে দিল। অবশ্য শাহেদও ততক্ষণে কাছাকাছি চলে এসেছে।
উত্তরের কক্ষটিতে প্রবেশ করে রিবিট থমকে গেল। না, ভিতরে কেউ নেই। অবাক হল সে, তাহলে কি তাকে ভুল তথ্য দিয়েছে হারুন। ভাবতেই রিবিট আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। সত্যি যদি তিশার কোনো ক্ষতি হয় তাহলে সে নিজেকে সান্ত্বনা দেবে কীভাবে?
রিবিট করিডোরে ফিরে আসতে দেখে শাহেদ এসে গেছে। শাহেদ তাকে দেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল : তিশার কোনো খোঁজ পেলে রিবিট?
না।
ওদের দলে কতজন আছে?
আমি এখনো জানি না। তুমি ওদের দুজনকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করো। দ্যাখো তো কিছু জানা যায় নাকি।
এ মুহূর্তে সম্ভব নয়। দুজনই অজ্ঞান। অবশ্য আমার লোকেরা ওদের জ্ঞান ফেরাতে চেষ্টা করছে।
রিবিট কিছু বলল না। তার মধ্যে বিশ্লেষণের ঝড় বইছে। ইলেকট্রন এখন তীব্রগতিতে ছুটে চলছে একটা সার্কিট থেকে অন্য সার্কিটে।
এখন আমরা কী করতে পারি রিবিট?
সেটাই তো ভাবছি। আমি নিশ্চিত তিশা আকৌপাশেই কোথাও আছে।
কিন্তু তিশাকে খুঁজে পাব কীভাবে?
হঠাৎই যেন বুদ্ধিটা এসেছে এমনভাবে কেরামতের মোবাইলটার দিকে তাকাল রিবিট। কেরামত অজ্ঞান হওয়ার পর মোবাইলটা তুলে নিয়েছিল সে। রিবিট শুনেছে কেরামত ‘বস’ বলে কাউকে সম্বোধন করেছে। এই বস্-ই যে কালোমানুষ সে-ব্যাপারে নিশ্চিত সে।
মোবাইলে স্কুল করে সে ‘বস’ নামে সত্যি একটা নম্বর সেইভ-করা দেখতে পেল। কল করার আগে শুধু বলল : শাহেদ কান খাড়া রেখো। কোনো রিংটোন শুনলে সাথে সাথে জানাবে।
ঠিক আছে।
রিবিট কল করার সাথে সাথে কান খাড়া করল শাহেদ। ওপাশে রিং হলেও শাহেদ কোনো রিংটোন শুনতে পেল না। দ্বিতীয়বার কল করতে আবারো রিং হতে লাগল। শাহেদ আগের মতো কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। রিবিট এবার খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে যে কক্ষটা থেকে সে বেরিয়ে এসেছে সেই কক্ষটায়। তবে এবার আর সবগুলো রিং হল না। তার আগেই কেউ কেটে দিল লাইনটা।
রিবিট কক্ষটাতে প্রবেশ করতে শাহেদ বলল : কিছু বুঝলে?
হ্যাঁ শাহেদ। মূল নেতা আশেপাশেই কোথাও আছে। আমি রিং শুনেছি।
কিন্তু আমি তো কিছুই শুনতে পেলাম না।
তুমি শোনোনি, কারণ আমার মতো প্রখর শ্রবণশক্তি তোমার নেই। আমি অনেক শব্দ শুনতে পাই যা সাধারণ মানুষের শোনার ক্ষমতা নেই। আর ইলেকট্রনিক শব্দ হলে আমার জন্য ব্যাপারটা আরো সহজ হয়ে পড়ে। মোবাইলের রিংটোনের শব্দ ইলেকট্রনিক শব্দ।
তাহলে কোথায় আছে তিশা?
রিবিট এবার খুব ভালোভাবে মেঝেটা পরীক্ষা করল। তারপর বলল : ঐ দ্যাখো, কোণায় একটা ধাতব ঢাকনা। সম্ভবত এই কক্ষ থেকে কোনো সুড়ঙ্গ নিচের দিকে নেমে গেছে। কিছুক্ষণ আগে আমি এই ঢাকানাটা দেখতে পাইনি, কারণ আমি মেঝের দিকে নজর দিইনি। এখানে যে কোনো সুড়ঙ্গ বা চোরাকুঠুরি থাকতে পারে সেটা আমার ধারণায় ছিল না। তাছাড়া ঢাকনাটার রঙ সবুজ। অন্ধকারে আমি যা-কিছু দেখছিলাম তার সবই নীলচে-সবুজাভ। এ-কারণে ঢাকানাটার উপস্থিতি টের পাইনি। সবুজের মধ্যে সবুজ হারিয়ে গিয়েছিল। আর এখন তোমার হাতের টর্চের আলোতে সবকিছু কী সুন্দর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
এখন কী করবে?
যা করার দ্রুত করতে হবে। অতিরিক্ত সময় নেয়া যাবে না। তোমার হাতের টর্চটি জ্বালিয়ে রাখো। আর হ্যাঁ, হারুনকে আমাদের দরকার।
কিন্তু ও তো অজ্ঞান হয়ে আছে।
তাতে সমস্যা নেই। ঢাকনা সরিয়ে প্রথমে ওর পাদুটোই নিচে নামিয়ে দিতে হবে। তাহলে ভিতরের মানুষ ভাববে হারুনই নামছে। আমার যুক্তি বলছে ভিতরে যে-মানুষটি আছে সে আর কেউ নয়, ইদ্রিস আলী। তবে একের অধিক ব্যক্তিও থাকতে পারে।
রিবিটের পরিকল্পনা অনুসারে হারুনকে নিয়ে আসা হল। হারুনকে আনতে যেয়ে দেখা গেল হারুনের জ্ঞান ফিরে এসেছে। এই কক্ষে এসে হারুন ছুটে যাওয়ার জন্য খানিকটা চেষ্টা করলেও রিবিটকে দেখে একেবারে থমকে গেল। রিবিট কিছু বলল না। সে শুধু ইশারায় হারুনকে নিচে যাওয়ার ইঙ্গিত করল।
হারুন দ্বিতীয়বার আর রিবিটের হাতে ঘুসি খেতে ইচ্ছুক নয়। তাই সে সুবোধ বালকের মতো ঢাকনাটা উঁচু করল। এ মুহূর্তে অবশ্য ঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার। রিবিটের কথামত শাহেদ তার টর্চলাইটটা বন্ধ করে দিয়েছে। ভিতরে অবশ্য কয়েকজন সশস্ত্র গোয়েন্দা সদস্য আছে।
হারুন ঢাকনা উঁচু করে ভিতরে পা রাখতেই নিচ থেকে সাংকেতিক শব্দ ভেসে এল : হিস্…।
সাথে সাথে হারুনও ওস্..ওস্..শব্দ করে উত্তর দিল।
রিবিট বুঝতে পারল এটা কালোমানুষদের নিজেদের মধ্যেকার কথাবার্তার সাংকেতিক ভাষা যার অর্থ তারা বুঝতে পারবে না। হঠাৎই তার সন্দেহ হল হারুন তাদের পক্ষে কাজ নাও করতে পারে। সে সংকেত দিয়ে হয়তো পুলিশের উপস্থিতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। তাই আর সে অপেক্ষা করল না। হারুনকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে দিয়ে নিজেও লাফিয়ে পড়ল নিচে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পর পর দুটো গুলির শব্দ হল। চমকে উঠল রিবিট।
একটা গুলি এসে সরাসরি তার কাঁধে লাগল। দ্বিতীয়টা অবশ্য উপরে ছাদে যেয়ে লাগল।
ভিতরটা অন্ধকার হলেও রিবিট স্পষ্ট দেখতে পেল তার থেকে মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে কুৎসিত চেহারার এক লোক। পিস্তলটা এখনো উপরের দিকে তাক করা। অন্ধকার থাকায় কোথায় কী ঘটছে সে তা দেখতে পাচ্ছে না। আর লোকটির ঠিক পিছনে গুটিশুটি মেরে আছে তিশা। খুব ধীরে ধীরে সে সরে যাচ্ছে ডান দিকে।
হঠাৎ হারুন চিৎকার করে উঠে বলল : বস্, গুলি করো, গুলি করো। মাইয়াডারে মাইরা ফ্যালো। এইহানে পুলিশ আইছে।
ইদ্রিস আলী আর দেরি করল না। ঘুরেই তিশা যেখানে ছিল সেই জায়গাটা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। কপাল ভালো তিশা আগেই সরে গিয়েছিল। মাত্র দু-ফুট দূরে যেয়ে লাগল গুলিগুলো। এরই মধ্যে টর্চ জ্বালিয়েছে ইদ্রিস আলী। তিশাকে সরে যেতে দেখে সে রাগে ফুঁসছে। পিস্তল ঘুরিয়ে সে আবারো তিশার দিকে তাক করলেও রিবিট এবার তাকে আর কোনো সুযোগ দিল না। পিছন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইদ্রিস আলীর উপর।
রিবিটের ধাক্কায় এবারেও ইদ্রিস আলীর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। তবে আর কোনো সুযোগ সে পেল না। রিবিটের ভয়ানক ঘুসিতে মুখ থুবড়ে নিচে পড়ল সে। অবশ্য রিবিটকে আর কিছু করতে হলো না। ততক্ষণে শাহেদ আর তার দল নেমে এসেছে নিচে। বাকি দায়িত্বটুকু বুঝে নিল তারা।
এদিকে তিশা অবাকচোখে তাকিয়ে আছে রিবিটের দিকে। রিবিট কাছে এসে তিশার হাত-পা-মুখের বাঁধন খুলে দিতে তিশা রিবিটের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
রিবিটও তিশাকে বুকে টেনে নিল।
হঠাৎই তিশা মাথা উঁচু করে রিবিটের কাঁধে যেখানে গুলি লেগেছে সেখানে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল : রিবিট, নিশ্চয় তোমার খুব ব্যথা লেগেছে?
রিবিট মিষ্টি হেসে বলল : না তিশা, আমার শরীরে ব্যথার কোনো অনুভূতি নেই। ব্যথার যে অনুভূতি আমার মধ্যে আছে তা শুধুই হৃদয়ে এবং শুধুমাত্র মানুষের জন্য। আমার নিজের জন্য নয়।
.
১৯.
একদিন পর।
মাঝরাতের কিছু আগে প্রফেসর হকের বাসা থেকে বেরিয়ে এল রিবিট। প্রফেসর হক রিবিটের কাঁধে গুলির যে আঁচড় লেগেছিল সেটা ঠিক করে দিয়েছে। এখন আর সেখানে কোনো দাগ নেই। একদম আগের মতো হয়ে গেছে।
পলাশীর মোড়ে আসতে রিবিট বলল : হ্যাঁ ইপি, তুমি যেন আমাকে কী বলতে চেয়েছিলে?
পুলিশ কমিশনার তোমাকে ফোন করেছিল। তুমি অবশ্য তখন সার্ভিসিং নিয়ে ব্যস্ত ছিলে। তাই কথা বলতে পারনি।
কী বললেন পুলিশ কমিশনার?
হারুন আর কেরামতের মতো দুজন সাজাপ্রাপ্ত এবং কুখ্যাত আসামিকে ধরে দেয়ার জন্য তিনি তোমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
দুজনেই সাজাপ্রাপ্ত আসামি, এটা তো জানা ছিল না।
ডিবির ডেটাবেজেও সেটা ছিল না। রেকর্ড নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে যেয়ে বের হয়েছে।
ও আচ্ছা। আর ইদ্রিস আলীর কী হল?
ইদ্রিস আলীই কালো মানুষের নেতা। সে আসলে ওয়েভ গার্মেন্টসে চাকুরি করত। ফ্যাক্টরি বন্ধ করে মালিক আমেরিকায় চলে যাওয়ার সময় তাকেই কেয়ারটেকার করে যায়। কেয়ারটেকার থাকার সুবাদে সে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে ওয়েভ গার্মেন্টসের ভিতরের জিনিসপত্র বিক্রি করতে থাকে। ব্যাপারটা জানতে পেরে মাঝখানে মালিক নিজে এসে ফ্যাক্টরির মালামাল বিক্রি করে দেয় এবং ইদ্রিস আলীকে কেয়ারটেকারের পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করে। মালিক চলে গেলে ইদ্রিস আলী নিজের আস্তানা গড়ে তোলে ওয়েভ গার্মেন্টসে। মাঝখানে মালামাল চুরি করে বিক্রি করায় তার খরচের হাত বেড়ে যায়। উপার্জনের অন্য কোনো উপায় না-পেয়ে শেষে স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড শুরু করে। ঘটনাক্রমে পরিচয় হয় হারুন আর কেরামতের সাথে। হারুন আর কেরামতও ইদ্রিস আলীকে পেয়ে খুব খুশি। কারণ তারা আর কিছু পাক বা না পাক, অন্তত নিরাপদ আশ্রয় তো পেয়েছে। সেই থেকে তারা নানা অপকর্ম শুরু করে। নিজেদেরকে পরিচয় দিতে শুরু করে কালোমানুষ হিসাবে। সম্প্রতি তারা ভয় ভীতি প্রদর্শন করে চাঁদা আদায় শুরু করে। তিশাদের ঘটনা এমনই একটি ঘটনা। অবশ্য এর আগে আরো দুটো জায়গা থেকে এভাবেই অর্থ আদায় করে, তবে তা ছিল খুব সামান্য। তবে একটা জিনিস সত্য, তিনজনই ভয়ংকর। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য এমন কোনো হীন কাজ নেই যা তারা করতে পারে না।
ইপি তোমাকে ধন্যবাদ তোমার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য।
ইপি একটু থেমে বলল : এখন কোন দিকে যাবে?
গুলিস্তানের দিকে।
এই বলে রিবিট হাঁটতে শুরু করল। একটু যেয়ে বলল : আজ খুব ঠাণ্ডা, তাই না?
হ্যাঁ, তাপমাত্রা পনেরো ডিগ্রির নিচে।
এবার বোধহয় শীতের তীব্রতা আরো বাড়বে।
সেরকমই পূর্বাভাস পাওয়া গেছে।
মানুষের খুব কষ্ট হবে, তাই না ইপি?
হ্যাঁ। দরিদ্র মানুষের কষ্ট হবে বেশি।
আমাদের…
তুমি….
এভাবেই ইপির সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে চলছে রিবিট। বুয়েট পার হয়ে চানখারপুলের কাছে আসতেই সে দেখতে পেল একটা দোকানের পাশে ফুটপাতে গরিব কয়েকটি ছেলে একসাথে জড়ো হয়ে আগুন জ্বালিয়েছে। ওদের মধ্যে এক বয়স্ক বুড়িও আছে। সবাই আগুনের উপর হাত দিয়ে আগুন পোহাচ্ছে। মাঝে মাঝে বুড়ি আশেপাশের কাগজগুলো আগুনের মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। আর তাতে দাউদাউ করে উঠছে আগুন। তখন সবাই হাতদুটো দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে আগুনের কাছাকাছি, যেন কেউ উত্তাপ থেকে বঞ্চিত না হয়।
রিবিট কাছাকাছি পৌঁছাতে কয়েকজন ভয়ে আগেই উঠে দাঁড়াল। যারা উঠে দাঁড়াল তারা কেউই আগে রিবিটকে দেখেনি। তবে অন্যরা আশ্বস্ত করল তাদেরকে।
রিবিট কাছে এসে বসতেই সবাই ঘিরে ধরল রিবিটকে। বুড়ি আরো কয়েকটা কাগজ ঠেলে দিল আগুনের কুণ্ডলীতে। সাথে সাথে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। সবাই আগুনের আরো কাছে চলে এল। একজন বলল : রিবিট, আগুন যা আরামের!
অন্য একজন বলল : মেলা ঠাণ্ডা! আগুন তো আরামের হইবই।
রিবিট ছেলেগুলোর অভিব্যক্তি লক্ষ্য করছিল। এবার সে অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দিল : তোমরা চা খাবে? চায়ের সাথে বড় বড় টোস্ট বিস্কিট?
ছেলেদের কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু বুড়ি বলল : হ খামু।
রিবিট দোকানদারকে চা আর মোটা টোস্ট বিস্কিট দিতে বলল।
দোকানদার খুবই চটপটে। সে দ্রুত সবাইকে চা আর বিস্কিট দিল। রিবিট বিস্মিত হয়ে দেখল সবাই কী তৃপ্তির সাথেই না চা খাচ্ছে! সবার প্রতিটা চুমুকেই যেন স্বর্গীয় তৃপ্তি।
সবচেয়ে ছোট্ট ছেলেটি, যে আজ রিবিটকে প্রথম দেখছে সাহস করে জিজ্ঞেস করল : রিবিট, তুমি চা খাইবা না?
রিবিট মৃদু হেসে ছেলেটিকে কোলের মধ্যে টেনে নিল। অবশ্য উত্তরটা রিবিটকে দিতে হল না। পাশ থেকে অন্য একটি ছেলে বলল : রিবিট কিছু খায় না।
ছোট্ট ছেলেটি এবার বলল : তোমার জন্যি মেলা আনন্দ পাইলাম। তুমি আমাগো আরো আনন্দ দিবার পারবা? আমাগো কাগইজ শ্যাষ, আর আগুন জ্বলব না। আমাগো কয়ড়া কাগইজ কিনা দিবার পারবা? পুরান পিপার হইলে চলব। নইলে আইজ রাইতে মেলা কষ্ট করা লাগব।
রিবিট কোনো কথা বলল না, ছেলেটাকে আরো কাছে টেনে নিল। এ মুহূর্তে কথা বলার মতো ভাষা তার নেই। এদের কষ্টে সে খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। তার মধ্যে কেন যে এত কষ্ট, সে মাঝে মাঝে তা বুঝে উঠতে পারে না।
অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে রিবিট ডেকে উঠল : ইপি।
বলল রিবিট।
আমি কী চাচ্ছি তুমি বুঝতে পারছ?
হ্যাঁ রিবিট বুঝতে পারছি। তুমি আজ রাতের জন্য হলেও ওদের সবাইকে শীত থেকে বাঁচাতে যাচ্ছ।
তুমি কি কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে?
এতে প্রচুর শক্তি খরচ হবে।
হোক না। আমার সমস্ত শক্তিই তো মানুষের জন্য। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এই ছেলেগুলোও তো মানুষ। আমার সৃষ্টি তো ওদের জন্যই। আমি আমার সবকিছু উজাড় করে দিয়ে ওদের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই।
তাই হবে রিবিট। আমি এখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি। দ্রুত উত্তর দিল ইপি।
.
২০.
শেষ রাত। চানখারপুলে একটা বন্ধ দোকানের পাশে কয়েকটা ছেলে আর এক বুড়ি ঘুমাচ্ছে। কোনো শীতের রাতেই তারা আজকের মতো এত আরামে ঘুমায়নি। তাদের মাঝে যে বসে আছে রিবিট। রিবিট তার শরীরের তাপমাত্রাকে এমনভাবে বৃদ্ধি করেছে যে আশেপাশের কয়েক বর্গমিটার জায়গায় একটা সুষম, সহনীয় আর আরামদায়ক তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়েছে। আর সেই তাপমাত্রায় গভীর ঘুমে হারিয়ে আছে আশ্রয়হীন কয়েকটি শিশু আর এক বৃদ্ধা। আর রিবিট, মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।
রিবিট জানে না তার মতো এমন মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে সমাজের ক’জন তাকায় আশ্রয়হীন এই মানুষগুলোর দিকে!
(রমনা, ঢাকা-১১.০১.২০০৮ – ২৫.০১.২০০৮)
.
রিবিট ০০৩
অদৃশ্য ফাঁদ
শিশু-কিশোরদের সাথে সময় কাটাতেই রিবিট বেশি পছন্দ করে। তাই তো একদিন সে আসে ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনে অসহায়, হতদরিদ্র, খেটে-খাওয়া শিশু কিশোরদের মাঝে। সবাই হঠাই রিবিটকে তাদের মাঝে পেয়ে মহাখুশি। আনন্দ ফুর্তিতে রিবিটও সময় কাটাতে থাকে সবার মাঝে। পিতৃমাতৃহীন, গরিব-দুঃখী এই শিশু-কিশোররা যে কত অল্পতেই সুখী তা দেখে বিস্মিত হয় রিবিট। সে আরো বিস্মিত হয় যখন দেখে এদেরই কেউ কেউ হঠাই হারিয়ে যাচ্ছে অজানা কোথাও। যে একবার হারিয়ে যাচ্ছে সে আর কখনোই ফিরে আসছে না। কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে এই নিষ্পাপ, এতিম আর অসহায় শিশু-কিশোররা? সেই রহস্যের বেড়াজাল ভেদ করতে যেয়ে ভয়ংকর আর লোমহর্ষক এক অন্ধকার জগতের সন্ধান পায় রিবিট।
শেষ পর্যন্ত রিবিট কি পেরেছিল অসহায় হতদরিদ্র শিশু-কিশোরদের সাহায্য করতে?
Leave a Reply