৫.
রিবিট বেরিয়ে যেতে সোবহান আহমেদ আর সুমন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল সোফায়। তারপর সুমনই প্রথম কথা বলল : বাবা, তিশা বোধহয় রিবিটকে সবকিছু লিখে পাঠিয়েছে।
হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। তা না হলে রিবিট হঠাৎ করে আমাদের বাসায় আসবে
রিবিট যে আমাদের বাসায় এসেছে এটা কালোমানুষদের কেউ জেনে গেল কিনা?
জেনে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। আমার বিশ্বাস, আশেপাশে কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে।
এখন তাহলে আমরা কী করব? অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল সুমন।
সেটা তো আমারও প্রশ্ন।
সুমন ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল : এখন ফোনে কী কথা হল?
ঐ আগের মতোই হুমকি দিয়েছে। যদি আজ রাতের মধ্যে দশ লাখ টাকা দিতে না পারি তাহলে ওরা তিশাকে মেরে ফেলবে।
এত টাকা কোথায় পাব আমরা?
দশ লাখ অনেক টাকা। আমার ব্যাংকে কিছু জমানো টাকা আছে। সর্বমোট লাখ। তিনেক হবে। আমি তোমাকে এই টাকাটা দিয়ে দেব। তবুও তিশার জীবন রক্ষা পাক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন সোবহান সাহেব।
বাবা, তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে সত্যি আমার খারাপ লাগবে। তারপরও আমাকে নিতে হবে। কিন্তু তারপর কী হবে? আমার সঞ্চয় দুই লাখ টাকা। তোমার আর আমার মিলে হবে পাঁচ লাখ টাকা। আর বাকি পাঁচ লাখ টাকা পাব কোথায়?
আমি জানি না সুমন।
আমরা কি কালোমানুষকে বোঝাতে পারি না?
ওরা তো কোনো কথাই শুনতে চায় না। নিজেরাই কথা বলে। তাও শুধু নির্দেশ। তাছাড়া আলোচনা করার সুযোগ কোথায়? আবার কখন ফোন করবে তাও জানি না। ফোন করলে ল্যান্ডফোনে করবে নাকি মোবাইলে করবে সেটাও অনিশ্চিত।
টাকা কোথায় পৌঁছে দিতে হবে সেটা কি বলেছে?
না, কিছুই বলেনি।
তাহলে?
বলেছে পরে জানাবে। আপতত টাকা জোগাড় করে রাখতে হবে।
এরপর দুজনেই চুপ হয়ে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। কিছুক্ষণ পর সুমন আবার বলল : বাবা, আমরা যদি পুলিশকে খবর দিই তাহলে কী হবে?
আমি সাহস পাচ্ছি না। আমার বিশ্বাস পুলিশকে জানানো মাত্রই ওরা সম্পূর্ণ। ব্যাপারটা জেনে যাবে। তাতে আমাদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ আমাদের ক্ষতি করতে ওদের সময় লাগবে না। আমাদের প্রতিদিনই বাইরে যেতে হয়। আমি বাইরে যাই, তুমি অফিসে যাও, তিশা স্কুলে যায়। মানুষের ক্ষতি করার নানারকম উপায় আছে। কালোমানুষ যদি আমাদের ক্ষতি করতে চায় তাহলে তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু তাই বলে এতগুলো টাকা আমরা এভাবে দিয়ে দেব? আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাব।
আমাদের আর কী-ই-বা করার আছে?
বাবা, আমার কী মনে হয় জানো?
কী?
তিশা বোধহয় ঠিকই করেছে। রিবিটকে খবর দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই কারো–কারো সাহায্য গ্রহণ করা উচিত।
নির্ভর করা যায় এমন কারো সাহায্য পেলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু রিবিট কি তা পারবে? মনে হয় না। রিবিটকে সবাই চিনে ফেলবে। কালোমানুষ কিংবা তার সঙ্গীরা যখন দেখবে কিংবা বুঝতে পারবে রিবিট আমাদের সাথে আছে সেক্ষেত্রে উল্টো ফল হতে পারে।
যদি আমরা টাকা না দিই? হঠাৎই প্রশ্ন করল সুমন।
এরকম একটা চিন্তা আমার মাথায়ও ঘুরছে। এমনো হতে পারে যে বা যারা আমাদের কাছে টাকা চাইছে তারা হয়তো আসলেই কুখ্যাত কেউ না। হয়তো কোনো সাধারণ মাদকসেবী, যে কিনা চেষ্টা করছে আমাদের কাছ থেকে টাকাটা বাগিয়ে নিয়ে মাদক সেবন করতে। আর যদি সত্যি কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরনের কেউ হয় তাহলে টাকা না-দেয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ ওরা তখন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে ক্ষোভটা যেয়ে পড়বে তিশার ওপর। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ ঢাকা শহরে তিশার মতো ছোট একটা মেয়ের ক্ষতি করা কঠিন কিছু নয়।
তাহলে এখন সিদ্ধান্ত কী হবে?
আপাতত আমরা টাকা জোগাড় করে রাখি।
কিন্তু দশ লাখ টাকা কোথায় পাব?
আমাদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা আছে। এই পাঁচ লাখ টাকা নিয়েই আমরা প্রস্তুত থাকব। এতে যদি না হয় তাহলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।
আমার গহনাগুলো বিক্রি করে দিন বাবা। আমার অনেক গহনা আছে। পিছন থেকে বলল মুনা। সে এতক্ষণ তিশার সাথে ছিল।
না মা, না। এ কাজ করা যাবে না। আমার বিশ্বাস, কালোমানুষ যত খারাপই হোক না কেন, আমাদের কিছু সুবিধা-অসুবিধা বুঝবে।
কিন্তু শেষপর্যন্ত ওরা যদি রাজি না হয়? আবারো প্রশ্ন করল মুনা।
রাজি না হলে তখন দেখা যাবে। আপাতত তোমার গহনা বিক্রির চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও। এখন আমরা দুজন ব্যাংকে যাব। সেখান থেকে টাকা তুলে নিয়ে আবার ফিরে আসব। এর মধ্যে ওরা যদি ফোন করে তাহলে তুমি তেমন কিছু বলবে না। শুধু শুনে রাখবে কখন কোথায় টাকাটা দিতে হবে।
মুনা কোনো কথা বলল না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
সোবহান সাহেব এবার সুমনের দিকে ফিরে বললেন : তুমি বাইরে যেয়ে একটা ট্যাক্সি ঠিক করো। আমরা যে ট্যাক্সিতে যাব, সেই ট্যাক্সিতে ফিরে আসব।
সুমন উঠে দাঁড়াল। এ মুহূর্তে সত্যি তার খুব খারাপ লাগছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কারো সাহায্যও নিতে পারছে না। অফিস থেকে অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু এই অসুস্থতা যে কী ভয়ানক অসুস্থতা তা সে ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারছে না।
দশ মিনিটের মাথায় সোবহান সাহেব আর সুমন বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে মুনাকে ভালোমতো দরজা আটকাতে বলতে ভুলল না। এ মুহূর্তে সবার মধ্যেই একরকম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গাড়িতে বসে সুমনের খারাপলাগাটা আরো বাড়ল। সে বলেই ফেলল : বাবা, আমার মনে হচ্ছে তোমার ধারণাই সত্য। কেউ হয়তো সত্যি আমাদের বোকা বানাতে চাইছে।
সোবহান সাহেব সুমনের চোখের দিকে তাকাতে সুমন আবার বলল : হ্যাঁ বাবা, হয়তো সামান্য কেউ। শুধুই আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।
আমি জানি না সুমন। আমার মনে হয় সবকিছুর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকাই ভালো। এজন্যই এখানে আসা। মনে রেখো, খারাপ মানুষের মতিগতি খুবই খারাপ। নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করতে পারে না।
সুমন আর কোনো কথা বলল না। এখন আর তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার মনে হচ্ছে সে কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। তার চারপাশে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আর সেই অন্ধকারে খেলা করছে হাজারো রঙ-বেরঙের আলো। প্রত্যেকটি আলোই যেন তার সামনে কুৎসিতভাবে নাচছে আর হি হি করে হাসছে।
.
৬.
তিশার মোবাইলে ম্যাসেজের উত্তর পাঠিয়েও রিবিট আর কোনো কিছু জানতে পারেনি তিশার কাছ থেকে। সে বুঝতে পেরেছে তিশা উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় নেই। তবে সে নিশ্চিত তিশা সুযোগ পেলেই তার সাথে কথা বলবে। আর আশার কথা হল, ইপির বিশ্লেষণ সত্য হয়েছে। সোবহান সাহেব আর তার ছেলে বাসা থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে। ফিরে আসার সময় তাদের হাতে একটা কালো ব্রিফকেস ছিল। অথচ যাওয়ার সময় সেটা ছিল না। এই ব্রিফকেসটা কোথা থেকে এল এবং কীভাবে এলো তা বুঝতে অসুবিধা হল না রিবিটের। সে নিশ্চিত এই ব্রিফকেসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় অর্থ রয়েছে।
অনেক বিচার-বিশ্লেষণের পর রিবিট সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে পুলিশের সাহায্য নেবে। কারণ তার একার পক্ষে সম্পূর্ণ কাজটা করা সত্যি কঠিন। তার ধাতব চেহার এমনিতেই চোখে পড়ার মতো, মানুষের মধ্যে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। সহজেই প্রতিপক্ষের চোখে পড়ে যাবে। এ নিয়ে অবশ্য ইপির সাথে কিছুক্ষণ আগেও যথেষ্ট তর্কবিতর্ক হয়েছে। রিবিট দাবি করেছে তার চেহারা মানুষের মতো হলে ভালো হত। কিন্তু ইপি তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে তার চেহারা রোবটের মতো হওয়ায়ই সে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। যাইহোক, শেষপর্যন্ত সে আর ইপি একটা বিষয়ে একমত হতে পেরেছে। আর তা হল সম্পূর্ণ ঘটনাটি পুলিশকে জানানো।
রিবিট পুলিশকে ঘটনাটি জানানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবে বলে ঠিক করেছে। তাই সে সরাসরি থানাকে না-জানিয়ে ডিবির অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার শাহেদকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিল। ডিবির পক্ষে এ-ধরনের অভিযান পরিচালনা সহজতর হবে। কারণ ডিবি সাদা পোশাকে কাজ করে। তাছাড়া ডিবির তরুণ অফিসার শাহেদ তার পরিচিত। অবশ্য পুলিশের সকল অফিসারই তাকে চেনে। পুলিশের কাছ থেকে সে সবসময়ই যথেষ্ট সম্মান পেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে রিবিট ভাবে : পুলিশ তার সাথে যেরকম ব্যবহার করে, সত্যি যদি তারা সকল মানুষের সাথে একই রকম ব্যবহার করত তাহলে এদেশে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা অনেক অনেকগুণ বৃদ্ধি পেত। শুধু ব্যবহারের কারণেই আজ তারা সমাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে।
রিবিট প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিবি অফিসে যাবে। কিন্তু পরে পরিবর্তন করেছে সিদ্ধান্তটা। ডিবি অফিসে গেলে তাকে এখান থেকে কিছু সময়ের জন্যও বাইরে থাকতে হবে। এসময়ে যদি সোবহান সাহেব কিংবা সুমন টাকা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় তাহলে তাদেরকে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়ে যাবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানেই অবস্থান করার।
বিকাল চারটার সময় রিবিট ফোন করল এসি শাহেদকে।
শাহেদ ফোন ধরেই বলল : রিবিট তুমি! আমি সত্যি অবাক হয়েছি!
শাহেদ তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। কোনোরকম সময় ক্ষেপণ ছাড়াই বলল রিবিট।
বলো রিবিট বলো। আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
ফোনে সবকিছু বলা সম্ভব নয়।
তাহলে আমার অফিসে চলে এসো অথবা বলো আমি কোথায় আসব।
পারলে আমি তোমার অফিসে আসতাম। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার পক্ষে এখান থেকে নড়া সম্ভব নয়। তুমি যদি ধানমণ্ডিতে চলে আসতে পারে সবচেয়ে ভালো হয়।
আমি এক্ষুনি আসছি।
তোমাকে খুব গোপনে আসতে হবে যেন কেউ টের না পায়।
তোমার কথায় বেশ রহস্য আছে মনে হচ্ছে। আমি রহস্য খুব পছন্দ করি। এজন্যই ডিবিতে চাকরি করি। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো কাক-পক্ষীও টের পাবে না আমি তোমার ওখানে যাচ্ছি।
তাই যেন হয়।
খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তুমি আমাকে তোমার সামনে দেখতে পাবে রিবিট।
শাহেদের কথাই সত্য প্রমাণিত হল। বিশ মিনিটের মাথায় শাহেদ একা এসে উপস্থিত হল রিবিটের অবস্থানে। রিবিট শাহেদকে সবকিছু খুলে বলতে শাহেদ বলল : তুমি আমাকে সংবাদ দিয়ে ঠিকই করেছ রিবিট। এ-ধরনের সমস্যা তোমার একার পক্ষে সমাধান করা সত্যি কঠিন। তাছাড়া আইনগত ব্যাপারও রয়েছে। তুমি অনেক কিছুই করতে পারবে না যা আমরা করতে পারব। যাইহোক এখন আমাদেরকে পরবর্তী পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ।
তোমার কি কোনো পরিকল্পনা আছে?
আমি নিজে গ্রহণযোগ্য কোনো পরিকল্পনা বের করতে পারছি না। মনে হচ্ছে। এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। যখন সোবহান সাহেব কিংবা তার ছেলে বাইরে বের হবে তখন আমি তাকে অনুসরণ করব। কিন্তু পরিকল্পনাটকে ঠিক গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।
কেন গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না? প্রশ্ন করল শাহেদ।
কারণ আমাকে দেখলে সহজেই চিনে ফেলবে। দ্বিতীয়ত এ মুহূর্তে আমার কোনো গাড়ি নেই। আর তৃতীয়ত আমি জানি না টাকাটা কোথায় হস্তান্তর হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ রিবিট। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন তথ্য সংগ্রহ করা।
কিন্তু তিশাদের বাসায় কেউই তো আমাদের সাহায্য কামনা করছে না।
আমরা এক কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আমরা তিশাদের বাসার ফোনের কথা রেকর্ড করতে পারি।
কিন্তু সেজন্য তো আমাদের ফোন নম্বর বা মোবাইল নম্বর জানা থাকতে হবে। আমাদের তো ফোন নম্বরই জানা নেই।
ল্যান্ডফোন নম্বর বের করা কঠিন কিছু হবে না। টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে জানা যাবে। আর কথোপকথন রেকর্ড করাও অসম্ভব কিছু নয়। বাইরে যে এক্সচেঞ্জ আছে সেখান থেকে রেকর্ড করা যাবে। তবে এগুলো অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করবে। আর কালোমানুষ যদি মোবাইলে যোগাযোগ করে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে।
তিশার দাদু কিংবা বাৰা সাহায্য করলে ভালো হত। আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত। বলল রিবিট।
কিন্তু তোমার ভাষ্য অনুযায়ী তারা আমাদের সাহায্য করবে না। এখন যদি আমরা জোরাজুরি করি তাহলে অনেকগুলো সমস্যা হবে। প্রথমত, তারা আমাদের বলতে চাইবে না এবং অতিরিক্ত ভয় পাবে। আর কালো মানুষেরা যদি জেনে যায় তাহলে অধিকতর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে কালোমানুষ কিংবা তার দলবলকে ধরাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা যদি শুধু তিশাদের রক্ষা করতে পারি তাহলে কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। কারণ কালোমানুষ তিশাদের মতো আরো অনেক পরিবারকে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করবে। কাজেই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হবে কালোমানুষ আর তার দলবলকে ধরা।
তুমি এখন কী করতে চাইছ? প্রশ্ন করল রিবিট।
আমি এখনই ডিবি হেডকোয়ার্টার্সে জানিয়ে দিচ্ছি। তিশাদের বাসার ল্যান্ডফোনের কথোপকথন রেকর্ড করার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আর তোমার লোকজন? তারা কি আসবে না।
তারা চলে আসবে। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
নির্মাণাধীন পুরাতন ভবনটিতে অপেক্ষা করতে লাগল দুজন। সন্ধ্যা নাগাদ টিঅ্যান্ডটির লোকজন তিশাদের বাড়ির ফোনে আড়িপাতা সম্পন্ন করল। মোবাইল কোম্পানির সহায়তায় তিশার মোবাইলটিতেও আড়ি পাতা হল। তিশা তার মোবাইল থেকে রিবিটকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল। এজন্য তিশার নম্বরটি আগে থেকেই রিবিটের কাছে ছিল। কিন্তু অন্য কারো মোবাইল নম্বর সগ্রহ করতে পারল না তারা। আশেপাশে ডিবির অন্য কোনো লোকজনকে না-দেখে রিবিট কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠলেও শাহেদকে কিছু বলল না।
সন্ধ্যার পর রাস্তায় লোকজন কিছুটা কমে এল। তবে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোজন ঠিকই বেরুচ্ছে ঢুকছে। পাশে দুটো বাড়ির পর একটা সুন্দর বাড়িতে একটা সাদা মাইক্রো ঢুকতে দেখল রিবিট। আবার দুজন লোককে ঐ বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে যেতেও দেখল। এদিকে সিটি কর্পোরেশনের একটা ময়লার গাড়ি এসে তিশাদের বাড়ির কোণা থেকে গাড়িতে ময়লা তুলতে শুরু করল। লোকগুলোর কাজ এতটাই ধীর যে রিবিট নিশ্চিত সারারাত কাজ করেও এরা ডাস্টবিনের ময়লাগুলো তুলতে পারবে না। এদিকে আরো খানিক পর এক ঝাড়দার এসে রাস্তা ঝাড় দিতে শুরু করল। এই লোকটা আগের লোকগুলোর থেকে আরো ধীর। রিবিটের ইচ্ছে হল সে নিজে যেয়ে সবাইকে বলে সবাই যেন খানিকটা দ্রুত কাজ করে। কিন্তু সে নড়ল না। তবে তার দৃষ্টি কাড়ল একপাশে এক পিঠাওয়ালা। কিছুক্ষণ হল সে এখানে এসেছে। ভাজা পিঠা বিক্রি করছে। দু-চারজন ভালোই ক্রেতা পাচ্ছে সে।
রিবিটের অবশ্য মূল মনোযোগ তিশাদের বাড়ির দিকে। সে একটু পর পর তাকাচ্ছে আর আশা করছে এই বুঝি বেরিয়ে আসে তিশার দাদা কিংবা বাবা। কিন্তু। সেরকম কিছুই ঘটছে না। তারপরও সে অপেক্ষা করে আছে। সে নিশ্চিত তারা দুজন একসময়-না-একসময় বের হবেই।
.
৭.
দুপুরের পর থেকে তিশাদের বাসার সবাই আশা করছে কালো মানুষের ফোন আবার আসবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও কালো মানুষের কোনো ফোন এলো না। সন্ধ্যার পর থেকে কেন যেন সুমনের মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কারো দুষ্টুমি হতে পারে। তা না হলে অবশ্যই এতক্ষণ ফোন করে জানতে চাইত কোথায় টাকা দিতে হবে। কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তার ধারণা ছিল বাড়ির বাইরে থেকেও হয়তো কালোমানুষদের কেউ তাদের উপর লক্ষ্য রাখছে। কিন্তু সে-সম্ভাবনাও নেই মনে হচ্ছে। কারণ বাইরে সিটি কর্পোরেশনের কিছু লোক কাজ করছে। এ ছাড়া যারা আছে তার সবাই সাধারণ পথচারী। আর একজন পিঠাবিক্রেতাও আছে। তবে এটা নতুন কিছু নয়। এ এলাকায় অনেকেই এভাবে পিঠা বিক্রি করে। এ ছাড়া অন্য কাউকে তার চোখে পড়েনি যাকে দেখে সন্দেহ হতে পারে সে কালো মানুষের দলের সদস্য।
সন্ধ্যার পর সামনের বারান্দা থেকে সুমন যখন ভিতরে সোফায় এসে বসল তখন সে প্রায় নিশ্চিত ফোনটি ছিল শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির খামখেয়ালিপনা। কিন্তু তার অনুমান সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হল যখন তার মোবাইলটি বেজে উঠল।
মোবাইল বেজে ওঠার সাথে সাথে সোবহান সাহেব, সুমন, মুনা হুমড়ি খেয়ে পড়ল মোবাইলের উপর। স্ক্রিনে ‘আনোন’ বা ‘অপরিচিত নম্বর’ লেখা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল তারা। সুমন তার বাবার দিকে জিজ্ঞাসু-চোখে তাকাতে সোবহান সাহেব উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে ফোন ধরার জন্য সম্মতি দিলেন। সুমন ফোন ধরে হ্যালো বললেও ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না।
সুমন আবার বলল, হ্যালো।
কোনো উত্তর নেই।
সুমন এবার একটু জোর দিয়ে বলল, হ্যালো।
এবার ওপাশ থেকে একটা গল্পীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমার কথা শুনবার পাইতেছেন সুমন সাহেব।
হ্যাঁ হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। কাঁপা গলা সুমনের।
আমারে চিনবার পারছেন?
জি..জি.. না। সুমনের গলাটা আরো কেঁপে উঠল।
আমি কালোমানুষ।
কালোমানুষ!!
হঁ, কালোমানুষ। আপনে কি টাকা জোগাড় করছেন?
জি চেষ্টা করেছি। কিন্তু..
আবার কিন্তু কিসের?
দশ লাখ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এত টাকা আমাদের নেই। পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছি।
পাঁচ লাখ টাকা! কী বলেন আপনে?
জি, আমাদের কাছে আর টাকা নেই।
পাঁচ লাখ টাকা দিয়া আপনে আপনের মেয়ের জীবন রক্ষা করবার পারবেন না। মনে রাখবেন আমরা খুব ভয়ংকর। আমরা মানুষের জীবন নিয়া খেলা করি। আপনি নিশ্চয় চাইবেন না আর মাত্র পাঁচ লাখ টাকার জন্য আপনের মেয়ে চিরতরে হারায় যাক।
না না চাই না। কিন্তু আমাদের তো করার কিছু নেই। গলা শুকিয়ে এসেছে সুমনের।
আছে, মেলা কিছু করার আছে। টাকা ধার করেন।
এত টাকা আমাদের কেউ ধার দেবে না।
অবশ্যই দিবে। বাড়ি বিক্রি কইরা দেন, নয় বন্ধক রাহেন।
কী বলছেন আপনি! বাড়ি বিক্রি করে দেব! চোখ কপালে তুলে বলল সুমন।
তাইলে আপনের মেয়ের জীবন উৎসর্গ করেন। হো হো.. হো…। কুৎসিতভাবে হেসে উঠল কালোমানুষ।
হাসিটা মোটেই ভালো লাগল না সুমনের। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল : না না, আমরা তিশাকে হারাতে চাই না।
তাইলে যা বললাম তাই করেন। দশ লাখ টাকা জোগাড় করেন।
আমাদের তাহলে এক সপ্তাহ সময় দিন। এত টাকা জোগাড় করতে সময়ের প্রয়োজন।
আর সময় দেওয়া যাবে না। আপাতত যা হাতে আছে তাই আমাগো দিয়া দ্যান। পরের তিন দিন পর।
জি জি। সায় দিয়ে বলল সুমন।
আজ রাইত সাড়ে দশটায় গাবতলীর আমিনবাজারে থাকবেন। টাকাগুলা একটা কালো রঙের ব্রিফকেসে আনবেন।
আমিনবাজারে কোথায়?
মোবাইল খোলা রাখবেন। সময়মতো সবকিছু জানবার পারবেন। কোনোরকম চালাকি করবার চেষ্টা করবেন না।
না না, করব না।
পুলিশকে জানাবেন না। মনে রাখবেন, পুলিশ যদি কিছু জানবার পারে তাইলে আপনের সারাজীবন পস্তান লাগব।
পুলিশ কিছু জানবে না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।
চমৎকার। আর হঁ, আসার সময় আপনের স্ত্রীর গহনাগুলোও নিয়া আসবেন।
জি নিয়ে আসব।
ঠিক আছে। রাইতে দেখা হবে।
আমার একটা কথা..
আর কোনো কথা নয়। শুধু এটুকু মনে রাখবেন, কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। পরিণতি তাহলে খুবই ভয়ংকর হবে। মনে রাখবেন আমরা খেলোয়াড় মানুষ। মানুষের জীবন নিয়ে খেলতেই আমি বেশি পছন্দ করি। আর সেটা যদি কোনো শিশুর জীবন হয় তাহলে আনন্দটা আরো বেশি।
এরপর লাইনটা কেটে গেল।
এটুকু কথাতেই কপাল ঘেমে উঠেছে সুমনের। সে শূন্যদৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকাতে সোবহান সাহেব বললেন : তুমি ঘাবড়ে যেও না। একটা-না-একটা সমাধান বের হবেই। তারপর মুনার দিকে তাকিয়ে বললেন : তিশা কোথায়?
ওর ঘরে, টিভি দেখছে।
ওর কাছে মোবাইল নেই তো? শেষে দেখা যাবে কালোমানুষ ওকে ফোন করে হুমকি দিয়েছে।
না বাবা, নেই। আমি অনেক আগেই মোবাইল সরিয়ে ফেলেছি। তবে..
তবে কী?
রিবিট ওকে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিল। সম্ভবত তিশা আগেই রিবিটকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
না না, আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। তিশা যেন আর রিবিটের সাথে যোগাযযাগ করতে না পারে। রিবিটকে জানানো আর পুলিশকে জানানো একই কথা। শেষে দেখা যাবে উল্টো ফল হবে।
ঠিক আছে বাবা।
আর এখন থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাতে আমরা কী করব।
কী করব মানে? ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল সুমন।
মানে আর কিছুই নয়। আমাদের পরিকল্পনা কী হবে। সত্যি আমরা টাকাগুলো কালোমানুষকে দিয়ে দেব কিনা। আর দিয়ে দিলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ওকে আবারও টাকা দিতে হবে। আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়বার দেয়ার পর তৃতীয়বারও দিতে হবে এবং এভাবে চলতে থাকবে। আর যদি না দিই….
না না বাবা, আমি আমার মেয়ের উপর কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। আমার বিশ্বাস পাঁচ লাখ টাকা পাওয়ার পর কালোমানুষ আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে না। প্রয়োজনে আমি আমার গহনাগুলো দিয়ে দেব। বলল মুনা।
তুমি ব্যাপারটাকে যত সহজ ভাবছ বৌমা, আসলে তত সহজ নয়। এদের চরিত্র খুব খারাপ। যেখানেই এরা সুযোগ পায় সেখানেই হাত বাড়ায়। এদের হাতদুটো কেটে না ফেলা পর্যন্ত এরা হাত বাড়ানো বন্ধ করে না।
হাত বাড়াচ্ছে বাক, তারপরও আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। আবারো বলল মুনা।
ঠিক আছে। টাকা যদি দিতেই হয় কীভাবে দেবে?
আমি নিয়ে যাব। বলল সুমন।
তোমার একা যাওয়া ঠিক হবে না। আমিও যাব তোমার সাথে। দুজনে থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।
কিন্তু যাব কীভাবে?
আমরা এখান থেকে কোনো ট্যাক্সি নিয়ে বের হয়ে যাব। সরাসরি আমিনবাজারে যেয়ে নামব। সেখানে পৌঁছালে কালোমানুষ হয়তো বলে দেবে কী করতে হবে।
ঠিক আছে বাবা। মলিন স্বরে বলল সুমন।
তারপর সে উঠে এল সোফা থেকে। এগিয়ে গেল সামনের বারান্দায়। এখনো বাইরে সিটি কর্পোরেশনের মানুষগুলো কাজ করছে। তার মনে হল মানুষগুলো খুব ধীরগতিতে কাজ করছে। অবশ্য সে জানে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা সমসময়ই ধীর। তবে আজকের লোকগুলো বেশি ধীর। কোথায় যেন সমীকরণে মিলছে না, ঠিক যেমন মিলছে না তাদের সুখের জীবনে কালো মানুষের উপস্থিতির ঘটনা।
.
৮.
রাত সাড়ে নটার সময় বাসা থেকে বের হল সোবহান সাহেব এবং সুমন। সাথে একটা কালো ব্রিফকেস। সেখানে পাঁচ লাখ টাকা আর মুনার সোনার গহনা। কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না তারা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদি সম্ভব হয় সামনাসামনি হলে কালোমানুষকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবে।
ট্যাক্সিক্যাবে ওঠার পর একেবারেই চুপ হয়ে গেল দুজন। দুজনের মধ্যেই একধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। তাদের কেউই বুঝতে পারছে না আদৌ তারা সমাধানের দিকে এগোচ্ছে নাকি জটিলতা আরো বাড়াচ্ছে। উপরন্তু পঁচ লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার যন্ত্রণা তো আছেই।
সোবহান সাহেব কিংবা সুমন কেউই লক্ষ্য করল না যাত্রা শুরুর পর থেকে তাদেরকে অনুসরণ করছে একটি মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের প্রশিক্ষিত ড্রাইভার এমনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে যে সামনের গাড়ির ড্রাইভার বুঝতেই পারছে না তাকে অনুসরণ করছে কেউ। এই মাইক্রোবাসে আছে রিবিট, শাহেদসহ আরো কয়েকজন।
মাইক্রো ধানমণ্ডি থেকে বের হয়ে গাবতলীর পথ ধরলে রিবিটই প্রথম কথা বলল : শাহেদ, তুমি তো আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে ফেলেছিলে।
কেন?
আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি তোমার লোক আশেপাশে এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আমরা এভাবেই থাকি।
তাই বলে একেবারে পরিচ্ছন্ন-কর্মী, পিঠা-বিক্রেতা, ঝাড়দারের বেশ ধরে।
এতে অনেক সুবিধা আছে। কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।
আমি অবশ্য তোমাদের কাজের গতি দেখে সন্দেহ করেছিলাম।
তা করেছিলে। কিন্তু আমরা যদি দ্রুত কাজ করতাম তাহলে আরো সন্দেহ করতে। কারণ আমাদের কাজ আগেই শেষ হয়ে যেত এবং আমরা সেখানে অতিরিক্ত সময় অবস্থানের জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি খুঁজে পেতাম না। এজন্য আমাদেরকে ধীর গতিতে অত্যন্ত কৌশলে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হল, আমাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ভেবেছিলাম আশেপাশে হয়তো কালো মানুষের দলের কেউ থাকবে। কিন্তু আসলে কেউই ছিল না।
কিন্তু এতে হতাশ হওয়ার তো কিছু নেই। তোমাদের কাজের ধরনটাই এরকম।
তা তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-গুণটার প্রয়োজন হয় তা হলো ধৈর্য।
যাইহোক, এখন তোমার কী মনে হচ্ছে?
একটু সময় নিয়ে শাহেদ বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। কালোমানুষ যে কীভাবে তিশাদের বাড়ির সবার সাথে যোগাযোগ করছে তাও বের করতে পারছি না। ল্যান্ডফোনে কথা বলেনি আমি নিশ্চিত। মোবাইলের ব্যাপারটাও নিশ্চিত নয়। যদিও তিশার বাবার অফিস থেকে আমরা সুমন সাহেবের নম্বর জোগাড় করেছি, সেটাও
কোনো কাজে আসেনি। সুমন সাহেবের মোবাইলে কালো মানুষের কেউই কথা। বলেনি।
এমনো হতে পারে সুমন সাহেবের মোবাইল নম্বর জোগাড় করে তা মোবাইল কোম্পানির সাহায্যে আড়ি পাতার আগেই কালো মানুষেরা সুমন সাহেবের সাথে কথা বলেছে। কারণ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা আমরা মাত্র কিছুক্ষণ আগে শেষ করেছি। তাছাড়া এমনো হতে পারে কালোমানুষ বাসার অন্য কারো মোবাইলে কথা বলেছে যেটা আমরা জোগাড় করতে পারিনি। তবে এখন কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আমাদের উচিত ছিল বাসার কারো সাথে কথা বলা। অন্তত আমরা তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হতাম যে আমরা তাদেরকে সাহায্য করতে চাই।
কিন্তু তিশাদের বাড়ির কারো আচরণে সেটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়নি।
হতে পারে তোমার কথাই সঠিক। আমাদের এই গোয়েন্দাগিরির কাছে আসলে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক অনেক সময় আগে থেকে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। যাইহোক, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। আশা করছি আমরা সফল হব।
এদিকে ট্যাক্সিক্যাব গাবতলী আসতে ফোন এল সোবহান সাহেবের মোবাইলে। আগের মতোই স্ক্রিনে কোনো নম্বর ভেসে উঠল না। সোবহান সাহেব বুঝতে পারলেন ফোনটি কোথা থেকে এসেছে। তিনি একবার সুমনের দিকে তাকিয়ে ফোন ধরে বললেন : হ্যালো।
ওপাশ থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে এল : ফোনডা আপনের ছেলেরে দ্যান।
সোবহান সাহেব কাঁপা হাতে ফোনটি সুমনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
সুমন ফোন কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলল : সুমন সাহেব, আপনে যদি বিপদ এড়াবার চান তাইলে আপনে একা আমিনবাজারে আসবেন, আপনের সাথে যেন আর কেউ না আসে।
জি..জি। তোতলাতে তোতলাতে বলল সুমন।
আমি কী কইছি বুঝবার পারছেন?
জি, বুঝতে পেরেছি।
আপনের সাথে আপনের বাবা ছাড়া কি আর কেউ আছে?
না নেই।
সত্য করে বলুন।
হ্যাঁ সত্য বলছি। আমার সাথে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই।
মনে রাখবেন, কথার এদিক-ওদিক হইলে আপনের ভয়ানক পরিণতি বরণ করা লাগব। যাইহোক, আপনে গাবতলী থ্যাইকা একলাই আমিনবাজার আসবেন। আপনের সাথে যেন আর কেউ না থাহে।
ঠিক আছে থাকবে না।
আমিনবাজারে পৌঁছানোর পর আমি আপনেরে পরবর্তী নির্দেশ দিব। আর ই, আপনের বাবার মোবাইলডা সাথে রাখবেন। আপনারড়াও রাখবেন।
জি রাখব। তবে..
সুমন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিল ভরাট কণ্ঠস্বরের কালোমানুষ।
সুমন সোবহান সাহেবকে সবকিছু খুলে বলতে সোবহান সাহেব গাবতলীতে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। গাড়ি থেকে নামার সময় সোবহান সাহেবের মুখটা একেবারে চুপসে গেল। তার মধ্যে এখন অতিরিক্ত একটা চিন্তা যোগ হয়েছে। আর তা হল তার সন্তানের সুস্থভাবে ফিরে আসা। কালো মানুষেরা এত খারাপ যে তারা সুমনের ক্ষতি করে কিনা এ-চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠল।
এদিকে সুমন ঘামতে শুরু করেছে। তার খুব ভয়ও করছে। এই প্রথম তার নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। অবশ্য সে সত্যি নিঃসঙ্গ। তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। কালো মানুষেরা যে একা আসবে না এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। কারণ সে যখন কালোমানুষদের সাথে কথা বলেছে প্রত্যেকবারই ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে। সে নিশ্চিত কালোমানুষদের একটা দল আছে এবং এই দলের সবাই আসবে। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করতে পারে না। এমনকি ইচ্ছে করলে তাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে। খুনের কথা মনে হতেই শিউরে উঠল সুমন।
ড্রাইভারের কথায় বাস্তবে ফিরে এল সুমন। ভাইজান, আপনে আমিনবাজারের কোন্হানে নামবেন?
সুমন দ্বিধায় পড়ল। সে আমিনবাজারের উপর দিয়ে অনেকবার যাওয়া-আসা করেছে ঠিকই কিন্তু কখনো এখানে নামেনি। জায়গাটা তার সম্পূর্ণই অপরিচিত।
সুমন কিছু বলছে না দেখে ড্রাইভার আবার বলল : ভাইজান, কোনহানে নামবেন কইলেন না তো?
এই তো আর একটু সামনে। আপনে এগোতে থাকুন।
ড্রাইভারকে মনে হল সে সুমনের কথায় সন্তুষ্ট হয়নি। তাই খানিকটা সামনে যেয়ে সে আবার বলল : ভাইজান, আপনে কি এইহানে নামবেন?
সুমন দ্বিধায় পড়ল। এতগুলো টাকা নিয়ে নামাও মুশকিল। যদি ছিনতাই হয়। হতেও পারে। সে জানে আমিনবাজার জায়গাটা ভালো না। এখানে অনেক সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা থাকে। ড্রাইভারের প্রশ্নে সে শুধু বলল : না, আরো সামনে।
ভাইজান আপনে কি কোনোকিছু নিয়া চিন্তায় আছেন? প্রশ্ন করল ড্রাইভার।
না না। আমার কোনো চিন্তা নাই। তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল সুমন।
কিন্তু আমার মনে হইতেছে আপনি কিছু নিয়া খুব টেনশন করতেছেন।
ড্রাইভার কেন এই প্রশ্ন করছে তা বুঝতে সুমনের অসুবিধা হল না। তার আচরণ ড্রাইভারের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। সে শুধু বলল : না আমি টেনশনে ভুগছি না।
কিন্তু আপনি ঘামতেছেন। আবারো বলল ড্রাইভার।
এবার কিছুটা বিরক্তিই হল সুমন। সে বুঝতে পারছে ড্রাইভারের প্রশ্ন তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।
সুমন কিছু না-বলায় ড্রাইভার আবার বলল : ভাইজান, আপনে কে এই এলাকায় আইছেন আমি জানি না। তয় এই জায়গাড়া ভালো না। আপনের ব্রিফকেসে যদি টাকা থাহে তাইলে সাবধানে থাকবেন।
সুমন বিস্ময়ে একেবারে থ বনে গেল। আমতা-আমতা করে শুধু বলল : জায়গাটা সত্যি খারাপ?
হুঁ ভাইজান। যা কইছি তাই সত্য। আমার মনে হয় আপনের কারো সাহায্যের প্রয়োজন।
না না, আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
তাইলে ভাইজান এইহানে নাইমা পড়েন। আমিনবাজার ছাইড়া আইছি।
ও আচ্ছা।
ড্রাইভার ভাড়া নেয়ার সময় সুমনের সাথে চোখাচোখি হল। ব্রিফকেসটার দিকেও তাকাল একবার। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না সুমনের। যাওয়ার সময় ড্রাইভার শুধু বলল : ভাইজান এইহানে বেশিক্ষণ থাকবেন না, জায়গাড়া ভালো না।
ড্রাইভার খুব দ্রুত গাড়িটা নিয়ে চলে গেল। ড্রাইভার চলে যেতে ভয় আর আতঙ্ক চারদিক থেকে গ্রাস করল সুমনকে। সে কী করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। এখানে রাস্তার দুপাশে মাল বোঝাই অনেক ট্রাক। লোকজনের চলাচল আছে। অধিকাংশই ট্রাকের হেলপার আর ড্রাইভার। তার দিকে দু-একজন তাকাচ্ছেও। আর এজন্য অস্বস্তিটাও বেড়েছে।
সুমন বুঝতে পারল এখানে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে লোকজন সন্দেহ করবে। তাই সে সাভারের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কী ঘটবে ভাবতে চেষ্টা করল সে। হয়তো কোনো গাড়ি কিংবা হোন্ডা এসে ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে নেবে। অথবা হঠাৎই কেউ ট্র্যাকের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ছুরি মেরে বা গুলি করে ব্রিফকেসটা ছিনিয়ে নেবে। নতুবা চার-পাঁচজন এসে তাকে মারধোর করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে নিয়ে নেবে ব্রিফকেসটা।
সুমনের কাছে থাকা সোবহান সাহেবের ফোনটা হঠাৎই বেজে উঠল। সাথে সাথে চমকে উঠল সুমন। সে বুঝতে পারল অল্পতেই ভয় পাচ্ছে সে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে জোরে শ্বাস নিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। ভয়টা আগের মতোই জেঁকে ধরে থাকল তাকে।
সুমন ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতে ওপাশ থেকে ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল : সুমন সাহেব, আপনি কোনহানে?
আমি এখন আমিনবাজার পার হয়ে সাভারের দিকে হাঁটছি।
চমৎকার। আপনে হাঁটতে থাকেন। কখনো থামবেন না।
হ্যাঁ আমি হাঁটছি।
যেভাবে কইছিলাম সব ব্যবস্থা করছেন তো?
হ্যাঁ করেছি। পাঁচ লাখ টাকা এনেছি, সাথে আমার স্ত্রীর গহনা।
সবকিছু কালো ব্রিফকেসে আছে?
হ্যাঁ আছে।
আপনের সাথে কেউ নাই তো?
না নেই।
আপনের বাবা?
বা নেই, তাকে আপনার কথামতো গাবতলী নামিয়ে দিয়েছি। চমৎকার। আপনি হাঁটতে থাকুন। একেবারে সাভারের দিকে হাঁটবেন। কখনো ডাইনে বামে কিংবা পিছনে তাকাবেন না। আপনের পাশে কালো রঙের একটা গাড়ি থামলে শুধু তহনই থামবেন। কোনোরকম কথা ছাড়া ব্রিফকেসটা গাড়ির ভিতরে বসা মানুষের হাতে দিয়া দিবেন। আপনে কি আমার কথা বুঝবার পারছেন?
হ্যাঁ পেরেছি।
কথার কোনোরকম বরখেলাপ করবেন না।
করব না।
আপাতত আপনের সাথে আমার আর কথা হবে না। পরে সময়-সুযোগমতো আমি আমার বাকি পাওনাটা বুইঝা নিব।
জি আচ্ছা।
আর কোনো কথা হল না। ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিল কালোমানুষ।
সুমন উপলব্ধি করল কালো মানুষের কণ্ঠস্বর এবারো ভিন্ন ছিল। উপরন্তু মনে হচ্ছিল এবার বুঝি কণ্ঠস্বরটা অনেকদূর থেকে ভেসে আসছিল। তার সাথে যে কথা বলেছে সে-যে আগের জন থেকে ভিন্ন এ-বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।
সুমন হেঁটে চলছে। তার পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার বড় বড় বাস আর ট্রাক। সুমন এতটাই ভীত যে একবার ডানে-বামেও তাকাচ্ছে না। মূল রাস্তার পাশে যে ঘাস তার উপর দিয়ে হাঁটছে সে। এখানে রাস্তায় লোকজন একেবারেই নেই। দুইপাশে শূন্য বিল। রাত গম্ভীর হতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডাও পড়েছে। ঠাণ্ডায় ভয়টা যেন আরো জেঁকে বসতে শুরু করেছে।
প্রায় পনেরো মিনিট একটানা হাঁটার পর কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠল সুমন। তাই সে প্রথমবারের মতো পিছনে ফিরে তাকাল। আর তখনই দেখতে পেল কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার এগিয়ে আসছে। তার কেন যেন মনে হল এই গাড়িটাই সেই গাড়ি। কিন্তু পরক্ষণেই চমকে উঠল সে। কালো গাড়িটার পিছনেই একটি পুলিশের পিক-আপ।
সুমন ভেবে পেল না পুলিশ কীভাবে খবর পেল। তাই আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠল সে। সাংঘাতিক কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে এ-বিষয়ে নিশ্চিত সে। কারণ গতি আরো বাড়ছে কালো গাড়ির। তবে পুলিশের গাড়িটি আগের গতিতেই চলছে। সে অবশ্য স্থির দাঁড়িয়ে আছে। রাতের ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে সে।
সুমনকে অবাক করে দিয়ে কালো প্রাইভেট কারটি তার সামনে দিয়ে শাঁই করে বেরিয়ে গেল। আর পুলিশের গাড়িটি এসে থামল তার সামনে। গাড়ির মধ্যে দেখে লম্বা মতো একজন পুলিশ অফিসার নেমে এসে সরাসরি তার সামনে দাঁড়াল। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল : এত রাতে এখানে কী করছেন?
না..মানে… ইয়ে,,। সুমন আমতা-আমতা করতে লাগল। কোথা থেকে কী ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
আপনার ব্রিফকেসে কী? আবার প্রশ্ন করল পুলিশ অফিসার।
না.. মানে.. ইয়ে.. কিছু না।
নিশ্চয় কোনো মাদক অথবা অবৈধ কিছু? পাচারের চেষ্টা করছিলেন।
না। তেমন কিছু না।
তাহলে কি কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য?
বিস্ফোরক দ্রব্য থাকবে কেন?
তাহলে এত রাতে এখানে একা একা এই ব্রিফকেস হাতে কী করছেন?
আ.. আ..মি আসলে..।
হুঁ বুঝতে পেরেছি। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে সত্য কথাই বলেছে। আপনার আচরণ সন্দেহজনক। আপনার ব্রিফকেস, মোবাইল আটক করা হল। আপনাকেও থানায় যেতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে আমাদের হেফাজতে থাকতে হবে।
সুমন একেবারে অসহায় হয়ে পড়ল। তার ব্রিফকেস, মোবাইল নিয়ে নেয়া হয়েছে। তাকেও গাড়িতে উঠতে বলা হয়েছে।
সুমন যখন গাড়িতে উঠল তখন নিঃশব্দে একটা মাইক্রো এসে গাড়ির পিছনে থামল। মাইক্রোর ভিতরে কারা বসে আছে সুমন বুঝতে পারল না। কারণ ভিতরের লাইট বন্ধ থাকায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে যখন মাইক্রোর উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে পুলিশের পিক-আপ।
সুমন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সঁপে দিল ভাগ্যের হাতে। সে বুঝতে পারছে মাঝে মাঝে মানুষ ভাগ্যের কাছে সত্যি অসহায় হয়ে পড়ে।
.
৯.
থানায় এসে সবকিছু খুলে বলতে বাধ্য হল সুমন। থানার অফিসারদের সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে কষ্ট হত যদি-না ডিবির এসি শাহেদ সেখানে উপস্থিত থাকত। থানার ডিউটি অফিসার তারপরও অনেক কিছু জানতে চায় সুমনের কাছ থেকে। সবকিছু বিস্তারিত জানার পর একটা জিডি করে অবশেষে সুমনকে ছেড়ে দেয় তারা।
মাইক্রোবাসে করে শাহেদ যখন সুমনকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে তখন প্রথম প্রশ্ন করল সুমন : শাহেদ সাহেব, আপনি কি শুরু থেকেই আমাদের অনুসরণ করছিলেন?
হ্যাঁ শুরু থেকেই।
আপনি জানলেন কীভাবে যে আমরা এমন একটা বিপদের মধ্যে আছি।
আমরা আমাদের সোর্সের মাধ্যমে জেনেছি। ইচ্ছে করেই রিবিটের নাম বলল না শাহেদ।
আমি কি আপনাদের সোর্সের নাম জানতে পারি?
না পারেন না। আমরা কখনোই আমাদের সোর্সের নাম কাউকে বলি না।
ও আচ্ছা। একটু থেমে সুমন আবার বলল : তাহলে থানায় আপনারা কোনো খবর দেননি?
না দিইনি কিংবা থানার কোনো সাহায্য আমরা চাইনি। আপনি আর আপনার বাবা যে-ট্যাক্সিতে করে আমিনবাজার গিয়েছিলেন সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার বুঝতে পারে আপনি বিপদে আছেন। তাই ফিরে আসার সময় সে থানাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অবহিত করে এবং থানার অফিসাররা আপনাকে খুঁজতে শুরু করে। আপনি স্বীকার করতে পারেন ট্যাক্সিড্রাইভার আপনার অনেক বড় উপকার করেছে।
কিন্তু এতে তো আমার বিপদ বাড়বে।
না বাড়বে না। বরং আপনি যদি আজ পাঁচ লাখ টাকা ওদের দিয়ে দিতেন ওরা আবার আপনার কাছে টাকা চাইত। ওরা আপনাদের বাড়ি বিক্রি করিয়ে পথের ফকির বানিয়ে ছাড়ত।
কিন্তু এখন কি আমরা নিরাপদ? আমার তো মনে হচ্ছে সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। বলল সুমন।
আপনার সেরকম মনে হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা এ-মুহূর্তে অনুমান করা সত্যি কঠিন। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে এরকম বেনামী চাঁদাবাজরা ব্যর্থ হয়ে আর বিরক্ত করে না। আবার দেখা গেছে তারা আগের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে, অবশ্য যদি তারা শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরনের কেউ হয়।
কালোমানুষ কী ধরনের সন্ত্রাসী?
কালোমানুষ সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আপনাদের ঘটনা থেকেই আমরা কালোমানুষ সম্পর্কে প্রথম জেনেছি। আশা করছি অল্পদিনের মধ্যেই আমরা কালোমানুষ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পেয়ে যাব এবং ওদেরকে ধরতে পারব।
এই অল্পদিনে আমাদের নিরাপত্তার কী হবে? অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল সুমন।
দেখুন, ব্যক্তিনিরাপত্তার উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত হচ্ছে নিজে সতর্ক থাকা। কাজেই প্রথমেই আমি আপনাকে বলব, আপনারা নিজেরা সতর্ক থাকবেন। আর আমরা তো আছিই। যখন প্রয়োজন আমাদের সংবাদ দেবেন। আপনারা যদি সংবাদ না দেন এবং আমরা যদি জানতে না পারি তাহলে আপনাদের মতো শত শত মানুষের কাছ থেকে কালো মানুষেরা টাকা নিতে থাকবে এবং আমরা কোনোদিনও ওদেরকে ধরতে পারব না। কাজেই আপনাদের নিরাপত্তা প্রদান যেমন আমাদের দায়িত্ব তেমনি আমাদের সহায়তা প্রদান করাও আপনাদের দায়িত্ব।
কিন্তু কালোমানুষ তো বলে আপনাদের জানালে ক্ষতি আরো বেশি হবে।
ওদের কাজই হবে আপনাদেরকে ভীত করে তোলা। আপনাদেরকে ওরা যত ভীত করতে পারবে ওরা তত সহজে ওদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে। আর আমাদেরকে যদি আপনারা জানান, অন্তত ওরা ভীত থাকবে এবং আমরা ওদেরকে ধরার সুযোগ পাব।
ধন্যবাদ শাহেদ সাহেব।
আপনি কি একটা বিষয় আমাদেরকে জানাবেন?
কী বিষয়?
আপনি কি একই লোকের সাথে বারবার কথা বলেছেন নাকি ভিন্ন কোনো লোক?
আমি জানি না। তবে কণ্ঠস্বর ভিন্ন ছিল।
টেলিফোনে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করা কঠিন কিছু না। আপনি রিসিভারের উপর ভিন্ন। ঘনত্বের কাপড় বা আবরণ ব্যবহার করলেই কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হবে। তবে কথার ধরন পরিবর্তন করা কঠিন। আপনার কী মনে হয় কথার ধরন পরিবর্তন হয়েছে?
ঠিক বুঝলাম না।
প্রত্যেক মানুষের কথা বলার ধরণ ভিন্ন। এই যেমন ধরুন কারো কথায় আঞ্চলিকতার টান থাকে, কারো কথা সম্পূর্ণ শুদ্ধ, কেউ আবার বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে। আপনার কাছে কি মনে হয়েছে কালোমানুষ সবসময় একইভাবে কথা বলেছে।
আমার কাছে ভাষার কোনো ভিন্নতা ধরা পড়েনি। তবে যে বা যারা কথা বলেছে তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আছে। আর অবাক ব্যাপার হল প্রত্যেকেই কালো মানুষের কালো’ শব্দটা সবসময় শুদ্ধভাবেই বলে।
হুঁ। ঠিক আছে, আমরা আপনাদের বাসায় চলে এসেছি। আমার ফোন নম্বরটি রেখে দিন। প্রয়োজনে ফোন করুন।
সুমন শাহেদের ফোন নম্বর রেখে মাইক্রো থেকে নেমে গেল। মাইক্রো চলে যেতে সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে থাকল। দেখতে পেল এককোণায় একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কয়েকজন পুলিশ বসে আছে। আর বাইরে দুজন হেঁটে বেড়াচ্ছে। পুলিশ দেখে সুমন সত্যি প্রশান্তি অনুভব করল। এই প্রথম সে অনুভব করল, পুলিশ দেখে আগে কখনো সে এখনকার মতো এতটা প্রশান্তি অনুভব করেনি। সে বুঝতে পারছে, আজ রাতে তার খুব ভালো ঘুম হবে।
৫.
রিবিট বেরিয়ে যেতে সোবহান আহমেদ আর সুমন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল সোফায়। তারপর সুমনই প্রথম কথা বলল : বাবা, তিশা বোধহয় রিবিটকে সবকিছু লিখে পাঠিয়েছে।
হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। তা না হলে রিবিট হঠাৎ করে আমাদের বাসায় আসবে
রিবিট যে আমাদের বাসায় এসেছে এটা কালোমানুষদের কেউ জেনে গেল কিনা?
জেনে যাওয়াটা অসম্ভব কিছু নয়। আমার বিশ্বাস, আশেপাশে কেউ আমাদের উপর নজর রাখছে।
এখন তাহলে আমরা কী করব? অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল সুমন।
সেটা তো আমারও প্রশ্ন।
সুমন ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল : এখন ফোনে কী কথা হল?
ঐ আগের মতোই হুমকি দিয়েছে। যদি আজ রাতের মধ্যে দশ লাখ টাকা দিতে না পারি তাহলে ওরা তিশাকে মেরে ফেলবে।
এত টাকা কোথায় পাব আমরা?
দশ লাখ অনেক টাকা। আমার ব্যাংকে কিছু জমানো টাকা আছে। সর্বমোট লাখ। তিনেক হবে। আমি তোমাকে এই টাকাটা দিয়ে দেব। তবুও তিশার জীবন রক্ষা পাক। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন সোবহান সাহেব।
বাবা, তোমার কাছ থেকে টাকা নিতে সত্যি আমার খারাপ লাগবে। তারপরও আমাকে নিতে হবে। কিন্তু তারপর কী হবে? আমার সঞ্চয় দুই লাখ টাকা। তোমার আর আমার মিলে হবে পাঁচ লাখ টাকা। আর বাকি পাঁচ লাখ টাকা পাব কোথায়?
আমি জানি না সুমন।
আমরা কি কালোমানুষকে বোঝাতে পারি না?
ওরা তো কোনো কথাই শুনতে চায় না। নিজেরাই কথা বলে। তাও শুধু নির্দেশ। তাছাড়া আলোচনা করার সুযোগ কোথায়? আবার কখন ফোন করবে তাও জানি না। ফোন করলে ল্যান্ডফোনে করবে নাকি মোবাইলে করবে সেটাও অনিশ্চিত।
টাকা কোথায় পৌঁছে দিতে হবে সেটা কি বলেছে?
না, কিছুই বলেনি।
তাহলে?
বলেছে পরে জানাবে। আপতত টাকা জোগাড় করে রাখতে হবে।
এরপর দুজনেই চুপ হয়ে ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। কিছুক্ষণ পর সুমন আবার বলল : বাবা, আমরা যদি পুলিশকে খবর দিই তাহলে কী হবে?
আমি সাহস পাচ্ছি না। আমার বিশ্বাস পুলিশকে জানানো মাত্রই ওরা সম্পূর্ণ। ব্যাপারটা জেনে যাবে। তাতে আমাদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ আমাদের ক্ষতি করতে ওদের সময় লাগবে না। আমাদের প্রতিদিনই বাইরে যেতে হয়। আমি বাইরে যাই, তুমি অফিসে যাও, তিশা স্কুলে যায়। মানুষের ক্ষতি করার নানারকম উপায় আছে। কালোমানুষ যদি আমাদের ক্ষতি করতে চায় তাহলে তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কিন্তু তাই বলে এতগুলো টাকা আমরা এভাবে দিয়ে দেব? আমরা একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাব।
আমাদের আর কী-ই-বা করার আছে?
বাবা, আমার কী মনে হয় জানো?
কী?
তিশা বোধহয় ঠিকই করেছে। রিবিটকে খবর দিয়েছে। আমাদের অবশ্যই কারো–কারো সাহায্য গ্রহণ করা উচিত।
নির্ভর করা যায় এমন কারো সাহায্য পেলে আমিও খুশি হতাম। কিন্তু রিবিট কি তা পারবে? মনে হয় না। রিবিটকে সবাই চিনে ফেলবে। কালোমানুষ কিংবা তার সঙ্গীরা যখন দেখবে কিংবা বুঝতে পারবে রিবিট আমাদের সাথে আছে সেক্ষেত্রে উল্টো ফল হতে পারে।
যদি আমরা টাকা না দিই? হঠাৎই প্রশ্ন করল সুমন।
এরকম একটা চিন্তা আমার মাথায়ও ঘুরছে। এমনো হতে পারে যে বা যারা আমাদের কাছে টাকা চাইছে তারা হয়তো আসলেই কুখ্যাত কেউ না। হয়তো কোনো সাধারণ মাদকসেবী, যে কিনা চেষ্টা করছে আমাদের কাছ থেকে টাকাটা বাগিয়ে নিয়ে মাদক সেবন করতে। আর যদি সত্যি কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরনের কেউ হয় তাহলে টাকা না-দেয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ ওরা তখন প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে ক্ষোভটা যেয়ে পড়বে তিশার ওপর। তুমি নিশ্চয় বুঝতে পারছ ঢাকা শহরে তিশার মতো ছোট একটা মেয়ের ক্ষতি করা কঠিন কিছু নয়।
তাহলে এখন সিদ্ধান্ত কী হবে?
আপাতত আমরা টাকা জোগাড় করে রাখি।
কিন্তু দশ লাখ টাকা কোথায় পাব?
আমাদের কাছে পাঁচ লাখ টাকা আছে। এই পাঁচ লাখ টাকা নিয়েই আমরা প্রস্তুত থাকব। এতে যদি না হয় তাহলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।
আমার গহনাগুলো বিক্রি করে দিন বাবা। আমার অনেক গহনা আছে। পিছন থেকে বলল মুনা। সে এতক্ষণ তিশার সাথে ছিল।
না মা, না। এ কাজ করা যাবে না। আমার বিশ্বাস, কালোমানুষ যত খারাপই হোক না কেন, আমাদের কিছু সুবিধা-অসুবিধা বুঝবে।
কিন্তু শেষপর্যন্ত ওরা যদি রাজি না হয়? আবারো প্রশ্ন করল মুনা।
রাজি না হলে তখন দেখা যাবে। আপাতত তোমার গহনা বিক্রির চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও। এখন আমরা দুজন ব্যাংকে যাব। সেখান থেকে টাকা তুলে নিয়ে আবার ফিরে আসব। এর মধ্যে ওরা যদি ফোন করে তাহলে তুমি তেমন কিছু বলবে না। শুধু শুনে রাখবে কখন কোথায় টাকাটা দিতে হবে।
মুনা কোনো কথা বলল না। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
সোবহান সাহেব এবার সুমনের দিকে ফিরে বললেন : তুমি বাইরে যেয়ে একটা ট্যাক্সি ঠিক করো। আমরা যে ট্যাক্সিতে যাব, সেই ট্যাক্সিতে ফিরে আসব।
সুমন উঠে দাঁড়াল। এ মুহূর্তে সত্যি তার খুব খারাপ লাগছে। নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না। কারো সাহায্যও নিতে পারছে না। অফিস থেকে অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়েছে। কিন্তু এই অসুস্থতা যে কী ভয়ানক অসুস্থতা তা সে ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারছে না।
দশ মিনিটের মাথায় সোবহান সাহেব আর সুমন বেরিয়ে পড়ল। যাওয়ার আগে মুনাকে ভালোমতো দরজা আটকাতে বলতে ভুলল না। এ মুহূর্তে সবার মধ্যেই একরকম আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গাড়িতে বসে সুমনের খারাপলাগাটা আরো বাড়ল। সে বলেই ফেলল : বাবা, আমার মনে হচ্ছে তোমার ধারণাই সত্য। কেউ হয়তো সত্যি আমাদের বোকা বানাতে চাইছে।
সোবহান সাহেব সুমনের চোখের দিকে তাকাতে সুমন আবার বলল : হ্যাঁ বাবা, হয়তো সামান্য কেউ। শুধুই আমাদের ভয় দেখাচ্ছে।
আমি জানি না সুমন। আমার মনে হয় সবকিছুর জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকাই ভালো। এজন্যই এখানে আসা। মনে রেখো, খারাপ মানুষের মতিগতি খুবই খারাপ। নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করতে পারে না।
সুমন আর কোনো কথা বলল না। এখন আর তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার মনে হচ্ছে সে কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। তার চারপাশে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। আর সেই অন্ধকারে খেলা করছে হাজারো রঙ-বেরঙের আলো। প্রত্যেকটি আলোই যেন তার সামনে কুৎসিতভাবে নাচছে আর হি হি করে হাসছে।
.
৬.
তিশার মোবাইলে ম্যাসেজের উত্তর পাঠিয়েও রিবিট আর কোনো কিছু জানতে পারেনি তিশার কাছ থেকে। সে বুঝতে পেরেছে তিশা উত্তর দেয়ার মতো অবস্থায় নেই। তবে সে নিশ্চিত তিশা সুযোগ পেলেই তার সাথে কথা বলবে। আর আশার কথা হল, ইপির বিশ্লেষণ সত্য হয়েছে। সোবহান সাহেব আর তার ছেলে বাসা থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে এসেছে। ফিরে আসার সময় তাদের হাতে একটা কালো ব্রিফকেস ছিল। অথচ যাওয়ার সময় সেটা ছিল না। এই ব্রিফকেসটা কোথা থেকে এল এবং কীভাবে এলো তা বুঝতে অসুবিধা হল না রিবিটের। সে নিশ্চিত এই ব্রিফকেসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় অর্থ রয়েছে।
অনেক বিচার-বিশ্লেষণের পর রিবিট সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে পুলিশের সাহায্য নেবে। কারণ তার একার পক্ষে সম্পূর্ণ কাজটা করা সত্যি কঠিন। তার ধাতব চেহার এমনিতেই চোখে পড়ার মতো, মানুষের মধ্যে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। সহজেই প্রতিপক্ষের চোখে পড়ে যাবে। এ নিয়ে অবশ্য ইপির সাথে কিছুক্ষণ আগেও যথেষ্ট তর্কবিতর্ক হয়েছে। রিবিট দাবি করেছে তার চেহারা মানুষের মতো হলে ভালো হত। কিন্তু ইপি তাকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে তার চেহারা রোবটের মতো হওয়ায়ই সে বেশি সুবিধা পাচ্ছে। যাইহোক, শেষপর্যন্ত সে আর ইপি একটা বিষয়ে একমত হতে পেরেছে। আর তা হল সম্পূর্ণ ঘটনাটি পুলিশকে জানানো।
রিবিট পুলিশকে ঘটনাটি জানানোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবে বলে ঠিক করেছে। তাই সে সরাসরি থানাকে না-জানিয়ে ডিবির অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার শাহেদকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিল। ডিবির পক্ষে এ-ধরনের অভিযান পরিচালনা সহজতর হবে। কারণ ডিবি সাদা পোশাকে কাজ করে। তাছাড়া ডিবির তরুণ অফিসার শাহেদ তার পরিচিত। অবশ্য পুলিশের সকল অফিসারই তাকে চেনে। পুলিশের কাছ থেকে সে সবসময়ই যথেষ্ট সম্মান পেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে রিবিট ভাবে : পুলিশ তার সাথে যেরকম ব্যবহার করে, সত্যি যদি তারা সকল মানুষের সাথে একই রকম ব্যবহার করত তাহলে এদেশে পুলিশের গ্রহণযোগ্যতা অনেক অনেকগুণ বৃদ্ধি পেত। শুধু ব্যবহারের কারণেই আজ তারা সমাজিকভাবে অনেক পিছিয়ে আছে।
রিবিট প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ডিবি অফিসে যাবে। কিন্তু পরে পরিবর্তন করেছে সিদ্ধান্তটা। ডিবি অফিসে গেলে তাকে এখান থেকে কিছু সময়ের জন্যও বাইরে থাকতে হবে। এসময়ে যদি সোবহান সাহেব কিংবা সুমন টাকা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় তাহলে তাদেরকে খুঁজে পেতে সমস্যা হয়ে যাবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানেই অবস্থান করার।
বিকাল চারটার সময় রিবিট ফোন করল এসি শাহেদকে।
শাহেদ ফোন ধরেই বলল : রিবিট তুমি! আমি সত্যি অবাক হয়েছি!
শাহেদ তোমার সাহায্যের প্রয়োজন। কোনোরকম সময় ক্ষেপণ ছাড়াই বলল রিবিট।
বলো রিবিট বলো। আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
ফোনে সবকিছু বলা সম্ভব নয়।
তাহলে আমার অফিসে চলে এসো অথবা বলো আমি কোথায় আসব।
পারলে আমি তোমার অফিসে আসতাম। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার পক্ষে এখান থেকে নড়া সম্ভব নয়। তুমি যদি ধানমণ্ডিতে চলে আসতে পারে সবচেয়ে ভালো হয়।
আমি এক্ষুনি আসছি।
তোমাকে খুব গোপনে আসতে হবে যেন কেউ টের না পায়।
তোমার কথায় বেশ রহস্য আছে মনে হচ্ছে। আমি রহস্য খুব পছন্দ করি। এজন্যই ডিবিতে চাকরি করি। তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো কাক-পক্ষীও টের পাবে না আমি তোমার ওখানে যাচ্ছি।
তাই যেন হয়।
খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তুমি আমাকে তোমার সামনে দেখতে পাবে রিবিট।
শাহেদের কথাই সত্য প্রমাণিত হল। বিশ মিনিটের মাথায় শাহেদ একা এসে উপস্থিত হল রিবিটের অবস্থানে। রিবিট শাহেদকে সবকিছু খুলে বলতে শাহেদ বলল : তুমি আমাকে সংবাদ দিয়ে ঠিকই করেছ রিবিট। এ-ধরনের সমস্যা তোমার একার পক্ষে সমাধান করা সত্যি কঠিন। তাছাড়া আইনগত ব্যাপারও রয়েছে। তুমি অনেক কিছুই করতে পারবে না যা আমরা করতে পারব। যাইহোক এখন আমাদেরকে পরবর্তী পরিকল্পনা নির্ধারণ করতে হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ।
তোমার কি কোনো পরিকল্পনা আছে?
আমি নিজে গ্রহণযোগ্য কোনো পরিকল্পনা বের করতে পারছি না। মনে হচ্ছে। এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। যখন সোবহান সাহেব কিংবা তার ছেলে বাইরে বের হবে তখন আমি তাকে অনুসরণ করব। কিন্তু পরিকল্পনাটকে ঠিক গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।
কেন গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না? প্রশ্ন করল শাহেদ।
কারণ আমাকে দেখলে সহজেই চিনে ফেলবে। দ্বিতীয়ত এ মুহূর্তে আমার কোনো গাড়ি নেই। আর তৃতীয়ত আমি জানি না টাকাটা কোথায় হস্তান্তর হবে।
তুমি ঠিকই বলেছ রিবিট। আর এজন্য আমাদের প্রয়োজন তথ্য সংগ্রহ করা।
কিন্তু তিশাদের বাসায় কেউই তো আমাদের সাহায্য কামনা করছে না।
আমরা এক কাজ করতে পারি।
কী কাজ?
আমরা তিশাদের বাসার ফোনের কথা রেকর্ড করতে পারি।
কিন্তু সেজন্য তো আমাদের ফোন নম্বর বা মোবাইল নম্বর জানা থাকতে হবে। আমাদের তো ফোন নম্বরই জানা নেই।
ল্যান্ডফোন নম্বর বের করা কঠিন কিছু হবে না। টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে জানা যাবে। আর কথোপকথন রেকর্ড করাও অসম্ভব কিছু নয়। বাইরে যে এক্সচেঞ্জ আছে সেখান থেকে রেকর্ড করা যাবে। তবে এগুলো অহেতুক জটিলতার সৃষ্টি করবে। আর কালোমানুষ যদি মোবাইলে যোগাযোগ করে থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হবে।
তিশার দাদু কিংবা বাৰা সাহায্য করলে ভালো হত। আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে যেত। বলল রিবিট।
কিন্তু তোমার ভাষ্য অনুযায়ী তারা আমাদের সাহায্য করবে না। এখন যদি আমরা জোরাজুরি করি তাহলে অনেকগুলো সমস্যা হবে। প্রথমত, তারা আমাদের বলতে চাইবে না এবং অতিরিক্ত ভয় পাবে। আর কালো মানুষেরা যদি জেনে যায় তাহলে অধিকতর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের মনে রাখতে হবে কালোমানুষ কিংবা তার দলবলকে ধরাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। আমরা যদি শুধু তিশাদের রক্ষা করতে পারি তাহলে কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। কারণ কালোমানুষ তিশাদের মতো আরো অনেক পরিবারকে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করবে। কাজেই আমাদের মূল উদ্দেশ্য হবে কালোমানুষ আর তার দলবলকে ধরা।
তুমি এখন কী করতে চাইছ? প্রশ্ন করল রিবিট।
আমি এখনই ডিবি হেডকোয়ার্টার্সে জানিয়ে দিচ্ছি। তিশাদের বাসার ল্যান্ডফোনের কথোপকথন রেকর্ড করার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আর তোমার লোকজন? তারা কি আসবে না।
তারা চলে আসবে। সেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।
নির্মাণাধীন পুরাতন ভবনটিতে অপেক্ষা করতে লাগল দুজন। সন্ধ্যা নাগাদ টিঅ্যান্ডটির লোকজন তিশাদের বাড়ির ফোনে আড়িপাতা সম্পন্ন করল। মোবাইল কোম্পানির সহায়তায় তিশার মোবাইলটিতেও আড়ি পাতা হল। তিশা তার মোবাইল থেকে রিবিটকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল। এজন্য তিশার নম্বরটি আগে থেকেই রিবিটের কাছে ছিল। কিন্তু অন্য কারো মোবাইল নম্বর সগ্রহ করতে পারল না তারা। আশেপাশে ডিবির অন্য কোনো লোকজনকে না-দেখে রিবিট কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠলেও শাহেদকে কিছু বলল না।
সন্ধ্যার পর রাস্তায় লোকজন কিছুটা কমে এল। তবে আশেপাশের বাড়ি থেকে লোজন ঠিকই বেরুচ্ছে ঢুকছে। পাশে দুটো বাড়ির পর একটা সুন্দর বাড়িতে একটা সাদা মাইক্রো ঢুকতে দেখল রিবিট। আবার দুজন লোককে ঐ বাড়ির ভিতর থেকে বেরিয়ে যেতেও দেখল। এদিকে সিটি কর্পোরেশনের একটা ময়লার গাড়ি এসে তিশাদের বাড়ির কোণা থেকে গাড়িতে ময়লা তুলতে শুরু করল। লোকগুলোর কাজ এতটাই ধীর যে রিবিট নিশ্চিত সারারাত কাজ করেও এরা ডাস্টবিনের ময়লাগুলো তুলতে পারবে না। এদিকে আরো খানিক পর এক ঝাড়দার এসে রাস্তা ঝাড় দিতে শুরু করল। এই লোকটা আগের লোকগুলোর থেকে আরো ধীর। রিবিটের ইচ্ছে হল সে নিজে যেয়ে সবাইকে বলে সবাই যেন খানিকটা দ্রুত কাজ করে। কিন্তু সে নড়ল না। তবে তার দৃষ্টি কাড়ল একপাশে এক পিঠাওয়ালা। কিছুক্ষণ হল সে এখানে এসেছে। ভাজা পিঠা বিক্রি করছে। দু-চারজন ভালোই ক্রেতা পাচ্ছে সে।
রিবিটের অবশ্য মূল মনোযোগ তিশাদের বাড়ির দিকে। সে একটু পর পর তাকাচ্ছে আর আশা করছে এই বুঝি বেরিয়ে আসে তিশার দাদা কিংবা বাবা। কিন্তু। সেরকম কিছুই ঘটছে না। তারপরও সে অপেক্ষা করে আছে। সে নিশ্চিত তারা দুজন একসময়-না-একসময় বের হবেই।
.
৭.
দুপুরের পর থেকে তিশাদের বাসার সবাই আশা করছে কালো মানুষের ফোন আবার আসবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হলেও কালো মানুষের কোনো ফোন এলো না। সন্ধ্যার পর থেকে কেন যেন সুমনের মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কারো দুষ্টুমি হতে পারে। তা না হলে অবশ্যই এতক্ষণ ফোন করে জানতে চাইত কোথায় টাকা দিতে হবে। কিন্তু সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তার ধারণা ছিল বাড়ির বাইরে থেকেও হয়তো কালোমানুষদের কেউ তাদের উপর লক্ষ্য রাখছে। কিন্তু সে-সম্ভাবনাও নেই মনে হচ্ছে। কারণ বাইরে সিটি কর্পোরেশনের কিছু লোক কাজ করছে। এ ছাড়া যারা আছে তার সবাই সাধারণ পথচারী। আর একজন পিঠাবিক্রেতাও আছে। তবে এটা নতুন কিছু নয়। এ এলাকায় অনেকেই এভাবে পিঠা বিক্রি করে। এ ছাড়া অন্য কাউকে তার চোখে পড়েনি যাকে দেখে সন্দেহ হতে পারে সে কালো মানুষের দলের সদস্য।
সন্ধ্যার পর সামনের বারান্দা থেকে সুমন যখন ভিতরে সোফায় এসে বসল তখন সে প্রায় নিশ্চিত ফোনটি ছিল শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির খামখেয়ালিপনা। কিন্তু তার অনুমান সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হল যখন তার মোবাইলটি বেজে উঠল।
মোবাইল বেজে ওঠার সাথে সাথে সোবহান সাহেব, সুমন, মুনা হুমড়ি খেয়ে পড়ল মোবাইলের উপর। স্ক্রিনে ‘আনোন’ বা ‘অপরিচিত নম্বর’ লেখা দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ল তারা। সুমন তার বাবার দিকে জিজ্ঞাসু-চোখে তাকাতে সোবহান সাহেব উপরে নিচে মাথা দুলিয়ে ফোন ধরার জন্য সম্মতি দিলেন। সুমন ফোন ধরে হ্যালো বললেও ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না।
সুমন আবার বলল, হ্যালো।
কোনো উত্তর নেই।
সুমন এবার একটু জোর দিয়ে বলল, হ্যালো।
এবার ওপাশ থেকে একটা গল্পীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমার কথা শুনবার পাইতেছেন সুমন সাহেব।
হ্যাঁ হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। কাঁপা গলা সুমনের।
আমারে চিনবার পারছেন?
জি..জি.. না। সুমনের গলাটা আরো কেঁপে উঠল।
আমি কালোমানুষ।
কালোমানুষ!!
হঁ, কালোমানুষ। আপনে কি টাকা জোগাড় করছেন?
জি চেষ্টা করেছি। কিন্তু..
আবার কিন্তু কিসের?
দশ লাখ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। এত টাকা আমাদের নেই। পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করতে পেরেছি।
পাঁচ লাখ টাকা! কী বলেন আপনে?
জি, আমাদের কাছে আর টাকা নেই।
পাঁচ লাখ টাকা দিয়া আপনে আপনের মেয়ের জীবন রক্ষা করবার পারবেন না। মনে রাখবেন আমরা খুব ভয়ংকর। আমরা মানুষের জীবন নিয়া খেলা করি। আপনি নিশ্চয় চাইবেন না আর মাত্র পাঁচ লাখ টাকার জন্য আপনের মেয়ে চিরতরে হারায় যাক।
না না চাই না। কিন্তু আমাদের তো করার কিছু নেই। গলা শুকিয়ে এসেছে সুমনের।
আছে, মেলা কিছু করার আছে। টাকা ধার করেন।
এত টাকা আমাদের কেউ ধার দেবে না।
অবশ্যই দিবে। বাড়ি বিক্রি কইরা দেন, নয় বন্ধক রাহেন।
কী বলছেন আপনি! বাড়ি বিক্রি করে দেব! চোখ কপালে তুলে বলল সুমন।
তাইলে আপনের মেয়ের জীবন উৎসর্গ করেন। হো হো.. হো…। কুৎসিতভাবে হেসে উঠল কালোমানুষ।
হাসিটা মোটেই ভালো লাগল না সুমনের। সে তোতলাতে তোতলাতে বলল : না না, আমরা তিশাকে হারাতে চাই না।
তাইলে যা বললাম তাই করেন। দশ লাখ টাকা জোগাড় করেন।
আমাদের তাহলে এক সপ্তাহ সময় দিন। এত টাকা জোগাড় করতে সময়ের প্রয়োজন।
আর সময় দেওয়া যাবে না। আপাতত যা হাতে আছে তাই আমাগো দিয়া দ্যান। পরের তিন দিন পর।
জি জি। সায় দিয়ে বলল সুমন।
আজ রাইত সাড়ে দশটায় গাবতলীর আমিনবাজারে থাকবেন। টাকাগুলা একটা কালো রঙের ব্রিফকেসে আনবেন।
আমিনবাজারে কোথায়?
মোবাইল খোলা রাখবেন। সময়মতো সবকিছু জানবার পারবেন। কোনোরকম চালাকি করবার চেষ্টা করবেন না।
না না, করব না।
পুলিশকে জানাবেন না। মনে রাখবেন, পুলিশ যদি কিছু জানবার পারে তাইলে আপনের সারাজীবন পস্তান লাগব।
পুলিশ কিছু জানবে না। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি।
চমৎকার। আর হঁ, আসার সময় আপনের স্ত্রীর গহনাগুলোও নিয়া আসবেন।
জি নিয়ে আসব।
ঠিক আছে। রাইতে দেখা হবে।
আমার একটা কথা..
আর কোনো কথা নয়। শুধু এটুকু মনে রাখবেন, কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবেন না। পরিণতি তাহলে খুবই ভয়ংকর হবে। মনে রাখবেন আমরা খেলোয়াড় মানুষ। মানুষের জীবন নিয়ে খেলতেই আমি বেশি পছন্দ করি। আর সেটা যদি কোনো শিশুর জীবন হয় তাহলে আনন্দটা আরো বেশি।
এরপর লাইনটা কেটে গেল।
এটুকু কথাতেই কপাল ঘেমে উঠেছে সুমনের। সে শূন্যদৃষ্টিতে তার বাবার দিকে তাকাতে সোবহান সাহেব বললেন : তুমি ঘাবড়ে যেও না। একটা-না-একটা সমাধান বের হবেই। তারপর মুনার দিকে তাকিয়ে বললেন : তিশা কোথায়?
ওর ঘরে, টিভি দেখছে।
ওর কাছে মোবাইল নেই তো? শেষে দেখা যাবে কালোমানুষ ওকে ফোন করে হুমকি দিয়েছে।
না বাবা, নেই। আমি অনেক আগেই মোবাইল সরিয়ে ফেলেছি। তবে..
তবে কী?
রিবিট ওকে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছিল। সম্ভবত তিশা আগেই রিবিটকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
না না, আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। তিশা যেন আর রিবিটের সাথে যোগাযযাগ করতে না পারে। রিবিটকে জানানো আর পুলিশকে জানানো একই কথা। শেষে দেখা যাবে উল্টো ফল হবে।
ঠিক আছে বাবা।
আর এখন থেকেই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাতে আমরা কী করব।
কী করব মানে? ভ্রূ কুঁচকে প্রশ্ন করল সুমন।
মানে আর কিছুই নয়। আমাদের পরিকল্পনা কী হবে। সত্যি আমরা টাকাগুলো কালোমানুষকে দিয়ে দেব কিনা। আর দিয়ে দিলেও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। ওকে আবারও টাকা দিতে হবে। আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়বার দেয়ার পর তৃতীয়বারও দিতে হবে এবং এভাবে চলতে থাকবে। আর যদি না দিই….
না না বাবা, আমি আমার মেয়ের উপর কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। আমার বিশ্বাস পাঁচ লাখ টাকা পাওয়ার পর কালোমানুষ আর আমাদের সাথে যোগাযোগ করবে না। প্রয়োজনে আমি আমার গহনাগুলো দিয়ে দেব। বলল মুনা।
তুমি ব্যাপারটাকে যত সহজ ভাবছ বৌমা, আসলে তত সহজ নয়। এদের চরিত্র খুব খারাপ। যেখানেই এরা সুযোগ পায় সেখানেই হাত বাড়ায়। এদের হাতদুটো কেটে না ফেলা পর্যন্ত এরা হাত বাড়ানো বন্ধ করে না।
হাত বাড়াচ্ছে বাক, তারপরও আমি কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। আবারো বলল মুনা।
ঠিক আছে। টাকা যদি দিতেই হয় কীভাবে দেবে?
আমি নিয়ে যাব। বলল সুমন।
তোমার একা যাওয়া ঠিক হবে না। আমিও যাব তোমার সাথে। দুজনে থাকলে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।
কিন্তু যাব কীভাবে?
আমরা এখান থেকে কোনো ট্যাক্সি নিয়ে বের হয়ে যাব। সরাসরি আমিনবাজারে যেয়ে নামব। সেখানে পৌঁছালে কালোমানুষ হয়তো বলে দেবে কী করতে হবে।
ঠিক আছে বাবা। মলিন স্বরে বলল সুমন।
তারপর সে উঠে এল সোফা থেকে। এগিয়ে গেল সামনের বারান্দায়। এখনো বাইরে সিটি কর্পোরেশনের মানুষগুলো কাজ করছে। তার মনে হল মানুষগুলো খুব ধীরগতিতে কাজ করছে। অবশ্য সে জানে সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা সমসময়ই ধীর। তবে আজকের লোকগুলো বেশি ধীর। কোথায় যেন সমীকরণে মিলছে না, ঠিক যেমন মিলছে না তাদের সুখের জীবনে কালো মানুষের উপস্থিতির ঘটনা।
.
৮.
রাত সাড়ে নটার সময় বাসা থেকে বের হল সোবহান সাহেব এবং সুমন। সাথে একটা কালো ব্রিফকেস। সেখানে পাঁচ লাখ টাকা আর মুনার সোনার গহনা। কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না তারা। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যদি সম্ভব হয় সামনাসামনি হলে কালোমানুষকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবে।
ট্যাক্সিক্যাবে ওঠার পর একেবারেই চুপ হয়ে গেল দুজন। দুজনের মধ্যেই একধরনের আতঙ্ক কাজ করছে। তাদের কেউই বুঝতে পারছে না আদৌ তারা সমাধানের দিকে এগোচ্ছে নাকি জটিলতা আরো বাড়াচ্ছে। উপরন্তু পঁচ লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার যন্ত্রণা তো আছেই।
সোবহান সাহেব কিংবা সুমন কেউই লক্ষ্য করল না যাত্রা শুরুর পর থেকে তাদেরকে অনুসরণ করছে একটি মাইক্রোবাস। মাইক্রোবাসের প্রশিক্ষিত ড্রাইভার এমনভাবে গাড়ি চালাচ্ছে যে সামনের গাড়ির ড্রাইভার বুঝতেই পারছে না তাকে অনুসরণ করছে কেউ। এই মাইক্রোবাসে আছে রিবিট, শাহেদসহ আরো কয়েকজন।
মাইক্রো ধানমণ্ডি থেকে বের হয়ে গাবতলীর পথ ধরলে রিবিটই প্রথম কথা বলল : শাহেদ, তুমি তো আমাকে একেবারে বোকা বানিয়ে ফেলেছিলে।
কেন?
আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি তোমার লোক আশেপাশে এভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
আমরা এভাবেই থাকি।
তাই বলে একেবারে পরিচ্ছন্ন-কর্মী, পিঠা-বিক্রেতা, ঝাড়দারের বেশ ধরে।
এতে অনেক সুবিধা আছে। কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।
আমি অবশ্য তোমাদের কাজের গতি দেখে সন্দেহ করেছিলাম।
তা করেছিলে। কিন্তু আমরা যদি দ্রুত কাজ করতাম তাহলে আরো সন্দেহ করতে। কারণ আমাদের কাজ আগেই শেষ হয়ে যেত এবং আমরা সেখানে অতিরিক্ত সময় অবস্থানের জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি খুঁজে পেতাম না। এজন্য আমাদেরকে ধীর গতিতে অত্যন্ত কৌশলে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু হতাশার ব্যাপার হল, আমাদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ভেবেছিলাম আশেপাশে হয়তো কালো মানুষের দলের কেউ থাকবে। কিন্তু আসলে কেউই ছিল না।
কিন্তু এতে হতাশ হওয়ার তো কিছু নেই। তোমাদের কাজের ধরনটাই এরকম।
তা তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-গুণটার প্রয়োজন হয় তা হলো ধৈর্য।
যাইহোক, এখন তোমার কী মনে হচ্ছে?
একটু সময় নিয়ে শাহেদ বলল, ঠিক বুঝতে পারছি না। কালোমানুষ যে কীভাবে তিশাদের বাড়ির সবার সাথে যোগাযোগ করছে তাও বের করতে পারছি না। ল্যান্ডফোনে কথা বলেনি আমি নিশ্চিত। মোবাইলের ব্যাপারটাও নিশ্চিত নয়। যদিও তিশার বাবার অফিস থেকে আমরা সুমন সাহেবের নম্বর জোগাড় করেছি, সেটাও
কোনো কাজে আসেনি। সুমন সাহেবের মোবাইলে কালো মানুষের কেউই কথা। বলেনি।
এমনো হতে পারে সুমন সাহেবের মোবাইল নম্বর জোগাড় করে তা মোবাইল কোম্পানির সাহায্যে আড়ি পাতার আগেই কালো মানুষেরা সুমন সাহেবের সাথে কথা বলেছে। কারণ সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা আমরা মাত্র কিছুক্ষণ আগে শেষ করেছি। তাছাড়া এমনো হতে পারে কালোমানুষ বাসার অন্য কারো মোবাইলে কথা বলেছে যেটা আমরা জোগাড় করতে পারিনি। তবে এখন কেন যেন আমার মনে হচ্ছে আমাদের উচিত ছিল বাসার কারো সাথে কথা বলা। অন্তত আমরা তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হতাম যে আমরা তাদেরকে সাহায্য করতে চাই।
কিন্তু তিশাদের বাড়ির কারো আচরণে সেটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়নি।
হতে পারে তোমার কথাই সঠিক। আমাদের এই গোয়েন্দাগিরির কাছে আসলে কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক অনেক সময় আগে থেকে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। যাইহোক, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আমরা সঠিক পথেই এগোচ্ছি। আশা করছি আমরা সফল হব।
এদিকে ট্যাক্সিক্যাব গাবতলী আসতে ফোন এল সোবহান সাহেবের মোবাইলে। আগের মতোই স্ক্রিনে কোনো নম্বর ভেসে উঠল না। সোবহান সাহেব বুঝতে পারলেন ফোনটি কোথা থেকে এসেছে। তিনি একবার সুমনের দিকে তাকিয়ে ফোন ধরে বললেন : হ্যালো।
ওপাশ থেকে গম্ভীর একটা কণ্ঠ ভেসে এল : ফোনডা আপনের ছেলেরে দ্যান।
সোবহান সাহেব কাঁপা হাতে ফোনটি সুমনের দিকে বাড়িয়ে দিলেন।
সুমন ফোন কানে লাগিয়ে ‘হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠস্বর বলল : সুমন সাহেব, আপনে যদি বিপদ এড়াবার চান তাইলে আপনে একা আমিনবাজারে আসবেন, আপনের সাথে যেন আর কেউ না আসে।
জি..জি। তোতলাতে তোতলাতে বলল সুমন।
আমি কী কইছি বুঝবার পারছেন?
জি, বুঝতে পেরেছি।
আপনের সাথে আপনের বাবা ছাড়া কি আর কেউ আছে?
না নেই।
সত্য করে বলুন।
হ্যাঁ সত্য বলছি। আমার সাথে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই।
মনে রাখবেন, কথার এদিক-ওদিক হইলে আপনের ভয়ানক পরিণতি বরণ করা লাগব। যাইহোক, আপনে গাবতলী থ্যাইকা একলাই আমিনবাজার আসবেন। আপনের সাথে যেন আর কেউ না থাহে।
ঠিক আছে থাকবে না।
আমিনবাজারে পৌঁছানোর পর আমি আপনেরে পরবর্তী নির্দেশ দিব। আর ই, আপনের বাবার মোবাইলডা সাথে রাখবেন। আপনারড়াও রাখবেন।
জি রাখব। তবে..
সুমন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই ওপাশ থেকে লাইন কেটে দিল ভরাট কণ্ঠস্বরের কালোমানুষ।
সুমন সোবহান সাহেবকে সবকিছু খুলে বলতে সোবহান সাহেব গাবতলীতে গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। গাড়ি থেকে নামার সময় সোবহান সাহেবের মুখটা একেবারে চুপসে গেল। তার মধ্যে এখন অতিরিক্ত একটা চিন্তা যোগ হয়েছে। আর তা হল তার সন্তানের সুস্থভাবে ফিরে আসা। কালো মানুষেরা এত খারাপ যে তারা সুমনের ক্ষতি করে কিনা এ-চিন্তায় সে অস্থির হয়ে উঠল।
এদিকে সুমন ঘামতে শুরু করেছে। তার খুব ভয়ও করছে। এই প্রথম তার নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। অবশ্য সে সত্যি নিঃসঙ্গ। তাকে সাহায্য করার মতো কেউ নেই। কালো মানুষেরা যে একা আসবে না এ-বিষয়ে সে নিশ্চিত। কারণ সে যখন কালোমানুষদের সাথে কথা বলেছে প্রত্যেকবারই ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছে। সে নিশ্চিত কালোমানুষদের একটা দল আছে এবং এই দলের সবাই আসবে। নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যে তারা করতে পারে না। এমনকি ইচ্ছে করলে তাকে খুন পর্যন্ত করতে পারে। খুনের কথা মনে হতেই শিউরে উঠল সুমন।
ড্রাইভারের কথায় বাস্তবে ফিরে এল সুমন। ভাইজান, আপনে আমিনবাজারের কোন্হানে নামবেন?
সুমন দ্বিধায় পড়ল। সে আমিনবাজারের উপর দিয়ে অনেকবার যাওয়া-আসা করেছে ঠিকই কিন্তু কখনো এখানে নামেনি। জায়গাটা তার সম্পূর্ণই অপরিচিত।
সুমন কিছু বলছে না দেখে ড্রাইভার আবার বলল : ভাইজান, কোনহানে নামবেন কইলেন না তো?
এই তো আর একটু সামনে। আপনে এগোতে থাকুন।
ড্রাইভারকে মনে হল সে সুমনের কথায় সন্তুষ্ট হয়নি। তাই খানিকটা সামনে যেয়ে সে আবার বলল : ভাইজান, আপনে কি এইহানে নামবেন?
সুমন দ্বিধায় পড়ল। এতগুলো টাকা নিয়ে নামাও মুশকিল। যদি ছিনতাই হয়। হতেও পারে। সে জানে আমিনবাজার জায়গাটা ভালো না। এখানে অনেক সন্ত্রাসী চাঁদাবাজরা থাকে। ড্রাইভারের প্রশ্নে সে শুধু বলল : না, আরো সামনে।
ভাইজান আপনে কি কোনোকিছু নিয়া চিন্তায় আছেন? প্রশ্ন করল ড্রাইভার।
না না। আমার কোনো চিন্তা নাই। তড়িঘড়ি করে উত্তর দিল সুমন।
কিন্তু আমার মনে হইতেছে আপনি কিছু নিয়া খুব টেনশন করতেছেন।
ড্রাইভার কেন এই প্রশ্ন করছে তা বুঝতে সুমনের অসুবিধা হল না। তার আচরণ ড্রাইভারের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। সে শুধু বলল : না আমি টেনশনে ভুগছি না।
কিন্তু আপনি ঘামতেছেন। আবারো বলল ড্রাইভার।
এবার কিছুটা বিরক্তিই হল সুমন। সে বুঝতে পারছে ড্রাইভারের প্রশ্ন তার উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে।
সুমন কিছু না-বলায় ড্রাইভার আবার বলল : ভাইজান, আপনে কে এই এলাকায় আইছেন আমি জানি না। তয় এই জায়গাড়া ভালো না। আপনের ব্রিফকেসে যদি টাকা থাহে তাইলে সাবধানে থাকবেন।
সুমন বিস্ময়ে একেবারে থ বনে গেল। আমতা-আমতা করে শুধু বলল : জায়গাটা সত্যি খারাপ?
হুঁ ভাইজান। যা কইছি তাই সত্য। আমার মনে হয় আপনের কারো সাহায্যের প্রয়োজন।
না না, আমার কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই।
তাইলে ভাইজান এইহানে নাইমা পড়েন। আমিনবাজার ছাইড়া আইছি।
ও আচ্ছা।
ড্রাইভার ভাড়া নেয়ার সময় সুমনের সাথে চোখাচোখি হল। ব্রিফকেসটার দিকেও তাকাল একবার। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না সুমনের। যাওয়ার সময় ড্রাইভার শুধু বলল : ভাইজান এইহানে বেশিক্ষণ থাকবেন না, জায়গাড়া ভালো না।
ড্রাইভার খুব দ্রুত গাড়িটা নিয়ে চলে গেল। ড্রাইভার চলে যেতে ভয় আর আতঙ্ক চারদিক থেকে গ্রাস করল সুমনকে। সে কী করবে ঠিক ভেবে পাচ্ছে না। এখানে রাস্তার দুপাশে মাল বোঝাই অনেক ট্রাক। লোকজনের চলাচল আছে। অধিকাংশই ট্রাকের হেলপার আর ড্রাইভার। তার দিকে দু-একজন তাকাচ্ছেও। আর এজন্য অস্বস্তিটাও বেড়েছে।
সুমন বুঝতে পারল এখানে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে লোকজন সন্দেহ করবে। তাই সে সাভারের দিকে হাঁটতে শুরু করল। কী ঘটবে ভাবতে চেষ্টা করল সে। হয়তো কোনো গাড়ি কিংবা হোন্ডা এসে ছোঁ মেরে তার হাত থেকে ব্রিফকেসটা নিয়ে নেবে। অথবা হঠাৎই কেউ ট্র্যাকের পিছন থেকে বেরিয়ে এসে তাকে ছুরি মেরে বা গুলি করে ব্রিফকেসটা ছিনিয়ে নেবে। নতুবা চার-পাঁচজন এসে তাকে মারধোর করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে নিয়ে নেবে ব্রিফকেসটা।
সুমনের কাছে থাকা সোবহান সাহেবের ফোনটা হঠাৎই বেজে উঠল। সাথে সাথে চমকে উঠল সুমন। সে বুঝতে পারল অল্পতেই ভয় পাচ্ছে সে। নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করতে জোরে শ্বাস নিল। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হল না। ভয়টা আগের মতোই জেঁকে ধরে থাকল তাকে।
সুমন ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতে ওপাশ থেকে ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল : সুমন সাহেব, আপনি কোনহানে?
আমি এখন আমিনবাজার পার হয়ে সাভারের দিকে হাঁটছি।
চমৎকার। আপনে হাঁটতে থাকেন। কখনো থামবেন না।
হ্যাঁ আমি হাঁটছি।
যেভাবে কইছিলাম সব ব্যবস্থা করছেন তো?
হ্যাঁ করেছি। পাঁচ লাখ টাকা এনেছি, সাথে আমার স্ত্রীর গহনা।
সবকিছু কালো ব্রিফকেসে আছে?
হ্যাঁ আছে।
আপনের সাথে কেউ নাই তো?
না নেই।
আপনের বাবা?
বা নেই, তাকে আপনার কথামতো গাবতলী নামিয়ে দিয়েছি। চমৎকার। আপনি হাঁটতে থাকুন। একেবারে সাভারের দিকে হাঁটবেন। কখনো ডাইনে বামে কিংবা পিছনে তাকাবেন না। আপনের পাশে কালো রঙের একটা গাড়ি থামলে শুধু তহনই থামবেন। কোনোরকম কথা ছাড়া ব্রিফকেসটা গাড়ির ভিতরে বসা মানুষের হাতে দিয়া দিবেন। আপনে কি আমার কথা বুঝবার পারছেন?
হ্যাঁ পেরেছি।
কথার কোনোরকম বরখেলাপ করবেন না।
করব না।
আপাতত আপনের সাথে আমার আর কথা হবে না। পরে সময়-সুযোগমতো আমি আমার বাকি পাওনাটা বুইঝা নিব।
জি আচ্ছা।
আর কোনো কথা হল না। ওপাশ থেকে লাইনটা কেটে দিল কালোমানুষ।
সুমন উপলব্ধি করল কালো মানুষের কণ্ঠস্বর এবারো ভিন্ন ছিল। উপরন্তু মনে হচ্ছিল এবার বুঝি কণ্ঠস্বরটা অনেকদূর থেকে ভেসে আসছিল। তার সাথে যে কথা বলেছে সে-যে আগের জন থেকে ভিন্ন এ-বিষয়ে তার কোনো সন্দেহ নেই।
সুমন হেঁটে চলছে। তার পাশ দিয়ে শাঁই শাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে দূরপাল্লার বড় বড় বাস আর ট্রাক। সুমন এতটাই ভীত যে একবার ডানে-বামেও তাকাচ্ছে না। মূল রাস্তার পাশে যে ঘাস তার উপর দিয়ে হাঁটছে সে। এখানে রাস্তায় লোকজন একেবারেই নেই। দুইপাশে শূন্য বিল। রাত গম্ভীর হতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডাও পড়েছে। ঠাণ্ডায় ভয়টা যেন আরো জেঁকে বসতে শুরু করেছে।
প্রায় পনেরো মিনিট একটানা হাঁটার পর কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠল সুমন। তাই সে প্রথমবারের মতো পিছনে ফিরে তাকাল। আর তখনই দেখতে পেল কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার এগিয়ে আসছে। তার কেন যেন মনে হল এই গাড়িটাই সেই গাড়ি। কিন্তু পরক্ষণেই চমকে উঠল সে। কালো গাড়িটার পিছনেই একটি পুলিশের পিক-আপ।
সুমন ভেবে পেল না পুলিশ কীভাবে খবর পেল। তাই আরো আতঙ্কিত হয়ে উঠল সে। সাংঘাতিক কিছু যে ঘটতে যাচ্ছে এ-বিষয়ে নিশ্চিত সে। কারণ গতি আরো বাড়ছে কালো গাড়ির। তবে পুলিশের গাড়িটি আগের গতিতেই চলছে। সে অবশ্য স্থির দাঁড়িয়ে আছে। রাতের ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামতে শুরু করেছে সে।
সুমনকে অবাক করে দিয়ে কালো প্রাইভেট কারটি তার সামনে দিয়ে শাঁই করে বেরিয়ে গেল। আর পুলিশের গাড়িটি এসে থামল তার সামনে। গাড়ির মধ্যে দেখে লম্বা মতো একজন পুলিশ অফিসার নেমে এসে সরাসরি তার সামনে দাঁড়াল। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল : এত রাতে এখানে কী করছেন?
না..মানে… ইয়ে,,। সুমন আমতা-আমতা করতে লাগল। কোথা থেকে কী ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে।
আপনার ব্রিফকেসে কী? আবার প্রশ্ন করল পুলিশ অফিসার।
না.. মানে.. ইয়ে.. কিছু না।
নিশ্চয় কোনো মাদক অথবা অবৈধ কিছু? পাচারের চেষ্টা করছিলেন।
না। তেমন কিছু না।
তাহলে কি কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য?
বিস্ফোরক দ্রব্য থাকবে কেন?
তাহলে এত রাতে এখানে একা একা এই ব্রিফকেস হাতে কী করছেন?
আ.. আ..মি আসলে..।
হুঁ বুঝতে পেরেছি। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে সত্য কথাই বলেছে। আপনার আচরণ সন্দেহজনক। আপনার ব্রিফকেস, মোবাইল আটক করা হল। আপনাকেও থানায় যেতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না আপনি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনাকে আমাদের হেফাজতে থাকতে হবে।
সুমন একেবারে অসহায় হয়ে পড়ল। তার ব্রিফকেস, মোবাইল নিয়ে নেয়া হয়েছে। তাকেও গাড়িতে উঠতে বলা হয়েছে।
সুমন যখন গাড়িতে উঠল তখন নিঃশব্দে একটা মাইক্রো এসে গাড়ির পিছনে থামল। মাইক্রোর ভিতরে কারা বসে আছে সুমন বুঝতে পারল না। কারণ ভিতরের লাইট বন্ধ থাকায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সে যখন মাইক্রোর উপর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে পুলিশের পিক-আপ।
সুমন ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে সঁপে দিল ভাগ্যের হাতে। সে বুঝতে পারছে মাঝে মাঝে মানুষ ভাগ্যের কাছে সত্যি অসহায় হয়ে পড়ে।
.
৯.
থানায় এসে সবকিছু খুলে বলতে বাধ্য হল সুমন। থানার অফিসারদের সম্পূর্ণ ব্যাপারটা বিশ্বাস করাতে কষ্ট হত যদি-না ডিবির এসি শাহেদ সেখানে উপস্থিত থাকত। থানার ডিউটি অফিসার তারপরও অনেক কিছু জানতে চায় সুমনের কাছ থেকে। সবকিছু বিস্তারিত জানার পর একটা জিডি করে অবশেষে সুমনকে ছেড়ে দেয় তারা।
মাইক্রোবাসে করে শাহেদ যখন সুমনকে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে তখন প্রথম প্রশ্ন করল সুমন : শাহেদ সাহেব, আপনি কি শুরু থেকেই আমাদের অনুসরণ করছিলেন?
হ্যাঁ শুরু থেকেই।
আপনি জানলেন কীভাবে যে আমরা এমন একটা বিপদের মধ্যে আছি।
আমরা আমাদের সোর্সের মাধ্যমে জেনেছি। ইচ্ছে করেই রিবিটের নাম বলল না শাহেদ।
আমি কি আপনাদের সোর্সের নাম জানতে পারি?
না পারেন না। আমরা কখনোই আমাদের সোর্সের নাম কাউকে বলি না।
ও আচ্ছা। একটু থেমে সুমন আবার বলল : তাহলে থানায় আপনারা কোনো খবর দেননি?
না দিইনি কিংবা থানার কোনো সাহায্য আমরা চাইনি। আপনি আর আপনার বাবা যে-ট্যাক্সিতে করে আমিনবাজার গিয়েছিলেন সেই ট্যাক্সির ড্রাইভার বুঝতে পারে আপনি বিপদে আছেন। তাই ফিরে আসার সময় সে থানাকে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা অবহিত করে এবং থানার অফিসাররা আপনাকে খুঁজতে শুরু করে। আপনি স্বীকার করতে পারেন ট্যাক্সিড্রাইভার আপনার অনেক বড় উপকার করেছে।
কিন্তু এতে তো আমার বিপদ বাড়বে।
না বাড়বে না। বরং আপনি যদি আজ পাঁচ লাখ টাকা ওদের দিয়ে দিতেন ওরা আবার আপনার কাছে টাকা চাইত। ওরা আপনাদের বাড়ি বিক্রি করিয়ে পথের ফকির বানিয়ে ছাড়ত।
কিন্তু এখন কি আমরা নিরাপদ? আমার তো মনে হচ্ছে সমস্যা আরো জটিল আকার ধারণ করেছে। বলল সুমন।
আপনার সেরকম মনে হওয়ার যুক্তিসংগত কারণ আছে। কিন্তু ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা এ-মুহূর্তে অনুমান করা সত্যি কঠিন। অনেকক্ষেত্রে দেখা গেছে এরকম বেনামী চাঁদাবাজরা ব্যর্থ হয়ে আর বিরক্ত করে না। আবার দেখা গেছে তারা আগের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে, অবশ্য যদি তারা শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরনের কেউ হয়।
কালোমানুষ কী ধরনের সন্ত্রাসী?
কালোমানুষ সম্পর্কে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। আপনাদের ঘটনা থেকেই আমরা কালোমানুষ সম্পর্কে প্রথম জেনেছি। আশা করছি অল্পদিনের মধ্যেই আমরা কালোমানুষ সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পেয়ে যাব এবং ওদেরকে ধরতে পারব।
এই অল্পদিনে আমাদের নিরাপত্তার কী হবে? অসহায়ভাবে প্রশ্ন করল সুমন।
দেখুন, ব্যক্তিনিরাপত্তার উল্লেখযোগ্য পূর্বশর্ত হচ্ছে নিজে সতর্ক থাকা। কাজেই প্রথমেই আমি আপনাকে বলব, আপনারা নিজেরা সতর্ক থাকবেন। আর আমরা তো আছিই। যখন প্রয়োজন আমাদের সংবাদ দেবেন। আপনারা যদি সংবাদ না দেন এবং আমরা যদি জানতে না পারি তাহলে আপনাদের মতো শত শত মানুষের কাছ থেকে কালো মানুষেরা টাকা নিতে থাকবে এবং আমরা কোনোদিনও ওদেরকে ধরতে পারব না। কাজেই আপনাদের নিরাপত্তা প্রদান যেমন আমাদের দায়িত্ব তেমনি আমাদের সহায়তা প্রদান করাও আপনাদের দায়িত্ব।
কিন্তু কালোমানুষ তো বলে আপনাদের জানালে ক্ষতি আরো বেশি হবে।
ওদের কাজই হবে আপনাদেরকে ভীত করে তোলা। আপনাদেরকে ওরা যত ভীত করতে পারবে ওরা তত সহজে ওদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারবে। আর আমাদেরকে যদি আপনারা জানান, অন্তত ওরা ভীত থাকবে এবং আমরা ওদেরকে ধরার সুযোগ পাব।
ধন্যবাদ শাহেদ সাহেব।
আপনি কি একটা বিষয় আমাদেরকে জানাবেন?
কী বিষয়?
আপনি কি একই লোকের সাথে বারবার কথা বলেছেন নাকি ভিন্ন কোনো লোক?
আমি জানি না। তবে কণ্ঠস্বর ভিন্ন ছিল।
টেলিফোনে কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করা কঠিন কিছু না। আপনি রিসিভারের উপর ভিন্ন। ঘনত্বের কাপড় বা আবরণ ব্যবহার করলেই কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হবে। তবে কথার ধরন পরিবর্তন করা কঠিন। আপনার কী মনে হয় কথার ধরন পরিবর্তন হয়েছে?
ঠিক বুঝলাম না।
প্রত্যেক মানুষের কথা বলার ধরণ ভিন্ন। এই যেমন ধরুন কারো কথায় আঞ্চলিকতার টান থাকে, কারো কথা সম্পূর্ণ শুদ্ধ, কেউ আবার বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলে। আপনার কাছে কি মনে হয়েছে কালোমানুষ সবসময় একইভাবে কথা বলেছে।
আমার কাছে ভাষার কোনো ভিন্নতা ধরা পড়েনি। তবে যে বা যারা কথা বলেছে তাদের কথায় আঞ্চলিকতার টান আছে। আর অবাক ব্যাপার হল প্রত্যেকেই কালো মানুষের কালো’ শব্দটা সবসময় শুদ্ধভাবেই বলে।
হুঁ। ঠিক আছে, আমরা আপনাদের বাসায় চলে এসেছি। আমার ফোন নম্বরটি রেখে দিন। প্রয়োজনে ফোন করুন।
সুমন শাহেদের ফোন নম্বর রেখে মাইক্রো থেকে নেমে গেল। মাইক্রো চলে যেতে সে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বাইরের গেটে দাঁড়িয়ে থাকল। দেখতে পেল এককোণায় একটা পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে কয়েকজন পুলিশ বসে আছে। আর বাইরে দুজন হেঁটে বেড়াচ্ছে। পুলিশ দেখে সুমন সত্যি প্রশান্তি অনুভব করল। এই প্রথম সে অনুভব করল, পুলিশ দেখে আগে কখনো সে এখনকার মতো এতটা প্রশান্তি অনুভব করেনি। সে বুঝতে পারছে, আজ রাতে তার খুব ভালো ঘুম হবে।
Leave a Reply